বাংলোর দুখানা ঘরের মধ্যে
বাংলোর দুখানা ঘরের মধ্যে কাকাবাবুর ঘরটাই বেশি বড়। এক দিকে খাট ও লেখাপড়ার জন্য টেবিল-চেয়ার, অন্য দিকে কয়েকটি সোফা পাতা রয়েছে। খাটের দু পাশে বড় দুটি বাতিদান।
কাকাবাবুর সঙ্গে সবাই চলে এল এ-ঘরে।
দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর বললেন, অন্যরা পাশের ঘরে গল্প করুক বরং, আমি আর রাজ সিং আপনার সঙ্গে আগে জরুরি কথাগুলি সেরে নিই।
কাকাবাবু বললেন, সন্তু আর জোজো থাকতে পারে। ওদের বাদ দিয়ে তো আমার কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।
তপন নিজে থেকেই বলল, স্যার, আমি এখন বাড়ি যেতে পারি? আমার একটু কাজ আছে।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে, এখন যাও। পরে তোমাকে কাজে লাগবে। তুমি মণ্টা সিং-কে বলে যাও, আমাদের কয়েক কাপ চা দিয়ে যেতে।
তপন বেরিয়ে যাওয়ার পর দেবেন্দ্র বড়ঠাকুর দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি তুলে দিলেন। তারপর সোফায় বসে বললেন, পশ্চিমবাংলার চিফ কনজারভেটর ডক্টর চক্রবর্তী আমাকে খবর পাঠিয়েছিলেন যে, আপনি আপনার ভাইপোদের নিয়ে অসমে বেড়াতে আসবেন, আমরা যেন সব ব্যবস্থা করে দিই। আমরা খুব আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার মনে একটা সন্দেহ ছিল। আপনার মতন মানুষ কি শুধু বেড়াতেই আসবেন, অন্য কোনও উদ্দেশ্য নেই?
কাকাবাবু হেসে বললেন, ওই যে আপনি বলেছিলেন, চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। আসলে আমার এখন অসমে আসবারই কথা ছিল না, যাব ঠিক করেছিলাম গোয়ায়। ওই চক্রবর্তীরাই এখানে জোর করে পাঠাল।
বড়ঠাকুর বললেন, চক্রবর্তীরাও পাঠায়নি, আপনাকে পাঠাবার নির্দেশ ছিল দিল্লি থেকে। কাল গুয়াহাটি গিয়ে সব খবর পেলাম, দিল্লি থেকে আমাদের অনেক কিছু জানানো হয়েছে।
কাকাবাবু সন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন, গণ্ডার।
জোজো বলল, আমি কাল পাঁচটা গণ্ডার দেখেছি!
সন্তু জোজোর ঊরুতে চিমটি কেটে বলল, চুপ কর না। নিশ্চয়ই শুধু দেখার কথা হচ্ছে না!
কাকাবাবু বললেন, শুধু গণ্ডার নয়। আসল হচ্ছে গণ্ডারের শিং!
জোজো বলল, গণ্ডারের আবার শিং থাকে নাকি? গোরু-মোষের শিং থাকে মাথার দুপাশে। আমি তো দেখলাম, গণ্ডারের নাকের ওপর উঁচুমতন কী যেন একটা!
কাকাবাবু বললেন, জোজো ঠিকই বলেছে। ইংরিজিতে বলে হর্ন, তাই আমরাও বলি শিং। আগে বাংলায় বলত খড়গ। কিংবা খাঁড়া। গণ্ডারের নাকের ওপর খাঁড়া থাকে।
সন্তু বলল, আমি জানি, আসলে ওটা শিং বা খাঁড়া কিছুই নয়। গণ্ডার ওটা দিয়ে কাউকে তোতেও পারে না। ওটার মধ্যে শক্ত হাড়-টাড় নেই, লোমের
মতন জিনিস জট পাকিয়ে-পাকিয়ে ওরকম দেখতে হয়ে যায়।
কাকাবাবু বললেন, হাড় নেই বটে, ওটা দিয়ে গুঁতোনো যায় না তাও ঠিক, কিন্তু ওই লোমের মতন জিনিসটাই খানিকটা শক্ত হয়ে যায়, নাকের ওপর থেকে কেটে নেওয়া যায়।
বড়ঠাকুর বললেন, ওই শিং বা খাঁড়ারই এক-একটার দাম সাত থেকে দশ লাখ টাকা। হাতির দাঁতের চেয়েও বেশি দাম!
