মূর্তি আর বাক্সগুলো
ওরা নেমে যাওয়ার পর কাকাবাবু অন্যান্য মূর্তি আর বাক্সগুলো খুলে দেখতে লাগলেন। বাক্সগুলো খোলা সহজ নয়। এক-একটা একেবারে সিল করা। কাকাবাবুর কাছে ছুরি টুরি কিছু নেই। তিনি তাঁর সাঁড়াশির মতন শক্ত আঙুল দিয়ে সেগুলো খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন।
কোনও বাক্সেই হিরে-জহরত নেই। রয়েছে গাঁজা, আফিমের মতন নিষিদ্ধ জিনিস। একটা চৌকো বাক্স অনেক কষ্টে খুলে কাকাবাবু চমকে উঠলেন। তার মধ্যে রয়েছে একটা ছোট্ট মাথার খুলি। মনে হয় চার-পাঁচ বছরের কোনও বাচ্চার। কাকাবাবু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাদা ধপধাপে খুলিটার দিকে। বিদেশে এইসবও বিক্রি হয়? পয়সার লোভে মানুষ কত হীন কাজই না করে!
কয়েকটা বাক্স শেষ পর্যন্ত খোলা গেল না।
মূর্তিগুলো বেশির ভাগই কোনও-কোনও মন্দিরের দেয়াল থেকে খুবলে আনা। বেশির ভাগই তেমন দামী নয়, তবে মন্দিরগুলোর সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।
একটা যুগল-মূর্তি কাকাবাবু খুব মন দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন। তাঁর সন্দেহ হল, সেটা ওড়িশার বিখ্যাত রাজারানী মন্দির থেকে চুরি করে আনা হয়েছে। তাহলে এটাও খুব দামী হবে। কিন্তু তিনি ঠিক নিঃসন্দেহ হতে পারছেন না।
কাকাবাবু যেন ভুলেই গেলেন যে, কতখানি বিপদ তাঁদের ঘিরে ছিল এতক্ষণ। এখন একটা পালাবার রাস্তা পাওয়া গেছে। সন্তু আর দেবলীনা তাঁর জন্য নীচে অপেক্ষা করছে। তবু তিনি খুব মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন সেই যুগল-মুর্তিটা।
হঠাৎ খট্ করে একটা শব্দ হতেই তিনি চমকে উঠলেন।
দেয়ালের দরজাটা আবার খুলে গেছে। সেখান দিয়ে রাজকুমার ঢুকল, সঙ্গে-সঙ্গে দরজাটা আবার বন্ধ হয়ে গেল।
কাকাবাবু সাবধানে মূর্তিটা নামিয়ে রেখে হালকা গলায় বললেন, আরে, কী ব্যাপার? এ তো দেখছি, বাঘ আর ছাগল এক খাঁচায়! জগাই মল্লিক। কি তোমাকেও বন্দী করে ফেলল নাকি?
রাজকুমার পকেট থেকে রিভলভারটা বার করে চিবিয়ে-চিবিয়ে বলল, আমায় আটকাবে জগাই মল্লিকের এমন সাহস আছে? ওই ব্যাটা ধ্রুব রায় নামে অফিসারটা এসে পড়েছে, সে ঠাকুরঘরে এসে প্ৰণাম করতে চায়, তাই আমাকে কিছুক্ষণের জন্য ছাগলের খাঁচায় আসতে হয়েছে।
কাকাবাবু বললেন, তা ভালই হয়েছে। তুমি বোসো, তোমার সঙ্গে আমার কাজের কথাগুলো সেরে নিই!
রাজকুমার রিভলভারের নলে দুবার ফুঁ দিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে আমার আর কোনও কথা নেই, রায়চৌধুরী। তোমাকে আমি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন তুমি জগাই মল্লিকের মাল। আর তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।
বিক্রি করে দিয়েছ! টাকা-পয়সা পেয়ে গেছ?
সে-কথায় তোমার দরকার কী?
