Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay » Page 4

কাকাবাবু ও বজ্র লামা || Sunil Gangopadhyay

সন্তু চোখ মেলে দেখল, তার মাথার দুপাশে মুখ কুঁকিয়ে রয়েছেন কাকাবাবু আর ক্যাপটেন নরবু। দুজনের মুখেই দারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ। জানলা দিয়ে। দিনের আলো এসে পড়েছে। সকাল হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

প্রথমে সন্তুর ঠিক মনে পড়ল না, সে কোথায় শুয়ে আছে।

সে ভাবার চেষ্টা করল। কী হয়েছিল কাল সন্ধেবেলা? কাকাবাবু দার্জিলিং ফিরে যাবার নাম করে সুখিয়াপোখরিতে নেমে গেলেন। এখানে তাঁর বন্ধু। ক্যাপটেন নরবুর বাড়ি। এখানেই তিনি আসতে চেয়েছিলেন? তা হলে দার্জিলিং থেকেই তো সহজে আসা যেত। শিলিগুড়ি বাগডোগরা ঘুরে আসার কী দরকার ছিল?

তার জ্বর হয়েছিল, ক্যাপটেন নরবু কী যেন ওষুধ খেতে দিলেন। তাতে জ্বর কমে গেল। রাত্তিরে ময়ূরের মাংসও কয়েক টুকরো খেয়েছিল গরম গরম চাপাটির সঙ্গে। তারপর? খেতে-খেতেই তার ঘুম পেয়ে গিয়েছিল খুব। টেবিলের ওপর চুলে ঢুলে পড়ছিল। তারপর আর তার মনে নেই।

কাকাবাবু বললেন, একশো পাঁচ জ্বর মনে হচ্ছে। গা এত গরম! তোমার বাড়িতে থার্মোমিটারও নেই।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, ছিল; ভেঙে গেছে। হ্যাঁ জ্বরটা খুব বেশিই।

কাকাবাবু বললেন, কী ওষুধ তুমি দিলে? কোনও কাজই হল না!

ক্যাপটেন নরবু বললেন, ওষুধ খেয়ে কাল জ্বর অনেক কমে গিয়েছিল। আবার হল। কোনও ভাইরাস ইনফেকশান মনে হচ্ছে।

কাকাবাবু বললেন, নিশ্চয়ই তাই। তুমি শিগগির জিপের ব্যবস্থা করা। ওকে এক্ষুনি শিলিগুড়ি নিয়ে যেতে হবে। তোমাদের এখানে তো আর কোনও ডাক্তার নেই বললে।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, একজন অ্যালোপাথ ডাক্তার ছিল, সে ছুটিতে গেছে। কিন্তু এই অবস্থায় কি ছেলেটাকে গাড়িতে এতটা রাস্তা নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে, রায়চৌধুরী? তাতে ওর আরও স্ট্রেইন হবে?

সন্তু উঠে বসার চেষ্টা করল, পারল না। তার মাথাটা যেন একশো কিলো ভারী।

কাকাবাবু ধমকের সুরে ক্যাপটেন নরবুকে বললেন, নিয়ে যেতেই হবে। না হলে ওকে আমি এখানে বিনা চিকিৎসায় ফেলে রাখব নাকি?

ক্যাপটেন নরব সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, কী মাস্টার সন্তু, তোমার কষ্ট হচ্ছে?

সন্তু আজ আর মিথ্যে কথা বলতে পারল না। জ্বরের ঘোরে তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। কোনওরকমে সে বলল, মাথায় খুব ব্যথা। সারা গায়েও ব্যথা!

ক্যাপটেন নরবু বললেন, কালকের বৃষ্টিতে রাস্তা আরও খারাপ হয়ে গেছে। যাওয়া মুশকিল হবে। আমাদের এখানে বর্ষাকালে এমন হয়। মাঝে-মাঝে দু-তিন দিন কোথাও যাওয়া যায় না।

কাকাবাবু দৃঢ় গলায় বললেন, তোমার জিপটা বার করো। যেমন করেই হোক যাবার চেষ্টা করতেই হবে।

সন্তুর কোনও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, তার কান্না পাচ্ছে। তার শরীরটা এমনই দুর্বল যে উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তার জন্য কাকাবাবুকে শিলিগুড়িতে ফিরে যেতে হচ্ছে। কিন্তু কাকাবাবুর নিশ্চয়ই অন্য কিছু প্ল্যান ছিল। একটা হতচ্ছাড়া অসুখের জন্য সব ভেস্তে গেল।

ক্যাপটেন নরবু সন্তুকে পাঁজাকোলা করে বিছানা থেকে তুলে নিয়ে এলেন বারান্দায়। একটা চেয়ারে তাকে বসিয়ে তিনি জিপটা আনতে গেলেন।

কাকাবাবু বারবার সন্তুর কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখছেন। কাকাবাবুকে এতটা বিচলিত হতে সন্তু কখনও দেখেনি। কিন্তু সন্তু কী যে বলবে, কোনও কথাই খুঁজে পাচ্ছে না। অসুখটা তাকে একেবারে কাবু করে দিয়েছে।

ক্যাপটেন নরবু জিপটাকে নিয়ে এলেন বারান্দার কাছে। জিপের পেছন দিকে তোশক-চাদর পেতে বেশ পুরু একটা বিছানা বানালেন। তারপর সন্তুকে শুইয়ে দিলেন সেখানে।

