মাঝরাতে ঝড়বৃষ্টি শুরু হল
মাঝরাতে এমন ঝড়বৃষ্টি শুরু হল যে, মনে হল যেন আকাশ ভেঙে পড়বে! প্রচণ্ড বজ্রপাতের আওয়াজ আর হাওয়ার বেগে উপড়ে পড়ল কয়েকটা বড় বড় গাছ। ঝনঝন শব্দে ভেঙে গেল বাংলোর কয়েকটা কাচের জানলা।
এর মধ্যে বেনো যায় না।
পাহাড়ি রাস্তায় রাত্তির বেলা গাড়ি চালানোই বিপজ্জনক। ঝড়-বাদলের মধ্যে যখন-তখন অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে।
কাকাবাবু শুতে গেলেন না। জানলার ধারে বসে রইলেন আগাগোড়া।
বৃষ্টির তেজ কমে এল প্রায় রাত তিনটের সময়। কাকাবাবু সঙ্গে সঙ্গেই উঠে গিয়ে ফিলিপ তামাং-এর ঘরের দরজায় খট খট করলেন।
ফিলিপ তামাং কোট-প্যান্ট পরে তৈরিই ছিলেন, কিন্তু শেষের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হঠাৎ। দরজা খুলে বললেন, এখন কী আর যাবেন? নাকি কাল রাত্তিরের জন্য অপেক্ষা করবেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি আজই যেতে চাই।
ফিলিপ তামাং ঘড়ি দেখে বললেন, ওখানে পৌঁছতে পৌঁছতে যদি ভোর হয়ে যায়?
কাকাবাবু বললেন, হোক।
একবার ঠিক হয়েছিল যাওয়া হবে মোটরসাইকেলে। কিন্তু ওতে বড্ড বেশি আওয়াজ হয়। রাত্তিরবেলা সেই আওয়াজ শোনা যায় অনেক দূর থেকে। এই ঝড় বৃষ্টির পর রাস্তা পেছল হয়ে আছে, এর মধ্যে ঘোড়ায় যাওয়াও ভয়ের ব্যাপার। তখন ঠিক হল জিপেই যেতে হবে। এই চা বাগানের দিক থেকে একটা রাস্তা আছে। সেটাতে ওই জঙ্গলের মনাস্টারির পেছনের পাহাড়টার একপাশে পৌঁছনো যায়। এই রাস্তায় গেলে ডিংলা ঝরনা পেরোতে হবে না। অবশ্য পাহাড়ের গা থেকে খানিকটা হাঁটতে হবে জঙ্গলের মধ্যে।
ফিলিপ তামাং জিজ্ঞেস করলেন, আপনি হাঁটতে পারবেন?
কাকাবাবু বললেন, পাহাড় দিয়ে নীচের দিকে নামতে হবে তো? সেটা আমি ঠিক পারব।
জিপ চালাচ্ছে জগমোহন। তাকে দেখলেই বোঝা যায়, তার গায়ে প্রচণ্ড শক্তি, কিন্তু সে কথা বলে খুব কম। তার মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা, কুস্তিগিরের মতন চেহারা।
ফিলিপ তামাং একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, আমি আরও একজনকে সঙ্গে নিতে চেয়েছিলাম। তার নাম বান্টু। খুব বিশ্বাসী আর বুদ্ধিমান। কিন্তু বজ্র লামার নাম শুনে সে ভয় পেয়ে গেল।
কাকাবাবু বললেন, বেশি লোকের দরকার নেই। তবে, মনাস্টারির বাইরে দুজন ষণ্ডামাকা লোক পাহারা দেয়, তাদের চোখ এড়িয়ে ভেতরে ঢোকা একটু শক্ত হবে।
ফিলিপ তামাং বললেন, তাদের ঘায়েল করার ব্যবস্থা আমি করেছি। আচ্ছা, মিঃ রায়চৌধুরী, কেউ যদি আপনাকে তাড়া করে, তা হলে তো আপনি দৌড়ে পালাতে পারেন না। অথচ, আপনি এত সব জায়গায় অ্যাডভেঞ্চারে যান কী করে?
কাকাবাবু হেসে বললেন, আমার কখনও পালাবার দরকার হয়নি এ পর্যন্ত। কেউ যদি তাড়া করে আসে, আমি ধরা দিই।
ফিলিপ তামাং বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, আপনি ধরা দেন? তারপর?
কাকাবাবু বললেন, তারপর কিছু একটা হয়ে যায়। এ পর্যন্ত তো একবারও মরিনি, দেখাই যাচ্ছে।
গম্ভীর স্বভাবের জগমোহন জিপ চালাতে-চালাতে হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, বজ্র লামার মনাস্টারিতে ভূত আছে?
ফিলিপ তামাং বললেন, ভূত? ধুর, ভূত আবার কী! একথা কে বলো তোকে?
জগমোহন বলল, বান্টু বলল! ওখানে কেউ মরলে নাকি পোড়ানো হয় না, কবরও দেওয়া হয় না। তারা ভূত হয়ে রাত্তিরবেলা ঘোরে!
ফিলিপ তামাং তার কাঁধে একটা চাপড় মেরে বললেন, কী রে, জগমোহন। তুইও ভয় পাচ্ছিস নাকি?
জগমোহন দুদিকে মাথা নাড়ল।
ফিলিপ তামাং বললেন, জ্যান্ত মানুষদের তুই কবজা করবি, তাতেই কাজ উদ্ধার হয়ে যাবে। এই যে মিঃ রায়চৌধুরী আছেন, ইনি ভূত-টুতদের জব্দ করবেন।
কাকাবাবু তাঁর ক্রাচ দুটো একবার তুলে দেখলেন। শব্দ যাতে না হয় সেইজন্য আজ বিকেলে ক্রাচ দুটোর তলায় রবার লাগানো হয়েছে। ইলাস্টিক দড়িও লাগানো হয়েছে, যাতে প্রয়োজনে ও দুটোকে পিঠে বেঁধে নেওয়া যায়। ফিলিপ তামাং বারবার বলছিলেন, আমি শুধু দেখতে চাই, শত্রুর ঘাঁটির মধ্যে গিয়ে আপনি কীভাবে ঘোরাফেরা করেন।
এত বৃষ্টির ফলে রাস্তা বেশ খারাপ হয়ে গেছে। জিপটা স্কিড করছে মাঝে-মাঝে। জগমোহন চালায় ভাল, তবু দু-একবার গাড়িটা প্রায় খাদে পড়ে যাবার উপক্রম হচ্ছিল। এক জায়গায় একটা গাছের সঙ্গে ধাক্কা লেগে গেল,
অবশ্য তাতে ক্ষতি হল না বিশেষ।
হেডলাইটের তীব্র আলোয় শুধু রাস্তার সামনেটা দেখা যাচ্ছে, বাকি সব অন্ধকার। একটা কী যেন প্রাণী দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে গেল, মখমলের মতন তার হলদে শরীর ঝিলিক দিয়ে গেল একবার।
কাকাবাবু বললেন, লেপার্ড!
ফিলিপ তামাং উৎসাহের সঙ্গে বললেন, গুড সাইন! লেপার্ড দেখলে কার্যসিদ্ধি হয়। আজ আমরা নিশ্চয়ই জিনিসটা পাব।
কাকাবাবু বললেন, জিনিস?
ফিলিপ তামাং বললেন, না, না। সরি, জিনিস কী বলছি! ভুল বলেছি। আপনার ভাইপো সন্তুকে নিয়ে আসতে পারব। সেটাই মিন করেছি।
জগমোহন বলল, আর যাওয়া যাবে না?
সামনে রাস্তার ওপরে দুটো বড় বড় পাইন গাছ পড়ে আছে। আজকের ঝড়ে ভেঙেছে। এই গাছ সরাতে অনেক লোক লাগবে।
কাকাবাবু বললেন, ভালই হয়েছে। আমরা এখানে নেমে পড়ি। আর কত দূর।
ফিলিপ তামাং বললেন, বড় জোর দু ফার্লং। তাই না জগমোহন?
জগমোহন বলল, সিকি মাইল থেকে আধ মাইল, তার বেশি হবে না। কাকাবাবু বললেন, গুড। লেটস স্টার্ট। ফিলিপ তামাং বললেন, লেপার্ড দেখা খুব গুড সাইন বটে। কিন্তু সে ব্যাটা না পেছন থেকে হঠাৎ ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে!
কাকাবাবু বললেন, তিনজন মানুষ একসঙ্গে দেখলে কোনও লেপার্ড অ্যাটাক করবে না। চলুন, চলুন, বেশি দেরি করলে ভোর হয়ে যাবে!
ক্রাচ নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে কাকাবাবুরই সবচেয়ে অসুবিধে হবার কথা, তবু তিনি অন্যদের চেয়ে আগে-আগে নামতে লাগলেন। তিনজনেরই হাতে জোরালো টর্চ।
নিঃশব্দে তিনজনে এসে পৌঁছলেন জঙ্গলের মনাস্টারির কাছে।
ফিলিপ তামাং ফিসফিস করে বললেন, কোনও গার্ডই তো দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টির পর বেশ ঠাণ্ডা পড়েছে, সবাই নিশ্চয়ই এখন ঘুমোচ্ছ।
কাকাবাবু বললেন, সামনের দিকে এদের প্রধান দরজা। পেছন দিকেও একটা ছোট দরজা আছে দেখেছি। কিন্তু কোনও দরজাই নিশ্চয়ই খোলা থাকবে না। পাঁচিল ডিঙোতে হবে।
ফিলিপ তামাং বললেন, দারুণ এক্সসাইটমেন্ট বোধ করছি। আপনার সঙ্গে একটা অভিযানে যাচ্ছি, এটা হিস্ট্রিতে লেখা থাকবে। চলুন, আগে সামনের দরজাটার কাছে গিয়ে দেখি।
মনাস্টারির সামনের দরজা অবশ্যই বন্ধ। পাথরের সিঁড়ির ওপর বসে আছে। একজন প্রহরী। সে দু হাঁটুতে মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে। বাতাস এখন কনকনে ঠাণ্ডা!
পকেট থেকে কী একটা জিনিস বার করে, এগিয়ে দিয়ে ফিলিপ তামাং বললেন,নে জগমোহন, লোকটাকে কাত করে দে?
জগমোহন প্রায় নিঃশব্দ-পায়ে ছুটে গিয়ে লোকটির মুখ চেপে ধরল।
লোকটি লড়াইয়ের কোনও সুযোগই পেল না। খানিকটা ছটফট করেই ঢলে পড়ল একপাশে।
কাকাবাবু শিউরে উঠে বললেন, লোকটা মরে গেল নাকি?
ফিলিপ তামাং বলল, না! মারবার দরকার হবে না।
ফিলিপ তামাং সিঁড়ি দিয়ে উঠে গিয়ে বড় দরজাটা একবার ঠেলে দেখল। তারপর ফিরে এসে বলল, এই দরজা ভাঙা যাবে না। লোহার মতন শক্ত। আর একটা ছোট দরজা কোথায় আছে বললেন?
কাকাবাবু ওদের নিয়ে এলেন মনাস্টারির পেছন দিকে, ডান পাশে। এখানে একটা ছোট দরজা আছে। আজ সকালে এই দরজা দিয়েই তাঁকে জোর করে বার করে দেওয়া হয়েছিল।
এখন অবশ্য সেই দরজাও বন্ধ।
ফিলিপ তামাং জিজ্ঞেস করলেন, জগমোহন, এই দরজাটা তেমন ভারী। ভাঙতে পারবি?
জগমোহন বলল, পারব! কিন্তু শব্দ হবে?
ফিলিপ তামাং বলল, আমি অবশ্য দেওয়াল টপকাবার জন্য দড়ির সিঁড়ি এনেছি। কিন্তু মিঃ রায়চৌধুরী কি সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারবেন?
কাকাবাবু কিছু উত্তর দেবার আগেই কাছাকাছি একটা শব্দ হল। এখানেও দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে আছে একজন প্রহরী। তার হাতে একটা গদা কিংবা মুগুরের মতন অস্ত্র। সেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। এদের কথাবার্তা শুনে জেগে উঠে হুঙ্কার দিয়ে বলল, কোন হ্যায়?
ফিলিপ তামাং সঙ্গে-সঙ্গে বলে উঠলেন, জগমোহন ওকে ধর!
জগমোহন ছুটে গিয়ে লোকটিকে জাপটে ধরতেই দুজনে জড়াজড়ি করে পড়ে গেল মাটিতে। তারপর চলল লড়াই।
ফিলিপ তামাং কাকাবাবুকে বললেন, চিন্তা করবেন না। জগমোহন এক্ষুনি। ওকে অজ্ঞান করে দেবে।
কিন্তু একটা অদ্ভুত কাণ্ড হল।
সেই প্রহরীটি লড়াই করতে করতে এক সময়ে হেরে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেল বটে, কিন্তু জগমোহনও উঠে দাঁড়াল না। সেও শুয়ে রইল লোকটির পাশে।
ফিলিপ তামাং দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, ব্লাডি ফুল!
তারপর তিনি ওদের কাছে গিয়ে নিচু হয়ে জগমোহনের নাকের কাছে হাত দিয়ে দেখলেন। আবার ফিরে এলেন হাতে একটা ছোট শিশি নিয়ে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী!
ফিলিপ তামাং বললেন, এটা একটা ক্লোরোফর্মের মতন জিনিস। এটা এনেছিলাম, প্রহরীগুলোকে অজ্ঞান করে ফেলার জন্য। কিন্তু জগমোহনটা এমন বোকা, এটা নিজের নাকের কাছ থেকে দূরে রাখতে পারেনি। ও নিজেও অজ্ঞান হয়ে গেল। আর ওর সাহায্য পাওয়া যাবে না। এখন তা হলে…
কাকাবাবু বললেন, দরজা ভাঙার চেয়ে দড়ির সিঁড়ি দিয়ে পাঁচিল টপকানো অনেক সহজ। আপনি ভাবছিলেন, আমি সেই সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারব কি না? সিঁড়িটা লাগান, আমিই আগে উঠব!
পাঁচিলটা পাথরের তৈরি, প্রায় দেড়-মানুষ সমান উঁচু। ওপরটা মসৃণ। ফিলিপ তামাং কয়েকবার চেষ্টা করতেই তাঁর দড়ির সিঁড়ির লোহার হুক পাঁচিলের মাথায় আটকে গেল।
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো পিঠের সঙ্গে বেঁধে দিব্যি তরতর করে উঠে গেলেন ওপরে। এবার উলটো দিকে নামতে হবে। ফিলিপ তামাং উঠে আসার পর সিঁড়িটাকে এপাশে ফেলে সহজে নামা যেত, কিন্তু কাকাবাবু আর দেরি করলেন না। হাতের ভর দিয়ে ঝুলে পড়লেন, তারপর ঝুপ করে লাফিয়ে পড়লেন মাটিতে।
তিনি কুকুরের ভয় করছিলেন। তিব্বতিরা অনেকেই কুকুর পোষে। যদি কুকুর ছাড়া থাকে, তা হলেই মুশকিল। সেরকম কিছু হল না। চতুর্দিকে একেবারে নিস্তব্ধ। পৌনে পাঁচটা বাজে, এই সময়টা সত্যিই ঘুমোবার সময়। আর একটু পরেই ভোর হবে। এইসব পাহাড়ি এলাকায় ভোর হয় তাড়াতাড়ি, সন্ধে হয় আগে-আগে।
কাকাবাবু দেখলেন, একটু দূরেই সেই টালির ছাদ দেওয়া লম্বা ঘরটি। এরই বারান্দায় সকালবেলা সন্তুকে তিনি দেখে গেছেন।
ফিলিপ তামাং নেমে আসার পর কাকাবাবু বললেন, খুব সম্ভবত ওই ঘরটার মধ্যেই সন্তু থাকবে। ওটা ছাত্রদের ডরমিটরি মনে হচ্ছে।
ফিলিপ তামাং বললেন, চলুন, আগে ওখানেই দেখা যাক।
নিঃশব্দে দুজনে এগিয়ে গেলেন ঘরটার দিকে। বারান্দা পেরোবার পর একটা দরজা। সেটা ঠেলতেই খুলে গেল। মেঝেতে সারি-সারি বিছানা পাতা। এটা ছাত্রদের ঘর ঠিকই।
ফিলিপ তামাং বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি এক-একজনের মুখের ওপর টর্চের আলো ফেলুন। আমি ওদের অজ্ঞান করে দিই। কারণ, ওরা জেগে উঠলে গণ্ডগোল করবে। শুধু সন্তুকে আমরা ডেকে নেব।
কাকাবাবু টর্চ জ্বেলে ধরলেন। ফিলিপ তামাং এক-একজন ছাত্রের নাকের কাছে রুমাল ঠেসে ধরতে লাগলেন, তারা দু-একবার ছটফট করেই ঢলে পড়ল। একটি ছাত্র শুধু আগেই জেগে উঠে চিৎকার করতে যাচ্ছিল, ফিলিপ তামাং তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখটা চেপে রইলেন খানিকক্ষণ।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ওদের কোনও ক্ষতি হবে না তো?
ফিলিপ তামাং বললেন, না, না, শুধু পাঁচ ঘণ্টা কি ছ ঘণ্টা অঘোরে ঘুমোবে। আজ সকালে ওদের প্রেয়ার হবে না, মর্নিং ক্লাসও ছুটি দিতে হবে। তাতে আর কী এমন ক্ষতি হবে বলুন?
একে-একে সাতটি ছাত্রকেই অজ্ঞান করা হয়ে গেল। কিন্তু তাদের মধ্যে সন্তু নেই।
কাকাবাবু খানিকটা নিরাশভাবে বললেন, সন্তুকে তা হলে অন্য জায়গায় রেখেছে। এখন অনেক খুঁজতে হবে। আমরা যে-ঘরটায় ছিলাম, চলুন, সেখানে এবার দেখা যাক।
এই মনাস্টারিতে আরও কত লোক আছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। কাকাবাবু ফিলিপ তামাংকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন। সকালবেলার সেই ঘরটির দরজাও ভেজানো, ঠেলতেই খুলে গেল। সকালেই কাকাবাবু লক্ষ করেছিলেন, এখানকার কোনও ঘরেই তালা দেবার ব্যবস্থা নেই। কোনও দরজার কড়া নেই।
কাকাবাবুর হাতের জোরালো টর্চের আলোয় দেখা গেল দুটো বিছানাই খালি। কেউ নেই সে ঘরে।
কাকাবাবু বললেন, যাঃ, সন্তু কোথায় গেল? ফিলিপ তামাং বললেন, বজ্র লামা তাকে অন্য মনাস্টারিতে নিয়ে যায়নি তো? সে নিশ্চয়ই ধরে নিয়েছে, আপনি পুলিশ নিয়ে কিংবা অন্য যে-কোনও উপায়ে আবার ফিরে আসতে পারেন। তাই সে সন্তুকে অন্য জায়গায় লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
কাকাবাবু দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, সে সন্তুকে পৃথিবীর যে-কোনও জায়গাতেই লুকিয়ে রাখুক, আমি ঠিক খুঁজে বার করব। আগে এই মনাস্টারির সব ঘর খুঁজে দেখে নিই, তারপর আমি বজ্র লামার কাছে যাব।
ফিলিপ তামাং বললেন, আগে একবার তিনশো বছরের বৃদ্ধ প্রাচীন লামার ঘরটায় গেলে হয় না? তাকে আমার দেখবার ইচ্ছে আছে।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, চলুন সেখানে। ওই ঘরের কাছাকাছি আরও দু তিনটে ঘর আছে মাটির নীচে। সন্তু ওখানে কোনও ঘরে থাকতেও পারে।
বুদ্ধমূর্তির বড় ঘরটা পার হয়ে কোণের দরজাটা খুলে কাকাবাবু সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে বললেন, এখানেও একটা লোক পাহারায় বসে থাকে। সাবধান।
সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার পর একটা সরু গলি। প্রাচীন লামার ঘরের সামনে প্রহরীটি আজ আর বসে বসে ঘুমোচ্ছে না। সে দরজা আড়াআড়ি লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। তার নাক ডাকছে।
ফিলিপ তামাং তার বুকের ওপর ঝুঁকে ক্লোরোফর্ম ভেজানো রুমাল চেপে ধরলেন নাকে। লোকটা একটু ছটফটও করল না। ঘুমের মধ্যে আরও ঘুমিয়ে পড়ল।
কাকাবাবু তাকে ডিঙিয়ে গিয়ে ঘরের দরজাটা ঠেলে খুলে টর্চের আলো ফেললেন।
এই ঘরটাও শূন্য। উঁচু বেদীটার ওপর বিছানা পাতা আছে, কিন্তু কোনও মানুষ নেই।
ফিলিপ তামাং খানিকটা অবিশ্বাসের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, এইখানে ছিল? আপনার ঘর ভুল হয়নি তো?
কাকাবাবু বললেন, না, এই ঘর! কী ব্যাপার, সবাই কি এই মনাস্টারি থেকে চলে গেল নাকি?
ফিলিপ তামাং বললেন, আমি যতদূর শুনেছি, প্রাচীন লামা তো কোনওদিন এখান থেকে বাইরে যান না।
কাকাবাবু বললেন, কী জানি, বুঝতে পারছি না।
কাকাবাবু টর্চ ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে সারা ঘরটা দেখতে লাগলেন। দেওয়ালে কোনও ইলেকট্রিকের তার কিংবা বাল্ব নেই। কাল রাতের বিদ্যমকের ব্যাপারটা তা হলে কী ছিল? এর মধ্যে তার-টার সব খুলে নিয়েছে।
কাকাবাবু বেদীটার পেছন দিকে চলে এলেন।
প্রাচীন লামা শুয়ে ছিলেন ওপরে। আর বজ্র লামা পেছন দিকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। ধূপের ধোঁয়া আর তারাবাজির ধোঁয়ায় ঘর ভর্তি ছিল, কীসব গন্ধও
এখানে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।
দেওয়ালের গায়ে একটা মড়ার মাথার খুলির চোখের মধ্যে আঙুল ভরে দিয়ে কাকাবাবু টের পেলেন, ভেতরে বাল্ব লাগানো আছে। এবার তিনি খানিকটা নিশ্চিন্ত হলেন।
দেওয়ালের গায়ে হাত বুলোত বুলোতে তিনি একটা পুশ বাটন সুইচও পেয়ে গেলেন। সেটা টিপলেও অবশ্য কোনও আলো জ্বলল না।
কাকাবাবুর গায়ে একটা ঠাণ্ডা হাওয়া লাগছে।
এবার তিনি দেখলেন, বেদীর পেছনের দেওয়ালের দিকে একটা বেশ বড় গোল গর্ত। মানুষ গলে যেতে পারে। একটা গুহার মতন। সেই গুহার মুখে অন্য সময় পাথর চাপা দেওয়া থাকে, একটা বড় পাথরের চাঁই পড়ে আছে একটু দূরে।
গুহাটা ভাল করে পরীক্ষা করার সুযোগ পেলেন না কাকাবাবু। ফিলিপ তামাং বললেন, শেকড়গুলো কোথায়?
কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, শেকড়?
ফিলিপ তামাং বললেন, এরা মারাংবু গাছের শেকড় রাখে, আপনি জানেন না? সেই শেকড় একটু-একটু খেলে মানুষ অনেকদিন বাঁচে।
কাকাবাবু বললেন, মারাংবু গাছ? কোনওদিন নাম শুনিনি!
ফিলিপ তামাং বললেন, মারাংবু গাছের আর-এক নাম ট্রি অফ গুড হোপ। একশো বছর আগে সেই গাছ পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে গেছে। একসময় তিব্বত আর চিনদেশের অন্য দু-একটা জায়গায় পাওয়া যেত। কনফুসিয়াস এই গাছের শেকড়ের গুণের কথা লিখে গেছেন। এই শেকড় খেলে মানুষের সব রোগ-ভোগ সেরে যায়। আয়ু অনেক বেশি হয়।
কাকাবাবু বললেন, আহ, এরকম একটা অদ্ভুত গাছ পৃথিবী থেকে শেষ হয়ে গেল?
ফিলিপ তামাং বললেন, গাছটা শেষ হয়ে গেলেও তার কিছু কিছু শেকড় এইসব লামাদের কাছে আছে। সেই শেকড় নষ্ট হয় না। সেই শেকড় আমাদের পেতেই হবে।
কাকাবাবু বললেন, কোনও গাছের শেকড় খেয়ে মানুষ দীর্ঘকাল বাঁচবে, তা আমার ঠিক বিশ্বাস হয় না। তবে সেরকম কিছু শেকড় পেলে লেবরেটারিতে পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে।
ফিলিপ তামাং বললেন, এই ঘরে প্রাচীন লামা ছিল, এখানেই সেই শেকড় থাকবে।
বেশি খুঁজতে হল না। উঁচু বেদীটার গায়ে দুটি দেরাজ। তার মধ্যে যেটা উপরের দিকে সেটা খুলতেই পাওয়া গেল একটা কাচের ছোট বাক্স। সেই বাক্সের মধ্যে কিছু একটা শেকড় রয়েছে ঠিকই, যদিও তার অনেকটাই ঝুরঝুরে গুড় হয়ে গেছে। অনেকটা চা-পাতার মতন দেখতে।
কাকাবাবু বাক্সটা তুলে নিয়ে বললেন, আমরা এখানকার কোনও জিনিস চুরি করছি না। ভারত সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে আমি এটা গ্রহণ করছি। যথাসময়ে বজ্র লামাকে জানিয়ে দেওয়া হবে।
ফিলিপ তামাং বললেন, ওটা আমার কাছে দিন, আমি রাখছি!
কাকাবাবু বললেন, আমার কাছেই থাক। আমার কোটের পকেটে বাক্সটা ধরে যাবে। এবার অন্য ঘরগুলো খুঁজে দেখা যাক।
দরজার সামনের লোকটা অজ্ঞান হয়েই আছে। তাকে ডিঙিয়ে বাইরে আসতেই কিসের যেন শব্দ শোনা গেল। খানিকটা দূরে।
কাকাবাবু আর ফিলিপ তামাং চুপ করে দাঁড়িয়ে শব্দটা শুনলেন।
ঘোড়ার খুরের মতন খটাখট খটাখট আওয়াজ। বেশ কয়েকজন লোক ঘোড়ায় চেপে এই মনাস্টারির দিকে আসছে। শব্দটা এগিয়ে আসছে ক্রমশ।
কাকাবাবু বললেন, পুলিশ? ক্যাপ্টেন নরবু এর মধ্যেই পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসেছে?
ফিলিপ তামাং বললেন, আর যদি বজ্র লামা হয়? হঠাৎ কোনও কারণে বজ্র লামা ফিরে আসতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, ওপরে উঠে আড়াল থেকে একবার দেখে নেওয়া দরকার।
ফিলিপ তামাং বললেন, পুলিশ তো ঘোড়ায় আসবে না। দার্জিলিং-এর পুলিশ এত রাত্রে ঘোড়া পাবে কোথায়? এ নিশ্চয়ই বজ্র লামার দল। আমি আর রিস্ক নিতে চাই না। ৫৫২
তারপর ফিলিপ তামাং আদেশের সুরে বললেন, কাচের বাক্সটা আমাকে দিন। ওইটার জন্যই আমি এসেছি। ওইটা নিয়ে আমি পালাব?
কাকাবাবু বললেন, আমিও তো তোমার সঙ্গেই যাচ্ছি!
ফিলিপ তামাং বললেন, আপনি ক্রাচ নিয়ে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারেন না। দড়ির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে আপনার সময় লাগবে। তারপর অনেকটা দৌড়ে যেতে হবে জিপের কাছে। আপনার সঙ্গে যেতে গেলে আমিও ধরা পড়ে যাব। দিন, বাক্সটা দিন আমাকে!
কাকাবাবু বললেন, উঁহু! এটা সরকারি সম্পত্তি। তুমি আমাকে ফেলে পালাতে চাইছ, আর তোমাকে আমি এটা দেব?
ফিলিপ তামাং ফস করে একটা রিভলভার বার করে কাকাবাবুর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, মিঃ রায়চৌধুরী, আপনি পালাতে না পারলে ধরা দেন, কিন্তু আমি ওই বজ্র লামার কাছে কিছুতেই ধরা পড়তে চাই না। আপনার ওইসব অভিযান-টভিযান বানানো গল্প, এবার বুঝেছি। একটা খোঁড়া লোক, গুড ফর নাথিং?
কাকাবাবু ঠাণ্ডা গলায় বললেন, রিভলভারটা নামাও! আমার দিকে কেউ অস্ত্র তুললে তাকে কোনও-না-কোনও সময়ে আমি শাস্তি দেবই!
ফিলিপ তামাং কাকাবাবুকে দেওয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে বললেন, হঃ! এখনও তুমি আমায় ভয় দেখাচ্ছ! একটা গুলিতে এখন তোমার কপাল ফুটো করে দিলে কে বাঁচাবে? পকেটে হাত দেবে না! ক্রাচ তুলবে না। কোনওরকম চালাকি করলেই গুলি চালাব। এবার আর তোমার সঙ্গে আমি খেলা করছি না! মারাংবু গাছের শেকড়গুলো নিয়ে আমি বিদেশে চলে যাব। এই জিনিসটার দাম হবে কয়েক কোটি টাকা! দাও বাক্সটা?
ফিলিপ তামাং হঠাৎ একেবারে বদলে গেছে। তার কথার মধ্যে এমন নিষ্ঠুরতা ফুটে উঠছে যে, মনে হয় সত্যিই সে গুলি চালিয়ে কাকাবাবুকে খুন করতে পারে।
কাকাবাবু কাচের বাক্সটা নিজে দিলেন না, ফিলিপ তামাংই তাঁর পকেটে হাত ভরে সেটা তুলে নিল। কাকাবাবুর ক্রাচ দুটোও ছিনিয়ে নিল সে।
তারপরই এক পা পিছিয়ে গিয়ে বলল, তুমি ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠার আগে নড়বে না। একটু নড়লে কিংবা পকেটে হাত দিলেই আমি গুলি চালাব।
কাকাবাবু স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফিলিপ তামাং রিভলভারটা উঁচিয়ে রেখে এক পা, এক পা করে পিছিয়ে যেতে লাগল। বাইরে ঘোড়র পায়ের শব্দ এখন অনেক কাছে এসে গেছে। কাকাবাবু রাগে ফুঁসতে লাগলেন। ফিলিপ তামাং নিজে পালিয়ে গিয়ে কাকাবাবুকে ধরিয়ে দিতেই চাইছে।
সরু গলিটার শেষ প্রান্তে পৌঁছে ফিলিপ তামাং সিঁড়িতে পা দিতে গিয়েই কিসের সঙ্গে যেন ধাক্কা খেল!
