Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay » Page 5

কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay

গভীর জঙ্গলের পথ, এখান দিয়ে গাড়ি চলার কোনও প্রশ্ন নেই।

জিপটাকে রেখে আসা হয়েছে আগের গুম্ফার কাছে, ওরা চলেছে টাট্ট ঘোড়ার পিঠে। কাকাবাবুর ঘোড়ায় চড়তে কোনও অসুবিধে নেই। কাচ দুটোকে তিনি ঘোড়ার পেছনের দিকে বেঁধে নিয়েছেন।

একটু আগে সন্তু যাচ্ছে সামাজির পাশাপাশি।

ক্যাপটেন নরবু কাকাবাবুকে বললেন, রাজা, তুমি যে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে চিঠি এনেছ, সেকথা তো আমাকে আগে ঘুণাক্ষরেও জানাওনি!

কাকাবাবু বললেন, আমি রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে চিঠি আনিনি। উনি নিজেই আমাকে চিঠি দিয়েছেন। এইসব ব্যাপারে ওঁর খুব কৌতূহল। কিন্তু রাষ্ট্রপতির চিঠিটাও লামাজি মানতে চাইছিলেন না, এটা বড় আশ্চর্য ব্যাপার। তিব্বতের হাজার-হাজার রিফিউজিকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এ জন্য ভারতের কম ক্ষতি হয়নি। চিনের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়েছে। সেজন্য ওঁদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, এই লামাজি গোঁয়ার ধরনের মানুষ। উনি রাজি হলে চিঠিটা আমি মহালামাকে দেখাতাম। উনি নিশ্চয়ই রাজি হতেন। উনি খুব হাসিখুশি মানুষ। যদিও এই লামাজির কথাতেই এখানে সবাই চলে।

আচ্ছা, এই লামাজির নাম কী?

এঁর আসল নাম দোরজে লামা, কিংবা বজ্র লামা। কিন্তু সবাই শুধু লামাজি লামাজিই বলে।

এখন যে মনাস্টারিতে আমরা যাচ্ছি, সেখানে তুমি কখনও গিয়েছ?

না। মানে, দূর থেকে দেখেছি, ভেতরে যাইনি।

আশ্চর্য ব্যাপার, নরবু। এখানে তিনশো বছর বয়েসী মানুষ থাকে, তা জেনেও তোমার কখনও আগ্রহ হয়নি?

আগ্রহ থাকলেই বা উপায় কী? শুনেছি তো, ওর মধ্যে বাইরের কোনও লোককে কক্ষনো যেতে দেয় না। স্থানীয় গোখরা ওই মনাস্টারিটাকে খুব ভয় পায়।

কেন, ভয় পাবে কেন? ভগবান বুদ্ধের শিষ্যরা তো সবাই অহিংস?

এরা এক ধরনের তান্ত্রিক। সব তিব্বতিরাও এখানে আসে না। তিব্বতিদের মধ্যেও তো আলাদা আলাদা ভাগ আছে। একের সঙ্গে অন্যদের মেলে না। এই যে লামাজি, ইনি কারুর কারুর চিকিৎসা করে রোগ সারিয়ে দেন। পয়সাটয়সা কিছু নেন না। আবার কারুর ওপর খুব রেগে গেলে কঠিন শাস্তিও দেন। একবার একজন চোর নাকি এই জঙ্গলের মনাস্টারিতে ঢুকেছিল। সে অন্ধ হয়ে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে বেরিয়ে এল। কেউ তার চোখ দুটো খুবলে নিয়েছে। সারা গায়ে কোনও হিংস্র জন্তুর নোখের ফালা ফালা দাগ।

জন্তুর নোখ, না মানুষের নোখ তা বোঝা গেল কী করে? মনাস্টারির মধ্যে হিংস্র জন্তু থাকবে কী করে?

তা কে জানে! তবে মানুষের নোখ কি কারুর শরীর ওরকমভাবে চিরে দেয়। সেই থেকেই লোকের ধারণা, ওই মনাস্টারির মধ্যে নানারকম অদ্ভুত কাণ্ড ঘটে।

তোমাকে তো সাহসী লোক বলে জানতাম, নরবু! তুমিও এই সব আজগুবি কথা শুনে ভয় পাও?

