এইমাত্র লোকটা নিঃশব্দে ঢোকে তার খুপরিতে। এককোণে
মেঝেতে বিছানা পাতা; মলিন চাঁদর,
বালিশ ওয়াড়ছুট, আহত পশুর মতো যেন
গোঙাচ্ছে, ঘরের তাকে কয়েকটি বই। একমাত্র
টুল ছাড়া আসবার বলতে কিছুই
নেই, জানলার নিচে আধপোড়া মোমবাতি টিনের কৌটোয়
করুণ দাঁড়ানো। সে কাপড় না ছেড়েই টুলে
কিছুক্ষণ বসে জুতো জোড়া ছুঁড়ে ফেলে গা রাখে শয্যায়।
লোকটাকে ঘিরে এই বিশীর্ণ গলিতে
রটেছে নানান কথা। কেউ বলে সে ঘোর অমাবস্যায়। জ্যোৎস্না,
বর্ষার রোদ্দুর পুরে রাখে তার বুকের পকেটে। মধ্যরাতে
ডাঙায় চালিয়ে নৌকো মেঘলোকে যায়, ফিরে এলে
জামায় মেঘের দাগ, নক্ষত্রের রেণু লেগে থাকে,
লোকে দ্যাখে; তারপর ঈষৎ গা ঝাড়া দিয়ে ঢোকে
খুপরিতে নিরিবিলি। সহজে ঘেষে না কেউ লোকটার কাছে,
কেবল বালক বালিকারা তার সঙ্গে মেতে ওঠে
কানামাছি খেলায় বিকেলবেলা অবরে-সবরে। স্বেচ্ছায় সে
বাজায় বাঁশের বাঁশি প্রতিদিন, যেন চৌরাসিয়া, সুরধারা
গলি ছেড়ে দূরে যেতে-যেতে নীলিমাকে ছোঁয়। ওরা
শোনে ভরা মুগ্ধতায়, দ্যাখে লোকটার
সমস্ত শরীর রঙধনু, মাথা আগুনের বল।
এক সন্ধ্যেবেলা, যখন যে ফিরছিল খুপরিতে,
পাড়ার রটনাকারীগণ প্রায় তেড়েমেড়ে আসে
লোকটার দিকে আর তাকে ঐন্দ্রজালিক ঠাউরে নিয়ে তার
শার্ট, ট্রাউজারের পকেট
তক্ষুণি উজাড় করে রোদ্দুর, চাঁদিনী, ঝকঝকে
অসংখ্য নোটের তাড়া, হীরে জহরত, সোনা দানা
দিতে বলে। লোকটা অসুস্থ, হৃদরোগী, ভিড়ভাট্রা দেখে আর
অতিশয় কর্কশ আওয়াজ
শুনে বেশ কিছুটা ভড়কে যায়। টানা-হেঁচড়ায়
মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, বুকের স্পন্দিত একা ঘড়ি থেমে যায়।
একটু পরেই খুব চুপচাপ বালক বালিকা সব আসে
একে একে, অশ্রুময় চোখে লোকটার
চারপাশে দাঁড়ায় এবং দ্যাখে স্তব্ধ সেই বংশীবাদকের
শিয়রে রোদ্দুর আর পায়ের তলায় জ্যোৎস্না। আজ
উন্নত মাথায় তার আগুনের বল নেই কোনও,
আছে শুধু নক্ষত্রের জ্বলজ্বলে রূপালি মুকুট।