রত্নহার উদ্ধারে ফ্রান্সিস
ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে ওদের দেশের দিকে। ফ্রান্সিসের ভাইকিং বন্ধুরা খুব খুশি। আকাশে মেঘ নেই। জোর বাতাস বইছে। ভাইকিংরা সব পাল খুলে দিয়েছে। বেগবান বাতাসে পালগুলো যেন বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে। খুব দ্রুত গতিতে জাহাজ ঢেউ ভেঙ্গে চলেছে। এখন আর দাঁড় বাইতে হচ্ছে না। ভাইকিংরা জাহাজের এখানে-ওখানে দল বেঁধে বসেছে। ছক্কা-পাঞ্জা খেলছে। গল্পগুজব করছে। বেশিরভাগই দেশের কথা। দেশের আত্মীয়স্বজন অবাক হয়ে শুনবে ওদের এই অভিযানের বিচিত্র কাহিনী। এসব নিয়েই কথা হচ্ছে।
তখন বিকেল হয়েছে। সূর্য অস্ত যায়নি। পশ্চিম আকাশে তখন সূর্য অনেকটাই ঢলে পড়েছে। হঠাৎই মাস্তুলের মাথা থেকে নজরদার পেড্রোর চিৎকার করে বলা কথাটা শোনা গেল। ভাইসব, সাবধান। ঝড় আসছে। পেড্রো দড়িদড়া ধরে দ্রুত মাস্তুল বেয়ে নামতে লাগল। বিস্কো ছুটল ফ্রান্সিসকে খবর দিতে।
একটু পরেই ফ্রান্সিস ডেক এ উঠে এলো। পেড্রো ফ্রন্সিসের কাছে এলো। পেড্রো তখনও হাঁফাচ্ছে। হাঁফাতেহাঁফাতে বলল, ফ্রান্সিস, ঝড় আসছে। ওপর থেকে দেখলাম দক্ষিণ দিকে কালো মেঘ জমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় উঠবে।
পেড্রো জাহাজের অভিজ্ঞ নজরদার। ওর অনুমান ঠিকই হবে। ঝড় আসার আর একটা লক্ষণও দেখা গেল। বাতাস পড়ে গেছে। পালগুলো নেতিয়ে পড়েছে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব, ঝড় আসছে। ডেক-এ এসে নিজের জায়গা নাও। পাল নামিয়ে ফেলো। ঝড়ের মোকাবিলা করতে সবাই তৈরি হও।
ভাইকিংরা ডেক-এ কিছুটা অন্তর অন্তর পালের খুঁটির দড়িদড়া ধরল। ঝড়ের সময় দাঁড় বেয়ে কোনও লাভ নেই। তাই দাঁড় ঘরে কেউ গেল না। ডেক-এ তৈরি হয়ে দাঁড়াল।
ফ্রান্সিস জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল, ঝড়ের মেঘ উঠেছে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড় আসবে তুমি তৈরি তো?
ফ্লেজার বলল, হুইল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমি দিকে ঠিক রাখতে চেষ্টা করব। ঝড়ের ধাক্কায় জানি না কতটা সফল হব।
ফ্রান্সিস বলল, এটা ভূমধ্যসাগর এলাকা। এখানে কয়েকবার ঝড়ের মুখে পড়েছি। দেখেছি এখানে প্রচণ্ড ঝড় হয় না। তবু তৈরি হও। দিক ঠিক রাখো।
দু’জনে যখন কথা বলছে তখনই হঠাৎ বাতাস বইতে শুরু করল। গুমোট ভাবটা আর রইল না। বাতাসের জোর বাড়তে লাগল। ঘন কালো মেঘ দক্ষিণের আকাশ থেকে মধ্য আকাশের দিকে উঠে আসতে লাগল। পশ্চিম আকাশে সূর্য ঢাকা পড়ে গেল। অন্ধকার নেমে এলো। কালো মেঘের মধ্যে শুরু হল আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎ ঝলসে ওঠা। সেই সঙ্গে বাজ পড়ার প্রচণ্ড শব্দ। সমুদ্রের জলে বড়ো বড়ো ঢেউ তুলে ঝড় ছুটে এলো। ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্রান্সিসদের জাহাজের ওপর। ঝড়ের ধাক্কায় ফ্রান্সিসদের জাহাজ বেগে দুলতে লাগল। ঝোড়ো বাতাসে জলের ঢেউ ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল ডেক-এ। ভাইকিংরা দড়িদড়া টেনে ধরে জাহাজকে সোজা রাখার চেষ্টা করতে লাগল। অল্প অল্প বৃষ্টির পর এখন শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি পড়া। জাহাজ কখনও ঢেউয়ের মাথায় উঠে পড়তে লাগল। তারপরেই দুই ঢেউয়ের মধ্যে নীচে নেমে আসতে লাগল। জাহাজের এই ওঠাপড়ার সঙ্গে ভাইকিংবা জাহাজকে সোজা রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে লাগল।
ফ্রান্সিসদের সৌভাগ্য বলতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই বৃষ্টি কমে এলো। তারপর থেমে গেল। বাতাসের বেগও কমতে লাগল। আকাশে ধোঁয়ার মতো কালো মেঘ উত্তরমুখো উড়ে যেতে লাগল। তারপরেই আকাশে আর মেঘ নেই। ফুলের মতো তারা ফুটতে লাগল। আধভাঙ্গা চাঁদ থেকে আলো সমুদ্রের জলে ছড়িয়ে পড়ল।
এতক্ষণ ঝড়ের সঙ্গে লড়াই করে ভাইকিংরা অবসন্ন হল। সসপে ভেজা পোশাক গায়ে তারা ডেক-এ বসে রইল কয়েকজন। বাকিরা ডেক-এ শুয়ে রইল। জলে ভেজা পোশাক গায়ে ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে জাহাজ চালক ফ্লেজারের কাছে এলো। বলল, ফ্লেজার, আমাদের দিক ভুল হয়নি ত?
ঝোড়ো বাতাস আর ঢেউয়ের ধাক্কায় দিক ঠিক রাখতে পারিনি। একবার এদিকে আর একবার ওদিকে জাহাজটা যেন ছিটকে পড়েছে। দিকটিক সব গুলিয়ে গেছে। ফ্লেজার বলল।
তা হলে এখন কী করবে? ফ্রান্সিস বলল।
জাহাজ যে মুখো চলছে চলুক। দ্বীপ বা দেশ যাই তোক সেখানে পৌঁছতে হবে। তবেই দেখেশুনে দিক ঠিক করতে পারবে। ফ্লেজার বলল।
বেশ জাহাজ চলুক দেখা যাক কোনও দ্বীপ বা দেশে পৌঁছনো যায় কিনা। ফ্রান্সিস বলল। তারপর কেবিনঘরে যাবে বলে সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়াল।
হ্যারি এগিয়ে এলো। সঙ্গে আরও কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু। হ্যারি বলল, এখন কী করবে?
ফ্লেজারের সঙ্গে যা কথা হল সেসব ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল, এখন আমাদের কিছুই করবার নেই। জাহাজ যেমন চলেছে চলুক।
সন্ধে হল। নজরদার পেড্রো মাস্তুলের মাথায় ওর বসার জায়গায় বসে আছে। চারদিকে নজর রাখছে কোনওদিকে ডাঙা দেখা যায় কিনা। আবার নজর রাখছে। জলদস্যুদের জাহাজ আসছে কিনা তার দিকেও।
রাত হল। চাঁদের আলো সমুদ্রে ছড়াল। সমুদ্র বেশ দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। সাদাটে কুয়াশা নেমে এলো। অবশ্য বেশি দূর পর্যন্ত দেখা যায় নি। কুয়াশার অস্পষ্টতার মধ্যে দিয়েও পেড্রোর নজরে পড়ল ডাঙা। ও চিৎকার করে বলে উঠল, ডাঙা, ডাঙা দেখা যাচ্ছে। কথাটা কানে যেতেই ডেক-এ ওপর যারা শুয়ে বসে ছিল তারা উঠে দাঁড়াল। জাহাজের রেলিঙের কাছে এসে দাঁড়াল। ডাঙা তখন অনেকটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সমুদ্রের ধারে কোনও টিলা বা ছোটো পাহাড় নেই। সমতলভূমি সমুদ্র থেকে উঠে গেছে। দুটো জাহাজ নোঙর করে আছে দেখা গেল।
ততক্ষণে ফ্রান্সিস হ্যারি ডেক-এ উঠে এসেছে। সঙ্গে মারিয়া। হ্যারি জাহাজ দুটো দেখতে দেখতে বলল, একটা যুদ্ধজাহাজ, অন্যটা মালবাহী জাহাজ।
ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল, কী করবে এখন?
ফ্রান্সিস বলল, ফ্লেজারকে জাহাজ থামাতে বলো। একজন ভাইকিং-বন্ধু ফ্লেজারকে সে-কথা বলতে গেল।
ডেক-এ জড়ো হওয়া বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বলল, ভাইসব, আমরা ওই জাহাজঘাটায় এখন জাহাজ ভেড়াব না। অচেনা অজানা জায়গা। সব আগে দেখেশুনে তারপর যা করবার করব। এখন জাহাজ এখানেই নোঙর করো। পরে ভাবব কী করা যায়।
ততক্ষণে জাহাজ থেমে গেছে। ঘরঘর শব্দে নোঙর ফেলা হল। থেমে থাকা জাহাজ ঢেউয়ের ধাক্কায় দোল খেতে লাগল। হ্যারি বলল, ডাঙায় জাহাজ না ভেড়ালেও কোথায় এলাম তা তো জানতে হবে।
ফ্রান্সিস বলল এজন্যেই রাত একটু বাড়লে তুমি, শাঙ্কো আর আমি আমাদের নৌকোয় চড়ে ওখানে যাব। লোকজনদের জিজ্ঞেস করে জানব, এই জায়গাটা কি কোনও দ্বীপ না দেশ। এটা জানতে পারলে আমাদের দেশ কতদূর সেটা বুঝতে পারব। এবার চলো রাতের খাওয়া খেয়ে নিই।
মারিয়া বলল, এখানে কারা থাকে, কী রকম মানুষ তারা, সেসব তো তোমরা কিছুই জানো না।
ফ্রান্সিস বলল, উপায় নেই, এই ঝুঁকিটুকু নিতেই হবে।
ফ্রান্সিসরা রাতের খাওয়া একটু আগেই খেয়ে নিল। ফ্রান্সিস হ্যারি আর শাঙ্কোকে বলল, তোমরা এখন শুয়ে বিশ্রাম করে নাও। আমি সময়মতো তোমাদের ডাকব।
রাত বাড়তে লাগল।তখন মধ্যরাত্রি। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠল। কোমরের ফেট্টিটা ভালো করে বাঁধল। তলোয়ার ঝোলাল। মোমের আলোয় দেখল মারিয়া উঠে বসেছে। ফ্রান্সিস বলল, তুমি রাত জেগে না। ঘুমিয়ে পড়ো।
মারিয়া ম্লান হেসে বলল, তোমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিদেশ বিভুইয়ে যাচ্ছে, আর আমি নিশ্চিতে ঘুমোবে, এটা কি হয়?
ফ্রান্সিস বলল,যাতে বিপদে না পড়ি তার জন্যে যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তুমি এসব নিয়ে ভেবো না।
ফ্রান্সিস তৈরি হয়ে কেবিনঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চলল হ্যারি আর শাঙ্কোকে ডাকতে। হ্যারি তলোয়ার নিল। শাঙ্কো নিল তীরধনুকী। তিনজনে জাহাজের ডেকে উঠে এল। সমুদ্রে থেকে একটা ঠাণ্ডা বাতাস ছুটে এসে ওদের গায়ে লাগল।
ফ্রান্সিসের শরীরটা একটু কেঁপে উঠল। অত রাতেও বেশ কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু। ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এলো হালের কাছে দড়ির মই বেয়ে হ্যারি আর শাঙ্কো ছোটো নৌকোটায় নেমে এলো। ফ্রান্সিস নামবার আগে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল, কোনও ভয় নেই, আমরা নিরাপদেই ফিরে আসব। এখন থেকে ফ্লেজারের কথামতোই তোমরা চলবে।
ফ্রান্সিস নৌকোয় নেমে দাঁড় তুলে নিল। শাঙ্কো জাহাজে বাঁধা নৌকোর দড়িটা খুলে দিল। একটা পাক খেল নৌকোটা। ফ্রান্সিস ডাঙার দিকে লক্ষ্য রেখে দাঁড় বাইতে লাগল।
চাঁদের আলো বেশ। সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথায় সেই আলো নাচছে। নৌকো চলেছে। তীরের দিকে। সমুদ্রে কখনও কুয়াশা জমছে, কখনও জোর হাওয়া কুয়াশা উড়িয়ে দিচ্ছে।
তীরের কাছে এসে ফ্রান্সিস দেখল, বন্দর, জাহাজ বেশ দূরে। কুয়াশার আস্তরণের মধ্যে দিয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
নৌকো তীরে লাগল। তিনজনে নৌকো থেকে নামল। তীরে এদিকটা ঢালু। তিনজনে ঠেলে নৌকোর অর্ধেকটা তীরে তুলে রাখল, যাতে ভেসে না যায়। ঢালু তীর দিয়ে ওরা উঠে এলো। দেখল, বিস্তৃত প্রান্তর। এদিকে বাড়িঘর নেই। বাড়িঘর সব বন্দরের দিকে। প্রান্তরের শেষে ঝোপজঙ্গল।ফ্রান্সিস বলল, চলো, ওই বন্দরের দিকে ওই বাড়িঘরের দিকে।
তিনজনে চলল। ঘাসে ঢাকা প্রন্তরে ফুটফুটে জ্যোৎস্না। হেঁটে চলল ওরা। বনজঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই শুনল, অস্ত্রের ঝনঝন শব্দ। বনজঙ্গলের মধ্য থেকে চারজন সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে দ্রুত পায়ে ফ্রান্সিসদের সামনে এসে দাঁড়াল। জ্যোৎস্নায় দেখা গেল, ওদের মাথায় শিরস্ত্রাণ, গায়ে বর্ম, হাতে খোলা তলোয়ার। ফ্রান্সিস বুঝল, এরা আরবি সৈন্য। ফ্রান্সিসরা কিছু বোঝার আগেই সৈন্য চারজন ফ্রান্সিসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস আর হ্যারি দ্রুত হাতে তলোয়ার খুলল। সৈন্যদের প্রথম আক্রমণটা ঠেকাল।
এবার শুরু হল তলোয়ারের লড়াই। শাঙ্কো তার আগেই কয়েক পা পেছনে সরে এলো।
ফ্রান্সিস তলোয়ার চালাতে চালাতে বলল, শাঙ্কো, মেরো না,আহত করো। শাঙ্কো ততক্ষণে ধনুকে তিরে পরিয়েছে। হ্যারির সঙ্গে লড়াই করছে যে সৈন্যটা, শাঙ্কো তাকেই নিশানা করল। হ্যারির শরীর দুর্বল।ও বেশিক্ষণ লড়তে পারবে না। শাঙ্কো তির ছুড়ল। সৈন্যটার ডান হাতে তিরটা বিধে গেল। তলোয়ারফেলে সৈন্যটি মাটিতে বসে পড়ল। ফ্রান্সিস তখন তিনজন সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করছে। ফ্রান্সিসদের মাথায় শিরস্ত্রাণ নেই, গায়ে বর্মও নেই। শুধু মনের জোরে ফ্রান্সিস লড়াই করতে লাগল। ততক্ষণে শাঙ্কো আরও একটা তির ছুঁড়ছে। তিরটা লাগল যুদ্ধরত এক সৈন্যের পায়ে। সৈন্যটি মাটির ওপর বসে পড়ল। বাকি দু’জনের একজনকে ফ্রান্সিস এবার ঘায়েল করল। তলোয়ারের কোপে তারা হাত কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল। তখন দু’জন সৈন্য গলা ছেড়ে চিৎকার করে কী বলে উঠল। আরবি ভাষা। ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না।
ফ্রান্সিস দেখল, বনজঙ্গলের দিক থেকে প্রায় পনেরো-বিশজন সৈন্য ছুটে আসছে। ফ্রান্সিস লড়াই থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। হাঁফাতে লাগল। সৈন্যটিও আর ফ্রান্সিসকে আক্রমণ করল না। মুখ হাঁ করে শ্বাস নিতে লাগল।
সেই সৈন্যরা ছুটে এসে ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। তাদের মধ্যে একজন সর্দার গোছের সৈন্য ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বলল, তোমরা কারা? ফ্রান্সিসরা কিছুই বুঝল না।
হ্যারি স্পেনীয় ভাষায় বলল, স্পেনীয় ভাষায় বলুন।
সেই সৈন্যটি এবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা স্পেনীয় ভাষায় বলল, তোমাদের পরিচয় কী? তোমরা কেখেকে এসেছ?।
হ্যারি বলল, আমরা ভাইকিং। অনেক দূরে আমাদের দেশ।
সে তো তোমাদের দেখে, পোশাক দেশে বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু তোমরা আমাদের সৈন্যদের মারলে কেন?
ফ্রান্সিস বলল, আপনার সৈন্যরা এসেই আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আত্মরক্ষার জন্যেই আমাদের লড়তে হয়েছে। নইলে এখানে তাদের মৃতদেহ পড়ে থাকত।
তোমাদের বার্বারদের গুপ্তচর ভেবেই আমাদের সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সর্দারটি বলল।
বাবার কারা আমরা জানি না। হ্যারি বলল।
যাকগে, সর্দারটি বলল, আমাদের তিনজন সৈন্যকে তোমরা আহত করেছ। তোমাদের বন্দী করা হল।
আমরা আক্রান্ত হয়েই আক্রমণ করেছি। হ্যারি বলল।
এসব কালকে আমাদের শন্ত মিনকে বোলো। তিনি বিচার করে যা হুকুম দেবেন তাই আমাদের মানতে হবে। সর্দরটি বলল। তারপর হাত তুলে বন্দরের দিকটা দেখিয়ে বলল, চলো সব। ফ্রান্সিসদের নিয়ে সব সৈন্য চলল।
যেতে যেতে হ্যারি সেই সর্দারকে জিজ্ঞেস করল, এটা কি কোনও দ্বীপ না দেশ।
সর্দার বলল, দ্বীপ নয়, এটা উত্তর আফ্রিকা। আমাদের ভাষায় নাম আলমেঘারি। বার্বাররা এই দেশকে আলজিরিয়া বলে।
এই বন্দর শহরের নাম কী? শাঙ্কো বলল।
সিউতা, সর্দারটি বলল।
সিউতার পথে নামল সবাই। চলল পুবমুখো।দুপাশে বাড়িঘরদোরে কোথাও আলো নেই। সবাই ঘুমিয়ে। অন্ধকার পথে ওরা চলল।
একটা লম্বাটে পাথরে তৈরি ঘরের সামনে এসে সর্দার দাঁড়াল। ফ্রান্সিস দেখেই বুঝল এই ঘরটাই কয়েদঘর। ঘরটার লোহার দরজার দু’পাশে মশাল জ্বলছে। সেই আলোয় দেখা গেল দু’জন পাহারাদার সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিচ্ছে। সর্দারটি এগিয়ে গেল। পাহারাদারদের কী বলল। একজন পাহারাদার কোমরে ঝোলানো চাবির থোকা থেকে একটা চাবি বের করল। তালা খুলল। ঢঢং-ঢন শব্দ তুলে লোহার দরজাটা খুলে দিল। সর্দারটি ফ্রান্সিসদের ঘরে ঢোকার ইঙ্গিত করল।ওর মাথা নিচু করে কয়েদঘরে ঢুকল। আবার শব্দ তুলে লোহার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। ভেতরে দুটো মশাল জ্বলছে। সেই আলোতে ফ্রান্সিস দেখল ঘরটা লম্বামতো। কয়েদঘরে যেমন হয় এই ঘরটাও তেমনই। ছাদটা কাঠ আর শুকনো লম্বা লম্বা ঘাসে তৈরি। অনেক ওপরে দুটো জানলা। জানলায় শিক বলে কিছু নেই। খোদল বললেই হয়। মেঝেয় দড়িদড়া দিয়ে শুকনো ঘাস বেঁধে বিছানা করা। তাতে একপাশে আট-দশজন লোক শুয়ে ঘুমোচ্ছে। দরজা খোলার শব্দে দু-একজনের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তারা ফ্রান্সিসদের দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস দেখল, আগের বন্দিদের হাত বাঁধা নয়। ও নিশ্চিন্ত হল যে, ওদেরও হাত বাঁধা হবে না।
হ্যারি আর শাঙ্কো ক্লান্তিতে বিছানায় বসেই শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস বসল। শুয়ে পড়োনা। ওর কানে পাখির ডাক ভেসে এলো। বাইরে ভোর হল বোধ হয়। সূর্য উঠতে দেরি নেই। তখনই ফ্রান্সিস মৃদু গোঙানির শব্দ শুনল। কে গোঙাচ্ছে? ফ্রান্সিস তাকাল সেইদিকে। দেখল একটা লোক। এখানকার লোকেদের মতো ঢোলা হাতা জোব্বামতো পরা। বিছানার বাইরে পাথরের দেওয়াল পিঠ দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাত দুটো ঝুলে পড়েছে। মাথা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে। একটু থেমে আবার গোঙাতে লাগল লোকটা।
ফ্রান্সিসের কেমন কৌতূহল হল। ভাবল কে লোকটা? এরকম গোঙাচ্ছে কেন? কে মেরেছে ওকে? ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ঘাসের বিছানা থেকে নেমে লোকটার পাশে গিয়ে পাথরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসল। দেখল লোকটার গায়ে জামা বলে কিছু নেই। লোকটা গোঙানি থামিয়ে মুখ তুলে ফ্রান্সিসকে দেখল। ফ্রান্সিস দেখল লোকটার মুখ কঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফ। মাথায় উড়ো-উড়ো কঁচাপাকা চুল। লোকটা এবার মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, নতুন আমদানি। আরবি ভাষা। ফ্রান্সিস বুঝল না। স্পেনীয় ভাষায় বলল, আমি আরবি ভাষা জানি না।
লোকটা এবার স্পেনীয় ভাষায় বলল, অল্পস্বল্প জানি।
ফ্রান্সিস বলল, তুমি গোঙাচ্ছ। তোমার কি শরীর খারাপ?
চাবুকের ঘা খেয়ে কি লোকের শরীর ভালো হয়? লোকটা বলল।
তো তো বটেই।ফ্রান্সিস বলল, কিন্তু তুমি তো ওই ঘাসের বিছানায় গিয়ে শুতেপারো।
লোকটা দেওয়াল থেকে আস্তে আস্তে পিঠটা তুলে বলল, আমার পিঠটা দ্যাখো। মশালের আলোয় লোকটার পিঠের অবস্থা দেখে ফ্রান্সিস চমকে উঠল। সারা পিঠে চাবুক মারার দাগ। দু-এক জায়গায় চাবুক কেটে বসে গেছে। রক্ত জমে আছে।
ফ্রান্সিস বুঝল পিঠে এরকম ঘা আর দাগ নিয়ে ঘাসের বিছনায় শোয়া অসম্ভব। ফ্রান্সিস বলল, তোমাকে কে এরকম নির্দয়ভাবে চাবুক মেরেছে! কেনই বা মেরেছে?
সে অনেক কথা? লোকটা আস্তে আস্তে বলল।
তোমার নাম কী? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
আমার নাম জিতা। লোকটা বলল।
এবার সব খুলে বলো তো। ফ্রান্সিস বলল।
কী হবে এসব শুনে! তুমিও তো আমার মতোই বন্দি। জিতা বলল।
আমি তোমাকে এই বন্দিজীবন থেকে মুক্তি দেব। ফ্রান্সিস বলল।
জিতা চমকে উঠে ফ্রান্সিসের মুখের দিকে ভালো করে তাকাল। বলল মিনের এই কয়েদঘর থেকে পালানো অসম্ভব!
ঠিক আছে, সেটা পরে ভাবা যাবে। ফ্রান্সিস বলল।
একটু থেমে বলল, এই মিন কে? আমাকে সব বলো। তোমার কোনও ভয় নেই। জিতা বলতে শুরু করল, প্রায় দুশো বছর আগের কথা। এই মেঘারিব-এ রাজত্ব করতেন এক বার্বার জাতির রানি তুহিনা। এক আরব দলনেতা বেনি এই দেশ আক্রমণ করল। একটু থেমে জিতা বলল, এবার আমাদের কথা বলি। আমরা জিতা পরিবার বংশানুক্রমে বৈদ্য চিকিৎসক। আর এক চিকিৎসক পরিবার এই সিউতাতে আছে। বেন্দিতো পরিবার। রানি তুহিনা যুদ্ধে ভীষণ আহত হলেন। সৈন্যরা তাকে নিয়ে যায় অয়েস পাহাড়ে রানির দুর্গে। সেই দুর্গে রানির চিকিৎসার জন্যে আমাদের পূর্বপুরুষ জিতাকে নিয়ে যাওয়া হয়। অন্য চিকিৎসক বেন্দ্ৰিতো পরিবারের পূর্বপুরুষকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দু’জন বৈদ্যই রানির চিকিৎসা করেছিল। কিন্তু রানির তখন শেষ অবস্থা। মৃত্যুর আগে রানি তুহিনা সবাইকে ঘরের বাইরে যেতে বললেন। সবাই বেরিয়ে গেল। তখন রানি অতি কষ্টে গলা থেকে দুটো রত্নহার খুললেন। একটা দিলেন আমাদের পূর্বপুরুষকে, অন্যটা দিলেন বেন্দিরে পূর্বপুরুষকে। দুটো রত্নহারই দেখতে একরকম, শুধু একটা রত্নহারে লকেট আছে। সেটা আমাদের পূর্বপুরুষকে দিয়ে রানি অতিকষ্টে বলেছিলেন, চিহ্ন দিলাম, বুদ্ধি খাটান, অলঙ্কার অমূল্য।
বেন্দিতো পরিবারের পূর্বপুরুষকে কিছু বলার আগেই রানি তুহিনার মৃত্যু হয়। জিতা থামল তারপর বলল, সেই থেকে আমাদের পরিবারের সঙ্গে বেন্দিতো পরিবারেরে শত্রুতা। ওদের রত্নহারে লকেটটা ছিল না। তারপর বাবার, মুর, আরবীয় অনেকেই এখানে রাজত্ব করে গেছে। কেউ রানি তুহিনার অলঙ্কারের গোপন ভাণ্ডার উদ্ধারের চেষ্টা করেনি। এখন আরবি দলনেতা মিনকে আমাদের চিরশত্রু বেন্দিতো পরিবারের লোকেরা বুঝিয়েছে যে, রানি তুহিনার দেওয়া লকেটসহ রত্নহার আমাদের কাছে আছে। লকেটে গুপ্ত অলঙ্কার ভাণ্ডারের চিহ্ন আছে, যা দেখে সেই ভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে। জিতা থামল। একটু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, এতসব তোমাকে বলে কী হবে?
ঠিক আছে। অনুমান থেকে আমি বলছি–ওই লকেটসহ রত্নহার কোথায়, মিন তোমার কাছ থেকে সব জানতে চেয়ে চাবুক মারছে। ফ্রান্সিস বলল। ঠিক তাই। মিন আমার বাবা-মা’র ওপরেও অত্যাচার করেছে। আমি কিছুতেই সেই লকেটসহ রত্নহার দেব না। জিতা থামল।
ফ্রান্সিস বলল, আমার শুধু একটাই প্রশ্ন, লকেটসহ রত্নহারটা এখন কোথায় আছে? সেটা জেনে তোমার কী লাভ? জিতা বলল।
ফ্রান্সিস হেসে বলল, আমি অনেক গুপ্তধন উদ্ধার করেছি। সব জানলে এটাও উদ্ধার করতে পারব।
জিতা কথাটা শুনে আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল, তুমি পারবে?
আগে সব জানি, শুনি, তারপর বলতে পারব। ফ্রান্সিস বলল।
জিতা একবার চারদিকে তাকিয়ে নিল। তখন সকাল হয়েছে। আগে যারা বন্দি ছিল তারা অনেকেই উঠে বসেছে। কেউ কেউ ওপরে দু’হাত উঠিয়ে হাই তুলছে। জিতা ফিসফিস করে বলল, রত্নহারটা আমার কোমরের ফোট্টিতে সেলাই করে রেখেছি।
ঠিক আছে। ফ্রান্সিস দেখল হ্যারি আরশাঙ্কোর ঘুম ভেঙেছে। দু’জনে বসে আছে। ফ্রান্সিস আঙুল নেড়ে ইশারায় ওদের কাছে আসতে ডাকল।
হ্যারি আর শাঙ্কো ফ্রান্সিসের কাছে এসে বসল। ফ্রান্সিস চাপা গলায় বলল, আমার পাশে যে লোকটাকে দেখছ তার নাম জিতা। ও কোমরের ফেট্টি থেকে একটা লকেটসহ রত্নহার খুলে দেখাবে। সবাই ওকে ঘিরে বোসো।
তিনজনই এবার জিতাকে ঘিরে বসল। এবার জিতা কী করছে কয়েদঘরের কেউ দেখতে পাবে না। জিতা একটু ইতস্তত করল। বলল, রত্নহারটা তোমাদের দেখালে আমার কোনও বিপদ হবে না তো?
ফ্রাসিস বলল, কথা দিচ্ছি তোমার কোনও বিপদ হলে আমরা তোমাকে রক্ষা করব। দেরিক কেরো না, বেলা বাড়ছে।
এবার জিতা কোমরের ফেট্টির মধ্যে আঙুল চেপে বলল, এখানটায় আছে। কিন্তু সেলাই করা। সুতো কাটতে হবে। শাঙ্কো জামার গলার দিকে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। সুতো কেটে রত্নহারটা বের করা হল। ফ্রান্সিস রত্নহারটা বাঁ হাতের তোলায় রাখল।
রত্নহারটা দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, এই লকেটের নকশাটা ভালো। করে দেখে রাখো।
হ্যারি বলল,মিনে করা চারটে ফুলের পাপড়ি।নীল মিনে করা। মাঝখানে রক্তপ্রবাল।
ঢং ঢং, দরজা খোলার শব্দ হল। ফ্রান্সিস দ্রুত রত্নহারটা জিতার হাতে দিয়ে বলল, কোমরে গুঁজে রাখো।
পাহারাদাররা সকালের খাবার নিয়ে ঢুকল। গোল করে কাটা রুটি আর নানা সবজির ঝোলমতো। ফ্রান্সিসরা যখন খাচ্ছে তখনই সেই দলের সর্দার ফ্রান্সিসদের দিকে এগিয়ে এলো। বলল, খাওয়ার পর তোমাদের শাসক মিনের কাছে নিয়ে যাওয়া হবে। জিতা তুমিও যাবে।
খাওয়া শেষ হল। সর্দার ইঙ্গিতে ফ্রান্সিসদের উঠে আসতে বলল। ফ্রান্সিসরা সর্দারের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা হল। ফ্রান্সিসরা সর্দারের পেছনে পেছনে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চলল সর্দারের পেছনে পেছনে। তখনই ফ্রান্সিস দেখল কয়েদঘরের পেছনে একটু দূর থেকেই বনজঙ্গল শুরু হয়েছে। তাই ভোরে পাখির ডাক শুনেছিল।
একটু পরেই ফ্রান্সিসরা পাথর বাঁধানো একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। সর্দার ভেতরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্রান্সিসরা ভেতরে ঢুকল। দেখল একটা বড়ো কালো এই পাথরের টেবিল। টেবিলের ওপাশে একটা বাঁকা পায়াওয়ালা চেয়ারে বসে আছে মধ্যবয়স্ক একজন লোক। তার থুতনিতে অল্প দাড়ি। মাথায় বিড়েমতো সাদা কাপড়ের ঢাকা। চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ঘরটা অন্ধকর অন্ধকার। মশাল জ্বলছে।
ফ্রান্সিস এসব দেখছে, ততক্ষণে সর্দার ফ্রান্সিসদের সম্পর্ক যা জানে সব বলে চলেছে। সর্দার থামল। মিন দু-একবার মাথা নেড়ে ফ্রান্সিসদের দিকে তাকিয়ে স্পেনীয় ভাষায় বলল, তোমাদের কয়েদঘরে থাকতে হবে। আমার লোক যাবে। তোমাদের জাহাজ খানাতল্লাশি করা হবে। দেখা হবে তোমরা জলদস্যু লুঠেরার দল কিনা।
ফ্রান্সিস বলে উঠল, আমরা জলদস্যু, লুঠেরা নই। আমরা ভাইকিং জাতি। যারা শৌর্যে-বীর্যে আমাদের সঙ্গে পেরে ওঠে না তারাই আমাদের বদনাম দেয়।
ঠিক আছে তোমাদের কথা বিবেচনা করা হবে। মিন বলল।
জিতা এতক্ষণে চুপ করে দাঁড়িয়েছিল। এবার জিতার দিকে তাকিয়ে মিন বলল, জিতা আর কত চাবুকের ঘা খাবে। চাবুক খেতে খেতে তুমি তো মরেই যাবে। যদি বাঁচতে চাও তো বলো লকেট ঝোলানো সেই রানি তুহিনার রত্নহারটা কোথায়? জিতা কোনও কথা বলল না। চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মিন দরজার কাছে দাঁড়ানো এক রক্ষীকে ইঙ্গিত করল। রক্ষী চাবুক হাতে এগিয়ে এলো। মিনের ইঙ্গিতে জিতার গায়ে চাবুকের ঘা মারল। জিতার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠল। জিতার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ বেরিয়ে এলো। ফ্রান্সিস দু’হাত তুলে বলল, শাসক মিন দয়া করে চাবুক মারা বন্ধ করুন। আমি জানি সেই রত্নহার কোথায় আছে। মিন বেশ চমকে উঠল। বলল, তুমি কি করে জানলে? কোথায় সেই রত্নহার?
আপনাকে দেব সেই রত্নহার। কিন্তু তার আগে কথা দিন রত্নহার পেলে আপনি জিতাকে মুক্তি দেবেন। ফ্রান্সিস বলল।
সেসব পরে। আগে তো হারটা পাই। মিন বলল।
বেশ, ফ্রান্সিস বলল। তারপর জিতার কাছে গিয়ে বলল, জিতা, রত্নহারটা বেরকরো।
না। তুমি বিশ্বাসঘাতক। জিতা চেঁচিয়ে বলল।
ফ্রান্সিস মৃদুস্বরে বলল, আমাকে এখন যা খুশি বলতে পারো। কিন্তু হারটা দিয়ে দাও।জিতা কোমরের ফেট্টি থেকে হারটা বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস হারটা উঁচু করে হাত তুলে মিনকে দেখিয়ে বলল, এই নিন রত্নহার, লকেট ঝোলানো।
মিন টেবিলের ওপাশ থেকে ছুটে এসে হারটা নিল। হারটা দেখতে দেখতে হা হা করে হাসতে লাগল।
ফ্রান্সিস বলল, আপনি বলেছিলেন হারটা পেলে জিতাকে মুক্তি দেবেন।
তোমাদের কাউকে মুক্তি দেওয়া হবে না। আগে রানি তুহিনার গুপ্ত সম্পদ উদ্ধার করি–তারপর ভাবা যাবে। একটু থেমে ডাকল–এই সর্দার।সর্দার এগিয়ে এলো। মিন বলল, যা, এগুলোকে কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দে। সর্দার এগিয়ে এসে ফ্রান্সিসদের ইঙ্গিত করল।ফ্রান্সিসদের নিয়ে সর্দার কয়েকজন সৈন্যের সঙ্গে চলল কয়েদঘরের দিকে।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর হ্যারি ফ্রান্সিসকে বলল, ফ্রান্সিস, রত্নহারটা মিনকে দিয়ে দেওয়া কি ঠিক হল?
উপায় কী বলো। আর দিনদুয়েক চাবুক খেলেই জিতা মারা যেত। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি জিতার দিকে তাকাল। দেখল জিতা দেওয়ালে পিঠ দিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে। মাথাটা বুকের ওপর ঝুঁকে পড়েছে।
ফ্রান্সিস বলল, মিন রত্নহারটা পেয়েছে বটে, কিন্তু রত্নহারের লকেটে যে নকশাটা রয়েছে সেটা কোনওদিনই বুঝবে না। একটু থেমে ফ্রান্সিস বলল, আচ্ছা হ্যারি, লকেটটায় কী নকশাটা ছিল বলো তো!
হ্যারি বলল, একটা ফুল। চারটে পাপড়ি। মাঝখানে একটা রক্তপ্রবাল। ফুলগুলো নীল রঙের মিনে করা। পেছনটা সবুজ।
ঠিক বলেছ। ফ্রান্সিস বলল, এই চার পাপড়িওয়ালা ফুলটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। চলো তো জিতার কাছে বসি গে। দু’জনে জিতার কাছে এসে বসল।
ফ্রান্সিস জিতাকে একটু ধাক্কা দিয়ে ডাকল, জিতা। জিতা মুখ তুলে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল,আচ্ছা জিতা–ওই লকেটে ঝোলানো রত্নহারটা পুরুষানুক্রমে তোমাদের গয়নাগাঁটির সঙ্গেই ছিল। তোমদের পূর্বপুরুষ কেউ কি ওই লকেটের নকশাটা নিয়ে রানি তুহিনার গুপ্ত রত্নভাণ্ডার খোঁজেনি।
জিতা মাথা নাড়ল, না। তবে আমি প্রায় কুড়ি বছর ধরে ওই ফুলের নকশাটা নিয়ে ভেবেছি। কিন্তু কোনও কূলকিনারা পাইনি। বছর কয়েক আগে অরেস পাহাড়ের মধ্যে যে দুর্গ আছে সেখানে দেখলাম দেওয়াল কুঁদে আঁকা হয়েছে লকেটের ফুলের মতো ফুল।
বলো কী! ফ্রান্সিস চমকে সোজা হয়ে বসল।
হ্যাঁ, দেখেছি সেই ফুলের নকশা, জিতা বলল, কিন্তু সেই নকশায় ফুলের পাপড়ি তিনটে। কিন্তু লকেটে আছে চারটে পাপড়ি।ফ্রান্সিস চুপ করে একটুক্ষণ ভাবল। তারপর বলল, আচ্ছা তুমি বলেছিলে রানি তুহিনার মৃত্যু হয়েছিল ওই দুর্গে।
হ্যাঁ, পুরুষানুক্রমে আমরা এটাই শুনে এসেছি। জিতা বলল।
আচ্ছা, অরেস পাহাড়ের দুর্গ কোথায়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।
এই কয়েদঘরের পেছনে যে বনজঙ্গল শুরু হয়েছে সেই বনজঙ্গলের মাঝবরাবর রয়েছে সেই দুর্গ। শুনে আশ্চর্য হবে সেই দুর্গ মানুষের হাতে গড়া নয়, প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি। দেখলে বুঝবে। জিতা বলল।
হ্যারি বলল, অবাক কাণ্ড।ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল, ফুলের রহস্যের সমাধান আছে ওই দুর্গেই।
তা হলে তো ওই দুর্গে যেতে হবে। হ্যারি বলল।
হ্যাঁ এবার এখান থেকে পালানোর উপায়টা ভাবতেহবে। ফ্রান্সিস বলল। তারপর ফ্রান্সিস গিয়ে ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে পড়ল না। দুচোখ বুজে পালানোর পরিকল্পনা ছকতে লাগল।
তখন রাতের খাওয়াদাওয়া হয়ে গেছে। পাহারাদাররা তখন ঢঢং ঢং শব্দ তুলে দরজা বন্ধ করে বারান্দায় পাহারা দিতে শুরু করেছে।
রাত বাড়তে লাগল। একসময়ে ফ্রান্সিস বিছানা থেকে উঠল। লোহার দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দেখল দু’জন পাহারাদার বারান্দায় বসে আছে। ভাল করে চারদিক দেখে বুঝল আজ পাহারাদার দু’জনই। দূরে মিনের বাড়ির সামনে কিছু সৈন্যের জটলা।
ফ্রান্সিস ফিরে এসে জিতার কাছে এলো। ঠেলে জিতার ঘুম ভাঙাল। জিতা বলে উঠল, কী ব্যাপার? ফ্রান্সিস মুখে আঙুল ছোঁয়াল। বলল, আস্তে। যা বলছি তাই করো।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল, আমার সঙ্গে এসো। ফ্রান্সিস চলল ঘরের কোণার দিকে, যেখানে বাবার বন্দিরা ঘুমিয়ে আছে সেইদিকে। সেখানে এসে জিতাকে বলল, ওদের ঘুম ভাঙাও। সাবধান, কেউ যেন চেঁচামেচি না করে। তারপর আমি যা বলব তুমি আরবি ভাষায় ওদের বুঝিয়ে বলবে।
দু’জন বার্বার বন্দিদের ঠেলেঠুলে ঘুম ভাঙ্গাতে লাগল। ফ্রান্সিস জিতাকে বলল, বলো যে, কেউ যেন চেঁচামেচি না করে।
যাদের ঘুম ভেঙে গেল, উঠেও বসল কেউ কেউ। জিতা ফিসফিস করে তাদের বলতে লাগল, সবাই চুপ করে থাকে। কেউ কোনও কথা বোলো না।
এবার ফ্রান্সিস বলল, খাবার জলের পিপেগুলোনাও। ওই পুব কোণা থেকে বিছানায় জল ছিটিয়ে দাও। জল একবারে বেশি ঢেলে দেবে না। আমি বিছানার পুব দিকটাতে মশাল ছুঁড়ে ফেলে আগুন লাগাব।
জিতা কথাগুলো আরবি ভাষায় ওদের বুঝিয়ে বলল।
ফ্রান্সিস সবশেষে বলল, দরজা যখন খোলা পাবে। তখন যে যেদিকে খুশি পালিয়ে যেও।
জিতা সব বুঝিয়ে বলল।
বার্বার বন্দিদের তখন ঘুম ভেঙে গেছে। ওরা সব শুনল। তারপর ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো জলের পিপেগুলো ধরাধরি করে নিয়ে এলো। ঘরে বিছানায় জল ছিটোতে লাগল। সব জল ছেটানো হল ফ্রান্সিস যেখানে মশাল জ্বলছে সেখানে এলো। মশালটা পাথরের খাঁজ থেকে তুলে নিয়ে পূর্ব দিকের কোণে ছুঁড়ে দিল। ঘাসের বিছানায় আগুন লাগল। কিন্তু আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল না। ঘাস ভেজা থাকায় আগুনের চেয়ে ধোঁয়াই হল বেশি। সেই ধোঁয়ায় কয়েদঘর ঢেকে গেল।
এবার ফ্রান্সিস বলে উঠল, সবাই চেঁচিয়ে বলো, আগুন, আগুন। জিতা ফ্রান্সিসের কথাটা বলল।
সবাই চিৎকার করে বলে উঠল, আগুন, আগুন।
পাহারাদার দু’জন ছুটে দরজার কাছে এলো। ওরা ধোঁয়া দেখল। তেমন আগুন দেখল না। ভালোভাবে দেখার জন্য একজন পাহারাদার অন্যজনকে বলল, চল তো দেখি কী ব্যাপার।
দু’জন তালা খুলে দরজা দিয়ে ঢু। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল, শাঙ্কো।
শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে একজন পাহারাদারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্যটির ওপর ফ্রান্সিস। পাহারাদার দু’জনেই ঘাসের বিছানার ওপর চিত হয়ে পড়ে গেল। হাতের তলোয়ার ছিটকে গেল। ওদিকে খোলা দরজা দিয়ে বার্বাররা পালাতে শুরু করল।
কয়েদঘরের চিৎকার চেঁচামেচি মিনের বাড়ির সামনে সৈন্যদের কানে গেল। তারা তলোয়ার উঁচিয়ে বর্শা তুলে এদিকে আসতে লাগল। বাবাররা তখন এদিকে-ওদিক দিয়ে পালাচ্ছে। সৈন্যরা তাদের পিছু ধাওয়া করল।
এবার ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কো ছুটে বাইরের বারান্দায় এলো। তারপর বারান্দা থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটল পেছনের বনজঙ্গলের দিকে। ঠিক তখনই কয়েদঘরের পেছন থেকে ছুটে এলো দু’জন সৈন্য। একজনের হাতে খোলা তলোয়ার, অন্যজনের হাতে বর্শা। চাঁদের আলোয় সবই দেখা যাচ্ছে। বনের প্রথম গাছটার কাছাকাছি ফ্রান্সিসরা ছুটে এসেছে তখন। পেছনের সৈন্যটি বর্শা ছুঁড়ে মারল। বর্শাটা শাঙ্কোর বাঁ পায়ের হাঁটুতে লেগে পড়ে গেল। শাঙ্কো থমকে দাঁড়াল। দেখল হাঁটুর কাছে বেশ কিছু জায়গা কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। ফ্রান্সিস ছুটে এসে শাঙ্কোকে ধরল। শাঙ্কো খোঁড়াতে খোঁড়াতে বনের দিকে ছুটল। তলোয়ার হাতে সৈন্যটি ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস দ্রুত সরে গেল। সৈন্যটা উবু হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে তলোয়ারটা তুলে নিল। সৈন্য দু’জনের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য তৈরি হল। তখনই শাঙ্কো বলে উঠল, ফ্রান্সিস, আরও সৈন্য আসছে, পালাও।
ফ্রান্সিস চাঁদের আলোয় দেখল–খোলা তলোয়ার হাতে চার-পাঁচজন সৈন্য ঘাসের প্রান্তর দিয়ে ছুটে আসছে।
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে পিছু ফিরল। তলোয়ার ফেলে দিয়ে শাঙ্কোর কাঁধে হাত দিয়ে নিয়ে চলল।জিতাও সুস্থ নয়। দু’জনকে প্রায় নিজের গায়ের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ফ্রান্সিস চলল। বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।
গভীর বন নয়। ছাড়া ছাড়া গাছপালা, ঝোপঝাড়, লতাপাতা। ফ্রান্সিস অনেক কষ্টে দু’জনকে ধরে ধরে নিয়ে ছুটতে লাগল। পেছনে সৈন্যদের হইহল্লা শোনা যাচ্ছে। সৈন্যদের সঙ্গে দূরত্ব কমে আসছে।
ফ্রান্সিস বুঝল, এই গতিতে ছুটলে সৈন্যরা কিছুক্ষণের মধ্যে ওদের ধরে ফেলবে। দৌড়োতেও অসুবিধা হচ্ছে। পায়ের গোড়ালি পচা পাতার স্কুপে ডুবে যাচ্ছে। ছাড়া ছাড়া গাছপালা। চাঁদের আলো পড়ছে এখানে-ওখানে। ফ্রান্সিস চারদিকে তাকাতে তাকাতে ছুটছে। পেছনে সৈন্যদের হইহল্লা কানে আসছে।
হঠাই ফ্রান্সিস দেখল ডানধারে কিছুদূরে একটা পাথরের টিলা। টিলার পেছনে আত্মগোপন করা যাবে। ফ্রান্সিস সেদিকেই ছুটল। টিলা ঘুরে ওপাশে গিয়ে দেখল, টিলায় একটা গুহামতো। গুহার মুখের কাছে এসে দেখল, গুহাটা খুব বড়ো নয়। তবে ওরা চারজন পরপর ঢুকে বসতে পারবে। ফ্রান্সিস তখন ভীষণ হাঁফাচ্ছে। হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, ছুটে পালাতে গেলে আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ে যাব। এই গুহায় আশ্রয় নিতে হবে। সাবধানে লুকিয়ে থাকতে হবে।
ফ্রান্সিস প্রথমে জিতাকে ধরে ধরে গুহায় ঢোকাল। জিতা তখন মুখ হাঁ করে শ্বাস নিচ্ছে। শাঙ্কো হাঁফাচ্ছে। ও নিজে নিজেই খোঁড়াতে খোঁড়াতে গুহায় ঢুকল। হ্যারিও ঢুকল। এবার ফ্রান্সিস ঢোকার আগে কান পাতল। সৈন্যদের হাঁকডাক খুব কাছেই শোনা যাচ্ছে। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়েই রইল। শুনল সৈন্যদের চিৎকার। হাঁকডাক ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ফ্রান্সিস গুহায় ঢুকে শুয়ে পড়ল। হ্যারি আর জিতা আগেই শুয়ে পড়েছে। শাঙ্কো বসে হাঁটুর কাটা জায়গাটা দেখছে। তখনও রক্ত পড়ছে।
জিতা চোখ বুজে টানা টানা সুরে বলল, তোমার কাটার ওষুধ–আমার পিঠের ঘা… সব চিকিৎসার ওষুধ… আমি জোগাড় করে… আনব… আমাকে একটু… বিশ্রাম করতে দাও।
পুব আকাশে লালচে রং ছড়ানো। একটু পরেই সূর্য উঠল। বনের গাছগাছলিতে নরম রোদ ছড়াল। পাখির ডাক শোনা গেল। গুহার মুখেও রোদ পড়ল। গুহাটার ধুলোটে মেঝেয় ফ্রান্সিসরা তখনও ঘুমোচ্ছে।
সকাল হল। পাখির ডাকাডাকিতে প্রথমে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙ্গে গেল। ও উঠে বসল। শাঙ্কোও উঠল। পায়ের দিকে তাকাল। কাটা জায়গাটা থেকে আর রক্ত পড়ছে না। যে রক্ত পড়েছিল সেটাই জমে কালচে হয়ে আছে। জিতাও উঠে বসল। বলল, তোমরা অপেক্ষা করো। আমি ওষুধ, খাবার নিয়ে আসছি।
ফ্রান্সিস বলল, আমি সঙ্গে যাব?
না, না, এখন আমার শরীর অনেকটা ভালো লাগছে।
জিতা বলল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে গুহার মুখ থেকে আস্তে আস্তে নেমে এলো। বনের গাছগাছালির নীচে দিয়ে জিতা চলে গেল। ফ্রান্সিস, শাঙ্কো আর হ্যারি অপেক্ষা করলে লাগাল।
বেলা বাড়ল। জিতা ফিরে এলো। ওর কোমরে লতাপাতা জড়িয়ে বাঁধা। হাতে একটা তরমুজ।
গুহায় এসে জিতা বলল, এই বনের বাঁদিকে বালি এলাকা। স্থানীয় লোকরা সেখানে তরমুজের চাষ করে। একটা পাকা দেখে তরমুজ নিয়ে এলাম। আগে সবাই তরমুজ খেয়ে নাও।
শাঙ্কো জামার নীচে হাত ঢুকিয়ে ওর ছোরাটা বের করল। তরমুজ কেটে সবাইকে ভাগ করে দিল। ওরা তরমুজ খেতে লাগল। খওয়ার পালা চুকল। জিতা কোমরে জড়ানো লতাপাতা আস্তে আস্তে খুলল। তারপর শাঙ্কোকে তিনটে পাতা দিল। বলল, মুখে ভরে দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করো। একটু তেতো লাগবে। শাঙ্কো পাতা তিনটে মুখে পুরল। দাঁত দিয়ে চিবোল। সত্যিই তেতো। চিবনো পাতার ছিবড়ে বের করল। জিতা সেটা নিয়ে শাঙ্কোর হাঁটুর কাটা জায়গাটায় আস্তে আস্তে টিপে টিপে লাগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কাটা জায়গাটায় যন্ত্রণা শুরু হল। শাঙ্কো মুখে শব্দ করল, উঃ।
একটু পরেই আরাম লাগবে। জিতা বলল। তারপর দুটো পাতা শাঙ্কোর কাটা জায়গায় আস্তে চেপে ধরে লতা দিয়ে বেঁধে দিল। একটু পরে সত্যিই শাঙ্কোর যন্ত্রণা কমে গেল। এবার জিতাও কয়েকটা পাতা চিবোল। বের করে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে সেই ছিবড়ে জিতার পিঠে চাবুকে কাটা জায়গাটা বসিয়ে দিল।
চারজন চুপচাপ গুহার মুখে বসে রইল।
এক সময় ফ্রান্সিস বলল, জিতা, অরেস পাহাড়ের দুর্গটা কতদূর?
জিতা বলল, আমরা সেই দুর্গের কাছাকাছি চলে এসেছি।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল, তা হলে দুর্গেই আমরা আশ্রয় নেব। আমার স্থির বিশ্বাস, রানি তুহিনার ধনরত্নের ভাণ্ডার ওই দুর্গেই কোথাও আছে।
বেশ চলো। জিতা উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস,শাঙ্কোও উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ধরে ধরে গুহা থেকে মাটিতে নামিয়ে আনল। জিতা উত্তরমুখো হাঁটতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিস, শাঙ্কো আর হ্যারি চলল।
দুপুর নাগাদ ফ্রান্সিসরা অরেস পাহাড়ের নীচে এসে দাঁড়াল। পাহাড়টা খুব উঁচু নয়। জিতা কয়েকটা এবড়োখেবড়ো পাথরের ধাপমতো পার হয়ে একটা গুহার সামনে এলো। ফ্রান্সিস, হ্যারি আর শাঙ্কোও এসে দাঁড়াল। কিন্তু গুহার মুখটা গোল নয়, চৌকোণা মতো। জিতা তার মধ্যে ঢুকল। পেছনে পেছনে ফ্রান্সিসরাও ঢুকল। কিছুদূর এগোতেই অন্ধকার হয়ে গেল চারদিক। যেতে যেতে জিতা বলল, পরে মশাল আনতে হবে। এবার তোমরা একটুক্ষণ দাঁড়াও। অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতে দাও। তারপরে অস্পষ্ট হলেও সব দেখতে পাবে।
ফ্রান্সিসরা অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সত্যি, তারপরে ওরা দু’পাশের এবড়োখেবড়ো পাথরের দেওয়াল আবছা আবছা দেখতে পেল। জিতা বলল, এবার এগিয়ে চলো। কিছুটা এগোতেই দেখল ডাইনে-বাঁয়ে দুটো ঘরের মতো, চৌকোণো নয়, গোল। বাঁদিকের ঘরমতো জায়গায় জিতা ঢুকল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। জিতা পেছন ফিরে বলল, দ্যাখো, গোলমতো দরজার ওপরে দেওয়ালে তিন পাপড়ির ফুল। ফ্রান্সিসও ফিরে তাকাল। আবছা দেখল, তিন পাপড়ির ফুল পাথরে কুঁদে তোলা। হুবহু লকেটের ফুলের মতো। শুধু একটা পাপড়ি নেই।
ওখানে থেকে বেরিয়ে এসে জিতা আবার গুহাপথে চলল। আবার ডাইনে-বাঁয়ে ঘরের মতো। সেই ঘরের মতো জায়গাটায় দরজার মাথায় দেখা গেল, সেই তিন পাপড়ির ফুল। এখানে গুহাপথ দু’পাশে চলে গেছে। সেইদিকে তাকিয়ে হ্যারি বলল, আশ্চর্য! প্রকৃতি নিজেই একটা দুর্গ তৈরি করেছে।
ওরা এখানে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। অসুস্থ জিতা, শাঙ্কো ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। সুস্থ হ্যারি আর ফ্রান্সিসও ক্লান্ত তখন। ফ্রান্সিস বলল, জিতা, মেঝেয় ধুলো পাথরকুচি নেই এমন একটা জায়গায় নিয়ে চলো।
তিন পাপড়ির ফুল খোদাই করা অন্য ঘরগুলো দেখবে না? জিতা বলল।
সেসব পরে হবে। এখন আমরা সবাই ক্লান্ত। খাদ্য চাই, বিশ্রাম চাই। ফ্রান্সিস বলল।
তা হলে রানি তুহিনার শয়নকক্ষে চলো। জিতা বলল।
জিতা ডানদিকের গুহাপথ দিয়ে চলল। পেছন পেছন ফ্রান্সিসরাও চলল। কিছুদূর গিয়ে বাঁদিকে একটা ঘরের মতো দেখল। সেটায় ঢুকল সবাই। এই ঘরমতো জায়গায় মেঝেটা অনেকটা পরিষ্কার, মসৃণও। ফ্রান্সিস পাথরের মেঝেয় বসে পড়ল। জিতা আর শাঙ্কো মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। হ্যারিও ক্লান্তিতে বসে পড়ল। জিতা টেনে টেনে বলল, লোকে বলে–এটা নাকি রানি তুহিনারশয়নকক্ষ ছিল। এই কক্ষেইনাকি রানি তুহিনার মৃত্যু হয়েছিল।অন্ধকারেইফ্রান্সিস ঘরটা ভালো করে দেখল।বু ঝল, মশাল বা মোমবাতি না হলে ঘরটা ভালোভাবে দেখা যাবে না।
বেশ কিছুক্ষণ সবাই শুয়ে-বসে বিশ্রাম করল। একসময় জিতা উঠে দাঁড়াল। বলল, এখন তোমরা কী করবে?
ফ্রান্সিস বলল, আমরা এখন দুর্গের মতো জায়গাটাতেই থাকব। বাইরে থাকলে মিনের সৈন্যদের নজরে পড়ে যেতে পারি। তা ছাড়া রানি তুহিনার গুপ্ত ভাণ্ডার তো এখানেই রয়েছে। তা তো খুঁজে বের করতে হবে। কাজেই কয়েকদিনের খাবারদাবার, জল, মশাল, চকমকি পাথর এসব তো লাগবে। দুটো কুড়ুলও আনতে হবে।
ঠিক বলেছ, জিতা বলল, কিন্তু এসব কিনতে তো মুদ্রা লাগবে। শাঙ্কো উঠে বসল। কোমরের ফেট্টিতে গোঁজা দুটো স্বর্ণমুদ্রা ফ্রান্সিসের দিকে এগিয়ে ধরল। মুদ্রা দুটো নিয়ে ফ্রান্সিস বলল, সাবাস শাঙ্কো।
ফ্রান্সিস আর জিতা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চলল গুহাপথ ধরে।
কাটা পায়ের যন্ত্রণা, ব্যথা নিয়ে শাঙ্কো শুয়ে রইল।হ্যারিশরীরের দিক থেকে বরাবরই দুর্বলক্লান্তিতে উত্তরদিকের দেওয়ালটায় ঠেস দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে রইল। এই দেওয়ালটা এবড়োখেবড়ো নয়। বেশ মসৃণ।
প্রায় তিন ঘণ্টা পরে ফ্রান্সিস আর জিতা ফিরে এলো। প্রয়োজনীয় সবই নিয়ে এসেছে ওরা। জিতা লতাপাতা এনেছিল। পাতা দাঁত দিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করে শাঙ্কোর কাটা জায়গায় আর নিজের পিঠে লাগল। তারপর তিনটে পাথর পেতে উনুন করল। বয়ে আনা কাঠকুটো উনুনে ঢোকাল। চকমকি পাথর ঠুকে আগুন জ্বালাল। রান্না শুরু করল। পাথরের দেওয়ালের খাঁজে রাখা ছিল একটা নেভানো মশাল।
ফ্রান্সিস মশালটা নিয়ে উনুনের আগুন থেকে মশালটা জ্বেলে নিল। হ্যারিকে বলল, চলো কয়েকটা গাছের ডাল কেটে আনি। ফ্রান্সিস মশালটা হ্যারির হাতে দিল। নিজে কুডুলটা নিল।
গুহাপথ দিয়ে হেঁটে দু’জনে মুখের কাছে এলো। বাইরে তখন দুপুর। গুহামুখে পাথরের খাঁজে মশালটা গুঁজে রেখে দু’জনে বনের মধ্যে ঢুকল।
খুঁজে খুঁজে কয়েকটা লম্বা ডাল ফ্রান্সিস কুড়ুল দিয়ে কাটল। তারপর মোটা শুকনো আর কঁচা লতাগাছদড়ির মতো পাকিয়ে নিল। দু’জনে ডালগুলো লতাগাছ নিয়ে গুহার মুখে ফিরে এলো।
মাটিতে ঝরে পড়া কিছু গোল বড়ো পাতাও নিল হ্যারি। গুহামুখে এসে মশালটা নিল। তারপর সে গুহাপথ দিয়ে চলল। রানির শয়নকক্ষে এসে দেখল–মশাল জ্বলছে। রান্না হয়ে গেছে। হ্যারি যে শুকনো গোল গোল পাতাগুলো এনেছিল সেসব পেতে দিল। আরও কিছুপাতা রেখে দিল। সকলেইক্ষুধার্ত তখন।পাতায় দেওয়া হল আটার মোটা মোটা পোড়া রুটি আর বুনো আলু আর সেদ্ধকরা শাকসবৃজি। সকলেই পেটপুরে তাই খেল।
খাওয়া সেরে ফ্রান্সিস ওই ঘরের মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে ভাবতে লাগল এই দুর্গে কোথায় রানি তুহিনা তার অলঙ্কারের পেটিকা গোপনে লুকিয়ে রেখেছেন? মৃত্যুশয্যায় তিনি জিতার পূর্বপুরুষকেলকেটসহ রত্নহার দিয়েছিলেন। রানি নাকি রত্নহার দিয়ে বলেছিলেন, চিহ্ন দিলাম, বুদ্ধি খাটাস-অলঙ্কার–অমূল্য। ফ্রান্সিস ভাবল, রানির অলঙ্কারের পেটিকা নিশ্চয়ই এই দুর্গে কোথাও গোপনে রাখা হয়েছে।
ফ্রান্সিসের একটু তন্দ্রমতো এসেছিল। তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল।ফ্রান্সিস উঠে বসল। তারপর কুডুলটা নিয়ে এলো যেখানে লম্বা গাছের ডাল দুটো রাখা হয়েছে সেখানে। লম্বা ডাল দুটো পাশাপাশি রাখল। এবার দুটো ডাল কেটে ছোটো ছোটো ফালি করল। তারপর ফালিগুলো লম্বা ডাল দুটোয় রেখে রেখে বুনো লতা দিয়ে বাঁধতে লাগল। শাঙ্কো, হ্যারি ফ্রান্সিসের কাছে এলো। হ্যারি বলল, মই বানাচ্ছ?
হ্যাঁ, তোমরাও হাত লাগাও। হ্যারিকে বলল। তিনজনে মিলে অল্পক্ষণের মধ্যেই একটা লম্বা মই বানিয়ে ফেলল।
ফ্রান্সিস এই ঘরটার চারদিকে তাকাল। আশ্চর্য! এই ঘরের কোনও দেওয়ালেই তিন পাপড়ির ফুল খোদাই করা নেই। ফ্রান্সিস মই কাঁধে নিল। কুড়ুলটা শাঙ্কো হাতে নিল। ফ্রান্সিস বলল, না,শাঙ্কো, তুমি বিশ্রাম করো। বেসি হাঁটাহাঁটি করলে আবার রক্ত পড়া শুরু হতে পারে। বরং হ্যারি আসুক।
ফ্রান্সিস মই কাঁধে চলল। পেছনে হ্যারি মশাল আর কুড়ুল হাতে চলল। একটা ঘরে ঢুকল। দেখল, পাথরের দেওয়ালে তিন পাপড়ির ফুল খোদাই করা ফ্রান্সিস সেই দেওয়ালে মই পাতল। তারপরে হ্যারির হাত থেকে কুড়ুলটা নিয়ে মই বেয়ে বেয়ে ফুলটার কাছে। চলে এলো। তিন পাপড়ির ফুলটা ভালোভাবে দেখল। বুঝল, আলাদা কোনও পাথরের পাটায় ফুলের নকশা কুঁদে তুলে এখানে বসানো হয়নি। পাথরের একবোখেবড়ো দেওয়ালেই কুঁদে নকশাটা তোলা হয়েছে।
এবার ফ্রান্সিস ফুলের নকশার ওপর কুড়ুল চালাল। বেশ কয়েকবার কুড়ুলের ঘা মারল নকশাটার ওপর। নাঃ, ফাঁপা শব্দ হচ্ছে না। বোঝা গেল, ফুলের নকশাটা কঠিন পাথরের দেওয়ালে কুঁদে কুঁদে তোলা হয়েছে। ফ্রান্সিসের কুড়ুলের ঘা খেয়ে নকাশার দুটো পপড়ি ভেঙে গেছে। ফ্রান্সিস ভাবল, নাঃ এখানে কঠিন পাথরের মধ্যে কোনও খোঁদল নেই। কাজেই এখানে রানি তুহিনার গুপ্ত সম্পদ নেই।
মই থেকে নেমে ফ্রান্সিস হ্যারিকে বলল, ভেবেছিলাম তিন ফুলের নকশা যেখানে খোদাই, রানি তুহিনার অলঙ্কারের পেটিকা সেখানে রাখা হয়েছে। দেখছিঅনুমান ভুল।
তা হলে অন্য ফুলের নকশা দেখে লাভ কী? হ্যারি বলল।
ফ্রান্সিস মাথা নেড়ে বলল, না, না, প্রত্যেকটি তিন ফুলের নকশায় ঘা মেরে দেখতে হবে। দু’জনে চলল অন্য ঘরে। ভাবে সবক’টা ঘরে যেখানে তিন ফুলের নকশা পেটিকার কুড়ুলের ঘা মেরে ফুলের নকশা। খোদাই করা আছে, সব কটাতেই কুড়ুলের ঘা মেরে ফ্রান্সিস বুঝল, কোনওটার পেছনের ফাপা খোঁদল নেই। কাজেই রানি তুহিনার অলঙ্কার পেটিকা ওসব জায়গায় নেই।
দু’জনে রানির শয়নকক্ষে ফিরে এলো। জিতা আর শাঙ্কো তখন বসে আছে। শাঙ্কো বলল, ফ্রান্সিস, কিছু হদিস করতে পারলে?
নাঃ। তবে সারা দুৰ্গটাই ভালোভাবে ঘুরে ঘুরে দেখতে হবে কোথায় খোদাই করা তিন ফুলের নকশা আছে! ফ্রান্সিস বলল।
ফ্রান্সিস মই, কুড়ুল রেখে মেঝেয় শুয়ে পড়ল। ক্লান্ত হ্যারি ওর পাশে বসল। ফ্রান্সিস চোখ বুজে ভাবতে লাগল রানি তুহিনা মৃত্যুর সময় বলেছিলেন, চিহ্ন দিলাম, বুদ্ধি খাটাস। চিহ্ন বলতে তো লকেটের চার পাপড়ির ফুলের নকশাটাই বোঝাচ্ছে। কিন্তু চিহ্ন হিসেবে পেলাম তিন পাপড়ির ফুলের নকশা। পাথুরে দেওয়াল কুঁদে তোলা ওই নকশাগুলোয় কুড়ুলের ঘা মেরে দেখেছি ওগুলোর পেছনে ফাপা কিছু নেই। অলঙ্কারের পেটিকা তো ওসব ফাঁপা জায়গায় থাকারই সম্ভাবনা বেশি।
জিতা হঠাৎ ধড়মড় করে উঠে বসল। ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল,কী হল জিতা? জিতা আস্তে আস্তে বলল, গুহাপথে এই দুর্গে কারা ঢুকেছে?
বলো কী! হ্যারি বলে উঠল।
হ্যাঁ, এই দুর্গে তো আমি অনেকদিন এসেছি, থেকেছি। রানি তুহিনার গুপ্ত অলঙ্কারের, ভাণ্ডারের খোঁজ করেছি। এই গুহার দুর্গে কোনও জায়গায় একটুশব্দ হলেই তো প্রতিধ্বনি হয় সারা দুর্গের পাথরের দেওয়ালে দেওয়ালে।
তুমি কি তেমন শব্দ পেয়েছ? ফ্রান্সিস বলল।
হ্যাঁ, তোমরাও কান পাতো, প্রতিধ্বনির শব্দ শুনতে পারবে। জিতা বলল।
ফ্রান্সিসরা কান পাতল। খুব ক্ষীণ শব্দ শুনল। পায়ে চলার শব্দ। ফ্রান্সিস বলল, শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু কে বা কারা এখানে ঢুকল?
খুবই সহজ। জিতা বলল, যার কবজা থেকে তোমরা বুদ্ধি খাঁটিয়ে পালিয়েছ।
তার মানে মিন। হ্যারি বলল।
হ্যাঁ, ওর সৈন্যরাই আমাদের পিছু ধাওয়া করেছিল। জিতা বলল।
ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে দাঁড়াল। বলল, আমাদের পালাতে হবে।
জিতা মাথা এপাশ-ওপাশ করে বলল, পালানোর কোনও উপায় নেই। এই দুর্গ। থেকে ঢোকার আর বেরনোর গুহাপথ একটাই। অন্য কোনও পথ নেই।
তা হলে তো আমাদের এখানেই অপেক্ষা করতে হয়। ফ্রান্সিস বলল।
ঠিক আছে। আমরা অপেক্ষা করব। হ্যারি বলল।
শাঙ্কো বলল, আচ্ছা জিতা, এখানে আত্মগোপন করে থাকা যায় এমন কোনও জায়গা নেই।জিতা মাথা নেড়ে বলল, না,সব ঘরের সঙ্গে গুহাপথের যোগ আছে।
হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস একটা কথা ভেবেছ?।
যদি মিন তার সৈন্যদের নিয়ে আসে, আর যদি আমাদের হত্যা করতে আসে, তা হলে নিরস্ত্র আমাদের মৃত্যু ছাড়া গতি নেই।
তা ঠিক, ফ্রান্সিস বলল, তবে মিনের সামনে লোভনীয় প্রস্তাব দেব। তখন মিন আমাদের একেবারে মেরে ফেলবে না। এখন দেখা যাক, কে বা কারা আসছে।
চারজনেই কান পাতল। এবার কয়েকজন লোকের পায়ের শব্দ শোনা গেল। পদধ্বনি এগিয়ে আসতে লাগল। গুহাপথের পাথুরে দেওয়ালে মশালের আলো পড়ল। সেই আলো এগিয়ে আসতে লাগল। রানি তুহিনার শয়নকক্ষের সামনে এসে দাঁড়াল মিন। সঙ্গে দশ-পনেরোজন সৈন্য। মিনের ঘর্মাক্ত মুখে মশালের আলো কাঁপছে।
ফ্রান্সিস উচ্চকণ্ঠে বলে উঠল, আমরা নিরস্ত্র। আপনি ইচ্ছে করলেই আমাদের হত্যা করতে পারেন। আমরা বাধা দেওয়ার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করতে পারব না।
মিন একটু হাঁফাতে হাঁফাতে বলল, তোমরা কয়েদঘর থেকে পালালে কেন?
নিজেদের জীবন রক্ষা করতে। ফ্রান্সিস বলল।
এখনই তোমাদের জীবন শেষ করে দিতে পারি, তা জানো? মিন বলল।
সে কথা তো আগেই বললাম। ফ্রান্সিস বলল।
না, তোমাদের হত্যা করব না। তোমাদের বাঁচিয়ে রাখব। ক্রীতদাস কেনাবেচার ব্যবসায়ীরা আসে। তাদের হাতে তুলে দেব। ভালো দাম পাওয়া যাবে। মিন বলল।
ফ্রান্সিস বলল, রানি তুহিনার যে রত্নহার আপনি পেয়েছেন তার লকেটে রানি যে নকশা মিনে করিয়েছেন সেটার সমাধান করতে পারলেই রানির অলঙ্কার ভাণ্ডার উদ্ধার করা যাবে।
এ-কথা আমার দুই পণ্ডিতও বলেছে। মিন বলল।
তারা কি সমাধান করতে পেরেছেন। ফ্রান্সিস বলল।
না, তবে সমাধান করতে পারবে। মিন বলল।
তা হলে তো ভালোই। তবে আমাদের যদি বন্দি না করেন তবে আমরা রানির গুপ্তভাণ্ডার উদ্ধারের চেষ্টাকরতে পারি। ফ্রান্সিস বলল।
কোনও প্রয়োজন নেই। আমার পণ্ডিতেরাই পারবে। পণ্ডিতরা পঞ্চশজন সৈন্য নিয়ে রানি তুহিনার ভগ্ন প্রাসাদের পাথর সরাচ্ছে। দিনকয়েক লাগবে সব ধ্বসংস্তূপ সরাতে। তারপর পণ্ডিতরা ওখানে রানির ভাঙ্গা,সভাঘরে রানির অন্তঃপুরে ঘরগুলোয় অনুসন্ধান চালাবে। মনে হয় রানির গুপ্তভাণ্ডার ওরা সন্ধান করতে পারবে। মিন বলল। তারপর সর্দারের দিকে তাকিয়ে বলল, এই সবকটাকে নিয়ে চল, কয়েদঘরে আটকে রাখবি।
সর্দার এগিয়ে এলো। সৈন্যদের আঙুল তুলে ইঙ্গিত করল। সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের ঘিরে দাঁড়াল। সর্দার বলল, সবাইকে নিয়ে চল।
ফ্রান্সিসরা চলা শুরু করল। ফ্রান্সিস বলল, হ্যারি, মিন আমার প্রস্তাবে সাড়া দিল না। পণ্ডিতদের ওপরেই ওর বিশ্বাস বেশি। পণ্ডিতেরা ভাঙ্গা প্রাসাদে কিছুই পাবে না।
এখন কী করবে?
বন্দিদশা মেনে নেব। আমার বন্ধুরা তো মুক্ত রয়েছে। ওদের কাছে আমাদের বন্দিদশার কথাটা পৌঁছে দিতে হবে। ওরাই যা করার করবে। ফ্রান্সিস বলল।
তা হলে তো মিনের সৈন্যদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে হবে। হ্যারি বলল।
প্রয়োজনে লড়াই তো হবেই। তবে মিনের সৈন্যদের মাথায় থাকবে শিরস্ত্রাণ বুকে বর্ম। আমার বন্ধুদের সেসব থাকবে না। তাই লড়াইটা যদি হয় তা হলে আমাদের পক্ষে কঠিনই হবে। ফ্রান্সিস বলল।
গুহাপথ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সবাই বাইরে এসে দাঁড়াল।
তখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। মিনের ঘোড়া দাঁড়িয়েছিল। মিন সর্দারকে ডেকে কিছু বলল। তারপর ঘোড়ায় চড়ে ছোটাল সিউতার দিকে।
এবার সৈন্যরা ফ্রান্সিসদের চারদিক ঘিরে নিয়ে চলল। ছাড়া ছাড়া গাছের বনের মধ্যে দিয়ে সবাই চলল। হেঁটে যেতে সবচেয়ে কষ্ট হতে লাগল শাঙ্কোর। তখনও ওর পায়ের ঘা শুকোয়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে ওকে।
ফ্রান্সিস সর্দারের কাছে এলো। সর্দার কিছু বুঝে ওঠার আগেই ফ্রান্সিস ওর খাপ থেকে এক হঁচকা টানে তলোয়ারটা খুলে আনল। অমনই দু’তিনজন সৈন্য তলোয়ার খুলে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস বাঁ হাতটা তুলে ওদের শান্ত থাকতে বলল। একটা লম্বা ডালওয়ালা গাছের কাছে গেল। তলোয়ারের এক কোপে একটা লম্বা ডাল কাটল। ডালটার পাতা হেঁটে শাঙ্কোকে দিল। শাঙ্কো ভর দেওয়ার মতো ডালটা পেয়ে খুশি হল। ডালে ভর দিয়ে হাঁটতে ওর কষ্ট কম হল। ফ্রান্সিস তলোয়ারটা সর্দারকে ফিরিয়ে দিল।
বন পার হওয়ার আগেই সন্ধে নামল। অন্ধকারে চলল ওরা। একটু পরেই গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের আলো পড়ল ঘাসে ঢাকা মাটিতে।
বন শেষ হল। চাঁদের আলোয় দেখা গেল সিউতার বাড়িঘর। সর্দার ফ্রান্সিসদের নিয়ে এলো কয়েদঘরের সামনে। পাহারাদার ঢং ঢ্যাং শব্দ তুলে লোহার দরজা খুলল। ফ্রান্সিসদের প্রায় ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে দিল। গাছের ডালে ভর দিয়ে চলা শাঙ্কো সেই ধাক্কায় প্রায় ছিটকে পড়ল মেঝেয় ওপর। সঙ্গে সঙ্গে ফ্রান্সিস পেছন ফিরে সৈন্যদের একজনকে জামা ধরে টেনে এনে ঘরে ঢোকাল। তখনও দরজা বন্ধ হয়নি। তিন-চারজন সৈন্য সঙ্গে সঙ্গে কোমর থেকে তলোয়ার খুলে ফ্রান্সিসের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্যত হল। হ্যারি দু’হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, ফ্রান্সিস, শান্ত হও। ফ্রান্সিস এক মুহূর্ত ভাবল। তারপরে সৈন্যটির জামা ছেড়ে দিল। ততক্ষণে শাঙ্কো উঠে দাঁড়িয়েছে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে ধরে ধরে ঘাসের বিছানায় বসিয়ে দিল। পাহারাদাররা ঠং শব্দ করে দরজা বন্ধ করল। তালা লাগল।
দুটো মশাল জ্বলছে, তবু ঘরের এদিকে-ওদিকে অন্ধকার কাটেনি। এমনই অন্ধকার কোণ থেকে একজন লোক ফ্রান্সিসের দিকে আসতে লাগল। ফ্রান্সিস বিছানায় বসতে যাবে, তখনই লোকটা ডাকল, ফ্রান্সিস।
ফ্রান্সিস মুখ ফেরাতেই দেখল, বিস্কো সামনে দাঁড়িয়ে। ফ্রান্সিস অবাক। সে বলে, উঠল, বিস্কো, তোমরা বন্দি হলে কী করে?
সব বলছি, তার আগে এদিকে এসো। রাজকুমারী মারিয়া ভীষণ মুষড়ে পড়েছেন। বিস্কো বলল। তারপরে ঘরের ডানদিকে চলল। ততক্ষণে হারি আর শাঙ্কো উঠে দাঁড়িয়েছে। সবাই চলল বিস্কোর পেছনে পেছনে। দেওয়ালের কাছে গিয়ে দেখল, পাথরের দেওয়ালে ঠেস দিয়ে মারিয়া চোখ বুজে বসে আছে। মারিয়ার কাছে পাঁচজন বন্ধু বসে আছে। মারিয়ার চোখমুখ শুকনো।মাথার চুলও উসকোখুসকো। মারিয়া বেশ রোগা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিসের মন কেঁদে উঠল। ও দ্রুত বসে মারিয়ার ডান হাতটা ধরল। না, গা গরম নয়। ফ্রান্সিস আস্তে ডাকল, মারিয়া।
মারিয়া চোখ মেলে তাকাল। ফ্রান্সিসকে দেখে মারিয়ার ভয়ার্ত স্বরে বলে উঠল, তোমরাও বন্দি হলে?
হ্যাঁ, পালিয়েছিলাম কিন্তু পরে ধরা পড়েছি। ওসব পরে শুনবে। তোমার শরীর ভালো তো?
মারিয়া হেসে বলল, তুমি এসেছ। এবার আমি একেবারে ভালো হয়ে যাব।
ফ্রান্সিস বিস্কোর দিকে তাকাল। বলল, তোমরা ধরা পড়লে কী করে?
বিস্কো বলল, প্রায় তিনদিন হতে চলল তোমরা ফিরে এলে না। তখন রাজকুমারী বললেন, চলো, আমরা কয়েকজন গিয়ে গোপনে ফ্রান্সিসদের খোঁজ করি। আমরা পাঁচজন আর একটা নৌকোয় চড়ে সমুদ্রতীরে এলাম। দেখলাম তোমাদের নৌকোটা মাটিতে তোলা আছে। বুঝলাম তোমরা এখানেই নেমেছিল। রাজকুমারী মানা করেছিলেন তাই আমরা তলোয়ার নিইনি। বিস্কো থামল। তারপর বলতে লাগল, বন্দরের কাছাকাছি একটা বাড়ির সামনে এলাম। ডাকাডাকি করলাম। একজন বৃদ্ধ বেরিয়ে এলো। বৃদ্ধের কাছেই জালালাম, এটা আলজিরিয়া আর এই বন্দর-শহরটির নাম সিউতা। বৃদ্ধের কাছে জানতে চাইলাম এখানে সে কয়েকজন বিদেশিকে দেখেছে কিনা। বৃদ্ধটি বলতে পারল না। অগত্যা আমরা খুঁজতে লাগলাম কয়েদঘরটা কোথায়? আমরা ঝোপজঙ্গ লের আড়ালে আড়ালে এখানে এলাম। এই বাড়িটা দেখে বুঝলাম, এটাই কয়েদঘর। বিস্কো থামল। তারপর বলতে লাগল, একটা ঝোঁপের আড়ালে সবাইকে রেখে আমি, একা এই কয়েদঘরের পেছনে এলাম। আমাদের দেশীয় ভাষায় চিৎকার করে বললাম, ফ্রান্সিস তোমরা কি বন্দি? তখন বেশ রাত। আমরা কথা বলা বেশ জোরেই শোনাল। কিন্তু তোমাদের কোনও উত্তর পেলাম না। ওখান থেকে পালিয়ে আসতে গিয়ে পারলাম না। আমরা পাঁচজন ধরা পড়ে গেলাম। বিস্কো চুপ করল।
ফ্রান্সিস বলল, তোমাদের এভাবে আসা উচিত হয়নি। মারিয়াকে বলল, তুমি এত ব্যস্ত হয়ে পড়লে কেন। নিজেই চলে এলে। যাকগে, কালকে মিনকে বলে তোমার জাহাজে থাকার ব্যবস্থা করব। তবে মনে হয় না মিন রাজি হবে। ততক্ষণে হ্যারি আর শাঙ্কোও সেখানে এসে বসে পড়েছে। হ্যারি বন্ধুদের কাছে বলতে লাগল কী ঘটেছে। এখানে।
তখন রাত হয়েছে। ঢটাং শব্দে দরজা খুলল। পাহারাদাররা খাবার নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসরা নিঃশব্দে খেয়ে নিল।
পরদিন সকালে ফ্রান্সিস পাহারদারকে বলল, সর্দারের সঙ্গে কথা আছে। সর্দারকে নিয়ে এসো।
একটু পরেই সর্দার এলো। ফ্রান্সিস মারিয়াকে দেখিয়ে বলল, ইনি আমাদের দেশের রাজকুমারী। এখানাকার এই কষ্টকর জীবন উনি সহ্য করতে পারবেন না। রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে বন্দি করে রাখো।
ঠিক আছে, এসব শাসক মিনকে বলবে। তিনি যা চাইবেন তাই হবে। সর্দার কথাটা বলে চলে গেল।
তিনদিন কেটে গেল। কয়েদর পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থায় কড়াকড়ি হল। আটজন প্রহরী রাখা হল। ফ্রান্সিস কিছুটা হতাশই হল। এত কড়া পাহারা এড়িয়ে পালানো অসম্ভব মনে হল। শুধু ফ্রান্সিস একা হলে হয়তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পালানো যেত। কিন্তু মারিয়া হ্যারিদের নিয়ে পালাতে গেল কেউ বাঁচবে না। এসব ভেবে ফ্রান্সিস খুব চিন্তায় পড়ল। ঘাসের বিছানায় শুয়ে ফ্রান্সিস এরকম সাত-পাঁচ ভাবছিল। হ্যারি কাছে এসে বসল। বলল, ফ্রান্সিস, কী করবে এখন?
কিছুই করার নেই। এই কয়েদঘর থেকে সবাইকেনিয়ে পালানো অসম্ভব। ফ্রান্সিস বলল।
হু, যেরকম পাহারা বসিয়েছে। হ্যারি বলল।
একমাত্র আশা, জাহাজ থেকে আমরা ফিরছি না দেখে বন্ধুরা যদি আসে। বন্ধুরা এলেও এই শিরস্ত্রাণ বর্মপরা সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে লড়াই করে কি আমাদের বন্ধুরা পারবে? ফ্রান্সিস বলল।
একথা সত্যি। কিছু বন্ধুর মৃত্যু হবেই। সৈন্যরা সুশিক্ষিত, সশস্ত্র। তুলনায় আমাদের বন্ধুদের একমাত্র অস্ত্র তলোয়ার। শাঙ্কো থাকলে তবু তিরধনুক কাজে লাগাতে পারত। হ্যারি বলল।
মারিয়া পাশেই বসেছিল। বলল, জাহাজের বন্ধুরা নিশ্চয়ই একটাই চিন্তা করবে মুক্তি হবে কী করে?
ফ্রান্সিসদের আরবী শাসকমিনের কয়েদখানায় একঘেয়ে দিন কাটাতে লাগল। ফ্রান্সিস প্রায় সারাদিনই ঘাসের বিছানায় শুয়ে থাকে। কত পরিকল্পনা করে পালানোর জন্যে। কিন্তু হিসেব করতে গিয়ে বোঝে সেসব পরিকল্পনা কার্যকরী হবে না। আরো বিপদ হয়েছে যে ফ্রান্সিসরা একবার পালিয়েছিল। কাজেই মিন কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেছে। কয়েদঘরের সামনে সারা দিনরাত চারজন করে প্রহরী মোতায়েন থাকে। তাদের হাতে থাকে খোলা তরবারি। রাতে বাড়তি আরো দু’জন সশস্ত্র সৈন্য কয়েদঘরের সামনের মাঠে ঘুরে বেড়ায়।
ফ্রান্সিসদের সঙ্গে আট-দশজন বাবার জাতির লোক বন্দী ছিল। সেদিন রাঁধুনিরা খাবার নিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে দুজন বাবার বন্দী দরজার ওফর ঝাঁপিয়ে পড়ল যাতে দরজা খোল অবস্থায় থাকে আর ওরা পালাতে পারে। কিন্তু প্রহরীরা খুবই তৎপরতার সঙ্গে লোহার দরজা বন্ধ করে দেয়। তাই বাবার বন্দী দু’জন পালাতে পারল না।
একজন প্রহরী চলে গেল। ফ্রান্সিস ভাবল হয়তো দু’জন বার্বারের কোনো শাস্তি হবে না। কিন্তু ফ্রান্সিস ভুল ভেবেছিল। কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এলো। হাতে চাবুক। প্রহরী দরজা খুলে দিল। সেনাপতি কয়েদঘরে ঢুকল। যে প্রহরীটি সেনাপতিকে খবর দিয়েছিল সে এগিয়ে গিয়ে সেই দু’জন বাবারকে দেখিয়ে দিল। সেনাপতি বার্বার দু’জনকে সামনে এগিয়ে আসতে বলল। বাবার দু’জন বুঝল কপালে দুঃখ আছে। দু’জন এগিয়ে গেল। সেনাপতি একটাকে সরিয়ে দিয়ে অন্যটার গায়ে চাবুক মারতে লাগল। বার্বারটি চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। সেনাপতির তখন চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। হাঁফাচ্ছে তবু চাবুকের মার বন্ধ করল না। হাঁফাতে হাঁফাতে সেনাপতি পরেরটাকে ধরল। তারপর চাবুক মারতে লাগল। এই বার্বারটি কাঁদল না মুখ বন্ধ করে চাবুকের মার খেতে লাগল। একটুক্ষণ পরে পরিশ্রান্ত সেনাপতি থামল। চাবুকটা পাকাতে পাকাতে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–আজকে এই পর্যন্ত। আবার পালাবার চেষ্টা করলে চাবুক মেরেনরকে পাঠাবো।
সেনাপতি এবার চারদিকে সব বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বলল–পালাতে চেষ্টা করলে সবার কাঁপালেই চাবুকের মার জুটবে। সেনাপতি চাবুকটা একজন প্রহরীকে দিল। বলল– রেখে দে। তারপর চলে গেল।
পরদিন রাতে চাবুকের মার খাওয়া একজন বাবার বন্দীর প্রচণ্ড জ্বর এলো। ওর সঙ্গীদের একজন ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বললো–আমাদের যে সঙ্গীটি চাবুকের মার খেয়েছে তার ভীষণ জ্বর এসেছে। একবার দেখে যান।- জ্বর আসাটা ভালো কথা নয়। কিন্তু আমি তো বৈদ্য নই। তবু চলো–দেখি।
ফ্রান্সিস অসুস্থ বন্দীটির কাছে এলো। কপালে গলায় হাত দিয়ে দেখল। বুঝল ভীষণ জ্বর এসেছে। ফ্রান্সিস কী বলবে কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ভেন তো আমাদের সঙ্গে নেই। কে চিকিৎসা করবে এই বাবার বন্দীটির? ফ্রান্সিস ফিরে এসে নিজের জায়গায় বসল। জিতাকে মারিয়াকে ঐ অসুস্থ বাবার বন্দীটির কথা বলল। জিতা বলল–আমি এর ওষুধ জানি কিন্তু আমি তো বন্দী। মারিয়া মুখ নিচু করে ফ্রান্সিসের সব কথা শুনল। তারপর নিজের পোশাকের রুলের দিক থেকে আধহাত খানেক কাপড় ছিঁড়ল। উঠে দাঁড়িয়ে চলল যেখানে পীপের মধ্যে খাবার জল রাখা হয়েছে সেখানে। একটা কাঠের গ্লাস নিল। জল ঢেলে নিয়ে চলল সেই বন্দীটির দিকে।
মারিয়া বন্দীটির পাশে বসল কপালে হাত দিয়ে বুঝল ভীষণ গরম। জলের গ্লাশটা রাখল। তারপর ছেঁড়া কাপড়টা জলে ভিজিয়ে নিল। বন্দীটির কপালে জলে ভেজা ঘেঁড়া কাপড়টা আস্তে চেপে ধরে রইল। কিছুক্ষণ রেখে আবার তুলল। একটু পরে আবার ভেজা কাপড়টা কাঁপালে রাখল। মারিয়া প্রায় আধঘণ্টা ধরে এইভাবে জলপট্টি লাগল। পরে কপাল মুছে কপালে হাত রাখল। কপালের গরম ভাবটা অনেকটা কম লাগল। এই অসুস্থ বন্দীটির সঙ্গে আর একজনকে যে চাবুক মারা হয়েছিল সে কিন্তু চুপ করে অসুস্থ বন্ধুটির পাশে বসে। জ্বালা যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করতে লাগল। মারিয়া তাকে বলল–আপনার বন্ধুটির জ্বর বেশ কিছুটা কমেছে।
–কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাবো-বার্বার যুবকটি বলল।
–সেসব পরে জানাবেন। এখন আপনার বন্ধুটি কিভাবে সুস্থ হবে সেই চেষ্টা করতে হবে। মারিয়া ফ্রান্সিসদের কাছে এসে বসল। ফ্রান্সিস বলল–ঐ বার্বার যুবকটি কেমন আছে?
–ভালোনা। প্রচণ্ড জ্বর ছিল। কপালে জলপট্টি দিয়ে কিছুটা জ্বর কমিয়েছি। আরও জলপট্টি দিতে হবে। মারিয়া বলল।
–তাই দিও। ফ্রান্সিস বলল।
রাতের খাওয়ার পর মারিয়া সেই অসুস্থ বাবার যুবকটির কাছে এলো। যুবকটির কপালে জলপট্টি দিতে লাগল।
একটু বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে মারিয়া সারারাত জলপট্টি দিল। ভোরের দিকে জ্বর কমল। কিন্তু জ্বর সেরে গেল না।
মারিয়া ফ্রান্সিসদের কাছে এলো। ফ্রান্সিস বলল
-কেমন আছে যুবকটি?
–জ্বর ছাড়েনি। তবে জ্বর কমেছে। মারিয়া বলল।
দুপুরবেলা যুবকটির জ্বর আবার বাড়ল। মারিয়া শুয়েছিল। সারারাত জেগে ছিল। একটু ঘুম ঘুম ভাব এসেছিল। সেই ভাবটা কেটে গেল একজন বাবার বন্দীর ডাকে। মারিয়া চোখ মেলে তাকাল। বাবার বন্দীটি বলল–আবার ওর জ্বর বেড়েছে। বন্ধুটি ভুল বকছে। আপনি যদি একবার আসেন।
ফ্রান্সিস উঠে বসল। বলল–মারিয়া–চলো–তোমরা সঙ্গে আমিও যাবো।
দুজনে অসুস্থ বন্দীটির কাছে এলো। বন্দীটি তখন প্রলাপ বকছে। বলছে–যে আমাকে চাবুক মেরেছে–কে সে? সেনাপতি আবার কে?মার মার সেনাপতিকে–আমি বাড়ি যাবো–কে ডাকছে? বাবা? আমি ভালো আছি–একটু জ্বর হয়েছে–সেরে যাবে। হা-পিঠে অসহ্য ব্যথা। মাঝে মাঝে সেই ব্যথা হাত পা বুকে ছড়িয়ে যাচ্ছে আমি বাড়ি যাবো।
ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। তারপর অসুস্থ যুবকটির কপালে হাত রাখল। গলায়। বুকে হাত বুলোল।মৃদুস্বরে বলল–শরীরটা আগুনের মতো গরম। তুমি এখানে থাকো। জলপট্টি দাও। জ্বরটা কমাও। নইলে–। ফ্রান্সিস আর কিছু বলল না।
মারিয়া কাঠের গ্লাসে জল নিয়ে এলো। ছেঁড়া কাপড়টা জলে ভিজিয়ে যুবকটির কপালে চেপে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস উঠল। চলে এলো নিজেদের জায়গায়। জিতাকে বলল অসুস্থ যুবকটির কথা। জিতা মন দিয়ে শুনল। তারপর বলল–যদি কালকেও জ্বর না সারে তবে জানবে যুবকটির বাঁচার আশা নেই।
পরদিনও যুবকটির জ্বর ছাড়ল না। মারিয়া কিছুক্ষণ পরপরই জলপট্টি দিতে লাগল। কিন্তু জ্বর কমার নাম নেই। সেই সঙ্গে যুবকটি সারা শরীর মোচড়াতে লাগল আর কিছুক্ষণ পরপরই প্রলাপ বকতে লাগল।
মারিয়া যুবকটির কষ্ট দেখতে পারছিল না। ও ফ্রান্সিসের কাছে এলো। বলল– তোমরা থাকতে যুবকটি বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে?ফ্রান্সিস বলল–মারিয়া সেনাপতির চাবুকের মার খেয়েই যুবকটি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই সেনাপতিকে ডেকে আনিয়ে অনায়াসে হত্যা করা যায়। কিন্তু তাহলে আমাকেও মরতে হবে। কাজেই সেটা করা যাবে না। সেনাপতিকে ডাকিয়ে আনতে পারি। সে কী বলবে তাও আমি জানি। সে বলবে কয়েদঘর থেকে পালাতে গেলে এই যুবকটির মতোই অবস্থা হবে আমাদের।
যাক গে–আমি সেনাপতিকে খবর পাঠাচ্ছি।
ফ্রান্সিস উঠে দরজার কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ডাকল। বলল–ভাই সেনাপতিকে খবর দাও। উনি যেন এখানে একবার আসেন। একজন বাবার যুবকের শরীরের অবস্থা খুব খারাপ।
–কার কথা বলছো? প্রহরটি বলল।
–যে যুবকটিকে সেনাপতি চাবুক মেরেছে তার শরীর খুব খারাপ ফ্রান্সিস বলল।
খুব ভালো হয়েছে–পালাতে গিয়েছিল কেন? প্রহরী বলল।
ফ্রান্সিসের রাগে মাথায় রক্ত উঠে গেল। তবুফ্রান্সিসশান্তস্বরে বলল–ভাইযুবকটি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেনাপতিকে খবর দাও।
–পারবো না। প্রহরীটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে উঠল। ফ্রান্সিস পরপর তিনজন প্রহরীকে একই অনুরোধ করল চতুর্থ প্রহরীটিকেও একই অনুরোধ করল। চতুর্থ প্রহরীটি বলল সেনাপতিকে ডেকে নিয়ে এসে কিছুই হবে না। উনি বলবেন–যা করেছি ঠিক করেছি। মরলে আমি কী করবো? সেনাপতিকে ডেকে কোনো লাভ নেই।
–লাভ লোকসানটা আমরা বুঝবো তুমি খবর দিয়ে আসতে বলল। ফ্রান্সিস বলল।
–বেশ–যাচ্ছি। প্রহরীটি বলল।
প্রহরী বারান্দা থেকে মাঠে নামল। তারপর চলল সেনাপতির বাড়ির দিকে।
ফ্রান্সিস বাকিতিনজন প্রহরীর দিকে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে শান্তস্বরে বলল তোমাদের ভাই বলে একটা অনুরোধ করেছিলাম। তোমরা শুনলে না। অনুরোধ রাখলে না। তোমাদের তিনজনকে হত্যা করা আমার কাছে কিছুই না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে তাহলে আমার বন্ধুদের বিপদ বাড়বে। কারণ তাহলে আমাকেও মরতে হবে। কিন্তু আমি এখন মরতে রাজি নই। আমাকে এখন বেঁচে থাকতেই হবে।
কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এলো। সেনাপতির মুখ দেখেই ফ্রান্সিস বুঝল সেনাপতি ক্রুদ্ধ। কয়েদঘরের দরজা খোলা হল। সেনাপতি ঘরে ঢুকল। চারদিকে বন্দীদের দিকে তাকিয়ে বলল কী হয়েছে? কী বলতে চাও তোমরা? সবাই শুয়ে বসেছিল। কেউ কোনো কথা বলল না। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। বলল–মাননীয় সেনাপতি মহাশয় গত পরশু যে দুজন বাবার বন্দীকে আপনি চাবুক মেরেছিলেন তাদের একজন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বোধহয় বাঁচবে না। তার চিকিৎসার জন্যে আপনাকে অনুরোধ করছি।
-কই সেই বন্দী? সেনাপতি বলল।
ফ্রান্সিস ঘরের কোণার দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল–ঐ দিকে যান। দেখতে পাবেন।
সেনাপতি সেদিকে গেল। মারিয়া তখন যুবকটির কপালে জলপট্টি দিচ্ছিল। সেনাপতি অসুস্থ যুবকটিকে দেখল। নিচু হয়ে নির্জীব উবু হয়ে শুয়ে থাকা বাবার যুবকটির কপালে গায়ে হাত দিল। বুঝল–প্রচণ্ড জ্বর হয়েছে। গা পুড়ে যাচ্ছে। সেনাপতি মাথা তুলে বলল–কয়েদঘর থেকে পালাবার শাস্তি এটা। আমার কিছু করার নেই।
ফ্রান্সিস বলল–ঠিক আছে। শুধু ওর জন্যে একজন বৈদ্য পাঠান।
–না। সেনাপতি চেঁচিয়ে উঠল–এভাবেই মরুক। ফ্রান্সিস বসা অবস্থা থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে হ্যারিও উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের হাত ধরল। গলা চড়িয়ে ডাকল–শাঙ্কো। শাঙ্কো ছুটে এলো। ফ্রান্সিসকে ধরল। ফ্রান্সিসের চোখে জল এলো। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস-ক্রুদ্ধ হয়ো না। নিরস্ত্র আমরা বিপদ হতে পারে।
ফ্রান্সিস দাঁত চাপাস্বরে বলল–এই কয়েদঘর থেকে কোনোদিন মুক্তি পেলে তোমাকে আমি যখন যে অবস্থায় পাবো তোমাকে আমি হত্যা করবো। এই আমার প্রতিজ্ঞা।
সেনাপতি একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ফ্রান্সিস চোখ মুছতে মুছতে বসে পড়ল। হ্যারি আর শাঙ্কো ফ্রান্সিসের পাশে বসল। কেউ কোনো কথা বলল না।
মারিয়ে ছুটে এলো। বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবে?–সবই তো শুনলে। যুবকটিকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে। আমরা কিছুই করতে পারবো না।
মারিয়া বসে পড়ল। তারপর দু হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফ্রান্সিসরা। কেউ কোনো কথা বলল না।
তখন গভীর রাত। যুবকটি শরীর এপাশ-ওপাশ করে মোচড়াচ্ছে। ফ্রান্সিস আর মারিয়া পাশে বসে আছে। মারিয়া যুবকটির কপালে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
হঠাৎ যুবকটি উঠে বসল। অস্ফুটস্বরে কী বলল। তারপর বিছানায় পড়ে গেল। শরীরের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল। যুবকটি মারা গেল। মারিয়া মৃত যুবকটির মুখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিস শাঙ্কো হ্যারি মাথা নিচু করে রইল। ওদের চোখেও জল। আজ ওরা অক্ষম। যুবকটিকে বাঁচাতে পারল না।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে এলো। একজন প্রহরীর দিকে তাকিয়ে বলল–শুনে যাও। প্রহরীটি এগিয়ে এলো। বলল, কী ব্যাপার?
–একজন বার্বার বন্দী মারা গেছে। তাকে কবর দেবার ব্যবস্থা করো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাহলে তো সেনাপতিকে খবরটা জানাতে হয়। প্রহরীটি বলল।– যাও। জানিয়ে এসো। ফ্রান্সিস বলল।
প্রহরীটি চলে গেল। ফ্রান্সিস ফিরে এসে বসল। ফ্রান্সিসরা কেউ কোনো কথা বলছে না। চুপ করে আছে।
কিছু পরে ফ্রান্সিস বলল–হ্যারি। হ্যারি ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–একটা সম্ভাবনার কথা ভাবছি। যদি সেনাপতি মৃতদহ কবর দেবার দায়িত্ব আমাদের দেয় তাহলে আমরা বাইরে যেতে পারবো। সুযোগ বুঝে পালাতেও পারবো।
–কিন্তু রাজকুমারীকে রেখে আমরা কী করে পালাবো? হ্যারি বলল।
হা–এই একটা ভুল আমরা করেছি। মারিয়াকে আমাদের জাহাজে গিয়ে রাখতে মিনকে বলেছিলাম। পরে ঐ ব্যাপারে আর চেষ্টা করিনি। ঐ ভুলের খেসারত দিতে হচ্ছে।
প্রহরীটি ফিরে গেল। দরজার কাছে এসে বলল–সেনাপতি বললেন–কয়েদী মারা গেলে অন্য কয়েদীর দল মৃতদেহ কবর দেবে। তোমাদের মধ্যেই সাতজনকে ছাড়া হবে। তারাই ঐ থর্ন বনে গিয়ে মৃতদেহ কবর দেবে। তোমাদের মধ্যে সাতজন এগিয়ে এসো। ফ্রান্সিস যা ভেবেছিল তাই হল। ফ্রান্সিস শেষ চেষ্টা করল। প্রহরীকে বলল আমাদের রাজকুমারীও আমাদের সঙ্গে যাবে।
–না! রাজকুমারীকে ছাড়া চলবে না। রাজকুমারী পালিয়ে গেলে আমাদের গান যাবে। তাছাড়া রাজকুমারী এখানে বন্দী আছে বলেই তোমরা আমাদের কজার আছে।
হ্যারি বলল–একটা কফিন তো লাগবে। একজন পাদ্রীকেও তো চাই।–তোমরা কয়েকজন এসো। কফিন আনতে হবে। পাদ্রী ফাদ্রী এই রাতে আর পাওয়া যাবে না। জিতা ঘুমোয়নি। প্রহরীর কথাটা ওর কানে গেল। জিতা গলা চড়িয়ে বলল–ফ্রান্সিস পাদ্রীর কাজ আমিই করবো। পাদ্রীরা বাইবেলের যে জায়গাটা বলে সেই জায়গাটা আমার মুখস্থ। বাইবেলও লাগবে না।
ফ্রান্সিস শাঙ্কোরা এখন কয়েদঘর থেকে বেরোচ্ছে তখন কয়েকজন বাবার বন্দী এগিয়ে এলো। বলল–আপনারা আমাদের বন্ধুর জন্যে যা করেছেন তা তো আমরা দেখেছি। আপনারা বিশ্রাম করুন। আমরা যাচ্ছি।
কথাটা প্রহরীর কানে গেল। প্রহরীটি বলল না। তোমাদের ছাড়া যাবে না। তোমরা যাবে না। বাবার সৈন্যটি বলল–আমরা আমাদের বন্ধুকে কবরও দিতে পারবো না?
–না। এই ভাইকিংরা সব করবে। ফ্রান্সিস বার্বারদের দিকে তাকিয়ে বলল—
–তোমরা নাই বা যেতে পারলে। আমরা সব করবো। তোমাদের চিন্তার কিছু নেই।
প্রহরীর শুনে শুনে সাতজন ভাইকিংকে কয়েদঘর থেকে বেরোতে দিল। ফ্রান্সিস প্রহরীদের বলল–আর একজনকে যেতে হবে। পাদ্রীর কাজ করবে।
–বেশ। যে পাদ্রীর কাজ করবে তাকে ডাকো। প্রহরীটি বলল।
–জিতা। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল। জিতা কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
–জিতা তুমিও চলো। পাদ্রীর কাজ করবে। ফ্রান্সিস বলল।
–ঠিক আছে চলো। সর্দারটি বলল।
তিনজন প্রহরীও খোলা তলোয়ার হাতে ওদের সামনে যেতে লাগল। এক সর্দার গোছের প্রহরী বলল–প্রথমে আমরা কফিন আনবো। এত লোকের দরকার নেই। কয়েকজন ভাইকিং কয়েদঘরে সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল।
বাকিরা চাঁদের আলোয় প্রান্তরের ওপর দিয়ে চলল। দু’জন সৈন্য দুটো মশাল নিয়েছে। শুধু তাদের হাতেই তলোয়ার নেই। প্রাসাদের এক কোণায় একটা ঘর তালাবদ্ধ। সর্দারটি কোমরের বন্ধনি থেকে চাবি বের করল। দরজা খোলা হল।
ঘরটার ভেতরে ঢুকল সবাই। মশালের আলোয় দেখা গেল অনেক কফিন ছিটিয়ে ছড়িয়ে রাখা। সৈন্যরা কফিনগুলো থেকে একটা কফিন বের করল। কফিনের কাঠ কি ভেঙ্গে গেছে। আবার খোঁজ শুরু হল। ফ্রান্সিসরাও হাত লাগাল। একটা মোটামুটি ভালো কফিন পাওয়া গেল। শাঙ্কো খুঁজে বের করল সেটা।
কফিনটা নিয়ে বাইরে এলো সবাই। ঘরটার তালা ঝুলল। সবাই ফিরে চলল কয়েদঘরের দিকে।
প্রান্তর পার হয়ে সকলে কয়েদঘরের সামনে এলো। কয়েদঘরের সামনে এসে সর্দার বলল–কফিন বারান্দায় রাখো। মড়া বের করে কফিন রাখো। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন যুবকটির মৃতদেহ কয়েদঘর থেকে নিয়ে এলো। কফিনে শুইয়ে দিল।
সর্দারটি জোর গলাই বলল–কফিন থর্ন বনের দিকে নিয়ে চলো।
ফ্রান্সিসরা কফিন কাঁধে নিল। চলল বনের দিকে। তখনই দুটো বেলচা নিয়ে একজন সৈন্য ছুটে এলো। হাঁপাচ্ছে তখন।
সকলে কিছুপরে বনভূমির কাছে পৌঁছল। সর্দার বলল–বনে ঢোক। সবাই কফিনটা নিয়ে বনের মধ্যে ঢুকল।
গাছ-গাছালির মধ্যে দিয়ে কফিন কাঁধে নিয়ে চলল সবাই। অন্ধকার খুব একটা বেশি নয়। ছাড়া ছাড়া গাছ-গাছালি বলে কোথাও কোথাও মাটিতে গাছের গায় চাঁদের ভাঙ্গা আলো পড়েছে।
কিছুদূর গিয়ে সর্দার বলল–থামো। সেখানেই দাঁড়াল সবাই। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে সর্দার একটা বুনো গাছের তলায় দাঁড়াল। গলা চড়িয়ে বলল–এখানে কবর খোঁড়।
ফ্রান্সিস সৈন্যের হাত থেকে বেলচাটা নিল। এগিয়ে গিয়ে গাছটার কাছে মাটিতে বেলচা চেপে ঢোকাল। আর এক ভাইকিংবন্ধু অন্য বেলচাটা নিল। মাটি খুঁড়তে লাগল।
বেশ কিছুক্ষণ খোঁড়া চলল। শাঙ্কো বিস্কোও হাত লাগাল।
একটা বড়ো গর্ত হল। ফ্রান্সিসরা কয়েকজন মিলে কফিনটা গর্তের কাছে নিয়ে এলো। দু’জন ভাইকিং গর্তটায় নামল। ওপর থেকে ফ্রান্সিসরা কফিনটা আস্তে আস্তে ধরে ধরে গর্তটায় নামাল। দুই বন্ধু নিচ থেকে ধরে ধরে কফিনটা গর্তের মধ্যে নামাল।
দুই বন্ধু উঠে এলো। গর্তটা ঘিরে দাঁড়াল সবাই। জিতা মৃদুস্বরে বাইবেল থেকে গরগর করে মুখস্থ বলে গেল। কবরে মাটি ফেলা শুরু হল। ফ্রান্সিসরা আগে একমুঠো করে মাটি কবরে ফেলল। তারপর সবাই মাটি ফেলল। এবার বেলচা দিয়ে মাটি ফেলতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যে কবরের গর্ত মাটিতে ঢেকে গেল। বিস্কো একটা লম্বা গাছের ডাল ভেঙ্গে নিয়ে এলো। ডালটা ভেঙ্গে দু’টুকরো করল। বুনো লতাও সঙ্গে এনেছিল। বুনো লতা দিয়ে ক্রশের মতো দুটো ডালকে বাঁধল। তারপর কবরের ওপর চেপে বসিয়ে দিল।
সর্দারের গলা শোনা গেল–ফিরে চলো কয়েদখানায়। সবাই ফিরে চলল।
যখন ঘাসে-ঢাকা প্রান্তরে এলো তখন সূর্য উঠছে। ওরা প্রান্তর পার হতে হতেই সূর্য। উঠল। ভোরের সূর্যালোক চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। বনের পাখির ডাকাডাকি এখান থেকেও কানে আসছে। ফ্রান্সিস মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকাল। ঝকঝকে নীল আকাশ। সাদা হালকা মেঘ উড়ছে। ওর মনে হল পৃথিবী কত সুন্দর! এরমধ্যে মানুষের মৃত্যুর কথা ভাবতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগে এক মৃতদেহ কবর দিয়ে এলাম। মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যু। আরবী শাসক মিন কী নিষ্ঠুর। তারই হাতে চাবুকের ঘা খেয়ে একজন তরতাজা যুবক মারা গেল। কথাটা ভাবতেই ফ্রান্সিসের চোখে জল এলো। ফ্রান্সিস হাতের উল্টেপিঠে চোখ মুছে নিল।
কয়েদঘরে ফিরে এলো ফ্রান্সিসরা।
দেখল হাঁটুতে মুখ গুঁজে অন্য যুবকটি কাঁদছে। এই যুবকটিকেও চাবুক মারা হয়েছিল। কিন্তু ওর সামান্য জ্বর হয়েছিল। জ্বর কমেও গিয়েছিল। মৃত বন্ধুর জন্যে ও মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে কাঁদতে লাগল।
ফ্রান্সিস ওর পাশে বসল। যুবকটির কাঁধে হাত রেখে মৃদুস্বরে বলল– কেঁদো না– তোমার বন্ধুর মৃত্যুর জন্যে যে দায়ী সেই শাসক মিনকে হত্যা করার সংকল্প নাও। কেঁদো না। মনকে শক্ত করো। প্রতিজ্ঞায় অবিচল থাকো। ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। হ্যারি মারিয়ার কাছে গিয়ে বসল।
সকালের খাবার খেয়ে ফ্রান্সিস শুয়ে পড়ল। একটাই চিন্তা কী করে জাহাজের বন্ধুদের কাছে খবর পাঠানো যায় যে মিনের কয়েদখানায় তারা বন্দী। ফ্লেজারভাই বা কী করে ওদের খোঁজ পাবে! কিভাবে ওদের মুক্ত করতে পারবে?
শাসক মিন কথা রাখল না। মারিয়াকে জাহাজে নিয়ে রাখল না। এই কয়েদঘরেই মারিয়াকে থাকতে হচ্ছে। ভালো করে খাওয়া নেই ঘুম নেই–এত কষ্ট মারিয়া সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু এই নিয়ে মারিয়া ফ্রান্সিসকেকিছুই বলল না। ফ্রান্সিস প্রতিদিনই দেখছে মারিয়ার মুখ শুকনো। চোখের নীচে কালি। মাথার চুলে জট পাকিয়ে গেছে। সবই বুঝতে পারছে ফ্রান্সিস কিন্তু উপায় নেই। সবই সহ্য করতে হবে।
ফ্রান্সিস উঠে দাঁড়াল। শেষ চেষ্টা। দেখা যাক শাসক মিন মারিয়াকে ওদের জাহাজে রাখার ব্যবস্থা করে কিনা।
ফ্রান্সিস দরজার কাছে গেল। লোহর দরজা ধরে ঝাঁকুনি দিল। এক প্রহরী এগিয়ে এলো। বলল–কী হয়েছে।
–শাসক মিনকে এখানে আসতে বলো। ফ্রান্সিস বলল।
শাসক মিন তোমার চাকর না। প্রহরীটি বলল।
–আমাদের মুক্তি দাও তোমাদের শাসক মিনকে আমার চাকর বানিয়ে ছাড়বো। যাও তো–তুমি গিয়ে বলল যে ভাইকিং সর্দার কিছু বলতে চাইছে।
আমি বলতে যাবো না। প্রহরীটি মুখ ঘুরিয়ে বলল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে লোহার দরজা ঝাঁকাতে লাগল। ভাইকিং বন্ধুরাও এগিয়ে এলো। একসঙ্গে কয়েকজন ফ্রান্সিসের সঙ্গে মিলে দরজা ঝাঁকাতে লাগল। সবাই দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। চলল দরজা ঝাঁকানো।
ফ্রান্সিস গলা চাড়িয়ে বলল–তুমি যদি শাসক মিনকে খবর না দাও তবে আমরা সারারাত ধরে দরজা ঝকাবো। প্রহরীটি ছুটোছুটি করতে লাগল। বুঝে উঠতে পারল না কী করবে? অন্য প্রহরীদের এক অবস্থা। জোর ঝঝন্ শব্দে ওরা দিশেহারা।
তখন একজন প্রহরী উঁচু গলায় বলল–আমরা শাসক মিনকে খবর দিচ্ছি তোমরা শব্দ থামাও। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল ঝাঁকুনি বন্ধ করো। প্রচণ্ড একঘেয়ে শব্দ বন্ধ হল।
সেই প্রহরীটি চলে গেল।
ঘণ্টাখানেক পরে শাসক মিন এলো। কয়েদঘরের দরজার কাছে এসে বলল– তোমরা কী আরম্ভ করেছে।
–এটা করলাম বলেই একজন পহারাদার আপনাকে ডেকে আনতে রাজি হল।
–কী বলতে চাও বলো। মিন বলল।
–আপনি আমাদের দেশের রাজকুমারীকে আমাদের জাহাজে রাখবেন বলেছিলেন। ফ্রান্সিস বলল।
কতজনকে কত কথাই তো বলি। সবসময় কি সেসব কথা মনে থাকে মিন বলল।
আপনি রাজী না হলে আমরা আবার দরজা ঝাঁকানো শুরু করবো, শাঙ্কো বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও। মিন বেশ ঘাবড়ে গেল।
–তাহলে বলুন। হ্যারি বলল।
–বেশ তো রাজকুমারী কখন যেতে চান বলুন আমি প্রহরী সঙ্গে দিয়ে পাঠাচ্ছি। মিন বলল।
রাজকুমারী দ্রুত উঠে দাঁড়ান। চড়া গলায় বলল–আপনার মতো নৃশংস নির্দয় মানুষের কাছে আমি কক্ষণো অনুরোধ জানাবো না। জাহাজের যুগের জীবন আমি চাই না।
–মারিয়া কী বলছো তুমি? এখানে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।ফ্রান্সিস বলল।
–অসুখ হলে মরে যাবো তাও ভালো এই খুনীর কাছে কিছু চাইব না। একটু পরে বলল–ফ্রান্সিস আজকে আমি তোমার কথাও শুনবো না। মারিয়া বলল।
মারিয়া শান্ত হও–সবদিক ভেবে দেখো। ফ্রান্সিস বলল।
–না আমি জাহাজে যাবো না। এখানেই থাকবো। মারিয়া বলল। মিন অল্প হাসল। বলল–দেখছো তো রাজকুমারী নিজেই যেতে চাইছে না। আমার আর কিছু করার নেই।
মিন চলে গেল। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইল। মারিয়া এসে ওর পাশে বসল। ফ্রান্সিসের কাঁধে হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল-তুমি আমার ওপর রাগ করেছো–তাই না। ফ্রান্সিস হেসে মুখ তুলল। বলল–পাগল–আমি তোমার ওপর রাগ করতে পারি? আমি তোমার শরীরের কথা ভেবেই এই প্রস্তাব করেছিলাম।
একটু চুপ করে থেকে ফ্রান্সিস বলল–এখন মহা সমস্যায় পড়লাম। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে পালাবার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু কী করে পালাতে পারবো বুঝতে পারছি না। ততদিনে তুমি যদি অসুস্থ হয়ে পড়ো তাহলে বিপদ বাড়বে। তুই তোমাকে জাহাজে রাখার ব্যবস্থা করতে চাইছিলাম। আর একটা উদ্দেশ্যে ছিল তুমি জাহাজে গিয়ে থাকলে আমরা সহজেই পালাতে পারবো।–তাহলে মিনকে বলো– আমি আমাদের জাহাজে থাকতে রাজি হয়েছি। না–এই জঘন্য চরিত্রের নরপশুটাকে আর অনুরোধ করবো না। শুধু তুমি সুস্থ থাকলেই আমি পালাবার পরিকল্পনা বেশ চিন্তা করে করতে পারবো। ফ্রান্সিস বলল।
–তাই করো। মারিয়া বলল।
ওদিকে জাহাজের বন্ধুরা অস্থির হয়ে উঠেছে। কী করবে ওরা বুঝে উঠতে পারছে না। ফ্রান্সিস, হ্যারি, শাঙ্কো, বিস্কো কেউ নেই। এই অবস্থায় ফ্লেজার এগিয়ে এলো। পেড্রোকে বলল, যাও সকলকে ডেক-উঠে আসতে বলল। পেড্রোনীচে নেমে সবাইকে খবরটা দিল।
তখন একটু রাত হয়েছে সবাই এসে ডেকে জড়ো হল। ফ্লেজার সকলকে সম্বোধন করে বলল, ভাইসব আমাদের আজ দিশেহারা অবস্থা। বুঝে উঠতে পারছি না এখন আমরা কী করব! প্রথমে গেল ফ্রান্সিস। পরে বিস্কোরা। সাতদিন হতে চলল ওরা কেউ ফিরে এলো না। আমাদের কোনও খবরও পাঠাতে পারল না। এখন এই একটা সম্ভাবনার কথাই মনে আসছে। সেটা হল, তারা সবাই বন্দী হয়েছে। এটা কী দেশ বা দ্বীপ আমরা জানি না। এখানে কারা থাকে, তাদের রাজাই বা কে আমরা কিছুই জানি না। একটু থেমে ফ্লেজার বলতে লাগল, বলতে আমার মন ভেঙ্গে যাচ্ছে তবু বলি, তবে কি ফ্রান্সিসরা কেউ জীবিত নেই?
ভাইকিং বন্ধুদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। একজন ভাইকিং বলল, ফ্লেজার, এতটা আশঙ্কা করো না। ওরা নিশ্চয়ই বেঁচে আছে। হয়তো মুক্তো নয়-বন্দী।
বয়স্ক বৈদ্য ভেন বলল, আমরা এখনও বিনা কারণে কোনও লড়াইয়ে জড়িয়ে যাইনি। আজকে আমাদের লড়াইয়ে নামতে হবেই, যদিও জানি ফ্রান্সিসরা বন্দী হয়ে আছে।
এবার ফ্লেজার বলল, ভাইসব, আমাদের সামনে আজ দুটো কাজ আছে। এক, ফ্রান্সিসদের ফেরার আশা নেই দেখে আমরা জাহাজ চালিয়ে চলে যেতে পারি। দুই, তীরে নেমে ফ্রান্সিসদের খোঁজ করতে পারি। বলোতোমরা কী চাও?
সবাই প্রায় একসঙ্গে বলে উঠল, আমরা এখান থেকে নড়ব না। ভেন বলল– আমরা তীরে নামব। ফ্রান্সিসদের খোঁজ করব। খোঁজ করতে গিয়ে যদিলড়াইতে নামতে হয় আমরা লড়াইয়ে নামব।
ফ্লেজার বলল, আমিও ঠিক এটাই চাইছিলাম। আমরা যে ফ্রান্সিসদের পরম বন্ধু, এটা প্রমাণ করবার সময় এসেছে।
একজন ভাইকিং বলল একটা জিনিস আমরা দেখেছি যে, এই অঞ্চলের সৈন্যরা সুশিক্ষিত আর শিরস্ত্রাণে, বর্মে সশস্ত্র। এরকম সৈন্যদের সঙ্গে যদি আমাদের লড়তে হয় আমরা কি লড়তে পারব?
ফ্লেজার বলল, কথাটা ঠিক। তবে আমরা লড়ব বন্ধুদের বাঁচাবার জন্যে এখানেই আমরা মনের জোর বেশি পাব। দেখা যাক, যদি ওরকম এক অসম লড়াইয়ে লড়তে হয় লড়ব। একটু থেমে ফ্লেজার বলল, সবাই তাড়াতাড়ি রাতের খাওয়া খেয়ে নাও।
রাত একটু গম্ভীর হলে আমরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তীরে নামব। ফ্রান্সিসদের মুক্ত করার জন্যে যা করার করব। সভা ভেঙ্গে গেল। কেউ কেউ কেবিনঘরে চলে গেল, কেউ কেউ ডেক-এ বসল। দু-চারজন ডেক-এ শুয়ে পড়ল।
রাতের খাওয়াদাওয়ার পর সকলেই তলোয়ার নিয়ে তৈরি হল। ডেক-এ উঠে এলো। ফ্লেজারও এলো। পেড্রোকে ডেকে বলল, সমুদ্রতীরে যাও। নৌকো দুটো নিয়ে এসো। পেড্রো রেলিং টপকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর সাঁতার কেটে চলল তীরের দিকে।
আকাশে চাঁদ। চাঁদের আলো পড়েছে সমুদ্রের জলে, ঢেউয়ের মাথায়। চিকচিক করছে। কোথাও সাদাটে কুয়াশার জটলা। তার মধ্যে দিয়েই পেড্রো সাঁতরে চলল। জাহাজঘাটা অনেক দূরে। ওখান থেকে কারও নজরে পড়ার সম্ভাবনা নেই।
পেড্রো তীরের কাছে এলো। দেখল, ওদের দুটো নৌকোই তীরে ঠেলে তোলা আছে। পেড্রো তীরে উঠল। একটা নৌকোর দড়ি দিয়ে অন্য নৌকোটার সঙ্গে বাঁধল। তারপর ঠেলে দুটো নৌকো জলে নামলো। একটা নৌকোয় উঠল। দাঁড় নৌকোটার গলুইয়ে রাখা ছিল। দাঁড়টা তুলে নিল। দাঁড় বাইতে লাগল। দুটো নৌকোই চলল ভাইকিংদের জাহাজের দিকে। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে নৌকো দুটো জোরেই চলল।
দাঁড় বেয়ে পেড্রো নৌকো দুটো জাহাজের গায়ে এসে লাগাল। দড়ির মই বেয়ে ডেক-এ উঠে এলো। তখন পেড্রো হাঁফাচ্ছে। ও নিজের কেবিনঘরের দিকে চলল। ভেজা পোশাক পালটাতে হবে।
রাত গম্ভীর হল। ফ্লেজার উঁচু গলায় বলল, এবার চলো ভাইকিংরা। দড়ির মই বেয়ে নৌকোয় নামতে লাগল। দুটো নৌকো ভরে গেল। নৌকো দুটো আস্তে আস্তে তীরের দিকে চলল।
তীরে এসে নৌকো লাগল। সবাই তীরে নামল। পেড্রো বলল, কেউ দাঁড়িয়ে থেকো না নজরে পড়ে যাবে। সবাই বসে পড়ো। সবাই বালি মেশানো মাটিতে বসে পড়ল।
পেড্রো আবার দুটো নৌকো চালিয়ে চলল জাহাজের দিকে। নৌকো দুটো জাহাজে লাগল। জাহাজ থেকে ফ্লেজার আর বাকি ভাইকিংরা নেমে এলো। নৌকো দুটো এবার চলল তীরের দিকে। নৌকো তীরে ভিড়ল। সবাই নেমে দাঁড়াল। পেড্রো ওদের বসে পড়তে বলল। ওরা বসে পড়ল। দুই বন্ধুকে ডেকে নিয়ে পেড্রো নৌকো দুটো ঠেলে মাটিতে তুলে রাখল।
ফ্লেজার জাহাজঘাটের দিকে তাকাল। জাহাজঘাটা বেশ দূরে। ওদের যেতে হবে জাহাজঘাটার কাছে। দেখা যাচ্ছে ওদিকেই জনবসতি। এখানে দেখা যাচ্ছে বালিমাটি ঢাকা ঘাসের প্রান্তর। বেশ দূর পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রান্তরে ফুটফুটে জোছনা। ফ্লেজার প্রান্তরের ওপর দিয়ে জনবসতি এলাকার দিকে চলল, পেছনে ভাইকিং বন্ধুরা। কেউ কোনো কথা বলছে না। যতটা সম্ভব নিঃশব্দে চলেছে সবাই।
বসতি এলকায় এলো ওরা। একটা পাথরের দেওয়ালওলা বাড়ির পেছনে এলো সবাই। ফ্লেজার বলল, এই বাড়ির পেছনে তোমরা অপেক্ষা করো। আমি খোঁজখবর নিয়ে আসছি।
সবাই সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ল। ফ্লেজার সেই বাড়িটার সামনে এলো। দু’দিকে তাকিয়ে বুঝল, এটা সদর রাস্তা। জাহাজঘাটা থেকে এসে দূরে চলে গেছে।
ফ্লেজার বাড়িটার বারান্দায় উঠে দরজার কাছে এলো। দেখল দরজাটা হাঁ করে খোলা। ফ্লেজার বুঝল বাড়িটা পোড়ো বাড়ি। তবু দরজাটায় বার দুয়েক শব্দ করল। কারও সাড়াশব্দ নেই।
ফ্লেজার রাস্তায় নামল। জোছনায় যতদূর দেখা যাচ্ছে লোকজন নেই। ফ্লেজার আর একটা বাড়ির সামনে এলো। বারান্দা পার হয়ে দরজার সামনে এলো। দরজায় হাত দিয়ে শব্দ করল। কোনও সাড়াশব্দ নেই। আবার ধাক্কা দিল। ভেতর থেকে বুড়ির গলায় শোনা গেল, কে?
কথাটা আরবি ভাষায় বলা। ফ্লেজার আন্দাজে বুঝল। গলা নামিয়ে বলল, একটু আসুন। কথা আছে?
একটু পরে দরজাটা খুলে গেল। একজন বয়স্কা মহিলা এসে দাঁড়াল। ফ্লেজার বলল, আপনি স্পেনীয় ভাষা বোঝেন?
মহিলাটি মাথা কাত করে বললেন, অল্প, অল্প।
ফ্লেজার বলল, তাতেই হবে। থেমে বলল, এখানে কয়েদঘরটা কোথায়?
মহিলাটি হাত তুলে কিছুদূরে একটা ঝুপসি পাতার গাছ দেখিয়ে বললেন, ওই গাছ বাঁ দিকে একটু দূর কয়েদখানা। মহিলাটা দরজা বন্ধ করে দিলেন।
ফ্লেজার বন্ধুদের কাছে ফিরে এলো। বন্ধুদের বলল, বন্ধুদের বলল, কয়েদঘর কোথায় জেনেছি। আগে দেখতে হবে ফ্রান্সিসরা কয়েদখানায় বন্দি হয়ে আছে কিনা। যদি না থাকে তা হলে অন্য জায়গাগুলো দেখতে হবে।
বৃদ্ধ হদিশ বলে ঘরে ঢুকে গেল। ফ্লেজাররাও ঘুরে দাঁড়াল কয়েদঘরের দিকে যাবে বলে। হঠাৎ বৃদ্ধর বাড়ির দরজাটা কাঁচকোঁচ শব্দ তুলে খুলে গেল। আট-দশজন সশসস্ত্র সৈন্য বেরিয়ে এলো। বারান্দা থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নামল। ফ্লেজারদের ঘিরে দাঁড়াল। ফ্লেজার অবাক। সৈন্যদের হাতে খোলা তলোয়ার। ফ্লেজার একবার পেছন ফিরে তাকাল। বন্ধুরাও অবাক। ফ্লেজার কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। আত্মরক্ষার জন্যে ফ্লেজার তরবারি কোষমুক্ত করল। বন্ধুরাও তরবারি খুলল। ভেন দুহাত তুলে বলে উঠল। ফ্লেজার ওর সংখ্যায় বেশি। লড়াইয়ে নামলে আমরা কেউ বাঁচতে পারবো না। মাথা ঠাণ্ডা করো। ওরা কী বলে শোনা যাক। ভেন-এর কথামতো বন্ধুরা তলোয়ার কোষবদ্ধ করল। এখন শুধু অপেক্ষা করা। সৈন্যরা ওদের নিয়ে কী করবে তাই দেখো।
সশস্ত্র সৈন্যদের দল থেকে একজন এগিয়ে এলো। তার মুখে চাপ দাড়ি গোঁফ। আদেশের স্বরে বলল-তলোয়ার ফেলে দাও। ফ্লেজাররা তলোয়ার খুলে রাস্তায় ফেলল। খোলা তলোয়ারের ডগাটা ভেন-এর বুকে ঠেকিয়ে দাড়ি গোঁফ বলল–এ্যাই বুড়ো তোরা কোত্থেকে এসেছিস্?
–আমরা ভাইকিংদের দেশ থেকে এসেছি। আমরা ভাইকিং। দেশ দ্বীপ ঘুরে বেড়াই। কোনো গুপ্তধনের সংবাদ পেলে সেই গুপ্তধন বুদ্ধি খাঁটিয়ে উদ্ধার করি।
তারপর সেই উদ্ধার করা গুপ্তধন নিয়ে পালিয়ে যা। সৈন্যটি বলল।
ভেন বলল-এই অভিযোগ অন্যায়। উদ্ধার করা গুপ্তধন সেই সেই দেশের রাজার হাতে তুলে দিয়েছি আমরা। একটা স্বর্ণমুদ্রাও আমরা নিই না।
রনি তুহিনার গুপ্তধন আছে এখানে। খুঁজবি নাকি? দাড়ি গোঁফওলা বলল।
এবার ফ্লেজার বলল–আমাদের দলনেতা কিছুদিন এখানকার শাসক মিনের কারাগারে হয়তো বন্দী। তাদের মুক্তি করতে পারলে এবং শাসক মিন যদি বলে তবে আমরা খুঁজবো।
–শাসক মিন কী করবে জানি না। আমরা কিন্তু মিনের সৈন্য নই। আমরা রানি ঈশিকার সৈন্য। মিনের সঙ্গে আমাদের শত্রুতা। লড়াই হবে দিন আট-দশ পরে। আমরা জাতিতে বাবার। শাসক মিন আরবীয়। লড়াই হবেই। যাক গেবনের বাইরে বেশিক্ষণ থাকা চলবে না। একটু গলা চড়িয়ে বলল–মিনের সৈন্যরা যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে। সবাই বনে ঢুকে পড়। তার আগে এই বিদেশি ভূতদের অস্ত্র কেড়ে নাও। দু’জন সৈন্য এসে ফ্লেজারদের পথের ওপর ফেলে দেওয়া তলোয়ারগুলি তুলে নিল।
ফ্রেজারদের নিয়ে দাড়ি গোঁফওয়ালা সর্দার বনের মধ্যে ঢুকে গেল। তারপর ফ্লেজারদের নিয়ে চলল।খুব একটা গভীর বন নয়। চাঁদের ভাঙ্গা আলো এখানে ওখানে পড়েছে।পথ বলে কিছু নেই। শুকনো ভাঙ্গা ডাল পাতায় শব্দ তুলে ফ্লেজাররা চলল।
বেশ কিছু পরে বনভূমি শেষ হল। ফ্লেজাররা দেখল একটা সবুজ ঘাসে ঢাকা মাঠ মতো। তারপরেই পাথরের বাড়িঘরদোর। ফ্লেজাররা মাঠ পার হয়ে বাড়ি ঘরের কাছে এলো। একটা পাথর বাঁধানো রাস্তায় এসে উঠলো। বাড়িঘরে আলো জ্বলছে না। নিস্তব্ধ চারদিক। পথ জনশূন্য। রাস্তা দিয়ে কিছুটা যেতেই একটা পাথরের লম্বাটে বাড়ি পড়ল। বাড়িটা অন্য সব বাড়ি থেকে অনেক বড়ো। বাড়িটার সামনে আসতে দাড়ি গোঁফওয়ালা সর্দার ডান হাতটা উঁচু করে বলল–থামো।
সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল।
সর্দার একটা ঘরের দরজার কাছে গেল। বাড়িটার সদর দরজা একটু দূরে। সদর দরজার দুপাশে পরপর ঘর। সর্দার দরজার কাছে গিয়ে কী বলল। দুজন পাহারাদারের একজন কোমর থেকে চাবির গোছ বের করল। একটা বড়ো ঘরের দরজার তালা খুলল।শক্ত কাঠের দরজাটা খুলে ধরল। সর্দার ফ্লেজারদের তাকিয়ে বলল–সবাই এই ঘরে ঢোকো। ফ্লেজাররা একে একে ঘরে ঢুকল। ঘরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। পাথুরে দেয়ালের মধ্যে গর্ত। তাতে দুপাশে দুটো মশাল জ্বলছে। মেঝেয় শুকনো ঘাসের বিছানা। দড়ি দিয়ে বিছানাটা শক্ত করে বাঁধা। তার ওপর একটা মোটা কাপড় পাতা।
সদার বলল–এই বাড়িটা হচ্ছে রানি ঈশিকার প্রাসাদের লাগোয়া কয়েদঘর। আরামেই থাকবে। সর্দার হো হো করে হেসে উঠল। ফ্লেজার হাসির মানেটা ঠিক বুঝল না।
ঘরে ঢুকে ভাইকিংরা কেউ কেউ শুয়ে পড়ল কেউ কেউ বসল। শুধু ফ্লেজার বসল না। ঘরটার পায়চারি করতে লাগল।
কিছু পরে ফ্লেজার ভেনের দিকে তাকিয়ে বলল–ভেন এখন কী করবো বলো।
–কিছু তো করার দেখছিনা। বন্দীদশা মেনে নিতেই হবে। তাছাড়া আমরা নিরস্ত্র। আমাদের তলোয়ার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। লড়াই করার প্রশ্নই নেই। ভেন বলল।
–এখন রানি ঈশিকা কী বলে সেটাই শোনার। কালকে আমাদের রানির দরবারে নিয়ে যাবে মনে হয়। রানির কথা থেকেই বুঝতে পারবো আমাদের মুক্তির ব্যাপারে সে কী ভাবছে। ফ্লেজার বলল।
তাহলে রানি যদি বলে আমাদের বন্দী হয়েই থাকতে হবে? পেড্রো বলল।
–তাহলে বন্দীই থাকতে হবে। ফ্লেজার বলল।
–একটা কথা ভাববার–ভেন বলল–আমাদের বন্দী করে রেখে রানির কী লাভ?
–রানির কথা থেকেই সেটা বোঝা যাবে। ফ্লেজার বলল। তারপর বিছানায় বসল।
বাইরে প্রাসাদ সংলগ্ন বাগান থেকে পাখির ডাক কিচিরমিচির ভেসে এলো। ভাইকিংদের কারো কারো ঘুম ভেঙ্গে গেল। ফ্লেজারের ঘুম ভেঙ্গে গেছে আগেই। চোখ ঝুঁজে সমস্যার কথাটাই ভাবছে। ফ্রান্সিস নেই হ্যারি নেই শাঙ্কো বিস্কো কেউ নেই। অন্তত ফ্রান্সিস থাকলে সমস্যার সমাধান ভাবতে পারতো। আজকে ওরা একেবারে অসহায়। না, ফ্লেজার মাথায় ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে বসল। ফ্রান্সিসরা বেঁচে থাকলে কোথায় আছে অথবা ওদের হত্যা করা হয়েছে কিনা এসব জানতে পারলেও মনে জোর পাওয়া যেতো। কিন্তু ফ্রান্সিসদের সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। একেবারে অন্ধকার। ফ্লেজার এসব সাত-পাঁচ ভাবতে লাগল।
শব্দ করে কাঠের বড়ো দরজাটা খুলে গেল। প্রহরীরা সকলের খাবার নিয়ে ঢুকল।
ফ্লেজার খুব মনোযোগ দিয়ে প্রহরীরা কিভাবে খাবার দিচ্ছে অন্য অন্য প্রহরীরা তখন কী করছে দেখতে লাগল। দেখল প্রহরীরা যখন খাবার দিচ্ছে অপেক্ষা করছে ওদের খাওয়া হয়ে যাওয়া পর্যন্ত, প্রহরী দুজন চুপ করে ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে ফ্লেজারদের খাওয়া দেখছে। বাইরের চারজন প্রহরী দরজা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছে। ফ্লেজারদের দিকে নজর নেই। ফ্লেজার সমস্ত ব্যাপারটা দেখতে লাগল খেতে খেতে ভাবতেও লাগল–কিভাবে কখন পালাতে হবে। ভেবে দেখল খাওয়ার সময়ই পালাতে হবে। এবার কী ভাবে পালাবে সেটা ভাবতে লাগল।
ফ্লেজারদের খাওয়া হয়ে গেল। প্রহরীরা গামলা কাঠের বড়ো রেকাবি কাঠের বড়ো হাতা এসব জিনিস নিয়ে চলে গেল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
একটু বেলা হল। কয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। সেনাপতি ঢুকল। মাথায় উষ্ণীব। গলা পর্যন্ত জুলপি। ইয়া বড়ো গোঁফ। বুকে বর্ম।
ঘরে ঢুকেই বাজখাঁই গলায় বলে উঠল–এখানে ভাইকিং দেশের লোক কারা?
–আমরা। ফ্লেজার উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে ভাইকিং বন্ধুরাও উঠে দাঁড়াল।
–বাঃ তোমরা তো বেশ তাগড়াই জোয়ান। রানি ঈশিকা এরকম জোয়ানই তো চান। সেনাপতি বলল।
–আমাদের মতো জোয়ান চান কেন? ভেন বলল।
–আছে–আছে কারণ আছে। পরে বুঝবে। যাক গে– তোমরা দু’তিনজন বাইরে এসো। রানি ঈশিকার দরবারে যেতে হবে। সর্দার বলল।
-কেন যেতে হবে? ফ্লেজার বলল।
–তোমাদের বিচার হবে। সেনাপতি হা হা করে হেসে উঠল।
-ঠিক আছে। চলুন। ফ্লেজার বলল। তারপর ভেনকে ডেকে বলল–চলো তুমি আর আমি যাবো।
সেনাপতি কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে বাইরের মাঠে এল। পেছনে ফ্লেজার আর ভেন। চলল দুজনে। প্রাসাদের শেষের দিকে রানি ঈশিকার দরবার কক্ষ। সেনাপতি ফ্রেজারদের সেই ঘরে ঢুকতে ইঙ্গিত করল। ফ্লেজার আর ভেন সেই ঘরে ঢুকল। দুইদিকে কয়েকটা জানালা থাকা সত্ত্বেও ঘরের ভেতরের অন্ধকার ভাবটা সম্পূর্ণ কাটে নি।
ফ্লেজার দেখল রানি ঈশিকা একটা পাথরের সিংহাসনে বসে আছে। আসলে গভীর নীল রঙের গদি আঁটা। ডানদিকে মন্ত্রী বসে আছে। রানির বয়েস হয়েছে। মুখে বলি রেখা। একটা বড়ো মুক্তো বসানো মুকুট মাথায়। মুকুটে মণিমাণিক্য বসানো। মীনে করা। ঢোলা হাতা পোশাক সোনারুপোর কাজ করা। হাতে একটা দণ্ড। তাতেও মণি মাণিক্যের কাজ।
ফ্লেজাররা যখন পৌঁছল তখন রানির দরবারে একটা বিচার চলছিল। রানি একটু মাথা নুইয়ে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের বক্তব্য গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল। সব শুনে রায়দান করল। অভিযোগকারী মাথা নুইয়ে রানিকে সম্মান জানিয়ে চলে গেল। অভিযুক্তের দুহাত ধরে দুজন সৈন্য নিয়ে গেল।
এবার সেনাপতি রানির সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেল। মাথা একটু নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল–মাননীয় রানি–আমার একটা অভিযোগ ছিল।
–বলুন। রানি বলল।
ফ্লেজারকে দেখিয়ে বলল–এরা জাহাজে চড়ে আপনার রাজত্ব এসেছে। এরা জাতিতে ভাইকিং। বিদেশি। ওদের থর্ন বনভূমিতে ধরা হয়েছে। ওরা বলছে বন্ধুদের খুঁজতে এখানে এসেছে। কিন্তু আমার মনে হয় এরা শাসক মিনের গুপ্তচর। আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবরাখবর নিতে এসেছে। এখন আপনার বিচার।
রানি ফ্লেজার আর ভেন-এর দিকে তাকাল। বলল
–তোমরা জাহাজে চড়ে দেশে দেশে দ্বীপেদ্বীপে ঘুরে বেড়াই। এ ছাড়া যদি কোথাও গুপ্ত ধনভাণ্ডারের বা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছুর সন্ধান পাই তাহলে বুদ্ধি খাঁটিয়ে সেইসব আমরা উদ্ধার করি। এর বদলে আমরা একটা স্বর্ণমুদ্রাও নিই না।
বলো কি। অবশ্য তোমরা চুরি করলে কে আর ধরতে যাচ্ছে।
–আমরা চোর নই। ফ্লেজার বলল।
–তাহলে জলদস্যু। রানি বলল।
না–আমরা তাও নই। আপনাদের সন্দেহ হলে আমাদের জাহাজে তল্লাসী করুন। শুধু খাদ্যসংগ্রহের জন্যে আমরা কিছু স্বর্ণমুদ্রা রেখেছি। বাঁচতে তো হবে। ফ্লেজার বলল।
–কিন্তু সেনাপতি যে বললেন তোমরা শাসক মিনের গুপ্তচর–তার কী হবে? রানি বলল।
-মিছে বদনাম দেওয়া হচ্ছে। আমরা গুপ্তচরগিরি করতে যাব কেন? এই দেশ এখানকার জনসাধারণ তাদের সঙ্গে আমাদের কী সম্পর্ক। আজ এখানে আছি। কাল জাহাজ চালিয়ে চলে যাবো অন্য দেশে। রুপনি বা শাসক মিনের সঙ্গে আমাদের স্বার্থ জড়িত নয় তবে কেন আমরা গুপ্তচরবৃত্তি করতে যাবো। ফ্লেজার বলল।
যাক গে–তোমরা কতজন বন্দী হয়ে আছো? রানি বলল।
–সাতজন। ফ্লেজার বলল।
–সবাই কি তোমার বয়সী। রানি বলল।
–হ্যাঁ, শুধু এই ভেনআমাদের বৈদ্য–এর বয়স বেশি। আর কী জানতে চান। বলুন? ফ্লেজার বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও–রানি বলল। শোনো আমার এখন খুব অর্থাভাব চলছে। মাথায় লড়াইয়ের চিন্তা তরা জন্যেও আমার খরচ টানতে হচ্ছে। পেরে উঠছি না। সেইজন্যেই ভেবেছি কিছুদিনের মধ্যেই সমুদ্রতীরে ক্রীতদাস বেচাকেনার হাট বসবে। তোমাদের মতো জোয়ানদের বিক্রী করতে পারলে ভালো দাম পাবো। আমার অর্থাভাব মিটবে।
ফ্লেজার চমকে উঠল। এই কথাটা ও একবারও ভাবে নি।ও ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ল। ও জানে, বলে লাভ নেই। রানি এখন অর্থ কিভাবে পাওয়া যাবে সেই চিন্তায় বিভোর। তবু ফ্লেজার বলল–দেখুন–শাসক মিন আর আপনাদের সম্পর্ক খুব খারাপ। কিছুদিনের মধ্যেই লড়াই হবে। এদিকে ক্রীতদাসের হাট বসবে সমুদ্রতীরে। হয় আপনার রাজত্বে নয় তো মিনের রাজত্বে। কিন্তু আপনারা তো পরস্পরের শত্রু। ক্রীতদাসের হাঁটে অন্যদের নিয়ে যাবেন কী করে?
এতক্ষণে রানি হাসল। বলল-ক্রীতদাসের হাট মাত্র তিনদিন চলে। সে সময় আমরা আমাদের বিবাদ ভুলে থাকি। আমরা আর ধারেকাছের দেশগুলো থেকেও রাজারা হাটে আসে। ক্রীতদাস কেনা বেচা চলে। একটা দিন কারোর সঙ্গে কারোর শত্রুতা করতে নেই।
–বাঃ–ফ্রেজার হেসে বলে উঠল–তিনদিনের জন্যে আপনারা শত্রুতা ভুলে যান। বরাবরের জন্যে শক্রতা ভুলতে পারেন না কেন?
সেটা সম্ভব নয়। আমাদের মধ্যে লড়াই লাগবেই। মিনও যুদ্ধ চায়, আমিও যুদ্ধচাই। রানি বলল।
–আমাদের মুক্তি দিলে আপনাকে আমরা অর্থ দেব। ফ্লেজার বলল।
রানি হেসে উঠলেন–তোমরা তো গরিব ভিখিরি। তোমরা অর্থ দেবে কোত্থেকে।
–আমাদের একবার চেষ্টা করতে দিন। ফ্লেজার বলল।
–না–না। তোমাদের মুক্তি দিলে আমার সব পরিকল্পনাই মার খাবে। আমার অর্থ সমস্যাও মিটবে না। আসলে ক্রীতদাসের হাট যখন বসে আমরা কয়েকঘরে আটক থাকা সব বন্দীকেই ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করে দিই। এই নিয়ম বাবর চলে আসছে। রানি বলল।
–এই নিয়মটা ভালো কি মন্দ–তা বোধহয় কোনোদিন ভেবে দেখেন নি। ভেন বলল।
না না–এতে ভাববার কী আছে। নিয়মটা চলে আসছে–চলে আসছে। রানি বলল।
–আপনি একজন নারী। নারী হয়ে এরকম একটা অমানুষিক কাজ করেন কী করে। আপনার কি বিবেক বলে কিছু নেই। ভেন বলল।
রানি ঈশিকা জোরে হেসে উঠল। বলল– ক্রীতদাস না থাকলে কি চলে। চাষাবাদ বাগান করা সেসবের দেখাশুনোক্রীতদাসের। এতসব কাজ ক্রীতদাসরা ছাড়া কারা করবে।
–তাহলে আপনি স্থির করে ফেলেছেন –আমাদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রী করবেন। ফ্লেজার বলল।
–হ্যাঁ। কাজেই তোমাদের মুক্তি নেই। রানি বলল।
–বেশ। ফ্লেজার বলল। সেনাপতির পেছনে পেছনে ফ্লেজাররা দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছে তখনই একজন সৈন্য এসে সেনাপতিকে কী বলল। সেনাপতি ফ্লেজারদের দিকে তাকিয়ে বলল-রানি তোমাদের ডেকেছেন। দরবারে চলো।
ভেন ও ফ্লেজাররা আবার দরবারে কক্ষে ফিরে এল। রানির সামনে এসে দাঁড়াতে রানি বলল–তোমাদের নাম কী?
–আমি ফ্লেজার, আমার সঙ্গী ভেন। ফ্লেজার বলল। রানি বলল–তোমাদের মুক্তির উপায় আছে। ফ্লেজার কথাটার অর্থ ঠিক বুঝতে পারল না।
–শোনোতোমরা যদি শাসক মিনের রাজত্বে গিয়ে ওদের যুদ্ধের পরিকল্পনা কী সেটা জেনে আসতে পারো তাহলে তোমাদের মুক্তি দেওয়া হবে। ফ্লেজার চুপ করে রইল। দ্রুত ভাবতে লাগল–কী করবো? গুপ্তচরবৃত্তি অত্যন্ত গর্হিত কাজ নিচু কাজ। এটা করা যাবে না।
কী হল? রানি বলল।
–একটু ভাবতে সময় দিন। ফ্লেজার বলল।
—বেশ ভাবো। রানি বলল।
ফ্লেজার কিছুক্ষণ ভাবল। ভেবে দেখল–শাসক মিনের রাজত্বে আমাদের যেতেই হবে। ফ্রান্সিসরা নিশ্চয়ই ওখানে বন্দী হয়ে আছে। বন্দী না হলেও ওরা কোথায় কিভাবে আছে সেটা জানা যাবে। সেটা জানালেই পরে কী করবো তা স্থির করা যাবো। কিন্তু কয়েদঘরে পড়ে থাকলে কিছুই জানা যাবে না। ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি হয়ে যেতে হবে।
ভেন এ সময় বলল–ফ্লেজার আমরা গুপ্তচরবৃত্তি করবো না।
ফ্লেজার মাথায় কঁকুনি দিয়ে বলল–ভেন–ঐ গোঁ ধরে বসে থাকলে আমাদের ক্ষতিই হবে। আমি পরে সব বুঝিয়ে বলবো। এখন রানি যে প্রস্তাব দিল সেটা গ্রহণ করা যাক।
–ঠিক আছে। তুমি যা ভালো বোঝো করো। ভেন বলল।
ফ্লেজার রানির দিকে তাকিয়ে বলল–মহামান্য রানি–আপনি যে প্রস্তাব দিলেন সেটা আমরা গ্রহণ করলাম। আমাকে আর ভেনকে মুক্তির আদেশ দিন। আমরা মুক্তি পেলে-থর্ন বনভূমির মধ্যে দিয়ে শাসক মিনের রাজত্বে যাবো। যুদ্ধের গোপন খবর জোগাড় করে ফিরে আসবো।
–আর তোমাদের বন্ধুদেরও মুক্ত করে আনবো। তোমাদের সবাইকে ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করতে পারলে আমার আর কোনো অভাব থাকবে না। রানি বলল।
–কিন্তু আমরা এরকম কথা দিতে পারি না। বন্ধুরা যদি বন্দী হয়ে থাকে তবে তাদের মুক্তি করতে পারবো এরকম কথা বলে লাভ নেই। কারণ বন্ধুরা কীভাবে কোথায় আছে আমরা এখনও জানি না। ফ্লেজার বলল।
-ঠিক আছে-তোমরা ছজন থাকলেই চলবে। রানি বলল।
–তাহলে দেরি না করে তোমরা এখনই বেরিয়ে পড়ো। রানি বলল।
–না–আমরা কয়েদঘরে যাবো এখন। বন্ধুদের সব বুঝিয়ে বলবোতারপর থর্ন বনভূমির দিকে যাত্রা করবো। ফ্লেজার বলল।
বেশ–তাই করো। আমি সেনাপতিকে সেই আদেশই দিচ্ছি। রানি বলল।
রানি সেনাপতির দিকে তাকিয়ে বলল–সেনাপতি –এই দু’জনকে আমি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিচ্ছি। এরা শাসক মিনের রাজত্বে গিয়ে কী কাজ করতে বলেছি তা তো শুনেছেন। আপনি সেভাবেই কাজ করুন।
রানিকে মাথা নুইয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবই দরবার কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলো
সেনাপতি ফ্লেজারদের নিয়ে কয়েদঘরে এলো। পাহারাদার দুজনকে ডেকে বলল দ্যাখো এই দুজন বন্দীকে রানি শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিয়েছেন। এরা যখন মুক্তি চাইবে তখনই মুক্তি দেবে।
সেনাপতি চলে গেল। ফ্লেজাররা কয়েদঘরে ঢুকল। বন্ধুরা কয়েকজন উঠে দাঁড়াল। বলল–ফ্লেজার রানির সঙ্গে কী কথা হল?
–সব বলছি। ফ্লেজার বলল। তারপর বন্ধুদের লক্ষ্য করে বলল ভাই সব–আমি খুব সমস্যায় পড়েছি; রানি আমাকে আর ভেনকেমুক্তি দিয়েছে কিন্তু শর্তসাপেক্ষে। শাসক মিনের রাজত্বে গিয়ে তাদের যুদ্ধপরিকল্পনার গোপন খবর আমাদের নিয়ে আসতে হবে।
–এ তো গুপ্তচরের কাজ। এক ভাইকিং বন্ধু বলে উঠল।
–হ্যাঁ–গুপ্তচরবৃত্তি। এখন আমি সেই প্রস্তারে রাজি হয়েছি।
একজন ভাইকিং বন্ধু বলে উঠল-বলো কি।
ফ্লেজার বলল, আমরা রাজি হয়েছি। একটু থেমে ফ্লেজার বলল–ভাইসব– ভেবে দেখো। ফ্রান্সিসরা কোথায় কী অবস্থায় আছে আমরা কিছুই জানি না। আবার আমরা এখানে কয়েদঘরে পড়ে আছি। আমাদের এখন দিশেহারা অবস্থা। কাজেই অন্তত আমি আর ভেন মুক্ত হয়ে ফ্রান্সিসদের খোঁজখবর করতে পারবো। তোমাদের মুক্তির ব্যবস্থাও করতে পারবো। যত শিগগির সম্ভব এটা করতে হবে। রানি ঈশিকা স্থির করে রেখেছে জাহাজঘাটায় যে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে সেখানে আমাদের সবাইকে বিক্রি করবে। আমরা সবাই যুবক এক ভেন বাদে কাজেই আমরা ভালো দামে বিকোবো। অর্থাৎ রানি আমাদের জন্যে ভালো দর পাবে। ফ্লেজার থামল। তারপর বলতে লাগল–কাজেই বেশিদিন আমদের হাতে নেই। এর মধ্যেই আমাদের পালাতে হবে। কাজেই আমি আর ভেন এ অবস্থায় কয়েদঘরের বাইরে থাকতে পারলে পালাবার ব্যবস্থা করতে পারবো, ফ্রান্সিসদের খোঁজখবরও নিতে পারবো। বন্দী হয়ে এখানে পড়ে থেকে কিছুই করতে পারবো না। তাই গুপ্তচরবৃত্তির কাজ আমাদের করতে হবে। আমরা এখন নিরুপায়।
ভাইকিং বন্ধুরা কোনো কথা বলল না। সবাই বুঝতে পারল ভবিষ্যতের কথা ভেবে এছাড়া অন্যকিছু করার উপায় নেই। যদি ফ্লেজাররা মুক্ত থাকে তাহলে সবদিক থেকেই মঙ্গল। ফ্লেজার বাইরে থেকে ফ্রান্সিসদের খোঁজখবর করতে পারবে আবার ওদের মুক্তির জন্যেও চেষ্টা করতে পারবে। কাজেই ফ্লেজারের সিদ্ধান্ত ওরা মেনে নিল।
দুপুর তখন। ঢং ঢংশব্দেকয়েদঘরের দরজা খুলে গেল। খাবার নিয়ে টুক কয়েকজন পাহারাদার। দেওয়া হল গোল করে কাটা রুটি পাখির মাংসের ঝোল শাকসবৃজি।
কিছুক্ষণের মধ্যে ভাইকিংদের খাওয়া হয়ে গেল। পাহারাদাররা কাঠের থালা বাটি রেকাবি এসব নিয়ে চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে ফ্লেজার এসে ঘাসের বিছানা রাখল। অনেক চিন্তা ওর মাথায়। তখনই ভাবলো–ফ্রান্সিসদের খোঁজখবর যুদ্ধের গোপন খবর এসব করতে হলে এই বিদেশি পোশাকে চলবে না। এদেশী পোশাক চাই।
ফ্লেজার উঠে দরজার কাছে এল। একজন পাহারাদারকে ডাকল। পাহারাদার এলো। ফ্লেজার বলল–সেনাপতিকে একবার ডেকে দাও। জরুরি কথা আছে। পাহারদারটি চলে গেল।
কিছুক্ষণ পরে সেনাপতি এলো। ফ্লেজার বলল-দেখুন যে কাজে আমরা যাচ্ছি। তা সুষ্ঠুভাবে করতে গেলে আমাদের এই বিদেশি পোশাক চলবে না। আপনি দুজোড়া ঢোলা হাতা পোশাক দিন। এ দেশের লোকেরা যেমন পরে।
–তাহলে তো পোশাক তৈরি করাতে হয়। সেনাপতি বলল। —
না না–আমাদের পুরানো পোশাক দিন ছেঁড়াখোঁড়া হলে আরো ভালো। ফ্লেজার বলল।
–বেশ–দেখছি। পেলে পাঠিয়ে দিচ্ছি। সেনাপতি বলল। তারপর চলে গেল।
ফ্লেজার অপেক্ষা করতে লাগল। এই কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে কী কী করবে তাও ভাবতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন পাহারাদার দুটো ছেঁড়া পোশাক নিয়ে এলো। পোশাক দেখে ফ্লেজার খুশি। ফ্লেজার একটা পোশাক ভেনকে দিল। অন্যটি নিয়ে ভাইকিংদের পোশাকের ওপরেই পরে নিল। দেখাদেখি ভেনও তাই করল।
ফ্লেজার আর ভেন দরজার কাছে এলো। বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে বলল–ভাইসব আমরা আজ সকলেই বিপদগ্রস্ত। হতাশ হয়ো না। মিছিমিছি তোমাদের রক্তপাত মৃত্যু আমি চাই না। আমার ওপরে ভরসা রাখো। সময়মতো সব হবে। সব বিপদ-আপদ কাটিয়ে আমরা দেশের দিকে জাহাজ ভাসাবো। ঈশ্বর আমদের সহায় হোন। ফ্লেজারের কথামতো এক প্রহরী ওদের দুজনের জন্যে দুটো তলোয়ার এনে দিল।
ততক্ষণে এক পাহারদার দরজা খুলে দিয়েছে। ফ্লেজার আর ভেন কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো। সামনের ঘাসে ঢাকা প্রান্তর পার হয়ে চলল থর্ন বনভূমির দিকে।
দুজনে থর্ন বনভূমিতে ঢুকল। বেশ ঘন গাছপালা। পথ বলে তো কিছু নেই। গাছগাছালির জটলার মধ্যে দিয়ে ওরা চলল। মাঝে মাঝে বুনো লতায় পা আটকে যাচ্ছে। তলোয়ারের কোপে লতাগাছ কেটে ফেলে দুজনে চলল।
গাছের মোটা গুঁড়ি লতাগাছ এসব নজরে রেখে ওদের যেতে হচ্ছে। বেশ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে সাবধানে পা রেখে রেখে যেতে হচ্ছে ওদের। বনে লতাগাছে পা জড়িয়ে যেতে পারে। ভীষণ পেছল গাছের গুঁড়িতে পা পিছলে পড়ে যেতে পারে। হঠাৎ সেই বনভূমি অনেক পাতলা হয়ে এলো। ছাড়া ছাড়া গাছপালা। এখানে অন্ধকারও অনেকটা কেটে গেছে। অনেকটা অস্পষ্ট গাছপালা। গাছের মোটা মোটা গুঁড়ি আর দেখা যাচ্ছে না। গাছের গুঁড়িগুলো আর বড়ো নয়। সাধারণ উচ্চতার গাছ সব।
গাছের গুঁড়িগুলো আর বড়ো নয়।
ছাড়া ছাড়া গাছের বনটা পার হতে দুজনে আর দেরি করতে চাইল না। বনের মধ্যে যতটা দ্রুত খাওয়া যায় সেইভাবে চলল। গাছপালার মধ্যে দিয়ে ছোটা সহজ নয়। ওদের দেরি হতে লাগল। ফ্লেজার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছুটতে গেল। ভেন বাধা দিচ্ছিল। বলছিল–ফ্লেজার অত দ্রুত ছুটো না। এতে আমরা পথ ভুলতে পারি। একবার এখানে পথ ভুল হলে আমাদের ভোগান্তির একশেষ হবে। কাজেই দেখে শুনে চলো। দেরি হোক ক্ষতি নেই। লক্ষ্য করতে হবে ঠিক উত্তরমুখো যাচ্ছি কিনা।
–কিন্তু এই ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিক হারানো অসম্ভব কিছু না।
–ভেন আমি জাহাজ চালাই। দিক ঠিক রাখা আমার পক্ষে সহজসাধ্য। ফ্লেজার বলল।
–সে তোমার সমুদ্রের বুকে। এখানে বন গাছপালা ওপরে ভালো করে আকাশ দেখা যাচ্ছে না। এসব দিকভ্রান্তি ঘটাতে পারে। ভেন বলল।
–হুঁ। সেটা একটা সমস্যা বটে। যাকগে–অনেকটা এলাম কিন্তু এখনও বন শেষ হল না। ফ্লেজার বলল।
–আমাদের দিক ভুল হল না তো? ফ্লেজার বলল।
–কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে থর্ন বনটা কি এদিকেও বিস্তৃত? ভেন বলল।
–অসম্ভব নয়। হয়তো আমরা এখনও থর্ন বনের মাঝামাঝি এসেছি। আগে যেতে হবে। ভেন বলল।
দাঁড়াও দাঁড়াও। ফ্লেজার বলল। তারপর দাঁড়িয়ে পড়ল। সামনের দিকে আঙুল তুলল।
দুজনেই দেখল একটা টিলামতো। ওখানেও টিলার চারপাশে গাছগাছালি। বনের মতোই জায়গাটা। ফ্লেজার বলল–ঐ টিলাটার চারপাশেই বন। তবে কি এটাই শাসক মিনের রাজ্য?
–ওখানে পৌঁছে সেটা দেখতে হবে। ভেন বলল।
কিন্তু ওখানে গিয়ে সেটা কীভাবে জানবো?তবে একটা বাঁচোয়া আমাদের পরনে এদেশীয় পোশাক। প্রথমেই আমাদের বিদেশি বলে মনে হবে না। ফ্লেজার বলল।
দুজনেই এবার গতি কমাল। বন শেষ। দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। গাছের আড়ালে। সামনেই দেখা গেল একটা মাঠমতো। সেখানে সশস্ত্র সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করছে।
–এরাই কি শাসক মিনের সৈন্য? এটাই কি তাহলে শাসক মিনের রাজত্ব?
–ভেন মাথা নাড়তে নাড়তে বললউঁহু শাসক মিনের যোদ্ধারা এত কম হতে পারে না।
কিন্তু শাসক মিনের কত সৈন তা তো আমরা জানি না। তবে মাঠের ডানদিকে দেখা যাচ্ছে দুটো সৈন্যাবাস। সুতরাং ধরেই নিতে হয় শাসক মিনের সৈনসংখ্যা কম। ফ্লেজার বলল।
–এখন কী করবে? ভেন বলল।
–খবর জোগাড় করা কবে নাগাদ শাসক মিন রানি ঈশিকার রাজ্য আক্রমণ করবে। সৈন্যসংখ্যা কত–এসব খবর জোগাড় করতে হবে। ফ্লেজার বলল।
–চলোঐ টিলার নীচে নিম্মই বসতি আছে। ওখানেই শাসক মিনের রাজবাড়িও হয়ত রয়েছে। ভেন বলল।
–এটা ভাবছো কী করে? ভেন বলল।
খুব সহজে। এখানে শুধু সেনাপতি আর যোদ্ধাদের থাকার জায়গা। ফ্লেজার বলল।
–চলো-সব আগে দেখি। ভেন বলল।
দুজনে গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। গাছ বুনো ঝোঁপের আড়ালে আড়ালে চলল সৈন্যাবাসের বাড়ি ছাড়িয়ে পেছনে টিলাটার দিকে।
দুজনে কিছুটা এগিয়ে দেখল একটা রাস্তামত। সোজা চলে গেছে টিলাটার দিকে।
এবার হল সমস্যা। রাস্তায় নামলেই এখানকার লোকজনেরা ওদের দুজনকে দেখতে পাবে। বলা যায় না কেউ কেউ হয়তো ওদের দুজনকে বিদেশি বলে ধরে নিতে পারবে। সৈন্যদের খবর দেবে। আবার বন্দীদশা।
ফ্লেজার ভাবল এসব সমস্যা তো থাকবেই। এসব ব্যাপার ঘটবেই। সেটা না ঘটিয়ে কী করে খবর সংগ্রহ করা যায় তার চেষ্টা করতে হবে।
এখন এই দিনের বেলা না বেরুনোই ভালো। ভেন বলল।
কিন্তু এখন তো খাবার ব্যবস্থা করতে হয়।না খেয়ে কতক্ষণ থাকা যায়? ফ্লেজার বলল।
–ঠিকআছে–ভেন বলল–আমি খাবার জোগাড়ে যাচ্ছি তুমি এই গাছের আড়াল থেকে বেরিও না।
কিন্তু তুমি আবার বিপদে পড়বে না তো? ফ্লেজার বলল।
–আরে আমার মতো বুড়ো হাবড়াকে কেউ কিছু বলবে না। তোমাদের পক্ষে যাওয়াই বিপদ। তো ফ্লেজার কিছু অর্থ তো দিতে হবে। ফ্লেজার কোমরের ফেট্টি থেকে একটা স্বর্ণমুদ্রা বের করল। বলল-এটা দেবেআর বলবে যে আমরা কয়েকদিন এখানে খাবো। প্রয়োজনে থাকবোও।
ভেন চলে গেল। রাস্তায় লোকজন বেশি নেই। ভেন হেঁটে চলল। দেখল যত ঘরবাড়ি সব এদিকেই। এখন থেকে সৈন্যাবাস বেশি দূরে নয়।
যেতে যেতে দুএকজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল সরাইখানা কোথায়।
ভেন একটা সরাইখানার সামনে এলো। সরাইখানার মালিককে বলল–আমি আর আমার এক বন্ধু খাবো। কিন্তু বন্ধুটি অসুস্থ। আসতে পারবে না। আমি এখান থেকে নিয়েই যাবো। বন্ধুটির জন্যে খাবার নিয়ে যাবো। দিতে পারবেন?
–কেন নয়। পাতাটাতা দিয়ে বেঁধে দেব। সরাইখানার মালিক বলল।
–তাহলে তো খুব ভালো হয়। ভেন বলল।
ভেন এসে টানা তক্তাটায় বসল। একটু পরেই সরাইখানাওয়ালা কাজের ছেলেটিকে বলল ভেনকে খাবার দেবার জন্যে।
একটু পরেই ছেলেটি কাটা রুটি মাংস সবজি দিয়ে গেল। ভেন বুঝল,বড়ো খিদে পেয়েছে। চেখে খাওয়ার ধৈর্য নেই। হাপুস হুপুস খেতে লাগল।
কিছুক্ষণ খাওয়ার পর ভেন বলল–আপনার দোকানে থাকার ব্যবস্থা আছে তো?
–হ্যাঁ হ্যাঁ। পাতবার তুলোর গদীমতো বালিশ সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আপনি থাকবেন? সরাইখানার মালিক বলল।
–সেটা এখনও ঠিক করি নি। রাতে খেতে এসে বলবো। ভেন বলল।
খেতে খেতে ভেন বলল–আচ্ছা–এটা তো আরবী শাসক মিনের রাজ্য?
–না–না। মালিক বলল।
–বলেন কি। ভেন হাঁ করে সরাইওয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল।
সারাইওয়ালা বলতে লাগল শাসক মিনের রাজত্ব হল উত্তর দিকে। এখানকার শাসক ওয়াজির্মো। ভেন আর কোনো কথা বলল না। বুঝল–সব কষ্টই বৃথা গেল। আবর যেতে হবে শাসক মিনের রাজত্বে। বোঝা যাচ্ছে থর্ন বনের উত্তর দিকে মিনের রাজত্ব। এটা থর্ন বনের পূর্বদিক। ভেন বলল–রাজা ওয়াজির্মোর রাজবাড়িটা কোথায়?
–কাছেই। এই টিলাটার নীচে। মালিক বলল।
শাসক ওয়াজির্মো কেমল লোক? সরাইওয়ালা ভেনের কাছে এলো। গলা নামিয়ে বলল রাস্তার গুণ্ডা রাজা হয়েছে। কে জানে কত মানুষ হত্যা করে ওয়াজির্মো রাজা হয়েছে। সাধারণ মানুষ শাসক ওয়াজির্মোর ওপর খুব রেগে আছে। কিন্তু কী করবে? ক্ষমতা তো শাসক ওয়াজির্মোর হাতে।
ও
তখনই রাস্তা দিয়ে ওয়াজির্মোর সৈন্যরা কুচকাওয়াজ করে গেল।
–এখানে যুদ্ধের আয়োজন চলছে। ভেন বলল।
-হ্যাঁ। রানি ঈশিকার রাজ্য ওয়াজির্মো দখল করতে যুদ্ধের আয়োজন করছে। মালিক বলল।
–যা দেখলাম–শাসক ওয়াজির্মোর সৈন্যসংখ্যা খুবই কম।
–কিন্তু উপায় নেই। শাসক ওয়াজির্মো প্রত্যেক দিন সকালে বিকেলে সৈন্যদের কুচকাওয়াজ দেখে। প্রজাদের সামনে বক্তৃতা দেয়। প্রজাদের উৎসাহিত করে রানি ঈশিকার বিরুদ্ধেলড়াই করবার জন্যে। মালিক বলল।
-প্রজাসাধারণ কি উৎসাহিত হয়েছে? ভেন বলল।
–না–না। কিন্তু উপায় নেই। সেনাপতিটি রাজ্যের সর্বত্র নজর রাখছে কতকগুলি বিশেষ সৈন্যদের সাহায্যে। যুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বলে অনেকে মারা গেছে। যেমন রাজা ওয়াজির্মো তেমনি তার সেনাপতি। দুজনের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলে কে কত হিংস্র তার প্রমাণ দেওয়ার। কিন্তু শাসক ওয়াজির্মোকে চটাতে কেউ সাহস পায় না। মন্ত্রীও বৃদ্ধ। চুপ করে থাকে। মালিক বলল।
বিকেলে রাজবাড়িটা দেখবো। ভেন বলল।
–দেখলে অবাক হবেন– এই তল্লাটে এত বড়ো প্রাসাদ নেই। এত অর্থব্যয়ে কোনো রাজা বা রানি অট্টালিকা করতে পারে নি। ঐ প্রাসাদের অর্থ আমরাই দিয়েছি। মলিক বলল।
তাহলে আপনাদের খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয়। ভেন বলল।
–সে তো বটেই। মালিক বলল।
ভেন উঠে দাঁড়াল। মালিক পাতায় জড়ানো খাবার ভেনকে দিল।
খাবার নিয়ে ভেন বলল–চলি ভাই। আমি আর আমার বন্ধু সন্ধেবেলা আসবো।
ভেন আস্তে আস্তে হেঁটে সেই গাছটার কাছে এলো। ফ্লেজার গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। খাবার নিয়ে ঘাসে ঢাকা মাটিতে বসল। খেতে লাগল। ভেন চুপ করে বসে রইল। ক্ষুধার্ত মানুষটা খেয়ে তৃপ্তি হোক। ভেন কোনো কথা বলল না। খেতে খেতে ফ্লেজার বলল-কী খবর এনেছো বলো।
-বলছি তুমি খেয়ে নাও। ভেন বলল।
ফ্লেজারের খাওয়া শেষ হল। ভেন ওর পাশে বসল।
জল তো খাওয়া হল না। ভেন বলল।
পরে খাবো। তুমি কী খবর আনলে বলো।
–ফ্লেজার আমরা ভুল করে অন্য এক দেশে এসেছি। ভেন বলল।
তার মানে? ফ্লেজার ভেন-এর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল।
–আমরা শাসক ওয়াজির্মোর রাজত্বে এসেছি–পথ ভুলে। ভেন বলল।
বলো কি! তাহলে বনভূমিতেই আমরা পথহারিয়েছিলাম। ফ্লেজার বলল।
বনের মধ্যে পথ কোথায়? আমরা দিভ্রান্ত হয়েছিলাম। ভেন বলল।
–তাহলে এখন কী করবো? ফ্লেজার বলল।
এবার ভেন আস্তে আস্তে বেশ কিছুক্ষণ সরাইওয়ালার কাছে যা-যা শুনেছিল সে সব বলল। সব শুনে ফ্লেজার বলল–তাহলে এখানে থেকে কী হবে?
–হবে। আমি সরাইওয়ালাকে বলে খাবার ব্যবস্থা করেছি। সন্ধে হলে সেখানে যাবো। ভেন বলল।
–কিন্তু এখানে থাকতে চাইছেন কেন? ফ্লেজার বলল।
–দেখো ফ্লেজার–আমরা রানিকে বলেছি আমরা গুপ্তচর হয়ে শাসক মিনের রাজ্যে যাবো–যুদ্ধের গোপন খবর নিয়ে আসবো। তার সঙ্গে এই শাসক ওয়াজিমোর যুদ্ধপ্রস্তুতির খবরও নিয়ে গিয়ে জানাবো। আমার মনে হয় রানি এই শাসক ওয়াজির্মো যে তার রাজ্য আক্রমণ করবে এই সংবাদটা জানে না। এখন এইখানে থেকে আমরা যুদ্ধের ব্যাপারে কিছু গোপন খবর সংগ্রহ করবো। তারপর ফিরে গিয়ে রানি ঈশিকাকে জানাবো। দুটো রাজ্যের দুটো সংবাদ রানিকে জানাতে পারলে রানি নিশ্চয়ই খুশি হয়ে আমাদের মুক্তি দেবে। অন্য কোনোভাবে মুক্তি পাবো না। ভেন বলল।
ফ্লেজার কিছুক্ষণ ভাবলো তারপর বলল–ভেন– তোমার কথা ঠিক। দু দুটো গোপন সংবাদ দিতে পারলে রানি নিষ্মই আমাদের মুক্তি দেবে।
–ভেবে দেখোবাধ্য হয়ে আমরা গুপ্তচরবৃত্তির মতো হীন কাজ করছি। আমরা নিরুপায়। যেভাবেই হোক এই পথটা নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। ভেন বলল।
কিন্তু প্রথমে তো দিক ভুল করে এখানেই এসে পড়েছি। এবার এখান থেকে শাসক ওয়াজির্মো কীভাবে রানি ঈশিকার দেশ আক্রমণ করার পরিকল্পনা নিচ্ছে এটা জেনে রানিকে সাবধান করে দিতে পারলে রানি খুব খুশি হবে। আমরাও মুক্তি পাবো। ফ্লেজার বলল।
তাহলে এখন কী করবে? ভেন বলল।
–এখানেই সরাইখানায় থাকবো ঘুরে ঘুরে খবর সংগ্রহ করবো। ফ্লেজার বলল।
–কিন্তু যদি ধরা পড়ি তাহলে কিন্তু মরতে হবে। ভেন বলল।
–যাতে মরতে না হয় সেইমতো কাজে নামতে হবে। ফ্লেজার বলল।
দেখা যাক গুপ্তচরবৃত্তিতে আমরা কতটা সফল হই। ভেন বলল।
সন্ধে হয়ে এলো। ফ্লেজার আর ভেন গাছতলায় বসে রইল। যখন সন্ধের পর রাত হল তখন দুজনে উঠে দাঁড়াল। রাস্তায় নামল। হাঁটতে হাঁটতে সরাইখানাটার সামনে এলো।
ওরা এদিকে ওদিকে দেখে নিয়ে সরাইখানায় ঢুকল। সরাইখানায় বেশ ভিড়। ভিড় কাটিয়ে ভেন সরাইওয়ালার কাছে গেল।
বলল–চিনতে পারছেন?
মোমবাতির আলোয় ভেনকে দেখে সরাইওয়ালা চিনল।
নিশ্চয়ই। একটা কাজের ছেলেকে সরাইওয়ালা ডাকল। ছেলেটি এলে বলল– যা–দুটো বিছানা পেতে দে। ছেলেটি পেছনের দিকে চলল। লম্বা ঘর। তার ওপর লম্বা ফুল লতাপাতা আঁকা মোটা কাপড়। ছেলেটি বালিশ রেখে চাদরটা টেনে তুলে ঠিক করে দিল। চলে গেল।
ভেন শুয়ে পড়ল। বলল–অত ভিড়ে আমরা খেতে যাবো না। রাত হোক। পরে খাবো। ফ্লেজার উঠল। বসে রইল।
কিছুক্ষণের মধ্যে আরো দুজন লোক এলো। ছেলেটি তাদেরও বিছানা বালিশ ঠিক করে দিয়ে চলে গেল।
-ফ্লেজার? ভেন বলল।
—বলো।
–দেখো-এখনি কিছু দরকারি কথা সেরে ফেলি। পরে ভিড় বাড়বে।
–বলো। কথাটা বলে ফ্লেজার ভেনের মুখের দিকে ঝুঁকে বসল।
–কীভাবে খবরটবর জোগাড় করবে? ভেন বলল।
-দেখো–আমি যা ভেবেছি বলছি। একটু থেমে ফ্লেজার বলল–রাজবাড়িতে। মন্ত্রণাকক্ষটা কোথায় সেটা খুঁজে বের করতে হবে।
কক্ষটি নিশ্চয়ই রাজবাড়ির মধ্যেই কোথাও আছে। ভেন বলল।
–তা তো বটেই। কিন্তু সেই ঘরটা রাজবাড়ির কোথায়? ফ্লেজার বলল।
–রাজবাড়িতে না গেলে জানা যাবে না। ভেন বলল।
তাহলে কালকে সকালে চলো। রাজবাড়ির মধ্যে যেতে হবে। ফ্লেজার বলল।
প্রধান প্রবেশ পথে নিম্মই প্রহরীরা থাকবে। ভেন বলল।
–থাকবে তো বটেই। ওদের ধোঁকা দিতে হবে। সেইসঙ্গে মন্ত্রণাকক্ষটি কোথায় তাও জানতে হবে। ফ্লেজার বলল।
সে রাতটা কাটল। বেশ ভিড় হল সরাইখানায়। কিন্তু ফ্লেজার আর ভেন-এর বিশেষ অসুবিধে হয় নি। কিন্তু নানা চিন্তা তো মাথায়। ভালোভাবে ঘুমুতে পারেনি। একটু বেশি রাতেই দুজন ঘুমোতে পেরেছিল। কাজেই একটু বেলায় দুজনের ঘুম ভাঙল।
প্রাতরাশ খেয়ে দুজনে তৈরি হল। তলোয়ার নিল না।
বেলা বাড়ল। দুজনে চলল রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে। বেশ হাঁটতে হল। রাজবাড়ির সামনে এলো। সত্যি বেশ অর্থব্যয় করে বাড়িটা নির্মাণ করা হয়েছে। দামি পাথর আর শ্বেতপাথর দিয়ে তৈরি। সদর দেউড়িতে প্রহরী আছে চারজন। চারজনেরহাতেই পেতলের ঝকঝকে বর্শা। কোমরে তলোয়ার।
ফ্লেজার আর ভেন সদর দরজার কাছে এসে দাঁড়াল। সদর দরজা বন্ধ। দুজনে লোহার গরাদে তৈরি সদর প্রবেশ দ্বারে। ফ্লেজাররা গরাদের ফাঁক দিয়ে রাজবাড়ির ভেতরটা দেখতে লাগল। সদর দেউড়ির পরেই বেশ বড়োদুটো ফুল বাগান। তারপরেই রাজবাড়ি। দুটো বাগানের মধ্যে দুটো ফোয়ারা।
ফ্লেজার একজন প্রহরীকে বললআচ্ছা আমরা ভেতরে ঢুকেরাজবাড়ি দেখতে পারিনা?
না। ভেতরে যাওয়ার অনুমতি আনতে হবে সেনাপতির কাছ থেকে।
আমরা ভেতরটা দেখতে চাই। সেনাপতিকে কোথায় পাবো?ফ্লেজার বলল।
–ঐ যে শুধুকাঠে তৈরি বাড়িটা–প্রহরী আঙ্গুল দিয়ে দেখাল–ঐ বাড়িটার পরেই। দামি পাথরের বাড়িটা। সেনাপতির বাড়ি ওটাই। প্রহরী বলল।
–ঠিক আছে। ফ্লেজার বলল।
দুজনে সদর রাস্তায় এলো। চলল সেনাপতির বাড়ির দিকে। কাঠের বাড়িটার পরেই সেনাপতির বাড়ি।
সেনাপতির বাড়ির দরজায় দুজন সশস্ত্র প্রহরী। ফ্লেজার একজন প্রহরীকে বলল– সেনাপতির সঙ্গে দেখা করতে চাই। সেনাপতি দেখা করতে দেবেন কিনা এটা জানতে পারলে ভালো হত।
–দেখছি। একজন প্রহরী বাড়ির মধ্যে ঢুকে গেল। একটু পরে প্রহরীটা ফিরে এলো। বলল–বাইরের ঘরে অপেক্ষা করো। সেনাপতি আসবেন।
প্রহরী দরজা খুলে ধরল। ফ্লেজাররা বাইরের ঘরে ঢুকল। মোটামুটি সাজানো গুছোনো ঘরটা।
দুজনে কালো কাঠের চেয়ারে বসল। একটু পরেই সেনাপতি ঘরে ঢুকল। গদিপাতা চেয়ারটায় বসল। ফ্লেজারদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমরা বিদেশি।
–হ্যাঁ–আমরা ভাইকিং। ফ্লেজার বলল।
–হু–তা আমার কাছে কী মনে করে? সেনাপতি বলল।
–আমরা রাজবাড়িটা একটু ঘুরে দেখতে চাই। তাই আপনার অনুমতি চাই। ফ্লেজার বলল।
হঠাৎ রাজবাড়ি দেখার শখ হল কেন? সেনাপতি বলল।
–রাজা ওয়াজিমোর রাজপ্রাসাদনাকি এত সুন্দর যে নিসবনেও এত সুন্দর অট্টালিকা নেই। ফ্লেজার বলল।
হ্যাঁ। কথাটা মিথ্যে শোনো নি। যাকগে–আমি এক ঘণ্টার সময় দিচ্ছি। তার বেশি থাকতে পারবে না। সেনাপতি বলল।
–এক ঘণ্টাই যথেষ্ট। ভেন বলল।
পাথরের টেবিলের ওপর থেকে সেনাপতি একটা পার্চমেন্ট কাগজ নিল। পাখির পালকে তৈরি কলমটা হাতে নিল। রুপোর দোয়াতদানে কলমটা ডুবিয়ে নিল। লিখতে লাগল। লেখা হলে কাগজটা ফ্লেজারের হাতে দিল।
দুজনে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
ফেরার পথে দুজনে শাসক ওয়াজির্মোর প্রাসাদের সামনে এলো। দেউড়ির কাছে গেল। একজন প্রহরীকে ডাকল। প্রহরী কাছে এলে সেনাপতির অনুমতিপত্রটা দেখাল। প্রহরী অনুমতিপত্রটা নিয়ে আরেকজন প্রহরীর কাছে গেল। তার হাতে দিল। বোঝা গেল ঐ প্রহরীটিই এদের দলপতি।
প্রহরীটি অনুমতিপত্রটি হাতে নিয়ে ফ্লেজারদের কাছে এলো। বলল–সেনাপতি এক ঘণ্টার সময় দিয়েছেন। তোমরা কখন দেখতে যাবে?
–এখনই যাবো। ফ্লেজার বলল।
–বেশ। এই বলে সে একজন প্রহরীকে ডাকল। প্রহরীটি এলে তাকে বলল–এই দুজনকে রাজবাড়িটা দেখিয়ে আনো। সময়–এক ঘণ্টা।
প্রহরীটি ফ্লেজারদের কাছে এলো। বলল–চলুন। প্রহরীটির বয়েস কম। পোশাক টোশাক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।
প্রহরীটি চলল রাজবাড়ির দিকে। পেছনে ফ্লেজার আর ভেন। যেতে যেতে ফ্লেজার ভাবল-রাজবাড়ির মন্ত্রণাকক্ষটা কোথায় সেটা জানাই আমাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু আগেই মন্ত্রণাকক্ষটা কোথায় জানতে চাই এসব বলা যাবে না। সময় বুঝে বলবো।
মূল রাজবাড়ির সামনে এসে ওরা দাঁড়াল। প্রহরীটি বলল–আগেই পশ্চিমটা দেখে আসি। সেইদিকে চলল। পেছনে ফ্লেজার আর ভেন।
একটা বড়ো ঘরের কাছে এসে প্রহরী বলল–এটা হচ্ছে পড়াশুনোর জন্যে ঘর। বড়ো বড়ো পণ্ডিতরা থাকে। আর একটা লম্বাটে ঘর দেখিয়ে বলল–এখানে ছাত্ররা থাকে। তারই পাশে একটা মাঠমতো। এখানে খেলাধূলো হয়।
কিছু পরে রাজবাড়ির মধ্যেই একটা বড়ো ঘর দেখিয়ে প্রহরীটি বলল–এটা হচ্ছে অস্ত্রাগার। দেখা গেল চারজন প্রহরী ঘরটা পাহারা দিচ্ছে। হাতে খোলা তলোয়ার।
রাজবাড়িটার দক্ষিণ কোণায় একটা ছোটো ঘর দেখিয়ে বলল–এটা মন্ত্রণাকক্ষ। ফ্লেজার এই ঘরটাই খুঁজছিল।
–এখানে তো কোনো প্রহরী নেই। ফ্লেজার বলল।
–থাকে যখন এই কক্ষে রাজা মন্ত্রী সেনাপতি দুজন অমাত্য এসে বসেন। এখানে দেশ শাসন যুদ্ধে আর্থিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রহরী বলল।
–এই মন্ত্রণাসভা কখন বসে। ফ্লেজার জানতে চাইল।
সাধারণত সন্ধের পরে। প্রহরীটি বলল। প্র
ত্যেকদিনই কি বসেন সবাই। ফ্লেজার বলল।
-প্রায় প্রত্যেকদিন। তবে প্রতি সোমবার আলোচনা সভা বসবেই। সেদিন বেশ রাত পর্যন্ত সভা চলে। প্রহরীটি দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল–আপিন এত কথা জানতে চাইছেন কেন? সঙ্গে সঙ্গে ফ্লেজার সতর্ক হল। বলল–দেখুন–এখানকার কয়েকটি দেশ নিয়ে আমি পড়াশুনো করেছি। এবার দেখতে বেরিয়েছি। রানি ঈশিকা আর সেউতার শাসক মিনের রাজত্ব গেছি। সব সংবাদ সংগ্রহ করেছি। এবার এখানে এসেছি। এইসব এলোকার আর্থিক অবস্থা কেমন সেটা লিখতে গিয়ে আরো তথ্য চাই। আমি এসব নিয়েই পড়াশুনো করি লিখি।
–ও। তাই বলুন। এখানে আর বিশেষ কিছু দেখার নেই। প্রহরীটি বলল।
–সৈন্যাবাসটা কোথায়? ভেন বলল।
–সেটা দক্ষিণ দিক দেখিয়ে বলল রাজবাড়ির দেয়ালের ওপাশে বিরাট মাঠ রয়েছে সেখানেই সৈন্যদের আসন।
–ঠিক আছে–ফ্লেজার বলল–তাহলে আর কিছু দেখার নেই।
–একটা ছোটো চিড়িয়াখানা আছে। প্রহরীটা বলল।
–না–না। অনেক দেখা হয়েছে। ফ্লেজার বলল-চলো ভেন।
দুজনে সদর দেউড়িতে এলো। প্রহরীটিকে ধন্যবাদ দিয়ে দরজার গায়ে হাত রাখল। প্রহরীটি এসে ঠেলে দরজাটা খুলে দিল।
দুজনে সদর রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
ফ্লেজাররা যখন সরাইখানায় ফিরল তখন বেশ বেলা হয়েছে। সরাই মালিক একটু দ্রুতই ওদের কাছে এলো। বলল–কোথায় গিয়েছিলেন?
রাজবাড়িটা দেখে এলাম। ভেন বলল। তারপর বলল–সেনাপতি অনুমতি দিল।
–বোধহয় আমাদের বিদেশি দেখে সেনাপতির দয়া হয়েছিল। এক ঘণ্টার জন্যে রাজবাড়ি দেখতে অনুমতি দিয়েছিলেন। ফ্লেজার বলল।
সরাই মালিক সজোরে বলে উঠল আরে–আমাকে তো বলবেন।
–কেন বলুন তো? ভেন বলল।
–রাজবাড়ির এক পাহারাদার ইগর আমার খদ্দের। আমার দোকানে সপ্তাহে দুতিনদিন আসবেই। খেয়ে যাবেই। মালিক বলল।
–ও। ফ্লেজার বলল–তাহলে উনি তো ভালোভাবে।
মালিক ফ্লেজারকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠল–আপনাদের সব দেখাতো।
যাক গে–দেখা তো হয়েছে। ভেন বলল।
ফ্লেজার তখন চিন্তামগ্ন। দ্রুত ভাবছে ঐ প্রহরীর মারফৎই গোপন সংবাদ বের করা যাবে। তাই বলল–আচ্ছা ইগর কি আজকে খেতে আসবেন?
আসবেন বই কি। ইগরের স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি গেছে। ইগরের রান্নার বালাই নেই। দুবেলা আমার এখানেই খাচ্ছে। মালিক বলল।
–রাতে কখন খেতে আসে? ফ্লেজার বলল।
–তার ঠিক নেই। মালিক বলল।
–এলে আমাদের কথা একটু বলবেন। বলবেন যে আমরা ওঁর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। ফ্লেজার বলল।
–নিশ্চয়ই বলবো। মালিক বলল। মালিক চলে গেল।
দুজনে পেছনের ঘরটায় এলো।
দুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে ফ্লেজার আর ভেন বিছানার ওপর এসে বসল। ফ্লেজার শুয়ে পড়ল। ভেন বসে রইল। একটু পরে ভেন বলল–ফ্লেজার পারবে ইগরের সঙ্গে কথা বলে গোপন সংবাদ বের করতে?
–চেষ্টা তো করি। দেখা যাকে। ফ্লেজার বলল।
বিকেলের দিকে দুজনে জায়গাটা দেখতে বেরুলো। ছোটো নগর। জনসংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে রাস্তাঘাট দোকান বাজার বেশ পরিচ্ছন্ন।
ফ্লেজার প্রায় কিছুই দেখছে না। নানা চিন্তা মাথায়? ফ্রান্সিসরা কোথায়? ওরা লড়াইটড়াইয়ে নেমে পড়েছে কিনা। তবে ভরসা ঐ ফ্রান্সিস। বোকার মতো কোনো কাজ ফ্রান্সিস করবে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ফ্লেজার। আবার কবে আমাদের সবাইর সঙ্গে সবাইর দেখা হবে। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাই মনে পড়ল রাজবাড়িতে শাসক ওয়াজির্মোর স্থাপিত স্কুল, ছেলেদের বাড়ি এসবের কথা।সরাইখানার মালিক যা বলেছিল। তার সঙ্গে শাসক ওয়াজির্মোর কাজের কোনো মিল নেই। সরাইওয়ালা অসৎ। সে মানুষের সগুণ দেখতে পায় না। মানুষের নামে কুৎসা রটাতে সে ভালোবাসে। যাক গে–তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক থাকা খাওয়া। চলে গেলেই তার সঙ্গে সম্পর্ক শেষ।
ফ্লেজাররা সন্ধের কিছু পরেই খেয়ে নিল। নিজেদের জায়গায় শুয়ে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
তখন একটু বেশি রাত হয়েছে। হঠাৎ ফ্লেজাররা শুনল চড়া গলার হাসি। সেইসঙ্গে সরাইওয়ালার বিগলিত সুরে বলা–আসুন–আসুন ইগর।
–খেতে দাও। চড়া গলা ইগরের।
ভেন কাঠের বিছানা থেকে নামল। দোকানঘরের পিছন দিককার দরজার কাছে এলো। দেখল ইগরকে। বেশ স্বাস্থ্যবান লম্বা চওড়া চেহারা। ভেন চলে এলো। বিছানায় বসতে বসতে বলল–প্রহরীর যেমন চেহারা হওয়া উচিত তেমনি চেহারা।
–এখন আমাদের প্রস্তাব শুনে কী বলে দেখি। ফ্লেজার বলল।
ফ্লেজাররা অপেক্ষা করতে লাগল।
ইগরের খাওয়া হল। ইগর বারপাঁচেক মাংস রুটি চাইল। সরাইমালিক ফ্লেজার আর ভেন-এর কাছে এলো। বলল–আপনাদের কথা বলেছি।ইগর আসছে এখানে কথাবার্তা বলবেন।
কিছুপরে ইগর এসে ফ্লেজারদের বিছানার সামনেদাঁড়াল। বেশভারী গলায় বলল– কী ব্যাপার বলুন তো?
একটা বিশেষ জরুরি কথা আছে। আপনি বসুন। ভেন বলল।
বসলে কাঠের পাটাতন ভেঙে যাবে। দাঁড়িয়েই কথা বলবো। ইগর বলল।
–আমি আগেই বলেছি আমার বন্ধুদের বাঁচাবার জন্যেই একটি প্রস্তাব আপনার কাছে রাখবো। ফ্লেজার বলল।
–ঠিক আছে বলুন। ইগর বলল।
ফ্লেজার বলতে লাগল–আমরা ভাইকিং বিদেশি। আমরা একটা জাহাজে চড়ে দেশ দ্বীপ ঘুরে ঘুরে বেড়াই। গুপ্তধনের খবর পেলে আমরা খুঁজে বের করি। যার বা যাদের সেটা প্রাপ্য তাদের নিয়ে আমরা জাহাজ ভাসাই। অন্য দেশে অন্য দ্বীপে যাই।
-বলেন কি! গুপ্তধন আবিষ্কার করেন তার ভাগও নেন না–এ কখনও হয় নাকি। আপনারা তো বোকা। ইগর বলল।
হ্যাঁ লোকে তাই ভাবে। যাকগে–এখানে আমরা জাহাজে চলে এসেছি। অনেকদিন আগে এখানকার এক রাজা ওবিজ্ঞে সাত হাত লম্বা একটা খাঁটি সোনর তরবারি তৈরি করিয়েছিলেন। তিনি মৃত্যুর আগে কাউকে বলে যান নি সেই সোনার তরবারি তিনি কোথায় রেখে গেছেন। ফ্লেজার বলল।
–বলুন। ইগর বলল।
–একটা নকশা আমরা পেয়েছিলাম। হঠাৎই। সেটা দেখে দেখে আমরা গুপ্ত তরবারির হদিশ পাবো বলে আশা করছি। এখন আমার বন্ধুরা রাজা মিনের কয়েদঘরে বন্দী রানি ঈশিকা আমাদের বন্ধুদের কারারুদ্ধ করেছে।
–হু। বলে যান। ইগর বলল।
–এখন রানি ঈশিকা আমাকে আর এই বন্ধুকে একটি শর্তে মুক্তি দিয়েছে। শর্তটি হল–শাসক মিন-এর যুদ্ধ পরিকল্পনার ব্যবস্থা জেনে রানিকে বলতে হবে। অর্থাৎ গুপ্তচরের নীচ কাজ।
-তারপর? ইগর বলল।
–আমরা দুজনে বেরিয়েছিলাম শাসক মিনের দেশে যাবো বলে। কিন্তু আমরা পথ ভুলে এই দেশে চলে এসেছি। ফ্লেজার বলল।
–এখন কী করতে চান? ইগর বলল।
আপনাদের শাসক ওয়াজির্মোর রানি ইশিকার সঙ্গে যুদ্ধের তোড়জোড় শুরু করেছেন। আপনি কি এটা জানেন? ফ্লেজার বলল।
–নিশ্চই জানি। প্রহরী হলেও আমাদের যুদ্ধ করতে হয়। যাকগে–এখন আপনার আমারা সঙ্গে কী কথা বলতে চান? ইগর বলল।
–দুভাবে আপনি আমাদের সাহায্য করতে পারেন। এক–আপনার প্রহরীর পোশাকটা আমাকে ধার দিতে পারেন–একরাতের জন্যে। দুই–আপনি নিজে কাজটা করতে পারেন।
–ঠিক বুঝলাম না। ইগর বলল।
–আপনার পোশাক পরে আমি শাসক ওয়াজির্মোর গোপন আলোচনা শুনতে পারে। অন্যপথ–আপনি নিজে শাসক ওয়াজির্মোর যুদ্ধ পরিকল্পনা শুনতে পাবেন পরে আমাদের সেটা জানাতে পারেন। দুটি দেশের যুদ্ধে পরিকল্পনা জানতে পারলে রানি ঈশিকা খুশি হয়ে আমাদের মুক্তি দেবে। ফ্লেজার বলল।
–সেটা হতে পারে। যাহোক আমার কাছে আপনারা কী চান? ইগর বলল।
–একটু আগেই তো বললাম আপনি আমাদের কীভাবে সাহায্য করতে পারেন। ফ্লেজার বলল।
পোশাক পরে কাজ করার বিপদ অনেক। আমিও জড়িয়ে যাবো। মনে হয় মন্ত্রণাকক্ষের কথাবার্তা সিদ্ধান্ত সবই আমি আড়াল থেকে শুনে জানতে পারি। পরে আপনাদের বলতেও পারি। ইগর বলল।
–দেখুন-গুপ্তচরবৃত্তি অত্যন্ত নিম্নস্তরের কাজ। এটা আমরা জানি। কিন্তু আমি আর আমাদের বন্ধুদের চিরজীবন কাটবে কয়েদঘরে এটা ভাবলে আমি কষ্টে চোখের জল ফেলি। ফ্লেজার বলল।
–হুঁ। ব্যাপারটা খুবই দুঃখের বেদনার। ইগর বলল।
–আরো একটা সম্ভাবনার কথা বলি। রানি ঈশিকা আমাদের বলেছে যে কিছুদিনের মধ্যে ওখানকার সমুদ্রতীরে ক্রীতদাস কেনাবেচার হাট বসবে। আমরা যদি শাসক মিনের যুদ্ধের পরিকল্পনা ঐ হাটবসার আগে রানিকে বলতে না পারি তবে আমাদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করে দেবে। শাসক মিন আর রানি ঈশিকার দয়ামায়া বলে কিছু নেই। এই মৃত্যু আর ক্রীতদাস হওয়া থেকে আপনিই আমাদের রক্ষা করতে পারেন। ফ্লেজার বলল।কিন্তু কোনোদিন শাসক ওয়াজির্মো এসব নিয়ে কথা বলবেন তাতো আগে থেকে জানতে পারবো না। ইগর বলল।
–আমি শুনেছি প্রতি সোমবার মন্ত্রণাকক্ষে শাসকওয়াজির্মো আর মন্ত্রী সেনাপতিরা বসে। দু’একজন অমাত্যও থাকেন। আপনাকে শুধু সোমবারের পাহারার কাজ করতে হবে। ফ্লেজার বলল।
–ঠিক আছে–দেখছি। কালকেই তো সোমবার। ইগর বলল।
–আপনি একটু চেষ্টা করলেই এই কাজটা করতে পারবেন। ফ্লেজার বলল। ইগর আস্তে আস্তে চলে গেল।
ফ্লেজার বলে উঠল–এখন যদিফ্রান্সিস থাকতো আমরা কত নিশ্চিন্ত হতে পারতাম।
–ওসব ভেবে কী হবে। দায়িত্ব আমাদের ওপর পড়েছে সেটা পালন করার দায়িত্বও আমাদের। ভেন বলল।
পরের দিনটা শুধু কী হয় কী হয় ভেবেই ফ্লেজারের আর ভেন-এর সময় কাটল।
সন্ধে পর্যন্ত সরাইখানাতেই থাকল। একটু রাত হতেই দুজনে বেরোল। হাঁটতে হাঁটতে রাজবাড়ির সামনে এলো। একটা গাছের নীচে দুজনে দাঁড়াল।
বেশ রাত হল। সেনাপতি মন্ত্রী অমাত্যরা ঘোড়ার গাড়ি চেপে চলে গেল।
এবার ইগর বেরোবে।
দুজনে সদর দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। সাত বাড়তে লাগল।
ইগর আর অন্য প্রহরীরা সাধারণ পোশাকে বেরিয়ে এলো।
-চলো। বলি এবার। ভেন বলল।
–না ভেন। এখন নয়। ওর সহকর্মীদের সামনে কোনো কথা নয়। ফ্লেজার বলল।
দুজনে ইগরদের পেছনে পেছনে চলল।
একজন দুজন করে ইগরের সহকর্মীরা চলে গেল। রইল একজন সহকর্মী।
– এখন কী করবে? ভেন বলল।
–ইগর একা না হওয়া পর্যন্ত আমরা ওর কাছে যাব না। ফ্লেজার বলল।
সরাইখানার কাছাকাছি এসে একজন সহকর্মী চলে গেল। একা ইগরের সঙ্গে কথা বলা যায়। ভেন বলল–এখুনি কথা বলা যায়।
–না ভেন। অধৈর্য হয়ো না। ফ্লেজার বলল।
ইগর সরাইখানায় ঢুকল। মালিক ছুটে এলো। ঘাড় কাত করে বলতে লাগল– আসুন–আসুন। একটু দেরি হল আসতে।
হুঁ। সেই দুজন লোক কোথায়? ইগর বলল।
ওঁরা তো বেরিয়ে গেছেন। মালিক বলল।
বেরিয়ে গেছেন? ইগর কথাটা বলে দরজার দিকে তাকাল। দেখল দুজন দাঁড়িয়ে আছে।
ইগর কোনো কথা না বলে ভেতরে ঢুকল। ফ্লেজারদের বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল।
দুজনে এসে ইগরের সামনে দাঁড়াল।
ইগর একবার দুজনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বলল–শাসক ওয়াজির্মো সেনাপতি মন্ত্রীরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে–সেটা আমি একটা কাগজে লিখে নিয়ে এসেছি। ইগর বুক পকেট থেকে একটা কাগজ বের করল। ফ্লেজারকে দিল।
ফ্লেজার কাগজটা মোমবাতির কাছে নিয়ে গেল। পড়তে লাগল
প্রথমে আমরা রানি ঈশিকার দেশ আক্রমণ করবো। ঈশিকার সৈন্যবল কম। আমরা, অতর্কিত আক্রমণ করবো। রানিকে সৈন্য সাজাবার সময়ই দেব না। কিন্তু আমরা সামনাসামনি অক্রমণ করবো না। চোরাগোপ্তা আক্রমণ করবো। রানির আবাসে গিয়ে রানিকেই বন্দী করবো। তাহলেই সৈন্যদল হতাশ হবে। তখন তাদের বন্দী করা হবে। এই আক্রমণে প্রথমেই সেনাপতি যাবে কিনা সেটা পরে আলোচনা করে স্থির করতে হবে।
ফ্লেজার হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে ইগরকে জড়িয়ে ধরল। বলল–আমরা প্রায় পনেরোজন বন্ধুকে আপনি বাঁচালেন।
-দেখুন গিয়ে রানি ঈশিকা কী বলে দেখুন। ইগর বলল। তারপর চলে গেল।
ফ্লেজার আনন্দে ভেন-এর হাত জড়িয়ে ধরল। বলল–ভেন-অর এক মুহূর্তও নয়। আমরা এক্ষুণি রওনা দেব। থর্ন বোনের মধ্য দিয়ে যাবো। চলো।
অল্পক্ষণের মধ্যে পোশাক কাপড়টাপর সব গুছিয়ে নিয়ে সরাইখানা থেকে বেরোবে বলে দরজার কাছে এলো। সরাইওয়ালা এগিয়ে এলো। দরজার তালা খুলে দিল।
দুজনে বেরিয়ে এলো। ভেন কোমর থেকে একটা ছোটো সোনার চাকতি বের করে সুরাইওয়ালাকে দিল। সরাইওয়ালা খুশির হাসি হাসল।
থর্নবনের মধ্যে দিয়ে দুজন আস্তে আস্তে যেতে লাগল। অনেকটা এসেছে দুজনে।
তখনই গাছপালার ফাঁক দিয়ে ফ্লেজারের নজরে পড়ল একটা ছোটো কুঁড়েঘর। ওরা কুঁড়েঘরটার কাছে এলো। ফালি কাঠের দরজা। দেখল দরজা বন্ধ। ফ্লেজার দরজার কাছে এলো। আঙ্গুল ঠুকে শব্দ করল। দরজা খুলে গেল। দুজনে দেখল–এক পাকা দাড়ি গোঁফওয়ালা বৃদ্ধ।
বেশ শান্ত সৌম্য চোহারা। বৃদ্ধ জিগ্যেস করল–কে তোমরা? কী চাও।
আমরা ভাইকিং বিদেশি। জাহজে চড়ে আমরা এসেছি। কিছু বন্ধু জাহাজ থেকে এখানে এসেছিল। খাদ্য আর জল নিয়ে যেতে। কিন্তু তারা আজও জাহাজে ফেরেনি। এখন কোথায় আছে অথবা অন্য কোথাও চলে গেছে কিনা সেই খোঁজেই আমরা এসেছি।
–তোমরা এখন কোথায় যাবে? বৃদ্ধ জানতে চাইল।
শাসক মিনের রাজ্যে। ফ্লেজার বলল।
–সে তো এই থর্ন বনভূমির মধ্যে ওপাশে কিনারা দিয়ে যেতে পারো তো। বৃদ্ধ বলল।
–না। আমরা বনভূমির মধ্যে দিয়েই যাবো। লুকিয়ে যাবো। ফ্লেজার বলল।
–বেশ যাও। কিন্তু নিশানা হারিও না। যদি নিশানা হারাও তবে এই বনভূমিতেই ঘুরে বেড়াতে হবে। বন থেকে বেরোবার পথ পাবে না। বৃদ্ধটি বলল।
না-না। আমরা নিশানা ঠিক রাখবো। ফ্লেজার বলল।
বৃদ্ধটি বলল–এই দুই রাজ্যের মধ্যে লড়াই আর থামল না। রানি ঈশিকার পিতা যখন রাজা ছিলেন অনেক চেষ্টা করেছিলেন দুই রাজ্যের বিরোধ মিটিয়ে ফেলতে। কিন্তু এই শাসক মিনের পূর্বেকার রাজা রাজি হয়নি। বরং বিনা কারণে লড়াই বাধিয়ে বসল। এরকম লড়াই-এ শুধু সৈন্যদের সাধারণ মানুষদের প্রাণ যায়। এইসব লড়াইয়ের সময় সবচেয়ে বিপদ হয় আমার। দুই রাজ্যেরই সীমা হল এই থর্ন বনভূমি। দুপক্ষের সৈন্যরা বনের মধ্যে ঢোকে। দুই দলে লড়াই চলে এই বনভূমিতে। যে দল জেতে তারা অন্য রাজ্যের মালিকানা পায়। লড়াই থামে। কিন্তু সে আর কতদিন। আবার লড়াই শুরু হয়। রাজ্য ফিরে পাবার লড়াই। এভাবেই এখানকার দুই রাজ্যের মধ্যে লড়াই চলেছে দীর্ঘদিন ধরে। আমি লড়াইয়ের সময় শুধু চেয়ে চেয়ে দেখি আমার কত কষ্টে রোয়া ফুলফলের গাছ সৈন্যদের দাপাদাপিতে গোড়া থেকে উপড়ে যায়। কিছুই বলার নেই। রাজাদের রাজ্য বাড়াবার লিঙ্গ নির্দয় মানসিকতা শুধুমৃত্যুই ডেকে আনে। রাজারা অক্ষত থাকেন। মনে সাধারণ সৈন্যরা। এত হত্যা এত রক্তপাত তবু কারো চৈতন্য হয় না।
–ঠিকই বলেছেন। এমন সব রাজাদের অভাব নেই যারা দাম্ভিক নির্মম স্বার্থান্ধ। প্রজাদের মঙ্গলসাধনের কথা তারা কখনো ভাবেই না। আরবীয় শাসক মিনকে এখনো দেখিনি কিন্তু রানি ঈশিকার পরিচয় পেয়েছি। অত্যন্ত ঘৃণ্য তার মনোভাব। এখানের জাহাজঘাটায় নাকি ক্রীতদাস কেনবেচার হাট বসে। সেসময় তিনি কয়েদঘরে আটক করা বন্দীদের ক্রীতদাসের হাটে বিক্রি করেন। তার বিবেকে বাধে না। ভেন বলল।
–রানি ঈশিকার নির্মমতার অনেক খবরই আমি জানি। কিন্তু তাঁকে সংযত করার উপায় আমি জানি না। অবশ্য উনি আমার মতো বনবাসী এক বৃদ্ধের কথা শুনতে যাবেন কেন। বৃদ্ধ বলল।
উনি বলেন এখন ওর নাকি খুব অর্থাভাব চলছে তাই ক্রীতদাস হিসেবে বন্দীদের বিক্রি করবেন। ফ্লেজার বলল।
–হ্যাঁ। নিষ্ঠুর নির্মম কাজ যারা করেন তারা সবসময়ই যুক্তি দেখান। ইনিও তাই। বৃদ্ধ বলল।
বৃদ্ধ তারপর বলল–তাহলে আরবীয় শাসক মিনের রাজত্বে যাবে?
–হ্যাঁ। বন্ধুদের যদি বন্দীশালায় পাই তাহলে আর কোথাও যাবো না। না পেলে যে করে হোক বন্ধুদের খবর পেতেই হবে। খবর পাবোই। তারপর বন্ধুদের নিয়ে পালাবো। জাহাজঘাটায় যাবো। জাহাজে উঠে দেশের দিকে যাত্রা করবো। ফ্লেজার বলল।
-বেশ! তোমাদের সাফল্য কামনা করছি। যীশু তোমাদের রক্ষা করুন। বৃদ্ধ বলল।
দু’জনে কুঁড়েঘর থেকে বেরিয়ে এলো। চলল মিনের রাজ্যের দিকে। বনের মধ্যে কিছুটা যেতে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। গাছগাছালির ডালপাতারে ফাঁকের মধ্যে দিয়ে আকাশ যেটুকু দেখল তাতে ফ্লেজার বুঝল ঝড় আসবে।
ফ্লেজার বলল–ভেন–ছোটো। দুজনে গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে ছুটল। সশব্দে বাজ পড়তে লাগল। ঝড়ের হাওয়ায় গাছগুলো মাথা ঝাঁকাতে লাগল। শুকনো ডালপাতা ভেঙ্গে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সেই সঙ্গে ধুলোবালি উড়ল। দু’জন চোখ কুঁচকে ছুটলো। একটু পরেই নামল বৃষ্টি। গাছের ডালপাতায় বৃষ্টি পড়ার চট্রচট শব্দ। তার মধ্যে দিয়েই দুজনে ছুটল। কিন্তু জোরে ছুটতে পারছে না। নিচু গাছের বৃষ্টি ভেজা কাণ্ডে পা পিছলে যাচ্ছে।
হাঁপাতে হাঁপতে ফ্লেজার বলল–বুঝলে ভেন ঝড় আমাদের উপকারই করল। ভেনও হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
–ও কথা বলছো কেন?
–এই ঝড় জলের মধ্যে শাসকমিনের সৈন্যরা বনভূমি ছেড়ে পালাতে ব্যস্ত থাকবে। আমরাও নির্বিঘ্নে শাসক মিনের রাজত্বে গিয়ে পৌঁছতে পারবো। ফ্লেজার বলল।
–রানি ইশিকার সৈন্যরাও আর এদিকে আসবে না ভেন বলল।
–ঠিক তাই। সুতরাং আমরা নিরাপদ। ফ্লেজার বলল।
–তাই তো মনে হচ্ছে। ভেন বলল।
হঠাই বন শেষ। সামনে বিস্তৃত ঘাসে ঢাকা প্রান্তর।
তখন বেশ রাত হয়েছে। প্রান্তরের পরেই রাজপথ। দুজনে প্রান্তরেনামল। আকাশের মেঘলা ভাবটা তখনও যায়নি। চাঁদ ঢাকা পড়ে গেছে মেঘে।
বেশ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে দুজনে রাজপথে উঠল। এবর কয়েদঘরটা খুঁজে বের। করা। দুজনে রাজপথ ধরে সমুদ্রের দিকে জাহাজঘাটের দিকে আসতে লাগল। বুড়োটা বলেছিল একটা রুপালি গাছের বাঁ পাশের রাস্তা ধরে গেলে কয়েদখানা পাওয়া যাবে।
তখন হাওয়ার জোর থাকলেও বৃষ্টি কমে গেছে। টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছে।
হঠাৎ অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় ওরা দেখল একদল মিনের সৈন্য পুবমুখো যাচ্ছে। ফ্লেজার দ্রুত ভেন-এর হাত ধরে পথের পাশের মোটা গাছটার পেছনে গিয়ে লুকোল।
অস্পষ্ট জ্যোৎস্নায় ভালো দেখা যাচ্ছে না। ওর মধ্যেই পুবদিকে খুব আবছা তিন চারটে লম্বাটে ঘর দেখা গেল। সৈন্যরা সেই ঘরগুলোর একটাতে ঢুকে গেল।
ফ্লেজার বলল–ভেন–ঐ ঘরে নিশ্চয়ই কিছু হবে। হয় সভাটাভা হবে নয়তো শাসক মিনের কোনো নির্দেশ সৈন্যদের জানানো হবে।
বলো কি! এতো বাঘের গুহায় ঢোকা। ভেন বলল।
–আমরা গুপ্তচর হয়েই এসেছি। কাজেই ভয়ে পিছোনো চলবে না। খবর সংগ্রহ করতেই হবে। চলো। ফ্লেজার বলল।
মাটিতে বুক পা ঘেষে ঘেষে দুজনে চলল সৈন্যাবাসের দিকে। আকাশে চাঁদ ঢাকা মেঘ। খুব অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে চারদিকে। সৈন্যরা যে ঘরটায় আলো জ্বলছিল সেই ঘরটার পেছনে এসে ওরা দাঁড়াল। জানালা মাত্র একটা। তারই নীচে দুজনে বসল। ঘরের ভেতরে সৈন্যরা চুপচাপ।
হঠাৎ সৈন্যরা বোধহয় বেঞ্চি ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। শব্দ হল। বসল। সেনাপতির উঁচু গলা শোনা গেল–যে কারণে তোমাদের ডাকা হয়েছে সেটা বলছি। রানি ঈশিকার? সৈন্যসংখ্যা আমাদের চেয়ে বেশি। তাই তিউনেশিয়া থেকে আরও সৈন্য আনার ব্যবস্থা করেছি। সেই সৈন্যদল এলেই আমরা একটু গুছিয়ে নিয়ে রানি ঈশাকার দেশ আক্রমণ করবো। সেই সৈন্যদল এখানে আশা পর্যন্ত তোমরা খাওদাও বিশ্রাম করো। তারপরেই যুদ্ধ। এবার তোমরা যাও। বিশ্রাম করো গে।
সৈন্যরা উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজেদের ঘরে ফিরে গেল। কিছুক্ষণ পরেই সৈন্যদের কথাবার্তা থেমে গেল। সবাই শুয়ে পড়ল, চারিদিক নিস্তব্ধ হল। শুধু গাছের পাতা কাঁপিয়ে হাওয়া চলার শব্দ।
সেই ঘরের পেছন থেকে ওরা আস্তে আস্তে সরে এলো। তারপর প্রান্তরে বুক পেতে শুয়ে পড়ল। বুক হাঁটু ঘষতে ঘষতে চলল রাস্তার দিকে। এভাবে বেশ কিছুদূর এসে দু’জনেই উঠে দাঁড়াল। পোশাকে জলকাদা লেগেছে।
এখন কী করবে? ভেন বলল।
সেই বৃদ্ধের ঘরে আশ্রয় নেওয়া যায়। ভেন বলল।
–ঠিক আছে। তাই চলো। ফ্লেজার বলল।
দুজনে বৃষ্টিভেজা বনভূমি দিয়ে চলল। ফ্লেজার জাহাজ চালনায় দক্ষ। ও ঠিক দিক নির্ণয় করে চলল। বড়ো বড়ো গাছের ডালপাতার ফাঁক দিয়ে যতটা আকাশ দেখা যাচ্ছে তারই ওপর নির্ভর করে আর আশেপাশের গাছপালা দেখে দেখে ফ্লেজাররা চলল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃদ্ধের ঘরটা দেখতে পেল। ভেন পাথরের বারান্দায় উঠে বন্ধ দরজায় টোকা দিল। একটু পরে দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। বৃদ্ধ হেসে বলল এসো এসো। বাইরে বোধহয় বৃষ্টি কমেছে।
—হ্যাঁ। বৃষ্টি থেমে গেছে। ভেন বলল।
–ভেতরে এসো। বৃদ্ধ বলল।
দুজনে অন্ধকার ঘরে ঢুকল। বৃদ্ধ একটা মশাল জ্বালল। ফ্লেজারদের চেহারা- মাথা পোশাক দেখে বলল–তোমরা কি আছাড় টাছার খেয়েছিলে।
হ্যাঁ। ফ্লেজার বলল-বুঝলেন–একেবারে কাদার মধ্যে।
দুজনে ওপরের এদেশীয় পোশাক খুলল। নিজেদের দেশীয় পোশাক আর খুলল না। ঘরে একটা কাঠের পাটাতন পাতা। তাতে মোটা সুতোয় কাজ করা মোটা কাপড় পাতা। বৃদ্ধ বলল–কোথায় যে তোমাদের শুতে দি।
–পাথরের মেঝেতেই শোব। কিন্তু বড্ড খিদে পেয়েছে। ফ্লেজার বলল।
–ঘরে কিছু ফলমূল আছে। খাও। বৃদ্ধ বলল।
বলেছিলাম আর কিছু নেই? ভেন বলল।
–হ্যাঁ। আটা চিনি এসব আছে। কিন্তু
–ব্যস্। আমি উনুন পাতছি। কাঠকুটো আছে তো?
–হ্যাঁ–হ্যাঁ। বৃদ্ধ বলল।
–তাহলে তিনটে বড়ো পাথর নিয়ে আসছি।কথাটা বলে ভেন ঘরের বাইরে চলে গেল। বৃদ্ধ বলল–তোমরা পরিশ্রান্ত। এই কাঠের পাটাতনে বসে বিশ্রাম করো।
–মেঝেতেই বসছি। এসবে আমরা অভ্যস্ত। ফ্রেজার মেঝেতে বসে পড়ল। ভেন পাথর নিয়ে ফিরে এলো। তিনটে পাথর বসিয়ে উনুন মতো বানাল। মশালের আগুন দিয়ে কাঠকুটো জ্বেলে উনুনে দিল। বৃদ্ধগিয়ে পাটাতনে বসল।
কিছু মনে করবেন না আপনার ঘুম ভাঙ্গালাম। ফ্লেজার বলল।
–কী যে বলো। তোমরা আমার অতিথি। আমার এই ভাঙ্গা ঘরে তোমরা যে আতিথ্য গ্রহণ করেছো এতেই আমি ধন্য। বৃদ্ধ বলল।
ফ্লেজার মেঝেয় শুয়ে পড়ল। একটু তন্দ্ৰামতো এলো। ভেন-এর রান্নাও চলল।
ভেন-এর রান্না হল। দুজনে হাপুস হুপুস করে চিনিমাখা রুটি খেল।
তারপর দুজনে মেঝেয় শুয়ে পড়ল।
সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গল দুজনের। হাতমুখ ধুয়ে ওরা গত রাতের বাড়তিরুটি খেল।
এবার ফ্লেজার সমস্যায় পড়ল কী করবে এখন? বলল-ভেন–এখন কী করবে?
–দেখো ফ্লেজার ফ্রান্সিসদের খোঁজ করতে গেলে গভীর রাতে যেতে হবে। অত রাতে কোথায় খুঁজবো? তার চাইতে আমি যেটা ভাবছি বলছি। একটু থেমে ভেন বলল– ফ্রান্সিসদের কয়েদঘরে বন্দী করে রাখা হয়েছে কিনা এটা বুঝতে হলে একটা কথা ভাবছি। রাজকুমারীকে ফ্রান্সিস কয়েদঘরে রাখতে দেবে না। নিম্মই রাজকুমারীকে জাহাজে থাকার ব্যবস্থা করবে। ফ্রান্সিসের কথায় শাসক মিন নিই রাজি হবে। এটা মিনের কাছেও সুবিধার মনে হবে।
রাজকুমারী জাহাজে বন্দী হয়ে থাকলে ফ্রান্সিসরা আর পালাতে পারবে না। রাজকুমারীকে রেখে ওরা কখনও পালাতে চাইবে না।
-হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছো। ফ্লেজার বলল।
–তাহলে ফ্রান্সিসদের খোঁজে এখনই না গিয়ে আমাদের জাহাজে চলো। ওখানে রাজকুমারীকে পাবো। সব জানতে পারবো। ফ্রান্সিসরা কেমন আছে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিনা পালাবার কী উপায় ভাবছে–এসব জানতে পারবো রাজকুমারীর কাছ থেকে। ভেন বলল।
–ঠিক আছে। চলো আমাদের জাহাজেই যাওয়া যাক। ফ্লেজার বলল।
বৃদ্ধকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুজনে ওদের জাহাজ যেখানে নোঙর করে আছে সেই সমুদ্রে তীরভূমির দিকে চলল।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে দুজন সমুদ্রতীরে পৌঁছল। দেখল জাহাজ নোঙর করাই আছে। তীরভূমিতে ওদের দুটো নৌকো বেলভূমিতে তোলা আছে।
একটা নৌকোতে ওরা উঠে বসল। দাঁড় নৌকোর গলুই থেকে তুলে নিল ফ্লেজার। নৌকো চালাল জাহাজের দিকে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নৌকো গিয়ে জাহাজের গায়ে ভিড়ল। দুজনে জাহাজে উঠল। ওদের রাঁধুনি পিত্তন ছুটে এলো। ফ্লেজারকে জড়িয়ে ধরল। বলল–আর সবাই কোথায়?
–রাজকুমারী কোথায়?
–সেই খোঁজেই তো এখানে এলাম। ফ্লেজার বলল।
–কেউ তো জাহাজে ফেরে নি। পিওন বলল।
–তাহলে রাজকুমারীকে জাহাজে রাখা হয়নি। তবে রাজকুমারী এখন কোথায় আছেন? ভেন বলল।
–তা তো বলতে পারবো না। পিত্তন বলল।
যাক গে–পিওান আমাদের খেতে দাও। ভেন বলল।
-ঠিক আছে। তোমরা বিশ্রাম করো। আধ ঘণ্টার মধ্যে তোমাদের খেতে দেব। পিত্তান বলল।
পিত্তান আধ ঘণ্টার মধ্যে রুটি মাংসের ঝোল বেঁধে দিল। ফ্লেজার আর ভেন খেতে শুরু করল। দুজনে কোনো কথা না বলে খেতে লাগল। বারদুয়েক আরো রুটি মাংস চেয়ে খেল। খাওয়া শেষ।
এইবার দুজনে বুঝল–কী ক্লান্ত ওরা। ফ্লেজার কেবিনঘরে এসেই শুয়ে পড়ল। ভেন কিছুক্ষণ পিত্তানের সঙ্গে গল্পগুজব করল। তারপর কেবিনঘরে এসে শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ল।
দুজনে সন্ধে পর্যন্ত ঘুমোল।
তারপর তিনজনেই ডেক-এ উঠে এলো। তাকিয়ে রইল তীরভূমির দিকে। ফ্রান্সিসরা কেউ এলো কিনা। কিন্তু তীরভূমি জনশূন্য। তিনজনে কেবিনঘরে ফিরে এলো।
পরদিন সকালের খাবার খেয়ে তিনজনে ডেক-এ উঠে এলো। তীরভূমির দিকে তাকিয়ে রইল। ফ্রান্সিস বা অন্য কোনো বন্ধুদের দেখা গেল না। ফ্লেজার ভেবে পেল না কোথায় ফ্রান্সিসদের খোঁজ করবে।
সন্ধেবেলায়ও ওরা ডেক-এ উঠে তাকিয়ে রইল সমুদ্রতীরের দিকে। কেউ এলো না।
ভেন বলল–ফ্রেজার এখন কী করবে?
–আমাদের দুজনকে তো রানি ঈশিকার কয়েদঘরে ফিরে যেতেই হবে। যে খবরটা মিন-এর সৈন্যাবাসে পেয়েছি সে খবরটা রানি ঈশিকাকে তো দিতেই হবে। দেখা যাক সেই খবর পেয়ে রানি খুশি হয়ে আমাদের মুক্তি দেয় কিনা।
–অসম্ভব। রানি অর্থ পিশাচিনী। সেই অর্থ যে পথেই আসুক না। ভেন বলল।
-হু। দেখা যাক। রানি মুক্তি না দিলে মুক্তির ব্যবস্থা আমাদেরই করতে হবে। ফ্লেজার বলল।
–রানির কয়েদখানা থেকে পালাতে পারবে? ভেন বলল।
—চেষ্টা তো করতে হবে? ফ্লেজার বলল।
চেষ্টা করতে গিয়ে আমরা না মারা যাই। ভেন বলল।
–আমরা যাতে না মরি অথচ মুক্তি পাই সেটাই করতে হবে। উপায় একটা হবেই। আর দেরি নয়। দুপুরে খেয়েই রানির রাজত্বের দিকে চলো। ফ্লেজার বলল।
–বেশ। পিওনকে সঙ্গে নেবে? ভেন বলল।
-না না। পিত্তান জাহাজেই থাক। জাহাজ দেখাশুনোর জন্যে তো একজনকে থাকতেই হবে। ফ্লেজার বলল।
দুপুরে খাওয়াদাওয়া সেরে তৈরি হয়ে ফ্লেজার আর ভেন জাহাজের ডেক-এ উঠে এলো। ভেন দুতিনটে ওষুধের শিশি নিয়ে নিল। জাহাজ থেকে দড়িরমই দিয়ে নৌকোর ওপর নেমে এলো। জাহাজের রেলিঙে ঝুঁকে পিত্তন হাত নাড়াল। ফ্লেজার নৌকো চালাচ্ছিল। ভেন হাত নাড়ল।
সমুদ্রতীরে বেশি দূরে নয়। অল্পক্ষণের মধ্যেই নৌকো তীরে ভিড়ল। নৌকো তীরের অনেকটা উপরে টেনে তুলে রাখল। তারপর বললো। রানি ঈশিকার রাজত্বের দিকে।
বনভূমি পার হয়ে যখন ঘাসে ঢাকা প্রান্তরে পৌঁছল তখন বিকেল হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেই সূর্য ডুবে গেল। দুজনে রানি ঈশিকার বন্দীঘরের সামনে পৌঁছল।
দুজনে কয়েদঘরের দরজার কাছে পৌঁছল। প্রহরী দুজন এগিয়ে এলো বলল রানির হুকুম তোমরা ফিরলেই যেন তার সঙ্গে দেখা করো।
–তাহলে চলো রানির কাছে। ভেন বলল।
একজন প্রহরী বারান্দা প্রহরী বারান্দা থেকে মাটিতে নামল। চলল রানির মন্ত্রণাকক্ষের দিকে। মন্ত্রণাকক্ষের সামনে এসে দুজনকে দাঁড়াতে বলে প্রহরীটি ঘরে ঢুকল।
কিছু পরে ফিরে এসে বলল-চলো। প্রহরীর সঙ্গে দুজনে মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকল।
ঘরে একটা বড়ো শ্বেতপাথরের টেবিল। টেবিলের চারপাশে বাঁকা পায়া ওককাঠের চেয়ার। তাতে গদীপাতা।
ফ্লেজার আর ভেন বসল। প্রহরী ভেতরে চলে গেল।
কিছু পরে প্রহরীটি ফিরে এলো। বলল-রানিমা আসছেন।
বেশ কিছুক্ষণ পরে রানি ঘরে ঢুকল। দুজনে চেয়ার ছেড়ে উঠে সম্মান জানাল। রানি বসল। বসল দুজনে বলল–তোমরাই তো ভাইকিং?
-হ্যাঁ। ভেন বলল।
–তোমাদের দুজনকে। শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। রানি বলল।
–হ্যাঁ। ফ্লেজার বলল।
–কী গুপ্ত সংবাদ আনলে শুনি। রানি বলল।
ফ্লেজার সেই সৈন্যাবাসে সেনাপতির কথা জানাল।
–ও। তাহলে ওরা আরো সেনা সংগ্রহ করে আক্রমণ চালাবে। খুব ভালো খবর এনেছো। আমরা কিছু সময় পেলাম। আমরাও বিদেশ থেকে সৈন্য আনাবো। একটু থেমে রানি বলল–আর কোনো সংবাদ?
না। আর কোনো সংবাদ জানতে পারিনি। ফ্লেজার বলল
রানি চেয়ার ছেড়ে উঠেদাঁড়াল। ফ্লেজাররাও উঠেদাঁড়াল। ফ্লেজার বলল–মাননীয়া রানি–গোপন সংবাদ এনেছি। তাহলে এবার আমাদের মুক্তি দিন।
-না-না। তোমাদের তো হাটে বিক্রি করব। রানি বলল।
–কিন্তু আমাদের তো কোন দোষ নেই। ভেন বলল।
–বিনা অনুমতিতে তোমরা আমার রাজত্বে ঢুকেছে। এটাই তোমাদের অপরাধ। রানি বলল।
রানি দরজার দিকে এগোল। বোঝা গেল রানি যা বলবার বলে দিয়েছে। তার অন্যথা হবে না। ফ্লেজার বুঝল মুক্তির আশা নেই।
ফ্লেজারের খুবই মন খারাপ হলো। তাদের মুক্তির আর কোনো আশাই রহিল না। একমাত্র পথ বুদ্ধিকরে পালানো। সেক্ষেত্রেও দু-একজন বন্ধুর হয়তো প্রাণ যাবে। ফ্লেজার এমন সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রহরীর সঙ্গে কয়েদখানায় ফিরে এলো।
দুজনে কয়েদখানায় ঢুকতেই বন্ধুরা এগিয়ে এলো। তাদের চোখেমুখে একটা জিজ্ঞাসা আমরা মুক্তি পাবো তো? ফ্লেজার আস্তে আস্তে সব ঘটনা বলল। সব শেষে বলল–যা বুঝলাম তাতে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া মুক্তির আশা নেই। ভেবেছিলাম মিন-এর রাজত্বে। গিয়ে গোপন খবরটা রানিকে দিলেই রানি আমাদের মুক্তি দেবে। এখন বুঝতে পারছি রানি আমাদের মুক্তি দেবে না। লড়াই শুরু হলে আমাদের জোর করে লড়াইয়ে নামাবে। রানির হয়ে আমাদের লড়তে হবে।
–আমরা লড়াইয়ে নামবো না। একজন ভাইকিং বলল—
–আমাদের বাধ্য করবে। ভেন বলল।
–ফ্লেজার এখন তাহলে আমরা কী করবো? একজন ভাইকিং বলল।
অপেক্ষা করবো। তারপর সুযোগ পেলেই পালাবো। ফ্লেজার বলল
–তাহলে তো আমাদের এখন সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। পেড্রো বলল।
–হ্যাঁ, ফ্লেজার বলল।
ফ্লেজার মোটা কাপড়ের বিছানায় বসল। মাথায় চিন্তা কী করে পালাবো। এমনভাবে পালাতে হবে যেন আমাদের কেউ মরে না যায়, আহত না হয়। ভেন বিছানায় শুয়ে পড়ল। এত ক্লান্ত ওর শরীর।
কয়েকদিন একঘেয়ে কাটল। ভাইকিং বন্দীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিল। এই বন্দীদশা থেকে মুক্তি নেই। এরকমই ভাবতে লাগল ওরা। ওরা ফ্লেজারকে বলল–আমাদের। মুক্তির ব্যাপারটা ভেবো ফ্লেজার।
আমি শুধু মুক্তির কথাই ভাবছি। তার জন্যে প্রহরীদের কাজকর্মের দিকেও লক্ষ্য রাখছি। এখন সময় আর সুযোগ। ফ্লেজার বলে। বন্ধুরাও চুপ করে যায়।
বোঝা ফ্লেজার মুক্তির পরিকল্পনা করছে। ফ্লেজার নিশ্চয়ই একটা উপায় বের করতে পারবে।
সেদিন দুপুরে হঠাৎ আকাশে মেঘ করল। আকাশ ঘেন ফালা ফালা করে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। সন্ধের দিকে নামল বৃষ্টি। হাওয়ার তেজও বেড়ে গেল। শুরু হল ঝড় আর সেই সঙ্গে প্রচণ্ড বৃষ্টি।
প্রহরীরা খাবার নিয়ে কখন আসে ফ্লেজার তারই অপেক্ষা করতে লাগল। এবার ফ্লেজার সবাইকে কাছে ডাকল। ভাইকিং বন্ধুরা ফ্লেজারকে ঘিরে বসল।
ফ্লেজার বলতে লাগল–মোট তিনজন প্রহরী আমাদের খবর নিয়ে ভেতরে ঢোকে। আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে তিনজন এঁটো থালা বাটি নিয়ে চলে যায়। তিনজন যখন ঢোকে তখন দরজা খোলা থাকে। চারজন সৈন্য তখন দরজার সামনে থাকে। ফ্লেজার থামল। তারপর বলতে লাগল–আমরা ততক্ষণ অপেক্ষা করবো না। তিন প্রহরী যখনই খাবার নিয়ে ঢুকবে তখনই আমরা ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। গরম ঝোল ওদের চোখে ছুঁড়ে ফেল। ওরা তখন চোখের জ্বালায় অস্থির হয়ে যাবে। তখন দরজা খোলা। আমরা এক ছুটে বাইরে বেরিয়ে এসে পেছনের ঐ বনভূমির দিকে ছুটবো।
বাইরের চারজন প্রহরী কিছু বোঝার আগেই দ্রুত বনের দিকে ছুটবো। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর অন্ধকারের মধ্যে প্রহরীরা আমাদের হদিশ করতে পারবে না। ওর মধ্যেও যদি কোনো প্রহরী আমাদের মধ্যে কাউকে ধরে ফেলে তাহলে আমি তাকে উদ্ধার করে নিয়ে ছুটবো। এই হল পরিকল্পনা। এখন এই পরিকল্পনা মতো কাজ করা। তোমাদের কারো কিছু বলার থাকলে বলো। কেউ কোনো কথা বলল না।
রাত বাড়তে লাগল। ঝড়বৃষ্টি সমানে চলেছে।
একসময় প্রহরী তিনজন খাবার নিয়ে দরজা খুলে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে চার-পাঁচজন ভাইকিং প্রহরীদের মধ্যে যে ঝোলের মস্ত বড়ো কাঠের গামলটা নিয়ে ঢুকল তার ওপর আঁপিয়ে পড়ে ঝোলের গামলাটা কেড়ে নিল। তারপর দ্রুত হাতে তিনজনের মুখে ঝোল ছিটিয়ে দিল। তিনজনই চোখে হাত চাপা দিয়ে বসে পড়ল। খাবারদাবার সব ছিটকে পড়ল। তিনজনের তখন চোখ জ্বলছে।
ফ্লেজার ছুটে দরজা পার হল। বাইরের প্রহরীরা কিছু বোঝার আগেই জড় বৃষ্টির মধ্যে ভাইকিংরা সিঁড়ি থেকে লাফ দিয়ে নীচে নেমেই ছুটল বনভূমির দিকে।
একজন ভাইকিং বৃষ্টিভেজা মাটিতে আছড়ে নেমে পড়ল। একজন প্রহরী কতকটা আন্দাজেই খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে এলো। দলের সামনে ছিল ফ্লেজার। অন্ধকার অস্পষ্ট দেখল ভাইকিং বন্ধুকে ফিরে দাঁড়িয়ে ফ্লেজার ছুটে এসে বন্ধুকে তুলল। তারপর দুজনেই ছুটল। তখনই বিদ্যুৎ চমকাল। একজন প্রহরী ফ্লেজার আর ফ্লেজারের বন্ধুকে দেখল। খোলা তলোয়ার হাতে জোরে আসতে লাগল। ফ্লেজার হঠাৎ ওর সামনে হামা দিয়ে বসে পড়ল। অন্ধকারে প্রহরীটি ফ্লেজারের গায়ে পা বেঁধে উপুড় হয়ে পড়ে গেল। হাত থেকে তলোয়ারও ছিটকে গেল।
ফ্লেজার বন্ধুকে নিয়ে প্রাণপণে ছুটল। একটু পরেই বনভূমির শুরু। বন্ধুরা আগেই বনে ঢুকে পড়েছে। ফ্লেজার আর ওর বন্ধু বনভূমিতে ঢুকে পড়ল।
বনভূমিতে একটানা বৃষ্টি পড়ার শব্দ।
কিছু পরে ফ্লেজার বলল–ভাইসব–এখন আর ছুটে চলার দরকার নেই। সবাধানে চলো। সবাই আমার পেছনে এসো।
ঐ বৃষ্টি আর বনের অন্ধকারের মধ্যে ফ্লেজার সেই বৃদ্ধের বাড়ির সামনে এসে হাজির হল। দরজার টোকা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
দরজা খুলে গেল। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে ফ্লেজারকে চিনতে পারল না। ফ্লেজার বলল–কিছুদিন আগে আমি আর আমার বন্ধু আপনার ঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আপনার মনে আছে বোধহয়।
-হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে বৈকি। তোমরা ভাইকিং। তাই না। বৃদ্ধ বলল।
–হ্যাঁ। আমি বন্ধুদের নিয়ে এসেছি। এখানে রাতটা থাকবো। ফ্লেজার বলল।
— নিশ্চয়ই। এসো। বৃদ্ধ বলল।
ভাইকিংরা বৃদ্ধের ঘরের বারান্দায় উঠে দাঁড়াল। তারপর গায়ের পোশাক খুলে গা মাথা মুছতে লাগল।
বৃদ্ধ চকমকি পাথর ঠুকে মশাল জ্বালাল। এতক্ষণ পরে আলো দেখে ভাইকিংরা খুশি হল। অন্ধকার থেকে আলোয়। ভাইকিংরা ঐ ছোট্ট ঘরের মেঝেতে বসল। কেউ কেউ শুয়ে পড়ল। তখনও কেউ কেউ ওরা হাঁপাচ্ছে।
ফ্লেজার বৃদ্ধের কাছে এলো। বলল–যে কোনো কারণেই হোক আমাদের আজকের রাতের খাওয়া জোটেনি। আমাদের খেতে দেবার মতো কিছু আছে?
–এই বনভূমির বাইরে শহরে গ্রামে যারা থাকে তারা আমাকে ভক্তিশ্রদ্ধ করে। তারা খাবার জিনিসটিনিস দিয়ে যায়। আজ সকালেই এক ধনী ব্যবসায়ী এসেছিলেন। দু’বস্তা আটা চিনি আনাজপাতি ফলটল দিয়ে গেছেন। এনেছেন ফেরাতে তো পারি না। আমর আর কতটুকু লাগে।
যদি দয়া করে ওখান থেকে কিছু দেন তাহলে আমাদের ক্ষুধা মেটে। ফ্লেজার বলল।
নিশ্চয়ই। রান্নার উনুন আছে। আপনাদের কেউ রান্নার লোক আছে। বৃদ্ধবলল।
–হ্যাঁ আছে। আপনার শুকনো কাঠ আছে?
–হ্যাঁ। পেছনের চিলতে ঘরটায় আছে।
–ঠিক আছে। আপনি দেখিয়ে দিন।
–যে রাঁধবে তাকে আসতে বলো।
ফ্লেজার ভেনকে ডাকল। বলল সব। ভেন বলল–আগেরবার তো আমিই বেঁধেছিলাম।
ভেন সব দেখেটেখে এলো। ফ্লেজারকে বলল–খাবার কী আছে আমি জানি।
কম কম করে খেলে আমাদের হয়ে যাবে।
–তুমি রান্না শুরু করো। যেটুকু খেতে পারি তাতেই হবে। ফ্লেজার বলল।
ভেন দেখল ওর হাতের মশালটা ছাড়া আর একটা মশাল দরজার ওপরে রয়েছে।
ভাইকিংরা সারা ঘরের মেঝেয় শুয়ে পড়ল। ঘুমও এলো।
একটা দুটো পাখির ডাক শোনা গেল।
রাত শেষ।
ভোর হল।
তখনও কেউ কেউ ওঠেনি।
সকাল হতে সবাই উঠল।
ফ্লেজার বলল–ভাইসব। আমাদের এক্ষুণি এখান থেকে চলে যেতে হবে। আমরা বন্দর শহর সিউতাতে আরবীয় শাসক মিন-এর রাজত্বে যাবো। ওখানে ফ্রান্সিসদের খোঁজ করতে হবে।
এবার ফ্লেজাররা নিঃশব্দে চলল ওই ঝুপসি পাতার গাছটার দিকে। গাছের নীচে এসে দাঁড়াল। বাঁ দিকে আবার চলল। চিলতে রাস্তাটা ধরে কিছুটা উঁচু-নিচু জমি পার হয়েই কয়েদঘরটা দেখা গেল। কয়েদঘরের লোহার দরজার দুটো মশাল জ্বলছে। আলোয় দেখা গেল সাত-আটজন পাহারাদার দাঁড়িয়ে বসে আছে। ডানপাশে ঘাসে ঢাকা একটা মাটির ঢিবি। ফ্লেজার ফিসফিস করে বলল, সবাই ঢিবিটার পেছনে বোসো। সবাই ঢিবিটার পেছনে গিয়ে বসল। এবার ফ্লেজার ভাবতে লাগল কিভাবে ওই পাহারাদারদের কাবু করা যায়, ছুটে গিয়ে ওদের সামনাসামনি আক্রমণ করা যায়। কিন্তু ওদের মাথায় শিরস্ত্রাণ, বুকে বর্ম। সামনাসামনি আক্রান্ত হলে ওরা লড়াইয়ের জন্যে নিজেদের তৈরি করার সময় পারে। ফ্লেজার বুঝল, এই সময়টুকু ওদের দেওয়া চলবে না। আক্রমণ করতে হবে অতর্কিতে, হঠাৎ যাতে ওরা তৈরি হওয়ার সময় না পায়।
ফ্লেজার দেখল, কয়েদঘরের পেছনে কিছুটা পরেই বনজঙ্গল শুরু হয়েছে। ওইদিক দিয়েই কয়েদঘরের পেছনে চলে যেতে হবে। ওখান দিয়েই আক্রমণ করতে হবে।
ফ্লেজার ডানদিকে বনজঙ্গলের দিকে সবাইকে যেতে ইঙ্গিত করল। সবাই সেদিকে চলল। ওদিকে দিয়ে ঘুরে ওরা কয়েদঘরের ঠিক পেছনে চলে এলো। সবাই অল্প হাঁফাচ্ছে তখন। ফ্লেজার সবাইকে একসঙ্গে জড়ো হতে বলল। সবাই একত্র হল গোল হয়ে। ফ্লেজার মৃদুস্বরে বলল, হঠাৎ আক্রমণ করেই সৈন্যদের ডান বাহু জখম করতে হবে। তা হলেই ওরা তলোয়ার চালাতে পারবে না। বিদ্যুৎগতিতে এই কাজ সারতে হবে। তবেই ওরা হার স্বীকার করতে বাধ্য হবে। শিরস্ত্রাণ আর বর্ম কোনও কাজেই লাগবে না। পেড্রোকে ডেকে ফ্লেজার বলল, পেড্রো তোর কাজ হল ছুটে গিয়ে মশাল দুটো মাটিতে ফেলে দিবি। পা দিয়ে চেপে আগুন নিবিয়ে দিব। বারান্দা অন্ধকার হয়ে যাবে। অন্ধকারে আমাদেরই সুবিধে হবে। একটু থেমে ফ্লেজার বলল, সবাই তলোয়ার খোলো। কিন্তু শব্দ না হয়।
এবার সবাই আস্তে আস্তে তলোয়ার খুলে তৈরি হল। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল, ফ্লেজার, যদি এই কয়েদঘরে ফ্রান্সিসরা না থাকে, সেটা আগে না জেনে জীবনের ঝুঁকি নেব কেন?
ফ্লেজার বলল, ফ্রান্সিসদের খোঁজে যেখানেই যাবে সেখানেই জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে। এবারে কথা নয়, কাজ। একসঙ্গে সবাই পাহারদারদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ো। ওরা আমাদের চেয়ে সংখ্যায় কম।
কয়েদঘরের অন্ধকার পেছন দিক দিয়ে দ্রুত এসে ভাইকিংরা প্রহরীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেড্রো ছুটে এসে মশাল দুটো পাথরের খাঁজ থেকে তলোয়ারের খোঁচায় নামিয়ে পা দিয়ে চেপে নিভিয়ে দিল। অন্ধকার হয়ে গেল বারান্দাটা। আক্রমণের প্রথম ধাক্কায় প্রহরীরা হকচকিয়ে গেল। কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ততক্ষণে পাঁচজন প্রহরী। বাহুতে তলোয়ারের ঘা খেয়ে খাপ থেকেতলোয়ার খুলতেই পারল না। খোলা তলোয়ার। ছিল মাত্র দু’জন প্রহরীর হাতে। এদের দুজনের ওপর প্রায় অন্ধকারে তিন-চারজন ভাইকিং কাঁপয়ে পড়ল। দু’জন প্রহরীই মেঝেয় ওপর চিত হয়ে পড়ল। হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। লড়াই শেষ। প্রহরীরা অনেকেই গোঙাতে লাগল। ভাইকিংরা চিৎকার করে উঠল, ও-হো-হো। যুদ্ধজয়ের চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে কয়েদঘর থেকেও চিৎকার উঠল, ও-হো-হো। তা হলে ফ্রান্সিসরা এই কয়েদঘরেই বন্দী হয়ে আছে। ভাইকিংরা হইহই করে উঠল।
ফ্রান্সিস ফ্লেজারদের আক্রমণে সময় থেকেই দরজার লোহার গরাদে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। তখন পেড্রো মশাল নিভিয়ে দিয়েছে। অন্ধকারে ঠিক বুঝতে পারছিল না। আক্রমণকারী কারা। চাঁদের অস্পষ্ট যেটুকু আলো আসছিল তাতেই ফ্রান্সিস বুঝল, আক্রমণ করেছে ভাইকিং বন্ধুরা। ততক্ষণে মারিয়া, হ্যারিরা সবাই এসে জড়ো হয়েছে দরজার কাছে।
লড়াই শেষ হতেই ভাইকিংদের যুদ্ধজয়ের ধ্বনি উঠল।ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল। ফ্লেজার। ফ্লেজার কয়েদঘরের দরজার কাছে ছুটে এলো। ফ্রান্সিস পাহারাদারদের একজনকে দেখিয়ে বলল, ওকে ধরো। ওর কোমরে চাবির গোছা আছে। ওকে দরজা খুলে দিতে বলো। তাড়াতাড়ি করো। মিনের বাড়ি থেকে, সেনা ছাউনি থেকে সৈন্যরা হইচই, গোলমাল নিশ্চয়ই শুনেছে। এক্ষুণি ছুটে আসবে। তাড়াতাড়ি।
ফ্লেজার ছুটে গিয়ে চাবিওয়ালা প্রহরীটিকে ধরল। বলল, তালা খুলে দাও। আমি তালা খুবল না। প্রহরীটি বলল।
ঠিক আছে, চাবিটা দাও। ফ্লেজার বলল
আমাকে না মেরে চাবি পাবে না। প্রহরীটি বলল।
তাহলে মরো। কথাটা বলে ফ্লেজার প্রহরীটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রহরীটি ফ্লেজারের প্রথম আক্রমণটা ঠেকাল। এবার দু’জনের তলোয়ারের লড়াই চলল। এগিয়ে পিছিয়ে ফ্লেজার নিপুণ হাতে তলোয়ার চালাতে লাগল। প্রহরীটির তখন দম ফুরিয়ে এসেছে। ও মুখ হাঁ করে হাঁফাতে লাগল। তেমন জোরে আর তলোয়ার চালাতে পারছে না।
ফ্লেজার হঠাই প্রহরীটির মার এড়িয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্রুত তলোয়ারের কোপ মারল ওর কাধ লক্ষ্য করে। প্রহরীটি সেই মার ঠেকাতে পরল না। ফ্লেজারের তলোয়ার পাহারাদারটির ডান কাঁধে বিধে গেল। তলোয়ার তুলে নিল ফ্লেজার। পাহারাদারটির কাঁধ থেকে রক্ত পড়তে লাগল। পাহারাদারটি ক্ষতস্থানে হাত চেপে ধরে বসে পড়ল। ফ্লেজার ওর কোমর থেকে চাবির থোকাটা খুলে নিল। দরজার কাছে এগিয়ে এলো। দরজার কাছে তখন ভাইকিং বন্ধুদের ভিড়। ফ্লেজার ভিড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়ে দরজার তালায় চাবি ঢোকাল। ঘোরাল। তারা খুলল না। ফ্রান্সিস বলল, সবচেয়ে বড়ো চাবিটা লাগবে। ফ্লেজার দরজা খুলে ধরল। ফ্রান্সিসরা সবাই দ্রুত বেরিয়ে এলো। কিছু বাবার সৈন্যও বেরিয়ে এসে পালিয়ে গেল। ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলে উঠল, ভাইসব, এখনও লড়াই শেষ হয়নি। ওই দেখো মিনের সৈন্যরা ছুটে আসছে।
চাঁদের আলোয় দেখা গেল মিনের সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে। পনেরো-কুড়িজন সৈন্য।
মারিয়া শাঙ্কো ছাড়া সকলে প্রহরীদের হাতে থেকে কেড়ে নেওয়া তলোয়ার নিয়ে তৈরি হল। অনেকেমিনের পরাজিত সৈন্যদের শিরস্ত্রাণ, বর্ম খুলে নিয়ে নিজেরা পরেছে।
ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল, ভাইসব আমরা এগিয়ে যাবনা। ওরা প্রান্তরটা পার হয়ে আসুক। এতে ওরা ক্লান্ত হবে। তাতে আমাদেরই সুবিধে হবে।….
সৈন্যরা বলল, ফ্রান্সিস, আমি বন্ধুদের বলেছি ওই শিরস্ত্রাণ আর বর্ম সৈন্যদের সুযোগ বুঝে বাহুতে তলোয়ার চালাতে।
ফ্রান্সিস মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি ঠিক বলেছো। কথাটা বন্ধুদের আর একবার মনে করিয় দাও। কথাটা ফ্লেজার আবার গলা চড়িয়ে বলল।
সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসতে লাগল। সবচেয়ে আগে সেই সেনাপতি। বিস্তৃত ঘাসের প্রান্তরটা পার হয়ে আসতে সত্যিই ওরা বেশ পরিশ্রান্ত হল। হাঁফাতে হাঁফাতে ফ্রান্সিসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
শুরু হল লড়াই। বেশিরভাগ ভাইকিং শিরস্ত্রাণ বর্ম পরে ছিল। কাজেই সৈন্যরা ওদের সহজে কাবু করতে পারল না। প্রচণ্ড লড়াই চলল। ফ্রান্সিস একা চারজন সৈন্যের সঙ্গে লড়াই করতে লাগল। সৈন্যদের তলোয়ারের ঘাষে ফ্রান্সিসের জামা অনেক জায়গায় কেটে গেল। শরীরেও লাগল। রক্ত পড়তে লাগল। ফ্রান্সিস বুঝল, সৈন্যদের মাথায় তলোয়ার চালিয়ে লাভ নেই। কাজেই ও একটু সুযোগ পেলেই সৈন্যরা বাহু হাত লক্ষ্য করে তলোয়ার চালিয়ে লাভ নেই। এসে সৈন্যরা আহত হতে লাগল। আহত হাত থেকে তলোয়ার ফেলে দিতে লাগল। ফ্রান্সিস তখন অন্য সৈন্যদের দিকে ধেয়ে গেল। লড়াই চালাতে লাগল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিনের সৈন্যরা হার স্বীকার করতে লাগল। হঠাৎ সেই সময় সেনাপতি ফ্রান্সিসের একেবারে সামনে এসে পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতিকে আক্রমণ করল। দু’জনের তলোয়ারের লড়াই জমে উঠল।দু’জনেই নিপুণ হাতে তলোয়ার চালাতে লাগল। ততক্ষণে আহত সৈন্যরা পালাতে শুরু করেছে। ভাইকিংরা লড়াই থামিয়ে দু’জনের তলোয়ারের লড়াই দেখতে লাগল। লড়াই চালাতে চালাতে ফ্রান্সিস চাপা গলায় হাঁফাতে হাঁফাতে বলল–বলেছিলাম সুযোগ পেলেই তোমাকে আমি হত্যা করবো। আজ সেই সুযোগ এসেছে। বুঝল বর্ম শিরস্ত্রাণ পরা সেনাপতিকে সহজে কাবু করা যাবে না। ঠিক করল সেনাপতির মথার শিরস্ত্রাণটিকে ফেলে দিতে হবে। ফ্রান্সিস তলোয়ার চালাতে চালাতে তক্কে তকে রইল। সুযোগ এসে গেল। সেনাপতি একটু অন্যমনস্ক হয়েছে। তখন ফ্রান্সিস বিদ্যুৎগতিতে শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে সেনাপতির মাথা লক্ষ্য করে তলোয়ার চালাল। শিরস্ত্রাণের বন্ধনি ছিঁড়ে গেল। শিরস্ত্রাণ ছিটকে গিয়ে মাটিতে পড়ল। ফ্রান্সিস আর সেনাপতিকে আত্মরক্ষার সুযোগ দিল না। দ্রুত সেনাপতির মাথায় তলোয়ারের কোপ বসাল। সেনাপতির হাতের তলোয়ার ফেলে দিয়ে দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। তারপর বসে পড়ল।
ফ্রান্সিস সেনাপতির বুকে গলায় তলোয়ার বিধিয়ে দিল।
লড়াই শেষ। ফ্রান্সিস হাঁফাতে হাঁফাতে জিতার কাছে এলো। বলল, জিতা মিনের কি আরও সৈন্য এখানে আছে?
হ্যাঁ। রানি তুহিনার প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ সরানোর কাজে তাদের লাগানো হয়েছে। দুই পাণ্ডিতকে সাহায্য করছে তারা।
হু–সেই সৈন্যরা আসার আগেই আমাদের প্রায় সবাইকে জাহাজে ফিরে যেতে হবে। পরিশ্রান্ত ভাইকিংরা কেউ কেউ প্রান্তরের ঘাসে বসে পড়েছে। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে বলল ভাইসব, শুধু আমি, শাঙ্কো, হ্যারি আর জিতা এখানে থাকব। রানি তুহিনার দুর্গের সন্ধান করব। রানির গুপ্তভাণ্ডার উদ্ধার করব।
যে ভাইকিংরা বসে পড়েছিল তারা উঠে দাঁড়াল। লড়াইয়ে আহতদের ওরা ধরে ধরে নিয়ে চলল। সবাই চলল জাহাজঘাটার দিকে।
তখন সূর্য উঠেছে। রোদ ছড়িয়ে পড়েছে বনে, কয়েদঘরের মাথায়। বনজঙ্গলের মাথায়।
হ্যারিকে ডেকে ফ্রান্সিস বলল, চলো, রানি তুহিনার দুর্গে যাই।
চারজন বনের মধ্যে দিয়ে চলল রানি তুহিনার দুর্গের দিকে। যখন দুর্গে এসে পৌঁছল তখন বেলা হয়েছে। দুর্গের প্রবেশ পথেই একটা মশাল রাখা ছিল। মশালটা ফ্রান্সিস তুলে নিল। গুহাপথে ঢুকল চারজন।
রানির শয়নকক্ষে ঢুকল। দেখল, যা কিছু ওরা রেখে গিয়েছিল, সবই আছে। জিতা উনুনের কাছে গিয়ে রান্নার উদ্যোগ করতে লাগল।
ফ্রান্সিস মেঝেয় বসল। তারপর ক্লান্তিতে শুয়ে পড়ল। চিত হয়ে শুল। দেখল, ওপরে পাথরের ছাদ। প্রকৃতির হাতে তৈরি ছাদ। পাশ ফিরে তাকাল। পাথরের দেওয়ালগুলো দেখল। তখনই উত্তরদিকের দেওয়ালটার দিকে চোখ পড়ল। সত্যিই আশ্চর্য্য! উত্তরদিকের দেওয়ালটা অনেকটা মসৃণ। এটাও প্রকৃতির আর-এক খেয়াল।
সঙ্গে সঙ্গে আর একটা চিন্তাও মাথায় খেলে গেল, এ ঘরের কোনও দেওয়ালেই তিন পাপড়ির ফুল খোদাই করা নেই। আবার ফ্রান্সিসের চোখ পড়ল উত্তরাদিককার অনেকটা মসৃণ দেওয়ালের দিকে। প্রকৃতির হাতে এত মসৃণ একটা দেওয়াল তৈরি হতে পারে? যতি তা না হয় তবে এখানেই যারা বাস করে গেছে তারা দেওয়ালটি ছেনি দিয়ে যতটা সম্ভব মসৃণ করেছে। কিন্তু তারা অন্য দেওয়ালগুলো মসৃণ করল না কেন?
ফ্রান্সিস এসব ভাবছে তখনই হ্যারি ওই মসৃণ দেওয়ালে ফ্রান্সিসের মইটা ঠেকা দিয়ে রাখছিল। বোধহয় ভালো করে ঠেকা দিতে পারেনি। তাই হ্যারি ঘুরে দাঁড়াতেই মইটা দেওয়াল লেগে মেঝেয় পড়ে গেল। ফ্রান্সিস দেখল, দেওয়ালে মইয়ের ঘষায় একটা অস্পষ্ট দাগ হয়েছে। পাথরে দাগ?
ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। ছুটে গেল দেওয়ালটার কাছে। মইয়ের ঘষায় দাগ লাগা জায়গাটা দেখল। চিৎকার করে বলে উঠল, হ্যারি, শাঙ্কো, এই দেওয়ালে মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছে। তাই এত মসৃণ। ফ্রান্সিস ছুটে গিয়ে কুড়ুলটা নিয়ে নিয়ে এলো। দেওয়ালটায় কুড়ুলের ঘা মারল। মাটির চাঙড়া উঠে এলো। আবার ঘা মারল। বেশ কিছু গুঁড়ো মাটি ঝরে পড়ল।
সেই জায়গায় পাথরের দেওয়ালের অংশ দেখা গেল। হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস, তবে কি রানি তুহিনার আমলেই এই মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল?
ঠিক তাই। ফ্রান্সিস বলল।
কিন্তু কেন দেওয়া হয়েছিল? হ্যারি বলল।
খুব সহজ–অন্য তিনটে দেওয়াল ছেড়ে দিয়ে এই উত্তরের দেওয়ালেই মাটির প্রলেপ দেওয়া হয়েছিল কিছু জিনিস লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে। ফ্রান্সিস বলল।
হ্যারি লাফিয়ে উঠল। বলল, রানি তুহিনা চার পাপড়ির ফুলের নকশা গোপন রাখার জন্যেই এটা করেছিলেন।
ঠিক বলেছ। ফ্রান্সিস বলল। তারপর দেওয়ালটার নীচের দিকে কুড়ুলের ঘা মারতে লাগল। মটি ছিটকে পড়তে লাগল। পাথরের দেওয়াল দেখা যেতে লাগল। যতদূর হাত যায় ততদুর পর্যন্ত ফ্রান্সিস মাটির পলেস্তরা খসিয়ে দিল। কিন্তু পাথরের দেওয়ালে কিছুই দেখা গেল না। ফ্রান্সিস হাঁফাতে লাগল। এবার হ্যারিও কুড়ল চালিয়ে অনেকটা মাটি খসাল।
একটু বিশ্রাম নিয়ে এবার ফ্রান্সিস মইটা দেওয়ালে রাখল। অন্য সব ঘরে দেওয়ালের একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় তিন পাপড়ি ফুলের নকশা কুঁদে তোলা হয়েছে। এবার ফ্রান্সিস ওই নির্দিষ্ট উচ্চতা হিসেব করে কুড়ুল চালাতে লাগল। হিসেব করে কুড়ল চালাতে লাগল।
মাটি খসে পড়তে লাগল। হঠাৎই দেখা গেল, সেই ফুলের পাপড়ি। ফ্রান্সিস এবার সাবধানে মাটি খসাল। ফুটে উঠল চার পাপড়ির ফুলের নকশা।
মইয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ হাঁফাতে লাগল। মেঝেয় হ্যারি, শাঙ্কো আর জিতা গভীর আগ্রহ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুসময় গেল। এবার ফ্রান্সিস জোরে কুড়ুল চালাল ওই নকশাটার ওপর।নকশাটা খানখান হয়ে ভেঙ্গে পড়ল। একটা প্রায় চৌকোণো ফেঁকর দেখা গেল। ফ্রান্সিস কুড়ুল ঠুকে ফোকরটা বড়ো করল। মশালের আলো এখানে পৌঁছোয়নি। কাজেই ভেতরে কী আছে দেখা গেল না।
ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে ফোকরের ভেতরে হাত ঢোকাল। হাতে ঠেকল একটা লম্বামতো কাঠের বাক্স। ও বুঝল, ওটা অলঙ্কার রাখার পেটিকা।
আস্তে আস্তে ফ্রান্সিস পেটিকা বাইরে নিয়ে এলো। হ্যারি আর শাঙ্কো চিৎকার করে উঠল, ও হো হো। ওদের আনন্দের ধ্বনি।
ফ্রান্সিস মই রেখে আস্তে আস্তে নেমে এলো। শাঙ্কো গিয়ে মশালটা নামিয়ে আনল।
মশালের আলোয় দেখা গেল পেটিকার গায়ে ধুলোর আস্তরণ পড়ে গেছে। ফ্রান্সিস আস্তে আতে ঢাকনাটা খুলল। দেখা গেল পেটিকায় কত রকমের অলঙ্কার। প্রায় দুশো বছর আগেকার অলঙ্কার। ধুলো ময়লা লেগেছে। তাই মশালের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল না অলঙ্কারগুলো। তবু কত মূল্যবান রানি তুহিনার অলঙ্কারগুলো। পেটিকাটাও কী সুন্দর! কালো কাঠের পেটিকা। তার গায়ে সোনা-রুপোর লতাপাতা, ফুলের নকশা।
হ্যারি বলল, ফ্রান্সিস। এখন এই অলঙ্কারগুলো কী করবে?
জিতাকে দেব। ওদেরই দেশের এক রানির সম্পদ এসব। জিতাই পাবে। ফ্রান্সিস বলল।
জিতা বলল, এত সম্পদ পেলে আমার দুঃখদুর্দশার জীবন শেষ হবে, এটা ঠিক। কিন্তু ফ্রান্সিস যদি এই সম্পদ আবিষ্কার না করত তবে তো আমি কিছুই পেতাম না। তাই বলছি ফ্রান্সিস, তুমি যতটা চাও ততটাই নাও, বাকিগুলো আমি নেব।
হ্যারি বলল, না। বরং সব অলঙ্কার দু’ভাগে ভাগ করে দু’জনে নাও।
জিতা মাথা নেড়ে বলল, বেশ। তারপর কোমরের ফেট্টি খুলে মেঝেয় পাতল। পেটিকা থেকে সব অলঙ্কার ঢালা হল। হ্যারি, জিতাকেই ভাগ করতে বলল। সব দু’ভাগ হল।
ফ্রান্সিস বলল, জিতা, এই গয়নাগুলোর ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আগের কয়েকটা অভিযান আমি কিছুই আমার স্ত্রীকে এনে দিতে পারিনি। তাই আমার অংশ পেটিকায় ভরে তাকে দেব। খুব খুশি হবে সে।
এবার নিজেদের জাহাজে ফেরা। ফ্রান্সিস জিতাকে বলল, তুমি এই বনের বাইরে আমাদের নিয়ে চলো। বড়ো রাস্তায় গিয়ে একটা ফসল-টানা গাড়ি জোগাড় করে দেবে, যাতে আমরা জাহাজঘাটে যেতে পারি। জিতা মশাল হাতে গুহাপথ দিয়ে চলল, পেছনে ফ্রান্সিসরা। ওরা যখন বাইরে এলো, রাত হয়েছে। চাঁদের ম্লান আলোর মধ্যে দিয়ে সবাই চলল।
একসময় বড়ো রাস্তায় এলো। জিতা গ্রামে গিয়ে কৃষকদের গাড়ি আর একজন গাড়োয়ানকে নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসরা গাড়িতে উঠল। ফ্রান্সিস জিতার ফেট্টির কাপড় কিছুটা নিল। পেটিকাটা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখল।
জিতা হাত বাড়িয়ে ফ্রান্সিসের হাত ধরল। একটু কান্নাভেজা গলায় বলল, কোনওদিন, ভাবিনি আমার দুঃখ-দারিদ্র ঘুচবে। ফ্রান্সিস তুমি আমাকে নতুন জীবন দিলে। ফ্রান্সিস মৃদু হেসে জিতার হাতে চাপদিয়ে হাত সরিয়ে নিল। ফ্রান্সিসদের গাড়ি চলল জাহাজঘাটার দিকে।
ফ্রান্সিস পথ দেখিয়ে গাড়িটা নিয়ে এলো জাহাজঘাটা থেকে দূরে যেখানে ওরা নৌকোটা পারে তুলে রেখে গেছে, সেখানে। ফ্রান্সিস ভাবল, নৌকোটা তো পাওয়া যাবে না। মাছ-ধরিয়েদের পাড়া থেকে নৌকো আনতে হবে। কিন্তু আশ্চর্য, পারে এসে দেখল ওদের নৌকোটা রয়েছে।
ওরা চিৎকার করে উঠল, ও হো হো।
নৌকোয় উঠল ওরা। নৌকো চলল ওদের জাহাজের দিকে।
একসময় ওদের নৌকো ওদের জাহাজের গায়ে এসে লাগল। ততক্ষণে ভাইকিং বন্ধুদের আনন্দের চিৎকার, হাসি শুরু হয়ে গেছে।
ফ্রান্সিসরা জাহাজে উঠে এলো। সবাই ছুটে এলো ওদের কাছে। মারিয়াও ছুটে এলো হাসতে হাসতে। ফ্রান্সিস কাপড়ে প্যঁচানো পেটিকাটা মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়া আর ভাইকিং বন্ধুরা তখনও বুঝতে পারল না ওটা কী। মারিয়া প্যাঁচানো কাপড়টা খুলছিল না। ফ্রান্সিসই বলল, কাপড়টা খুলে কী আছে দ্যাখো।
মারিয়া প্যাচানো কাপড়টা খুলে পেটিকা দেখে হাঁ হয়ে গেল। ফ্রান্সিস হেসে বলল, পেটিকাটা খোলো। মারিয়া খুলল সেটা। পেটিকায় অলঙ্কার, কত বিচিত্র আকার সেসবের। বইরের ঝিকিয়ে উঠেছে অলঙ্কারগুলো। অত অলঙ্কার দেখে মারিয়া হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ফ্রান্সিসের দিকে৷ ফ্রান্সিস বলল, মারিয়া, এবার কিন্তু আমার হাত শূন্য নয়।
মারিয়া হেসে বলল, তোমার হাত শূন্য থাকলেও আমার কোনও দুঃখ থাকত না। তোমরা অক্ষত ফিরে এসেছ, এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ওদিকে ভাইকিং বন্ধুরা শাঙ্কোকে ঘিরে ধরেছে। শাঙ্কো হাত-পা নেড়ে তখন রানি তুহিনার অলঙ্কারের পেটিকা উদ্ধারের ঘটনাটা বলছে।