Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

আদিম রিপু – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Banyopadhyay

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হইতে বাংলা দেশে‌, বিশেষত কলিকাতা শহরে‌, মানুষের জীবনের মূল্য খুবই কমিয়া গিয়াছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরে আমরা জীবনমৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করিয়া ফেলিয়ছিলাম। তারপর জিন্না সাহেবের সম্মুখ সমর যখন আরম্ভ হইল‌, তখন আমরা মৃত্যু দেবতাকে একেবারে ভালবাসিয়া ফেলিলাম। জাতি হিসাবে আমরা যে টিকিয়া আছি‌, সে কেবল মৃত্যুর সঙ্গে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর করিতে পারি বলিয়াই। বাঘ ও সাপের সঙ্গে আমরা আবহমানকাল বাস করিতেছি‌, আমাদের মারে কে?

সম্মুখ সমরের প্রথম অনলোদগার প্রশমিত হইয়াছে; কিন্তু তলে তলে অঙ্গার জ্বলিতেছে‌, এখানে ওখানে হঠাৎ দপ করিয়া জ্বলিয়া আবার ভম্মের অন্তরালে লুকাইতেছে। কলিকাতার সাধারণ জীবনযাত্রায় কিন্তু কোনও প্ৰভেদ দেখা যায় না। রাস্তায় ট্রাম-বাস তেমনি চলিতেছে‌, মানুষের কর্মতৎপরতার বিরাম নাই। দুই সম্প্রদায়ের সীমান্ত ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে হৈ হৈ দুমদাম শব্দ ওঠে‌, চকিতে দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়‌, রাস্তায় দুই চারিটা রক্তাক্ত মৃতদেহ পড়িয়া থাকে। সুরাবর্দি সাহেবের পুলিস আসিয়া হিন্দুদের শাসন করে‌, মৃতদেহের সংখ্যা দুই চারিটা বাড়িয়া যায়। কোথা হইতে মোটর ভ্যান আসিয়া মৃতদেহগুলিকে কুড়াইয়া লইয়া অন্তধান করে। তারপর আবার নগরীর জীবনযাত্রা পূর্ববৎ চলিতে থাকে।

ব্যোমকেশ ও আমি কলিকাতাতেই ছিলাম। আমাদের হ্যারিসন রোডের বাসাটা যদিও ঠিক সমর সীমানার উপর পড়ে না‌, তবু যথাসাধ্য সাবধানে ছিলাম। ভাগ্যক্রমে কয়েক মাস আগে ব্যোমকেশের শ্যালক সুকুমার খোকাকে ও সত্যবতীকে লইয়া পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়াছিল‌, তাই সম্মুখ সমর যখন আরম্ভ হইল তখন ব্যোমকেশ তার করিয়া তাহাদের কলিকাতায় ফিরিতে বারণ করিয়া দিল। তদবধি তাহারা পাটনায় আছে। ইতিমধ্যে সত্যবতীর প্রবল পত্রাঘাতে আমরা বার দুই পাটনা ঘুরিয়া আসিয়াছি; কারণ আমরা যে বাঁচিয়া আছি‌, তাহা মাঝে মাঝে স্বচক্ষে না দেখিয়া সত্যবতী বিশ্বাস করিতে চাহে নাই।

যাহোক‌, খোকা ও সত্যবতী নিরাপদে আছে‌, ইহাতেই আমরা অনেকটা নিশ্চিন্তু ছিলাম। রাষ্ট্রবিপ্লবের সময় নিজের প্রাণ রক্ষার চেয়ে প্রিয়জনের নিরাপত্তাই অধিক বাঞ্ছনীয় হইয়া ওঠে।

যেদিনের ঘটনা লইয়া এই কাহিনীর সূত্রপাত সেদিনটা ছিল দুৰ্গাপূজা এবং কালীপূজার মাঝামাঝি একটা দিন। দুৰ্গাপূজা অন্যান্য বারের মত যথারীতি ধুমধামের সহিত সম্পন্ন হইয়াছে এবং কালীপূজাও যথাবিধি সম্পন্ন হইবে সন্দেহ নাই। আমরা দু’জনে সকালবেলা খবরের কাগজ লইয়া বসিয়াছিলাম‌, এমন সময় বাঁটুল সদর আসিল। তাহাকে সেলামী দিলাম। বাঁটুল এই এলাকার গুণ্ডার সদর; বেঁটে নিটোল চেহারা‌, তৈলাক্ত ললাটে সিঁদুরের ফোঁটা। সম্মুখ সমর আরম্ভ হইবার পর হইতে বাঁটুলের প্রতাপ বাড়িয়াছে‌, পাড়ার সজ্জনদের গুণ্ডার হাত হইতে রক্ষা করিবার ওজুহাতে সে সকলের নিকট সেলামী আদায় করে। সেলামী না দিলে হয়তো কোনদিন বাঁটুলের হাতেই প্ৰাণটা যাইবে এই ভয়ে সকলেই সেলামী দিত।

সেলামীর জুলুম সত্ত্বেও ব্যোমকেশের সহিত বাঁটুলের বিশেষ সম্ভাব জগিয়েছিল। আদায়তসিল উপলক্ষে বাঁটুল আসিয়া উপস্থিত হইলে ব্যোমকেশ তাহাকে চা সিগারেট দিত‌, তাহার সহিত গল্প জমাইত; শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষের কূটনীতি সম্বন্ধে অনেক খবর পাওয়া যাইত। বাঁটুল এই ফাঁকে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসঙ্গ তুলিত। যুদ্ধের পর মার্কিন সৈনিকেরা অনেক আগ্নেয়াস্ত্ৰ জলের দরে বিক্রি করিয়া চলিয়া গিয়াছিল‌, বাঁটুল সেই অস্ত্ৰ কিছু সংগ্ৰহ করিয়া রাখিয়াছিল‌, এখন সে তাহা আমাদের বিক্রি করিবার চেষ্টা করিত। বলিত‌, ‘একটা রাইফেল কিনে ঘরে রাখুন কতা। আমরা তো আর সব সময় সব দিকে নজর রাখতে পারি না। ডামাডোলের সময় হাতে হাতিয়ার থাকা ভাল।’

আমি বলিতাম‌, না‌, বাঁটুল‌, রাইফেল দরকার নেই। অত বড় জিনিস লুকিয়ে রাখা যাবে না‌, কোন দিন পুলিস খবর পাবে আর হাতে দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে যাবে। তার চেয়ে একটা পিস্তল কি রিভলবার যদি যোগাড় করতে পার–’

বাঁটুল বলিত‌, ‘পিস্তল যোগাড় করাই শক্ত বাবু। আচ্ছা‌, চেষ্টা করে দেখব—’

বাঁটুল মাসে একবার আসিত।

সেদিন যথারীতি সেলামী লইয়া বাঁটুল আমাদের অভয় প্রদানপূর্বক প্রস্থান করিলে আমরা কিছুক্ষণ ত্ৰিয়মাণাভাবে সাময়িক পরিস্থিতির পযালোচনা করিলাম। এভাবে আর কতদিন চলিবে? মাথার উপর খাঁড়া ঝুলাইয়া কতকাল বসিয়া থাকা যায়? স্বাধীনতা হয়তো আসিতেছে‌, কিন্তু তাহা ভোগ করিবার জন্য বাঁচিয়া থাকিব কি? সম্মুখ সমরে যদি বা প্ৰাণ বাঁচে্‌্‌, কাঁকর ও তেঁতুল বিচির গুড়া খাইয়া কত দিন বাঁচিব? ব্যোমকেশের হাতে কাজকর্ম কোনও কালেই বেশি থাকে না‌, এখন একেবারে বন্ধ হইয়াছে। যেখানে প্ৰকাশ্য হত্যার পাইকারি কারবার চলিতেছে‌, সেখানে ব্যোমকেশের রহস্যভেদী বুদ্ধি কাহার কাজে লাগিবে?

আমি বলিলাম‌, ‘ভারতীরে ছেড়ে ধর এইবিলা লক্ষ্মীর উপাসনা।’

‘অর্থাৎ?’

‘অর্থাৎ রাত দুপুরে ছোরা বগলে নিয়ে বেরোও‌, যদি দু’চারটে কালাবাজারের মক্কেলকে সাবাড়। করতে পোর‌, তাহলে আর ভাবতে হবে না। যে সময়-কাল পড়েছে‌, বাঁটুল সদোরই আমাদের আদর্শ হওয়া উচিত।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘কথাটা মন্দ বলোনি‌, যুগধর্মই ধর্ম। কিন্তু কি জানো‌, ও জিনিসটা রক্তে থাকা চাই। খুনই বল আর কালাবাজারই বল‌, পূর্বপুরুষদের রক্তের জোর না থাকলে হয় না। আমার বাবা ছিলেন স্কুল মাস্টার‌, স্কুলে অঙ্ক শেখাতেন আর বাড়িতে সাংখ্য পড়তেন। মা ছিলেন। বৈষ্ণব বংশের মেয়ে‌, নন্দগোপাল নিয়েই থাকতেন। সুতরাং ওসব আমার কম নয়।’

ব্যোমকেশের বাল্য ইতিহাস আমার জানা ছিল। তাহার যখন সতেরো বছর বয়স। তখন তাহার পিতার যক্ষ্মা হয়‌, মাতাও সেই রোগে মারা যান। আত্মীয়স্বজন কেহ উঁকি মারেন নাই। তারপর ব্যোমকেশ জলপানির জোরে বিশ্ববিদ্যা সমুদ্র পার হইয়াছে, নিজের চেষ্টায় নূতন জীবন-পথ গড়িয়া তুলিয়াছে। আত্মীয়স্বজন এখনও হয়তো আছেন‌, কিন্তু ব্যোমকেশ তাঁহাদের খোঁজ রাখে না।

কিছুক্ষণ বিমনাভাবে কাটিয়া গেল। আজ সত্যবতীর একখানা চিঠি আসিতে পারে‌, মনে মনে তাহারই প্ৰতীক্ষা করিতেছি।

খট্‌ খট্‌ খট্‌ খট্‌ কড়া নড়িয়া উঠিল। আমি উঠিয়া গিয়া দ্বার খুলিলাম।

ডাকপিওন নয়। তৎপরিবর্তে যিনি দ্বারের বাইরে দাঁড়াইয়া আছেন‌, বেশবাস দেখিয়া তাঁহাকে স্ত্রীলোকই বলিতে হয়। কিন্তু সে কী স্ত্রীলোক! পাঁচ হাত লম্বা‌, তদনুপাতে চওড়া‌, শালপ্ৰাংশু আকৃতি; পালিশ করা আবলুশ কাঠের মত গায়ের রঙ; ঘটোধ্নী‌, নিবিড়নিতম্বিনী‌, স্পষ্ট একজোড়া গোঁফ আছে; বয়স পঞ্চাশের ওপারে। তিনি আমার দিকে চাহিয়া হাস্য করিলেন; মনে হইল। হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলিয়া গেল।

তিনি রামায়ণ মহাভারত হইতে বিনিৰ্গতা কোনও অতি-মানবী। কিনা ভাবিতেছি। হারমোনিয়াম হইতে খাদের গভীর আওয়াজ বাহির হইল‌, ‘আপনি কি ব্যোমকেশবাবু?’

আমি অতি দ্রুত মাথা নাড়িয়া অস্বীকার করিলাম। ব্যোমকেশের সহিত মহিলাটির কি প্রয়োজন জানি না‌, কিন্তু আমি যে ব্যোমকেশ নই তাহা অকপটে ব্যক্ত করাই সমীচীন। ব্যোমকেশ ঘরের ভিতর হইতে মহিলাটিকে দেখিতে পায় নাই, আমার অবস্থা দেখিয়া উঠিয়া আসিল। সেও অভ্যাগতকে দেখিয়া ক্ষণেকের জন্য থতমত খাইয়া গেল‌, তারপর সৎসাহস দেখাইয়া বলিল‌, ‘আমি ব্যোমকেশ।’

মহিলাটি আবার হারমোনিয়ামের ঢাকনা খুলিলেন‌, বলিলেন‌, নমস্কার। আমার নাম মিস। ননীবালা রায়। আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার আছে।’

‘আসুন।’

খট্‌ খট্‌ জুতার শব্দ করিয়া মিসা ননীবালা রায় ঘরে প্রবেশ করিলেন; ব্যোমকেশ তাঁহাকে চেয়ারে বসাইল। আমি ভাবিতে লাগিলাম‌, এরূপ আকৃতি লইয়া ইনি কখনই ঘরের ঘরণী হইতে পারেন না‌, স্বামীপুত্র ঘরকন্না গৃহস্থলী ইহার জন্য নয়। বিশেষ নামের অগ্ৰে ‘মিস’ খেতাবটি দাম্পত্য সৌভাগ্যের বিপরীত সাক্ষ্য দিতেছে। তবে ইনি কি? জেনানা ফাটকের জমাদারণী? উৰ্হ্‌্‌, অতটা নয়। শিক্ষয়িত্রী? বোধ হয় না। লেডি ডাক্তার? হইতেও পারে—

পরক্ষণেই ননীবালা নিজের পরিচয় দিলেন। দেখিলাম বেশি ভুল করি নাই। তিনি বলিলেন‌, ‘আমি পাটনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ধাত্রী ছিলাম‌, এখন রিটায়ার করে কলকাতায় আছি। একজনের কাছে আপনার নাম শুনলাম‌, ঠিকানাও পেলাম। তাই এসেছি।’

ব্যোমকেশ গম্ভীরমুখে বলিল‌, ‘কি দরকার বলুন।’

মিস ননীবালার চেহারা যেরূপ জবরদস্ত, আচার আচরণ কিন্তু সেরূপ নয়। তাঁহার হাতে একটা কালো রঙের হ্যান্ডব্যাগ ছিল‌, তিনি সেটা খুলিবার উপক্ৰম করিয়া বলিলেন‌, ‘আমি গরীব মানুষ‌, ব্যোমকেশবাবু। টাকাকড়ি বেশি আপনাকে দিতে পারব না—’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘টাকাকড়ির কথা পরে হবে। কি দরকার আগে বলুন।’

ননীবালা ব্যাগ বন্ধ করিলেন‌, তারপর সহসা কম্পিত স্বরে বলিয়া উঠিলেন‌, ‘আমার ছেলের বড় বিপদ‌, তাকে আপনি রক্ষে করুন‌, ব্যোমকেশবাবু–।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ তাঁহার পানে চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আপনার—ছেলে!’

ননীবালা একটু অপ্ৰস্তুত হইলেন‌, বলিলেন‌, ‘আমার ছেলে-মানে-আমি মানুষ করেছি। অনাদিবাবু তাকে পুষ্যিপুকুর নিয়েছেন—‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বড় পাঁচালো ব্যাপার দেখছি। আপনি গোড়া থেকে সব কথা বলুন।’ ননীবালা তখন নিজের কাহিনী বলিতে আরম্ভ করিলেন। তাঁহার গল্প বলার শৈলী ভাল নয়‌, কখনও দশ বছর পিছইয়া কখনও বিশ বছর আগাইয়া বহু অবান্তর প্রসঙ্গের অবতারণা করিয়া যাহা বলিলেন‌, তাহার জট ছাড়াইলে এইরূপ দাঁড়ায়–

বাইশ তেইশ বছর আগে মিসা ননীবালা রায় পাটনা হাসপাতালের ধাত্রী ছিলেন। একদিন একটি যুবতী হাসপাতালে ভর্তি হইল; অবস্থা খুবই খারাপ‌, ধুরিসির সহিত নানা উপর্সা‌, তার উপর পূর্ণগভর্ণ। যে পুরুষটি তাহাকে আনিয়াছিল‌, সে ভর্তি করিয়া দিয়াই অদৃশ্য হইল।

যুবতী হিন্দু নয়‌, বোধ হয় আদিম জাতীয় দেশী খ্ৰীষ্টান। দুই দিন পরে সে একটি পুত্র প্রসব করিয়া মারা গেল। পুরুষটা সেই যে উধাও হইয়াছিল‌, আর ফিরিয়া আসিল না।

এইরূপ অবস্থায় শিশুর লালন-পালনের ব্যবস্থা রাজ সরকার করেন। কিন্তু এক্ষেত্রে ননীবালা শিশুটির ভার লাইলেন। ননীবালা অবিবাহিতা‌, সন্তানাদি নাই‌, শিশুটি বড় হইয়া তাঁহার পুত্রের স্থান অধিকার করিবে এই আশায় তিনি শিশুকে পুত্ৰবৎ পালন করিতে লাগিলেন। শিশুর নাম হইল প্ৰভাত রায়।

প্রভাতের বয়স তখন তিন-চার, তখন ননীবালা হঠাৎ একটি ইন্সিওর চিঠি পাইলেন। চিঠির সঙ্গে দুই শত টাকার নোট। চিঠিতে লেখা আছে, আমি জানিতে পারিয়াছি আমার ছেলে তোমার কাছে আছে। তাহাকে পালন করিও। উপস্থিত কিছু টাকা পাঠাইলাম, সুবিধা হইলে আরও পাঠাইব।–চিঠিতে নাম দস্তখত নাই।

তারপর প্রভাতের বাপের আর কোনও সংবাদ পাওয়া যায় নাই। লোকটা সম্ভবত মরিয়া গিয়াছিল। ননীবালা বিশেষ দুঃখিত হইলেন না। বাপ কোনও দিন আসিয়া ছেলেকে লইয়া যাইবে এ আশঙ্কা তাঁহার ছিল। তিনি নিশ্চিন্ত হইলেন।

প্রভাত বড় হইয়া উঠিতে লাগিল। ননীবালা নিজের ডিউটি লইয়া থাকেন, ছেলের দেখাশুনা ভাল করিতে পারেন না ; প্রভাত পাড়ার হিন্দুস্থানী ছেলেদের সঙ্গে রাস্তায় খেলা করিয়া বেড়ায়। তাহার লেখাপড়া হইল না।

পাড়ায় এক মুসলমান দপ্তরীর দোকান ছিল। প্ৰভাতের যখন ষোল-সতেরা বছর বয়স, তখন সে দপ্তরীর দোকানে কাজ করিতে আরম্ভ করিল। প্রভাত লেখাপড়া শেখে নাই বটে, কিন্তু বয়াটে উচ্ছঙ্খল হইয়া গেল না। মন দিয়া নিজের কাজ করিত, ধাত্রীমাতাকে গভীর ভক্তিশ্রদ্ধা করিত।

এইভাবে তিন চার বছর কাটিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষের দিকে অনাদি হালদার নামে এক ভদ্রলোক পাটনায় আসিলেন। অনাদিবাবু ধনী ব্যবসাদার। তাঁহার ব্যবসায়ের বহু খাতা বহি বাঁধাইবার প্রয়োজন হইয়াছিল, তিনি দপ্তরীকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। দপ্তৱী প্ৰভাতকে তাঁহার বাসায় পাঠাইয়া দিল। অনেক খাতা পত্র, দপ্তরীর দোকানে সব বহন করিয়া লইয়া যাওয়া সুবিধাজনক নয়। প্রভাত নিজের যন্ত্রপাতি লইয়া অনাদিবাবুর বাসায় আসিল এবং কয়েক দিন ধরিয়া তাঁহার খাতা বহির মলাট বাঁধিয়া দিল।

অনাদিবাবু অকৃতদার ছিলেন। প্রভাতকে দেখিয়া বোধ হয় তাঁহার ভাল লাগিয়া গিয়াছিল, তিনি একদিন ননীবালার বাসায় আসিয়া প্রস্তাব করিলেন তিনি প্রভাতকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করিতে চান।

এতবড় ধনী ব্যক্তির পোষ্যপুত্র হওয়া ভাগ্যের কথা ; কিন্তু ননীবালা এক কথায় প্রভাতকে ছাড়িয়া দিতে রাজী হইলেন না। প্ৰভাতও মাকে ছাড়িতে চাহিল না। তখন রফা হইল, প্ৰভাতের সঙ্গে ননীবালাও অনাদিবাবুর সংসারে থাকিবেন, নারীবর্জিত সংসারে ননীবালাই সংসার পরিচালনা করিবেন।

ননীবালা হাসপাতালের চাকরি হইতে অবসর লাইলেন। অনাদি হালদারও কর্মজীবন হইতে প্রায় অবসর লইয়াছিলেন, তিনজনে কলিকাতায় আসিলেন। সে আজ প্রায় দেড় বছর আগেকার কথা। সেই অবধি তাঁহারা বহুবাজারের একটি ভাড়াটে বাড়ির দ্বিতলে বাস করিতেছেন। যুদ্ধের বাজারে ভাল বাসা পাওয়া যায় না। কিন্তু অনাদিবাবু তাঁহার বাসার পাশেই একটি পুরাতন বাড়ি কিনিয়াছেন এবং তাহা ভাঙ্গিয়া নূতন বাড়ি তৈরি করাইতেছেন। বাড়ি তৈরি হইলেই তাঁহার নূতন বাড়িতে উঠিয়া যাইবেন।

অনাদিবাবুর এক বড় ভাই ছিলেন, তিনি কলিকাতায় সাবেক বাড়িতে বাস করিতেন। ভায়ের সহিত অনাদিবাবুর সদ্ভাব ছিল না, কোনও সম্পর্কই ছিল না। ভাই প্রায় দশ বছর পূর্বে মারা গিয়াছেন, কিন্তু তাঁহার দুই পুত্ৰ আছে—নিমাই ও নিতাই। অনাদিবাবু কলিকাতায় আসিয়া বাসা লাইলে তাহারা কোথা হইতে সন্ধান পাইল এবং তাঁহার কাছে যাতায়াত শুরু করিল।

ননীবালার মতে নিমাই ও নিতাই পাকা শয়তান, মিটমিটে ডান, ছেলে খাওয়ার রাক্ষস। কাকা পোষ্যপুত্ৰ লইলে কাকার অতুল সম্পত্তি বেহাত হইয়া যাইবে, তাই তাহারা কাকাকে বশ করিয়া দত্তক গ্ৰহণ নাকচ করাইতে চায়। অনাদিবাবু ভ্রাতুষ্পপুত্রদের মতলব বুঝিয়া কিছুদিন আমোদ অনুভব করিয়াছিলেন, কিন্তু ক্ৰমে তিনি উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিলেন। মাস কয়েক আগে তিনি ভাইপোদের বলিয়া দিলেন তাহারা যেন তাঁহার গৃহে পদার্পণ না করে।

নিমাই ও নিতাই কাকার বাসায় আসা বন্ধ করিল বটে‌, কিন্তু আশা ছাড়িল না। অনাদিবাবু প্ৰভাতকে একটি বইয়ের দোকান করিয়া দিয়াছিলেন; কলেজ স্ট্রীটের এক কোণে ছোট্ট একটি দোকান। প্ৰভাত লেখাপড়া শেখে নাই বটে‌, কিন্তু সে বই ভালবাসে; এই দোকানটি তাহার প্ৰাণ। সে প্রত্যহ দোকানো যায়‌, নিজের হাতে বই বিক্রি করে। নিতাই ও নিমাই তাহার দোকানে যাতায়াত আরম্ভ করিল। বই কিনিত না‌, কেবল চক্ষু মেলিয়া প্ৰভাতের পানে চাহিয়া থাকিত; তারপর নীরবে দোকান হইতে বাহির হইয়া যাইত।

তাহাদের চোখের দৃষ্টি বাঘের দৃষ্টির মত ভয়ানক। তাহারা মুখে কিছু বলিত না‌, কিন্তু তাহাদের মনের অভিপ্রায় প্ৰভাতের জানিতে বাকী থাকিত না। প্ৰভাত ভােলমানুষ ছেলে‌, সে ভয় পাইয়া ননীবালাকে আসিয়া বলিল; ননীবালা অনাদিবাবুকে বলিলেন। অনাদিবাবু এক গুখা নিয়োগ করিলেন‌, যতক্ষণ দোকান খোলা থাকিবে ততক্ষণ গুখাঁ কুকীরি লইয়া দোকান পাহারা দিবে।

ভ্রাতুষ্পপুত্র যুগলের দোকানে আসা বন্ধ হইল। কিন্তু তবু প্ৰভাত ও ননীবালার ভয় দূর হইল। না। সর্বদাই যেন দু’জোড়া অদৃশ্য চক্ষু তাঁহাদের উপর লক্ষ্য রাখিয়ছে‌, তাঁহাদের গতিবিধি অনুসরণ করিতেছে।

তা ছাড়া আর একটা ব্যাপার লইয়া বাড়িতে অশান্তি দেখা দিয়াছে। একটি মেয়েকে দেখিয়া প্ৰভাতের ভাল লাগিয়াছিল; মেয়েটি পূর্ববঙ্গ হইতে উদ্বাস্তু একটি পরিবারের মেয়ে‌, খুব ভাল গান বাজনা জানে‌, দেখিতে সুন্দরী। কোন এক সভায় প্রভাত মেয়েটিকে গান গাহিতে শুনিয়াছিল এবং তাহার কথা ননীবালাকে বলিয়াছিল। অনাদিবাবু প্ৰভাতের জন্য পাত্রী খুঁজিতেছিলেন‌, ননীবালার মুখে এই মেয়েটির কথা শুনিয়া বলিলেন‌, তিনি নিজে মেয়ে দেখিয়া আসিবেন এবং পছন্দ হইলে বিবাহ দিবেন।

অনাদিবাবু মেয়ে দেখিয়া আসিলেন এবং বলিলেন‌, এ মেয়ের সঙ্গে প্ৰভাতের বিবাহ হইতে পারে না। তিনি কোনও কারণ প্ৰদৰ্শন করিলেন না‌, কিন্তু ননীবালার বিশ্বাস এ ব্যাপারে নিমাই ও নিতাইয়ের হাত আছে। সে যাই হোক‌, ইহার পর হইতে ভিতরে ভিতরে যেন একটা নূতন গণ্ডগোল শুরু হইয়াছে। ননীবালা ভীত হইয়া উঠিয়াছেন। বর্তমান ডামাডোলের সময় প্রভাতের যদি কোনও দুর্ঘটনা হয়? যদি গুণ্ডা ছুরি মারে? নিমাই ও নিতাইয়ের অসাধ্য কাজ নাই। এখন ব্যোমকেশবাবু কোনও প্রকারে প্রভাতের জীবনরক্ষা করুন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19
Pages ( 1 of 19 ): 1 23 ... 19পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *