Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » স্বর্গের গল্প || Tarapada Roy

স্বর্গের গল্প || Tarapada Roy

স্বর্গের গল্প

যাঁরা ভাবেন স্বর্গে শুধু পুণ্যবানেরা প্রবেশাধিকার পান, পাপীদের সেখানে কোনও স্থান নেই, তাঁরা স্বর্গ সম্বন্ধে প্রায় কিছুই জানেন না।

প্রত্যেক পাপীকে নরকে যাওয়ার আগে কম-বেশি কিছুদিন স্বর্গে থাকতে হয়, তা না হলে তারা কী করে বুঝবে স্বর্গে কী আরাম আর নরকে কী কষ্ট।

বলা বাহুল্য, পাপীদের পক্ষে এই স্বর্গদর্শন প্রায় কন্ডাক্টেড ট্যুরের মতো, চট করে স্বর্গটা দেখিয়ে তাদের নরকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শুধু তারতম্যটা বোঝানোর জন্যে, পাপের পরিণতি হৃদয়ঙ্গম করানোর জন্যে।

স্বর্গ বিষয়ে মানুষের অন্যান্য যা ধারণা, সে অবশ্য খুব অলীক নয়। বহু শত শতাব্দীর পুরনো ধারণা এটা, সেই যে-যুগে স্বর্গ এবং মর্তের মধ্যে একটু একটু যাতায়াত ছিল, সেই সময়কার ধারণা, তাই খুব ভুল নয়। এ কথা সত্যি যে স্বর্গের সীমানায় মলয় পবন ছাড়া আর কোনও বাতাস বয় না। নন্দন কাননের। পারিজাত ফুল কোনওদিন মলিন হয় না, ঝরে পড়ে না। স্বর্গের অপ্সরীরা কখনও ক্লান্ত হয় না, তাদের বয়স বাড়ে না, তাদের চঞ্চল চরণে নূপুরধ্বনি কখনও থেমে যায় না বা স্তিমিত হয় না। স্বর্গীয় দ্রাক্ষারসে যে আসব প্রস্তুত হয় তার মাদকতা স্কচ-হুঁইস্কির চেয়ে বহুগুণ বেশি, তার ফেনিল মধুরতার তুলনায় মরপৃথিবীর শ্যাম্পেনের স্বাদ নিতান্ত জোলো ও পানসে।

এসব তবু ঠিক আছে। অনেকেই এসব বিষয়ে অল্পবিস্তর জানেন।

কিন্তু স্বর্গের অন্য একটা ব্যাপার আছে যে সম্পর্কে পৃথিবীর লোকেরা কেউই বিশেষ কিছু জানে। চিন্ময়বাবুও জানতেন না। চিন্ময়বাবু মানে বালিগঞ্জের চিন্ময় রায়। ব্যাপারটা হল স্বর্গের যানবাহন-সংক্রান্ত। পৃথিবীর মতো স্বর্গে ট্রামবাস, ট্যাকসি, রেল, পাতাল রেল, স্টিমার, ফেরিনৌকো, উড়োজাহাজ ইত্যাদি জনসাধারণের এক্তিয়ারভুক্ত কোনও যান চলাচলের ব্যবস্থা নেই। প্রয়োজনও নেই।

তবে জগৎ-সংসারের পোড়খাওয়া, মারখাওয়া মানুষেরা যাই বলুন, ভগবান মোটেই অবিবেচক নন। তিনি স্বর্গে প্রত্যেকের জন্যে ব্যক্তিগত যানবাহনের ব্যবস্থা রেখেছেন। স্বর্গে পৌঁছানোমাত্র প্রত্যেককে যানবাহন বরাদ্দ করা হয়।

.

আমাদের চিন্ময়বাবু মোটামুটি সচ্চরিত্র লোক। স্বর্গে আসা তার অবধারিত ছিল। কিন্তু মৃত্যুর পরে তিনি স্বর্গের দরজায় পৌঁছে স্বর্গের দ্বাররক্ষীদের যে সমস্ত প্রশ্নের সম্মুখীন হলেন সেগুলি খুব রুচিসম্মত বা সম্মানজনক নয়।

ব্যাপারটা অনেকটা ইন্টারভিউয়ের মতো। সুসজ্জিত দ্বাররক্ষীবৃন্দ, আসলে তারাও বড় বড় দেবতা, মণিমুক্তাখচিত ঝলমলে পোশাক ও উষ্ণীষ তাদের, কোমরে সোনার খাপে রুপোর তলোয়ার, পায়ে জরির নাগরা, তাদের দেখলে মনে সমবোধ জাগে।

স্বয়ং ভগবানও এঁদের সঙ্গে রয়েছেন। বলতে গেলে তিনিই ইন্টারভিউ বোর্ডের চেয়ারম্যান। তার সাজপোশাক প্রায় একইরকম, তবে অনেক বেশি উজ্জ্বল, অনেক বেশি মহার্ঘ।

অন্য কোনও বিষয়ে প্রশ্ন তুলে আলোচনায় না গিয়ে চিন্ময় রায়ের নামধাম ইত্যাদি প্রথমে চেক করা হল।

কলকাতার বালিগঞ্জের লোক। চিন্ময় রায় একটা বেসরকারি অফিসে বেশ ভাল চাকরি করতেন। তবে খাওয়া-দাওয়া, পান-ভোজনে সতর্ক ছিলেন না। কাল ছিল শনিবার, কাল রাতে গুরুভোজন করেছিলেন অখাদ্য-কুখাদ্য সব জিনিস, খাসির মাংসের বড়া, গোমাংসের কাবাব, শুয়োরের মাংসের সসেজ, সেই সঙ্গে অপরিমিত মদ্যপান-রাত দুটো হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুর বাড়ি থেকে কোনওরকমে টলতে টলতে রাত আড়াইটে নাগাদ বাড়ি ফিরে ধড়াচূড়ো এমনকি পায়ের জুতো-মোজা সমেত গভীর নিদ্রামগ্ন স্ত্রীর পাশে শুয়ে পড়েন।

ঘুম ভাঙে সকাল সাড়ে চারটের সময়। গলগল করে ঘামছেন, বুকে অসহ্য ব্যথা। পাশে স্ত্রী সর্বজয়া তখন কী এক মধুর স্বপ্ন দেখছেন, তার ঠোঁটে মৃদু হাসি। চিন্ময় সর্বজয়াকে ধাক্কা দিয়ে বললেন, ওগো বুকে বড় ব্যথা।

সুখস্বপ্ন ভেঙে যাওয়ায় এবং অন্যান্য বহুবিধ কারণে বিরক্ত সর্বজয়া চিন্ময়ের হাত সজোরে সরিয়ে দিয়ে ধমকে উঠলেন, চোপ, মাতাল।

সর্বজয়ার ধমকের প্রয়োজন ছিল না। ঠিক পনেরো মিনিট পরে পৌনে পাঁচটা নাগাদ চিন্ময়বাবু চিরতরে সম্পূর্ণ চুপ করে গেলেন। ইহলোক পরিত্যাগ করলেন।

এখন সকাল দশটায় স্বর্গের অফিসঘর খোলার পর পরলোকে তার ইন্টারভিউ হচ্ছে। আর বালিগঞ্জের বাড়িতে ভিড়েভরা আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের মধ্যে তখনও সর্বজয়া ইনিয়ে-বিনিয়ে কঁদছেন, ওগো, তুমি না একেবারে চুপ করে গেলে গো!

নামধাম ইত্যাদি ইন্টারভিউয়ের প্রাথমিক পর্যায় মিটে যাওয়ার পরে এবার আসল প্রশ্নের পালা।

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যেমন নানা বিষয়ে নানারকমের প্রশ্ন করা হয়, ভেনেজুয়েলা থেকে কুয়ালালামপুর কাছে না বাগদাদ থেকে রেঙ্গুন কাছে?রেঙ্গুনের নতুন নাম কী, ভেনেজুয়েলার পুরনো নাম কী? মাছির কটা চোখ, আরশোলার বা মাকড়সার কটা পা? সত্যিই কি পা না হাত?

এরকম ইয়ার্কি, এ জাতীয় প্রশ্ন স্বর্গে করা হয় না। রীতি নেই।

চিন্ময়বাবু একদা একটা সরকারি চাকরির চেষ্টা করেছিলেন। অনেকদূর উতরে যাওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষায় আটকে যান, তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, হিজলপুকুর পল্লিসমবায় উন্নয়ন সমিতির পরিচালকের নাম কী?

হিজলপুকুর পল্লিসমবায় উন্নয়ন সমিতির সেই পরিচালক ছিলেন প্রশ্নকর্তার শ্বশুর এবং তৎকালীন সমবায় সচিবের ভায়রাভাই। কিন্তু চিন্ময়বাবু সে কথা কী করে জানবেন। সেই সরকারি চাকরি তিনি পাননি, কিন্তু তার জন্যে তাঁর কোনও আফসোসও নেই। তবে আজ এই স্বর্গীয় ইন্টারভিউয়ে তত জটিলতা নেই। শ্রীল শ্রীযুক্ত শ্রীভগবানের একটাই মাত্র জিজ্ঞাসা, একটাই প্রশ্ন। তাঁর পাপপুণ্যের নিরিখ একটাই, সেটা হল নরনারীর নৈতিক জীবনের পবিত্রতা। তার চেয়েও বড় কথা অন্য কোনও নৈতিকতা নিয়ে তিনি মাথা ঘামান না, এই বুড়ো বয়সে তার একমাত্র ভাবনা নরনারীর শারীরিক সম্পর্কের নৈতিকতা নিয়ে।

সবাইকে যেমন জিজ্ঞাসা করা হয়, চিন্ময়বাবুকেও জিজ্ঞাসা করা হল সেই একটিই প্রশ্ন।

প্রশ্নটি হল, তুমি কখনও ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছ কিনা?

চিন্ময়বাবু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ছাত্র ছিলেন। বাংলা খবরের কাগজ, বইপত্র কিছু কিছু পড়েন বটে কিন্তু ব্যভিচারের মতো কঠিন শব্দের প্রকৃত অর্থ তিনি জানেন না। প্রশ্ন শুনে চিন্ময়বাবু আমতা আমতা করতে লাগলেন।

প্রশ্নকর্তা অন্য কেউ হলে ধরে নিত লোকটির দোষ আছে তাই এই আমতা আমতা ভাব। কিন্তু এখানে প্রশ্নকর্তা স্বয়ং ভগবান। তিনি সর্বজ্ঞ, তিনি সব বোঝেন, সব জানেন।

ব্যভিচার শব্দে চিন্ময়বাবুর অসুবিধা দেখে ঈশ্বর ইংরেজিতে অ্যাডাল্টারির কথা বললেন, সেই সঙ্গে ব্যাখ্যা করে প্রশ্ন করলেন, বিবাহিতা স্ত্রী ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে জীবনে কখনও ফস্টিনস্টি করেছ কিনা? ফস্টিনস্টির চেয়ে বেশি কিছু করেছ কিনা?

অন্তত এই একটি ব্যাপারে চিন্ময়বাবুর কখনও কোনও দোষ ছিল না। প্রশ্ন বোঝামাত্র তিনি চট করে উত্তর দিলেন,নো স্যার। নেভার স্যার। কখনও না স্যার।

যমরাজার বিশ্বস্ত সহকারী চিত্রগুপ্ত ভগবানের সামনে ছিলেন, তিনি পাশের ব্লকে যমপুরীর অফিসে তখনই দূরভাষে যোগাযোগ করে খোঁজ নিয়ে জানলেন চিন্ময়বাবু সত্যি কথাই বলেছেন।

আর কোনও প্রশ্ন চিন্ময়বাবুকে করা হল না। এই প্রশ্নোত্তরের ভিত্তিতেই তাকে একটি শীততাপনিয়ন্ত্রিত স্বর্গীয় মোটরগাড়ি বরাদ্দ করা হল।

গতকাল রাতে কিংবা আজ সকালে আরও যারা মারা গিয়েছেন তাঁদেরও প্রশ্নোত্তর চিন্ময়বাবুর সঙ্গেই চলছিল।

তবে সব ক্ষেত্রে প্রশ্নোত্তর মোটেই জরুরি নয়। দু-চারজনের রেকর্ড এত খারাপ যে তাদের ক্ষেত্রে রেকর্ড বা জবানবন্দি কিছুই প্রয়োজন নেই।

এই তো সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন শ্রীযুক্ত রামভজন চৌরাসিয়া, ক্রোড়পতি ও স্বনামধন্য লম্পট। চিন্ময়বাবু রামভজনকে আলগা আলগা চিনতেন। রামভজনবাবুর দুর্বলতা ছিল অনতি-সাবালিকা, স্বভাবত অথবা জন্মজ গরঠিকানা-অভিনেত্রীদের প্রতি। একবার চিন্ময়বাবু দেখেছিলেন পুরীর সমুদ্রসৈকতে দুই সদ্যোখিতা উপনায়িকাকে দুই বগলে নিয়ে চিরগোলমেলে নুলিয়াদের হাত এড়িয়ে রামবাবু মাত্র তিনটে রবারের টিউব নিয়ে তরঙ্গসংকুল সাগরে হাসতে হাসতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

কুখ্যাত হোটেলের বারান্দায়, খারাপ পার্টিতে এবং এই জাতীয় নানা জায়গায় সময়ে-অসময়ে খারাপ-ভাল নানারকম মহিলার সঙ্গে রাম চৌরাসিয়াকে দেখেছেন চিন্ময় রায়।

চৌরাসিয়ার কাগজপত্র দেখে চিত্রগুপ্তের সঙ্গে অল্পবিস্তর আলোচনা করে ভগবান রামভজন চৌরাসিয়াকে বরাদ্দ করলেন একটি রিকশা।

ভগবানের নির্দেশ শুনে রামভজন একেবারে আকাশ থেকে পড়লেন, করজোড়ে বললেন, হুজুর, পৃথিবীতে কোনওদিন আমি এয়ারকন্ডিশন গাড়ি ছাড়া চড়িনি আর আমাকে এখানে রিকশায় চড়তে হবে।

ভগবান বললেন, না, না। তোমাকে রিকশায় চড়তে হবে না।

শুনে রামভজন যেন একটু আশ্বস্ত হলেন এয়ারকন্ডিশন না হোক, স্বর্গে এয়ারকন্ডিশন দরকারও নেই। অন্তত একটা গাড়ি পেলেই হল। তিনি একটু হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

কিন্তু ওই পর্যন্তই। ভগবানের অঙ্গুলি নির্দেশে চিত্রগুপ্ত রামভজনকে জানালেন তোমাকে রিকশা চড়তে হবে এ কথা তো বলা হয়নি। তোমাকে তো রিকশা চড়ার জন্যে দেওয়া হচ্ছে না। তুমি রিকশা টানবে তোমার যা রেকর্ড তাতে এটাই তোমার প্রাপ্য।

অনেক হাতেপায়ে ধরা, কাদাকাটি অনেক কিছু করেও রামভজন ভগবানের মন গলাতে পারলেন না। স্বর্গে হুকুম জারি হয়ে গেলে তার আর কোনও নড়চড় হয় না।

বিচারসভার শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে স্বর্গের কাণ্ডকারখানা প্রত্যক্ষ করছিলেন চিন্ময়বাবু। তার আর কিছু করার নেই, তিনি তো নিজ পুণ্যবলে ভাল এয়ারকন্ডিশন গাড়ি পেয়েছেন। এখন শুধু মজা দেখছেন, যেমন যেমন লোক আসছে তাদের কথাবার্তা শুনে, কাগজপত্র-রেকর্ড দেখে একেকজনকে একেকরকম যান বরাদ্দ করা হল।

একটি সুন্দরী মেয়ে এল। খুব চঞ্চলা, প্রগলভা ছিল পৃথিবীতে, তবে বোধহয় দুশ্চরিত্রা ছিল না, তাকে চাকা লাগানো দ্রুতগতি স্কেটিং বোর্ড দেওয়া হল।

এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এলেন, দেখা গেল দেশে তিনি যথেষ্ট সংযত থাকলেও যতবারই বিদেশে গিয়েছেন মেমসাহেবের সঙ্গে যথেষ্ট বদমায়েসি করেছেন। তাকে একটা পুরনো মোটর সাইকেল দেওয়া হল।

পুলিশের এক প্রাক্তন বড়কর্তা এমনিতে ভালই ছিলেন, তবে মধ্যযৌবনে একবার যখন তাঁর স্ত্রী অসুস্থ হয়ে মাসছয়েক হাসপাতালে ছিলেন তখন পাশের বাড়ির বিধবা বউদির সঙ্গে একটু লটঘট বাধিয়ে ফেলেছিলেন।

ভদ্রলোককে একটা ফিটন গাড়ির কোচম্যান করা হল। ভদ্রলোক প্রাক্তন পুলিশকর্তা, তিনি জানতে চাইলেন, আমাকে কি খালি ঘোড়ার গাড়ি চালাতে হবে?

চিত্রগুপ্ত খাতা দেখে বললেন, তা কেন? তোমার সেই পাশের বাড়ির বিধবা বউদি তিনিই তো ওই গাড়ি চড়েন। আগের কোচম্যান নরকে মেয়াদ খাটতে গেছে। এখন থেকে তুমি চালাবে ওঁর ঘোড়ার গাড়ি।

এইভাবে ছোট বড়, সাধারণ, বিলাসবহুল মোটরগাড়ি, স্কুটার, মোটর সাইকেল, ঘোড়ার গাড়ি, ঘোড়া, সাইকেল, সাইকেল রিকশা, টানা রিকশা, পায়ের নীচের স্কেটিং চাকা একেকজনকে একেকরকম বরাদ্দ করা হল।

চরিত্রদোষ অনুযায়ী চুলচেরা বিচার করে যার যেমন প্রাপ্য তেমন বাহন সে পেল।

কাউকে কাউকে বাহন দেওয়াই হল না। তাদের ড্রাইভার, কোচম্যান বা রিকশাওয়ালা করা হল।

বিগত যুগের এক বিখ্যাত নর্তকী শ্রীমতী মদালসা দেবীকে দায়িত্ব দেওয়া হল চিন্ময়বাবুর গাড়ি চালানোর।

মহিলা বহুকাল আগেই এসেছেন, তবে আগে যাঁর সারথি ছিলেন তিনি সম্প্রতি আবার মানব জন্ম পরিগ্রহণ করতে ধরাধামে গিয়েছেন।

সে যা হোক, মদালসা দেবীকে নিয়ে চিন্ময়বাবুর আপত্তি নেই। আর আপত্তি করে লাভই বা কী? স্বর্গে নিজের ইচ্ছের কোনও দাম নেই।

মদালসা দেবী পারিজাত স্কোয়ারে চিন্ময়বাবুর জন্যে নির্দিষ্ট বাংলোয় গাড়ি চালিয়ে চিন্ময়বাবুকে নিয়ে গেলেন। চমৎকার বাংলো, সুন্দর ব্যবস্থা, সব নিখুঁত, কোথাও কোনও ত্রুটি নেই। স্বর্গের ব্যাপারই আলাদা।

মদালসা কাছেই কোথাও থাকেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় এসে তিনি চিন্ময়বাবুকে পারিজাত স্কোয়ারে, নন্দন অ্যাভিনিউয়ে, ব্রহ্মা রোডে, মহাদেব মার্কেটে গাড়ি করে বেড়িয়ে নিয়ে আসেন।

রাস্তায় অনেক চেনা লোক। তাদের বাহন দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় পৃথিবীতে কে কতটা সচ্চরিত্র ছিলেন। সেদিন চিন্ময় এক নীতিবাগীশ গার্লস কলেজের প্রিন্সিপ্যালকে দেখলেন সাইকেল চালাচ্ছেন, ভদ্রলোক চিন্ময়বাবুকে দেখে চিনতে পেরে লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে পাশের গলিতে কেটে পড়লেন।

মদালসা দেবী অবশ্য বলেন, স্বর্গে আবার লজ্জা কী? এ নিয়ে চিন্ময়বাবুর সঙ্গে মদালসা দেবীর। অনেক আলোচনা হয়। সে আলোচনায় চিন্ময়বাবু বেশ মজা পান।

কিন্তু এ মজা দীর্ঘস্থায়ী হল না। রাস্তায় বিভিন্ন লোককে হরেক রকম যানবাহনে দেখতে দেখতে হঠাৎ একদিন চিন্ময়বাবু দেখলেন তার স্ত্রী সর্বজয়া আসছেন সামনের রাস্তা দিয়ে।

সর্বজয়াকে দেখেই কপালে করাঘাত করলেন চিন্ময় রায়। গাড়ির গতি একটু মন্থর করে দিয়ে মদালসা দেবী বললেন, কী হল?

চিন্ময় বললেন, আমার স্ত্রী।

মদালসা বললেন, কোথায়?

চিন্ময় বললেন, ওই টুং টাং করতে করতে সামনের গলিতে ঢুকছে।বলে আবার কপালে করাঘাত করলেন, এবার বেশ জোরে।

মদালসা দেবী বললেন, আপনার স্ত্রী মারা গেছেন তাই পরলোকে এসেছেন। পৃথিবীতে স্ত্রী মারা গেলে স্বর্গে স্বামী শোক করে নাকি? চিন্ময় বললেন, আমি শোক করছি না, আমি নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছি। ধিক্কার? মদালসা দেবী প্রশ্ন করলেন, ধিক্কার কীসের? চিন্ময়বাবু বিমর্ষ কণ্ঠে বললেন, দেখলেন না আমার স্ত্রী রিকশা টানছেন। বুঝতেই পারছেন কেমন চমৎকার চরিত্রবতী ছিলেন উনি। আর সারাজীবন ধরে মূর্খ আমি, ওঁকে কী তোয়াজটাই না করেছি। ওঁর মতো মহিলার কথা ভেবে সারাজীবন শুকনো কাটিয়েছি। হায়, কপাল আমার। বলে চিন্ময়বাবু আবার কপালে করাঘাত করলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress