দ্বিতীয় ইন্দ্র নহুষ ও অগস্ত্যের অভিশাপ
বিশ্বজগতে কি দিক বলে কিছু আছে? যে দশ দিক ( উত্তর , দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম, ঈশান, নৈঋত, বায়ু, অগ্নি, ঊর্ধ্ব, অধো)আমরা চিহ্নিত করি, তাতো সুবিধার্থে আমাদের কল্পনাতে। আছে শুধু ঘুর্ণমানের দিক, clockwise , anti-clockwise বিজ্ঞানে বলে spin, যেমন ঘোরে পৃথিবী anticlockwise, আর শুক্রগ্রহ clockwise along their axis. opposite spin of electrons is called paired সেই হিসেবে শুক্রগ্রহ ও পৃথিবী paired।
কিন্ত পুরাণ মতে পৃথিবীতে দিনে রাতে প্রতিক্ষণেই সবসময়ই মাথার উপর আকাশ– ঊর্ধ্ব, আর পায়ের তল– অধো কিন্ত সত্যিই কি মহাশুন্যে ‘উপর ” বা ‘নীচ’ বলে কিছু আছে? আকাশ মানে সুরলোক বা স্বর্গ, নিম্নে পাতাল বা নরক। পুরাণ যুগে আকাশ থেকে হতো “দৈববানী”, হতো “পুষ্পবৃষ্টি”।
দেবতা , দৈত্য দানব ও ঋষিদের ছিল আরও এক অদ্ভুত ক্ষমতা —অভিশাপ প্রদান এবং তা থেকে আবার পরিত্রাণ। এ ক্ষমতা কমবেশী তাদের ছিল।
সময়ের হিসাবও বড়ো কঠিন ও অজ্ঞাত। কত মাত্রায় (unit) হাজার বছর পরিষ্কার বোঝা মুস্কিল।
অলৌকিক শক্তিশালী দানবদের উৎপাত ও দুষ্কর ক্রীয়াকলাপে স্বর্গ মর্ত অতিষ্ঠ, তাদের দমনক্রীয়ায় দেবগণ সর্বদাই রত থাকতেন। ক্ষমতাশালী এক অসুররাজ বৃত্রাসুর তার তাণ্ডব লীলায় মেতে থাকতেন। বৃত্রাসুর ছিলেন ব্রহ্মা-আশীর্বাদ পুষ্ট। তিতিবিরক্ত হয়ে দেবতারা ইন্দ্রকে বললেন, বৃত্রাসুরকে হনন করতে। প্রচন্ড হানাহানি হলো ইন্দ্র ও বৃত্রাসুরের মধ্যে। সে অনেক বড়ো ঘটনা, কিন্ত এখানে সেটা বিষয় নয়। ইন্দ্রর হাতে বৃত্রাসুর অবশেষে নিহত হয়েছিলেন। তারপরের ঘটনাই এখানে আলোচ্চ।
তবে ইন্দ্রর চরিত্রও বিশেষ নির্মল ছিল না, কেন তার দেহে সহস্রাক্ষি ছিল, (তাত পরে পরিবর্তিত)—নেপথ্যে তা ছিল এক কেচ্ছা কাহিনীর দৃষ্টান্ত। সে কথাও এখানে নয়।
এ কাহিনীর নায়ক ” নহুষ” যিনি ছিলেন সেই বিখ্যাত ক্ষত্রিয় রাজা, “যযাতি”র পিতা।
বৃত্রাসুরকে হত্যা করার পর ইন্দ্রর মনে এলো এক শঙ্কা ‘ব্রহ্মহত্যা ‘র পাপ।
ইন্দ্রর একবার “বিশ্বরূপ”কে হত্যা করে ‘ব্রহ্মহত্যা’ র পাপ হয়েছিল। তখন ইন্দ্র সে পাপ বন্টন করে দিয়েছিলেন ভূমি,জল, বৃক্ষ ও স্ত্রীলোকের মধ্যে। কিন্ত পুনরায় সে পাপ হলে, কি ভাবে মার্জনা পাবেন? ঋষিগণ আশ্বাস দিলেন, “অশ্বমেধ” যজ্ঞ করলে লাঘব হবে, কারণ এ যজ্ঞ দ্বারা ব্রহ্মাঘাতী, পিতৃঘাতী, মাতৃঘাতী, গুরুহত্যাকারী , গো- হত্যাকারী পাপী পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র হয়।
ঋষিদের এ প্রবোধ বাক্যে ইন্দ্রর বিশেষ ভাবান্তর হলো না, বিষন্ন মনা ইন্দ্র কিছুতেই নিজেকে সন্তাপমুক্ত করতে পারলেন না। যেমন বহুগুণমান ব্যক্তি কোন নিন্দনীয় কর্ম করে লজ্জ্বাবোধ করেন, তেমনই।
এ পাপবোধে ক্রমশই ইন্দ্র জরাব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়লেন।পাপ যেন ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করে সর্বদা তাঁকে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। শেষে তিনি নিজেকে তাড়িয়ে আশ্রয় নিলেন মানস সরোবরে, লুকিয়ে রাখলেন নিজেকে পদ্ম মৃণালের ঝোপের জলে “হাজার” বছর।
ইন্দ্রর অন্তর্ধানে দেবলোকের সিংহাসন তখন শূন্য, দেবতারা সে সিংহাসন বসালেন ক্ষত্রিয় “নহুষ” দেবকে, কারণ বিদ্যা, তপস্যা ও যোগবলে নহুষ স্বর্গ পালনের ক্ষমতা অর্জন করেছিলেন।
কিন্ত কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিজ স্খলনের পথ অজান্তে নিজেই টেনে আনলেন।
নহুষ দেব ক্রমশই অহংকারী ও ঐশ্বর্য লোভী হয়ে উঠলেন । কিন্ত এতেই তিনি ক্ষান্ত হলেন না , ভোগলিপ্সার মোহে তিনি দাবী করে বসলেন ইন্দ্র পত্নী শচীদেবীকে– কামনা বাসনায় বশীভূত ও উন্মত্ত হয়ে , শচীদেবীকে বললেন– ” এখন, আমিই স্বর্গলোকের ইন্দ্র, তুমিও আমার ইন্দ্রাণী, এসো আমরা নির্জনে দুজনে বিহার করি।”
শচী বিপদ আগে থেকে আশংকা করে কুলগুরু বৃহস্পতির পরামর্শ নিয়েছিলেন, তাই নির্ভয়ে জবাব দিলেন– “অবশ্যই, কিন্ত একটি সর্ত আছে যেদিন আপনি ব্রাহ্মণদের বাহক করে সেই শিবিকা করে আপনি আসবেন, সেদিন আমি আপনার ভজনা ও সেবা করব।” নহুষের জানা ছিল না, ব্রাহ্মণদের বাহক করলে, কোন এক ব্রহ্মহত্যাও হবে ও সেই পাপে পতন ঘটবে।
নহুষ “অগস্ত্য”সহ কিছু শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ নিযুক্ত করলেন শিবিকা বহন করবার জন্য। তারপর দম্ভভরে অগস্ত্যের পা মাড়িয়ে বলেন ” সর্প, সর্প ” সর্প মানে চল্, অর্থাত “চল্ চল্” এ তীব্র অহংকার অগস্ত্য মুনি সইতে পারলেন না, তৎক্ষণাৎ শাপ দিয়ে বসলেন— ” তুই সর্প হ” নহুষ সঙ্গেসঙ্গেই বিশাল অজগর সাপে পরিণত হয়ে জঙ্গলে চলে গেলেন।
পরে ব্রাহ্মণেরা ইন্দ্রকে আবার ফিরিয়ে আনেন , ইন্দ্র অশ্বমেধ যজ্ঞ করেন, শ্রী হরি ইন্দ্রর ভজনায় তুষ্ট করে তার পাপ মুক্ত করেন। এ পুরাণ কাহিনীতে উঠে আসে একটি বিরাট প্রশ্ন—-প্রকৃত অনুশোচনাই কি পাপমুক্তির পথ? যদিও পাপ পুণ্যের ব্যাপারটি সর্বদাই আপেক্ষিক। বৈধ অবৈধ বিষয়ও আপেক্ষিক, আর নির্ভর করে যুগপোযোগী সমাজ ব্যবস্থার উপর।
এ কাহিনীগুলোর অবাস্তবতা থাকলেও উপেক্ষা করা যায় না, অনুশীলিত চিন্তার অবকাশ কিন্ত থেকেই যায়।