কিন্তু রাজকুমার, জগাই মল্লিক। আমাকে দিয়ে তার কাজ করিয়ে নিয়ে ছেড়ে দেবে বলেছে। আমাকে ছেড়ে দিলেই যে তোমার বিপদ। তোমার কী ব্যবসা তা-ও আমি জেনে গেছি, আর তোমার কাজ-কারবার যেখানে চলে সেই জায়গাটাও খুঁজে বার করা আমার পক্ষে শক্ত হবে না।
জগাই মল্লিক তোমাকে ছেড়ে দেবে? সে অত কাঁচা? হা-হা-হা-হা। হঠাৎ হাসি থামিয়ে সে বলল, ছেলেমেয়ে দুটো কোথায় গেল?
কাকাবাবু বললেন, তাই তো, কোথায় গেল, আমিও ওদের কথা ভাবছি!
বাজে কথা বোলো না। আমাকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা কোরো না। ওদেরও এই ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ও কী! ওখানে, ওখানে ওই গর্তটা…
ও হ্যাঁ। মনে পড়েছে। ছেলেমেয়ে দুটো বাইরে একটু হাওয়া খেতে গেছে। এই জায়গাটা বড্ড বদ্ধ কি না!
কাকাবাবু অনেকটা আড়াল করে বসে থাকলেও মেঝের চীেকো গর্তটা রাজকুমারের চোখে পড়ে গেছে। তার চোখ চকচক করে উঠল।
সে বলল, বেরুবার পথ রয়েছে? তবু তুমি পালাওনি যে বড়? জায়গাটা সরু, তুমি গলতে পারোনি! সরে এসো, সরে এসো, আমি ঠিক গলে যাব।
দাঁড়াও, এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? আগে তোমার সঙ্গে কথাবার্তাগুলো হয়ে যাক?
আমার কোনও কথা নেই, সরে এসো।
আমার যে অনেক কথা আছে!
চালাকি করে সময় নষ্ট করছ? ছেলেমেয়েগুলোকে বাইরে পাঠিয়ে পুলিশে খবর দিতে চাও? আমি এক্ষুনি গিয়ে ওদের ধরে ফেলব।
এক্ষুনি তো তোমায় যেতে দেব না আমি!
রাজকুমার রিভলভারের নলটা কাকাবাবুর কপালের সোজাসুজি তুলে হিংস্রভাবে বলল, রায়চৌধুরী, আমি ঠিক দশ গুনব। তার মধ্যে সরে না। গেলে…
কাকাবাবু তার কথা শুনে নিজেই তখন গুণতে লাগলেন, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়-সাত-আট-নয়-দশ! তারপর হেসে হেসে বললেন, কই, গুলি করলে না?
রাজকুমার এক পা এগিয়ে এসে গলার আওয়াজে আগুন মিশিয়ে বলল, তুমি কি ভাবছ। আমি ছেলেখেলা করছি? তুমি যদি সরে না দাঁড়াও তা হলে তোমাকে আমি কুকুরের মতন গুলি করে মারব। জগাই মল্লিক কী বলবে তাও আমি পরোয়া করি না?
আমার কথা শেষ না হলে তোমাকে আমি যেতে দেব না বলছি তো!
রাজকুমার সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে ট্রিগার টিপল।
শুধু একটা খট্ করে আওয়াজ হল, গুলি বেরুল না।
কাকাবাবু এবার অট্টহাস করে উঠে বললেন, দেখলে, দেখলে! আমার হচ্ছে চার্মড লাইফ, আমি গুলিগোলায় মরি না!
রাজকুমার বিমূঢ়ভাবে হাতের রিভলভারটার দিকে তাকিয়ে রইল। আরও কয়েকবার ট্রিগার টিপলেও খট্-খট্ শব্দ হল।
কাকাবাবু বললেন, ওটা দিয়ে আর কিছু হবে না। ওই খেলনাটা এখন ফেলে দাও! কাল রাত্তিরে ঘুমের ওষুধ দিয়ে আমাদের অজ্ঞান করে দিয়েছিলে। জ্ঞান হারাবার আগে আমি বুঝতে পেরেছিলুম রিভলভারটা তুমি আবার নিয়ে যাবে। তাই আমি গুলিগুলো সব সরিয়ে ফেলেছি। তুমি একবার চেক করেও দ্যাখোনি।
রাজকুমার তখন সেই রিভলভারটাই কাকাবাবুর মাথার দিকে ছুঁড়ে মারবার জন্য হাত তুলতেই কাকাবাবু একটা ক্রাচ দিয়ে ঘুরিয়ে মারলেন তার হাতে।
রাজকুমারের হাত থেকে সেটা ছিটকে গিয়ে দেয়ালে লেগে আবার মেঝেতে পড়ল।
রাজকুমার এদিক-ওদিক তাকিয়ে টপ করে তুলে নিল কাকাবাবুর আর একটা ক্রাচ।
কাকাবাবু বসে ছিলেন, এই সুযোগে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন দেয়াল ঘেঁষে। রাজকুমারের চোখে চোখ রেখে তিনি শান্তভাবে বললেন, এখন আর ওটা নিয়ে তোমার কোনও লাভ নেই। শুধু শুধু আমার ক্রাচটা ভাঙবে। কোনওদিন লাঠিখেলা শিখেছি? আমি শিখেছি।
রাজকুমার দুহাত দিয়ে ক্রাচটা তুলে খুব জোরে মারতে গেল কাকাবাবুর মাথা লক্ষ্য করে, কাকাবাবু খুব সহজেই নিজের ক্রাচটা তুলে সেটা আটকালেন।
তারপর চলল। খটখট লড়াই।
এই সময় তলার সিঁড়ি দিয়ে উঠে এল সন্তু। রাজকুমার তার দিকে পেছন ফিরে রয়েছে, রাজকুমার তাকে দেখতে পেল না, কাকাবাবু দেখতে পেলেন। সন্তু সঙ্গে-সঙ্গে মনস্থির করে ফেলল। অনেক পাথরের মূর্তি পড়ে আছে, তার একটা তুলে নিয়ে সে পেছন দিক থেকে রাজকুমারের মাথায় ঠুকে দেবে।
সন্তু এক লাফে ওপরে এসে একটা মূর্তি তুলে নিতেই কাকাবাবু বললেন, তোকে কিছু করতে হবে না, এই দ্যাখ।
এতক্ষণ কাকাবাবু যেন খেলা করছিলেন, এবারে তিনি বিদ্যুৎ গতিতে ক্রাচটা রাজকুমারের মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে তার ঘাড়ে মারলেন।
উফ শব্দ করে রাজকুমার মাটিতে বসে পড়ল হাঁটু গেড়ে।
কাকাবাবু তাতেই থামলেন না, তিনি আবার মারলেন তার পিঠে।
রাজকুমার বলে উঠল, ওরে বাবা রে, মেরে ফেললে? কাকাবাবু এক টানে রাজকুমারের হাত থেকে অন্য ক্রাচটা কেড়ে নিয়ে সন্তুকে বললেন, ওইখানে দ্যাখ। কতকগুলো কাপড় পড়ে আছে, ওইগুলো দিয়ে ওর হাত আর পা বাঁধ তো?
রাজকুমার টান-টান হয়ে শুয়ে পড়েছে। সন্তু দুটো টুকরো কাপড় নিয়ে বেশ সহজেই বেঁধে ফেলল তার হাত ও পা। রাজকুমার ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে, কোনও বাধা দিতে পারছে না। তার ঘাড়ে খুবই জোর লেগেছে।
কাকাবাবুর মুখখানা বদলে গেছে। অসম্ভব রাগে। লাল লাল ছোপ পড়েছে তাঁর মুখে। ঘন-ঘন নিশ্বাস পড়ছে তাঁর।
তিনি বললেন, বার বার তিন বার। এর আগে ত্রিপুরায় তোমাকে দুবার ক্ষমা করেছি। এবার আর তোমার ক্ষমা নেই। আমার কথা শোনার ধৈর্য ছিল না তোমার, না? এবার শোনাচ্ছি।
রাজকুমার হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, উঃ, ভীষণ ব্যথা! মরে যাচ্ছি! মরে যাচ্ছি!
কাকাবাবু বললেন, না, তুমি মরবে না, বেঁচে উঠবে ঠিকই। বাকি জীবন জেলের ঘানি ঘোরাতে হবে না? পুলিশ তোমাকে যা-ই শাস্তি দিক, আমি নিজে তোমাকে আলাদা শাস্তি দেব! তুমি ছোট ছেলেমেয়েদের ওপর অত্যাচার করো, তুমি মানুষ বিক্রি করো, তুমি সমাজে থাকার অযোগ্য।
কাকাবাবু রিভলভারটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেট থেকে গুলি বার করলেন। বললেন, আগেই ওরা আমাকে সার্চ করেছে, তাই পরে আর পকেট দেখেনি। যাক, এতক্ষণে একটা ভালমতন অস্ত্ৰ পাওয়া গেল!
