প্লেনটা আবার আকাশে উড়ল
প্লেনটা আবার আকাশে উড়ল তিনঘণ্টা পরে।
এবার কাকাবাবুর পাশে বসেছেন অরুণকান্তি। তিনি বললেন, আমি বয়সে আপনার চেয়ে তেমন কিছু ছোট নই। তবু অনেকেই আপনাকে কাকাবাবু বলে, আমিও কাকাবাবু বলে ডাকতে পারি?
কাকাবাবু হেসে বললেন, হ্যাঁ, পারেন নিশ্চয়ই। কাকাবাবুটাই এখন আমার ডাকনাম হয়ে গিয়েছে। অনেকে আসল নামই মনে রাখে না।
অরুণকান্তি বললেন, তা হলে আপনি আমাকে তুমি বলবেন। যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ।
অরুণকান্তি বললেন, আপনি যে একজন হাইজ্যাকারকে ঘুসি মারলেন, তখন একটুও ভয় করেনি? ওর হাতে অমন মারাত্মক অস্ত্র ছিল, আপনার ঘুসিটা যদি ওর চোখে ঠিকমতো না লাগত, তা হলে তো সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালিয়ে আপনাকে মেরে ফেলত। সেকথা একবারও ভাবেননি?
কাকাবাবু বললেন, না, সেকথা মনে পড়েনি। তখন এমন রাগ হয়ে গিয়েছিল, সে সময় আর কোনও কিছু মনে পড়ে না। তবে মরতে তো একদিন হবেই, বিছানায় শুয়ে অসুখে ভুগে ভুগে মরার চেয়ে কোনও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে যদি মরতে হয়, সেটাই ভাল মনে হয় আমার কাছে।
অরুণকান্তি আরও কিছু বলতে গেলেন, তা আর শোনা গেল না। প্লে
নের সামনের দিকে দশ-বারোজন লোক একসঙ্গে একটা গান গেয়ে উঠল। তারা সবাই আফ্রিকান। সে গানের ভাষা বোঝা যায় না।
প্লেনে সবাই গম্ভীর হয়ে থাকে কিংবা পাশের লোকের সঙ্গে নিচু গলায় কথা বলে। এরকমভাবে কোরাস গান আগে কখনও শোনা যায়নি। আসলে এত বড় একটা বিপদ কেটে গিয়েছে বলে সকলেরই এত ফুর্তি হয়েছে যে, তা আর চেপে রাখতে পারছে না।
গানের সুরটায় বেশ দুলুনি আছে, শুনতে ভাল লাগে।
অরুণকান্তি বললেন, কাকাবাবু, আপনি গানের কথা কিছু বুঝতে পারছেন?
কাকাবাবু বললেন, না। এটা কি সোয়াহিলি ভাষা? আমি বুঝব কী করে?
অরুণকান্তি বললেন, আমি একটু একটু বুঝি। আমাকে প্রায়ই কেনিয়ার নানান জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়, তাই সোয়াহিলি ভাষা খানিকটা শিখতে হয়েছে। ওই যে মাঝে মাঝেই বলছে, হাকুনা মাটাটা, হাকুনা মাটাটা, তার মানে হচ্ছে, আর কোনও সমস্যা নেই!
কাকাবাবুও দুবার বললেন, হাকুনা মাটাটা, হাকুনা মাটাটা! আমিও মুখস্ত করে রাখি, যদি পরে কাজে লাগে।
অরুণকান্তি বললেন, আপনি কি এখানে বিশেষ কোনও কাজে যাচ্ছেন?
কাকাবাবু বললেন, না না, কোনও কাজে নয়, এমনিই বেড়াতে এসেছি। আমি আগে একবার কেনিয়ায় এসেছিলাম, তখন অনেক কিছুই দেখা হয়নি। নাইরোবিতে পি আর লোহিয়া নামে একজন ব্যবসায়ী আছেন, তিনি আমাকে নেমন্তন্ন করেছেন। তাঁর সঙ্গে আমার অনেকদিনের পরিচয়। তিনি আমাকে অনেক জায়গায় বেড়াবার ব্যবস্থা করে দেবেন বলেছেন। আফ্রিকা আমার খুব ভাল লাগে।
অরুণকান্তি বললেন, ওরে বাবা, পি আর লোহিয়া তো খুব নামী লোক। তাঁর অনেকরকম ব্যাবসা, অনেক ক্ষমতা। তবে তিনি অনেককে নানারকম সাহায্যও করেন। তা ছাড়া, আপনি জানেন নিশ্চয়ই, মি. লোহিয়া জঙ্গলের জন্তু-জানোয়ারদের অকারণে হত্যা করার ঘোর বিরোধী। এখানে অনেক চোরাশিকারি আছে। তাদের এক পাণ্ডার নাম স্যাম নিন্জানে। দুমাস আগে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। সব কাগজেই সে খবর বড় করে ছাপা হয়েছিল।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, এ খবর আমিও শুনেছি। লোহিয়া বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের ব্যাপারে খুব উৎসাহী। বিশেষ করে কোথাও কোনও হাতি মারা পড়লে, সেকথা শুনেই তিনি কেঁদে ফেলেন। তিনি খুব হাতির ভক্ত।
অরুণকান্তি বললেন, কিন্তু আপনি কি এ খবর শুনেছেন, দিনদশেক আগে ওই স্যাম নিজানে জেলখানা থেকে পালিয়ে গিয়েছে?
একথা শুনে কাকাবাবু খুব অবাক হলেন না। তিনি বললেন, চোরাশিকারিদেরও অনেক টাকা। তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও কিছু লোককে ঘুষটুস খাইয়ে জেল থেকে বেরিয়ে আসে। এরকম তো অনেক দেশেই হয়। তবে আবার ধরা পড়বে নিশ্চয়ই।
অরুণকান্তি বললেন, আপনি আসছেন তো, ইচ্ছে করলেই ওই নিজানেকে আবার ধরিয়ে দিতে পারবেন।
কাকাবাবু বললেন, না না। আমার সেরকম ক্ষমতাই নেই। আমি বিদেশি, কোনও অপরাধীর পিছু ধাওয়া করব কী করে? সেটা আমার কাজই নয়। আমি ওসব ব্যাপারে মাথাই গলাব না। আমি শুধু নিশ্চিন্তে বেড়াতে চাই।
আকাশ পরিষ্কার। ঝড়-ঝাপটা নেই। আর কোনও ঝামেলা হল না, বিমানটি পৌঁছে গেল নাইরোবি বিমানবন্দরে।
নীচে নেমে আসার পর হেমন্তিকা নামের সেই মহিলা কাকাবাবুর কাছে এসে বললেন, আমাদের বাড়িতে আসতে হবে কিন্তু! আপনি কথা দিয়েছেন।
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, যাব। আচ্ছা বলো তো, রবীন্দ্রনাথের কোন গানে নাই রবি আছে?
মহিলা বেশ অবাক হয়ে বললেন, রবীন্দ্রনাথ নাইরোবি নিয়ে গান লিখেছেন? রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন?
কাকাবাবু বললেন, রবীন্দ্রনাথ এখানে এসেছিলেন কি না, তা জানি না। রবীন্দ্রনাথ নাইরোবি নিয়ে গান লিখেছেন, তাও বলিনি। আমি বলছি, রবীন্দ্রনাথের কোন গানে নাই রবি আছে?
হেমন্তিকা বললেন, তা তো জানি না।
কাকাবাবু বললেন, খুঁজে দ্যাখো। যেদিন তোমাদের বাড়ি যাব, সেদিন এই গানটা শুনতে চাই।
বাইরে আসার পর অরুণকান্তি জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে কেউ নিতে এসেছে?
কাকাবাবু সামনের লোকজনের দিকে তাকিয়ে বললেন, নাঃ, কে আর আসবে? সবই তো উলটোপালটা হয়ে গিয়েছে।
অরুণকান্তি বললেন, তা হলে আপনি কী করে যাবেন?
কাকাবাবু বললেন, একটা ট্যাক্সি নিয়ে কোনও হোটেলে উঠব। তারপর লোহিয়ার খোঁজ করব। ওঁর বাড়ির ফোনটা বোধহয় খারাপ, অনেকবার চেষ্টা করেও লাইন পাইনি।
অরুণকান্তি বললেন, আমি একটা অনুরোধ করব? আমি কাম্পালা থেকেই ফোন করে আমার অফিসকে সব খবর জানিয়েছি। অফিস থেকে গাড়ি পাঠাচ্ছে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন। আমার বাড়িতে গিয়ে আজকের রাত্তিরটা বিশ্রাম নিন। কাল সকালে লোহিয়ার খোঁজ নেওয়া যাবে।
কাকাবাবু বললেন, এ তো ভালই প্রস্তাব। কিন্তু আমি গেলে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না তো?
অরুণকান্তি বললেন, অসুবিধে আবার কী? আপনি গেলে আমি ধন্য হব। আপনি যেভাবে আমাদের সবাইকে বাঁচালেন…!
কাকাবাবু বললেন, থাক, ওকথা থাক। আমি তো কোনও বিরাট বীরপুরুষের মতো কিছু করিনি। ওটা হঠাৎ ঘটে গিয়েছে।
অরুণকান্তি বললেন, আমার তো অসুবিধের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। আপনার কোনও অসুবিধে হবে না। কোম্পানি আমাকে বড় বাড়ি দিয়েছে, অনেক ঘর। তিনজন কাজের লোক। আমার স্ত্রী অবশ্য এখানে নেই, দেশে গিয়েছেন। তবে রান্নাবান্নার লোক আছে। আপনি যা খেতে ভালবাসেন, তাই-ই বানিয়ে দেবে।
অরুণকান্তি কাকাবাবুকে সুটকেসও টানতে দিলেন না, নিজেই নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুললেন। বিরাট এসি গাড়ি, ড্রাইভারের সাদা পোশাক, মাথায় টুপি। বোঝাই যাচ্ছে, অরুণকান্তি বেশ বড় চাকরি করেন।
প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল তাঁর বাড়ি পৌঁছোতে।
নিরিবিলিতে ছিমছাম একটা দোতলা বাড়ি। সামনে অনেকখানি বাগান। অনেক বড় বড় গাছে ম্যাগনোলিয়া ফুল ফুটে আছে।
একতলাতেই অতিথিদের জন্য সাজানো একটা ঘর। কাকাবাবুকে আর সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে হল না। এ ঘরেই টিভি, ফোন সবই আছে। সংলগ্ন বাথরুম। কোনও অসুবিধে নেই। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। কাকাবাবু স্নান সেরে নিলেন। কাম্পালায় অনেক কিছু খাইয়েছে, এখন আর বিশেষ কিছু খাওয়ার ইচ্ছে নেই। তবু অরুণকান্তির অনুরোধে খানিকটা মুরগির ঝোল আর ভাত খেতে হল।
খাওয়ার পর অরুণকান্তি বললেন, আপনি এবার বিশ্রাম নিন। কাল সকালে কথা হবে।
গুড নাইট, বলে তিনি উপরে চলে গেলেন।
গতকাল থেকে খুব ধকল গিয়েছে। কাকাবাবু ভেবেছিলেন, খাওয়ার পরেই ঘুমে চোখ টেনে আসবে। কিন্তু বিছানায় শুয়েও তাঁর ঘুম এল না।
খুব সন্তুর কথা মনে পড়ছে। প্রত্যেকবারই বাইরে কোথাও গেলে সন্তু সঙ্গে থাকে। গতবারেও সন্তু এসেছিল কেনিয়ায়। এখন সন্তুর পরীক্ষা চলছে। কয়েকটা দিন পিছিয়েও দেওয়া গেল না। কারণ, লোহিয়া জানিয়েছিলেন, এই সময়েই তাঁর সুবিধে। সামনের সপ্তাহেই তাঁকে অনেক দিনের জন্য চলে যেতে হবে আমেরিকায়।
কাল সকালে সন্তুকে ফোন করে জানতে হবে, পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? জোজোও পরীক্ষা দিচ্ছে একই সঙ্গে।
ঘুম আসছে না কিছুতেই।
বই পড়লে ঘুম আসতে পারে, কাকাবাবু তাই বিছানার পাশের আলো জ্বেলে মহাভারত খুললেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে কর্ণের সঙ্গে দেখা হয়েছে কৃষ্ণের। কৃষ্ণ তাঁকে বললেন, তুমি তো আসলে কুন্তীরই ছেলে। পাণ্ডবদের ভাই। তুমি দুর্যোধনকে ছেড়ে এসে আমাদের পক্ষে যোগ দাও!
