ঢল নেমেছে আজ,
উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায়, তারপর সরকারি হাইওয়ে
শ্রাবণহীন ঢল; অসময়ের ঢেউ দুলিয়ে
চলে গেছে শাশ্বতী নামে পাখিটি
খড়-কুটো নিয়ে, মা বলেছিলেন
অসময়ের ফল শুভ নয়, সাবধানে থাকিস খোকা
আমি তখন রামকৃষ্ণ বস্ত্রালয়ের চত্বরে
গরম চায়ের নেশায়, পেঁয়াজ গন্ধ একটু বেশিই
লেগেছিল নাকে, আর মুড়ির তেলের ঝাঁঝ
এসব সাপটে আশ্বিনের মাদকতা
দেখছিলাম আকাশ জুড়ে,
আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল আষাঢ় যুবক
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন ঘোষালবাবু আমাদের নিধু ঘোষাল,
কালিদার চায়ের আড্ডায় বসে পরপর কয়েক কাপ চা খেয়ে মাথার খুলিটা তুলে ধরেছিলেন, বুড়বুড়ি কেটেছিলেন নতুন কবিতায়, দুয়েক ছন্দ আবৃত্তিও
করেছিলেন, গলার সাথে একেবারে বেখাপ্পা তবুও নিজস্ব ভঙ্গি, নিজস্ব সৃষ্টি।
আমি না দেখার ভান করে জোরে পা চালাতেই খপ করে ধরলেন, মনে হল বড়সড়ো একটা রুই
বললাম যেতে হবে, কথা আছে—কমলা টকিজে
নতুন বই লেগেছে, এ্যাডভান্স বুকিং করেছে বেকার বয়সে প্রেম, গলা খাকাড়ি দিয়ে উঠলেন
ধরে বসালেন আমায়
আকাশটাকে দেখালেন, আশ্বিনের ঢল, আশ্বিনের
ঢেউ আজ জেগেছে আকাশে
আমি রাস্তার দিকে চেয়ে মনে মনে
নিধুবাবুকে গালাগালি করছিলাম, বলছিলাম
তোমার কবিতার নিকুচি করেছে—
স্কুলের ঢং ঢং আওয়াজে ছুটির বার্তা বয়ে আনল
বর্ষার ছুটি আজ, ছোট ছোট
ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করে চলতে চলতে একসময়
বড় হয়ে গেল !
নিধুবাবু আমাকে তাঁর শেষ রচনার
গৌরচন্দ্রিকা দিচ্ছিলেন
আমি দেখছিলাম রূপালি পর্দার নায়িকা
এলোকেশীকে; বন্ধুরা বলেছিল যতীনবাবুর
কোচিং সেন্টার নাকি হাউসফুল এলোকেশীর পেছনে যত পড়ুয়া ছেলে দখিনা হাওয়ার মত
হু হু করে একেবারে হাউসফুল করে দিল।
ওদের হাতে স্বপ্নাদ্য মাদুলি, দৃষ্টি সবার ওই
ফাৎনার দিকে
কিন্তু ওদের আড্ডা বিড়িবাঁধা কদম গাছের নিচে, ফুক্ ফুক্ বিড়ি টানে কাশেও মাঝে মাঝে …
থাক অতশত—আমাদের নিধুবাবুও ছেলে পড়াতেন,
তবে কোনো কোচিং সেন্টার খুলেননি
কিন্তু কখন যেন এসব ছেড়ে কবিতার
ছন্দ পরিক্রমায় নামলেন কেউ জানে না ;
আমার সাথে তাঁর প্রথম পরিচয়
কালিদার এই চায়ের আড্ডাতেই
কেউ একজন আঙুল তুলে দেখাল এক উস্কো-খুস্কো
লোককে, দেখে মায়া হল
‘মল্লিকা’ পত্রিকায় ওঁর দুটো
লেখা পড়েছিলাম, বলেছিলাম বেশ
লিখেছেন; ব্যস এই আরকি, অবশ্য
‘মল্লিকা’ নামে কাগজটি আর কখনো বেরোয়নি।
নিধুবাবুর কাছেই আমার হাতেখড়ি
আমাকে মানিক বলে ডাকতেন
বস্তুত আমার নাম মানিক নয়
পৈতৃক নাম শ্যামসুন্দর
কবিতা লেখার উপমার মত উনিই আমার
নামটা দিয়েছিলেন।
আজ আমাকে তাই নিধুবাবু তাঁর
শেষ লেখা পদ্যের ছন্দপতনের কথা
বলছিলেন,
বলছিলেন আশ্বিনের ঢেউ এর কথা,
শাশ্বতী নামে পাখিটি সেই যে গেল
নিধুবাবু তার অপেক্ষায় সারাবিকেল পার করে দিলেন তিন লাইন পদ্য লিখে
অসমাপ্ত করে রাখলেন ওটা।
আজ প্রথম লক্ষ্য করলাম একটা ঢল নেমেছে
নিধুবাবুর ভেতর।
বোধহয় আশ্বিনের ঢল
ঢেউ তার কূল ছাপিয়ে গেছে
হঠাৎ মার কথা মনে পড়ল, বলছিলেন
অসময়ের ফল শুভ নয়, সাবধানে থাকিস খোকা,
একটা ঢল যেন বয়ে গেল
আশ্বিনের ঢেউ
আমার কূল ছাপিয়ে গেল
আমি অতি সন্তর্পণে রাস্তায়
পা বাড়ালাম…