হঠাৎ বিকট চিৎকার করে উঠল সে। তার হাত থেকে রিভলভারটা পড়ে গেল মাটিতে। তারই মধ্যে একটা গুলির শব্দ হল দড়াম করে। গুলিটা কাকাবাবুর দিকেই এসে একটা দেওয়ালে লাগল, পাথরের কয়েকটা চল্টা এসে পড়ল কাকাবাবুর গায়ে।
ফিলিপ তামাং আর্ত চিৎকার করতে করতে কার সঙ্গে যেন যুঝবার চেষ্টা করছে।
কাকাবাবু মাটিতে বসে পড়ে টর্চ জ্বেলে দেখলেন। তাঁর বুকটা কেঁপে উঠল।
ফিলিপ তামাংকে জড়িয়ে ধরেছে একটা বিশাল মূর্তি। টর্চের আলোতেও ভাল করে দেখা যাচ্ছে না। শুধু মনে হচ্ছে কালো ধোঁয়া দিয়ে গড়া একটা কিছু।
কাকাবাবু ভাবলেন, এই কি তা হলে দানব? ফিলিপ তামাং শক্তিশালী পুরুষ, কিন্তু কিছুই করতে পারছে না, তার শরীরটা দলা-মোচা হয়ে যাচ্ছে। একবার সে বলে উঠল, মিঃ রায়চৌধুরী বাঁচান! বাঁচান! আপনার পায়ে পড়ি।
কাকাবাবু রিভলভারটা বার করেও গুলি চালাতে পারলেন না। ফিলিপ তামাং-এর গায়েও গুলি লেগে যেতে পারে। ওকে সাহায্য করবার জন্য কাকাবাবু দু-এক পা এগোতে যেতেই ফিলিপ তামাং-এর গলা দিয়ে ঘড়ঘড় শব্দ হতে লাগল। সেই দানবটা তাকে উঁচুতে তুলে একটা প্রবল আছাড় মারল।
তারপর একটা হুঙ্কার দিয়ে দানবটা এগিয়ে এল কাকাবাবুর দিকে।
এবার কাকাবাবু টর্চের আলোয় ভাল করে দেখলেন। অন্ধকার ধোঁয়া-ধোঁয়া বিশাল শরীরের ওপর দিকে দুটো জ্বলজ্বলে ছোট-ছোট চোখ। সরু মুখ। দানব নয়, একটা ভাল্লুক!
বজ্র লামা রাত্তিরবেলা পাহারা দেবার জন্য একটা পোষা ভাল্লুক রেখেছে এখানে। এটা এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল, কিংবা অন্য কোথাও ছিল। সাধারণ পাহাড়ি ভাল্লুকের চেয়েও এটার আকার দ্বিগুণ। বোঝাই যাচ্ছে অসম্ভব হিংস্র।
রাইফেল ছাড়া শুধু রিভলভারের গুলি দিয়ে এত বড় একটা লোমশ ভাল্লুককে ঘায়েল করা যায় না।
কাকাবাবু অসহায়ভাবে এদিক-ওদিক তাকালেন। তাঁর পেছনে গলিটা শেষ হয়ে গেছে, নিরেট পাথরের দেওয়াল। পালাবার কোনও উপায় নেই। ফিলিপ তামাং তাঁকে ঠেলতে-ঠেলতে এখানে নিয়ে এসেছিল, এখান থেকে প্রাচীন লামার ঘরের দরজাটাও কিছুটা দূরে। ভাল্লুকটা গর্জন করতে করতে সেই পর্যন্ত এসে গেছে। এপাশে আর কোনও দরজা নেই।
কাকাবাবু টর্চ জ্বেলেছিলেন বলে ভাল্লুকটা তাঁর উপস্থিতিও টের পেয়ে গেছে। দু হাত তুলে সে এগিয়ে আসছে এদিকে।
কাকাবাবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ভাল্লুকটা থপথপ করে এসে কাকাবাবুর সামনে দাঁড়াল। কাকাবাবু একটুও নড়লেন না। ভাল্লুকটা প্রথমে একটা থাবা মেরে ধারালো নখে কাকাবাবুর গাল চিরে দিল। তবু একটুও শব্দ করলেন না কাকাবাবু।
এবার ভাল্লুকটা হাতে জড়িয়ে ধরল তাকে। কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে টের পেলেন, ওর সঙ্গে লড়াই করার চেষ্টাতেও কোনও লাভ নেই। ওর গায়ে অসীম শক্তি। ও কাকাবাবুকে পিষে ফেলে দেবে।
কাকাবাবু একটুও ছটফট না করে ডান হাতটা তুললেন খুব আস্তে। ভাল্লুকটার পেটের নরম জায়গায় রিভলভারটা ঠেকিয়ে গুলি করলেন।
একটা গুলি খেয়েই ভাল্লুকটা ছিটকে সরে গেল।
তারপর কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে একটা হাড়হিম করা চিৎকার করল। কাকাবাবু জানেন, আহত ভাল্লুক অতি সাঙ্ঘাতিক প্রাণী। এরা এমনই গোঁয়ার
যে কোনও অস্ত্রকেই ভয় পায় না।
ভালুকটা আবার ঝাঁপিয়ে পড়ল তাঁর ওপরে। কাকাবাবু তবু একটুও নড়লেন না। ভাল্লুকটার নোখ বিধে গেছে তাঁর কাঁধে, সে কাকাবাবুর মুখটা কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে।
কাকাবাবু মাথাটা যথাসম্ভব ঝুঁকিয়ে রিভলভারটা আবার ভাল্লুকটার পেটে ঠেকালেন, এবার পর-পর পাঁচটা গুলি চালিয়ে দিলেন একসঙ্গে।
ভাল্লুকটার আলিঙ্গন আস্তে-আস্তে আলগা হয়ে গেল। সে এবার মাটিতে পড়ে গেল ধপ করে।
কাকাবাবু হাঁপাতে লাগলেন। আর আধ মিনিট দেরি হলে তাঁর প্রাণ বাঁচত।
কিন্তু সময় নষ্ট করার উপায় নেই। খোঁড়াতে-খোঁড়াতে তিনি এগিয়ে গেলেন সিঁড়ির দিকে। ক্রাচ দুটো তুলে নেবার আগে তিনি একবার দেখতে গেলেন ফিলিপ তামাং-এর কী অবস্থা।
ঠিক তক্ষুনি সিঁড়িতে পড়ল একটা আলো। খুব দ্রুত একটা জ্বলন্ত মোম নিয়ে নেমে এলেন বজ্র লামা।
মেঘের মতন গম্ভীর গলায় বজ্র লামা বললেন, আবার তুমি এখানে এসেছ? তুমি মরতে চাও।
কাকাবাবু সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটুও ভয় না পেয়ে বললেন, আমার ভাইপো সন্তু কোথায়?
বজ্র লামা শেষ সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে বললেন, সে আর কোনওদিন তোমার। কাছে যাবে না! তুমি আমার সব পরিকল্পনা বানচাল করে দেবে ভেবেছ? তুমি আর এখান থেকে জ্যান্ত বেরুতে পারবে না।
কাকাবাবু বললেন, আমি এরকম ভয় দেখানো পছন্দ করি না। বজ্র লামা বললেন, তুমি আমার প্রিয় ভাল্লুকটাকে মেরে ফেলেছ। আজ তোমার শেষ দিন! তাকাও আমার দিকে।
একহাতে মোমবাতিটা তুলে অন্য হাতে বজ্র লামা কাকাবাবুর চোখের সামনে সম্মোহনের ভঙ্গি করলেন।
কাকাবাবু খপ করে চেপে ধরলেন সেই হাতটা। তারপর এক ঝটকা টানে বজ্র লামার ওরকম বিশাল শরীরটাকে শূন্যে তুলে দিলেন এক আছাড়! পাথরে তাঁর মাথা ঠুকে গেল। তিনি আঁক শব্দ করে উঠলেন।
তবু বজ্র লামা জ্ঞান হারালেন না।
কাকাবাবু তার দিকে রিভলভার তুলে বললেন, আমাকে হিপনোটাইজ করতে পারে, এমন মানুষ পৃথিবীতে জন্মায়নি। তুমি আমাকে ইলেকট্রিক শক খাইয়ে অজ্ঞান করে দিয়েছিলে, আমি তার বদলা নিলাম। নড়া চড়া করলে তোমার পা খোঁড়া করে দেব। লামারা অতি শান্ত ও ভালমানুষ হয়। তুমি লামাদের মধ্যে একটা কলঙ্ক! এখনও বলল, সন্তু কোথায়?
বজ্র লামা হঠাৎ দুর্বোধ ভাষায় কী একটা চিৎকার করে উঠলেন।
তক্ষুনি সিঁড়িতে আবার পায়ের শব্দ হল, দুজন লোক দুপ-দাপিয়ে নেমে এল, তাদের হাতে চকচকে ভোজালি।
কাকাবাবু রিভলভারটা তাদের দিকে ঘুরিয়ে বললেন, সাবধান!
বজ্র লামা ওঠার চেষ্টা করেও পারলেন না। তবু তেজের সঙ্গে বললেন, আমি পর-পর ছটা গুলির শব্দ শুনেছি। ওটার মধ্যে আর গুলি নেই। মারো ওকে।
লোক দুটো ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই কাকাবাবু এক লাফে ঢুকে পড়লেন প্রাচীন লামার ঘরের মধ্যে। দরজাটা বন্ধ করেও দেখলেন, ভেতর দিকে ছিটকিনি বা খিল কিছু নেই। এদের দরজা বন্ধ রাখা যায় না।
কাকাবাবু পিঠ দিয়ে চেপে থাকার চেষ্টা করেও বুঝলেন কোনও লাভ হবে। ওদের দুজনের সঙ্গে গায়ের জোরে তিনি পারবেন না।
দরজাটা ছেড়ে দিয়ে তিনি ছুটে গেলেন বেদীটার পেছনে। ওরা হুড়মুড় করে ঘরের মধ্যে ঢুকে এসেছে। সেই দুজনের সঙ্গে আরও দুজন। কিন্তু বজ্র লামা বোধ হয় উঠতে পারেননি। এক্ষুনি তো ওরা তাঁকে ধরে ফেলবে। আর কোনও উপায় নেই দেখে কাকাবাবু নিচু হয়ে ঢুকে পড়লেন গুহাটার মধ্যে।
কিন্তু যেটাকে তিনি গুহা ভেবেছিলেন, সেটা আসলে একটা সুড়ঙ্গ। সিঁড়ি-টিড়ি কিছু নেই। সেটা ঢালু হয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। কাকাবাবু ব্যালেন্স সামলাতে পারলেন না, থামতে পারলেন না, গড়াতে লাগলেন নীচের দিকে।
দুদিকের দেওয়ালে ধরার কিছুই নেই। কাকাবাবুর মাথা ঠুকে যেতে লাগল। তাঁর কাঁধ ও গাল থেকে রক্ত ঝরছে, আরও কেটে যেতে লাগল অন্যান্য জায়গায়। ওই অবস্থাতেও তিনি বুঝতে পারলেন, এই সুড়ঙ্গে ঢুকে পড়ে তিনি ভুল করেছেন। এটা নিশ্চয়ই শেষ হয়েছে পাহাড়ের গায়ে কোথাও, সেখান থেকে অনেক নীচে তিনি পড়ে যাবেন। এই সুড়ঙ্গটা ওরা রেখেছে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ফেলার জন্য। হয়তো মৃতদেহ ফেলে দেয় এখান দিয়ে।
আততায়ীরা আর কেউ সেই সুড়ঙ্গ দিয়ে তাঁকে ধরতে এল না।
অন্ধকার সুড়ঙ্গ দিয়ে গড়াতে গড়াতেও কাকাবাবু চিন্তা করতে লাগলেন, যে করে হোক, জ্ঞানটা রাখতেই হবে। কিছুতেই অজ্ঞান হলে চলবে না। সুড়ঙ্গটা যেখানে শেষ হবে, সেখানে গাছ-টাছ কিছু একটা ধরে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
হঠাৎ সুড়ঙ্গটা শেষ হয়ে গেল, কাকাবাবু ঝপাস করে পড়ে গেলেন জলের মধ্যে। সেই জলে খুব স্রোত। কিছু বুঝবার আগেই কাকাবাবু ভেসে যেতে লাগলেন স্রোতের টানে।
প্রায় ভোর হয়ে এসেছে, আকাশে ফুটেছে নীল আলো। ঘুম ভেঙে ডাকাডাকি শুরু করেছে পাখিরা।
জলটা অসম্ভব ঠাণ্ডা। তবু কাকাবাবুর আহত শরীরটায় সেই জলের ছোঁয়ায় খানিকটা আরাম লাগল। তিনি বুঝলেন, তিনি এখনও মরেননি। এবার বাঁচার চেষ্টা করতে হবে।
হঠাৎ দুটো হাত তাঁকে চেপে ধরল। তারপরেই চেনা গলার ডাক শোনা গেল, কাকাবাবু।
সন্তু আর অন্য একটি ছেলে মিলে কাকাবাবুকে টেনে তুলল জল থেকে।
কাকাবাবুর এক মুহূর্তের জন্য মনে হল তিনি স্বপ্ন দেখছেন। তাঁর শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ! তারপরেই ভাল করে চোখ মেলে তিনি বললেন, সন্তু? তুই এখানে কী করে এলি?
সন্তু বলল, ওই সুড়ঙ্গ দিয়ে! এই তো খানিকক্ষণ আগে!
ঘাসের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে কাকাবাবু বড় বড় নিঃশ্বাস নিলেন কয়েকবার। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, এই ছেলেটি কে?
সন্তু হেসে বলল, এই তো প্রাচীন লামা। আমার সঙ্গে খুব ভাব হয়ে গেছে। আগের রাত্তিরে তুমি আর ক্যাপটেন নরবু অজ্ঞান হয়ে গেলে, আমাকেও নিয়ে গেল। তারপর আমি চুপিচুপি আবার ফিরে গিয়েছিলাম ওই ঘরে। তখন আলোটালো আর জ্বলছিল না। প্রাচীন লামা বিছানার ওপর বসে ছিলেন। একটু একটু হিন্দি জানেন। আমার সঙ্গে অনেক কথা হল।
কাকাবাবু হাঁপাতে-হাঁপাতে বললেন, তুই সকালবেলা আমার সঙ্গে আসতে চাসনি?
সন্তু বলল, বজ্র লামা আমাকে বলেছিলেন, তুমি এখানে থেকে যাও? তুমি অনেক কিছু পাবে। তোমার আয়ু অনেক বেড়ে যাবে। তারপর তিনি আমায় হিপনোটাইজ করলেন। ইস। তোমার মুখে এ কী হয়েছে? কাঁধ দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোকে হিপনোটাইজ করা হয়েছে, সেটা তুই বুঝেছিলি?
সন্তু বলল, প্রথমটায় বুঝিনি। তুমি জোরে চড় মারলে। তারপর থেকে একটু-একটু করে কাটতে লাগল। তখন আমার মনে হয়েছিল, থেকে যাই, প্রাচীন লামার রহস্যটা জানব। ইনি কিন্তু বেশ সরল ছেলেমানুষ! আমাকে বললেন, ওঁকে জোর করে একটা অন্ধকার ঘরে আটকে রেখে দেয়, ওঁর ভাল লাগে না। বাইরে জঙ্গলের মধ্যে খেলতে ইচ্ছে করে।
কাকাবাবু এবার ছেলেটিকে ভাল করে দেখলেন। সারা শরীরের মত মাথার চুলও ধপধপে সাদা। ভুরু সাদা।
কাকাবাবু অস্ফুটস্বরে বললেন, অ্যালবিনো! সেইজন্যই চুল সাদা!
সন্তু বলল, এঁর বয়েস কিন্তু তিনশো বছর হতেও পারে। দেখবে?
সন্তু সেই ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করল, আপকা উমর কিতনা? বলিয়ে? কাকাবাবুকে বল দিজিয়ে?
ছেলেটি ফিক করে হেসে বলল, মেরা উমর তিনশো দো বরষ।
সন্তু বলল, কাকাবাবু, আর একটা অদ্ভুত জিনিস দেখবে? প্রাচীন লামা, আপ কাকাবাবুকে থোড়া টাচ কর দিজিয়ে তো!
ছেলেটি কাকাবাবুর বুকে একটা আঙুল ছুঁইয়েই হাত সরিয়ে নিল। কাকাবাবু সাঙ্ঘাতিক চমকে গেলেন। তাঁর বুকের মধ্যে ঝনঝন করে উঠল। তাঁর
শরীরে বিদ্যুতের তরঙ্গ খেলে গেল সত্যি-সত্যি।
কাকাবাবু উঠে বসে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললেন, ইলেকট্রিক ম্যান? কোটি কোটি মানুষের মধ্যে এক-একজন এরকম হয়। এদের শরীরে বিদ্যুৎ জমে থাকে। আশ্চর্য! আশ্চর্য! শুধু বইতেই এঁদের কথা পড়েছি।
সন্তু বলল, আমি আর প্রাচীন লামা ওঁর ঘরে বসে গল্প করছিলাম। হঠাৎ বাইরের সিঁড়িতে কারুর পায়ের শব্দ শুনে মনে হল বজ্র লামা ফিরে আসছেন। আমাকে ওই ঘরে দেখলে তিনি নিশ্চয়ই শাস্তি দিতেন। তখন প্রাচীন লামাই। ওই সুড়ঙ্গটার মুখের পাথর সরিয়ে বললেন, চলো, আমরা দুজন পালাই!
কাকাবাবু বললেন, সেটা আমাদের পায়ের শব্দ নিশ্চয়ই। আমরা ঘরে ঢুকে কাউকে দেখতে পাইনি।
সন্তু বলল, ইস, তা হলে তো আর একটু থাকলেই ভাল হত।
কাকাবাবু বললেন, ভালই করেছিস চলে এসে। নইলে বজ্র লামার হাতে ধরা পড়তেই হত। এই ছেলেটি একটি অত্যাশ্চর্য মানুষ। এঁর বয়েস যতই হোক, এঁর শরীরে এই যে ইলেকট্রিসিটি, এটাও তো বিজ্ঞানের একটা বিস্ময়। এই ছেলেটিকে বজ্র লামা নিজের কুক্ষিগত করে রাখবে কেন? সারা পৃথিবীকে ওঁর কথা জানানো উচিত। ইনি কি আমাদের সঙ্গে যাবেন?
সন্তু বলল, হ্যাঁ। ইনি আমাকে বলেছেন, ওই অন্ধকার ঘরে থাকতে ওঁর একটুও ভাল লাগে না।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু বজ্র লামা তো সহজে ছাড়বে না। বোধ হয় বেশ আহত হয়েছে, দাঁড়াতে পারছে না। তবু নিশ্চয়ই দলবল নিয়ে খুঁজতে আসবেই। কোন্ দিক দিয়ে আসবে কে জানে? আমার ক্রাচ দুটো নেই, হাঁটব কী করে?
সন্তু বলল, আমি একদিক ধরছি। কাকাবাবু, দূরে আওয়াজ শুনতে পাচ্ছ? ঝরনার এদিকেও জঙ্গলের মধ্যে কারা যেন এসেছে।
কাকাবাবু একটুক্ষণ আওয়াজটা শুনলেন। আট-দশজন লোকের হাঁটার মসমস শব্দ হচ্ছে। বেশ খানিকটা দূরে দেখা গেল ক্যাপটেন নরবুকে। মনাস্টারির দিক থেকেও ভেসে এল ঘোড়র পায়ের শব্দ।
কাকাবাবু বললেন, আর চিন্তা নেই, পুলিশ এসে গেছে। ওরা আগে বজ্র লামার সঙ্গে বোঝাপড়া করুক। মনাস্টারি সার্চ করলেই ফিলিপ তামাং আর জগমোহনকে পেয়ে যাবে। আমরা ততক্ষণে চল একটু ফাঁকা জায়গায় গিয়ে বসে বিশ্রাম নিই। বড় ধকল গেছে। এই প্রাচীন লামা কিংবা আশ্চর্য ছেলেটিকে নিয়ে এর পর আমরা দিল্লি যাব!
প্রাচীন লামাকে সামনে নিয়ে কাকাবাবু সন্তুর কাঁধ ধরে এগিয়ে যেতে লাগলেন জঙ্গলের দিকে। উষার নীল আলো এখন সোনালি হয়ে ঝলমল করছে।