স্মৃতিভ্রম
সুমনা আনমনা হয়ে বারান্দায় বসে ছিল।কয়েকদিন ধরে সুমনা ও রাজের বেশ ঝগড়া চলছিল। ওদের তিন বছরের বিবাহিত জীবন।
সুমনা গৃহবধূ, সময় কাটতে চাই না। সুমনা আবৃত্তি করতে ভালবাসে। এই আবৃত্তি শুনেই রাজের সুমনাকে মনে ধরেছিল। দু একদিন এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি,তারপর দুই বাড়িতে দেখাশোনা, পরিণতি বিয়ে।
বিয়ের তিন বছরের মাথায় রাজের আবৃত্তি অসহ্য লাগে।কিন্তু সুমনার বেঁচে থাকার অক্সিজেন আবৃত্তি।
আসলে গাইনোকোলজিস্ট দেখিয়ে জেনেছে সুমনার প্রেগন্যান্ট
হওয়ার সমস্যা আছে।ওদিকে রাজের ও কিছু সমস্যা আছে। দুজনের চিকিৎসা হলে বাচ্চা হতে পারে।এই সমস্যার ব্যাপারে দুজনেই রাজযোটক। কেউ কাউকে দোষ দিতে পারবে না।
সুমনা তিন তলার বারান্দায় বসে রাতের তারাদের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। রাজের কাজের চাপ এখন খুব বেশি।
দোতলায় থাকেন শ্বশুর- শাশুড়ি। একতলায় ভাড়াটিয়া মল্লিকা ও ওর স্বামী থাকে। মল্লিকা খুব ভাল গান গায়।সুমনা ও মল্লিকার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। অনেক ফাংশনে ওরা কবিতা ও গানের কোলাজ ও করেছে।
সুমনা আকাশের তারা গুনতে গুনতে কবিগুরুর কবিতা সহযাত্রী কবিতা বলতে থাকে।
“কথা ছিল এক তরীতে কেবল তুমি আমি যাব অকারণে ভেসে কেবল ভেসে।
ত্রিভূবনের জানবে না কেউ আমরা তীর্থগামী….”
কবিতা বলার সময় পিঠে কার আলতো ছোঁয়া পেয়ে চুপ করে যায়।
দেখে রাজ অফিস থেকে ফিরে এসেছে।
রাজ কবিতা শুনে আজ একটুও রাগ করে নি।বিরক্ত ও হয় নি।সুমনার মনে হচ্ছিল সেই আগের রাজ।
আবার রাজকে খুব ভালবাসতে ইচ্ছা করছিল।
সুমনা কবিতা থামিয়ে দিয়ে রাজকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বলে।
বাবা মার খাওয়া হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি খেতে বসো,ছুঁচোতে পেটে ডন বৈঠক করছে। রাজ সুমনার খাওয়া হয় নি শুনে খুশিই হয়।
সুমনার আজ মনটা বেশ ফুরফুরে। হঠাৎ রাজের ধাক্কায় সম্বিত ফিরে পেল। রাজ বলে আচ্ছা কাল ডাক্তার দেখিয়ে আমরা চিকিৎসা করাব। রাজের ও মনটা বেশ উৎফুল্লিত।
খাবার টেবিলে ডিনার করতে করতে রাজ জানাল সুমনাকে মা অফিস যাবার সময় বলেছে আমাদের ঝগড়া করতে না।সুমনা বলে ও মা বারণ করেছে বলে ঝগড়া করছ না,।
রাজকে সুমনা গম্ভীর মুখে বলে তুমি নিজের থেকে বড় হতে পার না। তারপর দুজনেই অট্টহাসি।
ডাক্তারখানায় গিয়ে নানান টেস্ট করে তিন মাসের পর সুমনা প্রেগন্যান্ট হয়।
পরিবারে সুখের মূহূর্তে রাজ অফিসের পর কোথায় নিরুদ্দেশ হয়!!
খোঁজ করেও রাজের হদিশ মেলেনি।বহু বছর অতিক্রান্ত.সুমনার ছেলের বয়স পনেরো।একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। শ্বশুরবাড়ির সব দায়িত্ব সুমনার ঘাড়ে। করতেই হবে,রাজ ওনাদের একমাত্র সন্তান। বৌমা ও নাতিকে নিয়ে ওনারা বেঁচে আছেন।
সুমনা এখন মাধ্যমিকস্কুলের দিদিমণি।বাড়িতেও প্রচুর বাচ্চা ও পড়ে।
একদিন পেপারে চোখ পরে নিরুদ্দেশ কলামে,ছবিটা যেটা দেওয়া সেটা ঠিক তার ছেলে দীপনের মত দেখতে।এপ্রিল মাসের দুইতারিখ থেকে নিখোঁজ।বয়স এগারো…যোগাযোগের ঠিকানা..বাবা…রাজেশ পাল
মা..সীমা পাল,চারনম্বর জুবিলি পাড়া।মধ্যপ্রদেশ।ফোন নম্বর…৯৮৩১৯৪৬০৭৯
ছেলেটা তো পুরো সুমনার ছেলের মতো দেখতে। বাবার নামটাও মিলে গেছে। সুমনা ভাবে ,না না তার রাজ হবে না।মনের মধ্যে খচখচ নিয়ে কাজে মন দেয়।স্কুলের কিছু বান্ধবী কে বলে কথাটা।ওরা ফোন করতে বলে।সুমনা বলে থাক কয়েকদিন বাদেই ফোন করব।ততদিনে ছেলেটাকে পেয়েও যাবে।ছেলে পেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করব।
এর পরদিন একদিন সুমনা দেখে জি বাংলার গানের অডিশান চলছে।লম্বা লাইন ,সব বাচ্চারা লাইন করে দাঁড়িয়ে আছে।আবৃত্তি গান সুমনা ভালোবাসে।সুমনাও দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে।সুমনা আবৃত্তি করত তাই অনেকেই চিনত। তাই যেখানে গানের পরীক্ষা চলছে সেখানে নিয়ে গিয়ে আদর করে চেয়ারে বসান। বেশ কিছু বাচ্চার পর একটা বছর বারো বাচ্চা আসে,পিঠে ব্যাগ।মুখটা দেখেই চমকে উঠে সুমনা।
গানের পরীক্ষকরা বলেন ‘তুমি মধ্যপ্রদেশ থেকে এসেছ গান করতে’।ছেলেটি বলে ‘হ্যাঁ।’এখানে এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে এসেছে।ছেলেটি এত সুন্দর গান করে সবার মন জয় করে নেয়।
আত্মীয়ের ঠিকানাতো বলতে
হবেই ।ও চুপ করে থাকে।কি বলবে মাথা নিচু করে থাকে।
সুমনা অবচেতন মনে গড়গড় করে তার ঠিকানাটা বলে দেয়।আর বলে ,আমার আত্মীয়।ছেলেটার মুখে খুশির ঝলক দেখে সুমনা।ও সুমনারর সাথে সুমনার বাড়িতে আসে।পথে একটায় কথা বলে. ..”.কাকীমা ধন্যবাদ”।
আমার তো কেউ নেই।কদিন থাকতে দেবে!!
সুমনা বলে, আমিতো ছেলেধরা হতে পারি । তুই আমাকে চিনিস না আমার সঙ্গে চলে এলি। ছেলেটা বলে আমার তো কেউ নেই ।
তাই কাকীমা তোমার আশ্রয়ে কদিন থাকতে দেবে। ঠিক দেখো আমি গানে নাম করে গেলে তোমায় উপহার দেব।সুমনা বলে তুই
তো আমায় মনেই রাখবি না।
তারপর রিপন আসে সুমনার বাড়ি।সুমনার ছেলে নুতন ভাইটার সঙ্গে খুব খেলাধুলা করে।
সুমনার ছেলের নাম দীপন।এই বাচ্চাটির নাম রিপন।প্রায় একই দেখতে।
সুমনা নৈশভোজের পর রিপনকে জিজ্ঞাসা করে তার মার নাম কি ছিল?
বাবার নাম কি ছিল?
সুমনা ছিল বলে জিজ্ঞাসা করে কেননা রিপন বলেছে তার কেউ নেই।
নাম যা বলল ,পুরো মিল।
সুমনা বাবা মা এর ছবি আছে কিনা রিপনকে জিজ্ঞেস করতেই,ছেলেটি রাজের ছবি দেখাতেই ,চমক ওঠে। মা ও সুন্দরী।
তার মানে আরেকটা বিয়ে করেছে!!
মা -বাবা -সন্তানকে সুমনার ঘাড়ে চাপিয়ে পালিয়ে গেছে রাজ!!
সারা রাত সুমনা জেগেভাবতে থাকে “শ্বশুর-শাশুড়িকে কি বলবে ?”।
এই দেখুন আপনার চরিত্রবান ছেলে বেঁচে আছে,এই আপনার ছোট নাতি।বাপের মত পালানো রক্ত পেয়েছে।
পরদিনই ভোরে সুমনা পেপার থেকে ফোন নম্বর নিয়ে ফোন করে
রাজকে—
“রাজেশ বাবু বলছেন”??
ওপার থেকে উত্তর আসে ‘ হ্যাঁ’।
আপনার ছেলেকে পেয়েছেন??
না ম্যাডাম পাই নি। এদিকে আমার স্ত্রীর শারীরিক অবস্হা প্রচন্ড খারাপ।
সুমনা আস্তে করে মুখ চেপে বলে কোন স্ত্রীর!!!
রাজ বলে কি বলছেন??
সুমনা বলে আপনার কি টাচ মুঠোফোন।
রাজ বলে শুনুন -‘হ্যাঁ’।আমার মনমেজাজ ভাল নেই।আপনার যা বলার সংক্ষেপে বলুন।
সুমনা বলে এই নম্বরটি সেভ করে নিন।আপনার ছেলের খোঁজ পাবেন।আমার কাছেই আছে।তবে কোলকাতায় আছে।বাদবাকি ঘটনা সুমনা জানাই।
অবশ্যই নিজের পরিচয় ও ঠিকানা গোপন রাখে।
ও কখন আসছেন বলুন।??
তবে ছেলেটা গলা খুব ভাল।আপনারা ওকে গানটা করতে দিন।না হলে ও কিন্তু আবার পালাবে।রাজকে তো ঠিকানাটা দেওয়া যেতেই পারে।এই ফ্ল্যাটটা তো নতুন।ফোনটা সুমনা কেটে দেয়।ভাবতে থাকে ওর কি খামতি ছিল যে আরেকটা বিয়ে করতে হল। জানিয়ে গেলে সে ও তো তার জন্য ষোল বছর অপেক্ষা করত না।পুরো দায়িত্ব চাপিয়ে আরেকটা বিয়ে!!
ক্রিং ক্রিং করে ফোন বাজছে।রাজেরই ফোন।
সুমনা ফোনটা ধরতেই রাজ ঠিকানা চাইল। সুমনা ঠিকানা দিয়ে দেয় ।
পাশের বাড়ির রেডিও তে গান বাজছে ,,,,ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস… আজ সুমনার মনেও শত প্রশ্ন?????
ছেলেটাকে শ্বশুর মশাই অডিশনে নিয়ে যান।
শাশুড়িকে সুমনা বলে একটা সত্যি কথা বলব ,এবার আপনারা ছেলের কাছে চলে যান।
বৌমা তুমি মরে যেতে বলছ!!
আমরা বোঝা হয়ে গেছি।তোমার শ্বশুর তো পেনশন পান।তবুও তুমি বলছ!!!
আমরা জানি খুব বোঝা তোমার কাছে।
আ রে কাঁদছেন কেন?সব ঘটনা জানাই সুমনা।এই ছেলেটা তার নাতি।
সুমনার শাশুড়ি হঠাৎ বলে ফেলেন
এর থেকে তুমি মরার খবর দিতে খুব খুশী হতাম।
সুমনা হাতের শাখায় প্রণাম করে বলে,কি বলছেন মা!!
তিনি তো আমার স্বামী!!
শাশুড়ি বৌমাকে জড়িয়ে বলে হা রে মা তোর জন্য আজ বুড়ো ,বুড়ি বেঁচে আছি।তুই আমাদের চলে যেতে বলিস না।
ষোল বছরের জমানো কান্না বৌমা ও শাশুড়ির চোখ দিয়ে অঝোরে বইতে থাকে।
বলো বৌমা আমার ছেলে বেঁচে আছে!!
সুমনা বলে মা ছেলেরা কেউ জানতে না পারে। তাছাড়া ওদের কিবা দোষ!!
না হলে আপনার বড় নাতি বাবাকে ঘৃণা করবে আর ছোট নাতি সে আবার বাবার মত পালান অভ্যেস আছে,আবার পালাবে।
আপনি বাবাকে চুপিচুপি সব জানাবেন।
সুমনা পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখে শ্বশুরমশাই আগেই উঠে বসে আছেন।মুখটা থমথমে।বিড়বিড় করে বলছেন কুলাঙ্গার।
সুমনা শ্বশুরকে বলে আজ রিপনকে নিয়ে আমি অডিশানে যাচ্ছি। আপনার ছেলে আসলে পরিস্থিতি সামলে রাখবেন।ইচ্ছে হলে আপনারা ছেলের সঙ্গে চলে যেতে পারেন।
সুমনা আজ দুই ছেলেকে নিয়ে বাপের বাড়ি রেখে আসে।আজ অডিশান বাতিল।ওরা বিকেল ফিরবে।
বাড়িত সুমনা ফিরেএসে দেখে ঘরে বসে আছে এক ভদ্রলোক ও মহিলা।
বাড়ির পরিবেশ থমথমে।সুমনাকে শাশুড়ি কাছে ডেকে বলে জানিস
মা—
রাজের স্মৃতি ভ্রম হয়েছিল এক পথ দুর্ঘটনায়।
সুমনা বলে সব মিথ্যে।সে কাউকেই বিশ্বাস করে না।
আজকে সব মনে পড়েছে বুঝি!!
ওই ভদ্রমহিলা বলে মধ্যপ্রদেশের এক রাস্তায় পড়েছিলেন রাজ। উনি রাজকে বাড়ি নিয়ে যান।পেপারেও নিরুদ্দেশ বিজ্ঞপ্তি দেন।কোন উত্তর পান নি।তখন সীমার বাবা মা ছেলের মতো মনে করে বাড়িতে আশ্রয় দেন।সীমার বাবার ব্যবসার হাল ধরে রাজ।।
একদিন পাড়ার লোকেরা অশান্তি করাতে রাজ ও সীমা ভবিষ্যতের কথা না ভেবেই বিয়ে করে।তবে রাজের কোন হাত ছিল না।তারতো অতীত মুছে গেছিল।
বিয়ের পর তাদের ছেলে জন্মের পর রাজের দ্বিতীয় বার রাস্তায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মাথায় লাগে।আমার সেবাই উনি খুব খুশি হন।আগের কথা হালকা বলতেও পারছিলেন।
কিন্তু মা-বাবা-আপনাকে কি করে মুখ দেখাবেন ভাবতে পারছিলেন না!!
আমিও দিদি ভয় পেয়ে গেছিলাম।আমি ওর তাহলে অবৈধ বউ!!
তাই দিদি ক্ষমা করে দিওএই ছোট বোনকে।আমার যা টাকা আছে মা ছেলেতে চলে যাবে।সুমনা চুপ করে সব শোনে।ঠিক আছেখাওয়া দাওয়া কর।তারপর ভেবে দেখব।বিকালে দুই ছেলে রিক্সা থেকে হইহই করে নামে।ছেলে তো বাবা মাকে দেখেই পালাতে যাচ্ছিল।সুমনা চেপে ধরে বলে কোথায় যাচ্ছিস??
তুই আমার কাছেই থাকবি।তোর গান ও পড়াশুনা এখানেই করবি।এটাই তোর বাবা ও মায়ের শাস্তি।
রাজ তার বাবা-মা ও নুতন বৌ নিয়ে ফিরে গেছে। সুমনা দুই ছেলে নিয়ে ব্যস্তময় জীবন।তবে দুই পরিবারের যাতায়াত আছে।সুমনা মনে মনে ভাবে কারর কোন দোষ নেই।সব ওর কপালের দোষ।