কাকাবাবু গুলিগুলো রিভলভারে ভরে সন্তুকে বললেন, তুই ওপরে উঠে এলি কেন? মেয়েটাকে এক ফেলে এলি?
সন্তু বলল, আপনার দেরি হচ্ছে দেখে…
তুই চলে যা নীচে।
এবারে আপনিও চলুন।
যাচ্ছি, একটু পরেই যাচ্ছি। আগে এই শয়তানটার সঙ্গে বোঝাপড়া করে যাই। ও যাতে জীবনে আর কোনওদিন কারুর ওপরে অত্যাচার করতে না পারে, সেই ব্যবস্থা করে যাব।
আমি থাকি না একটুখানি। একসঙ্গে যাব।
না। তোকে এখানে থাকতে হবে না। দেবলীনাকে এক ফেলে এসেছিস, ও যদি ভয় পেয়ে যায়? শিগগির যা!
কাকাবাবুর হুকুম অগ্ৰাহ্য করতে পারে না বলে সন্তু গর্তটার মধ্যে নামল। কিন্তু বেশি দূর গেল না। সিঁড়ির কয়েক ধাপ নীচে গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
সে ভাবল, কাকাবাবুকি রাজকুমারকে গুলি করে একেবারে মেরে ফেলবেন নাকি? সে কান খাড়া করে রইল।
কিন্তু গুলির শব্দের বদলে কিসের যেন ধাপ-ধপ আওয়াজ হতে লাগল। আর রাজকুমার বিকট চিৎকার করে বলতে লাগল, মরে গেলাম! মরে গেলাম! আর করব না, আর করব না, এবারকার মতন। দয়া করুন!
কাকাবাবু বললেন, না, তোমায় দয়া করব না। যতই চ্যাঁচাও কেউ শুনতে পাবে না! তুমি একটু আগেই আমাকে খুন করতে চাইছিলে না?
সন্তু কাকাবাবুর এত রাগ অনেকদিন দেখেনি। অথচ এর আগে সারাক্ষণ কাকাবাবু রাজকুমারের সঙ্গে ইয়ার্কির সুরে কথা বলছিলেন।
সন্তুর খুব কৌতূহল হচ্ছে কাকাবাবু ওকে কী শাস্তি দিচ্ছেন দেখবার জন্য। কিন্তু মাথা তুলতে সাহস করল না। ওপরের ধপধপ আওয়াজটা থেমে গেল, কিন্তু রাজকুমারের কান্না চলতে লাগল।
হঠাৎ নীচের দিকে তাকাতেই সন্তুর বুক কেঁপে উঠল। সিঁড়ি দিয়ে কে যেন উঠে আসছে। সিঁড়িটা যেখানে বেঁকে গেছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে টর্চের আলো।
সঙ্গে-সঙ্গে সন্তুর দুটো কথা মনে হল। টর্চের আলো নিয়ে যখন আসছে, তখন নিশ্চয়ই অন্য লোক। আর অন্য লোক যখন এই সিঁড়ির সন্ধান পেয়ে গেছে, তখন দেবলীনা নিশ্চয়ই ধরা পড়ে গেছে!
দেরি করার সময় নেই, সন্তু তরতার করে ওপরে উঠে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, কাকাবাবু, কেউ একজন আসছে! টর্চ নিয়ে!
কাকাবাবু সঙ্গে-সঙ্গে রাজকুমারের মুখটা চেপে ধরে ওর চিৎকার বন্ধ করে দিলেন। সন্তুকে বললেন, আর-একটা ন্যাকড়া নিয়ে আয়, ওর মুখটা বাঁধতে হবে। এটা আগেই করা উচিত ছিল।
সন্তু আর-একটা কাপড় নিয়ে এল, কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রাজকুমারের মুখ বাঁধা হয়ে গেল। এরই মধ্যে সে দুবার বাঁচাও, বাঁচাও বলে ফেলল।
কাকাবাবু সুইচ অফ করে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিলেন। তারপর মেঝের গর্তটার পাশে এসে বসলেন। সন্তুও বসল। অন্য দিকে। অন্ধকার ফুড়ে টর্চের আলো এসে পড়ল ঘরের মধ্যে। কিন্তু যে লোকটি সিঁড়ি দিয়ে উঠছিল, সে থেমে গেছে এক জায়গায়।
এই ছোট চৌকো গর্ত দিয়ে একজনের বেশি একসঙ্গে উঠতে পারবে না। যে আসবে, তাকে আগে মাথাটা বাড়াতেই হবে। একটা মাত্র ডাণ্ডার বাড়ি মেরে তাকে ঠাণ্ডা করে দেওয়া যায়।
সেই কথা বুঝেই ওই লোকটি আর উঠল না, দাঁড়িয়ে পড়েছে। এখন ওপর থেকেও কেউ নীচে নামতে গেলে লোকটা সহজেই তাকে কাবু করে ফেলবে!
লোকটি কোনও সাড়াশব্দও করছে না।
কাকাবাবু আর সন্তু নিঃশব্দে বসে রইল সেখানে। তারা ফাঁদে পড়ে গেছে। কিন্তু এই গর্তটার কাছে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লোকটা যে-কোনও সময়ে ওপরে উঠে আসতে পারে।
সন্তুর খুব অনুতাপ হচ্ছে দেবলীনাকে এক ফেলে আসার জন্য। অবশ্য সন্তু যখন তাকে বলেছিল, আমি একটু কাকাবাবুকে দেখে আসি, তুমি এখানে একা থাকতে পারবে?-সে বলেছিল, হ্যাঁ, পারব।
নীচের লোকটা টর্চ নিভিয়ে দিয়েছে। এখন একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এই অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে লোকটা হঠাৎ মাথা তুলতে পারে বলে কাকাবাবু তাঁর একটা ক্রাচ গর্তের মুখে আড়াআড়ি ভাবে রাখলেন।
তারপর এক-এক ঘণ্টার মতন লম্বা এক-একটা মিনিট কাটতে লাগল। কিছুই ঘটছে না। অসহ্য সেই প্ৰতীক্ষা! অন্ধকারের মধ্যে চেয়ে থাকতে-থাকতে যেন চোখ ব্যথা করে।
তারপর একসময় পেছনের দেয়ালে ঘর্ঘর শব্দ হল। ওদিকের দরজাটা খুলে যাচ্ছে। কেউ ঢুকছে ওদিক থেকে। এবার দুদিকেই শত্রু। কাকাবাবু ক্রাচটা সরিয়ে নিয়ে চৌকো পাথরটা গর্তে চাপা দিয়ে সেখানে বসে পড়লেন। সন্তুর গা টিপে বুঝিয়ে দিলেন একেবারে চুপ করে থাকতে।
দরজাটা খোলার পর জগাই মল্লিক মুখ বাড়িয়ে বলল, আল ক্লিয়ার। এবারে বেরিয়ে আসতে পারো। আর কিছু চিন্তা নেই। এ কী, ঘর অন্ধকার কেন? রাজকুমার, রাজকুমার
কেউ কোনও সাড়া দিল না। শুধু রাজকুমারের মুখ দিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ বেরুল।
জগাই মল্লিক ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বলল, এত ভয় যে, আলো নিভিয়ে আছ? আমি থাকতে চিন্তার কী আছে? ও রাজকুমার, ও রায়চৌধুরীবাবু!
পেছনে দরজাটা বন্ধ হয়ে যাবার শব্দ হল।
দেয়াল হাতড়ে সুইচটা টিপে আলো জ্বেলেই সে আঁতকে উঠল।
কাকাবাবু তার দিকে রিভলভার উঁচিয়ে আছেন।
শান্ত গলায় কাকাবাবু বললেন, পাশার দান উলটে গেছে, জগাই মল্লিক। এবারে আমি হুকুম দেব!
চাটু করে নিজেকে সামলে নিয়ে মুখে হাসি ফোঁটাবার চেষ্টা করে জগাই মল্লিক বলল, ওই পিস্তলটা বুঝি রাজকুমারের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন? ওটা একটা অপদাৰ্থ! কোনও কম্মের নয়! যাকগে, ভালই হয়েছে। আপনি আমার দিকে ওটা উঁচিয়ে আছেন কেন? আপনার সঙ্গে তো আমার কোনও ঝগড়া নেই! আমি ওই ব্যাটার কাছ থেকে আপনাকে উদ্ধার করে এনেছি!
কাকাবাবু বললেন, পেছনের দরজাটা খুলুন।
জগাই মল্লিক পেছন ফিরে দ্বিতীয়বার অবাক হয়ে বলল, আরেঃ, এ দরজাটা কে বন্ধ করল?
দেয়ালের গায়ে কিল মেরে সে চেঁচিয়ে উঠল, এই খোল, খোলা! এই পন্টু, এই ভোলা?
কিন্তু এদিক থেকে কোনও আওয়াজই যায় না। কেউ দরজা খুলল না। খুব সম্ভবত জগাই মল্লিক একই দরজা খুলে ঢুকেছে, তারপর দরজাটা নিজে-নিজেই বন্ধ হয়ে গেছে।
জগাই মল্লিক বলল, যাকগে, একটু পরে ওরা কেউ এসে খুলে দেবে।
কাকাবাবু বললেন, যে-করেই হোক, এক্ষুনি দরজাটা খোলার ব্যবস্থা করুন!
ও দরজা তো ভেতর থেকে খোলা যায় না!
কোনও গোপন উপায় নেই?
না, তার জন্য ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? একটু বাদেই আমার কোনও লোক এসে খুলে দেবে। ওরা এখন নীচে পুলিশের লোকদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করছে! পুলিশ সার্চ করে কিছুই খুঁজে পায়নি। এ কী, আমার বিষ্ণুমূর্তি? মোটে একটা কেন?
সে-মূর্তি স্বর্গে ফিরে গেছে।
অ্যাঁ? আর সেই মেয়েটা?
সেই মেয়েটাকে আপনার, লোক ঘাড় ধরে এই ঘরের মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। তার কপাল কেটে রক্ত বেরিয়েছিল, তবু আপনি কোনও কথা বলেননি।
মেয়েটা পুলিশ এসেছে শুনেই টিয়াপাখির মতন চ্যাঁচাতে গেল কেন?
আপনি বলেছিলেন, আপনার ওই বয়েসি ছেলেমেয়ে আছে। আপনার ছেলে বা মেয়েকে কেউ ওইরকমভাবে ছুঁড়ে দিলে আপনি সহ্য করতেন?
আহা, ওসব ছোটখাটো কথা এখন থাক না। আমার বিষ্ণুমূর্তি কোথায় গেল?
ওই মূর্তিটা উদ্ধার করতে গিয়ে আমায় সাপে কামড়েছিল। ওটা আপনার হয়ে গেল কী করে?
আমি দাম দিয়ে কিনেছি।
টাকা দিয়ে সবই কেনা যায়, না? মানুষও কেনা যায়!
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়ালেন। একটু সরে এসে বললেন, আপনার লোক এসে কতক্ষণে ঐ দরজা খুলবে, ততক্ষণ আমার ধৈর্য থাকবে না। তার আগেই আমার কাজ শুরু করতে হবে। ওই রাজকুমারের দিকে চেয়ে দেখুন। ওরা দুটো বুড়ো আঙুল আমি জন্মের মতন র্থেতলে দিয়েছি। বুড়ো আঙুল না থাকলে কী হয় জানেন? যার বুড়ো আঙুল থাকে না সে কোনও অস্ত্র ধরতে পারে না। ও এখন হাত দিয়ে অন্য সব কাজই করতে পারবে, কিন্তু কোনওদিন আর ছুরি-ছোরা-বন্দুক ব্যবহার করতে পারবে না।
রাজকুমার বড়-বড় চোখ মেলে চেয়ে আছে। এই সময় কুঁ-বু শব্দ করে কিছু বলতে চাইল।
কাকাবাবু বললেন, এখন আমি যা বলব, তার যদি একটুও নড়াচড় হয়, তা হলে তোমারও ওই অবস্থা হবে জগাই মল্লিক?
তারপর সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, তুই ওই সিঁড়ির পাথরটা সরিয়ে দে!