জোজো জিজ্ঞেস করল, কেন, কেন? অত দাম কেন? হাতির দাঁত দিয়ে অনেক কিছু বানানো যায়, গণ্ডারের শিং দিয়ে কী হয়? কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, কিছুই হয় না! জোজো বলল, কিছুই হয় না, তবু অত দাম? কারা কেনে?
কাকাবাবু বললেন, বোকা লোকেরা কেনে! অবশ্য সেই বোকা লোকদের অনেক টাকা থাকা চাই! যারা হঠাৎ বড়লোক হয়, তাদের মধ্যে এ রকম বেশ কিছু বোেকা লোক থাকে। এই বোকা বড়লোকগুলো যখন বুড়ো হয়, তখন খুব ভয় পেয়ে যায়। তারা ভাবে, এত টাকাপয়সা, এত লোকজন, এসব ছেড়ে হঠাৎ একদিন মরে যেতে হবে? তখন তারা বয়স আটকাবার, গায়ের জোর বাড়াবার নানারকম ওষুধ খোঁজে। কেউ একজন এক সময় রটিয়ে দিয়েছিল যে, গণ্ডারের শিং গুঁড়ো করে, বেটে দুধের সঙ্গে খেলে যৌবন ফিরে পাওয়া যায়। যে খাবে, সে আর বুড়ো হবে না! সেই থেকে গণ্ডার মেরে-মেরে তাদের শিংগুলো গোপনে বিক্রি হয়!
সন্তু বলল, আসলে নিশ্চয়ই গণ্ডারের শিং খেলে কোনও কাজ হয় না?
কাকাবাবু বললেন, সব মানুষই একসময় বুড়ো হয়, তা আটকাবার কোনও ওষুধ এ-পর্যন্ত আবিষ্কার করা যায়নি। গণ্ডারের শিং বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে, তাতে ও রকম কোনও গুণই নেই।
সন্তু বলল, তা হলে শুধু-শুধু ওই জিনিসটা কারা কেনে অত টাকা দিয়ে?
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে কারা এখন হঠাৎ বড়লোক? আরব দেশের মরুভূমিতে পেট্রোল আবিষ্কারের পর সেখানকার অনেক লোক দারুণ ধনী হয়ে গেছে। এককালে যারা ছিল বেদুইন, তারা এখন কোটি-কোটি টাকার মালিক। অত টাকা নিয়ে কী করবে, ভেবেই পায় না! আজেবাজে ভাবে খরচ করে। দশ লাখ টাকা দিয়ে একটা গণ্ডারের শিং কেনা তাদের পক্ষে কিছুই না।
জোজো জিজ্ঞেস করল, দুধের সঙ্গে গণ্ডারের শিং বাটা, কেমন খেতে লাগে?
কাকাবাবু বললেন, আমি তো খেয়ে দেখিনি! কেউ দিলেও আমি খাব না! তবে, একবার প্লেনে কায়রো যাওয়ার সময় একজন আরব শেখের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। কথায় কথায় সে বলল, ইন্ডিয়ার গণ্ডারের শিং খুব ভাল জিনিস, একখানা খাওয়ার পরেই সে বুড়ো বয়েসে আর-একটা বিয়ে করেছে! সে বলেছিল, জিনিসটা ওরকম বিচ্ছিরি দেখতে বটে, কিন্তু বেটে দুধের সঙ্গে মেশালে বেশ স্বাদ হয়। ঝাঁঝালো স্বাদ, অনেকটা আদার মতন।
বড়ঠাকুর বললেন, দিল্লির গোয়েন্দা বিভাগ খবর পেয়েছে, এ-মাসে বোম্বাইতে চারজন আরব ব্যবসায়ী এসে পৌঁছেছে, তারা অন্তত একশোটা গণ্ডারের শিং কিনবে। সুতরাং এখন চোরাশিকারিরা প্রচুর গণ্ডার মারবে।
জোজো বলল, গোয়েন্দারা যখন টের পেয়েই গেছে, তখন ওই আরব ব্যবসায়ীদের গ্রেফতার করছে না কেন?
বড়ঠাকুর বললেন, আগে থেকে কি গ্রেফতার করা যায়? বেআইনি জিনিস তাদের কাছে পাওয়া গেলে তবে তো ধরা হবে? তার আগে নিরীহ গণ্ডারগুলো শুধু-শুধু মারা পড়বে।
কাকাবাবু বললেন, এই তেজপুরের দিকটাতেই গণ্ডারের শিঙের চোরাকারবারের বড় বাজার। এখান থেকেই গণ্ডারের শিং বোম্বাইয়ের দিকে যায়। সেইজন্যই আমাকে তেজপুরে পাঠানো হয়েছে। কেউ যাতে কিছু বুঝতে না পারে, সেইজন্য আমি বেড়াবার ছুতো করে এসেছি।
বড়ঠাকুর বললেন, আপনি কি কিছু পরিকল্পনা করেছেন? সেইমতো আমাদের সব ব্যবস্থা নিতে হবে। দেরি করলে চলবে না। পাঁচ-ছ বছর আগে এখানে দারুণ বন্যা হয়েছিল, তখন প্রায় আশি-নব্বইটা গণ্ডার মারা যায়। এবারেও যদি শখানেক গণ্ডার ধ্বংস হয়, তা হলে ওদের সংখ্যা খুবই কমে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, পরিকল্পনা একটা করেছি বটে!
জোজো বাধা দিয়ে বলল, কাকাবাবু, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? কিছু মনে করবেন না?
কাকাবাবু বললেন, না, না, বলে ফেলো, বলে ফেলো। পেটের মধ্যে কথা আটকে রাখতে নেই!
জোজো বলল, চোরাশিকারিরা গণ্ডার মারে। পুলিশ কিংবা মিলিটারি দিয়েই তো তাদের ধরা উচিত। দিল্লি থেকে আপনাকে পাঠাল কেন? আপনি, মানে, আপনি জঙ্গলের মধ্যে দৌড়তে পারবেন না, তাড়াতাড়ি গাছে চাপতে পারবেন না, অনেকে মিলে আক্রমণ করলে আপনি একাই বা কী করবেন?
কাকাবাবু মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, তা ঠিক, তা ঠিক। আমি খোঁড়া লোক, আমার অনেক অসুবিধে। দিল্লির কর্তারা আমার ওপর বেশি-বেশি বিশ্বাস করে। হয়তো আমি কিছুই পারব না।
বড়ঠাকুর এবার কাকাবাবুকে মিস্টার রায়চৌধুরী না বলে কাকাবাবু বলেই সম্বােধন করে বললেন, আমি বলছি কারণটা। শোনো জোজো, পুলিশ কিংবা মিলিটারি দিয়েও এই চোরাশিকারিদের দমন করা যায় না। এত বড় জঙ্গল, রাতের অন্ধকারে কোথায় ওরা লুকিয়ে থাকে, কখন চট করে একটা গণ্ডার মেরে পালায়, তা ধরা শক্ত। তা ছাড়া, পুলিশ বা বনবিভাগ থেকে অভিযান চালাবার আগেই কী করে যেন ওরা খবর পেয়ে যায়।
কাকাবাবু বললেন, পুলিশ আর বনবিভাগে যে ওদের নিজস্ব লোক থাকে, সেটা স্বীকার করুন না। অনেক টাকার কারবার, তাই ওরা টাকা দিয়ে অনেককে হাত করে রাখে। সেইজন্যই ওদের ধরা যায় না।
বড়ঠাকুর বললেন, কে যে ওদের খবর দেয়, তাও বোঝা যায় না। সুতরাং ওদের দমন করতে হবে বুদ্ধি দিয়ে। কাকাবাবু একবার আফ্রিকার কেনিয়াতে একটা বিরাট বন্যজন্তু-চোরাশিকারির দলকে শায়েস্তা করেছিলেন, দিল্লির গগায়েন্দারা সে-খবর জানে। সেইজন্যই তারা কাকাবাবুর ওপর ভরসা করেছে।
কাকাবাবু বললেন, সেবারে কেনিয়ায় ওই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলুম পাকেচক্রে। সন্তু, তোর মনে আছে?