জিপের স্টিয়ারিং-এ বসলেন ক্যাপটেন নরবু, কাকাবাবু তাঁর পাশে। বাড়ির সামনের রাস্তাটা এত সরু যে, মনে হয় ওখান দিয়ে গাড়ি চলতে পারে না। কিন্তু জিপটা ঠিকই বেরিয়ে গেল। শুধু একবার একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে খুব জোর লাফিয়ে উঠল। তখন সন্তুও বিছানা থেকে ছিটকে খানিকটা ওপর দিকে উঠে গিয়েছিল। তাতে তার মাথার মধ্যে ঠিক যেন ভূমিকম্প হতে লাগল। যেন মনে হতে লাগল, আকাশ আর পৃথিবী উলটো দিকে বোঁ-বোঁ করে ঘুরছে। জিপ গাড়িটা ওলট-পালট খাচ্ছে শুন্যে।

সন্তুর এই অবস্থার মধ্যে একবার মনে হল, সে কি মরে যাচ্ছে? আগে তো কখনও তার মাথার এই অবস্থা হয়নি। না, সে কিছুতেই মরতে চায় না। কলকাতায় ফিরে মা বাবার সঙ্গে দেখা করার আগে এমনি-এমনি মরে যাওয়া খুব বাজে ব্যাপার!

প্রচণ্ড জ্বর ও মাথাব্যথার জন্য সন্তুর চোখ বুজে এলেও তার জ্ঞান আছে ঠিকই, সে সবরকম শব্দ, কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছে।

জিপটা টিলার নীচে নেমে এসে চায়ের দোকানের পাশে বেঁকল। সেই দোকানের সামনে আজও কয়েকটা ছেলে ক্যারম খেলছে। ক্যাপটেন নরবু ওদের সঙ্গে নেপালি ভাষায় দু-একটা কী যেন কথা বললেন।

তারপর আবার জিপটা স্টার্ট দেবার পর তিনি কাকাবাবুকে বললেন, রায়চৌধুরী, একটা কথা বলব? প্রথমেই না বলল না, আগে শোনো! আমি খবর নিয়ে জানলাম, সুখিয়াপোখরি থেকে একটু নীচে, মিরিকে পৌঁছবার আগেই সিমানা বলে একটা জায়গায় রাস্তা ভেঙে গেছে। অন্য গাড়ি তো যেতে পারছেই না, জিপও যাবে কি না সন্দেহ আছে।

কাকাবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, আগে সেই পর্যন্ত চলল, তারপর দেখা যাবে।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আমি অন্য একটা কথা সাজেস্ট করছি। এখানে। আমার চেনা একজন তিব্বতি লামা আছেন, তাঁর খুব নামডাক। সব অসুখ তিনি ইচ্ছে করলে সারিয়ে দিতে পারেন। পুরনো আমলের অনেক গোপন মন্ত্র তিনি জানেন, তা দিয়ে সব রোগ তিনি দূর করে দেন। তাঁর কাছে একবার মাস্টার সন্তুকে নিয়ে যাব?

কাকাবাবু বললেন, দ্যাখো নরবু, মন্তর-ফন্তরে আমার কোনও বিশ্বাস নেই। তবু অন্য সময় হলে আমি লোকটিকে গিয়ে দেখতাম। কিন্তু এখন আমার ভাইপো খুব গুরুতর রকমের অসুস্থ। এখন ওসব ছেলেখেলার প্রশ্রয় দিতে আমি একদম রাজি নই। সন্তুর জীবনের দাম আমার চেয়েও বেশি। তুমি শিগগির শিলিগুড়ি চলো তো! ওকে ভাল ডাক্তার দেখাতে হবে, দরকার হলে নার্সিংহোমে ভর্তি করে দিতে হবে।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, রায়চৌধুরী, সেই তিব্বতি লামা সহজে কারুকে দেখেন না। আমি বললে তিনি রাজি হতে পারেন। তিনি বেশি দূরে থাকেন না। বড় জোর ডিটুর করার জন্য এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগবে শিলিগুড়ি পৌঁছতে। একবার ঘুরে যেতে দোষ কী? তুমি রাজি থাকলে বলো, গাড়ি ঘোরাই।

কাকাবাবু জেদির মতন বললেন, না, আমি রাজি নই!

ক্যাপটেন নরবু এবার বেশ শব্দ করে হেসে উঠে বললেন, তুমি ঠিক আগের মতনই জেদি আছ! বাংলায় কী যেন বলে, গোঁয়ারগোবিন্দ, তাই না? তুমি রাজি না থাকলেও আমি মানেভঞ্জনের দিকটা ঘুরেই যাব। লামাজিকে দেখিয়েও যদি সন্তুর কোনও উপকার না হয়, তা হলে চটপট নেমে যাব শিলিগুড়ির দিকে। ওই দিকে একটা শর্টকাট আছে, হয়তো সে রাস্তাটা ভাল থাকতেও পারে। রায়চৌধুরী তোমার ভাইপোর অসুখ, সেজন্য কি আমার চিন্তা কিছু কম?

কাকাবাবু আর কোনও কথা না বলে গুম হয়ে গেলেন। রাস্তাটা ক্রমশই ওপরের দিকে উঠে যাচ্ছে, এক সময় মূল রাস্তা ছেড়ে একটা সরু পথে ঢুকে পড়ল। দুপাশে গভীর জঙ্গল। এদিকে আর কোনও গাড়ি দেখা যাচ্ছে না। রাস্তার পাশে বাড়ি-ঘরও নেই।

বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকার পর কাকাবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে নরবু, তুমি বলছ, এখানে তিব্বতি লামাদের মধ্যে তিনশো বছরের বুড়ো লোক বেঁচে আছে?

নরবু বললেন, হ্যাঁ আছে। দুজন।

কাকাবাবু আবার বললেন, তিনশো বছর বয়েস? তা কখনও হতে পারে? তুমি তো নিজের চোখে তাদের দেখোনি?

