মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে
মুখবন্ধ
কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম পুলিসের বড়কর্তা মিঃ সেন রায় ঘন ঘন কিরীটীর কাছে যাতায়াত করছিলেন।
একদিন কৌতূহলটা আর দমন করতে না পেরে শুধালাম, কি ব্যাপার রে কিরীটী?
কিরীটী আনমনে একটা জুয়েলস সম্পর্কিত ইংরাজী বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিল সামনের সোফাটার উপর বসে—মুখ না তুলেই বললে, কিসের কি?
সেন রায় সাহেবের এত ঘন ঘন যাতায়াত কেন তাই শুধাচ্ছিলাম।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথর।
পরশপাথর!
হ্যাঁ, কিছুদিন যাবৎ কলকাতা শহরে ইমিটেশন জুয়েলস নকল জহরতের সব ছড়াছড়ি দেখা যাচ্ছে।
নকল জহরৎ!
হ্যাঁ, তাই ভদ্রলোকের আহার নিদ্রা সব ঘুচে গিয়েছে।
তা ভদ্রলোকের কোন সুরাহা হল?
কোথায় আর হল?
তবে আজ যে সেন রায়কে ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারের কথা কি বলছিলি?
কলকাতা শহরে জুয়েলসের মার্কেট তো ঐ ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারই কনট্রোল করছে। তাই বলছিলাম ওদিকটায় একবার খোঁজ নিতে।
মৃদু হেসে বললাম, কেবল কি তাই?
তাছাড়া আর কি! বঁড়শী ফেলে রুই কাতলাই ধরা উচিত—পুঁটি ধরে কি হবে!
ঐ ঘটনারই দিন দুই পরে—
.
০১.
মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে দেখছিলাম। মুখের মধ্যে কোথায় যেন একটু বিশেষত্ব আছে। এবং নিজের অজ্ঞাতেই বোধ হয় মুখটির মধ্যে কোথায় এবং কেন বিশেষত্ব সেইটাই অনুসন্ধান করছিলাম।
মনে হচ্ছিল যাকে বলে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনী না হলেও মনের মধ্যে যেন তার একটা বিশেষ অনুভূতি আছে, যে অনুভূতি অনেক কিছুরই ইশারা দেয় বুঝি।
তবে সেদিন মেয়েটি চলে যাবার পর কিরীটী এক সময় বলেছিল মেয়েটি সম্পর্কে আমার অভিমত শুনে, মিথ্যে নয়, ঠিকই ধরেছিস। তবে সেই অনুভূতিকে যেন আচ্ছন্ন করে রেখেছিল একটা আশংকার কালো ছায়া।
সত্যি বলছিস?
সত্যি।
তবে ওকথা মেয়েটিকে বললি কেন?
কিরীটী মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিয়েছিল, মেয়েটির চেষ্টাকৃত ভণিতা দেখে।
ভণিতা?
কিন্তু ঐ পর্যন্তই। কিরীটী আর কোন কথা বলেনি বা বলতে চায়নি।
.
মাত্র হাত দুই ব্যবধানে আমাদের মুখোমুখি বসেছিল অন্য একটা সোফায় মেয়েটি শকুন্তলা চৌধুরী। এবং আর একটা সোফায় বসেছিলাম পাশাপাশি আমি আর কিরীটী।
একটু আগে শকুন্তলা তার বক্তব্য শেষ করেছে, এবং নিজের কথা বলতে বলতে সে যে যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তার রক্তিম শেষ আভাসটা যেন এখনো তার মুখের উপরে রয়েছে।
ইতিমধ্যে সন্ধ্যার ধূসর আবছায়া চারিদিকে নেমে এসেছিল। এবং বাইরের আলো ঝিমিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যেও আবছায়া ঘনিয়ে এসেছিল।
আমি সোফা থেকে উঠে গিয়ে সুইচ টিপে ঘরের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। হঠাৎ ঘরের আলোটা জ্বেলে দেওয়ায় শকুন্তলা যেন একটু নড়েচড়ে বসল।
সামনের ত্রিপয়ের উপরে রক্ষিত টোবাকোর সুদৃশ্য কৌটোটা তুলে নিল কিরীটী এবং হাতের নিভে যাওয়া পাইপটার তামাকের দহ্মাবশেষ সামনে অ্যাসট্রের মধ্যে ফেলে দিয়ে নতুন করে আবার সেটার গহুরে তামাক ভরতে শুরু করল।
আমি কিন্তু শকুন্তলার মুখের দিকেই চেয়েছিলাম।
রোগা ছিপছিপে গড়ন এবং বেশ দীর্ঘাঙ্গী। মুখটা লম্বাটে ধরনের। নাক ও চিবুকের গঠনে একটা যেন দৃঢ়তার ছাপ। দুটি চোখে বুদ্ধির দীপ্তি স্পষ্ট বটে তবে সেই দীপ্তিকে আচ্ছন্ন করে কি যেন আরো কিছু ছিল।
সাধারণ একটি হ্যাঁতের আকাশ-নীল রঙের শাড়ি পরিধানে ও গায়ে একটি চিকনের সাদা ব্লাউজ। দুহাতে একটি করে সরু সোনার রুলি ও বাম হাতের মধ্যমাতে সাদা পোখরাজ ও লাল চুনী পাথর বসানো আংটি ব্যতীত সারা দেহে আভরণের চিহ্নমাত্র নেই। মুখে প্রসাধনের ক্ষীণ প্রলেপ।
কিন্তু ঐ সামান্য বেশেই তরুণীর চেহারার মধ্যে যেন একটি স্নিগ্ধ সুন্দর শ্রী ফুটে উঠেছিল, বিশেষ একটা আভিজাত্য যেন প্রকাশ পাচ্ছিল। তরুণীর বয়স তেইশ-চব্বিশের বেশী হবে বলে মনে হয় না।
পাইপে অগ্নিসংযোগ করে দেশলাইয়ের কাঠির সাহায্যে কাঠিটি অ্যাশট্রের মধ্যে ফেলে দিতে দিতে এতক্ষণ বাদে কিরীটী কথা বলল।
শান্ত মৃদুকণ্ঠে বললে, কিন্তু মিস চৌধুরী, আপনার এই ব্যাপারে আমি কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি বলুন!
তা আমি জানি না, তবে ঐ লোকটার সঙ্গে সত্যিই যদি আমার বিয়ে হয়, কাকার আদেশ মেনে নিয়ে সত্যিই যদি ওকেই আমায় বিয়ে করতে হয় এবং আপনি যদি এ ব্যাপারে আমাকে
সাহায্য করেন তো আমার সামনে একটি মাত্র পথ খোলা আছে—জানবেন সেটা হচ্ছে সুইসাইড করা।
ছিঃ, সুইসাইড করবেন কেন! বললাম এবারে আমিই।
তাছাড়া আমার অন্য কোন পথই তো নেই সুব্রতবাবু।
বুদ্ধিমতী আপনি, ওভাবে দুর্বলের মত সুইসাইড করতে যাবেন কেন, আপনার কাকাকে আর একবার বুঝিয়ে বলুন না। আমিই আবার বললাম।
কোন ফল হবে না সুব্রতবাবু। বললাম তো আপনাদের, কাকা এ ব্যাপারে অত্যন্ত অ্যাডামেন্ট! তাছাড়া জানি—এবং দেখেছিও তো চিরদিন—ওঁর মতের বিরুদ্ধে কেউ যাবার চেষ্টা করলে তাকে তিনি কিছুতেই ক্ষমা করেন না। তাছাড়া–
কি?
দুষ্মন্ত, সেও কাকার বিরুদ্ধে যেতে রাজী নয়।
দুষ্মন্তবাবু তো আপনারই কাকার ছাত্র, তাই বললেন না? কিরীটী এতক্ষণে আবার কথা বলল।
হ্যাঁ। শুধু মাত্র নয় জীবনের সব চাইতে প্রিয় ছাত্র বলতে পারেন। হি ইজ সো মাচ প্রাউড অফ হিম! কিন্তু দুষ্মন্ত বিয়ের প্রপোজালটা তাকে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি না করে দিয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে বলে দিয়েছেন তা সম্ভব নয়।
দুষ্মন্ত জিজ্ঞাসা করেননি কেন সম্ভব নয়? আবার কিরীটী প্রশ্ন করে।
যখন তিনি কোন ব্যাপারে একবার না বলেন, তারপর তো কারো কোন কথাতেই আর কান দেন না এবং বলতে গেলে বলেন, ও-কথা শেষ হয়ে গিয়েছে, অন্য কথা বল। তাই সে আর অনুরোধ করেনি।
তা আপনি বলেননি কেন কাকাকে আপনার কথাটা? আপনাকে তো তিনি অত্যন্ত ভালবাসেন, একটু আগে বললেন!
হ্যাঁ, জানি ভালবাসেন এবং আমি বলেছিলামও—
বলেছিলেন!
হ্যাঁ—
কি বললেন আপনাকে তিনি জবাবে?
বললেন, না, তোমার বিয়ে আমি ঠিক করেছি রাঘব সরকারের সঙ্গে। এতদিন বিয়েটা তোমাদের হয়েও যেত। কিন্তু আমার ইচ্ছা, তুমি বি.এ.টা পাস কর, তার পর বিয়ে হবে, সেই কারণেই দেরি।
হঠাৎ যেন শকুন্তলার কথায় কিরীটী চমকে ওঠে, বলে, কী—কী নাম বললেন?
রাঘব সরকার।
মিস্ চৌধুরী, আচ্ছা রাঘব সরকার কি–
কি?
ইকনমিক জুয়েলার্সের মালিক?
তা ঠিক জানি না।
জানেন না?
না।
ও! হ্যাঁ, কি যেন আপনি বলছিলেন, এই বছরেই বুঝি আপনি তাহলে বি. এ. পরীক্ষা দিচ্ছেন?
এইবার পাস করলাম।
রাঘব সরকারের সঙ্গে আপনার কাকার সম্পর্ক কি? বলছিলাম কি সূত্রে পরিচয়, আর কতদিনের এবং কি রকম পরিচয়?
আশ্চর্য তো আমার সেইখানেই লাগে মিঃ রায়—
আশ্চর্য! কেন?
কারণ পরিচয় ওঁদের পাঁচ-সাত বছর হবে, ঘনিষ্ঠতাও খুব, কিন্তু—
কি?
রাঘব সরকারকে কাকা যে রকম ঘৃণা করেন—
ঘৃণা?
হ্যাঁ, মুখে যদিও সেটা তিনি প্রকাশ করেন না কখনো কিন্তু আমি তা জানি। আশ্চর্য তো হয়েছি আমি তাইতেই, সেই লোকের সঙ্গেই কাকা আমার বিয়ে দিতে কেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
রাঘব সরকারকে ঘৃণা করেন আপনি ঠিক জানেন?
জানি বৈকি।
কি করে জানলেন?
কেউ কাউকে সত্যিকারের ঘৃণা করলে সেটা বুঝতে কি খুব কষ্ট হয় মিঃ রায়?
কিন্তু—
না, সেরকম কখনো কিছু আমার চোখে পড়েনি বটে তবে বুঝতে পেরেছি আমি।
আর একটা কথা মিস্ চৌধুরী—
বলুন।
খুব ঘন ঘন যাতায়াত আছে বুঝি রাঘব সরকারের আপনাদের বাড়িতে?
না, এক মাস দেড় মাস অন্তর হয়ত একবার সে আসে।
এক্সকিউজ মি মিস চৌধুরী, লোকটার মানে ঐ রাঘব সরকারের বয়স কত?
পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে বলেই মনে হয়—
হুঁ, চেহারা?
মিথ্যা বলব না—হি ইজ রিয়ালী হ্যাণ্ডসাম! একটু যেন কেমন ইতস্ততঃ করেই কথাটা বলে শকুন্তলা।
সত্যি?
হ্যাঁ—কিন্তু তাতে আমার কি? আই হেট হিম! গলায় অনাবশ্যক জোর দিয়েই যেন কথাটা বললে শকুন্তলা।
আর একটা কথা—
বলুন।
দুষ্মন্তবাবু দেখতে কেমন?
রাঘব সরকারের সঙ্গে তুলনায় কিছুই নয়—কিন্তু তাকে আমি—
জানি ভালবাসেন। কিরীটীই কথাটা শেষ করল, সে তো বুঝতেই পেরেছি।
মুহূর্তকাল তারপর যেন কিরীটী চুপ করে থাকে। মনে হয় কি যেন সে ভাবছে। মুখ থেকে পাইপটা হাতে নেয়।
এবং তার পরই হঠাৎ শকুন্তলার দিকে তাকিয়ে বলে, আপনার ঐ আংটিটা নতুন বলে মনে হচ্ছে মিস্ চৌধুরী।
হ্যাঁ।
আপনি নিজেই আংটিটা শখ করে তৈরী করেছেন, না কেউ দিয়েছে আংটিটা আপনাকে?
রাঘব সরকার দিয়েছেন।
কি বললেন! একটু যেন কৌতূহল কিরীটীর কণ্ঠে প্রকাশ পায়, রাঘব সরকার দিয়েছেন আংটিটা আপনাকে?
হ্যাঁ, কাকার হাত দিয়ে আর কাকার আদেশেই আমাকে আংটিটা আঙুলে পড়তে হয়েছে।
দুষ্মন্তবাবু জানেন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা?
জানে।
কিছু বলেননি তিনি?
কি বলবে? কাকাকে সে কি জানে না!
হুঁ। কিন্তু মিস্ চৌধুরী—
বলুন।
এ-ব্যাপারে যা বুঝতে পেরেছি, মীমাংসা করতে পারেন আপনারাই–শান্তকণ্ঠে বলে কিরীটী।
আমরাই!
হ্যাঁ, আপনি আর দুষ্মন্তবাবু।
কিন্তু–
একটু চিন্তা করে দেখুন, তাই নয় কি? আপনিও সাবালিকা এবং দুষ্মন্তবাবুও ছেলেমানুষ নন। আপনারা পরস্পরকে যখন ভালবাসেন এবং পরস্পরকে যখন বিয়ে করতে চান তখন কোন বাধা যদি কোথাও থাকে সে বাধাকে উত্তীর্ণ হতে হবে আপনাদেরই। হ্যাঁ—আপনাদেরই চেষ্টা করতে হবে।
কিন্তু আপনি ঠিক বুঝতে পারছেন না মিঃ রায়—
পারছি! আর সেইজন্যেই তো বলছি—দায়িত্ব যখন আপনাদের, মীমাংসাটাও আপনাদেরই করে নিতে হবে।
মিঃ রায়—
তাছাড়া সত্যিই বলুন তো, কি ভাবে আপনাকে আমি সাহায্য করতে পারি!
আমি ভেবেছিলাম—
কি ভেবেছিলেন?
কত জটিল ব্যাপারেরই তো মীমাংসা আপনি করেছেন—আমাদের এ ব্যাপারেও—
সেরকম সত্যিই কিছু জটিল হলে সাহায্য নিশ্চয়ই আপনাকে আমি করতাম।
আমি-আমি তাহলে কোন পরামর্শই আপনার কাছে পাব না মিঃ রায়?
একটা যেন রীতিমত হতাশার সুর ধ্বনিত হয় শকুন্তলার কণ্ঠে। চোখের দৃষ্টিতেও একটা নিরাশার বেদনা ফুটে ওঠে যেন।
আচ্ছা, তাহলে উঠি। নমস্কার—বলতে বলতে শকুন্তলা উঠে দাঁড়ায় এবং যাবার জন্য পা বাড়ায়।
দরজা বরাবর গিয়েছে শকুন্তলা, সহসা ঐ সময় কিরীটী ডাকল, শুনুন মিস চৌধুরী—
শকুন্তলা কিরীটীর ডাকে ফিরে দাঁড়াল।
একটা কাজ করতে পারবেন?
কি?
কাল দুপুরের পরে মানে এই সন্ধ্যার দিকে আপনার ঐ দুষ্মন্তবাবুকে নিয়ে আমার এখানে একবার আসতে পারবেন আপনারা?
কেন পারব না, নিশ্চয়ই পারব।
বেশ, তবে তাই আসবেন।
কিন্তু–হঠাৎ যেন কি মনে হওয়ায় শকুন্তলা বলে ওঠে, কাল তো আসতে পারব না মিঃ রায়, কাল আমাদের বাড়িতে একটা উৎসব আছে—
উৎসব?
হ্যাঁ, কাকামণির জন্মতিথি উৎসব। প্রতি বৎসর ঐ দিনটিতে উৎসব হয়—তার সব পরিচিত আত্মীয় বন্ধুবান্ধবেরা আসেন আর আমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হয়। পরশু আসতে পারি—
তবে তাই আসবেন।
অতঃপর শকুন্তলা নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
.
০২.
শকুন্তলা ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী যেন একটু ক্লান্ত ভাবেই সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজল এবং কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থেকে যেন একেবারে প্রায় নিঃশব্দ কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য!
একটু যেন চমকেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, কিছু বলছিস?
হ্যাঁ, ভাবছি—
কি?
ভাবছি মেয়েটি নিজেই এসেছিল আমার কাছে না কেউ পাঠিয়েছিল ওকে!
ও-কথা কেন বলছিস কিরীটী?
বলছি এই কারণে যে, আংটির অনুমানটা যদি আমার সত্যিই হয় তো—চমৎকার অভিনয় করে গেল মেয়েটি স্বীকার করতেই হবে।
অভিনয়!
হ্যাঁ, মেয়েরা অবিশ্যি আমার মতে সবাই, বলতে গেলে বেশীর ভাগই, জাত-অভিনেত্রী এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রেই তাদের অভিনয়টাই সত্যি এবং বাকি যা তা মিথ্যা; কিন্তু তাদের মধ্যেও আবার কেউ কেউ অনন্যসাধারণ থাকে তো–
তার মানে তুই বলতে চাস, ঐ শকুন্তলা মেয়েটি সেই শেষোক্ত পর্যায়ে পড়ে?
কিছুই আমি বলতে চাই না কারণ একটু আগেই তো বললাম ব্যাপারটাই আমার অনুমান মাত্র; কিন্তু শ্রীমান জংলীর ব্যাপারটা কি? সে কি আজ আমাদের চা-উপবাসীই রেখে দেবে স্থির করেছে নাকি?
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না, ট্রেতে ধূমায়িত কাপ নিয়ে জংলী এসে ঘরে ঢুকল।
কি রে চা এনেছিস?
আজ্ঞে না।
আজ্ঞে না মানে! তবে ঐ কাপে কি?
ওভালটিন। জংলী বললে।
সত্যিই সুব্রত, চায়ের কাপের দিকে আদৌ হাত না বাড়িয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে কিরীটী এবারে, আমার স্বাস্থ্য ও তার রক্ষণাবেক্ষণ সম্পর্কে হঠাৎ যে মাঝে মাঝে কৃষ্ণা অতি-সচেতন হয়ে ওঠে—চায়ের বদলে সরবত বা ওভালটিনের অত্যাচার
অসহ্য! কথাটা শেষ করল কৃষ্ণা।
না, মানে কৃষ্ণা তুমি—
হস্তধৃত কাচের প্লেটটা এগিয়ে দিতে দিতে মৃদু হাস্য সহকারে কৃষ্ণা এবারে বলে, ওভালটিনের সঙ্গে টোমাটোর পাঁপড় খেয়ে দেখো, সত্যি ডেলিসাস!
অবনক্সাস! মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে বলে কিরীটী।
কি বললে? প্রশ্ন করে কৃষ্ণা।
বললাম ওটা পাঁপড়ও নয় টোমাটোরও নয়। সামথিং ক্যাডাভারাস লাইক ইয়োর মডার্ণ সো-কল্ড আপ-টু-ডেট সোসাইটি! অর্থাৎ সুকুমার রায়ের গজকচ্ছপেরই একটা সংস্করণ মাত্র।
কথাগুলো কিরীটী গম্ভীর হয়ে বলল বটে তবে দুটোই অর্থাৎ ওভালটিন ও পাঁপড় টেনে নিয়ে নির্বিবাদে সদ্ব্যবহার করতে শুরু করে দিল।
তার পর ঐ ব্যাচিলার ভদ্রলোকটিকে কি সারমন দেওয়া হচ্ছিল শুনি নারী সম্পর্কে। কিরীটীর দিকে চোখ পাকিয়ে প্রশ্নটা করে কৃষ্ণা।
কই না, নারী সম্পর্কে তো নয়, আমি তো বলছিলাম অভিনেত্রী সঙ্রে কথা।
অভিনেত্রী সঙ্ঘ!
হুঁ, মানে যারা এই আর কি অভিনয়ই করে। কথাটা চোখ বুজেই একটা পাপড়ের টুকরো আরাম করে চিবুতে চিবুতে কিরীটী বললে।
শুধু নিশ্চয়ই নারী অভিনেত্রীদের কথা নয়—পুরুষ অভিনেতাদের কথাও বলছ! কৃষ্ণা শুধায়।
য়্যাঁ, কি বললে? চোখ মেলে তাকায় কিরীটী।
বলছিলাম চমৎকার অভিনয় করতে পারে এমন তো শুধু নারীই নয়, পুরুষও আছে।
দুজনের–স্বামী ও স্ত্রীর পরস্পরের কৌতুকপূর্ণ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত কথার লেনদেন শুনতে আমি বেশ উপভোগই করছিলাম।
সহসা ঐ সময় কিরীটী বলে উঠল, সন্দেহ নেই, সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু প্রিয়ে, অভিনয়শিল্পে নারীর স্থান যে একটু বিশেষ স্তরেই, নিশ্চয়ই কথাটা অস্বীকার করবে না?
নিশ্চয়ই করব।
বেশ। তবে তিষ্ঠ ক্ষণকাল। এবারে সত্যিই তোমাকে শ্রীকৃষ্ণ যে মোহিনী রূপ ধারণ করে সমস্ত দেবাসুরের মাথাটা ঘুরিয়ে দিয়েছিল সেই মোহিনী রূপের অভিনয় মহিমা তোমাকে দেখাব। কিন্তু আমাকে একটিবার বেরুতে হবে—
কথাটা বলতে বলতে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং সোজা গিয়ে তার শয়নঘরের সংলগ্ন তার একান্ত নিজস্ব যে প্রাইভেট কামরাটি তার মধ্যে প্রবেশ করে ভিতর থেকে অর্গল তুলে দিল টের পেলাম।
.
সেই কামরা থেকে বের হয়ে এল যখন, সম্পূর্ণ ভোল একেবারে পাল্টে ফেলেছে কিরীটী।
মুসলমানী চোস্ত পাজামা ও গায়ে শেরওয়ানী। মাথায় কালো টুপী। হাতে একটা ছোট চামড়ার কেস। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। চোখে কালো চশমা।
কি ব্যাপার, হঠাৎ এ বেশ কেন? প্রশ্ন করলাম আমিই।
একটু সওদা করে আসি।
সওদা কিসের?
জহরতের। বলেই আমাকে তাড়া দিল, চল্ ওঠ—
কোথায়?
বললাম তো সওদা করে আসা যাক। ওই—আবার তাড়া দিল কিরীটী।
কিন্তু তবু উঠতে আমি ইতস্ততঃ করি।
কি রে, এর মধ্যেই গেঁটে বাত ধরল নাকি? ওঠ—
অগত্যা উঠে দাঁড়াই।
রাস্তায় এসে ওর পাশে চলতে চলতে আবার পূর্বোক্ত প্রশ্নটাই করলাম, কিন্তু এই অসময়ে সত্যি কোথায় চলেছিস বল্ তো কিরীটী!
অসময় আবার কোথায়, মাত্র পৌনে আটটা রাত। আর একান্ত দেখা যদি নাই করে তো ফিরে আসব। তার বেশী তো কিছু নয়। তবু অন্তত একটু বেড়ানোও তো হবে।
তা যেন হবে, কিন্তু কার সঙ্গে দেখা করতে চলেছিস এ সময় হঠাৎ?
হঠাৎ আবার কোথায়! এই ট্যাক্সি-ইধার! কথাটা শেষ করল কিরীটী রাস্তার ওধারে গিয়ে, আমাদের দিকেই যে খালি ট্যাক্সি যাচ্ছিল সেই ট্যাক্সিটা ডেকে।
পাঞ্জাবী ট্যাক্সি ড্রাইভার সর্দারজী কিরীটী ডাকতেই সঙ্গে সঙ্গে ট্যাক্সিটা ঘুরিয়ে একেবারে রাস্তার এদিকে আমাদের সামনে এনে দাঁড় করাল।
আয়, ওঠ—
উঠে বসলাম ট্যাক্সিতে। ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।
কিধার যায়গা বাবুজী?
বৌবাজার। কিরীটী বলে।
ট্যাক্সি বৌবাজারের দিকেই ছোটে।
বৌবাজারের কোথায় যাচ্ছিস?
ইকনমিক জুয়েলার্সে। গম্ভীর কণ্ঠে কিরীটী বলে।
কিছু কিনবি বুঝি?
পূর্ববৎ গম্ভীর কণ্ঠে বললে, দেখি—তেমন মনমতো জুয়েলস যদি কিছু পাই তো কেনা চলতে পারে বৈকি।
বুঝলাম কিরীটী কেন যাচ্ছে সেখানে আপাততঃ ব্যাপারটা ভাঙতে আমার কাছে রাজী নয়। আবার সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় তবে কি ইকনমিক জুয়েলার্সের রাঘব সরকারের সঙ্গে মোলাকাত করতেই চলেছে।
হয়তো তাই। কথাটা নেহাত অসংগতও মনে হয় না। কারণ সেন রায়কেও ও বলেছিল ঐ রাঘব সরকারের সঙ্গে দেখা করতে। আবার শকুন্তলাও আজ সন্ধ্যায় ঐ রাঘব সরকারের কথাই বলে গেল।
জনাকীর্ণ আলোকিত পথ ধরে ট্যাক্সিটা ছুটে চলেছে। এবং গাড়ির মধ্যে অন্ধকার থাকলেও, মধ্যে মধ্যে এক-আধটা যে আলোর ঝাপ্টা রাস্তার আলো থেকে চলমান গাড়ির জানালাপথে ভিতরে এসে পড়ছিল, সেই আলোর মধ্যে কিরীটীকে দেখা যাচ্ছিল।
গাড়ির ব্যাকে হেলান দিয়ে কিরীটী চুপটি করে বসেছিল। চোখে তার কালো কাচের চশমা থাকায় ওর চোখ দুটো দেখতে পাচ্ছিলাম না। তবে এটুকু বুঝতে পারি, কি যেন সে ভাবছে।
পথে একটা বড় জুয়েলারী শপের সামনে গাড়ি থামিয়ে কিরীটী ভিতরে গেল এবং মিনিট কুড়ির মধ্যেই ফিরে এলো। গাড়ি আবার সামান্য চলে ইকনমিক জুয়েলার্সের সামনে এলে। ট্যাক্সি থেকে নামলাম আমরা। পকেট থেকে টাকা বের করে কিরীটী ভাড়া মিটিয়ে দিল।
রাস্তার দু ধারেই সার সার সব জুয়েলারীর দোকান। প্রত্যেক দোকানেই তখনো বেচাকেনা চলেছে। আলোঝলমল শোকেসগুলোর মধ্যে নানা ধরনের সব দামী দামী অলংকার সাজানো।
পর পর অনেক দোকান থাকলেও তারই মধ্যে ইকনমিক জুয়েলার্স যেন বিশেষ ভাবেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
দু দিককার দুটো রাস্তা জুড়ে অনেকখানি জায়গা নিয়ে বিরাট একটি ত্রিকোণ বাড়ি। বাড়ির মাথায় কোণাকুণি ভাবে বসানো বিরাট একটি নিওন সাইন বোর্ড। ইকনমিক জুয়েলার্স কথাগুলো নীল লাল নিওনে জ্বলছে নিভছে।
একতলায় পুরু কাচের পাল্লা বসানো শোকেস আগাগোড়া। ভিতরে আলোকিত শোকেসের মধ্যে নানাবিধ মহার্ঘ্য অলঙ্কারাদি থরে থরে সাজানো।
কিরীটী সোজা দোকানে প্রবেশ করবার দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে দাড়িওয়ালা বন্ধুকধারী শিখ দারোয়ান।
দোকানের ভিতরে দুজনে আমরা প্রবেশ করলাম।
কিরীটী সোজা কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায় এবং কাউন্টারের যে প্রৌঢ়-বয়েসী ভদ্রলোকটি চোখে একটা পুরু কাচের চশমা পরে লিখছিলেন তাঁকেই শুধায়, ম্যানেজিং ডাইরেক্টার মিঃ সরকারের সঙ্গে একটিবার দেখা হতে পারে?
কিরীটী হিন্দীতেই কথাটা জিজ্ঞাসা করল।
ভদ্রলোক কিরীটীর প্রশ্নে মুখ তুলে তাকালেন, একটু অপেক্ষা করুন, মেমোটা শেষ করে নিই।
.
০৩.
মেমোটা লেখা শেষ করে প্রৌঢ় মুখ তুলে তাকালেন, কাকে চাই বলছিলেন?
ম্যানেজিং ডাইরেক্টারকে। কিরীটী তার কথাটার পুনরাবৃত্তি করল।
বড়বাবুকে?
হ্যাঁ, রাঘব সরকার মশাইকে। কিরীটীর মুখে কর্তার নামটা শুনেই প্রৌঢ় ভদ্রলোকটিও ওর মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন এবং ক্ষণকাল তাকিয়ে তাকিয়ে কিরীটীর আপাদমস্তক তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে বললেন, কি নাম আপনার? কোথা থেকে আসছেন? বড়বাবুর সঙ্গে আপনার প্রয়োজনটা কি?
নাম বললে তো তিনি চিনবেন না, আসছি আপাততঃ আমেদাবাদ থেকে আর প্রয়োজনটা ব্যক্তিগত।
ভদ্রলোকও যেমন প্রশ্নগুলো পর পর একই সঙ্গে করে গিয়েছিলেন, কিরীটীও পর পর একই সঙ্গে জবাবগুলো দিয়ে গেল।
ওঃ, তা—
তিনি যদি থাকেন তো দয়া করে তাকে খবরটা দিলে বাধিত হব।
চেয়ার থেকে এবারে উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক এবং মৃদুকণ্ঠে বললেন, হুঁ, দাঁড়ান, দেখি তিনি ঘরে আছেন কিনা?
ভদ্রলোক ভিতরের দিকে চলে গেলেন। আমরা এদিক-ওদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম।
প্রতিষ্ঠানটি বিরাট নিঃসন্দেহে। বিরাট হলঘর। অর্ধেকটা ঘরের পর পর একই সাইজের কাচের শোকেস দিয়ে একটা যেন বেষ্টনী গড়ে তোলা হয়েছে।
বেষ্টনীর ভেতরের অংশে রয়েছেন কর্মচারী ও সেলস্ম্যানরা আর বাহিরের অংশে খরিদ্দাররা। বেষ্টনীটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে যেন খাড়া করে তোলা হয়েছে।
ঘরের সর্বত্র উজ্জ্বল ফুরসেন্ট টিউব জ্বলছে। তারই আলোয় সমগ্র হলঘরটি যেন একেবারে ঝলমল করছে। প্রতিষ্ঠানটির অনুরূপ আড়ম্বরে কোন ত্রুটি নেই কোথাও যেন এতটুকু। ইতিমধ্যে সময় উত্তীর্ণ হওয়ায় খরিদ্দারের ভিড় একটু একটু করে কম হতে শুরু করেছিল।
একটু পরেই ভদ্রলোক ফিরে এলেন, আসুন বলে আহ্বান জানালেন।
কোন্ পথে যাব? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ঐ দক্ষিণ দিক দিয়ে আসুন—ওখানে ভিতরে আসবার রাস্তা আছে। ভদ্রলোক আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন।
ভদ্রলোকের নির্দেশমত আমরা ভিতরে গিয়ে প্রবেশ করলাম এবং তাকে অনুসরণ করেই হলঘর থেকে বের হয়ে বন্ধ একটা কাচের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালাম।
পুরু কাচের দরজার ওদিকে একটা ভারি পর্দা ঝুলছে। ঘরের অভ্যন্তরে কিছু নজরে পড়ে না।
সঙ্গের ভদ্রলোকটিই কাচের দরজাটা টেনে খুলে আমাদের বললেন, যান, বড়বাবু ভিতরে আছেন–
পর্দা সরিয়ে আমরা ভিতরে প্রবেশ করতেই নাতি প্রশস্ত একটি ঘর আমাদের নজরে পড়ল। ঘরের দু পাশে দুটি লোহার সিন্দুক। এবং এক কোণে একটি কাচের টেবিলের সামনে সবুজ ঘেরাটোপ দেওয়া টেবিল ল্যাম্পের নীলাভ আলোয় চোখে পড়ল টাকমাথা এক ব্যক্তি, মাথা নীচু করে কি যেন পরীক্ষা করছেন। তাঁর সামনে নানা আকারের ছোট বড় জুয়েলয়ের বাক্স। পাশে কাচের কেসের মধ্যে একটি ওয়েয়িং অ্যাপারেটাস।
টেবিলের সামনে দেখা গেল খান-তিনেক আধুনিক ডিজাইনের স্টীলের চেয়ার।
মাথা না তুলেই সেই ব্যক্তি মৃদুকণ্ঠে আমাদের আহ্বান জানালেন, আসুন-বসুন।
বলা বাহুল্য আমরা এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসলাম।
কাজ করতে করতেই ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আমেদাবাদ থেকে আসছেন?
কিরীটী এবারও মৃদু কণ্ঠে বললে, না, আসলে করাচী থেকে আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে ভদ্রলোক মুখ তুললেন।
চোখে কালোমোটা সেলুলয়েড ফ্রেমের চশমা। চশমার কাচের ভিতর দিয়ে এক জোড়া চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমাদের উপরে ন্যস্ত হল। মুহূর্তকাল সেই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যেন কিরীটীর ও আমার উপরে স্থির রইল।
আপনারা–
মিঃ সরকার, আমার নাম ইসমাইল খান—আমার সঙ্গে ইনি আমার দোস্ত মধুবাবু— আমি একটা বিশেষ কাজে আপনার কাছে এসেছিলাম—একেবারে খাস হিন্দীতে কথাগুলো বললে কিরীটী।
বলুন?
কিছু বেলজিয়ান হীরা আমার কাছে আছে।
বেলজিয়ান হীরা!
হ্যাঁ। হীরাগুলো বিক্রি করতে চাই।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আবার কিছুক্ষণ চেয়ে রইল রাঘব সরকার। তারপর মৃদুকণ্ঠে বললেন, হীরা বিক্রী করতে চান?
হ্যাঁ।
অপরিচিত কারো কাছ থেকে তো কখনো আমি কোনো জুয়েলস্ কিনি না।
ব্যবসা করতে বসেছেন আপনি মিঃ সরকার, তাই ভেবেছিলাম—
কি ভেবেছিলেন মিঃ খান?
যাদের সঙ্গে কারবার করেন নিশ্চয়ই সকলেই আপনার পরিচিত আসেন না—সম্ভবও নয় তা।
না, তা আসেন না বটে—তবে—
বলুন?
আপনি এ দেশের হলে কথা ছিল না—কিন্তু আপনি আসছেন করাচী থেকে!
তা হয়ত আসছি, তবে একজনের কাছে আপনার নাম শুনেই এসেছিলাম।
কে সে?
ক্ষমা করবেন, নামটা বলা সম্ভব নয়।
অতঃপর রাঘব সরকার মুহূর্তকাল কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, বেশ নিয়ে আসবেন, দেখব।
একটা স্যাম্পল এনেছি, যদি দেখতে চান তো দেখাতে পারি।
স্যাম্পল এনেছেন?
হ্যাঁ। কারণ দরদস্তুর একটা মোটামুটি স্থির না হলে মিথ্যে হীরাগুলো বয়ে নিয়ে এসে তো কোন লাভ হবে না।
কিরীটীর শেষোক্ত কথায় আবার রাঘব সরকার কিরীটীর দিকে মুখ তুলে তাকালেন।
আমি লোকটির—অর্থাৎ রাঘব সরকারের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম।
বয়স লোকটার যে পঞ্চাশের নীচে নয় তা দেখলেই বোঝা যায়। কপালের কাছে এবং রগের দু পাশের চুলে পাক ধরেছে। কপাল ও নাকের পাশে বলিরেখা জাগতে আরম্ভ হয়েছে, বয়সের চিহ্ন। কিন্তু সত্যি সুপুরুষ ভদ্রলোক!
শকুন্তলা চৌধুরী মিথ্যা বলে নি, রাঘব সরকারের রূপবর্ণনায় এতটুকু অত্যুক্তি করে নি। মাথার চুল পাতলা হয়ে এসেছে, মধ্যস্থলে টাক দেখা দিয়েছে। প্রশস্ত কপাল। দীর্ঘ চক্ষু। চক্ষুর দৃষ্টিতে বুদ্ধির দীপ্তি। রোমশ জোড়া জ্ব। খাড়া নাক। দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল। বৃষস্কন্ধ। টুকটকে গৌর গাত্রবর্ণ। পরিধানে ঢোলা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির তলা থেকে নেটের গেঞ্জীর কিয়দংশ ও রোমশ বক্ষঃস্থলের কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
কই দেখি কি স্যাম্পল এনেছেন? রাঘব সরকার আবার বললেন।
সেরওয়ানীর পকেটে হাত চালিয়ে একটি মরক্কো লেদারের ছোট কেস বের করল কিরীটী এবং বাক্সের গায়ের বোতামটি টিপতেই, স্প্রিং অ্যাক্সনে বাক্সের ডালাটা খুলে যেতেই বাক্সের মধ্যস্থিত প্রায় দশ রতির একটি হীরা ঘরের ঈষৎ নীলাভ আলোয় যেন ঝিলমিল করে উঠল।
এই দেখুন—কিরীটী বাক্সসমেত হাতটা এগিয়ে ধরল রাঘব সরকারের দিকে।
রাঘব সরকার কিরীটীর হাত থেকে হীরাটা নিলেন বাক্স থেকে দু আঙুলের সাহায্যে তুলে। এবং বেশ কিছুক্ষণ সময় হীরাটা আলোয় পরীক্ষা করে বললেন, বেলজিয়ান হীরাই। কতগুলো হীরা আছে আপনার কাছে, মিঃ খান?
কিছু আছে—
হুঁ। তা এ হীরা আপনি কোথা থেকে পেলেন মিঃ খান?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হীরা বেচতে এসেছি, ঠিকুজী বেচতে তো আসি নি মিঃ সরকার।
রাঘব সরকার কিরীটীর কথায় আবার ওর মুখের দিকে তাকালেন পূর্ববৎ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবং ক্ষণকাল তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে বললেন, এত দামী জিনিসের কারবার তো ঠিকুজী না জানলে হয় না মিঃ খান!
কেন বলুন তো?
কারণ ঠিকুজীর উপরই যে অনেক সময় দামটা নির্ভর করে।
ওঃ, এই কথা! তা বেশ তো, কি রকম ঠিকুজী হলে আপনার পছন্দ হবে বলুন?
মানে?
কথাটা তো আমার অস্পষ্ট বা দুর্বোধ্য নয় মিঃ সরকার, বিশেষ করে আপনার মত একজন অভিজ্ঞ কারবারীর পক্ষে।
তাহলে—
ধরে নিন না, আপনি যা ভেবেছেন তাই। বলুন এবারে দর।
আবার ক্ষণকাল যেন স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন রাঘব সরকার কিরীটীর মুখের দিকে। তারপর বললেন নিম্নকণ্ঠে, দরের জন্য আটকাবে না। যত হীরা আপনার কাছে আছে নিয়ে আসবেন।
চেকে কিন্তু পেমেন্ট নেব না।
নগদই পাবেন। কবে আসছেন বলুন?
ফোনে জানাব।
বেশ।
অতঃপর রাঘব সরকারকে নমস্কার জানিয়ে আমরা বের হয়ে এলাম তার ঘর থেকে।
.
রাস্তায় বের হয়ে আবার একটা ট্যাক্সি নেওয়া হল এবং ট্যাক্সিতে উঠে প্রশ্ন করলাম, হীরাটা কার রে?
কিরীটী বললে, আড্ডি জুয়েলার্স থেকে এনেছি—কাল ফিরিয়ে দিতে হবে। অতঃপর ঘণ্টাখানেক ট্যাক্সিতে শহরের এদিক ওদিক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে সাদার্ন অ্যাভিনুর কাছাকাছি এসে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দেওয়া হল।
রাত তখন প্রায় সাড়ে নটা।
কিরীটী লেকের দিকে হাঁটতে শুরু করল। আমিও ওকে অনুসরণ করলাম।
এতক্ষণ কিরীটী একটি কথাও বলে নি। একেবারে চুপ ছিল। লেকের দিকে হাঁটতে হাঁটতে এতক্ষণে কথা বলল, মিস শকুন্তলা চৌধুরীর কথা যদি সত্যই হয় সুব্রত তাহলে বলবতার পক্ষে ঐ রাঘব সরকারকে এড়ানো সত্যিই কঠিন হবে।
কঠিন হবে।
নিশ্চয়ই। বুঝতে পারলি না লোকটাকে দেখে, ওর কথাবার্তা শুনে—সত্যি সত্যিই একটি খাঁটি রাঘব বোয়াল লোক। গ্রাস যখন করে সম্পূর্ণভাবেই গ্রাস করে ও-জাতের লোকগুলো।
তুই কি রাঘব সরকারকে স্রেফ দেখবার জন্যই ইকনমিক জুয়েলার্সে গিয়েছিলি নাকি কিরীটী? প্রশ্নটা না করে পারি না।
শুধু দেখবার জন্যে হবে কেন?
তবে?
আরো প্রয়োজন ছিল।
কি শুনি?
প্রথমতঃ মিস্ চৌধুরীকে আসতে বলেছি যখন—জানা তো আমার প্রয়োজন সত্যিই তাকে সাহায্য করা শেষ পর্যন্ত আমার পক্ষে সম্ভবপর কিনা!
হ্যাঁ, তা তো বটেই।
কি বললি?
না, বিশেষ কিছু না। এই বলছিলাম—
কি?
সুন্দর মুখের জয় তো সর্বত্রই।
আজ্ঞে না।
আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকবার চেষ্টা কেন বন্ধু!
মাছ যে শাক দিয়ে ঢাকা যায় না তুইও যেমন জানিস আমিও জানি।
সত্যি বলছিস?
হ্যাঁ। সত্যিকারের রহস্যের ইঙ্গিত না পেলে ইকনমিক জুয়েলার্সে রাঘব সরকারকে দেখবার জন্য আর যেই যাক—কিরীটী রায় যেত না।
রহস্যের ইঙ্গিত? মানে তুই সেনরায়কে সেদিন যে কথা বলছিলি—
যাক সে কথা, তোর কেমন লাগল রাঘব সরকার লোকটাকে বল্?
বুদ্ধিমান নিঃসন্দেহে। কিন্তু—
সত্যি সত্যি লোকটার সঙ্গে কেন দেখা করতে গিয়েছিলি বল্ তো!
দেখতে গিয়েছিলাম শ্রীমান দুষ্মন্তর প্রতিদ্বন্দ্বীটি কি ধরনের—
সত্যিই কি তাই?
তা ছাড়া আর কি!
তা কি বুঝলি?
বুঝলাম, লোকটা সত্যিকারের ধনী আর—
আর?
আর সত্যিই যদি হাত বাড়িয়ে থাকে ও শকুন্তলার দিকে, তাকে সে করায়ত্ত করবেই। তাছাড়া আরো একটা কথা নিশ্চয়ই তোর মনে আছে সুব্রত–
কি?
শকুন্তলার কাকা ঐ রাঘব সরকারকে ঘৃণা করা সত্ত্বেও শকুন্তলাকে বলেছেন ওকেই নাকি বিয়ে করতে হবে তাকে।
হ্যাঁ, মনে পড়ছে বটে।
অথচ বিমল চৌধুরী—মানে শকুন্তলার কাকা অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকলেও তাকে আমি জানি।
জানিস তুই ভদ্রলোককে?
জানি। অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হচ্ছেন সেই শ্রেণীরই একজন যারা পাব্লিক-এর চোখে একজন চিহ্নিত হয়ে দাঁড়াবার জন্য একটার পর একটা চেষ্টাই করে এসেছেন কিন্তু নেভার বিন সাকসিডেড়! কৃতকার্য হতে পারেন নি। হতাশের দলে—ডিফিটেড-এর দলে এবং তারা হাতের কাছে কোন সুযোগ পেলে যেমন ছাড়তে পারেন না তেমনি সেই সুযোগের জন্য তাঁরা অনেক কিছুই বিসর্জন দিতে পারেন। আর রাঘব সরকার হচ্ছে সেই শ্রেণীর একজন–যাঁরা ঐ ধরনের সুযোগের বেচা-কেনা করে উচিত মূল্য পেলে
কি বলছিস তুই কিরীটী?
ঠিক ঐ কথাটাই বলতে চেয়েছি আমি, অর্থাৎ রাঘব সরকারের যদি সত্যিই লোভ হয়ে থাকে শকুন্তলার ওপরে—অনন্যোপায় বিমল চৌধুরীকে তা মেনে নিতেই হবে।
.
০৪.
কিরীটী পথ চলতে চলতেই বলতে লাগল, কিন্তু আমি ভাবছি এখনো মিস শকুন্তলা চৌধুরী আমার কাছে আগমনের তার সত্যিকারের কারণটা কেন শেষ পর্যন্ত বলতে পারল না!
কেন, সে তো বললেই, বিয়েটা কোনমতে বাধা দেওয়া যায় কিনা তাদের—
আদৌ না। সে তুই বুঝবি না। তুচ্ছ কারণে সে আমার কাছে আসে নি।
তবে?
সে এসেছিল সত্যিকারের কোন বিপদের আভাস পেয়ে—
বিপদের!
হ্যাঁ, কিন্তু কথাটা আমাকে শেষ পর্যন্ত যে কোন কারণেই হোক বলতে পারে নি।
তবে?
অবিশ্যি বিয়ের ব্যাপারটাও একটা কারণ ছিল। কিন্তু তার পশ্চাতে নিশ্চয়ই ছিল আরো একটা গুরুতর কারণ—যেজন্য সে ছুটে এসেছিল আমার কাছে।
কিন্তু–
কিরীটীর দিক থেকে আর কোন সাড়া পাওয়া গেল না। কথা বলতে বলতে হঠাৎ যেন সে চুপ করে গেল। পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে সেটায় অগ্নিসংযোগ করে পুনরায় হাঁটতে লাগল।
লেকের ভিতর দিয়ে আমরা শর্টকার্ট করছিলাম।
লেকটা ইতিমধ্যেই নির্জন হয়ে গিয়েছে। ভ্রমণকারী ও বায়ুসেবীর দল অনেক আগেই চলে গিয়েছে। কদাচিৎ এক-আধজনকে চোখে পড়ছিল। অদ্ভুত একটা শান্ত স্তব্ধতা যেন চারিদিকে ঘনিয়ে উঠেছে।
কৃষ্ণপক্ষের রাত। কালো আকাশে কেবল তারাগুলো পিটপিট করে জ্বলছে।
কিরীটীর নাম ধরে একবার ডাকলামও, কিন্তু কোন সাড়া দিল না কিরীটী, যেমন হেঁটে চলছিল তেমনই হেঁটে চলতে লাগল। কোন একটা চিন্তা চলেছে কিরীটীর মনের মধ্যে। বরাবর দেখেছি মনের ঐ অবস্থায় কখনো সে কথা বলে না।
অগত্যা আমিও ওর পাশে পাশে হেঁটে চললাম।
বোধহয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলাম হঠাৎ কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ল, সুব্রত—
অ্যাঁ! কিছু বলছিলি?
হুঁ, বলছিলাম ভবিকে ভোলাতে পারি নি। নিম্নকণ্ঠে কথাগুলো বলল কিরীটী।
কি বললি?
রাঘব সরকারের লোক আমাদের ফলো করছে—
সে কি!
হ্যাঁ—পিছনে ফিরে দেখ—
সত্যিই ফিরে তাকিয়ে দেখলাম, আমাদের হাত-পনের দূরে একটা মূর্তি অদূরবর্তী লাইট পোস্টটার নীচে দাঁড়িয়ে।
ঠিক আছে, এক কাজ করা যাক, সামনেই টিপু সুলতান রোডে অমিয় চক্রবর্তী থাকে। এককালে এম-এস-সি ক্লাসে পরিচয় হয়েছিল—চল–
কিরীটী কথাটা বলেই হঠাৎ চলার গতি যেন বাড়িয়ে দিল।
সে-রাত্রে টিপু সুলতান রোডে অমিয়র ওখানে ঘণ্টা-দুই কাটিয়ে কিরীটীর বাসায় যখন ফিরে এলাম রাত তখন সাড়ে এগারোটা।
.
কিরীটীর অনুমানটা অর্থাৎ শকুন্তলা চৌধুরী তার কাছে আসার ব্যাপারটার মধ্যে যে সত্যিই কোনো গুরুতর কারণ ছিল সেটা প্রমাণিত হতে কিন্তু খুব বেশী দেরি হল না। চব্বিশ ঘণ্টাও পুরো অতিবাহিত হল না।
পরের দিন রাত তখন ন টা হবে, নিত্যকার মত কিরীটীর গৃহে বসে বিকেল থেকে আড্ডা দিতে দিতে রাত নটা যে বেজে গিয়েছে টের পাই নি।
আরো একটা ব্যাপার নজরে পড়েছিল, আড্ডা দিলেও কিরীটী যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক। এবং ব্যাপারটা একা আমারই নজরে পড়ে নি, কৃষ্ণাও লক্ষ্য করেছিল, কৃষ্ণার কথাতেই সেটা একসময় ধরা পড়ল।
কথার মাঝখানে হঠাৎ একসময় কৃষ্ণা বললে, সেই সকাল থেকে লক্ষ্য করছি কেমন যেন অন্যমনস্ক তুমি, কি ভাবছ বল তো?
কিরীটী তার ওপ্রান্ত থেকে অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা হাতে নিয়ে সিগারেটের অগ্রভাগ থেকে অ্যাসট্রেতে ছাইটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, সত্যিই ভাবছি একটা কথা কৃষ্ণা কাল থেকে।
আমরা দুজনেই ওর মুখের দিকে যুগপৎ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম।
কৃষ্ণা শুধাল, কি?
অভিজ্ঞান শকুন্তলম্–
সে আবার কি? প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল কৃষ্ণা।
শকুন্তলার হাতের হারানো আংটিটা খুঁজে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলাকে চিনতে পেরেছিল যদিও সেটা নাটকীয়–কিন্তু–
কি?
কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম না কেন গত সন্ধ্যায় এ যুগের শকুন্তলা দেবীর মনের কথাটা! কেন ধরতে পারলাম না!
কালকেই সেই মেয়েটার কথাই ভাবছিস নাকি?
হ্যাঁ। শকুন্তলা কেন এসেছিল আমার কাছে? আর যদি এসেছিলই তো আসল কথাটা বলতে পারল না কেন? কি ছিল তার মনে?
কি আবার থাকবে?
তাই তো ভাবছি। তার সারা মুখে যে আশঙ্কার দুর্ভাবনার ছায়াটা দেখেছিলাম সে তো মিথ্যা নয়। শি মাস্ট–ইয়েস—শি মাস্ট—অ্যান্টিসিপেটেড সামথিং! ভয়ের কালো ছায়া সে দেখেছিল—ভয়–
কথাটা কিরীটীর শেষ হল না, ক্রিং ক্রিং করে ঘরের কোণে টেলিফোনটা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে যেন তড়িৎবেগে কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং ফোনের দিকে যেতে যেতে নিম্নকণ্ঠে বলে, নিশ্চয়ই শকুন্তলা–
ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল কিরীটী, হ্যালো! হা হ্যাঁ, কিরীটী রায় কথা বলছি। কে শকুন্তলা দেবী? হা হ্যাঁ—আই ওয়াজ সো লং এক্সপেকটিং ইউ! কি-কি বললেন, আপনার কাকা মারা গেছেন! হ্যাঁ, হ্যাঁ—যাবো, নিশ্চয়ই যাবো–আচ্ছা—ফোনটা রেখে দিল কিরীটী।
তারপর ফোনগাইড দেখে একটা নাম্বারে ফোন করল, কে—শিবেন? হ্যাঁ, আমি কিরীটী রায় কথা বলছি-বেলগাছিয়া তো তোমারই আণ্ডারে, তাই না? শোন—ঠিক ট্রাম ডিপোর পিছনে নতুন যে বাড়িগুলো হয়েছে—তারই একটা বাড়ি-নম্বর হচ্ছে পি ৬/১, অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর বাড়ি—অধ্যাপক চৌধুরী,—হ্যাঁ, প্রবাবলি হি হ্যাজবিন কিল্ড! হ্যাঁ-হ্যাঁ— যাও–কি বললে—হ্যাঁ-হ্যাঁ–যাও। হ্যাঁ আমি আসছি, দেখা হলে সব বলব।
কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
কি ব্যাপার?
শুনলে তো শিবেন সোম থানা-ইনচার্জকে কি বললাম! অধ্যাপক বিমল চৌধুরী হ্যাজবিন কিল্ড।
সত্যিই?
আমার অনুমান তাই।
কে ফোন করছিল, শকুন্তলা চৌধুরী?
হ্যাঁ। কথাটা বলে কিরীটী গিয়ে ভিতরের ঘরে প্রবেশ করল। বুঝলাম সে প্রস্তুত হবার জন্যই ভিতরে গেল।
এতটুকুও আর বিলম্ব করবে না। এখুনি বেরুবে।
.
আমি ভাবছিলাম ব্যাপারটা সত্যি সত্যিই তাহলে যাকে বলে ঘনীভূত হয়ে উঠল।
মনে পড়ল ঐ সঙ্গে, আজই অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর জন্মতিথি উৎসব ছিল। শকুন্তলা গতকাল বলে গিয়েছিল অধ্যাপকের জীবনের ঐ দিনটি বিশেষভাবে পালিত হয়। অতিথি, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের দল সব ঐ দিনটিতে আসেন বিমল চৌধুরীকে শুভকামনা জানাবার জন্য।
আজও নিশ্চয়ই এসেছিল সবাই এবং যা বোঝা গেল সেই উৎসবের ও আনন্দের মধ্যেই অকস্মাৎ মৃত্যুর কালো ছায়া নেমে এসেছে। আনন্দরস মৃত্যু-বেদনায় নীল হয়ে গিয়েছে।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে সম্বিৎ ফিরে এল, চল সুব্রত, একবার ঘুরে আসা যাক।
মনটা ইতিমধ্যে আমারও বুঝি কিরীটীর সঙ্গে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, চল–
বিমল চৌধুরীর বাড়িটা খুঁজে পেতে আমাদের দেরি হয় নি। বাড়ির সামনেই পরিচিত কালো পুলিসভ্যান দাঁড়িয়েছিল এবং দুজন লালপাগড়ি দরজার গোড়ায় প্রহরায় ছিল।
বাড়িটা নতুন নয়। পুরাতন দোতলা বাড়ি। সামনে কিছুটা জায়গা জুড়ে বাগানের মত। নানা জাতীয় ফল ও ফুলের সব গাছ।
পরে জেনেছিলাম দীর্ঘদিন ভাড়াটে হিসেবে থেকে মাত্র বছর তিনেক পূর্বে কিনে নিয়েছিলেন অধ্যাপক বাড়িটা।
সেকালের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। দীর্ঘদিনের সংস্কারের অভাবে কেমন যেন একটা জীর্ণতার ছাপ পড়েছে বাড়িটার গায়ে। সামনেই একটা টানা বারান্দা। মোটা মোটা পাথরের কাজকরা সেকেলে থাম। বারান্দাটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি ভাবে উত্তর থেকে পশ্চিমে ঘুরে গিয়েছে। বাড়িটার পিছনদিকে একটা দীঘি ও নারিকেল গাছ। তার ওদিকে খোলা মাঠ। অর্থাৎ সামনের দিকে শহর আর পিছনে গ্রাম।
উপরে ও নিচে খান-আষ্টেক ঘর। বেশ বড় সাইজের ঘরগুলি। পশ্চিম দিক থেকে চওড়া সেকেলে বেলোয়ারী কাচের রঙিন টুকরো বসানো সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষপ্রান্তে নীচের তলার মতই বারান্দা।
দোতলায় পিছনের দিকে প্রশস্ত একটি খোলা ছাদ। সেই ছাদেই সামিয়ানা খাটিয়ে ও চেয়ার টেবিল পেতে অতিথিদের অভ্যর্থনার আয়োজন হয়েছিল।
এবং জলখাবারের ব্যবস্থা হয়েছিল নীচের হলঘরে।
.
নীচের তলায়ই শিবেন সোমের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রথমে কিরীটীর মুখে নামটা শুনে ভদ্রলোকের চেহারাটা মনে করতে পারি নি।
কিন্তু সামনাসামনি দেখা হতেই মনে পড়ে গেল, বছর চারেক পূর্বে একটা আফিম চোরাইয়ের তদন্তের ব্যাপারে কিরীটীর ওখানেই ভদ্রলোকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আমার। ভদ্রলোক, শিবেনবাবু আমাদের বয়সীই হবেন। তবে বয়সের অনুপাতে একটু যেন বেশী বুড়িয়ে পড়েছেন—গাল কুঁচকে গিয়েছে, কপালে ভাঁজ পড়েছে, মাথার চুল বেশীর ভাগই পেকে গিয়েছে।
এসো এসো কিরীটী, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম, আহ্বান জানালেন শিবেন সোম।
কিছু জানতে পারলে সোম?
না, এখনো সরেজমিন তদন্তই করি নি। ডেড় বডিটা দেখেছি আর ব্যাপারটা মোটামুটি শুনেছি।
কি শুনলে?
যতটুকু শুনেছি ও দেখেশুনে যা মনে হচ্ছে—
কি?
সেরকম কিছু নয়। ন্যাচারাল ডেথ-স্বাভাবিক মৃত্যু বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া শুনলামও, ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ রক্ত-চাপাধিক্যে নাকি ভুগছিলেন।
কিরীটী ঐ কথার কোন উত্তর না দিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করল, কিন্তু বাড়িটা যেন কেমন চুপচাপ মনে হচ্ছে! নিমন্ত্রিতরা সব চলে গিয়েছেন নাকি?
হ্যাঁ, বেশীর ভাগই চলে গিয়েছেন। সামান্য চার-পাঁচজন আছেন, কিন্তু এখানে যে অনেক নিমন্ত্রিত আজ উপস্থিত ছিলেন তুমি জানলে কি করে?
কথাটা বলে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে শিবেন সোম কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।
ওঁর ভাইঝি—মানে অধ্যাপকের ভাইঝি যে গত সন্ধ্যায় আমার ওখানে গিয়েছিলেন, তার মুখেই শুনেছিলাম আজকের উৎসবের কথাটা।
কে, মিস্ শকুন্তলা চৌধুরী?
হ্যাঁ।
ওঃ, তা তোমার সঙ্গে মিস্ চৌধুরীর পূর্ব-পরিচয় ছিল নাকি?
না। গতকালই প্রথম তাকে দেখি ও প্রথম পরিচয়।
কি রকম?
কিরীটী সংক্ষেপে তখন গত সন্ধ্যার ব্যাপারটা খুলে বলল, কেবল ইকনমিক জুয়েলার্সে হানা দেবার কথাটা বাদ দিয়ে।
আই সী! তাহলে তুমি কি মনে কর–
কি?
ঐ দুষ্মন্তবাবুই—মানে ঐ দুষ্মন্ত রায়ই—
তিনি আসেন নি?
এসেছেন, তবে ঘটনার সময় তিনি ছিলেন না, পরে এসেছেন—
পরে? কখন?
আমি আসার মিনিট কয়েক আগে শুনলাম এসেছেন।
এখনো আছেন নিশ্চয়?
আছেন। কেউই যান নি ঐ ঘটনার পর।
আর কে কে আছেন?
বিমলবাবুর এক সতীর্থ সুধীর চক্রবর্তী, ওঁর এক ভাগ্নে রঞ্জন বোস, এই পাড়ারই এক রিটায়ার্ড জজ মহেন্দ্র সান্যাল, ইকনমিক জুয়েলার্সের মালিক রাঘব সরকার–
আর?
বিমলবাবুর ছেলেবেলার এক বন্ধু–বিনায়ক সেন।
কতক্ষণ আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে?
তা ধরো ঘণ্টা দুই হবে।
হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিরীটী বললে, এখন সোয়া দশটা। তাহলে আটটা পঁয়তাল্লিশের মত সময়ে–
ঐ রকমই হবে—ওঁরা বলছিলেন—
কে–কে বলছিলেন?
শকুন্তলা দেবী।
তিনি কোথায়?
উপরে তার ঘরে।
মৃতদেহ কোথায় পাওয়া গিয়েছে?
তাঁর নিজের ঘরে। বিমলবাবুর বেডরুমেই।
নিজের শোবার ঘরে?
হ্যাঁ, তার শয়নঘরে আরামকেদারাটার উপরে শায়িত অবস্থায়।
মৃতদেহ নিশ্চয়ই ডিসটার্ব করা হয় নি?
না, ঠিক যেমনটি ছিল তেমনটিই আছে।
ভদ্রলোকের তাহলে স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে, তাই তোমার ধারণা সোম?
সেই রকমই তো মনে হয়। তাছাড়া তো শুনলে ভদ্রলোক কিছুদিন যাবৎ হাইপারটেনসনে ভুগছিলেন, তাতেই মনে হয় সাডেন স্ট্রোক-এ-
হতে পারে অবিশ্যি, অসম্ভব কিছু নয়। তা ডাক্তার ডাকা হয়েছিল?
আমি এসে ডাক্তারকে আসবার জন্য ফোন করেছি।
মানে এঁরা করেন নি?
না। এভরিওয়ান ওয়াজ সো ননপ্লাস!
.
০৫.
আশ্চর্য, এখনো ডাক্তারই একজন ডাকা হয় নি! কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই কথাটা উচ্চারণ করে কিরীটী।
না, হয় নি—তাছাড়া মাত্র তো ঘণ্টাখানেক আগে ব্যাপারটা জানা গিয়েছে, সোম বললেন।
ওঁর মৃত্যুর ব্যাপারটা প্রথমে কার নজরে পড়ে সোম এ-বাড়িতে?
এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরাতন ঝি সরমা। সে-ই সর্বপ্রথমে নাকি ব্যাপারটা জানতে পারে, সোম বললেন।
ঠিক ঐ সময় বাইরে একটা গাড়ি থামার শব্দ শোনা গেল।
বোধহয় ডাক্তারবাবু এলেন কিরীটী, সোম বললেন, তুমি একটু অপেক্ষা করো, আমি দেখে আসি।
কথাটা বলে সোম ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
থানা অফিসার শিবেন সোমের অনুমান মিথ্যা নয়, একটু পরে এক প্রৌঢ় ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে সোম এসে ঘরে ঢুকলেন।
ডাক্তার কথা বলতে বলতে এসে ঘরে ঢুকলেন, শুনে হয়ত আশ্চর্য হবেন, আমি ঘণ্টাদেড়েক আগে একবার একটা ফোনে কল পেয়েছিলাম। এই বাড়ি থেকেই কেউ ফোন করেছিল, অধ্যাপককে তাড়াতাড়ি একটিবার দেখে যাবার জন্য। কিন্তু অন্য এক জায়গায় জরুরী একটা কল পেয়ে আমি তখন বেরুচ্ছি, তাই দেরি হয়ে গেল—
সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী যেন বাধা দিয়ে তাকে প্রশ্ন করে, কি বললেন ডাক্তার? ঘণ্টা দেড়েক আগে ফোন করেছিল, এ-বাড়ি থেকে আপনাকে কেউ?
হ্যাঁ।
কে? নাম বলে নি?
নাম! না বলে নি—আর তাড়াতাড়িতে আমিও জিজ্ঞাসা করি নি—
আপনাকে ফোন করেছিল পুরুষ না মেয়ে?
স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর মনে আছে আমার।
স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর?
হ্যাঁ।
এ বাড়ির সঙ্গে কি আপনার কোন পূর্ব-পরিচয় ছিল ডাক্তারবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
জবাব দিলেন থানা-অফিসার শিবেন সোম, হ্যাঁ, ডাঃ ঘোষ তো এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান। মিস চৌধুরীর মুখে ওঁর নাম শুনে তাই তো ওঁকেই আমি ফোন করেছিলাম–
আপনি এ বাড়ির ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান তাহলে ডাঃ ঘোষ?
হ্যাঁ।
কতদিন এঁদের সঙ্গে আপনার পরিচয়?
তা বছর বারো-তেরো তো হবেই—এ পাড়ায় আমি আসা অবধি ওঁরা আমার পেসেন্ট।
তাহলে তো খুব ভালই হল, অধ্যাপকের স্বাস্থ্য সম্পর্কে আপনি ডিটেলস্ খবর দিতে পারবেন! কিরীটী বলে।
তা পারব বৈকি। কিন্তু তার আগে একবার বিমলবাবুকে—
হ্যাঁ দেখবেন বৈকি, চলুন—সোম বললেন।
অতঃপর সকলে আমরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলার দিকে অগ্রসর হলাম।
সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই কিরীটী ডাঃ ঘোষকে পুনরায় প্রশ্ন করে, ডাঃ ঘোষ, বিমলবাবু রক্তচাপে ভুগছিলেন শুনলাম–
হ্যাঁ, বেশ কিছুদিন ধরে ভুগছিলেন।
রক্তচাপ কি খুব বেশী হয়েছিল?
তা একটু বেশীই ছিল—
ওষুধ খেতেন না উনি?
মধ্যে মধ্যে খেতেন, তবে—
তবে?
রেগুলার কোন ওষুধ খেতেন না।
কেন?
কারণ প্রেসারটা ফ্লাকচুয়েট করত—
ভদ্রলোকের মেজাজ কেমন ছিল?
খুব কুল ব্রেনের লোক ছিলেন।
কিন্তু সাধারণত শুনেছি রক্তচাপাধিক্যে যাঁরা ভোগেন তারা একটু রগচটা প্রকৃতির হন। কিরীটী সহসা প্রশ্ন করে।
না, সে-রকম বড় একটা তাকে মনে হয় নি কখনন, ডাঃ ঘোষ বললেন, এবং শুধু তাই নয়, রাগারাগি চটাচটি বিশেষ তিনি পছন্দ করতেন না এমনও শুনেছি।
আচ্ছা ডাঃ ঘোষ—
বলুন?
বিমলবাবুর শেষ ব্লাডপ্রেসার কবে নিয়েছিলেন, কিছু মনে আছে?
থাকবে না কেন—মাত্র দিন চারেক আগেই তো নিয়েছি।
আপনি মধ্যে মধ্যে নিশ্চয়ই এসে বিমলবাবুর ব্লাডপ্রেসারটা পরীক্ষা করে যেতেন।
না, প্রেসার নেওয়াটা তিনি বিশেষ পছন্দ করতেন না। তবে সেদিন তিনি নিজেই আমাকে ফোন করে ডেকেছিলেন—
কেন?
কিছুদিন থেকে মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছিল তাই—
তার কোন কারণ ঘটেছিল কি?
ঠিক বলতে পারি না, অত্যন্ত চাপা প্রকৃতির লোক ছিলেন তো। তবে–
তবে?
তবে সেদিন তাঁকে দেখে মনে হয়েছিল মনের মধ্যে যেন কিছু একটা দুশ্চিন্তা চলেছে, কেমন যেন একটু বিশেষ আপসেট-বিচলিত মনে হয়েছিল তাকে।
বিচলিত হবার মত কোন কারণ–
না, আমিও জিজ্ঞাসা করি নি তিনিও বলেন নি।
.
দোতলায় যে ঘরের মধ্যে মৃতদেহ ছিল আমরা এসে সেই ঘরের দরজা ঠেলে প্রবেশ করলাম—ডাঃ ঘোষ, থানা-অফিসার শিবেন সোম, কিরীটী ও আমি।
ঘরটা বেশ বড় আকারেরই, দক্ষিণ-পূবমুখী।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে দক্ষিণমুখী এগুলে প্রথম দরজাটা দিয়েই সেই ঘরে প্রবেশ করতে হয়। দরজাটা ভেজানো ছিল এবং দ্বারে একজন লালপাগড়ী মোতায়েন ছিল।
ভিতরে প্রবেশ করে কিরীটী দাঁড়িয়ে গেল। ঘরের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে একটা বেতের আর্মচেয়ারে শোয়া অবস্থায় ছিল মৃতদেহ।
হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন ভদ্রলোক চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। নিমীলিত চক্ষু। একটি হাত বুকের উপরে ন্যস্ত, অন্য হাতটি বামপাশে ঝুলছে অসহায় ভাবে। পরিধানে গরদের পাঞ্জাবি ও দামী শান্তিপুরী ধুতি। সামনেই এক জোড়া কটকী চটি পড়ে আছে।
সামনে ত্রিপয়ের উপর সেদিনকার সংবাদপত্র ও একটি গোল্ড ফ্লেকের সিগারেট টিন, দেশলাই ও চিনামাটির একটি অ্যাশট্রে।
ঘরের উত্তরদিকে দুটি প্রমাণ সাইজের কাঠের আলমারি। একটির পাল্লায় আয়না বসানোঅন্যটিতে বই ঠাসা, কাচের পাল্লা দেওয়া।
ঘরের মধ্যে প্রবেশের তিনটি দরজা, তার মধ্যে উত্তরদিকের ঘরের মধ্যবর্তী দরজাটি বন্ধ ছিল এবং বাথরুমে যাবার দরজাটি ও অন্য দরজাটি খোলাই ছিল।
দক্ষিণমুখী তিনটি জানালাই খোলা ছিল। জানালায় পর্দা দেওয়া।
দক্ষিণ দিক ঘেঁষে জানালা বরাবর খাটের উপরে শয্যা বিস্তৃত। তার পাশে একটি বুকসেলফ। সেলফ-ভর্তি বই।
শয়নঘরটি যে কোন অধ্যাপকের দেখলেই বোঝা যায়।
দেখলাম কিরীটী বেশ কিছুক্ষণ ঘরের চারিদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে এক সময় এগিয়ে গেল মৃতদেহের দিকে।
ইতিমধ্যে ডাক্তার ঘোষের মৃতদেহ পরীক্ষা করা হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাক্তার ঘোষকে প্রশ্ন করে, কি মনে হয় ডাক্তার ঘোষ? ডেথ ডিউ টু থম্বসিস বলেই কি মনে হয়?
শান্ত মৃদুকণ্ঠে না শব্দটি উচ্চারণ করলেন ডাঃ ঘোষ। এবং সঙ্গে সঙ্গে শিবেন সোম ও আমি ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকালাম।
কিরীটী কিন্তু তাকায় নি। বরং দেখলাম, প্রশ্নটা করে সে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে যেন মৃতের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
ডাক্তার ঘোষের কথাটা তার কানে গিয়েছিল কিনা বুঝতে পারলাম না। কারণ একটু পরেই দেখি সে মৃতদেহের একেবারে সামনাসামনি এগিয়ে গিয়ে মৃতের মুখের কাছে একেবারে ঝুঁকে পড়ে কি যেন তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে লক্ষ্য করছে এবং দেখতে দেখতেই পকেট থেকে একটা লেন্স বের করে সেই লেন্সের সাহায্যে মৃতের মুখের উপরে কি যেন পরীক্ষা করতে লাগল।
তারপর একসময় লেন্সটা পকেটে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং এতক্ষণে কথা বলল, ইয়েস, আই এগ্রি উইথ ইউ ডাক্তার ঘোষ—আপনার সঙ্গে আমি একমত। এবং ইফ আই অ্যাম নট রং—আমার অনুমান যদি ভুল না হয়ে থাকে তো-ডাক্তার ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়ে কিরীটী তার কথাটা শেষ করল, ওঁর মৃত্যু ঘটেছে কোন ত্বরিৎক্রিয়াশীল বিষে–
কি বললি কিরীটী? প্রশ্ন করলাম আমিই।
হ্যাঁ, বিষ সুব্রত! কোন বিষের ক্রিয়াতেই ওঁর মৃত্যু ঘটেছে এবং সে বিষ তার অজ্ঞাতে খুনী প্রয়োগ করেছিল বলেই বোধ হয়—অর্থাৎ বিষপ্রয়োগের পূর্বে ওঁকে ক্লোরোফর্মের সাহায্যে খুব সম্ভব ঘুম পাড়ানো হয়েছিল—
ক্লোরোফর্ম! প্রশ্ন করলেন শিবেন সোম।
হ্যাঁ শিবেন, ভাল করে লক্ষ্য করে দেখো—ওঁর নাকের ডগায় কয়েকটি রক্তাভ বিন্দু আছে—
রক্তাভ বিন্দু!
হ্যাঁ, রুমালে বা কাপড়ে ক্লোরোফর্ম ঢেলে ওঁর নাকের ওপর হয়তো চেপে ধরা হয়েছিল, যার ফলে উনি জ্ঞান হারান। তারপর কোন তীব্র বিষ—
কিন্তু–
অবিশ্যি সঠিক কিভাবে কি ঘটেছে সেটা তদন্ত ও বিশ্লেষণ সাপেক্ষ, এই মুহূর্তেই সব কিছু তোমাকে আমি পরিষ্কার করে বলতে পারব না—সেটা সম্ভবপরও নয়। তবে ব্যাপারটা যে সাধারণ ও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, এমন কি আত্মহত্যাও নয়, সেইটুকুই বর্তমানে বলতে পারি।
মানে?
মানে বিমলবাবুকে হত্যা করা হয়েছে।
হত্যা!
আমার তাই ধারণা, কিন্তু একটা কিসের শব্দ পাচ্ছি যেন! কিরীটীর শ্রবণেন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে।
বলা বাহুল্য সেই সঙ্গে আমাদের সকলেরই।
এতক্ষণ শব্দটা কানে প্রবেশ করে নি, কিন্তু কিরীটী কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শব্দটা ঘরের মধ্যে উপস্থিত আমরা সকলেই যেন শুনতে পেলাম।
বাথরুমের দরজাটা ভেজানোই ছিল তবে সামান্য ফঁক হয়ে ছিল, কিরীটী বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমিও।
দরজাটা হাত দিয়ে ঠেলে খুলে দিতেই শব্দের উৎসটা পরিষ্কার হয়ে গেল। বাথরুমের মধ্যে বেসিনের ট্যাপটা খোলা রয়েছে এবং বাথরুমের আলোটা জ্বলছে।
সেই ট্যাপ দিয়ে জল পড়ার শব্দটা আমাদের কানে এসেছিল।
কিরীটী থমকে দাঁড়ায়। পাশেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি।
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে ডাকল, সুব্রত!
কি?
একটা তীব্র অথচ মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছিস!
গন্ধটা আমার নাকে প্রবেশ করেছিল এবং আমার পশ্চাতে দণ্ডায়মান শিবেন সোমের নাসারন্ধ্রেও প্রবেশ করেছিল।
তিনিই জবাব দিলেন, হুঁ, পাচ্ছি—
কিসের গন্ধ বলে মনে হচ্ছে বল তো শিবেন?
ঠিক বুঝতে পারছি না—
আমিও না। কথাটা বলে নাক দিয়ে টেনে টেনে গন্ধটা বোঝবার চেষ্টা করে কিরীটী কয়েকবার এবং তারপরই হঠাৎ একসময় বলে ওঠে, হ্যাঁ পেরেছি–ক্লোরোফর্ম–
ঠিক-ঠিক।
ইতিমধ্যে বেসিনের কাছেই একটা টার্কিশ টাওয়েল পড়ে ছিল, কিরীটী এগিয়ে গিয়ে নীচু হয়ে সেটা মাটি থেকে তুলে নিল।