ঠিকানা
চৌদ্দ বছর বয়সেই আমি বুঝে ফেলেছিলাম, ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ভগবানের সৃষ্ট সামান্য পার্থক্যের চেয়ে, মানুষের তৈরি প্রভেদ অনেক বেশি। ছেলেদের থেকে মেয়েদের দূরে দূরে থাকতে হয়। না হলেই বিপদের সম্ভাবনা খুব। ছেলেদের থেকে দূরে দূরে থাকতে হবে। অথচ তাদের কারও না কারাও কাছে নিজেদের সঁপে দিত হবে শেষ পর্যন্ত, আশ্চর্য। মেয়েদের জীবনের যেন একটিই উদ্দেশ্য। তা হল বিয়ে। তাতেই স্বস্থি, তাতেই শান্তি। মেয়ে হয়ে জন্মানোই যেন বিয়ের জন্য, আর ঘরের কাজ কর্ম গুছিয়ে রেখে, সস্তান প্রসবের জন্য।আর তাদের কোলে পিঠে করে মানুষ করে অবার তাদের বিয়ে দেওয়ার জন্য। মেয়েদের জন্মের আর অন্য কোন মানে নেই। থাকতে পারে না। এ রকম একটা ধারনা নিয়ে বড় হয়েছিল আমি। আর ছেলেদের জন্মানো যেন, কাজকর্ম করে রােজগার করবে, বিয়ে করবে। বিয়ের অর্থ একজন পুরুষের একজন নারীর ওপর সব রকম অত্যাচার করার অধিকার লাভ করতে আইনতঃ অঙ্গীকারে। পুরুষ নারীর অত্যাচার করবে সারা জীবন। কোন রেহাই নেই। প্রতিবাদ করেও কোন লাভ নেই। পুরুষ শাসিত সমাজে, প্রতিবাদ করলেই আইন, সমাজ সবই একসঙ্গে তােমার ঘাড়ে হুমড়ি খয়ে পড়বে। স্বামীকে ভালাে না লাগলেও মুখ ফুটে কিছু বলার উপায় নেই। বললে বাড়তি অত্যাচার জুটবে নানাভাবে। তাই অভিনয় করে, যেতে হবে, স্বামী আমার মনের মতো। এ যেন দোকানের কেনা ইডলির মতাে। দোকানদারের কথায় বিশ্বাস করে কিনতে হবে। কিনেছাে যখন, ভাল না লাগলেও খেতে হবে। ফেলে দেওয়া চলবে না, তাে এই হলাে আমাদের পবিত্র বিয়ের মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান।
সেবার বড়দিনে, পাড়ার ক্লাবের ছেলে মেয়েদের সঙ্গে পিকনিক করতে বারুইপুরের একটা বাগান বাড়িতে যাই। বেশ হে-হুল্লা করে আর মজা করে সারাটা দিন কেটে গেল। ফেরার পথে অয়নদা, পড়াশােনায় বেশ ভাল। পাড়ার সকলে তাকে ভাল ছেলে বলে জানে। অয়নদা আমাকে বললাে, চল আমরা সবার আগে গিয়ে ভাল সিটটা দখল করে বসি। প্রস্তাবটা মন্দ লাগলাে না আমার। আসার সময় লোক বেশি হওয়ার জন্য ভাল করে বসে আসা হয়নি। পিছনের সিটে বেশ ঝাকুনি লাগছিল। অয়নদারনকথায় তাই রাজি হয়ে গেলাম। আমি তার সঙ্গে এসে বাসের একটি ভাল সিট দখল করে জানলার ধারে বসলাম। অয়নদা আমার পাশেনবসলাে। আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মােহিত হয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম। আকাশ চুইয়ে কেমন নীরবে অন্ধকার নামছে। পাখিরা আকাশের বুক রেখা টেনে নীড়ে ফিরছে। এই সব দেখতে দেখতে যখন আমি বিভোর হয়ে ছিলাম,তখন হঠাৎ অয়নদা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে এনে, বাস থেকে নেমে ছুটে পালিয়ে এলাম। মনে মনে রাগ হলো খুব। কিস্তু ভয়ে কাউকে কিছু বলতে পারলাম না। এই ঘটনার পর থেকে ছেলেদের সম্পর্কে আমার ভয় আরাও বেড়ে গেল। সব সময় ছেলেদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতাম। ধারে কাছে কাউকে ঘেঁসতে দিতাম না ওদের। কেউ কোন রকম ইশারা ইঙ্গিত করলে, না বোঝার ভান করে এড়িয়ে যেতাম। ছেলেরা যা খুশি করতে পারে, তাতে কোন দোষ হয় না।আর মেয়েরা একটু হাসলে, কিংবা কারও দিকে মুখ তুলে তাকালে বা এক দৃষ্টিতে কিছু দেখলে, আর উপায় নেই। অপরাধ হয়ে যায়। এসব কথা আমি বুঝতে পারি পনেরো বছর বয়সেই। অভিভাবকেরা বলেন, ছেলেরা ওসব একটু আধটু করতেই পারে অল্প বয়সে, ওসব তেমন কিছু দোষের হয় না। আর মেয়েদের নামে মিথ্যে কিছু রটলেও, আর রক্ষে নেই। লোকের মুখে মুখে রটে যাবে মুখরোেচক আচারের মতাে রসালো হয়ে ওঠে। ফুলে ফেঁপে তিল থেকে তাল হয়ে যায়। নীরব সত্যের চেয়ে সরব মিথ্যে অনেক বেশি লোকে বিশ্বাস করে থাকে।
আমার বয়স তখন যোল। তখন অনেক কিছুই বুঝতে শিখে গেছি আমি।
আমাদের পাশের ঘরের পুরনোে ভাড়াটে চলে যাওয়ার পর দু-তিন মাসের মধ্যেই সেখানে ভাড়াটে এলো নতুন। এক বৃদ্ধা। ও তার নাতি। নাতির বয়স কুড়ি-বাইশ হবে। যণ্ডা মার্কা চেহারা। পড়াশোেনা করে না। মাস্তানি করে বেড়ায়। পাড়ার মাস্তানদের সঙ্গে অল্পদিনের মধ্যেই তার বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তার ডাক নাম মুন্না। আমাকে দেখার পর থেকেই আমার ওপরে তার নজর পড়লোে। সতর্ক নজরে রাখতাে কখন আমি ঘর ছেড়ে বাইরে বের হই। একদিন সকালবেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতে আমাকে চোখের ইশারায় কাছে ডাকলাে। আমি না বোঝার ভান করে ঘরে চলে এলাম। মা বাবাকে বলতে সাহস হলো না। তাহলে হয়তো আমার ঘরের বাইরে বেরনাে বন্ধ হয়ে যাবে। তাই কাউকে কিছু জানালাম না। তবে মুন্নার দৃষ্টি এড়িয়ে চনলতাম। ও বাড়িতে আছে বুঝতে মােটেও ঘর ছেড়ে বাইরে বেরতাম না।
সেদিন ছিল শিবরাত্রি। বাবা অফিস থেকে রাত করে বাড়ি ফিরবে বলেই গেছিলো।
মা, কাছেই একটি শিব মন্দিরে জল ঢালতে গেছে। আমার মাথা ধরেছে বলে আমি যাইনি। ঘরে শুয়ে আছি। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আলস্যে আর উঠে আলো জ্বালিনি। ভাবছি, মা কখন ফিরবে।
হঠাৎ দেখলাম, দরজায় কার ছায়া পড়েছে। ভাবলাম, মা বােধহয় ফিরলাে। আমি বিছানায় উঠে বসলাম। দেখলাম, মুন্না এসে ঘরে ঢুকলাে।
রুক্ষ স্বরে বললাম, কি চাই ?
– তোমাকে
– মানে?
তার কোন উত্তর না দিয়ে, সে আমাকে জড়িয়ে ধরে, জোর করে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঘটনার আকম্মিকতায় আমি বিমূঢ় হয়ে পড়লাম। তবু আমি বললাম, আমি কিন্তু চিৎকার করবো। চেচিয়ে লোক ডাকবো।
– ডাকো, আমি বলবা, তুমি আমাকে ঘরে ডেকেছো।
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না। প্রতিরোধ করেও কোন লাভ হবে না বুঝলাম। তবু আমি চিৎকার করতে যেতেই সে জোর করে আমার মুখ চেপে ধরলো। ফল হল না কোনও । সে তার যৌন ইচ্ছা পূরণ করে একটু পরেই চলে গেল। আমি পড়ে রইলাম বিছানায় অসহায়ের মতো একা। মা বাবা ফিরে এলেও তাদের কারো কাছে কিছু খুলে বলতে পারলাম না ভয়ে। আরও মাথা ধরার ভান করে পড়ে রইলাম বিছানায়। নিজেকে অসহায় লাগছিল খুব। খুব ভয় হয়েছিল হয়তা মা আমার মুখ দেখে সব বুঝে ফেলবে। মা অনেক সাধাসাধি করলেও সে রাত্রে আর কিছু খেতে উঠিনি। খুব মাথা ধরার বাহানায় সেদিন নিজেকে আড়াল করেছিলাম। অনেক রাত পর্যস্ত বিছানায় ছট্ফট করছিলাম। কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ছিলাম। ঘুমতে পারিনি । ভাবছিলাম কাল মুখ দেখাবে কেমন করে ? এসব ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি একসময়। টেরও পাইনি। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে, প্রথমেই আয়নায় মুখ দেখে নিলাম নিজের। মুখে কোন অপরাধের ছাপ আছে কি না। কিছু বুঝাতে পারবে কি না কেউ। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম নিজের চোখের দৃষ্টি। কয়েকদিন ভয়ে ভয়ে কাটলো খুব। মুন্নাকে দেখলেই বুকটা কেঁপে উঠতো শঙ্কায়, ঘৃণায়। তারপর থেকে আমি যেন ওর কেনা বাদী হয়ে গেলাম। মুন্না যা বলতাে তাই করতে হতো আমাকে। না হলে সবাইকে সব জানিয়ে দেবে বলে ভয় দেখাতো। আকারে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিতো কবে, কখন, কোথায় দেখা করতে হবে। যাব না ভাবততাম। দুর্নাম রটার ভয়ে আমাকে যেতেই হতো। তাকে দেখে দরজায় খিল এঁটে দিতাম। তার ইশারায় শেষ পর্যন্ত আমাকে সেটা খুলে দিতে হতাে, এরপর থেকে ওর নেশার সামগ্রীর জন্য টাকা যােগান দিতে হতো আমাকে।না করে আমার আর কোন উপায় ছিল না। বাগে পেয়েছে একবার যখন। রাজী না হলেই হাটে হাঁড়ি ভাঙবে বলে, আমাকে ভয় দেখাতো। তার চাল-চলন, হাব-ভাব ব্যবহার, তার হাসি, তার চাউনি সব কিছুই খুব খারাপ লাগতাে আমার। তবু আমি নিরুপায়, দিশেহারা। কাকে বলবাে এসব কথা। তাই সব সহ্য করতে হতো মুখ বুজে। মনে মনে ভবেছি অনেকবার, ফুঁসে উঠবাে। কিস্ত ফুঁসে উঠতে পারিনি কখনােই। ভেবেছিলাম গলায় দড়ির ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়বা। না হলে রেল লাইনে মাথা দিয়ে এ কলুষিত জীবন শেষ করে দেবো। কিত্তু শেষ পর্যন্ত মরতেও সাহসে কুলায় নি। ইচ্ছে হয়েছিল, মা বাবাকে সব খুলে বলে দিই। পরক্ষণেই ভয় হয়েছিল। যদি মারধোর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয়, বাবা যা রাগী মানুষ। তারচেয়ে কোন কিছু না বলাই ভাল। পঙ্কিল হয়ে উঠলো আমার জীবন। চোখের চাউনি, কাজকর্ম সব কিছুর মধ্যেই যেন চোর চোর ভাবটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত একদিন সব কিছু জানাজানি হয়ে গেল। আমাদের ঘরে ঢুকে মুন্না সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে … মা কি কাজে পাশের বাড়ি গেছিল। ঠিক সেই সময় ঘরে এসে ঢুকলো। সে, তখন আমাকে ছেড়ে দিয়ে, মায়ের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আমি বিমূঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা সেই মুহুর্তে আমার ওপর তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়লো। মা আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করলো না। মুখেও বললো না কিছু। আমার চুলের মুঠি ধরে টেনে হিচড়ে মাটিতে ফেলে দিলেন। সমানে লাথি ঘুঁষি মারতে লাগলেন। তারপর সেই অবস্থায় ফেলে রেখে, কি সব বিড় বিড় করতে লাগলেন মনে মনে। বাবা ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে মা ফিসফিস্ করে তাকে কি সব বললেন। শুনে বাবা দরজা বন্ধ করে দিয়ে একটা শক্ত লাঠি দিয়ে আমাকে সমানে এলোপাথাড়ি মারতে লাগলেন। মারতে মারতে লাঠিটা ভেঙে গেল। এতেও বাবার রাগ পড়লো কি না বােঝা গেল না। এতাে মার খেয়ে ছিলাম বলে তেমন কোন দুঃখ ছিল না। ভাবলাম এবার মুন্নার হাত থেকে বোধহয় মুক্তি পাবো। বাবা ওকে দেখতে পেলে আর আস্ত রাখবেন না।
পরের দিন বাবা তাকে দেখতে পেয়েও কিন্তু কিছু বললেন না। শুধু আমাকে শাসিয়ে ওকে শুনিয়ে বললেন, আর একবার যদি ছেলেটা এ ঘরে আসে, আমাকে বলিস, সেদিন ওর ঘাড়ে মাথা থাকবে না। তারপর দিন বাবা ঘরের কোণে লুকিয়ে থেকে, আমাকে বললেন বাড়িতে কেউ না থাকার ভান করতে। মাকে পাশের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন। মুন্না টোপ গিললাে। পা টিপে টিপে ঘরে এসে ঢুকলো আমার। বাবা ওকে মারার জন্য দরজার মােটা খিলা খুলে নিলেন হাতে। বাড়ি মারতে যাবেন ওর মাথায়, এমন সময় মুন্না বাবার হাত চেপে ধরে বললো, খবরদার বলছি। লাঠির একটাও ঘা যদি আমার গায়ে লাগে, তাহলে …। তাহলে কি করবে তুমি ? বাবা বললেন অগ্নিশর্মা হয়ে।
– হাটে হাঁড়ি ভাঙব। ঢি ঢি পড়ে যাবে আপনার মেয়ের নামে।
– তার আগে, তােমায় আমি থানায়, পুলিশে দেবো।
– ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না।এই দেখুন আপনার মেয়ের হাতের লেখ চিঠি। বাবা চট্ করে ওর হাত থেকে চিঠিটা কেড়ে নিয়ে ছিঁড়ে ফেললেন। মুনা, শ্লেষের হাসি হেসে বললো, ও রকম চিঠি আরেও আছে।
– একথা সত্যি? বাবা রাগতঃস্বরে আমার কাছে জানতে চাইলেন। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর আর কোন কথা নেই। বাবা মুন্নার দিক থকে ঘুরে, আমার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে আছড়ে ফেলে, মারতে শুরু করলেন। হঠাৎ কি হলাে, মুন্না বাবার উপর ঝাঁপিয়ে পড় বললো, ওকে আর মারলে, আপনাকে আমি খুন করে ফেলবাে। বলে মুন্না বাবার গলা টিপে ধরলাে। মুহুর্তে বাবার মুখের সমস্ত রক্ত শুকিয়ে গেল। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে এলাে। বিবর্ণ মুখে, বাবা ছটফট করতে লাগলেন।
এরপর থেকে স্বাভাবিক ভাবেই মুন্না আমাদের ঘরে যাতায়াত শুরু করলো। দিনে, রাতে যখন খুশি আসতাে। ওকে দেখেও বাবা-মা না দেখার ভান করে থাকতাে। ওর বন্ধু বান্ধবরা মাঝে মধ্যে আমাদের ঘরে এলে, মা তাদের সঙ্গে ভালভাবে ব্যবহার করতাে। নিজের হাতে চা তৈরি করে খাওয়াতো। মেয়েরা বোধহয় এ ধরণের ছেলেদের প্রতি সহজেই আকৃষ্টি হয়ে পড়ে ! আমার মুন্নাকে আগের মতা আর অতাে খারাপ লাগতাে না। ধরেই নিয়েছিলাম, এটাই আমার ভবিতব্য। সেই ঘটনার পর থেকই বাবা মা আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড় লাগলেন। ওদের চোখে ঘুম নেই, ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া নেই। বাবার শরীর ভেঙে পড়তে লাগলাে। তাদের এক ভাবনা, একবার মেয়ের নামে বদনাম ছড়িয়ে পড়লে, তাদের পক্ষে আমাকে বিয়ে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এই ভয়ে বাবা মা শীঘ্র আমার বিয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। যেমন কোনাে এঁটো জিনিষ দেবতার ভােগ লাগে না। একজন পুরুষ যখন কোন নারীকে এঁটো করে দেয়। তাকে কেউ বিয়ে করে না। বড়জোর রক্ষিতা করে রাখতে পারে। অনেক চেষ্টা করে বাবা মা, বরপণের অস্বাভাবিক লোভ দেখিয়ে (যা বাবার পক্ষে দেওয়া কোনদিনই সম্ভব নয়), একজন লোভী ছিট কাপড়ের দোকানের কর্মচারীকে পাওয়া গেল। সম্প্রতি যার বউ গায়ে আগুন দিয়ে পুড়ে মারা গেছে। বাবা মা তাতেই রাজী হয়ে গেল। কথাবার্তা শুরু হলো। বিয়ের দিনও ঠিক হয়ে গেল। এ রকম আত্মাহূতিতে আমার কোন সম্মতি ছিল না। বাবা মা আমার মতের কোন আমল দিলেন না। মুন্নাকে আমি সব কথা খুলে বললাম। সে সব কথা শুনে আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালালো। আমাকে নিয়ে এসে উঠলো বেহালার এক বস্তিত। কয়েকমাস বেশ ভালই কাটলো। নতুন জীবনে অভ্যস্থ হয়ে উঠছিলাম। মুন্না বােধহয় আমাকে সত্যিকারের ভালবেসে ফেলেছিল। আমার কষ্ট হচ্ছে দেখলে, আমার কাজে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতো। তখন আমারও আর কোন ক্ষোভ ছিল না ওর প্রতি। এভাবে দিনগুলি গড়িয়ে গেলে মন্দ হতা না।
ভগবানের ইচ্ছে ছিল অন্যরকম। হঠাৎ একদিন খবর এলো, পোর্ট এলাকায় স্মাগলিং করতে গিয়ে এনকাউন্টারে মারা গেছে মুন্না। সেখানে
গিয়ে দেহ শনাক্ত করে আসতে হয়েছিল আমাকে। এরপর অকূল পাথারে পড়লাম আমি। কি করবো, কিভাবে বাঁচবোে ভাবতে পারলাম না। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ফিরে গেলাম বাবা মায়ের কাছে। সেখানেও আমার ঠাঁই হলাে না। দূর দূর করে আমাকে তাড়িয়ে দিলেন ওরা। সেখানে একটা রাত কোনরকমে কাটিয়ে পরের দিনই ফিরে আসতে হয়েছিলো বেহালার বস্তিতে। তারপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
এখন আমার ঠিকানা কালীঘাটের গঙ্গা পারের একটা নােংরা গলিতে।
হঠাৎ মহালয়ার দিন অয়নদা এই গলিতে এসে আমায় দেখতে পেয়েই চিনতে পারে। সে সেদিন সারা রাত আমার ঘরে কাটালো। কিছু না করে আমার এই পরিণতির করুণ কাহিনি শুনে বোধহয় তার মায়া হলো। আবার আসবে বলে পরদিন সকালে সে আমার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে চলে গেল। কয়েকদিন পর সে আবার এলো। সারাদিন এখানে থাকলো, খাওয়া দাওয়া করলো, সন্ধ্যায় আবার সে কিছু টাকা দিয়ে চলে গেল। আবার সে এক সপ্তাহ পরে এসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো। আমি বললাম, তা হয় না, আমি এখন নষ্ট নারী। আমাকে বিয়ে করলে সমাজ সেটা মেনে নেবে না। তোমাকেও একঘরে করবে।
– সে আমি বুঝবো। বলে সে সেদিনও চলে গেল।
কিছুদিন পর সত্যিই সে এসে, আমায় এখান থেকে নিয়ে গেল তার ভাড়া করা নতুন ঘরে। এটা যেন আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। বিশ্বাস হচ্ছিলো না সত্যি এমন কিছু ঘটতে পারে আবার আমার জীবনে। কিন্তু সেটাই বাস্তব সত্য বলে প্রমাণিত হলো। এখন আমাদের সংসার খুবই সুখের। সে টিউশন করে সকাল সন্ধ্যায়। আমি একটা সেলাই মেশিন কিনে নিয়েছি। বাড়িতে বসেই পাড়ার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েদের জামা সেলাই করে আমিও কিছু রোজগার করি, তাতে আমাদের সংসার ভাল ভাবে চলে যায়। জীবন সত্যিই প্রবাহিত নদির মতো , কখনও চড়ায় আটকে পড়ে কিন্তু থেমে থাকে না, সামনের দিকে সে এগিয়ে যায় তার নিজস্ব গতিতে।