সন্তু বলল, হ্যাঁ, সেবারে আমরা সেরিংগেটি ফরেস্টের মধ্যে একটা তাঁবুর হোটেলে ছিলাম।
কাকাবাবু বললেন, এবারেও যে আমি কিছু করতে পারব, তার ঠিক নেই। তবু চেষ্টা তো করতে হবে। আচ্ছা, হিম্মত রাও লোকটা কীরকম? ওর সঙ্গে চোরাশিকারিদের যোগ আছে?
বড়ঠাকুর বললেন, থাকতেও পারে। ওর অনেক টাকা, অনেক লোকবল। কিন্তু ওকে ধরা-ছোঁয়া যায় না। একবার ওর বাড়ি সার্চ করেও কিছু পাওয়া যায়নি।
কাকাবাবু বললেন, অতখানি ছড়ানো বাড়ি, দেখেই বুঝেছি, ওখান থেকে কিছু খুঁজে বের করা শক্ত। ওর ওপর নজর রাখতে হবে। আর ওই কুমার টিকেন্দ্রজিৎ, সে আসলে কী করে?
বড়ঠাকুর বললেন, টিকেন্দ্রজিৎকে দেখেছেন? রহস্যময় মানুষ। ও যে কী। করে, তা বলা শক্ত। ঘোড়া ছুটিয়ে বেড়ায়। কখনও এখানে, কখনও মণিপুরে, কখনও অরুণাচলে চলে যায়। আপনি তো জানেন, তিনটে আলাদা রাজ্য, পুলিশ আলাদা, বনবিভাগ আলাদা। ওর পেছনে তাড়া করলেই ও অন্য রাজ্যে ঢুকে যায়, আমরা সেখানে যেতে পারি না। মণিপুরে ওর একটা বাড়ি আছে, সেখানকার পুলিশ জানিয়েছে যে, টিকেন্দ্রজিতের নামে কোনও অভিযোগ নেই। একবার টিকেন্দ্রজিৎ এখানে হরিণ মারতে গিয়ে ধরা পড়েছিল, আদালতে জরিমানা দিয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা, ও অন্য বড় জানোয়ারও মারে। শুনেছি, ওর হাতের টিপ সাঙ্ঘাতিক।
কাকাবাবু বললেন, লোকটি ইন্টারেস্টিং। বারবার দেখা দিচ্ছে কিন্তু আলাপ করছে না। ওর সঙ্গে একবার কথা বলার ইচ্ছে আছে। এবার আমার পরিকল্পনাটা শুনবেন?
বড়ঠাকুর ব্যগ্রভাবে বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, বলুন, বলুন।
কাকাবাবু বললেন, কাল থেকে আগামী সাতদিন আপনারা পুলিশের সাহায্য নিন। আপনাদের ফরেস্ট গার্ড ও পুলিশ মিলে সমস্ত জঙ্গলটা চষে ফেলুক, রাত্তিরবেলাও টহল দিক। টানা সাত দিন, ব্যস, তারপর আর কিছু দরকার নেই।
বড়ঠাকুর হতাশভাবে বললেন, ব্যস, শুধু এই? এতে কিছু কাজ হবে মনে করেন?
তিনি রাজ সিংয়ের দিকে তাকালেন। রাজ সিং এতক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন। এবার দৃঢ়ভাবে বললেন, আমার মনে হয়, এতে কিছুই কাজ হবে না। একজনও চোরাশিকারি ধরা পড়বে না।
কাকাবাবু একগাল হেসে বললেন, আমিও তো জানি, এতে কিছু কাজ হবে। এটা ওদের চোখে ধূলো দেওয়া। এই সাত দিন শিকার তো অন্তত বন্ধ থাকবে! চোরাশিকারিরা জানে, পুলিশ-ফরেস্ট গার্ডরা যদি একটানা সাতদিন ধরে এত উৎসাহ নিয়ে বন পাহারা দেয়, তা হলে সাতদিন পরে তাদের উৎসাহ হঠাৎ আবার থেমে যাবে। তখন জঙ্গল একেবারে নিরিবিলি। তখন চোরাশিকারিরা কাজে নেমে পড়বে, সেই অবস্থায় তাদের ধরতে হবে।
রাজ সিং বললেন, কে ধরবে?
কাকাবাবু বললেন, আমরা কয়েকজন যাব শুধু।
বড়ঠাকুর জিজ্ঞেস করলেন, কী করে বোঝা যাবে, তারা কোথায় অপারেট করছে?
কাকাবাবু বললেন, বোঝার উপায় আছে। এই সাতদিনের মধ্যে আপনাদের আর-একটা কাজও করতে হবে। এই দেখুন!
কোটের পকেট থেকে কাকাবাবু ফস করে একটা ম্যাপ বার করলেন। সেটা কোলের ওপর বিছিয়ে ধরে বললেন, কাজিরাঙা ফরেস্টের এই ম্যাপটা দেখে-দেখে আমার প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে। কোর এরিয়ার মধ্যে, যেখানে গণ্ডারের সংখ্যা বেশি, সেখানে মোট পাঁচটি জলাশয় বা ঝিল আছে। একটা খুব বড় ঝিল, আর চারটি ছোট। এই যে সাতদিন আপনারা জঙ্গলে পাহারা দেবেন, তার মধ্যে গোপনে আর-একটা কাজ করতে হবে। এই চারটে ছোট ঝিল থেকে পাম্প করে সব জল তুলে নিতে হবে। একেবারে শুকনো করে ফেলবেন, কাদা কাদা অবস্থাটা গণ্ডাররা ভালবাসে। সেইজন্য একেবারে শুকনো খটখটে করে ফেলা চাই। তা হলে একটা ঝিলে শুধু জল থাকবে, জন্তু-জানোয়ারেরা সেখানেই যাবে, চোরাশিকারিরাও সেখানে গিয়ে জমায়েত হবে। তখন শুরু হবে আমাদের কাজ।
বড়ঠাকুর বললেন, তবু যেন এর মধ্যে একটা আন্দাজের ব্যাপার থেকে যাচ্ছে। চোরাশিকারিরা ঠিক কবে, কখন জমায়েত হবে, তা আমরা জানব কী করে?
কাকাবাবু বললেন, খানিকটা আন্দাজের ব্যাপার তো থাকবেই। এ তো অঙ্ক নয়। তবে, আন্দাজটাও যুক্তিহীন নয়। গণ্ডার শিকার কখন হয় নিশ্চয়ই জানেন। জ্যোৎস্না রাতে। কেন জানেন? আপনারা হয়তো জানেন, সন্তুদের বুঝিয়ে দিচ্ছি। গণ্ডার শিকার করা তত সহজ ব্যাপার নয়। অত শক্ত, পুরু চামড়া একেবারে লোহার বর্মের মতন, এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে গণ্ডার মারা যায় না। আহত গণ্ডার অতি সাঙ্ঘাতিক প্রাণী, সারা বন একেবারে তছনছ করে দেবে। সেইজন্য ভাল করে দেখেশুনে টিপ করে গুলি চালাতে হয়। অন্ধকার রাতে তা সম্ভব নয়। গণ্ডারের শরীরের দুটি মাত্র জায়গা নরম। এক, তার খাঁড়ার ঠিক নীচে, নাকের কাছটায়। আর পেছন দিকে যখন ল্যাজ তোলে, সেখানে গুলি চালালে সঙ্গে-সঙ্গে গণ্ডার মরে যায়। সামনাসামনি এসে নাকের কাছে গুলি চালাবার সাহস কজনের আছে? তাই চোরাশিকারিরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে, কখন গণ্ডার একবার লেজটা তুলবে।
বড়ঠাকুর বললেন, হ্যাঁ, জোৎস্না রাতের ব্যাপারটা ঠিকই বলেছেন।
কাকাবাবু বললেন, আর ঠিক নদিন পরেই পূর্ণিমা। সাত দিনের মধ্যে বনের মধ্যে পুলিশ আর গার্ডদের তাণ্ডব চলার পর থেমে গেলে, তারপর ওই জ্যোৎস্না রাতে চোরাশিকারিরা কাজে নেমে পড়বে, এরকম ধরে নেওয়া যায় না? এক দিন নাহয়, দু দিন, তিন দিন আমাদের সেখানে গিয়ে বসে থাকতে হবে। মাচা বেঁধে রাখতে হবে গাছের ওপর।
বড়ঠাকুর বললেন, ঠিক আছে। আপনার কথামতন সব ব্যবস্থা হবে। আমি আর রাজ সিং রোজ সন্ধেবেলা এসে আপনাকে রিপোর্ট দিয়ে যাব।
কাকাবাবু বললেন, না, না, না, না, আমার সঙ্গে এর মধ্যে আর দেখাই হবে। বেড়াতে এসে কেউ তেজপুরের মতন শহরে সাতদিন বসে থাকে? তা হলেই লোকে সন্দেহ করবে। আমরা তিনজন কাল বিকেলেই এখান থেকে চলে যাব শিলচর। অন্য জায়গায় বেড়াব। ফোনে যোগাযোগ রাখব আপনার সঙ্গে। আর পূর্ণিমার দিন দিনের বেলাই চলে যাব সরাসরি জঙ্গলে।
আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর উঠে পড়লেন বড়ঠাকুর আর রাজ সিং। কাকাবাবুদের খাবারের দেরি হয়ে গেছে অনেক। মণ্টা সিং খবর নিয়ে গেছে দু বার।
ওঁদের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে কাকাবাবু বললেন, দেখবেন, সব ব্যাপারটা যেন গোপন থাকে। আপনি নিজে জঙ্গলে গিয়ে রাত জাগতে রাজি আছেন তো?
বড়ঠাকুর বললেন, নিশ্চয়ই। রাজ সিংও থাকবেন।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তপন রায় বর্মণ আর শচীন সইকিয়া, এদের বিশ্বাস করা যায়?
বড়ঠাকুর বললেন, এরা খুবই বিশ্বাসযোগ্য অফিসার। শচীন রাইফেল শুটিং খুব ভাল জানে। তপনও খুব কাজের লোক।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে। আর কাউকে কিছু জানাবার দরকার নেই। আপনারা এই চার জন আমার সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। মোট পাঁচ জন।
সন্তু বলল, বাঃ, আমরা থাকব না? আমি আর জোজো? আমরা তো থাকবই।
জোজো বলল, তা হলে হল সাত জন। সপ্তরথী, কী বল সন্তু?
বড়ঠাকুর ওদের দু জনের কাঁধ চাপড়ে দিলেন।
সন্তুর মুখোনা উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। কাকাবাবু আগে তাকেও কিছু বলেননি। শুধু এমনি বেড়ানোও ভাল, বেশ ভালই লেগেছে এই ক দিন। তবে এখন বেড়ানোর সঙ্গে একটা অ্যাডভেঞ্চার যুক্ত হল বলে তার আরও ভাল লাগছে।