এদের অলৌকিক ক্ষমতা আছে। আমি জন্তু-জানোয়ারদের ভয় পাই না। কিন্তু তান্ত্রিকরা অনেক রকম অলৌকিক কাণ্ড কারখানা ঘটিয়ে দিতে পারে। রাজা, তুমি সঙ্গে আছ বলেই আমি যাচ্ছি। না হলে যেতাম না।

ইচ্ছে করলে এখনও ফিরে যেতে পারো।

আরে না না, ফিরব কেন? তোমাকে, সন্তুকে কোনও বিপদের মধ্যে ফেলে। কি আমি পালাতে পারি? অবশ্য, এবারে কোনও বিপদের আশঙ্কা নেই। লামাজি নিজেই তো আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন। সন্তুর জন্যই এবার সব কিছু হল। সন্তুর কঙ্খাতেই উনি রাজি হলেন।

হুঁ, সন্তুর সঙ্গে ওঁর খুব ভাব জমে গেছে। দ্যাখো, দুজনে কত গল্প করছে।

তুমি তো অলৌকিকে বিশ্বাস করো না, রাজা! কিন্তু সন্তুর অসুখটা কীরকম চট করে সেরে গেল? এটা দারুণ আশ্চর্য ব্যাপার নয়!

তেমন কিছু আশ্চর্য ব্যাপার নয়। তবে, ভাল, ভাল। নিশ্চয়ই ভাল। আমি খুশি হয়েছি।

তুমি এখনও বলছ এটা আশ্চর্য ব্যাপার নয়?

কাকাবাবু আর-কিছু বলার আগেই দূর থেকে সন্তু চেঁচিয়ে বলল, কাকাবাবু, এবার ডান দিকে বেঁকতে হবে। তারপর একটা ঝরনা পড়বে। লামাজি বললেন, ঝরনাটায় বেশি জল নেই, ঘোড়া সদ্বুই পার হওয়া যাবে।

কাকাবাবু উত্তর দিলেন, ঠিক আছে।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, এই পাহাড়ি ঝোরাটার নাম ডিংলা। এক-এক সময় এটা জলে ভরে যায়, আর এত জোর স্রোত হয় যে কিছুতেই পার হওয়া যায় না। দু-একজন লোক স্রোতের টানে ভেসেও গেছে। এই ঝোরাটাই মনাস্টারিটাকে তিন দিকে ঘিরে আছে। পেছনে খাড়া পাহাড়। সেইজন্য এখানে সব সময় আসাও যায় না!

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, এটা কতদিনের পুরনো?

অনেক দিনের। এটা কিন্তু তিব্বতি রিফিউজিরা এসে বানায়নি, তার অনেক আগে থেকেই ছিল।

তা হলে তিনশো বছরের কোনও বুড়ো যদি এখানে থেকে থাকে, তা হলে সে তিব্বত থেকে আসেনি? ভারতেই জন্মেছে?

তা জানি না। তুমি এখনও যদি থাকে বলছ? এখনও বিশ্বাস করতে পারছ না?

প্রমাণ পাবার আগেই কী করে বিশ্বাস করি বলো!

জঙ্গলটা অন্ধকার হলেও ঝরনার জলে চিকচিকে জ্যোৎস্না দেখা যাচ্ছে। শোনা যাচ্ছে একটি মিষ্টি কুলুকুলু আওয়াজ।

সন্তু আগে ঘোড়া নিয়ে ছপাৎ ছপাৎ করে পার হয়ে গেল ঝরনাটা।

লামাজি দাঁড়িয়ে যেতে কাকাবাবু আর ক্যাপটেন নরবুকে বললেন, আপনারা আগে যান।

কাকাবাবুর ঘোড়াটা জলে পা দিয়েই চি হি হি করে ডেকে দুপা তুলে দিল উঁচুতে। ওর বোধ হয় জলটা বেশি ঠাণ্ডা লেগেছে। কাকাবাবু শক্ত করে ধরে রইলেন লাগাম। পা খোঁড়া হবার আগে তিনি খুব ভাল ঘোড়া চালাতেন।

তিনি ডান হাঁটু দিয়ে ঘোড়াটার পেটে একটা খোঁচা লাগাতেই সে তড়বড় তড়বড় করে ঝরনাটা পেরিয়ে এল।

এদিকে জঙ্গল অনেকটা পরিষ্কার। সামনে একটা ফাঁকা মাঠের মতন। তারপর দেখা যাচ্ছে একটা অন্ধকার বাড়ির রেখা। কোথাও আলো নেই।

অন্ধকারেই বোঝা যাচ্ছে মনাস্টারিটা বেশ বড়। ক্যা

পটেন নরবু কাকাবাবুর পাশে এসে বললেন, যাই বলল রাজা, এখান থেকে দেখলেই কেমন যেন গা ছমছম করে। কেমন যেন রহস্যময়!

কাকাবাবু হেসে বললেন, রহস্যময় বাড়ি দেখতেই আমার বেশি ভাল লাগে। সাধারণ বাড়ি তো রোজই দেখি!

লামাজি চিৎকার করে কী যেন বললেন।

একইরকম চিৎকার দু-তিনবার করার পর দূরে দপ করে জ্বলে উঠল দুটো মশাল। মনাস্টারির মধ্যে ঢং ঢং করে শব্দ হতে লাগল।

সন্তু ঘোড়া ছুটিয়ে সেই মশালের দিকে এগিয়ে গেল সবচেয়ে আগে!

ক্যাপটেন নরবু বললেন, তোমার ভাইপোটির দেখছি একদম ভয়ডর নেই।

কাছে আসতে দেখা গেল দুজন বিশাল চেহারার পুরুষ উঁচু করে ধরে আছে মশাল দুটো। তাদের ভাবলেশহীন পাথরের মূর্তির মতন মুখ।

মনাস্টারির মস্ত বড় দরজাটা নানারকম কারুকার্য করা। সেটা খুলে গেল আস্তে-আস্তে। ভেতরটা পুরোপুরি অন্ধকার। তার মধ্যেই কোথাও ঘণ্টা বাজছে।

লামাজি সবাইকে ঘোড়া থেকে নেমে পড়ার জন্য ইঙ্গিত করলেন।

মনাস্টারির ভেতর থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। তারা লামাজির কাছে হাঁটু গেড়ে বসল নিঃশব্দে। লামাজি তাদের মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদের মন্ত্র পড়লেন। একটু পরে তারা উঠে দাঁড়িয়ে ঘোড়াগুলো নিয়ে চলে গেল।

এবার মনাস্টারি থেকে বেরিয়ে এল এক বৃদ্ধ। ছোটখাটো চেহারা। মাথা, ভর্তি সাদা চুল। গায়ে একটা নানারকম ছবি আঁকা আলখাল্লা।

ক্যাপটেন নরবু ফিসফিস করে বললেন, ইনি মহালামা, মহালামা?

লামাজি, অর্থাৎ, বজ্র লামা এগিয়ে গিয়ে সেই মহালামার কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন। মহালামা তাঁর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন বিড়বিড় করে।

বজ্র লামা কী যেন জানালেন মহালামাকে। সে ভাষা ক্যাপটেন নরবুও বুঝতে পারছেন না।

মহালামা মুখ তুলে খুনখুনে গলায় বললেন, ওয়েলকাম! ওয়েলকাম!

সন্তু হঠাৎ মহালামার সামনে গিয়ে আশীর্বাদ নেবার জন্য হাঁটু গেড়ে বসল। মহালামা তার মাথাতেও হাত রেখে বললেন, ওয়েলকাম?

এবার সবাই মিলে আসা হল মনাস্টারির ভেতরে।

অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। আন্দাজে মহালামা ও বজ্র লামার পেছনে যেতে যেতে সবাই দু-তিনবার ঠোক্কর খেতে লাগল।

কাকাবাবু বললেন, একটা কোনও আলো আনা যায় না? অন্ধকারে আমাদের অসুবিধা হচ্ছে।

বজ্র লামা বললেন, খুব প্রয়োজন না হলে আমরা আলো জ্বালি না। সন্ধের পর জ্যোৎস্না কিংবা অন্ধকার যাইই থাকুক, তাতেই আমরা কাজ চালাই। আজ জ্যোৎস্না ওঠেনি। ঠিক আছে। একটা মোমবাতি জ্বালানো যাক!