কাকাবাবু পড়েই চলেছেন, ঘুমের নামগন্ধও নেই।
খানিক পর তিনি শুনতে পেলেন দরজায় ঠুকঠুক শব্দ।
কাকাবাবুর ভুরু কুঁচকে গেল। এত রাত্রে আবার কে আসবে?
অরুণকান্তি উপরে চলে গিয়েছেন। সব দরজা-জানলা বন্ধ রাখতে বলেছেন, নইলে অনেক রকম পোকামাকড় আসতে পারে। চোরের উপদ্রবও আছে।
আরও একবার সেই শব্দ হতে কাকাবাবু বিছানায় উঠে বসে জিজ্ঞেস করলেন, কে?
অরুণকান্তিরই গলা পাওয়া গেল। তিনি বললেন, সরি কাকাবাবু, আপনি নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, আমি ডিসটার্ব করছি। একটা ব্যাপার ঘটেছে…!
কাকাবাবু দরজা খুলে দিয়ে বললেন, কী ব্যাপার?
অরুণকান্তি ভিতরে ঢুকে এসে বললেন, আপনি টিভি দেখেননি?
কাকাবাবু বললেন, টিভি? আমার তো টিভি দেখার তেমন অভ্যেস নেই।
অরুণকান্তি বললেন, রোজ রাতে কিছুক্ষণ টিভি না দেখলে আমার ঘুম আসতে চায় না। খবরটবর দেখি…!
অরুণকান্তি এ ঘরের টিভিটা চালিয়ে দিলেন। তাতে ইংল্যান্ডের ফুটবল খেলা দেখাচ্ছে।
কাকাবাবু বিস্মিতভাবে অরুণকান্তির দিকে তাকালেন।
অরুণকান্তি বললেন, দাঁড়ান, আবার নিশ্চয়ই দেখাবে।
কয়েকমিনিট পরে শুরু হল বিজ্ঞাপন।
তারপরই দেখাল, বিশেষ সংবাদ, যাকে বলে ব্রেকিং নিউজ। তাতে লেখা ফুটে উঠল, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী পি আর লোহিয়ার বিশাল বাড়ি আগুন লেগে সম্পূর্ণ ভস্মীভূত। আগুন কীভাবে লাগল, পুলিশ তা অনুসন্ধান করে দেখছে। কেউ কেউ সন্দেহ করছে, এটা তাঁর শত্রুপক্ষের কাজ। পি আর লোহিয়াকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিনি আগুনে পুড়ে মারা যাননি, এটা নিশ্চিত। ধ্বংসন্তুপে তাঁর কোনও চিহ্ন পাওয়া যায়নি।
মি. লোহিয়া বাইরে যাওয়ার সময় একটা মোবাইল ফোন সঙ্গে রাখেন। সেটা আধপোড়া অবস্থায় উদ্ধার হয়েছে। সুতরাং তিনি নিজে কোথাও চলে গিয়েছেন কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না।
মি. লোহিয়ার কেউ সন্ধান দিতে পারলে তাঁকে পাঁচ লক্ষ ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
খবরটা দেখার পর দুজনেই একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন।
তারপর অরুণকান্তি বললেন, এরকম ঘটনা এখানে আগেও কয়েকবার ঘটেছে। কারও সঙ্গে শত্রুতা থাকলে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। লোহিয়া অত বড় ব্যবসায়ী, তাঁর তো অনেক শত্রু থাকবেই। বিশেষত, রয়াল পাওয়ার নামে একটা ব্রিটিশ কোম্পানির মালিক অ্যান্ড্রু লয়েড নামে এক সাহেবের সঙ্গে তাঁর ঝগড়া ও মুখ দেখাদেখি বন্ধ ছিল। আমার তো মনে হয়, লোহিয়ার ব্যাবসার ক্ষতি করার জন্য ওই ব্রিটিশ কোম্পানিই গুন্ডা লাগিয়ে এ কাজ করেছে। এ কাজের জন্য এখানে গুন্ডা ভাড়া পাওয়া যায়।
কাকাবাবু বললেন, কিন্তু লোহিয়া গেলেন কোথায়? তিনি কি আগুন লাগার সময় পালিয়ে গিয়েছেন? কিংবা তাঁকে ধরে নিয়ে গিয়েছে?
অরুণকান্তি বললেন, সেটা কয়েক দিনের মধ্যেই জানা যাবে। যদি কেউ ধরে নিয়ে যায়, নিশ্চয়ই মুক্তিপণ দাবি করবে।
কাকাবাবু বললেন, পাঁচ লাখ ডলারের পুরস্কার তো ঘোষণা করা হয়েই গিয়েছে।
অরুণকান্তি বললেন, কাকাবাবু, পাঁচ লাখ ডলার আমাদের দেশের টাকার হিসেবে অনেক টাকা, কিন্তু এখানে বড় ব্যবসায়ীদের পাঁচ লাখ ডলার কিছুই নয়। এদের কোটি কোটি ডলারের কারবার। মি. লোহিয়ার যে বাড়িখানা ধ্বংস হয়ে গেল, সেটার দামই তো অন্তত দু-তিন কোটি ডলার।
কাকাবাবু বললেন, আগুন লেগেছে কাল রাত্তিরে। লোহিয়া আমাকে তাঁর বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন। আমি ঠিক সময় পৌঁছেলে হয়তো আগুন লাগার সময় ওই বাড়িতেই থাকতাম।
অরুণকান্তি বললেন, আপনি থাকলে হয়তো আগুন লাগতই না। আপনি কোনও না-কোনওভাবে ঠিক লোকগুলোকে ধরে ফেলতেন। আপনার যা ক্ষমতা দেখছি?
কাকাবাবু বললেন, ধ্যাত। আমার সেরকম ক্ষমতাই নেই। আগুন লাগলে হয়তো আমি পুড়েই মরতাম। আমার তো দৌড়ে পালাবার ক্ষমতা নেই।
একটু পরে অরুণকান্তি বললেন, অবশ্য আপনি এসে পড়েছেন, আপনার বেড়াবার কোনও অসুবিধে হবে না। আমি কয়েকদিন ছুটি নেব, আপনাকে আশপাশের কয়েকটা জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়ে আনব।
কাকাবাবু বললেন, লোহিয়া আমার বন্ধু মানুষ। তিনি আমাকে এখানে নেমন্তন্ন করে এনেছেন, তাঁর এত বড় বিপদের সময় আমার কি আর বেড়াতে ভাল লাগবে? তাঁর কী হল, কোথায় গেলেন, সেটাই আগে জানা দরকার।
অরুণকান্তি চলে যাওয়ার পর কাকাবাবু আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন। লোহিয়ার কথাই ভাবতে লাগলেন। তারপর একসময় ঘুমিয়ে পড়লেও জেগে উঠলেন বেশ ভোরে।
বাইরে বেরিয়ে কিছুক্ষণ বাগানে ঘুরলেন তিনি। একটু শীত শীত লাগছে। এখন কলকাতায় খুব গরম, এখানে সোয়েটার কিংবা চাদর গায়ে দিলে ভাল হয়।
কাকাবাবুর মনটা বেশ অস্থির হয়ে আছে। কোনও কবিতা কিংবা গান। ভাববার চেষ্টা করেও পারছেন না।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে অরুণকান্তি বললেন, আমার একবার বিকেলের দিকে অফিসে গেলেই চলবে। সকালে কোথায় বেড়াতে যাবেন বলুন?
কাকাবাবু বললেন, বেড়াবার বদলে আমি একবার লোহিয়ার আগুনলাগা বাড়িটা দেখে আসতে চাই। তুমি চেনো সেই বাড়িটা?
অরুণকান্তি বললেন, সেটা এ শহরের একটা বিখ্যাত বাড়ি ছিল। ওটা আগে ছিল একজন ইংরেজের বাড়ি। লোহিয়া সেটা কিনে নিয়ে আরও অনেক বাড়িয়ে ছিলেন। চতুর্দিকে বারান্দা, আর সব বারান্দা ঝুলন্ত ফুলের টব দিয়ে সাজানো। চলুন, সেদিকেই যাই।
নাইরোবি শহরটার পশ্চিম দিকটাতেই ছিল বেশিরভাগ ইংরেজদের বাড়ি।
গাড়ি চালাতে চালাতে অরুণকান্তি বললেন, আমাদের কলকাতা শহরটার মতো নাইরোবি শহরও অনেকটা ইংরেজ সাহেবরাই বানিয়েছে। কলকাতায় সাহেবরা যেমন থাকত চৌরঙ্গি-পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলে, এখানেও সাহেবরা থাকত নানগাটা, হাইরিজ এইসব পাড়ায়। এখনও কিছু কিছু সাহেব রয়ে গিয়েছে। তবে, একসময় ওসব পাড়ায় সাদা চামড়ার লোকরা ছাড়া কালো মানুষদের থাকার কোনও অধিকারই ছিল না। এখন কিছু কিছু কেনিয়ান, ভারতীয়, চিনারাও বাড়ি কিনে নিয়েছে।
পাড়াগুলো বেশ সুন্দর, পরিষ্কার, ছিমছাম।
গাড়িটা উঠতে লাগল খানিকটা উঁচুমতো একটা টিলার দিকে। আকাশ একেবারে পরিষ্কার, ঝকঝক করছে রোদ। এই রোদে গরম লাগে না।
কাকাবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, আরে! আগে শহরের এদিকটায় আসিনি। এখান থেকে কিলিমাঞ্জারো পাহাড় দেখা যায়?
অরুণকান্তি বললেন, হা, ওই তো দেখা যাচ্ছে। রোজ দেখা যায় না, শুধু পরিষ্কার দিনেই।
কাকাবাবু বললেন, ইস, আমাদের কলকাতা থেকে যদি কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যেত, কী ভাল হত! পাহাড় দেখতে হলে আমাদের অনেক দূরে যেতে হয়।
অরুণকান্তি বললেন, আমাদের এখানে তো চতুর্দিকেই পাহাড় আর জঙ্গল।
একটু যেতে না-যেতেই দেখা গেল কিছু লোক দৌড়োদৌড়ি করছে রাস্তা দিয়ে। তারা কোনও কারণে ভয় পেয়েছে মনে হয়!
লোকগুলো কাকাবাবুদের গাড়িটার পাশ দিয়ে যেতে যেতে কী যেন বলে গেল, তার মানে বোঝা গেল না।
তারপরই দেখা গেল, রাস্তার মাঝখানে একজোড়া চিতাবাঘ!
অরুণকান্তি সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে বললেন, কাকাবাবু, কাচ তুলে দিন। চিতাবাঘ খুবই হিংস্র। কিন্তু কাচ বন্ধ থাকলে কিছু করতে পারবে না।
কাকাবাবু বললেন, চিতাবাঘ একেবারে শহরের মধ্যে ঢুকে পড়ল কী করে? জঙ্গলের দিকে জাল ঘেরা আছে না?
অরুণকান্তি বললেন, কী হয়েছে বুঝতে পেরেছি। সিংহ কখনও কখনও ঢুকে পড়ে শুনেছি, কিন্তু চিতাবাঘ কখনও শহরে আসে না। মি. লোহিয়ার বাড়িতে বেশ কিছু জন্তু-জানোয়ার ছিল। ওঁর নিজস্ব চিড়িয়াখানা। জন্তুগুলো ওঁর প্রায় পোষাই ছিল বলতে গেলে। বাড়িতে আগুন লাগার ফলে সেই জন্তুগুলো সব বেরিয়ে পড়েছে।
চিতাবাঘ দুটো বসে পড়েছে রাস্তার ঠিক মাঝখানে।
কাকাবাবু বললেন, কী সুন্দর দেখতে! আমাদের নর্থ বেঙ্গলেও লেপার্ড বা চিতাবাঘ আছে বটে, কিন্তু সেগুলো ছোট ছোট। আফ্রিকার চিতা অনেক বড়।
অরুণকান্তি বললেন, এরা সাংঘাতিক হিংস্র আর সব প্রাণীর মধ্যে এরাই সবচেয়ে জোরে দৌড়াতে পারে।
পিছনে আরও দু-তিনটে গাড়ি এসে গিয়েছে। তারা হর্ন দিতে লাগল। অরুণকান্তিও বাজাতে লাগলেন হর্ন। চিতা দুটো সেই আওয়াজে যেন বেশ বিরক্ত হয়ে ঢুকে গেল রাস্তার পাশের একটা ঝোপে।
অরুণকান্তি গাড়িতে আবার স্টার্ট দিয়ে বললেন, এ শহরের লোকেরা জানে যে, চিতারা আওয়াজ সহ্য করতে পারে না। কিন্তু যদি কোনও হাতি এসে পড়ত, সহজে সরে যেত না। মি. লোহিয়ার চিড়িয়াখানায় হাতিও ছিল নিশ্চয়ই।
টিলাটার উপরের দিকে বেশ কিছু মানুষের ভিড় রয়েছে। এখানেই ছিল সেই বিখ্যাত বাড়ি। এখনও কয়েক জায়গায় ধিকিধিকি করে জ্বলছে আগুন। দুখানা দমকলের গাড়ি জলের ফোয়ারা ছিটিয়েই চলেছে। উদ্ধারকর্মীরা ধ্বংসন্তুপ সরিয়ে সরিয়ে খুঁজছে, কেউ চাপা পড়ে আছে কি না।
একপাশে একজন ব্যক্তিকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছু সাংবাদিক আর টিভি ক্যামেরা। অরুণকান্তি গাড়ি থেকে নেমে বললেন, চলুন, ওই দিকে যাই। ওই ভদ্রলোককে চিনি, উনি চমনলাল দেওয়ান, মি. লোহিয়ার ব্যাবসার একজন পার্টনার। লোহিয়ার কীরকম আত্মীয়ও যেন হন। ইনি আবার একজন নামি সাঁতারু!
লোহিয়ার সঙ্গে এই ব্যক্তিটির চেহারার অনেক তফাত। লোহিয়া রোগাপাতলা, শান্ত ধরনের মানুষ। কথা বললে বোঝাই যায় না, তিনি এত বড় একজন ব্যবসায়ী, অঢেল টাকার মালিক। আর এই ব্যক্তিটি লম্বা-চওড়া, দশাসই পুরুষ, মস্তবড় গোঁফ। গলার আওয়াজটাও বাজখাই।
তাঁর কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে সবদিক দেখতে লাগলেন। এমন আশ্চর্য সুন্দর বাড়ি ধ্বংস হয়ে গেল! তাঁর এ বাড়িতেই থাকার কথা ছিল। নিশ্চয়ই খুব ভাল লাগত!
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে চমনলাল বললেন, না, এখনও মি. লোহিয়ার কোনও খবর পাওয়া যায়নি। কেউ তাঁর মুক্তিপণ দাবিও করেনি। আগুন লেগেছিল মধ্য রাত্তিরে, তখন তিনি এ বাড়িতেই ঘুমিয়ে ছিলেন। আমরা সবাই তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। আগুন লাগার পর অ্যালার্ম বেল বেজে ওঠে। আমরা সবাই ছুটোছুটি করে বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই তাঁকে দেখতে পাইনি।
একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, উনি কি একলা একলা বাড়ির বাইরে যান?
চমনলাল বললেন, না, কখনও কোথাও একলা যান না। আমাকে না জানিয়েও কোথাও যাবেন না। সেইজন্যই তো ব্যাপারটা আরও রহস্যময় লাগছে।
আর-একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করল, এই বাড়ির এতখানি অংশ পুড়ে গেল, নিশ্চয়ই অনেকটা সময় লেগেছে। তার মধ্যে আগুন নেভানো গেল না? নিশ্চয়ই সে ব্যবস্থা ছিল।
চমনলাল বললেন, ব্যবস্থা তো সবই আছে। কিন্তু অত রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে উঠে ব্যাপারটা বুঝতেই খানিকটা সময় লাগে। তা ছাড়া, আমাদের শত্রুপক্ষ আগে অনেকখানি জায়গায় পেট্রল ছড়িয়ে দিয়েছিল। চারজন আর্মড গার্ড আছে, তারা কিছুই টের পায়নি। ঘুমোচ্ছিল বোধহয়। কেউ কেউ নাকি দুটো বোমার আওয়াজও শুনেছে।
এবার দু-তিনজন সাংবাদিক একসঙ্গে বলে উঠল, শত্রুপক্ষ? আপনি জানেন যে শত্রুপক্ষই আগুন লাগিয়েছে? শত্রুপক্ষ বলতে কারা, তাও আপনি জানেন?
চমনলাল বললেন, অবশ্যই জানি। দেখুন, আমি রেখে-ঢেকে কথা বলতে পারি না। আমাদের প্রধান শত্রুপক্ষ হচ্ছে হাইল্যান্ড ওভারসিজ কোম্পানি। ওদের মালিক জোসেফ এনক্রুমার সঙ্গে গত সপ্তাহেই আমার খুব ঝগড়া হয়েছিল। সে আমাকে শাসিয়ে ছিল যে, এ দেশ থেকে আমাদের ব্যাবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য করবে। সে-ই এ বাড়িতে আগুন লাগিয়েছে। আমি এর প্রতিশোধ নেবই। ওই জোসেফ এনক্রুমাকেই আমি এ দেশ ছাড়া করব।
কাকাবাবুর এসব শুনতে ভাল লাগছে না। তিনি অরুণকান্তির দিকে তাকিয়ে চোখের ইঙ্গিতে বললেন, চলো, এবার ফিরে যাই।
অরুণকান্তি বললেন, আর-একটু দাঁড়ান।
তিনি হাত তুলে চমনলালের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, দেওয়ানজি, আমি একটা কথা বলতে চাই। আমার সঙ্গে একজন এসেছেন, তিনি লোহিয়াজির বন্ধু ছিলেন।
চমনলাল শুকনোভাবে বললেন, হ্যাঁ, এখন অনেকেই দেখা করতে আসছে। কিন্তু আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।
অরুণকান্তি আবার বললেন, লোহিয়াজি ওঁকে নেমন্তন্ন করেছিলেন। ওঁর এই বাড়িতেই ওঠার কথা ছিল।
চমনলাল বললেন, বাড়ির অবস্থা তো দেখছেন। এখন তো আমি ওঁকে এখানে থাকার জায়গা দিতে পারব না।
অরুণকান্তি বললেন, না না, থাকার জায়গার সমস্যা নেই। উনি আমার কাছে থাকবেন। উনি ইন্ডিয়া থেকে এসেছেন। ওঁর নাম রাজা রায়চৌধুরী, খুব বিখ্যাত মানুষ। উনি অনেক বড় বড় কেসে অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন। উনি লোহিয়াজির সন্ধান পাওয়ার ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করতে পারেন।
চমনলাল একবার কাকাবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখে খানিকটা বিদ্রুপের সুরে বললেন, আমার তো কারও সাহায্যের দরকার নেই। ঠিক আছে, ধন্যবাদ। নমস্কার। আর কেউ কোনও প্রশ্ন করবেন?
কাকাবাবু এর মধ্যে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। অরুণকান্তি তাঁর কাছে এসে বললেন, লোকটা কীরকম অভদ্র দেখলেন? আমার কথা ভাল করে শুনলই না।
কাকাবাবু বেশ বিরক্ত হয়েছেন। গম্ভীরভাবে বললেন, তোমার ওরকমভাবে কথা বলা উচিত হয়নি। এর পর থেকে তুমি কোথাও আমার পরিচয় দিতে গিয়ে বিখ্যাত লোক, আমি হ্যানো করেছি, ত্যানো করেছি, এসব কিচ্ছু বলবে না। এখানে আমাকে কেউ চেনে না। আমি সেরকমভাবেই থাকতে চাই।