অমর নেতাজি
“নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস” এই নামটা ছিল তৎকালীন ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের সমগ্র মুক্তিকামী জনগণের সমবেত কন্ঠস্বর। শুধু ভারত নয় সমস্ত বিশ্বের সশস্ত্র আন্দোলনের ইতিহাসে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। আজাদ হিন্দ ফৌজের সুদক্ষ পরিচালনা থেকে শুরু করে ছদ্মবেশে ব্রিটিশের চোখে বার বার ধুলো দেওয়া, সাবমেরিনে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া, সব কাজেই তিনি অসম্ভব দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তার মত দুঃসাহিক স্বাধীনতা সংগ্রামী পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তিনি সকল ভারতবাসীর কাছে একটাই জিনিস চেয়ে ছিলেন- “রক্ত”। রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা।তিনি বুঝেছিলেন গান্ধীজির অহিংস নীতিতে ভারত স্বাধীন হবে না। এখানে থেকেই তার সাথে গান্ধীজির মত বিরোধ হতে থাকে। তার এক ডাকে শত শত ভারতবাসী হেলায় প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল। এহেন মহান ব্যক্তিত্বের জীবনের শেষ দিকটা অজানা থেকে গেছে। অনেকে মনে করে বিমান দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল। যদিও আমাদের কাছে তিনি মৃত্যুঞ্জয়।আমরা এটাই বিশ্বাস করি এমন মানুষের মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের মনের মণিকোঠায় ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবেন।
সুভাষ চন্দ্র বসু১৮৯৭সনের ২৩শে জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত বাংলা প্রদেশের উড়িষ্যা বিভাগের কটকে(অধুনা ভারতবর্ষের ওড়িশা রাজ্যের কটক শহর) জন্মগ্রহন করেন। তার বাবা জানকীনাথ বসু ছিলেন একজন সফল সরকারি আইনজীবী। তাদের পৈতৃক নিবাস ছিল ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার কোদালিয়া গ্রামে। কর্মসুত্রে কটকে থাকার কারণে তিনি তার সন্তানদের কটকের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করেন। ১৯০২ সালে সুভাষ তার অগ্রজদের সাথে কটকের প্রোটেস্ট্যান্ট ইউরোপীয় স্কুলে ভর্তি হন। সেখানে শিক্ষাদানের মাধ্যম ছিল শুধুমাত্র ইংরেজি।ভারতীয় কোনো ভাষা সেখানে শেখানো হতো না। এই বিদ্যালয় সুভাষের পিতার পছন্দের ছিল।তিনি চাইতেন তার ছেলেরা যেন ইউরোপীয়দের মতো আদপ কায়দা,নিয়মানুবর্তিতা শিখে নির্দ্বিধায় নির্ভুল ইংরেজি বলতে পারে। তবে তিনি ইংরেজির সাথে সাথে বাংলা ভাষা শেখা ও সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। তিনি ১৯০৯ সালে সুভাষকে কটকের রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করে দেন। এখানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ও সংস্কৃতি ভাষাও শেখানো হতো। পড়াশোনায় বরাবরই কৃতি ছাত্র সুভাষ অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষাও অনায়াসেই শিখে ফেলল।এবং প্রথম বছর বাংলায় শ্রেণীর মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেল।এই স্কুলে পড়া কালিন তার মধ্যে জাতীয় চেতনা উদ্বুদ্ধ হয়। ছাত্রজীবন থেকেই তার মনে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে বিরাগ ভাব সৃষ্টি হয়েছিল,ক্রমে এই বিরাগ বিদ্বেষে পরিণত হয়। তিনি মনে করতেন মানুষের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ না থাকলে একজন মানুষ সঠিক মানুষ হতে পারে না।
সুভাষের বয়স তখন সবে ১৫ কি ১৬, এই সময় তার মনের মধ্যে এক তীব্র মানসিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এই দ্বন্দ্বটা ছিল জাগতিক এবং পার্থিব জীবনের মধ্যে সংশয়ে পরিপূর্ণ। এই সময় তিনি আকস্মিক ভাবে স্বামী বিবেকানন্দের রচনবলীর প্রতি আকৃষ্ট হন। বিবেকানন্দ চর্চা করে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, নিজের মুক্তির জন্য নয়,মানব সেবায় নিজের সত্তাকে সম্পূর্ণ ভাবে উৎসর্গ করতে হবে। প্রতিটা ভারতবাসীর কথা ভাবতে হবে।ভারত মা’কে শৃঙ্খল মুক্ত করতে হবে।
১৯১৩ খী: রাভেনশ কলেজিয়েট স্কুল থেকে সুভাষ বোস ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সসম্মানে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। এর পর তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসেন।এখানে এসে তিনি এমন কিছু ছাত্রদের সংস্পর্শে আসে যাদের মনে দেশ প্রেমের আগুন জ্বলছে। এরই মধ্যে ঋষি অরবিন্দের সাথে দেখা হওয়াটা সুভাষের জীবনকে অন্যদিকে চালিত করেছিল। অরবিন্দের ভাবধারা তাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মঞ্চ থেকে অরবিন্দ বামপন্থী চিন্তাধারা তুলে ধরেছিলেন। পূর্ন স্বাধীনতার দাবীও তুলেছিলেন। সুভাষ অরবিন্দকে পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নিলেন।
এর পর প্রেসিডেন্সি কলেজে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনায় সুভাষের জীবন আমূল পরিবর্তন হয়ে যায়। কলেজের ইরেজি বিভাগের অধ্যাপক ভারতবর্ষ ও ভারতীয়দের সম্পর্কে অপমানকর মন্তব্য করেন।ভারতীয় ছাত্ররা দাবী করে অধ্যাপককে এই ঘটনার জন্য ক্ষমা চাইতে হবে।কিন্তু তিনি তা করতে সম্মত হলেন না,তখন কলেজে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়,যার নেতৃত্ব দেন সুভাষ বোস।ফলে উনি কলেজ কতৃপক্ষের বিষ নজরে পড়ে যান। ঠিক এর পরের মাসে ওই অধ্যাপক একজন প্রথম বর্ষের ভারতীয় ছাত্রের গায় হাত তোলেন।এর প্রতিবাদে ছাত্ররা আইন হাতে তুলে নেয়। যদিও এই ঘটনায় সুভাষের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিলো না, তিনি শুধুমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন কিন্তু কলেজের তদন্তকমিটি সুভাষকেই দোষী সাব্যস্ত করে কলেজ থেকে বহিস্কার করে। সুভাষ বাধ্য হয়ে ফিরে আসে কটকে। এর একবছর পর ১৯১৭সালের জুলাই মাসে দর্শনে অনার্স নিয়ে স্কটিশচার্চ কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এবং১৯১৯ সালে দর্শনসাস্ত্রের অনার্স পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য স্কটিশচার্চ কলেজে পড়া কালিন তিনি ভারতরক্ষা বাহিনীর একটি শাখায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পান।এই সময় চার মাস সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং শিবির জীবন যাপন করেন।এই শিক্ষা, যা পরবর্তীতে তার কিছুটা হলেও কাজে এসেছিল।
ছাত্রজীবন শেষ করে সুভাষ এই পি এস পরীক্ষার জন্য ইংল্যান্ড গিয়েছিলেন। সেখানে সসম্মানে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পত্র হাতে পান।কিন্তু তার বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বদেশপ্রেমের কারণে তিনি সেই নিয়োগপত্র প্রত্যাখ্যান করেন। ফিরে এলেন স্বদেশে এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। এর অল্পদিনের মধ্যেই তিনি ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই মহত্মাগান্ধীর সাথে তার মতানৈক্য শুরু হয়ে যায়।ফলে ১৯৩৯সালের ২৯শে এপ্রিল তিনি জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে ইস্তফা দেন। এবং ঐ বছরই ৩রা মে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। সুভাষ বোস এই নবনির্মিত দলের সভাপতি পদ গ্রহণ করেন। এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪০ সালের জুন মাসে নাগপুরে দলের প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন হয়। এর পর পরই ১৯৪০সালের ২রা জুলাই নেতাজিকে গ্রেফতার করে কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি করা হয়। কিন্তু তিনি জেলে থাকা কালিন অনশন শুরু করেন, ফলে তাকে জেল থেকে মুক্ত করে গৃহবন্দী করে রাখা হয়।১৯৪১সালের জানুয়ারি মাসে তিনি তার দলের একজন সদস্যর সাহায্যে আফগানিস্তান দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে জার্মানি পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি প্রথমে বার্লিনে “ভারতীয় মুক্তকেন্দ্র” গড়ে তোলেন। ১৯৪৩সালে তিনি জার্মানি ত্যাগ করে একটা সাবমেরিন চেপে পৌঁছে যান জাপানে।সেই সময় জাপানে রাসবিহারী বসু ভারতীয় জাতীয় সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন।১৯৪৩ সালে তিনি এই বাহিনীর দায়িত্বভার তুলে দেন সুভাষ বোসের হাতে। নারী পুরুষ মিলিয়ে এই বাহিনীতে প্রায় ৮৫০০০ সেনা ছিল। পরে এই বাহিনীর নাম পাল্টে “আজাদ হিন্দ ফৌজ” করা হয়।
জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জেনারেল তোজো নেতাজিকে সবরকম সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন। ১৬ই জুন ১৯৪৩ জেনারেল তোজো জাপানি সংসদে ঘোষণা করেন ভারতের স্বাধীনতার জন্য জাপান সবরকম সহযোগিতা করবে। জাপানের পরিকল্পনা ছিল মায়ানমারের পূর্বদিক থেকে ব্রিটিশদের ওপর আক্রমণ করা এবং আজাদহিন্দ বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়ে ইংরেজদের ভারত থেকে তাড়ানো। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে জাপান ও নেতাজির সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাছাড়া তখন আজাদহিন্দ বাহিনীর কাছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো পর্যাপ্ত খাদ্য এবং অস্ত্র ছিলো না। সুভাষ ১৯৪৪সালের ২৪শে আগস্ট রেঙ্গুন ফিরে আসেন এবং সেখানকার রেডিও স্টেশন থেকে ঘোষণা করেন ইমফলের সৈন্য কাজ করতে বিফল হয়েছে।কিন্তু দেশবাসী যেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যায়।
সুভাষ বোসের এই আহ্বানে প্রথমে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া নৌ বাহিনী এবং পরে ব্রিটিশ ভারতের সমস্ত ভারতীয় সৈন্য ইংরেজ সরকারের বিরোধিতা শুরু করে। ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় সৈন্যদের বিরোধিতা এবং নেতাজির কর্মকান্ডে প্রচন্ড ভয় পায় এবং সেই কারণে খুব তাড়াতাড়ি ভারতকে স্বাধীন করার কথা ঘোষণা করে। এই সময় সোভিয়েত বাহিনীর কাছে জার্মানি পুরোপুরি পরাজিত হয় এবং হিটলার আত্মহত্যা করে। ওদিকে আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা নাগাসাকি শহরে পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে,ফলে জাপান আমেরিকার কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। ব্রিটেন এবং আমেরিকার সৈন্যদল সিঙ্গাপুর, মালাই,থাইল্যান্ড, ও ব্রক্ষ্মদেশের দিকে এগোতে থাকে। এই সময় নেতাজি সিঙ্গাপুরে ছিলেন।সেখান থেকে তিনি ১৬ই আগস্ট ১৯৪৫ সালে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে পৌঁছন।সেখান থেকে তিনি জাপানের প্রতিনিধি হো চিয়া তেরু হোর সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু পরমাণু হামলার পর জাপান একপ্রকার বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে ছিল।তাই সেখান থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করা সম্ভব হলো না। তিনি বাহিনীর পরবর্তী রণনীতি নিয়ে খুবই চিন্তিত ছিলেন।
১৯৪৫ সালের ১৭ই আগস্ট সকালে নেতাজি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির বিমানে চড়ে ব্যাংকক থেকে ভিয়েতনাম পৌঁছন। সেখান থেকে এগোনোর জন্য কোনো বিমান না পেয়ে শেষ পর্যন্ত জাপানের একটা বোমারু বিমানে চড়ে তিনি রওনা হন। তার সঙ্গে ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের এ ডি সি কর্নেল হাবিবুর রহমান। কিন্তু ওই বিমান দুর্ঘটনায় পড়ে।এবং এখান থেকেই শুরু হয় নেতাজি মৃত্যু রহস্য, যা আজও অজানা। কারো কারো মতে নেতাজি ওই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন।
নেতাজি জীবিত না মৃত সেই তর্কে না গিয়ে, আমি মনে করি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোসের মতো নেতৃত্বের কোনো দিন মৃত্যু হয় না। তিনি সকল ভারতীয় তথা বাঙালির হৃদয়ে সদা জীবিত থাকবেন।