না, তা দেখিনি। সেই মনাস্টারিটা খুব রিমোট জায়গায়। তার ভেতরে সবাইকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। খুব কড়াকড়ি। তবে আমি খুব বিশ্বাসযোগ্য লোকের কাছ থেকে শুনেছি, সেখানে ওরকম দুজন মানুষ আছে। তাঁরা এখনো হাঁটতে পারেন, কথা বলতে পারেন।

কিন্তু কী করে বোঝা যাবে, তাদের বয়েস তিনশো বছর?

যারা দেখেছে, তারা শুধু শুধু মিথ্যে কথা বলবে কেন? জানো রায়চৌধুরী, এই সব পাহাড়ি মানুষেরা মিথ্যে কথা বলেই না।

মিথ্যে কথা বলবে না, কিন্তু তাদের তো ভুল হতে পারে? পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সবচেয়ে বুড়ো লোকের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার বয়েস একশো বেয়াল্লিশ বছর। তাও সেই বয়েসটা সঠিক কি না, ঠিক প্রমাণ করা যায়নি। কোনওরকম ডাক্তারি পরীক্ষা তো হয়নি। অনেক সময় হয় কী জানো, যারা বলে তাদের বয়েস একশ বছরের বেশি, তারা অনেক সময় বছর গুনতে ভুলে যায়।

তুমি কী বলছ, রায়চৌধুরী? পাঞ্জাবে আমি একজন বুড়ো লোকের সন্ধান পেয়েছিলাম, সে নিজের চোখে সিপাহি যুদ্ধের কিছু কিছু ঘটনা দেখেছে। নানা সাহেকে দেখেছে! সে-ও তো প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগেকার ব্যাপার। তা হলে ওর বয়েস কত বুঝে দেখো!

ওসব একদম বাজে কথা! পুরনো আমলের গল্প শুনতে-শুনতে অনেক সময় মনে হয়, সেটা আমরা নিজের চোখে দেখেছি। আমাদের ঠাকুমা-দিদিমারা ছেলেবেলার অনেক গল্প বলেন, তখনও এরকম হয়। আমাদের গ্রামের বাড়িতে একবার একটা চিতা বাঘ ধরা পড়েছিল। তখন বাংলাদেশের গ্রামে প্রায়ই বাঘ আসত। একটা চিতা বাঘ এসে ঢুকে পড়েছিল আমাদের গোয়াল ঘরে। আমার ঠাকুর্দা বন্দুকের গুলিতে তার একটা পা খোঁড়া করে দেন। আমার এক কাকা ছিলেন দারুণ সাহসী, তিনি বস্তা চাপা দিয়ে সেই চিতা বাঘটাকে বেঁধে ফেলেন। পরে সেটাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় এক জমিদারের চিড়িয়াখানায়। এটা সত্যি ঘটনা, আমি ছোটকাকার পেছনে দাঁড়িয়ে সব দেখেছিলাম। ছোটকাকা যখন বাঘটাকে বস্তা চাপা দিয়ে বাঁধছেন, তখন আমি তাঁকে দড়ি এগিয়ে দিয়েছি। বাঁধা পড়ে গিয়ে বাঘটা গাঁক গাঁক করে হুঙ্কার ছাড়ছে, সেই আওয়াজ আজও স্পষ্ট শুনতে পাই। কিন্তু পরে হিসেব করে দেখেছি, ওই ঘটনাটা ঘটেছিল আমার জন্মের দুবছর আগে! গল্পটা বারবার শুনতে শুনতে কল্পনায় আমি নিজেকে তার মধ্যে দাঁড় করিয়ে দিয়েছি। ওই সিপাহি যুদ্ধ দেখার ব্যাপারটাও সেরকম?

কিন্তু এই তিনশো বছরের বৃদ্ধ লামাদের বংশধররা এখানেই আছে। তারা সাক্ষী দেবে।

তিনশো বছরের কোনও লোকের বংশধর, তার মানে হল বারো জেনারেশন! এই বারো জেনারেশন আগেকার পূর্ব পুরুষদের সম্পর্কে কিছু মনে রাখাও অসম্ভব ব্যাপার। তুমি তোমার ঠাকুর্দার যিনি ঠাকুর্দা ছিলেন, তাঁর নাম বলতে পারো? বলল, পারবে?

আমি পারব না। কিন্তু তিব্বতি লামারা তাদের বংশ পরিচয়ের খুব ভাল। রেকর্ড রাখে। দশবারো জেনারেশানের নাম মুখস্থ বলে দিতে পারে।

নাম মুখস্থ রাখলেও বারো জেনারেশান আগেকার ঠাকুদার চেহারা মনে রাখা কিংবা তাকে আইডেন্টিফাই করা একটা গাঁজাখুরি ব্যাপার!

তুমি দেখছি, কিছুই বিশ্বাস করতে চাও না। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, এখানে তিনশো বছর বয়েসী মানুষ আছে। সেই ছেলেবেলা থেকে একথা শুনে আসছি।

আরে, সত্যি-সত্যি একজন তিনশো বছর বয়েসী মানুষ খুঁজে বার করতে পারলে সারা পৃথিবীতে হইচই পড়ে যাবে! বিরাট খবর হবে। বিজ্ঞানের জগতে একটা আলোড়ন পড়ে যাবে। সেরকম কেউ তোমাদের সুখিয়াপোখরিতে লুকিয়ে থাকবে কেন?

ওঁরা পাবলিসিটি চান না। বাইরের লোকের কাছে দেখা দিতেও চান না। এঁদের কিছু একটা সাঙ্ঘাতিক ওষুধ আছে। সেই ওষুধ খেয়ে এরা অনেক দীর্ঘজীবন পেতে পারেন।

সন্তুর হঠাৎ এরকম অসুখ না হয়ে পড়লে আমি একবার যাচাই করে আসতাম নিশ্চয়ই। সেই বুড়োদের ছবি তুলে আনতাম। এবার ফিরে যেতে হচ্ছে। আবার শিগগিরই আসব।

গোটা দু-এক পাহাড় পেরোবার পর জিপটা এল আর একটা পাহাড়ের পাদদেশে। এখানে একটা ছোটখাটো গ্রাম রয়েছে। কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে জিপ গাড়ির শব্দ শুনে ছুটে বেরিয়ে এল। এরা গাড়ি খুব কম দেখে। এই গ্রামটা একটা তিব্বতি উদ্বাস্তুদের কলোনি।

গ্রামের শেষের দিকে একটি মাঝারি মতন বৌদ্ধ গুম্ফা।

সেই গুফা থেকে একটু দূরে জিপটা থামল। সামনের উঠোনে বড় বড় চাটাই পাতা, তার ওপর কী যেন একটা ফল শুকোচ্ছে। একটা বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোৰু একপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আস্তে-আস্তে, কিন্তু সে একবারও চাটাইয়ে পা ফেলছে না, কিংবা ফলগুলোতে মুখ দিচ্ছে না।

জিপটা থামতেই কাকাবাবু পেছন দিকে ঝুঁকে সন্তুর কপালে হাত দিয়ে দেখলেন।

সন্তুর জ্বর সেই একই রকম। তার নিশ্বাসে আগুনের হস্কা। সে চোখ বুজে আছে।

কাকাবাবুর চোখ ছলছল করে এল। তিনি বললেন, এখানে দশ মিনিটের বেশি কিছুতেই সময় নষ্ট করা যাবে না। তারপরেই শিলিগুড়ির দিকে ছুটতে হবে?

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আমি আগে গিয়ে লামাজির সঙ্গে দেখা করে কথা বলে আসি। ওঁর মুডের ব্যাপার আছে। সব সময় রাজি হন না।

ক্যাপটেন নরবু চলে যেতেই কাকাবাবু ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, সন্তু, সন্তু তোর খুব কষ্ট হচ্ছে?

সন্তু শুধু উ উ করল দুবার। সে কোনও কথা বলতে পারছে না। কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, জল খাবি? তেষ্টা পেয়েছে? সন্তু বলল, হুঁ।

আসবার সময় ক্যাপটেন নরবু একটা ওয়াটার বটুল ভর্তি করে এনেছিলেন। কাকাবাবু সেটা খুলে সন্তুকে জল খাওয়াবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সন্তু ঢোঁক ৫০৮

গিলতেও পারল না, সব জল গড়িয়ে পড়ে গেল তার মুখের দুপাশ দিয়ে।

ক্যাপটেন নরবু ছুটতে-ছুটতে ফিরে জিপের পেছনটা খুলতে লাগলেন।

কাকাবাবুকে বললেন, উনি সহজে রাজি হতে চান না। আজকে ওঁর তন্ত্র সাধনার দিন। বাইরের লোকের সঙ্গে দেখা করেন না। আমার সঙ্গে অনেক দিনের চেনা। আমি এখানে কমলালেবু সাপ্লাই করি। এখানকার মহালামাকে আমি দুবার আমার জিপে শিলিগুড়ি পৌঁছে দিয়েছি। তাও বললেন, আজ রুগি দেখবেন না। তখন আমি বললাম, দেখুন লামাজি, এই বাঙালিবাবু দুবার আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন। আমি ওঁদের নিয়ে এসেছি। এখন আপনি যদি ওদের ফিরিয়ে দেন, তা হলে আমার খুব অপমান হবে। আমি আর আপনাদের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখব না, তখন উনি বললেন, ঠিক আছে, রুগিকে নিয়ে এসো।

কাকাবাবু বললেন, নরবু, তোমার এই লামা যদি সন্তুর কোনও উপকার করতে না পারেন, তা হলে কিন্তু আমি তোমার ওপর খুব চটে যাব। তুমি শুধু শুধু সময় নষ্ট করাচ্ছ! আমি এসব তন্ত্র-মন্ত্রে বিশ্বাস করি না।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, একবার একটু বিশ্বাস করে দ্যাখোই না!

তারপর তিনি সন্তুকে দুহাতে তুলে নিয়ে দ্রুত এগোলেন গুম্ফার দিকে।

বড় দরজাটা দিয়ে ঢুকে বাঁ দিকে একটুখানি গিয়ে একটা সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগলেন ক্যাপটেন নরবু। তাঁর পেছনে কাকাবাবুর ক্র্যাচের খটখট শব্দ হল। এ ছাড়া চতুর্দিক একেবারে নিস্তব্ধ।

ক্যাপটেন নরবু সন্তুকে নিয়ে এলেন মাটির তলার একটি ঘরে। ঘরটি বেশ বড়। সমস্ত দেওয়াল ভর্তি হাতে-লেখা বই। মাঝে-মাঝে ছোট-ছোট পেতলের মূর্তি দেওয়ালে গাঁথা। বাইরের কোনও আলো এ-ঘরে ঢোকে না। কিন্তু এখানে ইলেকট্রিসিটি আছে। একটা বেশ বেশি পাওয়ারের বা সিলিং থেকে ঝুলছে।

একদিকের দেওয়ালের কাছে একটা জলচৌকির ওপর একটা বাঘ-ছাল পাতা। বাঘের মুণ্ডটাও রয়েছে সামনের দিকে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। সেই বাঘ-ছালের ওপর জোড়াসন করে বসে আছেন একজন পুরুষ। বসে থাকা অবস্থাতেই বোঝা যায়, তিনি খুব লম্বা-চওড়া মানুষ। দাড়ি-গোঁফ নেই, পরিষ্কার মুখ, গায়ে একটা নানা রঙের আলখাল্লা।

ক্যাপটেন নরবু সন্তুকে ওই পুরুষটির ঠিক সামনে, মেঝের ওপরেই শুইয়ে দিলেন। তারপর একটু সরে গিয়ে হাত জোড় করে বসলেন। কাকাবাবুও তাঁর দেখাদেখি বসলেন একপাশে, কিন্তু হাত জোড় করলেন না।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, নমস্তে লামাজি! এই ছেলেটির একটা ব্যবস্থা করে দিন দয়া করে। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে।

লামাজি প্রথমে কাকাবাবুর দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। কাকাবাবুও তাঁর চোখে চোখ রেখে রইলেন। মুখ দেখে ওঁর বয়েস বোঝা যায় না। তবে ষাট-পয়ষট্টির কম নয়। মুখখানা কঠোর নয়। দেখলে ভাল লাগে, চোখ দুটি খুব উজ্জ্বল।

তিনি ডান হাত দিয়ে সন্তুর মুখে, বুকে আলতো করে বোলাতে লাগলেন কয়েকবার। একটা আঙুল দিয়ে সন্তুর চোখের ওপর কী যেন লিখতে লাগলেন।

সন্তু তবু চোখ খুলল না।

এবার উনি ক্যাপটেন নরবুর দিকে তাকিয়ে কী যেন বললেন নিজের ভাষায়, কাকাবাবু কিছুই বুঝতে পারলেন না।

ক্যাপটেন নরবু ফিসফিস করে জানালেন, উনি আশা দিয়েছেন। ভয় নেই। তবে, উনি আমাদের একেবারে চুপ করে থাকতে বললেন।

কাকাবাবু তবু বললেন, কতক্ষণ লাগবে? ক্যাপটেন নরবু বললেন, চুপ!

লামাজি এবার বেশ জোরে কী যেন মন্ত্র পড়তে লাগলেন নিজের ভাষায়। তাঁর ভরাট কণ্ঠস্বর গমগম করতে লাগল ঘরের মধ্যে।

মিনিট-পাঁচেক এরকম চলার পর তিনি হঠাৎ ঠাস ঠাস করে দুটো চড় মারলেন সন্তুর গালে। বেশ জোরে।

কাকাবাবু আঁতকে উঠে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁর একটা হাত শক্ত করে চেপে ধরলেন ক্যাপটেন নরবু।

ওই চড় খেয়েই চোখ মেলল সন্তু। লামাজি দু আঙুল দিয়ে সন্তুর চোখ আরও বেশি খুলে দিয়ে আবার মন্ত্র পড়তে লাগলেন।

সন্তু এবার ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইল। চোখের পলকই ফেলছে না।

লামাজি জোর করে এবার সন্তুর ঠোঁটও ফাঁক করে দিলেন। সন্তু হাঁ করে থাকল। লামাজি পাশ থেকে কমণ্ডলুর মতন একটা জিনিস তুলে নিয়ে উঁচু করে জল ঢেলে দিলেন সন্তুর মুখে।

কাকাবাবু দেখলেন, একটু আগে তিনি চেষ্টা করেও সন্তুকে জল খাওয়াতে পারেননি। এখন সন্তু দিব্যি ঢোঁক গিলে গিলে জল খাচ্ছে।

জলচৌকির তলা থেকে কিছু একটা ওষুধ বের করে সামাজি দিয়ে দিলেন সন্তুর মুখে, আরও অনেকখানি জল খাওয়ালেন। তারপর সন্তুর চোখে চোখ রেখে মন্ত্র পড়তে লাগলেন জোরে-জোরে।

এবারের মন্ত্রটা আরও অদ্ভুত। এমনিতে কিছুই বোঝা যায় না, কিন্তু মধ্যে-মধ্যে দুটি ইংরিজি কথা আছে। নো পেইন, নো ফিভার! নো পেইন,

নো ফিভার।

ক্রমে সেই মন্ত্রটা গানের মতন হয়ে গেল, প্রচণ্ড চিৎকার করে ওই কথাগুলোই সুর দিয়ে গান করছেন লামাজি, তাঁর ডান হাতখানা ফণাতোলা সাপের মতন সামনে দোলাচ্ছেন।

প্রায় দশ মিনিট সেই গান চলল। কাকাবাবুর মনে হল যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই এক একঘেয়ে জিনিস চলছে। কিন্তু তিনি প্রতিবাদও করতে পারছেন না। তাঁর মাথাটাও যেন ঝিমঝিম করছে। তিনি খালি শুনছেন, নো পেইন, নো ফিভার!

একসময় ঘরের আলোটা নিভে গেল। একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। আলোটা নিভে যেতেই মন্ত্র পড়াও থেমে গেল। এতক্ষণ চ্যাঁচামেচির পর হঠাৎ একেবারে দারুণ নিস্তব্ধতা।

একটু পরে সন্তু ডেকে উঠল, কাকাবাবু! কাকাবাবু!

কাকাবাবু চমকে উঠে বললেন, কী রে? কী রে, সন্তু?

সন্তু বলল, কাকাবাবু, আমার জ্বর সেরে গেছে! মাথায় ব্যথা নেই।

আবার আলো জ্বলে উঠল।

লামাজি যেন ক্লান্ত হয়ে এখন দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসেছেন। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছেন। সন্তুও উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

ক্যাপটেন নরবু জিজ্ঞেস করলেন, ঠিক হ্যায়? সব ঠিক হ্যায়?

সন্তু বলল, আমার অসুখ একদম সেরে গেছে।

ক্যাপটেন নরবু ঝুঁকে এসে সন্তুর কপালে হাত দিয়ে খুশির চোটে চেঁচিয়ে বলে উঠলেন, মিরাল! মিরাল! কপাল একেবারে ঠাণ্ডা!

সন্তু বলল, নো পেইন, নো ফিভার।

ক্যাপটেন নরবু কাকাবাবুকে বললেন, রায়চৌধুরী দ্যাখো, দ্যাখো, মাস্টার সন্তু পুরোপুরি সেরে গেছে? তুমি হাত দিয়ে দেখে নাও!

সন্তু নিজেই এগিয়ে গেল কাকাবাবুর দিকে। কাকাবাবুও হাত তুলে সন্তুর কপালটা ছুঁলেন। সত্যিই সন্তুর কপাল ঘামে ভেজা, ঠাণ্ডা।

তিনি মৃদু গলায় সন্তুকে জিজ্ঞেস করলেন, মাথায় কোনও যন্ত্রণা নেই?

সন্তু ঝলমলে হাসিমুখে বলল, নো পেইন! নো পেইন!

উঠে দাঁড়িয়ে ছটছট করতে করতে বলল, বাঃ, দেওয়ালে কী সুন্দর সুন্দর মূর্তি? এগুলো দেখব?

সন্তু ঘুরে-ঘুরে মূর্তি দেখতে লাগল। লামাজি তাঁর পাশের একটা ঝোলানোনা দড়িতে টান দিলেন। দূরে কোথাও ঢং ঢং করে ঘণ্টার শব্দ হল।

ক্যাপটেন নরব গর্বের সঙ্গে কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, দেখলে তো, আগে আমার কথায় বিশ্বাস করোনি।

কাকাবাবু বললেন, বীরেন্দ্র সিং নামে একজন লোকের এক হাতের আঙুল কাটা, সে-ও এই লামাজির কাছে চিকিৎসা করাতে আসে, তাই না।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তুমি তাকে চেনো নাকি? তারও মিরাকুলাস কিওর হয়েছে। তার এক হাতে মোটে একটা আঙুল, তবু সে সব জিনিস ধরতে পারে। রাজা, তোমার পা-টা লামাজিকে একবার দেখাবে নাকি?

লামাজি দেওয়ালে ঠেস দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। আর কোনও কথা বলছেন না।

কাকাবাবু বললেন, না, আমার কিছু দরকার নেই। নরবু, তুমি লামাজিকে বলল, উনি যে আমার ভাইপো-কে সারিয়ে তুললেন, আমাদের এই যে উপকার করলেন, এ জন্য আমরা ওঁর কাছে গম্ভীরভাবে কৃতজ্ঞ।

ক্যাপটেন নরবু নিজেদের ভাষায় এটা বলতেই লামাজি সেই ভাষাতেই উত্তর দিলেন ওঁর দিকে চেয়ে।

ক্যাপটেন নরবু অনুবাদ করে কাকাবাবুকে জানালেন, লামাজি বলছেন, মানুষের সেবা করাই তো ওঁর কাজ। ছেলেটি তাড়াতাড়ি সেরে উঠেছে বলে উনি খুব খুশি হয়েছেন। চিকিৎসার দেরি করালে ওর অসুখটা খুব কঠিন হয়ে যেতে পারত। ছেলেটি বেশ বুদ্ধিমান। অসাধারণ। এইরকম ছেলের কষ্ট পাওয়া উচিত নয়।

কাকাবাবু বললেন, সন্তুকে উনি সারিয়ে তুললেন, তার বিনিময়ে কি আমরা কিছু দিতে পারি? জানি, ওঁর কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধ করা যায় না, তবু এই মঠের জন্য আমরা কিছু সাহায্য করতে পারি কি?

ক্যাপটেন নরবু লামাজিকে এই কথাটা শুনিয়ে উত্তরটা জেনে নিয়ে বললেন, উনি বলছেন, চিকিৎসার বিনিময়ে এখানে কিছুই নেওয়া হয় না। উনি চিকিৎসক নন, উনি একজন সাধক। তবে, কাকাবাবুকে লামাজি অনুরোধ করছেন, এই সব কথা তিনি যেন বাইরে গিয়ে প্রচার না করেন। দলে দলে লোক এখানে চিকিৎসার জন্য ছুটে এলে ওঁর সাধনার ব্যাঘাত হবে। এই মঠটাও হাসপাতাল হয়ে যাবে, তা উনি চান না।

এই সময় একজন লোক এসে তিনটি খাবার-ভর্তি প্লেট এনে রেখে গেল। ওঁদের সামনে। তাতে রয়েছে নানারকম ফল ও মিষ্টি।

সন্তু মুখ ফিরিয়ে বলল, আমার খুব খিদে পেয়েছে।

সে প্রায় ছুটে এসে কপাকপ খেতে লাগল। কাকাবাবু একটা ফলের টুকরো তুলে মুখে দিলেন। একদৃষ্টিতে একটুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন লামাজির দিকে।

তারপর হঠাৎ লামাজিকে সরাসরি ইংরেজিতে কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনার মন্ত্রের মধ্যে দু-একটা ইংরিজি কথা ছিল। আপনি নিশ্চয়ই ইংরেজি জানেন?

লামাজি সামান্য হেসে বললেন, এ লিটল! নট মাচ।

কাকাবাবু আবার বললেন, যদি কিছু মনে না করেন, তা হলে জানতে পারি কি, আপনার বয়েস কত?

লামাজি হাসি মুখেই বললেন, সেভেনটি নাইন।

কাকাবাবু একটা বিস্ময়ের শব্দ করে উঠলেন। তারপর বললেন, এত? দেখে কিছুই বোঝা যায় না। আমার মনে হয়েছিল, বড় জোর ষাট বাষট্টি।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, সত্যিই দেখে কিছু বোঝা যায় না। গত পঁচিশ বছর ধরে আমি লামাজির ঠিক একই রকম চেহারা দেখছি! এঁদের মঠের যিনি প্রধান, সেই মহালামার বয়েস বোধ হয় একশো ছাড়িয়ে গেছে! লামাজি বললেন, মহালামার বয়েস একশো পাঁচ বছর।

ক্যাপটেন নরবু বললেন, এত বয়েসেও তিনি ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ান। কথা বলার সময় গলা একটুও কাঁপে না।

কাকাবাবু বললেন, আপনাদের এখানে আরও অনেকে দীর্ঘজীবী আছেন, তাই না?

ক্যাপটেন নরবু বললেন, আমরা শুনেছি, মহালামার ওপরেও একজন আছেন। তাঁকে সবাই বলে প্রাচীন লামা। তাঁর বয়েস তিনশো বছর।

লামাজি বললেন, প্রাচীন লামার বয়েস এখন ঠিক তিনশো দু বছর। তাঁর একজন পরিচারকও আছেন। তাঁর বয়েস দুশো পঁচানব্বই বছর!

কাকাবাবু বললেন, সত্যি?

ক্যাপটেন নরবু তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন, এই, এই, রাজা, এঁদের কথায় সন্দেহ প্রকাশ করতে নেই। লামাজিরা কখনও মিথ্যে কথা বলেন না!

কাকাবাবু লজ্জিতভাবে সামাজির দিকে তাকিয়ে বললেন, মাপ করবেন, আমি আপনার কথায় সন্দেহ প্রকাশ করিনি। খুব অবাক হয়েছি। এরকম তো কখনও শোনা যায় না। তিনশো বছর! তখনও জোব চার্নক কলকাতা শহরের প্রতিষ্ঠা করেননি! আচ্ছা লামাজি, আপনারা বয়েসের হিসেব রাখেন কী করে? তিনশো বছরের রেকর্ড রাখাও তো সোজা কথা নয়!

লামাজি বললেন, পৃথিবীতে একমাত্র বৌদ্ধরাই হাজার-হাজার বছরের ইতিহাস রক্ষা করেছে। ভগবান বুদ্ধের জন্মের পর থেকেই লিখিত ইতিহাসের শুরু তা জানেন না? আমাদের এইসব গুম্ফায় প্রত্যেক বছরের ঘটনা লিখে রাখা হয়।

কাকাবাবু বললেন, তবু একজন লোকের বয়েস যে তিনশো বছর, সেটা কী করে বোঝা যাবে? তিনি নিজে বছর গুনতে ভুল করতে পারেন। অন্য কারুর পক্ষেই সেটা জানা সম্ভব নয়।

লামাজি বললেন, আপনি বিশ্বাস করতে না চান, করবেন না। আমরা তো একথা বাইরে প্রচার করতে চাই না! প্রাচীন লামার কথা বিশেষ কেউ জানেও না!

কাকাবাবু অত্যন্ত বিনীতভাবে বললেন, না, না, আমি বিশ্বাস করতেই চাই। আমার শুধু কৌতূহল যে, বয়েসের হিসেব কী করে রাখা হয়!

লামাজি বললেন, প্রাচীন লামা প্রত্যেক বছর বুদ্ধ-পূর্ণিমার রাতে একটা করে শ্লোক লিখে রাখেন। তাঁর তেরো বছর বয়েস থেকে সেইসব প্রত্যেকটি লেখা সযত্নে রাখা আছে।

একটু থেমে তিনি আবার বললেন, আপনারা জন্ম-মৃত্যু সম্পর্কে যেভাবে ভাবেন, আমরা সেভাবে ভাবি না। আমাদের সাধকেরা যাঁর যতদিন প্রয়োজন এই পৃথিবীতে থাকেন, প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে পৃথিবী থেকে চলে যান। আমাদের সাধকেরা রোগ-শোক-জরা-মৃত্যু এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে।

কাকাবাবু বললেন, আরও একটু আমাকে বুঝিয়ে দিন। এতজন সাধকের মধ্যে শুধু একজন-দুজন তিনশো বছর বেঁচে থাকেন কী প্রয়োজনে?

লামাজি বললেন, প্রাচীন লামা বেঁচে রয়েছেন, শুধু তাঁর নিজের প্রয়োজনে নয়। সমস্ত বৌদ্ধদের স্বার্থে। ভগবান বুদ্ধের নির্বাণ হয়েছিল আড়াই হাজার বছর আগে। তিনি এই পৃথিবীতে আবার জন্মাবেন। এবারে তাঁর নাম হবে মৈত্রেয়। তাঁর সেই আবির্ভাবের সময় হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি জন্মালেও কেউ তাঁকে প্রথমে চিনতে পারবে না। আমাদের প্রাচীন লামার দিব্যদৃষ্টি আছে। তিনি সমস্ত মানুষ ও প্রাণীর অন্তর পর্যন্ত দেখতে পান। আবার তিনি বহু দূরের দৃশ্যও দেখতে পান। তিনি মৈত্রেয়কে চিনিয়ে দেবেন। তা হলেই তাঁর কাজ শেষ।

লামাজি কথা শেষ করেই উঠে দাঁড়ালেন। ক্যাপটেন নরবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার আমি স্নান করতে যাব।

অর্থাৎ, তিনি এদের সবাইকে এখন চলে যাবার জন্য ইঙ্গিত করছেন।

ক্যাপটেন নরবু উঠে পড়লেও কাকাবাবু বসে রইলেন নিজের জায়গায়।

ছেলেমানুষের মতন আবদারের সুরে তিনি বললেন, চা? খাবার। খাওয়ালেন, চা খাওয়াবেন না। আপনাদের চা খুব ভাল হয়। আমি অন্য মনাস্টারিতে আগে কয়েকবার চা খেয়েছি, ভেড়ার দুধে সেদ্ধ করা চা, অন্যরকম লাগে।

লামাজি দড়ি টান দিয়ে ঘন্টা বাজালেন।

সঙ্গে সঙ্গেই একজন লোক এসে উপস্থিত হতেই লামাজি বেশ বকুনি দিলেন তাকে। সেই লোকটি দৌড়ে চলে গেল।

লামাজি কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, হ্যাঁ, চা আনছে। আপনারা চা খান। আমি স্নান করতে যাচ্ছি।

কাকাবাবু বললেন, অনুগ্রহ করে আর এক মিনিট দাঁড়ান। লামাজি, আমরা একবার আপনাদের প্রাচীন লামাকে দর্শন করে প্রণাম জানিয়ে যেতে চাই!

লামাজি এবার গম্ভীর সুরে বললেন, অসম্ভব।

কাকাবাবু বললেন, কেন, অসম্ভব কেন? আমরা ওঁকে ডিস্টার্ব করব না। একবার শুধু দেখেই চলে যাব।

লামাজি আবার ধমকের সুরে বললেন, অসম্ভব!

কাকাবাবু অনুনয়ের সুরে বললেন, লামাজি, আপনাকে এই ব্যবস্থাটুকু করে দিতেই হবে। এতবড় একজন পুণ্যবান মানুষ, তিনশো দুই বছর ধরে আছেন এই পৃথিবীতে, এত কাছে এসেও তাঁকে একবার না দেখে চলে যাব? অন্তত দূর থেকে একবার দেখে জীবন সার্থক করতে চাই!

লামাজি বললেন, দেখা হবে না! এরকম অন্যায় অনুরোধ করবেন না।

এবার কাকাবাবুও বেশ কড়া গলায় বললেন, এটা মোটেই অন্যায় অনুরোধ নয়! মানুষ মানুষকে দেখবে, এর মধ্যে অন্যায় কী আছে?

তারপর কাকাবাবু তাঁর কোটের ভেতর পকেট থেকে একটা খাম বার করলেন।

সেই খামটা লামাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনি ইংরাজি বলতে পারেন যখন, পড়তেও পারেন নিশ্চয়ই। এটা ভারতের রাষ্ট্রপতির চিঠি। রাষ্ট্রপতি দার্জিলিং-এ এসে গুজব শুনেছেন যে, আপনাদের এখানকার কোনও মনাস্টারিতে তিনশো বছর বয়েসী মানুষ বেঁচে আছে। যদি তা সত্যি হয়, তবে তা সারা পৃথিবীর কাছেই একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ভারতের গৌরব। রাষ্ট্রপতি তাই আমাকে একবার নিজের চোখে দেখে রিপোর্ট দিতে বলেছেন।

চিঠিখানা নিয়ে উলটে-পালটে দেখলেন লামাজি। তারপর অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, এ চিঠি রাষ্ট্রপতি আপনাকে লিখেছেন। আমাদের তো কিছু লেখেননি!

কাকাবাবু বললেন, রাষ্ট্রপতি আগেই সরকারিভাবে অ্যাকশান নিতে চান না। আপনাদের ধর্মস্থানে কোনও ব্যাঘাত সৃষ্টি হোক, তাও তিনি চান না। সেইজন্যই তিনি প্রথমে আমাকে প্রাইভেটলি খোঁজ নিতে বলেছেন। আপনারা তিব্বতিরা ভারতের অতিথি। ভারতের রাষ্ট্রপতির এই অনুরোধটুকু মানবেন না?

লামাজি বললেন, প্রাচীন লামা আরও দূরে, অন্য একটা গুম্ফায় থাকেন। তিনি প্রায় সর্বক্ষণই ঘুমোন। দু তিনদিন অন্তর জাগেন একবার। বাইরের কোনও লোককেই তাঁর সামনে যেতে দেওয়া হয় না। তিনি কখন জাগেন, তারও ঠিক নেই। অনেক সময় মাঝরাত্তিরে..

কাকাবাবু বললেন, আমরা সেই গুস্কার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করব। তিনি মাঝরাত্তিরে জাগলে সেই সময়েই একবার দেখা করব।

চিঠিখানা কাকাবাবুর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে লামাজি বললেন, আপনাদের রাষ্ট্রপতির অনুরোধ মানতে আমরা বাধ্য নই! আমরা একমাত্র দলাই লামার আদেশ মানি। আপনারা দলাই লামার আদেশ নিয়ে আসুন। না হলে…আমি দুঃখিত!

কাকাবাবু ও লামাজি পরস্পরের চোখের দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত।

সন্তু প্লেটের খাবার শেষ করে আবার দেওয়ালে বসানো মূর্তিগুলো দেখছিল। কাকাবাবু ও লামাজির কথা কাটাকাটি সে যেন শুনতেই পায়নি।

ক্যাপটেন নরবু কাকাবাবুর হাত ধরে টেনে বললেন, উনি বলছেন দেখা হবে না। রাজা, এবার চলো?

সন্তু হঠাৎ পেছন ফিরে বলল, আমি দেখব! আমি প্রাচীন লামাকে একবার দেখব।

তারপর সে লামাজির কাছে এসে বলল, নো ফিভার! নো পেইন!

লামাজি কাকাবাবুর চোখ থেকে চোখ সরিয়ে সন্তুর দিকে তাকালেন। আস্তে আস্তে তাঁর মুখটা আবার কোমল হয়ে এল। তিনি সন্তুর মাথায় হাত রাখলেন।

সন্তু আবার বলল, নো পেইন/ নো ফিভার। আমি ভাল হয়ে গেছি। আমি প্রাচীন লামাকে একবার দেখব। তিনশো বছরের মানুষ!

লামাজি আস্তে-আস্তে বললেন, ঠিক আছে। আজ সন্ধের সময় তোমাদের নিয়ে যাব সেখানে!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress