বিকেলের দিকে বাতাস
বিকেলের দিকে বাতাস এমন ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে, বাগানে আর বসা যায় না। ডাকবাংলোর তিন দিকে রয়েছে চওড়া ঢাকা বারান্দা। সেখানে চাদরমুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে চেয়ারে বসেছে সন্তু আর জোজো। কাকাবাবু ওভারকোট পরে নিয়েছেন। একবার চা, একবার কফি পান করা হয়ে গেছে। জোজো গল্প বলে যাচ্ছে অনবরত।
একসময় জোজো সন্তুকে জিজ্ঞেস করল, তুই কখনও কোনও পাখির পিঠে চেপেছিস?
সন্তু বলল, পাখির পিঠে? না তো! অতবড় কোনও পাখি আছে নাকি?
জোজো বলল, কেন! উটপাখি! আমি সেই পাখিতে চেপে গেছি অনেকটা দূর!
সন্তু বলল, উটপাখি? অস্ট্রিচকে বাংলায় বলে উটপাখি। কিন্তু উটপাখি তো ভাই পাখি নয়। চিংড়িমাছ যেমন মাছ নয়, বনমানুষ মানুষ নয়, ঘোড়ার ডিম ডিম নয়, ড়ুমুরের ফুল ফুল নয়…
কাকাবাবু একটু বই পড়ছিলেন, বই সরিয়ে হাসিমুখে তাকালেন। জোজো সঙ্গে এলে সময়টা বেশ ভালই কাটে।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, জোজো, তুমি উটপাখির পিঠে কোথায় চেপেছিলে?
জোজো অম্লান বদনে বলল, বাবার সঙ্গে যখন সাউথ আমেরিকায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, কী যেন দেশটার নাম, উরুগুয়ে বোধ হয়, সেখানে…
সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে বাধা দিয়ে বলল, ধ্যাত! অস্ট্রিচ শুধু আফ্রিকা ছাড়া আর কোথাও পাওয়াই যায় না!
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইলেন জোজোর দিকে। তারপর বললেন, জোজোর কথাটা অত সহজে উড়িয়ে দিতে পারবি না রে সন্তু। দক্ষিণ আমেরিকাতেও উটপাখির মতনই প্রায় একটা প্রাণী আছে, তার নাম রিয়া। উড়তে পারে না বটে, কিন্তু দারুণ জোরে ছোটে। আর্জেন্টিনায় আমি দেখেছি। পিঠে আর পেছন দিকে অনেক বড় বড় পালক থাকে, আর ডিম পাড়ে বলে ওদের পাখি বলেই ধরা হয়।
জোজো বলল, ডিম পাড়লে পাখি হবে না কেন? উটপাখিও ডিম পাড়ে। সেইজন্যই ওরাও পাখি।
সন্তু বলল, ডিম পাড়লেই বুঝি পাখি হয়? কচ্ছপও তো ডিম পাড়ে, তা হলে কচ্ছপও পাখি? পাখি মানে খেচর, যারা আকাশে ওড়ে।
কাকাবাবু বললেন, ওই রিয়াগুলোর একটা বৈশিষ্ট্য আছে, যা আর কোনও পাখি বা প্রাণীর নেই। মেয়ে রিয়াগুলো ডিম পাড়ে, ডিম পেড়েই তারা চলে যায়, আর কোনও খবরই রাখে না। পুরুষ রিয়াগুলো সেই ডিম পাহারা দেয়, তা দিয়ে ফোটায়, বাচ্চাদের বড় করে তোলে। বাবা হিসেবে এমন দায়িত্ববান আর দেখা যায় না।
জোজো বলল, আমি ওই পুরুষ রিয়ার পিঠেই চেপেছি।
সন্তু বলল, ঠিক করে বল তো, তুই সত্যি-সত্যি চেপেছিস, না কোনও ছবিতে দেখেছিস?
কাকাবাবু ওদের তর্ক থামিয়ে দিয়ে বললেন, আচ্ছা, ঘোড়ার ডিম কথাটা লোকে কেন বলে? গরুর ডিম, মোষের ডিম তো বলে না?
জোজো বলল, এককালে পক্ষিরাজ ঘোড়া ছিল, তাদের ডানা ছিল, আকাশে উড়ত। ওই যে সন্তু খেচর না মেচর কী বলল, তাই-ই ছিল। সেই পক্ষিরাজ ঘোড়া নিশ্চয়ই ডিম পাড়ত!
সন্তু বলল, কোনও এক জন্মে জোজো রাজপুত্র ছিল, তখন ও পক্ষিরাজ ঘোড়ার পিঠেও চেপেছে।
জোজো বলল, হতেও পারে। আমি মাঝে-মাঝে স্বপ্নে আমার আগের জন্মগুলো দেখতে পাই। ঠিক আগের জন্মে আমি ছিলাম আর্মির একজন কর্নেল।
কাকাবাবু বললেন, ওই দ্যাখো, ওই ঘোড়াটা বোধ হয় কোনও এক জন্মে পক্ষিরাজ ছিল!
ওরা দু জনেই চমকে মুখ ফেরাল।
সত্যি-সত্যি ঘোড়ায় চড়ে একজন লোক ঢুকছে বাগানে। ঘোড়াটার রং কুচকুচে কালো, দেখলেই মনে হয় খুব তেজি। কাছে এসে ঘোড়াটা থেকে নামল তার আরোহী, এত শীতেও সে শুধু একটা নীল রঙের শার্ট আর জিন্স পরা। মাথায় একটা কাপড়ের টুপি। লোকটির চেহারা চোখে পড়বার মতন। গায়ের রং কালো, ছিপছিপে লম্বা, শরীরে একটুও মেদ নেই, খুব ভাল খেলোয়াড়দের মতন। ওর চোখের দৃষ্টি অন্তর্ভেদী।
লোকটি দু হাত তুলে কাকাবাবুকে বলল, নমস্কার। আপনিই তো মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী? আপনাদের আমি নিয়ে যেতে এসেছি।
কাকাবাবু অবাক হয়ে বললেন, কোথায়?
লোকটি বলল, আপনাদের চায়ের নেমন্তন্ন আছে। হিম্মত রাও আপনাদের আজ নেমন্তন্ন করেছেন।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, তিনি নেমন্তন্ন করেছেন বটে, কিন্তু আমরা আজই যাব তো বলিনি। আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে।
লোকটি বলল, হিম্মত রাওয়ের ধারণা, আপনারা আজই যাবেন, তিনি চা-টা টেবিলে সাজিয়ে বসে আছেন।
কাকাবাবু বললেন, দুঃখিত। ওই যে বললাম, আমাদের চা খাওয়া হয়ে গেছে। আজ আর বেরোতে ইচ্ছে করছে না।
লোকটি বলল, ও! আপনারা যাবেন না! ঠিক আছে। নমস্কার।
আর একটিও কথা বাড়াল সে। খুব সাবলীলভাবে ঘোড়ায় উঠে পড়ল। তারপর সোজাসুজি গেটের দিকে না গিয়ে বাগানের মধ্যে ছোটাতে লাগল ঘোড়াটাকে। ক্রমশই গতিবেগ বাড়াচ্ছে। ঘোড়ার পায়ের চাপে তছনছ। হয়ে যাচ্ছে অনেক ফুল গাছ। তারপর একসময় প্রচণ্ড জোরে লাফ দিল ঘোড়াটা, বাগানের পাঁচিল পেরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।
কাকাবাবু বললেন, বাপ রে, লোকটা দারুণ ঘোড়া চালায় তো!
সন্তু বলল, হিম্মত রাওয়ের সঙ্গীরা সবাই কি অভদ্র? লোকটা নিজের নামও বলল না!
জোজো বলল, অভদ্র ব্যবহার তো কিছু করেনি। জোরাজুরিও করেনি। আমরা যাব না শুনেই চলে গেল।
সন্তু বলল, কাকাবাবুর সামনে শুধু-শুধু বাগানের মধ্যে ঘোড়া চালাবার কেরানি দেখাবার কী মানে হয়? কতগুলো ফুলগাছ নষ্ট করে দিল। যারা গাছ নষ্ট করে, তাদের আমি কিছুতেই ভাল লোক মনে করি না।
কাকাবাবু বললেন, যাই বলিস, এমন চমৎকার স্বাস্থ্যবান লোক আজকাল দেখাই যায় না। কী সুন্দরভাবে ঘোড়াটায় চাপল!
একটু বাদেই নিজে জিপ চালিয়ে চলে এল তপন রায় বর্মণ। মুখে-চোখে অস্থির ভাব।
সে বলল, কাকাবাবু, আপনারা হিম্মত রাওয়ের বাড়ি চা খেতে গেলেন না? আপনাদের জন্য তো স্টেশান ওয়াগনটা রয়েছেই, ওতে চলে গেলে পারতেন!
কাকাবাবু বললেন, একজন ডাকতে এসেছিল, আমরা যাব না বলে দিয়েছি।
তপন বলল, কিন্তু হিম্মত রাও যে রেডি হয়ে বসে আছে আপনাদের জন্য। না গেলে খুব অসন্তুষ্ট হবে। চলুন, চলুন!
কাকাবাবু বললেন, কী মুশকিল, ইচ্ছে না করলেও যেতে হবে নাকি! জোর-জবরদস্তি করে নেমন্তন্ন?
তপন শুকনো মুখে বলল, হিম্মত রাও আমার কাছে খবর পাঠাল, আপনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। সব দোষটা আমার ঘাড়ে পড়বে। তারপর যদি আমার পেছনে লাগে!
কাকাবাবু সন্তু আর জোজোর মুখের দিকে তাকালেন। ওরা দুজনেই মাথা নাড়ল। চাদর জড়িয়ে আরাম করে বসেছে, এখন আর ওদের যাওয়ার ইচ্ছে নেই একটুও।
কাকাবাবু তপনকে বললেন, বোসো, বোসো, একটু বোসো। আমাদের যে ডাকতে এসেছিল, সে কে বলো তো?
তপন একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, কে এসেছিল? কী রকম চেহারা?
কাকাবাবু বললেন, ঘোড়ায় চেপে এসেছিল, কালো, লম্বা, খুব চমৎকার স্বাস্থ্য, বয়স হবে পঁয়তিরিশ-ছত্রিশ।
তপন বলল, ও বুঝেছি। টিকেন্দ্রজিৎ! সে নিজে এসেছিল?
কাকাবাবু বললেন, টিকেন্দ্রজিৎ কে? হিম্মত রাওয়ের কর্মচারী?
তপন বলল, না, না, কর্মচারী নয়, বন্ধু বলতে পারেন। টিকেন্দ্রজিৎ তো এখানে থাকে না। মাঝে-মাঝে আসে। তখন হিম্মত রাওয়ের বাড়িতে ওঠে। তাই তো অবাক হচ্ছি, সাধারণ একজন কর্মচারীর মতন টিকেন্দ্রজিৎ নিজে ডাকতে এসেছিল আপনাদের?
কাকাবাবু বললেন, সে যে সাধারণ নয়, তা সে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। এখানে থাকে না তো কোথায় থাকে?
তপন বলল, তা ঠিক জানি না। লোকটা দুর্ধর্ষ শিকারি ছিল শুনেছি। বন্দুক চালায়, তলোয়ার খেলতে জানে, অনেক রকম খেলাধুলো জানে। ওর পুরো নাম রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ। মনে হয়, মণিপুরের লোক। রাজকুমার মানে সত্যি-সত্যি রাজপুত্র নয়, মণিপুরিরা অনেকেই রাজকুমার লেখে নামের আগে।
সন্তু বলল, মণিপুরিরা কালো হয়?
তপন বলল, না, বেশির ভাগই ফরসা, তবে দু-চার জন কালোও হয়। এই টিকেন্দ্রজিৎ ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেই ভালবাসে। বোধ হয় ওর মা ছিল বাঙালি।
সন্তু বলল, আমি লক্ষ করেছি, হিম্মত রাওয়ের মতন ওর গলাতেও একটা সোনার চেন আছে। তবে তাতে হনুমানের বদলে একটা বাঘের মুখের ছবি।
তপন বলল, মনে হয়, ও আপনাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছিল।
কাকাবাবু বললেন, তা হলে একবার ঘুরেই আসা যাক। কী রে, তোরা যাবি নাকি?
সন্তু প্রতিবাদের সুরে বলল, হিম্মত রাও ডেকে পাঠালেই আমাদের যেতে হবে?
কাকাবাবু বললেন, ওই টিকেন্দ্রজিতের সঙ্গে আমার আলাপ করতে ইচ্ছে করছে। লোকটা ইন্টারেস্টিং। তোরা বরং তা হলে থাক।
তপন বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওদের জামাকাপড় পরতে আবার সময় লাগবে। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে। আপনিই চলুন!
কাকাবাবু তপনের জিপে গিয়ে উঠলেন।
হিম্মত রাওয়ের বাড়িটা দেখবার মতন কিছু নয়। বড় বাড়িও নয়, একটা কম্পাউন্ডের মধ্যে অনেক ছোট-ছোট বাড়ি ছড়ানো। এরই মধ্যে রয়েছে কাঠের গোলা, ধানের গোলা, গোয়ালঘর, তিনখানা গাড়ির গ্যারাজ, এক-উঠোন কাঁচালঙ্কা ও বেগুন গাছ। বড়বড় দুটো কুকুর ঘুরছে।
গাড়ি থেকে নামতেই একজন লোক ওদের নিয়ে গেল ভেতরের দিকের একটা বাড়িতে। পুরনো আমলের মোটা-মোটা সোফা দিয়ে সাজানো একটা বসবার ঘর। একপাশে একটা গোল শ্বেতপাথরের টেবিল। তার ওপর নানারকম বাসনপত্রে অনেক খাবার সাজানো। একটা সিংহাসনের মতন বিশাল চেয়ারে বসে আছে মানুষপাহাড় হিম্মত রাও। থুতনিতে এক হাত দিয়ে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
কাকাবাবুর দিকে সে মনোেযোগই দিল না, নমস্কারও করল না, তপনকে বলল, আমি এখনও চা খাইনি। তোমরা না এলে আমি চা খেতামই না। রাত্রেও কোনও খানা খেতাম না।
কাকাবাবুর মজা লাগল। এত বড় চেহারার মানুষটা ঠিক যেন বাচ্চা ছেলের মতন অভিমান করে আছে।
তিনি ভদ্রতা করে বললেন, আমাদের মাফ করবেন, হিম্মত রাও সাহেব। আজই যে আপনার এখানে আসতে হবে, তা আমি বুঝতে পারিনি। ছি ছি ছি, আপনার চা খেতে দেরি হয়ে গেল!
হিম্মত রাও এবারও কাকাবাবুর কথা গ্রাহ্য না করে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, রামলখন, ঝগরু!
সঙ্গে-সঙ্গে দুজন লোক হাজির হল দুদিক দিয়ে।
হিম্মত রাও তাদের দিকে চোখ পাকিয়ে বলল, বাতি জ্বালিসনি কেন ঘরের? চায়ের পট নিয়ে আয়।
এর পর সে উঠে দাঁড়িয়ে কাকাবাবুর কাঁধে একটা নতুন সুদৃশ্য গামছা পরিয়ে দিল। একটা প্লেটে করে এগিয়ে দিল কয়েকটি গুয়া বা কাঁচা সুপুরি। অসমের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়িতে অতিথিদের যে গামছা ও সুপুরি দিয়ে বরণ করা হয়, তা জানেন কাকাবাবু। তিনি একটা সুপুরি মুখে দিলেন, কামড়ালেন না বা চুষলেন না। অভ্যেস না থাকলে কাঁচা সুপুরি খেলে মাথা ঘোরে।
এবার হিম্মত রাও নম্র গলায় বললেন, দয়া করে বসুন। গরিবের বাড়িতে সামান্য কিছু গ্রহণ করুন।
তারপরই তপনের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বললেন, আর পাঁচ মিনিট দেরি হলে সব কিছু ছুঁড়ে ফেলে দিতাম!
কাকাবাবু বললেন, ওকে বকছেন কেন? বললাম তো, দোষ আমারই!
হিম্মত রাও বলল, না, না, আপনার দোষ হবে কেন? আপনি বিখ্যাত লোক, আপনার সব কথা মনে না থাকতে পারে। কিন্তু এই অতি চালাক বাঙালিটা কেন আপনাকে ঠিক সময় মনে করিয়ে দেয়নি? আপনার সঙ্গের ছেলেদুটো কোথায়?
কাকাবাবু বললেন, তারা আর আসতে চাইল না। বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে তো!
হিম্মত রাও বলল, তা হলে এত খাবার খাবে কে? সব টিফিন কেরিয়ারে ভরে দেব। ডাকবাংলোয় নিয়ে যাবেন! ওদের খেতে হবে।
কাকাবাবু একটা চেয়ার টেনে বসে টেবিল থেকে একটা বরফি তুলে নিয়ে মুখে দিলেন। মাথা নাড়তে-নাড়তে বললেন, বাঃ, ভারী ভাল স্বাদ। আপনার বন্ধুটি কোথায়!
হিম্মত রাও বলল, কোন বন্ধু!
কাকাবাবু বললেন, রাজকুমার টিকেন্দ্রজিৎ সিংহ, যিনি আমাদের ডাকতে গিয়েছিলেন?
হিম্মত রাও বলল, টিকেন্দ্রজিৎ? সে চলে গেছে। সে কখন আসে, কখন যায়, কোনও ঠিক নেই। ঝড়ের মতন আসে, যায়। টিকেন্দ্রজিৎ আর তার ঘোড়া, বেশিক্ষণ এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারে না।
উনি কোথায় থাকেন?
তা জানার কী দরকার আপনার?
ও, না, না, কোনও দরকার নেই। এমনিই জিজ্ঞেস করছিলাম।
মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনি তেজপুরে বেড়াতে এসেছেন?
হ্যাঁ। তাতে আপনার আপত্তি আছে?
আপত্তি থাকবে কেন? কাজিরাঙ্গা জঙ্গল দেখতে গেলে সবাই গুয়াহাটি থেকে সোজা জঙ্গলেই চলে যায়, সেখানে ভাল থাকার জায়গা আছে। তেজপুরে সাধারণত কেউ থাকে না।
এরকম ছোট-ছোট শহর দেখতে আমার ভাল লাগে।
বেশ, আপনি আমাদের অতিথি। আমি গাড়ির ব্যবস্থা করব, যেখানে ইচ্ছে ঘুরে আসবেন, সঙ্গে খাবারদাবার থাকবে।
ধন্যবাদ, হিম্মত রাও সাহেব। কিন্তু সে সবের কোনও দরকার হবে না।
কেন?
কারণ, আমি আপনার অতিথি নই। বনবিভাগের অতিথি। ওঁরাই সব ব্যবস্থা করবেন। তাই না তপন?
তপন রায় বর্মণ মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। মিস্টার বড়ঠাকুর সব ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।
চা এসে গেছে। কাকাবাবু এক চুমুক দিয়ে বললেন, বাঃ, তেজপুরে এসে এই প্রথম ভাল চা খেলাম। জানেন তো, আমরা বাঙালিরা দার্জিলিং চা খাই। অসমের চায়ের স্বাদ অন্য রকম।
হিম্মত সিং অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, দার্জিলিংয়ের চা আবার চা নাকি? শুধু গন্ধ! লিকার হয় না। আমাদের অসমের চা-ই বেশি ভাল। শুনুন মিস্টার রায়চৌধুরী, সরকারি গাড়ি আপনাকে শুধু বাঁধাধরা জায়গায় নিয়ে যাবে। যেখানে সবাই যায়। আমার গাড়ি আপনাকে অনেক ভেতরে নিয়ে যেতে পারে, ইচ্ছে করলে আপনি হরিণ-টরিন শিকারও করতে পারবেন।
কাকাবাবু বললেন, আপনাকে আবার ধন্যবাদ। আমি শিকার করি না। নিরীহ জন্তুদের গুলি করে মেরে আমি কোনও আনন্দ পাই না।
হিম্মত রাও হা-হা করে হেসে উঠে বলল, এই আপনাদের একটা নতুন বাতিক হয়েছে। শিকার বন্ধ। কেন বন্ধ? জন্তু-জানোয়াররা মানুষকে কামড়ায় না? মানুষ মারে না?
কাকাবাবু বললেন, আপনাকে যদি একটা বাঘ তেড়ে আসে, আপনি নিশ্চয়ই সেটাকে মারতে পারেন। আপনার বাড়িতে যদি হঠাৎ একপাল হাতি চলে আসে, আপনি গুলি চালাবেন অবশ্যই। কিন্তু জঙ্গলের মধ্যে যেসব বাঘ আর হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কারও কোনও ক্ষতি করছে না, লুকিয়ে লুকিয়ে তাদের মারার মধ্যে কোনও বীরত্ব নেই। পৃথিবী থেকে তা হলে একদিন সব বাঘ আর হাতি-টাতি শেষ হয়ে যাবে!
হিম্মত রাও আবার হেসে বলল, বাঘ আর হাতি! হা-হা-হা, বাঘ আর হাতি! অসমে বাঘ আর হাতি অনেক আছে, শেষ হবে না। আপনি এখানে কতদিন থাকবেন?
কাকাবাবু বললেন, দু-তিন দিন। আচ্ছা, তা হলে এবার উঠি হিম্মতবাবু? আপনার সঙ্গে আলাপ করে খুশি হলাম।
কাকাবাবু উঠে দাঁড়াতেই হিম্মত রাও কাছে এসে তার গদার মতন একখানা হাতে কাকাবাবুর কাঁধে একটা চাপড় মেরে বলল, ভাল করে সব ঘুরে দেখুন। আপনি আজ সন্ধেবেলা না এলে খুব দুঃখ পেতাম।
তারপর তপনের পিঠে একটা গুঁতো মেরে বলল, এই তপনবাবু, সাহেবের ভাল করে যত্ন নেবে। আমাদের তেজপুরের অতিথি!
হিম্মত সিং দাঁড়িয়ে রইল দরজার কাছে। কাকাবাবুরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন নীচে। গাড়ির কাছে এসে কাকাবাবু কাঁধে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ওফ, শুধু হাতখানা রেখেছে, তাতেই যেন আমার কাঁধ ভেঙে যাচ্ছিল।
তপন ককিয়ে উঠে বলল, আর আমার পিঠে…আমি সোজা হয়ে দাঁড়াতেই পারছি না।
কাকাবাবু বললেন, ওর গায়ে কতটা জোর, তা বুঝিয়ে দিল।
একজন তোক সত্যি সত্যি দুটি টিফিন কেরিয়ারে ভর্তি করে খাবারগুলো নিয়ে আসছে গাড়িটার দিকে।
কাকাবাবু মাথা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে বাড়িটা দেখতে লাগলেন। হিম্মত সিংয়ের যে অনেক টাকা আছে, তা বোঝা যায়। কিন্তু রুচি নেই। সবই কেমন যেন এলোমেলো। এখানে কোনও কিছু লুকিয়ে রাখাও সহজ। পুলিশ এবাড়ি সার্চ করতে এলেও সহজে কিছু খুঁজে পাবে না।
কাকাবাবু আফসোস করে বললেন, টিকেন্দ্রজিতের সঙ্গে দেখা হল না!
ঠিক সেই সময় ঘোড়ার পায়ের খটাখট আওয়াজ হল। প্রচণ্ড জোরে রাস্তা থেকে ঘোড়া চালিয়ে উঠোনে ঢুকে এল টিকেন্দ্রজিৎ। ঠিক যেন ঝড়ের মতন। শেষ মুহূর্তে সে ঘোড়ার রাশ টেনে থামাল, ঘোড়াটা সামনের দু পা তুলে চি হি হি হি করে ডেকে উঠল। এক লাফ দিয়ে নামল টিকেন্দ্রজিৎ।
তপন জিপে উঠে পড়েছে, কাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন এক পাশে। টিকেন্দ্রজিৎ একবার তাকাল কাকাবাবুর দিকে। যেন চিনতেই পারল না। অহঙ্কারের সঙ্গে মুখটা ঘুরিয়ে নিয়ে চলে গেল গটগট করে।