জোজো ভুরু কুঁচকে বলল
জোজো ভুরু কুঁচকে বলল, এই বাড়িটায় এক হাজারটা ঘর আছে? যাঃ, বাজে কথা! সন্তু বলল, তুই গুনে দ্যাখ!জোজো বলল, শুধু শুধু কষ্ট করে। গুনতে যাব কেন? দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে। আমাদের কলকাতায় এক-একটা বিশাল বিশাল মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এ কত ঘর থাকে! বড়জোর আড়াইশোতিনশো! এ-বাড়িটা মোটেই তেমন কিছু বড় নয়। মাত্র তিনতলা!
সন্তু একটা আখ ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে খাচ্ছে। খানিকটা ছিবড়ে ফেলে দিয়ে বলল, তুই বাড়ি বাড়ি কী বলছিস? এটা বাড়ি নয়, প্যালেস। রাজপ্রাসাদ। প্যালেসের সঙ্গে কখনও আজকালকার মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং-এর তুলনা হয়? তা ছাড়া, কোথাও বলা হয়নি যে, এখানে হাজারটা ঘর আছে। আসলে আছে এক হাজারটা দরজা। সেই জন্যই এর নাম হাজারদুয়ারি।
জোজো আখ ছাড়াতে পারে না। সে আখের টুকরোটা ধরে আছে লাঠির মতন। কাকাবাবু একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন একজন দাড়িওয়ালা লোকের সঙ্গে।
জোজো আবার বলল, এক হাজারটা দরজা মানেই তো এক হাজারটা ঘর থাকবে।
সন্তু বলল, মোটই তা নয়। অনেক ঘরের দুটো করে দরজাও থাকতে পারে। বাথরুমেরও একটা দরজা থাকে।
জোজো বলল, দুর বোক, তা হলে তো বাথরুমটাও একটা ঘর হল। সেটাও তো গুনতির মধ্যে পড়বে।
কাকাবাবু অন্য লোকটির সঙ্গে কথা শেষ করে এদিকে এসে বললেন, কী ব্যাপার, বাথরুমের কী কথা হচ্ছে?
সন্তু বলল, বাথরুম নয়, আমরা ভাবছিলাম, এই প্যালেসে যদি এক হাজারটা দরজা থাকে, তা হলে ঘর আছে কতগুলো? ঘরও কি এক হাজার? বাথরুম টাথরুম সব নিয়ে?
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, এই প্যালেসে এক হাজার দরজা আছে, আবার নেইও বটে।
জোজো জিজ্ঞেস করল, এটা একটা ধাঁধা?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, ধাঁধারই মতন। একটা সূত্র দিয়ে দিচ্ছি। দরজা আছে, কিন্তু কৰ্জাহীন, মানুষ ভুল করে, খোলে না কোনওদিন।
জোজো কিছু বলার আগেই সন্তু বলল, আসল দরজা নয়, দরজার ছবি আঁকা।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক ধরেছিস। হাজারদুয়ারি নামটা সার্থক করার জন্য অনেক জায়গায় দেওয়ালে নিখুঁতভাবে দরজার ছবি আঁকা। দেখলে দরজা বলেই ভুল হয়।
সন্তু বলল, আমি একটা ভ্রমণকাহিনিতে পড়েছি, ফরাসিদেশের একটা রাজপ্রাসাদে আছে চারশো ঘর। এই হাজারদুয়ারি কি তার চেয়েও বড়?
কাকাবাবু দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ! ফরাসিদেশের সেই প্যালেস আমি দেখেছি। সেটার নাম শার প্যালেস। সেটা এর চেয়ে অনেক বড়। মজার কথা কী জানিস, সেই শাবর প্যালেসে বাথরুম কটা বলতে পারিস? মাত্র একটা। তাও নতুন তৈরি হয়েছে, এখনকার কেয়ারটেকারের জন্য। আগেকার দিনে বাড়ির মধ্যে বাথরুম রাখার চল ছিল না। সেটাকে মনে করা হত, নোংরা, অস্বাস্থ্যকর ব্যাপার! অবশ্য তখন তো পাম্প করে উপরে জল তোলাও যেত না!
জোজো অবজ্ঞার সঙ্গে বলল, এর চেয়ে কত বড় বড় প্যালেস আমি দেখেছি। হাঙ্গারির একটা প্যালেসে ঘর আছে এগারোশো বত্রিশটা। আর জর্জিয়ায় এক হাজার একান্ন?
কাকাবাবু বললেন, সে যাই-ই হোক, আমাদের বাংলার মধ্যে এত বড় প্যালেস তো আর নেই। এটা দেখার জন্যই অনেকে মুর্শিদাবাদে আসে। ভিতরটাও দেখার মতন। আমি অনেকদিন আগে একবার এসেছি।
জোজো জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, নবাব সিরাজদৌল্লা এত বড় একটা বাড়ি শুধু শুধু বানিয়েছিলেন কেন? ওঁর ফ্যামিলিতে কি অনেক লোক ছিল?
সন্তু বলল, তুই হিষ্ট্রি একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিস! সিরাজের আমলের সব কিছুই ধ্বংস হয়ে গেছে। এটা তৈরি করেছেন হুমায়ুন।
জোজো বলল, হুমায়ুন মানে আকবরের বাবা?
সন্তু বলল ধ্যাত! আকবরের বাবা তো আগেকার লোক! এ অন্য হুমায়ুন। নবাব হুমায়ুন। এটা এমন কিছু পুরনোও নয়।
কাকাবাবু বললেন, দাঁড়া, দাঁড়া। শুধু হুমায়ুন বললে ভুল বোঝার আশঙ্কা আছে। বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর বাংলার সিংহাসন দখল করে নেওয়ার পর ইংরেজরা তার অনেক ক্ষমতাই কেড়ে নেয়। তারপর থেকে যারা নবাব হয়েছে, তারা একেবারেই ইংরেজদের হাতের পুতুল। সেই রকমই এক নবাবের নাম নাজিম হুমায়ুনজা। দেশ শাসন করার কোনও ক্ষমতা নেই, বিশেষ কোনও কাজই নেই। তাই তিনি শুধু বিলাসিতায় টাকা ওড়াতেন। এইরকম রাজপ্রাসাদ বানানোও তোক দেখানো ব্যাপার।
জোজো বলল, আমরা এবার ভিতরে যাব না?
কাকাবাবু বললেন, চলো। অনেক সিঁড়ি! সেই তো আমার পক্ষে মুশকিল। যাই হোক, আমি তো পুরোটা দেখব না। তোমরা দুজন সব কটা ঘর ঘুরে দেখে এসো। উপরে খুব ভাল ভাল ছবি আছে। আমি শুধু অস্ত্রাগারটা আর-একবার দেখব ভাল করে।
সামনের দিকে বিশাল চওড়া সিঁড়ি। সন্তু আর জোজো উঠে গেল লাফিয়ে লাফিয়ে। কাকাবাবুকে ক্র্যাচে ভর দিয়ে কষ্ট করে উঠতে হয়। একটা খোঁড়া পা নিয়েও তাঁর অন্য জায়গায় বিশেষ অসুবিধে হয় না, শুধু সিঁড়ির কাছেই জব্দ।
কাকাবাবু প্রায় উঠে এসেছেন উপরে, উপর থেকে নামছে একটি দল। তাদের মধ্য থেকে একজন লম্বামতো লোক একেবারে কাকাবাবুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আপনি মিস্টার রাজা রায়চৌধুরী না?
কাকাবাবু মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
এক-একটা বড় ঘটনার পর কাকাবাবুর ছবি ছাপা হয় খবরের কাগজে। গত বছর নানাসাহেবের গুপ্তধন আবিষ্কারের জন্য দারুণ হইচই পড়ে গিয়েছিল। প্রেসিডেন্সি কলেজের ইতিহাসের ছাত্রছাত্রীরা কাকাবাবুর সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছিল রবীন্দ্রসদনে। কাকাবাবু সংবর্ধনা টংবর্ধনা পছন্দ করেন না, কিন্তু ছাত্রছাত্রীরা জোর করেই নিয়ে গিয়েছিল তাঁকে। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কাকাবাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে গেলেন, কাকাবাবু তাঁকে বাধা দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন, সেই ছবি দেখানো হল সব কটা টিভি চ্যানেলে। ছাপা হল সব কটা কাগজের প্রথম পাতায়। সেই জন্যই এখন রাস্তায়ঘাটে লোকেরা কাকাবাবুকে দেখলেই চিনতে পারে।
এই লোকটি কাকাবাবুর চেয়েও বেশ খানিকটা লম্বা। মাথার লম্বা চুল পিছন দিকে গিট করে বাঁধা। চোখে কালো চশমা। পাজামার উপর একটা হলুদ সিল্কের পাঞ্জাবি পরা, তাতে এক জায়গায় পানের পিকের একটু দাগ।
লোকটি ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল, আমি আপনার বহুত ভকতো আছি, আপনার এক ডজন সে বেশি অ্যাডভেঞ্চার কহানি পড়েছি, আপকা কিতনা সাহস আর শক্তি। স্যার, আপনার পায়ের ধুলো একটু নিতে চাই।
কাকাবাবু বিব্রত হয়ে বললেন, না, না, তার দরকার নেই, দরকার নেই। এই তো হাতে হাত…
লোকটি আগেই ঝুঁকে পড়েছে।
কাকাবাবু তার হাত ধরতে গিয়েও পারলেন না। লোকটি কাকাবাবুর পা ধরতে গিয়ে তাল সামলাতে পারল না, কাকাবাবুর গায়ের উপর পড়ে গেল।
সে উপরের সিঁড়িতে আর কাকাবাবু নীচে, তাই কাকাবাবু ওর শরীরের ওজন সামলাতে পারলেন না। পড়ে গেলেন পিছন দিকে।
তলার সিঁড়িতে তাঁর মাথা ঠুকে গেল। তিনি আরও গড়িয়ে পড়ে যেতে পারতেন, সন্তু আর জোজো দৌড়ে এসে ধরে ফেলল তাঁকে।
লম্বা লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কেয়া হুয়া? কে আমাকে ঠেলা মারল?
তার সঙ্গের লোকটি বলল, কে তোমাকে ঠেলা মারবে? তুমি ব্যালান্স রাখতে পারোনি।
লম্বা লোকটি বলল, আরে ছি ছি ছি ছি। কী লোজ্জার কোথা! মিস্টার রায়চৌধুরী মাফ কিজিয়ে! আমি ক্ষোমা চাইছি!
কাকাবাবুর বেশ লেগেছে। কিন্তু তিনি উঃ-আঃ করছেন না। কখনও নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করেন না। একটুক্ষণ তিনি চুপ করে রইলেন, সন্তু
আর জোজো তাঁর প্যান্ট-শার্টের ধুলো ঝেড়ে দিতে লাগল।
লম্বা লোকটির ক্ষমা চাওয়া আর থামছেই না।
কাকাবাবু বললেন, আপনার লাগেনি তো? আমি ঠিক আছি। হঠাৎ পা পিছলে গেছে। এরকম অ্যাক্সিডেন্ট তো হতেই পারে!
লোকটি বলল, তবু আমি হাজারবার মাফি মাঙছি। আপনার মতন রেসপেক্টেবল মানুষ, আর আমি আপনার এত অ্যাডমায়ারার…
কাকাবাবু অস্বস্তি চাপা দিয়ে বলে উঠলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে!
লোকটি পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে বলল, যদি কখনও দোরকার লাগে, প্লিজ কল মি, আমি আপনাকে কখনও কিছু হেল্প করতে পারলে ধোন্য হোবো?
কাকাবাবু কার্ডটা হাতে নিলেন কিন্তু পড়লেন না। লোকটির মুখ ভাল করে দেখে নিয়ে বললেন, আচ্ছা ভাই, এখন আমরা ভিতরে যাব!
ওদের ঘিরে খানিকটা ভিড় জমে গেছে। এর মধ্যে আবার দুটি বাচ্চা ছেলেমেয়ে এসে বলল, কাকাবাবু, অটোগ্রাফ!
কাকাবাবু বললেন, এই রে, এরপর যে হাজারদুয়ারি বন্ধ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ওদের কাগজে সই করে দিয়ে তিনি উঠতে লাগলেন উপরে।
একেবারে উপরে উঠে চারদিকটা একবার দেখে নেওয়ার পর কাকাবাবুদের আবার অন্য দিক দিয়ে নীচেই নামতে হল। কারণ, কাকাবাবু শুধু অস্ত্রাগারটা দেখবেন বলেছেন।
ভিতরে এসে তিনি জোজোকে বললেন, আমি যখন প্রথমবার এখানে আসি, তখন তো আর খোঁড়া ছিলাম না, আর তোমাদেরই মতো বয়স। পুরো প্যালেসটা তো দেখেছিলাম বটেই, আর গঙ্গায় সাঁতার কেটেছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে, মনে আছে।
সন্তু বলল, আমিও সাঁতার কাটব। জোজোটাকে এত করে সাঁতার শিখতে বলি—
জোজো বলল, এবারে শিখে নেব। তবে নদীফদিতে নয়, সুইমিং পুলে। সাঁতার শিখতে আর কতক্ষণ লাগে! আমার এক মামা সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়েছিলেন।
কাকাবাবু বললেন, নরানাং মাতুলঃ ক্রম। তার মানে কী জানো, নর মানে মানুষ ঠিক তার মামার মতো হয়। তোমার মামা যখন অত বড় সাঁতারু, তুমিও পারবে!
সন্তু জিজ্ঞেস করল, জোজো, তোর তিন জন মামাকে আমি চিনি। ইনি কোন জন রে?
জোজো বলল, ইনি আর-একজন। আমার মামাতো মামা!
মামাতো মামা মানে কী?
মায়ের নিজের ভাই নয়, মামাতো ভাই। তা হলে আমার মামাতো মামা হল না? এখন বহুদিন আর তিনি সাঁতার কাটেন না অবশ্য।
কেন?
একবার একটা হাঙর ওঁর ডান পা কেটে নিয়েছে। সেই থেকে উনি আর কখনও সমুদ্রের ধারে যান না! এমনকী, কোনও নদী, পুকুর, জলই দেখতে চান না। এখন থাকেন আল্পস পাহাড়ের একটা গুহায়। সেখানে একটা ঝরনা পর্যন্ত নেই।
তা হলে তেষ্টা পেলে কী করেন?
বরফ আছে তো। চতুর্দিকে বরফ। সেই বরফ কড়মড় করে চিবিয়ে খান।
কাকাবাবু মুচকি হেসে বললেন, বাব্বাঃ! আল্পস পাহাড়ে থাকেন? নাম কী তোমার সেই মামার?
জোজো বলল, আগে নাম ছিল বরুণ রায়। এখন আমরা বলি বরফমামা।
তারপরই প্রসঙ্গ বদলে সে জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা কাকাবাবু, এক-একটা তলোয়ার কিংবা বর্শা এত বড় কেন? আগেকার মানুষরা কি অনেক লম্বা ছিল?
কাকাবাবু বললেন, এসব অস্ত্র তো খুব আগেকার মানুষদের নয়। তা ছাড়া মানুষরা কখনওই এখনকার মানুষদের চোখে আকারে তেমন বড় ছিল না। চার-পাঁচ হাজার বছর আগেকার যেসব মানুষদের কঙ্কাল পাওয়া গেছে, তা দেখেই বোঝা যায়।
অস্ত্রাগারটিতে নানারকম অস্ত্র সাজানো। অনেক ঢাল-তরোয়াল, বন্দুকপিস্তল।
কোনওটা আলিবর্দি খাঁ-র, কোনওটা মুর্শিদকুলি খাঁ-র। বিদেশের কিছু অস্ত্রও আছে।
সন্তু বলল, মানুষ কেন এত অস্ত্র বানায়? শুধু মানুষ মারার জন্যই!
কাকাবাবু বললেন, পৃথিবীতে মানুষকে মারার তো আর কেউ নেই। রাক্ষস-খোক্কস, দৈত্য-দানব কিছু নেই। বাঘ সিংহ গরিলারাও মানুষের সঙ্গে পারে না। মানুষ যদি মানুষকে না মারত, তা হলে পৃথিবীটা কত শান্তির জায়গা, সুন্দর জায়গা হতে পারত?
জোজো বলল, তার বদলে এখন অ্যাটম বোমা বানাচ্ছে! এক-একখানা বোমায় এক-একটা শহর খতম। কয়েকটা দেশের কাছে যত অ্যাটম বোমা আছে, সেগুলো সব একসঙ্গে ফাটালে গোটা পৃথিবীটাই ধ্বংস হয়ে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, একবার না, তিনবার।
জোজো বলল, আমি এই পচা পৃথিবীতে থাকবই না। মঙ্গলগ্রহে চলে যাব। সব ঠিক হয়ে গেছে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, সব ঠিক হয়ে গেছে?
জোজো বলল, হ্যাঁ, পাঁচ বছরের মধ্যেই তো মঙ্গলগ্রহে বাড়ি-ঘর তৈরি হবে। আমাদের জন্য একটা বাড়ি বুক করা আছে।
সন্তু বলল, আমি এই পৃথিবী ছেড়ে কোথাও যাব না। যতই যা হোক, আমার নিজের দেশটাই ভাল।
কাকাবাবু বললেন, ঠিক আছে জোজো, তুমি মঙ্গলগ্রহে বাড়ি করলে আমি আর সন্তু বেড়াতে যাব একবার। আপাতত এসো, এই জায়গাটা দ্যাখা শেষ করি। এই দ্যাখো, এটা সিরাজদ্দৌলার বর্শা!
সন্তু বলল, এত বড় বর্শা। নিশ্চয়ই খুব ভারী। এটা নিয়ে সিরাজ যুদ্ধ করতে পারতেন?
কাকাবাবু বললেন, না না, এগুলো সাজিয়ে রাখা হত। সিরাজ যুদ্ধ করতে জানতেন কিনা তাতেই সন্দেহ আছে। পলাশির যুদ্ধে উনি নিজে কিছুই করেননি। অনেককাল আগে, রাজা কিংবা রাজপুত্ররা নিজেরাও খুব ভাল লড়াই করতে জানতেন। আলেকজান্ডার কিংবা চেঙ্গিজ খান, এঁরা ছিলেন অসাধারণ সাহসী যোদ্ধা। তার পরের দিকে রাজা-বাদশারা নিজেরা বসে থাকতেন তাঁবুতে, যুদ্ধ করে মরত সাধারণ সৈন্যরা।
জোজো বলল, কাকাবাবু, এই ছুরিটা দেখুন। এটাকে এত যত্ন করে সাজিয়ে রেখেছে কেন?
একটা ট্রে-তে লাল মখমল পাতা, তার উপরে রয়েছে একটা লম্বা ছুরি, হাতির দাঁতের হাতল। ছুরিটায় এখনও যেন লেগে আছে রক্ত।
কাকাবাবু সেটার সামনে এসে বললেন, এই ছুরিটার দারুণ ঐতিহাসিক মূল্য আছে। এটা মহম্মদি বেগের ছুরি। বলতে গেলে এই ছুরিটার জন্যই আমাদের দেশটা পরাধীন হয়ে গিয়েছিল।
জোজো সন্তুর দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, আহম্মদি বেগটা কে রে?
সন্তু বলল, আহম্মদি না মহম্মদি। তুই ইতিহাস পড়িসনি?
জোজো বলল, অত আমার নামধাম মনে থাকে না।
কাকাবাবু বললেন, সব নাম মনে রাখা খুবই শক্ত। একটা মাত্র ঘটনা ছাড়া মহম্মদি বেগের আর কোনও উল্লেখই নেই। তবে, ইতিহাস বই পড়ার চেয়েও সিনেমা বা থিয়েটারে দেখলে নামটাম সব মনে থাকে। আমাদের ছেলেবেলায় সিরাজদৌল্লা নামে একটা নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। সেটা আবার রেকর্ডও করা হয়েছিল। তখনকার দিনে তো টিভি ছিল না। সিডি কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারও ছিল না। শুধু ছিল রেডিয়ো আর গ্রামাফোন। রেডিয়োতে এই নাটকের রেকর্ড বাজানো হত প্রায়ই। পাড়ায় পাড়ায় পানবিড়ির দোকানেও বাজত রেডিয়ো। শুনে শুনে নাটকটা আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। নির্মলেন্দু লাহিড়ি নামে একজন অভিনেতা কাঁপাকাঁপা গলায় দারুণ অভিনয় করতেন সিরাজের। শেষ দৃশ্যে আমাদের চোখে জল এসে যেত। পলাশির যুদ্ধে সেনাপতি মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় তো ইংরেজের কাছে হেরে গেলেন সিরাজ। পালাতে বাধ্য হলেন ছদ্মবেশে। ধরাও পড়ে গেলেন ভগবানগোলা নামে একটা জায়গায়। পায়ের নবাবি জুতোটা নাকি বদলাতে ভুলে গিয়েছিলেন।
জোজো জিজ্ঞেস করল, নবাবি জুতো কীরকম হয়?
কাকাবাবু বললেন, জুতোর উপর হিরে-জহরতও বসানো থাকত বোধহয়। নবাবরা তো নিজেরা কখনও জুতো পরতে জানতেন না। কেউ একজন জুতো পরিয়ে দিত, খুলেও নিত। পালাবার সময় তাড়াহুড়োয় জুতো খোলার লোক পাওয়া যায়নি। সেই জুতো দেখেই তাকে চেনা গিয়েছিল। ধরা পড়ার পর তো সিরাজকে বন্দি করে আনা হল মুর্শিদাবাদে। নাটকটায় আছে, সেই সময় একদিন দারুণ একখানা বক্তৃতা দিয়ে সিরাজ লোক খ্যাপাবার চেষ্টা করেছিলেন। সে লেকচার শুনে আমাদেরও রক্ত গরম হয়ে যেত। লোকেরাও খেপে উঠছিল। সেই সময় তারা যদি সিরাজকে উদ্ধার করে নিতে পারত, তা হলে আবার ইতিহাস অন্যরকম হয়ে যেত। তখনই মহম্মদি বেগের প্রবেশ। মিরজাফরের ছেলে মিরন, তারই এক চ্যালা এই মহম্মদি বেগ। সে চিৎকার করে বলল, সে সুযোগ আর তোমাকে দেব না শয়তান! খোলা ছুরি বসিয়ে দিল সিরাজের বুকে। ব্যস শেষ, বেজে উঠল করুণ বাজনা।
ঘটনাটা বলতে বলতে গলা চড়িয়ে কাকাবাবুও প্রায় অভিনয় করে ফেললেন, একটা ভিড় জমে গেল তাঁকে ঘিরে।
একটি স্কুলের ছাত্র জিজ্ঞেস করল, সিরাজ যদি পালাতে পারতেন, তা হলে কী হত?
কাকাবাবু বললেন, সিরাজ তো তখনও নবাব। তিনি আবার সৈন্যসামন্ত জোগাড় করতে পারতেন। ফরাসিদের সাহায্য নিতে পারতেন। আবার একটা যুদ্ধ হত, তাতে ইংরেজরা হেরেও যেতে পারত। বাংলার স্বাধীনতা হারাতে হত না। কিন্তু মহম্মদি বেগের একটা ছুরির আঘাতে সব আশা-ভরসা শেষ হয়ে গেল। ওই একটা কুকীর্তি করার জন্য মহম্মদি বেগের নাম রয়ে গেল ইতিহাসে।
ছেলেটি আবার জিজ্ঞেস করল, মহম্মদি বেগ মারল কেন?
কাকাবাবু বললেন, তার সম্পর্কে আর কিছু জানি না। মিরনের হুকুমে মারতে পারে। কিংবা সিরাজের উপরে তার নিজের কোনও রাগও ছিল হয়তো।
ছেলেটি সরল রাগের সঙ্গে বলল, লোকটাকে একবার হাতের কাছে পেলে…
সবাই হেসে উঠল।
কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, তোরা এবার অন্য ঘরগুলো দেখে আয়। আমি বাইরের সিঁড়িতে গিয়ে বসছি।
ফেব্রুয়ারি মাস। শীত এখনও শেষ হয়নি, দুপুরবেলার রোদও ভালই লাগে। কাকাবাবু ক্রাচ দুটো পাশে রেখে বসলেন একেবারে উপরের সিঁড়িতে। আজ ছুটির দিন নয়, তবু এখানে যথেষ্ট ভিড়। কলকাতা থেকেও গাড়ি ভরতি ভরতি লোক আসছে হাজারদুয়ারি আর মুর্শিদাবাদ দেখতে।
কাকাবাবু একবার মাথার পিছনটায় হাত বুলোলেন। ফেটে যায়নি বটে, তবে বেশ লেগেছে, এখনও কিছুটা ব্যথা আছে।
হঠাৎ তার মনে হল, খানিক আগে লোকটা তাঁকে প্রণাম করতে এসে তাল সামলাতে পারেনি! না ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছিল? হাত দিয়ে তাঁকে ঠেলেছিল ঠিকই, তবে সেটাও অনিচ্ছাকৃত হতে পারে! শুধু শুধু একটা লোক তাঁকে ঠেলে ফেলার চেষ্টা করবে কেন? আবার বলাও যায় না। অনেক লোকেরই রাগ আছে তার উপরে।
শার্টের পকেট থেকে তিনি সেই লোকটির দেওয়া কার্ডটা বের করে দেখলেন। লোকটির নাম রাকেশ শর্মা, তলায় লেখা ক্লথ মার্চেন্ট। ঠিকানা ভাগলপুর। একজন জামা-কাপড়ের ব্যবসায়ীর কেন রাগ থাকবে তাঁর ওপর?
একটু পরে নানারকম বাজনা বাজাতে বাজাতে এল একটা দল। তাদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়া দুজন লোক। সামনের চত্বরে এসে সেই লোক দুটি ঘোড়া থেকে নামল। একজনের পোশাক সাহেবের মতন, আর-একজনের মাথায় পালক বসানো সাদা মুকুট। দুজনেরই কোমরে তলোয়ার। সেই তলোয়ার খুলে ওরা ঠকাঠক করে লড়াই শুরু করে দিল, আর তাদের ঘিরে ঢাক ঢোল আর সানাই বাজাতে লাগল বাজনদাররা।
এরা বোধহয় কোনও যাত্রাপার্টি। কাকাবাবু বুঝতে পারলেন, এরা দুজন সেজেছে সিরাজদৌল্লা আর লর্ড ক্লাইভ। ওরা লড়াইয়ের অভিনয় করে দেখাচ্ছে! সিরাজের সঙ্গে ক্লাইভের এরকম লড়াই হওয়া দূরে থাক, কোনওদিন সামনাসামনি দেখা হয়েছিল কিনা সন্দেহ। একটু পরেই এই নকল ক্লাইভ হেরে গিয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ল।
কাকাবাবু হাসলেন। এতদিন পর এরা ইতিহাসকে উলটে দিতে চাইছে।