তিনি জোরে জোরে দুবার হাততালি দিলেন।

এবার সন্তুর বয়েসী একটি ছেলে মোমবাতি জ্বালিয়ে নিয়ে এল। বাইরে থেকে একজন নতুন লোক এসেছে, তবু ছেলেটি কোনও কৌতূহল দেখাল না, কারও দিকে চাইল না। তার চোখ মাটির দিকে।

ছেলেটির হাত থেকে মোমটি নিলেন বৃদ্ধ মহালামা। কাছে এসে তিনি কাকাবাবুদের দলের প্রত্যেকের মুখ ভাল করে দেখলেন। বারবার বলতে লাগলেন, ওয়েলকাম ওয়েলকাম। মনে হয়, এ ছাড়া তিনি আর কোনও ইংরেজি শব্দ জানেন না।

তারপর তিনি মোমটি তুলে দিলেন লামাজি অর্থাৎ বজ্র লামার হাতে। বজ্র লামা বললেন, আপনারা আসুন আমার সঙ্গে।

ডান দিকে ঘুরে একটা গলির মতন জায়গা দিয়ে খানিকটা যাবার পর তিনি একটা ঘরের দরজা খুললেন।

এই ঘরটি ছোট, তাতে পাশাপাশি দুখানা খাট পাতা। ধপধপে সাদা চাদর পাতা বিছানা। দেওয়ালের গায়ে জাতকের অনেক ছবি আঁকা।

বজ্র লামা বললেন, আপনারা এই ঘরে বিশ্রাম করুন। প্রাচীন লামার কখন ঘুম ভাঙবে তার কোনও ঠিক নেই। হয়তো আপনাদের দু-তিনদিন এখানে অপেক্ষা করতে হতে পারে। আবার তিনি আজ রাতেও একবার জেগে উঠতে পারেন। আশা করি, এখানে থাকতে আপনাদের কোনও অসুবিধে হবে না।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, না, না, কোনও অসুবিধে হবে না। কাকাবাবু একটা খাটের ওপর বসে বললেন, সন্তু, এদিকে আয় তো!

সন্তু কাছে আসতে তিনি তার কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোর এখন কোনও কষ্ট হচ্ছে না তো?

সন্তু বলল, নো পেইন, নো ফিভার। আমার অসুখ সেরে গেছে।

কাকাবাবু একটুক্ষণ সন্তুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ভাল কথা, তোর ক্যামেরাটা বার কর।

কাকাবাবুদের জিনিসপত্র সব জিপ গাড়িতেই রেখে আসা হয়েছে। সঙ্গে আনা হয়েছে শুধু একটা ছোট্ট ব্যাগ।

সন্তু সেই ব্যাগ থেকে তার ক্যামেরা বার করল।

কাকাবাবু সেটা হাতে নিয়ে দেখে বললেন, এখনও ফিল্ম আছে পনেরোটা। ফ্ল্যাশটা ঠিক কাজ করছে তো? একবার দেখা যাক। সন্তু তুই। ক্যাপটেন নরবুর পাশে গিয়ে দাঁড়া।

ক্যামেরাটা চোখে লাগিয়ে তিনি ওদের দুজনের একসঙ্গে একটা ছবি তুললেন। ফ্ল্যাশটা ঠিকমতনই জ্বলল।

কাকাবাবু সন্তুষ্ট হয়ে ক্যামেরাটা রাখলেন কোটের পকেটে।

ক্যাপটেন নরবু একটা খাটে শুয়ে পড়ে বললেন, আজ রাত্তিরে আর কিছু হবে না মনে হয়। আচ্ছা রাজা, প্রাচীন লামাকে দেখলেও কী করে তাঁর বয়স বোঝা যাবে? ওরা তিব্বতি ভাষায় কী সব লিখে রেখেছে, তা তো তুমি কিংবা আমি কিছুই বুঝব না!

কাকাবাবু বললেন, আজকাল ডাক্তারি পরীক্ষায় মানুষের বয়েস অনায়াসে জানা যায়।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, কিন্তু তুমি তো ডাক্তার নও?

কাকাবাবু বললেন, চোখে দেখে খানিকটা তো বুঝব। একশো বছরের একজন মানুষ আর তিনশো বছরের মানুষের চেহারা তো এক হতে পারে না?

ক্যাপটেন নরবু বললেন, তিনশো বছর বয়েস হলে মানুষের চেহারা কেমন হয় কে জানে! তারা কি চোখে দেখতে পায়? কানে শুনতে পায়?

কাকাবাবু বললেন, বাইবেলে আছে, ম্যাথুসেলা নামে একজন লোক তিনশো বছর বেঁচে ছিল। বানার্ড শ নামে একজন নাট্যকারের নাম শুনেছ? তিনি বলেছিলেন, আমিও ম্যাথুসেলার মতন তিনশো বছর বাঁচতে চাই।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, রামায়ণ-মহাভারতেও এক-একজনের বয়েস দুশো-তিনশো বছর না?

সন্তু বলল, পিতামহ ভীষ্মের বয়েস কত?

কাকাবাবু বললেন, এরা সবাই গল্পের চরিত্র। সত্যিকারের কোনও মানুষ দেড়শো বছরের বেশি বেঁচেছে এমন কখনও শোনা যায়নি পৃথিবীর কোনও দেশে। তাও, দেড়শো বছরটাও সন্দেহজনক। ঠিক প্রমাণিত হয়নি। প্রাচীন লামার বয়েস যদি সত্যিই তিনশো বছর হয়, তবে তাঁকে আমি দিল্লি নিয়ে যাব। সারা পৃথিবীর সাংবাদিকদের ডেকে প্রেস কনফারেন্স করব। এটা হবে মানুষের ইতিহাসের এক পরমাশ্চর্য ঘটনা।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, প্রাচীন লামাকে এরা এই মঠের বাইরে নিয়ে যেতে দেবে?

কাকাবাবু কিছু উত্তর দেবার আগেই দরজা খুলে ঢুকল একজন লোক। একটা কাঠের গোল ট্রেতে চা ও রুটি, তরকারি সাজানো।

ঘরে কোনও টেবিল-চেয়ার নেই। ট্রে-টা একটা বিছানার ওপর রেখে লোকটি ক্যাপটেন নরবুকে কী যেন বলে চলে গেল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী বলল লোকটি?

ক্যাপটেন নরবু জানালেন, আমাদের খেয়ে নিতে বলল। আধ ঘণ্টা বাদে বজ্র লামা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

কাকাবাবু বললেন, এত চটপট আমাদের জন্য খাবার তৈরি হয়ে গেল? এ যে অনেক রুটি দিয়েছে!

ওরা খাওয়া শেষ করার খানিকবাদে বজ্র লামা এলেন সেই ঘরে। এখন তিনি একটা সিল্কের আলখাল্লা পরে এসেছেন, তাতে বিরাট করে একটা ড্রাগন আঁকা। তাঁর হাতে একগোছা জ্বলন্ত ধূপকাঠি। সেই ধূপের গন্ধ সাধারণ ধূপের মতন নয়। গন্ধটা অচেনা আর খুব তীব্র।

বজ্র লামা বললেন, আপনারা সৌভাগ্যবান। বেশি অপেক্ষা করতে হল না। প্রাচীন লামা একটু আগে জেগে উঠেছেন। টানা তিন দিন তিনি ঘুমিয়েছিলেন।

কাকাবাবু বললেন, তা হলে এখন নিশ্চয়ই তিনি খাওয়া-দাওয়া করবেন? আমরা কি তা হলে একটু পরে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পাব?

বজ্র লামা হেসে বললেন, তিনি কিছু খান না। আপনারা এখনই যেতে পারেন।

ক্যাপটেন নরবু জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কিছুই খান না?

বজ্র লামা বললেন, গত পঞ্চাশ বছর ধরে আমি দেখছি, উনি ঘুম থেকে উঠে শুধু এক গ্লাস জল পান করেন, আর একটা গাছের শিকড় চিবোন।

কাকাবাবু আর ক্যাপটেন নরবু একসঙ্গেই জিজ্ঞেস করলেন, কোন্ গাছের শিকড়?

বজ্র লামা বললেন, তা আমিও জানি না। দেখে চিনতেও পারি না। কোনও একটা গাছের শুকনো শিকড়। ওঁর কাছে অনেকখানি আছে। উনি সামান্য একটুখানি চিবিয়ে খান। যতটা আছে, তাতে উনি আরও দুশো বছর খেতে পারবেন?

কাকাবাবু অবিশ্বাসের সুরে বললেন, শুধু গাছের শিকড় চিবিয়ে মানুষ বাঁচতে পারে? গাছের শিকড় খেয়ে দীর্ঘজীবী হওয়া যায়? তা হলে তো সেই শিকড় পরীক্ষা করে দেখা উচিত। সেই শিকড় খুঁজে বার করে আরও অনেক মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা যায়।

বজ্র লামা বললেন, সব মানুষের তো বেশিদিন বেঁচে থাকার প্রয়োজন হয়। এঁর দিব্য দৃষ্টি আছে। এঁর জীবনের মূল্য অনেক। ইনি ভগবান বুদ্ধের পুনর্জন্মের পর মৈত্রেয়কে দেখে চিনতে পারবেন। সেইদিন ঘনিয়ে এসেছে।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, ওঁকে দেখে আসি।

বজ্র লামা জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তিন জনেই যাবেন? না শুধু আপনি একা দেখবেন?

সন্তু আর ক্যাপটেন নরবু একসঙ্গে বলে উঠল, আমরাও দেখব?

বজ্র লামা বললেন, সবাই ওর দৃষ্টি সহ্য করতে পারে না। ওর চোখের দিকে তাকালেই অনেকে অজ্ঞান হয়ে যায়। এর আগে এরকম হয়েছে। সেইজন্যই তো ওঁর সঙ্গে বাইরের লোকের দেখা করতে দিই না। এমনকী আমি নিজেও ওঁর চোখের দিকে পাঁচ মিনিটের বেশি তাকিয়ে থাকতে পারি না?

কাকাবাবু বললেন, দিব্য দৃষ্টি কাকে বলে জানি না। কখনও দেখিনি। এই সুযোগটা আমরা কেউই ছাড়তে চাই না।

বজ্র লামা সন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার কাছে ক্যামেরা আছে?

সন্তু অমনি কাকাবাবুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল, ওঁর কাছে আছে।

বজ্র লামা বললেন, ক্যামেরাটা অনুগ্রহ করে এখানে রেখে যান। কেউ নেবে না।

কাকাবাবু বললেন, ওঁর একটা ছবি তোলা যাবে না?

বজ্র লামা বললেন, সে প্রশ্নই ওঠে না। মহাপুরুষদের সামনে ছেলেখেলা চলে না।

কাকাবাবু ক্ষুন্নভাবে ক্যামেরাটা কোটের পকেট থেকে বার করে রেখে দিলেন।

বজ্র লামা বললেন, আর-একটা অনুরোধ, সেখানে গিয়ে কোনও শব্দ করবেন না, কথা বলবেন না। প্রাচীন লামাকে কোনও প্রশ্ন করে লাভ নেই, উনি আপনাদের ভাষা কিছু বুঝবেন না। আপনারা জুতো খুলে রেখে আমার সঙ্গে চলুন।

বজ্র লামার এক হাতে ধূপকাঠির গোছা, অন্য হাতে তিনি তুলে নিলেন এই ঘরের মোমবাতিটা।

তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে একটা সরু গলি পার হয়ে ওঁরা এলেন মনাস্টারির মূল জায়গাটায়। এই ঘরটা বিশাল, যেমন চওড়া, তেমনি উঁচু। একদিকে রয়েছে প্রকাণ্ড এক বুদ্ধমূর্তি, প্রায় দশ ফুট লম্বা তো হবেই। সেই মূর্তির দুপাশে জ্বলছে বড় বড় প্রদীপ। সেই প্রদীপের আলোতে এত বড় ঘরে অন্ধকার কাটেনি, অদ্ভুত এক আলো-আঁধারি সব দিকে। দেওয়ালে-দেওয়ালে আরও অসংখ্য মূর্তি রয়েছে, সেগুলো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

ক্যাপটেন নরবু হিন্দু হলেও মাটিতে কপাল ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন সেই বুদ্ধমূর্তির উদ্দেশে। তাঁর দেখাদেখি সন্তুও তাই করল। কাকাবাবু প্রণাম করলেন হাত জোড় করে।

বজ্র লামা সেই ঘরের এক কোণের একটা দরজা খুলে ফেললেন। তারপর নামতে লাগলেন ঘুটঘুটে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে। এইসব মনাস্টারিতে যে মাটির তলায় ঘর থাকে, তা কাকাবাবু জানতেন না।

ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেশ দুরের একটা ঘরে নিয়ে এলেন বজ্র লামা।

সেই ঘরের সামনে একজন লোক মাটিতে বসে ঘুমে ঢুলছে। সে এতই। ঘুমোচ্ছিল যে, তার মাথাটা মাঝে-মাঝে ঠেকে যাচ্ছে মেঝেতে।

বজ্র লামা একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে লোকটিকে দেখলেন, তারপর হঠাৎ খুব জোরে একটা লাথি মারলেন তার মুখে।

লোকটি আঁক করে চেঁচিয়ে উঠল। তারপর বজ্র লামাকে দেখেই জড়িয়ে ধরল তাঁর দুপা। কান্না কান্না সুরে কী যেন বলতে লাগল।

বজ্র লামা তার চুলের মুঠি ধরে টেনে তুলে একপাশে সরিয়ে দিলেন। তারপর তাকে কিছু একটা আদেশ দিয়ে, ঠেলে খুললেন দরজা।

এই ঘরের মধ্যেও নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। বজ্র লামার হাতের মোমটার সমস্ত আলো সেই অন্ধকার ভেদ করতে পারছে না।

বজ্র লামা তাঁর হাতের ধূপকাঠির গুচ্ছ একদিকের দেওয়ালে কিসে যেন গুঁজে দিলেন। নিভিয়ে দিলেন মোমবাতিটা।

ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকুন। মহাপুরুষ প্রাচীন লামাকে ঠিক সময় দেখতে পাবেন।

ঘরের মধ্যে ধূপের গন্ধ ছাড়াও আরও কিসের যেন গন্ধ। কাছেই কোথাও একটা গোঁ-গোঁ আওয়াজ শুরু হল। অনেকটা কোনও যন্ত্রের শব্দের মতন। কাকাবাবু দাঁড়িয়ে আছেন সন্তু আর ক্যাপটেন নরবুর মাঝখানে, হাত দিয়ে ওদের ছুঁয়ে রইলেন।

অন্ধকারের মধ্যে বজ্র লামাকে আর দেখাই যাচ্ছে না।

এক মিনিট, দুমিনিট, তিন মিনিট করে সময় কাটতে লাগল, বজ্র লামা আর কিছুই বলছেন না। অন্ধকারের মধ্যে এরকমভাবে দাঁড় করিয়ে রাখার মানে কী হয়, তা কাকাবাবু বুঝতে পারছেন না। তবু তিনি ধৈর্য ধরে রইলেন।

হঠাৎ ধূপগুলো থেকে ফস-ফস শব্দ হতে লাগল। তারপরেই ফুলঝুরির মতন সেগুলো থেকে ঝরে পড়তে লাগল আলোর ফুলকি। সে-এক বিচিত্র আলো। কাকাবাবুরা তিনজনেই চমকে সেদিকে তাকালেন। ধূপকাঠি থেকে এরকম আলো বেরোতে কেউ কখনও দেখেনি।

সেই আলোর ফুলকিতেই অন্ধকার খানিকটা কেটে গেল। তাতে দেখা গেল, একদিকে একটা উঁচু বেদী, তার ওপরে একজন মানুষ শুয়ে আছে। একটা চাদরে বুক পর্যন্ত ঢাকা। মানুষটি পাশ ফিরে আছে। এদিকেই মুখ।

আলোর ফুলকিগুলো ক্রমশই জোরালো হল। তখন দেখা গেল উঁচু বেদীর ওপর শুয়ে থাকা মানুষটির মুখ।

কাকাবাবু বিস্ময় চেপে রাখতে পারলেন না। তিনি বলে উঠলেন, এ কী?

শুয়ে থাকা মানুষটির মুখ একটি বালকের মতন। তেরো-চোদ্দ বছরের বেশি বয়েস বলে মনে হয় না। অত্যন্ত ফরসা, পরিষ্কার মুখ, মাথার চুলগুলো শুধুধপধপে সাদা!

দূর থেকে বজ্র লামা বললেন, প্রাচীন লামাকে প্রণাম করুন। কাকাবাবু বললেন, ইনি প্রাচীন লামা? বজ্র লামা মন্ত্রপাঠের মতন গমগমে গলায় বললেন, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না? মহাযোগীদের শরীর অনবরত বদলায়। শরীরে বার্ধক্য আসে, বার্ধক্যের শেষ সীমায় পৌঁছবার পর আবার শৈশব ফিরে আসে। তখন শরীরটা শিশুর মতন হয়ে যায়। তারপর যৌবন, আবার বার্ধক্য, আবার শৈশব। একই শরীরে বারবার এই পালা চলে।

ক্যাপটেন নরবু বলে উঠলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, এইরকমই হয়। আমিও শুনেছি।

সন্তু বলল, কী সুন্দর, ওঁকে কী সুন্দর দেখতে! কিন্তু এখানে এত কঙ্কাল কেন?

ধূপকাঠির আলোর ফুলকিতে এখন দেখা যাচ্ছে, উঁচু বেদীটার পেছনের দেওয়ালে সারি সারি মড়ার মাথার খুলি!

কাকাবাবু হাতজোড় করে বেশ জোরে বললেন, হে মহামানব প্রাচীন লামা, আমাদের প্রণাম গ্রহণ করুন।

তারপর একটুখানি এগিয়ে এসে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমি কি ওঁর পা ছুঁয়ে একবার প্রণাম করতে পারি?

বজ্র লামা ধমক দিয়ে বললেন, দাঁড়ান! আর এগোবেন না। উনি কোনও মানুষের স্পর্শ সহ্য করতে পারেন না। অপেক্ষা করুন, উনি একটু পরেই চোখ মেলবেন।

বালকের মতন মুখ, সেই প্রাচীন লামার চক্ষু দুটি বোজা। ঠোঁটে হাসি মাখানো। সত্যি, ভারী সরল, সুন্দর সেই মুখ। শুধু মাথাভর্তি পাকা চুল দেখলে গা শিরশির করে।

ক্যাপটেন নরবু কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, দেখা হয়ে গেছে! আমার দেখা হয়ে গেছে!

কাকাবাবু বললেন, চুপ! বালকবেশি প্রাচীন লামা আস্তে-আস্তে চোখ মেললেন।

সঙ্গে-সঙ্গে এক অদ্ভুত কাণ্ড শুরু হল। সারা ঘরের মধ্যে বিদ্যুতের মতন। আলো ঝলকাতে লাগল। ঠিক আকাশের বিদ্যুতের মতনই ছুটন্ত আলো। প্রত্যেকটা মড়ার মাথার খুলির চোখ দিয়ে আলো বেরোতে লাগল। সব মিলিয়ে এত আলো যে, চোখ ধাঁধিয়ে যায়।

বালকবেশি প্রাচীন লামা এবার উঠে বসলেন।

তাঁর মাথায় চার পাশেও ঘুরতে লাগল আলো। তাঁর শরীর থেকেও যেন আলো বেরোচ্ছে। তিনি আশীবাদের ভঙ্গিতে হাত তুললেন এঁদের দিকে।

ক্যাপটেন নরবু হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে নিজের ভাষায় মন্ত্র পড়তে শুরু করলেন।

সন্তু দুহাতে চোখ ঢেকে বলে উঠল, জ্বালা করছে! আমার চোখ জ্বালা করছে।

কাকাবাবু দ্রুত এগিয়ে গিয়ে উঁচু বেদীটার ওপর এক হাতের ভর দিয়ে অন্য হাতে ছুঁয়ে দেখতে গেলেন প্রাচীন লামাকে।

কিন্তু তাঁর গায়ে হাত দেবার আগেই কাকাবাবু আঃ করে প্রবল এক আর্তনাদ করে ধপাস করে পড়ে গেলেন মেঝেতে। সেই মুহূর্তেই তাঁর জ্ঞান চলে গেল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress