ধনী যুবা এক শ্মশান ঘাটে
একা বসি তার রজনী কাটে।
অদূরে অন্তিম শয়নোপরি
দিদিমা তাহার আছেন পড়ি,
সম্মুখে পূর্ণিমা গগনতলে
পিছনে শ্মশানে আগুন জ্বলে,
তাহারি মাঝারে নদীর তীরে
হরিনাম ধ্বনি উঠিছে ধীরে।
একাকী যুবক বসিয়া কুলে
সহসা কি ভাবি আপনা ভুলে।
প্রসন্ন আকাশ চাঁদিম রাতি
ধরিল অপূর্ব নতুন ভাতি,
তুচ্ছ বোধ হল ধন – বিভব
বিলাস বাসনা অসার সব,
অজানা কি যেন সহসা স্মরি
পলকে পরান উঠিল ভরি।
আর কি সে মন বিরাম মানে?
গভীর পিপাসা জাগিল প্রাণে।
কোথা শান্তি পাবে ব্যাকুল তৃষা
শুধায় সবারে না পায় দিশা।
-সহসা একদা তাহার ঘরে
ছিন্নপত্র এক উড়িয়া পড়ে ;
কি যেন বচন লিখিত তায়
অর্থ তার যুবা ভাবি না পায়।
বিদ্যাবাগীশের নিকটে তবে
যুবা সে বাণীর মরম লভে-
“যাহা কিছু এই জগততলে
অনিত্যের স্রোতে ভাসিয়া চলে
ব্রহ্মে আচ্ছাদিত জানিবে তায়-“
শুনিয়া যুবক প্রবোধ পায়।
শুনি মহাবাণী চমক লাগে,
আরো জানিব রে বাসনা জাগে
ব্রহ্মজ্ঞান লাভে পিপাসু মন
গভীর সাধনে হল মগন:
যত ডোবে আরো ডুবিতে চায়
ডুবি নব নব রতন পায়া।
হেনকালে হল অশনিপাত
যুবকের পিতা দ্বারকানাথ,
অতুল সম্পদ ধন বিভব
ঋণের পাথারে ডুবায়ে সব
কিছু না বুঝিতে জানিতে কেহ
অকালে সহসা ত্যজিল দেহ।
আত্মীয় -স্বজন কহিল সবে,
“যে উপায়ে হোক বাঁচিতে হবে-
কর অস্বীকার ঋণের দায়
নহিলে তোমার সকলি যায়।”
নাহি টলে তায় যুবার মন,
পিতৃঋণ শোধ করিল পণ,
হয়ে সর্বত্যাগী ফকির দীন
ছাড়ি দিল সব শোধিতে ঋণ।
উত্তমর্ণজনে অবাক মানি
কহে শ্রদ্ধাভারে অভয় বাণী,
“বিষয় বিভব থাকুক তব,
মোরা তাহা হতে কিছু না লব।
সাধুতা তোমার তুলনাহীন;
সাধ্যমত তুমি শোধিও ঋণ।”
বরষের পর বরষ যায়,
যুবক এখন প্রবীণ -প্রায়।
সংসারে বাসনা -বিগত মন,
ঋষি কল্পরুপ ধ্যানে মগ্ন,
ব্রহ্ম-ধ্যান -জ্ঞানে পুরিত প্রান ,
ব্রহ্মানন্দ রস করিছে পান;
বচনেতে যেন অমৃত ঝরে-
নমি নমি তাঁরে ভকতি ভরে।
ব্রাহ্মসমাজে আসন হতে
দীপ্ত অগ্নিয় বচন স্রোতে
ব্রহ্মজ্ঞান ধারা বহিয়া যায়,
কত শত লোকে শুনিতে ধায়।
“ব্রহ্মে কর প্রীতি নিয়ত সবে,
প্রিয়কার্য় তাঁর সাধহ ভবে।
হের তারে নিজ হৃদয় মাঝে,
সেথা ব্রজ্যেতি নিয়ত রাজে।
জ্ঞান সমুজ্জল বিমল প্রাণে ,
যে জানে তাহারে ধ্রুব সে জানে ।
জানিবার পথ নাহিক আর,
নহে শাসত্র বাণী প্রমান তাঁর ।
বহু তর্ক বহু বিচার বলে
বহু জপ তপ সাধন ফলে
বহু তত্ত্বকথা আলোড়ি চিতে
নাহি পায় সেই বচনাতীতে।”
ব্রহ্ম সমাজের অসাড় প্রাণে ,
মহর্ষির বানী চেতনা আনে।
দলে দলে লোক সেথায় ছোটে
ঊৎসাহের স্রোতে আসিয়া জোটে।
মত্ত অনুরাগে কেশব ধায়,
প্রতিভার জ্যোতি নয়নে ভায়;
আকুল আগ্রহে পরান খুলি
ঝাঁপ দিল স্রোতে আপনা ভুলি।
হেরি মহর্ষির পুলক বাড়ে
“ব্রহ্মনন্দ” নাম দিলেন তারে ।
লভি নব প্রানে সমাজ কায়
নব নব ভাবে বিকাশ পায় ;
ধর্ম গ্রন্থ নব,নব সাধন,
ব্রহ্ম উপাসনা বিধি নূতন
ধর্মপ্রান কত নারী ও নরে
তাহে নিমগন পুলক ভরে ।