Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি || Ashutosh Mukhopadhyay

দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি || Ashutosh Mukhopadhyay

কাহিনীর নামের প্রসঙ্গ পরে। কাহিনী প্রসঙ্গও পরে।

একজোড়া দম্পতি ঘাটশিলা বেড়াতে গেছেন সেটা গাঁজাখুরি ব্যাপার কিছু নয়। বেড়ানোর মৌসুমে বহুজোড়া দম্পতি গিয়ে থাকেন। এটাও বেড়ানোর অথবা স্বাস্থোদ্ধারের মৌসুম। এই বছরেরই অর্থাৎ আশি সালের আশ্বিন মাস। সালটা টাটকা বটে, কিন্তু ওই দম্পতি টাটকা বা কাঁচা কিছু নয়। চৌষট্টি আর সাতান্ন। মোহিনী সরকার চৌষট্টি। লম্বা, কালো। একমাথা কাঁচা-পাকা চুল। চাউনিতে বুদ্ধির ছাপ। এই বয়সেও শক্ত-সমর্থ মনে হয়। কিন্তু বছর দুই আগে একবার ছোট-খাটো হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। হাইকোর্টের নামী অ্যাডভোকেট। সকাল সাতটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত সেরেস্তা-কোর্ট-সেরেস্তা করে অভ্যস্ত। কিন্তু দুবছর আগে ওই অ্যাটাকটি হয়ে যাবার পরে জীবনের দোসর সাতান্নটি অর্থাৎ বিভা সরকার তার সময়ের ওপর প্রকাণ্ড একটা থাবা বসিয়েছেন এবং ফাঁক পেলেই বসিয়ে চলেছেন। বিভা সরকারের ডাক্তার বাবা এখনো বেঁচে, আর ডাক্তার দাদা তো বহাল তবিয়তে বেঁচে। তাঁদের পরামর্শের পরোয়ানা নিয়ে বিভা সরকার দাবি করেছিলেন, প্র্যাকটিস থেকে সম্পূর্ণ অবসর নিতে হবে। অনেক বাক-বিতণ্ডার পর আপসরফা হয়েছে। বাছাই দুচারটে কেস শুধু নেবেন, তার বেশি নয়। সপ্তাহে বড়জোর তিন দিন কোর্টে যাবেন, তার বেশি নয়। আর বছরে অন্তত তিন বার বেড়াতে বেরুবেন, তার কম নয়।

বিভা সরকারের সাদা-সাপটা হিসেব। মানুষ যা কিছু চায় সবই তো হয়েছে বাপু, আর কেন? নিজের মস্ত বাড়ি হয়েছে, দু-তিন বছর অন্তর নতুন নতুন গাড়ি হচ্ছে, ব্যাঙ্কে টাকা যা আছে দেড়শ বছর বেঁচে থেকে বসে খেলেও ফুরোবে না –এ ছাড়া ওপরে-নিচে দুটো দুটো করে এয়ারকুলার, দুটো ফ্রিজ, টি-ভিকি না হয়েছে! আর কি চাই বা কত চাই? তার মতে কেবল কাজ করা আর টাকা আনা একটা অভ্যাসের রোগ ছাড়া আর কিছু নয়।

মায়ের সঙ্গে একেবারে একমত তাদের ব্যারিস্টার ছেলের। একমাত্র ছেলে। আর কোনো সন্তান নেই। অতএব তার মতেরও রীতিমতো জোর থাকাই স্বাভাবিক। ব্যারিস্টার ছেলের যা আয় তার বেশির ভাগ বাবার জুনিয়র হিসেবে। বাধ্য হয়েই এই বাস্তব তাকে মেনে নিতে হয়েছিল। বাবা প্র্যাকটিস কমানো মানেই তার প্র্যাকটিস বাড়া। কারণ বাবা যখন একেবারে সরে দাঁড়াচ্ছে না, তখন মক্কেলরাই বা একেবারে সরে যাবে কেন?

অগত্যা একা মোহিনী সরকার সকলের সঙ্গে আর কত যুঝতে পারেন? তাই বুদ্ধিমানের মতো অনেকটা অবকাশের কোলে গা ছেড়ে দিয়েছেন। তাঁর মনে মনে ধারণা, ছোটখাটো হার্ট অ্যাটাকের ফলে স্ত্রী-টি ভিতরে ভিতরে একটু খুশিই হয়েছেন। তার কাজকর্মের ওপর এত জারিজুরি আর কখনো খাটাতে পারেন নি। এই বয়সে এসে স্বামীটিকে মোটামুটি দখলের ওপর পেয়েছেন। গোড়ায় গোড়ায় মোহিনী সরকারের এত অবকাশ ভালো লাগত না। হাঁপ ধরে যেত। এখন সয়ে যাচ্ছে শুধু নয়, তারও ভিতরে একটু গা-ছাড়া ভাব এসেছে। এই দেশটা যে বেশ একটু ঘুরে বেড়াবার জায়গাও এটা অনুভব করছেন। এখন অনেক কিছু খুঁটিয়ে দেখেন যা আগে দেখতেন না। অনেক কিছু পড়েন যা আগে পড়তেন না।

হালের গল্প-উপন্যাস ছেড়ে রবি ঠাকুরের কবিতা পড়েও বেশ রস পাচ্ছেন আজকাল। পড়ার ব্যাপারে তার গাইডের কাজ করছেন বিভা সরকার। এককালে স্ত্রীটির লেখিকা হবার সখ ছিল। বয়েসকালে কিছু লেখা খুব সংগোপনে মাসিক-সাপ্তাহিকের দপ্তরে পাঠিয়েছেন এবং তা ফেরতও এসেছে। ক্রমে লেখিকা হবার সাধ গেছে, কিন্তু গল্প-উপন্যাস পড়ার ঝোঁক বেড়েছে। নেশা বলতে এখন ওই একটাই। হাতে গোনা যে দুচারজন লেখকের লেখা তার ভালো লাগে তা বারকয়েক পড়া না হলে তৃপ্তি নেই। দিনে হোক রাতে হোক ভালো গল্প উপন্যাস পড়ার অভ্যাসটা শুয়ে এবং বই। বুকে নিয়ে। তাই দেখে মোহিনী সরকার কত ঠাট্টা করেছেন। বলেছেন, তোমার ভালো লেখকদের ভাগ্য বটে, ষোল থেকে সত্তর বছরের তরুণী যুবতী প্রৌঢ়া আর বৃদ্ধার বুকে বুকে ঘুরে বেড়ান। এমন জানলে ওকালতির দিকে না গিয়ে লেখক হতাম।

বিভা সরকারও সমান তালে জবাব দিতেন, মেয়েদের বুকে ওঠার মতো লেখক ইচ্ছে করলেই হওয়া যায় না-বুঝলে! এ তোমার পেনাল কোড না যে ঝেড়ে মুখস্ত করে মেরে দিলেই হল। লেখক হতে হলে জীবন দেখার আর জীবন-জটিলতা বোঝার আলাদা চোখ আলাদা মন দরকার।

মহিলার বাছাই-করা লেখকদের বই বেরুলে তিনি কিনেই ফেলেন। লাইব্রেরি থেকে এনে পড়ার অপেক্ষায় থাকেন না। এই করে তার নিজস্ব লাইব্রেরিটি কম বড় নয়। এখন সেখান থেকে বই বেছে বেছে নিয়ে তিনি স্বামীকে পড়ান। পড়ার পর আলোচনা করেন। এক-এক সময় জোর তর্কও বেধে যায়। কারণ স্ত্রীটির যে লেখক যত প্রিয়, তার এই সমালোচনায় মোহিনী সরকার ততো নির্মম। স্ত্রীর কাছে ভালো লাগার দিকটা এড়িয়ে কেবল খুঁতগুলোই বড় করে তোলেন এবং স্ত্রীর তর্কের মেজাজ দেখে মনে মনে খুশি হন। মোটকথা স্ত্রীর পাল্লায় পড়ে আর সময় কাটানোর দায়ে ইদানীং গল্প-উপন্যাস পড়তেও ভদ্রলোকের ভালোই লাগে।

এবারে কাছাকাছির মধ্যে সস্ত্রীক ঘাটশিলায় এসেছেন। ছেলে বা ছেলের বউ তাঁদের সঙ্গে কখনো বেরোয় না। এদিকে মোহিনী সরকার সস্ত্রীক আসা মানে সঙ্গে পুরনো খানসামা আসা, একটা ছোকরা চাকর আসা, চাকরের থেকে প্রমোশন পাওয়া বয়স্ক অথচ কর্মঠ কেয়ারটেকারের আসা। সকলেই এসেছে। সেই সঙ্গে কলকাতা থেকে আরামে বা ভালো থাকার জন্যে যেসব সরঞ্জাম আনা সম্ভব তা-ও এসেছে। অথচ সরকার দম্পতি এখানে একমাস থাকবেন কি এক সপ্তাহ সেটা কেমন লাগে তার ওপর নির্ভর। বেশ নিরিবিলি ছিমছাম জায়গা, স্বাস্থ্যকর তো বটেই, আশা করা যায় ভালোই লাগবে।

এখানে এসে তিন চার দিন ধরে মোহিনী সরকার আর বিভা সরকার আর একজোড়া ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে লক্ষ্য করছেন। এদের দৃষ্টিতে তারা আর যা-ই হোন দম্পতি বলে মনে হয় নি। মোহিনী সরকার উকিলের চোখ দিয়ে তাঁদের দেখছেন। আর বিভা সরকার তার সহজাত মেয়েলি কৌতূহলের চোখ দিয়ে। খুব সকালে তিন মাইল দূরের বাজারে বা কিছুটা কাছের হাটে দুজনকে দেখেছেন। এখানে খুব সকালে ভিন্ন বাজার থেকে পছন্দের মাছ তরকারি বা মাংস মেলা ভার। বেড়ানোর মৌসুমে লোকের ভিড়ে তো বাজার আরো আকাল হয়ে ওঠে। মোহিনী সরকার সস্ত্রীক সাইকেল রিকশয় আসেন, হাট বা বাজার সেরে তাতেই ফেরেন। তাদের লক্ষ্যের ওই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাও তাই। মোহিনী সরকার তাদের বাজার করাও একটু আধটু লক্ষ্য করেছেন। ভদ্রলোককে এই বয়সেও একটু পেটুক মনে হয় তার। কারণ, সামনে যা দেখেন সঙ্গিনীকে তাই কিনতে বলেন। আর সঙ্গিনীটি সুন্দর মুখে একটু ভুরু কুঁচকে বা একটা হাত অল্প একটু নেড়ে তার বেশির ভাগই বাতিল করে দেন। মোহিনী সরকার বেশ লক্ষ্য করেছেন, মহিলা নিজের বিবেচনামতো পরিমিত বাজার করেন। নিজেই শক্ত হাতে বাস্কেট বা ব্যাগ নিয়ে বাজার বহন করেন। মাথায় কাপড় থাকে না তখন, শাড়ির আঁচল গাছকোমর করে জড়ানো থাকে। মোহিনী বা বিভা সরকারের বাজারের ব্যাগ আর থলে অবশ্যই ছোকরা চাকরটার হাতে। সময় হিসেব করে তাকে আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাজার শেষে ছোকরাটা হেঁটে ফেরে, আর বাজার ফেরে তাদের রিকশয়।

হাটে বা বাজারে ছাড়া রাস্তায় দেখা হচ্ছে, শীর্ণ সুবর্ণরেখার ধারে বা কাছের পাহাড়ী টিলাটার কাছেও দেখা হচ্ছে। কাছাকাছির মধ্যে বেড়াবার জায়গা এই দুটোই। শহরের মধ্যে বেড়াতে বেরুলে এর এক জায়গায় না এক জায়গায় দেখা হবেই। কিন্তু বেড়াতে তো আরো অনেকেই বেরিয়ে থাকেন। অথচ সরকার দম্পতির অবধারিত লক্ষ্য ওই ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাটি।

লক্ষ্যের প্রধান কারণ বোধহয় দুজনের বয়সের ফারাক। ফারাকটা অবশ্য সরকার দম্পতির বিবেচনায়। দুজনেরই ধারণা, ভদ্রলোকের বয়েস সত্তরের কিছু ওপরে ছাড়া নিচে হবে না। মাথায় চুল যেটুকু আছে সবই সাদা। গায়ের রং না কালো না ফর্সা। চোখে মোটা কাঁচ আর মোটা ফ্রেমের চশমা। লাঠি ব্যবহার করেন না বটে তবে ধীরেসুস্থে পা ফেলে হাঁটেন। মুখখানা হাসি-হাসি, কিন্তু, মহিলার তুলনায় কথা কম বলেন যে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যখনই দেখা হয়, মহিলাকে বেশ সুন্দর ভঙ্গীতে একটু একটু হাত নেড়ে কথা বলতে দেখা যায়। ভদ্রলোকের বেশির ভাগ শ্রোতার আর অল্প অল্প হাসার ভূমিকা।

কৌতূহলের বা লক্ষণীয় হয়ে ওঠার আসল কারণ ওই মহিলা। দুজনেরই মতে তার বয়েস খুব বেশি হলে সাতচল্লিশ কি আটচল্লিশ। মাথায় একরাশ কুচকুচে চুলের ওপর দিয়ে কতগুলো রুপোলি চুল ছড়িয়ে না থাকলে বা কানের দুপাশেও কিছু পাকা চুল দেখা না গেলে সাতচল্লিশ আটচল্লিশও আদৌ বলা যেত না। গায়ের রং রীতিমতো ফর্সা, মুখশ্রীও সুন্দরই বলতে হবে। কিন্তু অমন ফর্সা বা অমন মুখশ্রীও হামেশাই দেখা যায়। এ ছাড়াও মহিলার মধ্যে দর্শনীয় কিছু আছে যা চট করে ঠাহর করা যায় না, অথচ অনুভব করা যায়। বয়েসকালে প্রায় দীর্ঘাঙ্গী মহিলার স্বাস্থ্য-সম্পদ নিশ্চয় চোখে পড়ার মতো ছিল। তারই তৎপরতাটুকু এখনো যেন সর্ব অঙ্গে ছড়িয়ে আছে। তার বাস্কেট হাতে বাজার করা, হাঁটা চলা কথা বলার সময় ঈষৎ চঞ্চল ভঙ্গীতে সুডৌল হাত নাড়া–সবকিছুর মধ্যে সেই সূতৎপর মাধুর্যটুকু রমণীয় হয়ে ওঠে। সুগৌর। কপালে ঘোটর ওপর জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ, সিঁথিতে সিঁদুরের জ্বলন্ত আঁচড়। এ রকমই হয়তো সকলে পরে, কিন্তু মহিলার সজীবতার দরুন তা-ই হয়তো একটু বেশি উজ্জ্বল মনে হয়। মহিলার মধ্যে দর্শনীয় কি মোহিনী সরকারের ধারণা তিনি ধরতে পেরেছেন এবং স্ত্রীকেও বলেছেন। সাতচল্লিশ বা আটচল্লিশ যে বয়েসই হোক এখন, মহিলার চাল-চলনে তা-ও যেন একটু তফাতে সরে আছে–ছুঁয়ে থেকেও ছুঁতে পারছে না। বিভা সরকার এই মন্তব্যের সঙ্গে খুব দ্বিমত হননি।

এখন প্রশ্ন বা কৌতূহল, ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের কে হতে পারেন? আত্মীয়া তো বটেই। তাদের বাড়ির আধ মাইলের মধ্যে রেল লাইনের কাছাকাছি দুখানা ঘরের একটা ছোট্ট বাংলোয় ওঁরা আছেন–আসতে যেতে সরকার দম্পতি তা-ও দেখে রেখেছেন। আত্মীয়া ভিন্ন ওই বুড়োর সঙ্গে এসে এক বাড়িতে থাকা, এক রিকশয় চেপে বাজারে যাওয়া বা বিকেলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া সম্ভব কেউ ভাবে না। আত্মীয়া তো বটেই, ঘনিষ্ঠ আত্মীয়াই মনে হয়। কিন্তু সেটা কি হতে পারে? অবকাশ অঢেল, তাই আলোচনাতেও আলস্য নেই। মোহিনী সরকার আর বিভা একটু হিসেবও করেছেন। বিভা বলেছেন, ধরা যাক ভদ্রলোকের বয়েস বাহাত্তর, তার বেশি ছাড়া কম কিছুতে হবে না, আর ওই মহিলার বড়জোর আটচল্লিশ–তাহলে তফাৎ কত হল?

–চব্বিশ।

বিভার মন্তব্য, আগের দিনের মানুষদের বিয়ে তো একটু আগেই হত-তাহলে ভদ্রলোকের মেয়ে হওয়াই সম্ভব।

মোহিনী সরকারের উকীলের মাথা, তার ভাবনাও একেবারে অত সহজ বা সরল কিছু না। জবাব দেন কিন্তু মেয়ে মনে হয় না। প্রথম কথা, ভদ্রলোককে মহিলার আগলে রাখার মধ্যে একটু মিষ্টি শাসনের ভাব আছে যা বাদ দিলে তোমার সঙ্গেও একটু আধটু মেলে।

বিভা ছোট্ট প্রতিবাদ করলেন, আ-হা

–দ্বিতীয় কথা, আজই তোমাতে আমাতে ওই ঢিবিতে বেড়াতে গিয়ে দেখলাম, বিকেলের আলোয় টান ধরতে না ধরতে ব্যাগ থেকে চাদর বার করে মহিলা নিজের হাতে বেশ করে ভদ্রলোকের গায়ে গলায় জড়িয়ে দিলেন, যা অনেকটা শরৎবাবর নায়িকাদের সঙ্গে মেলে। কিন্তু তাদের মধ্যে একমাত্র শেষ প্রশ্নে তাজমহলে বেড়াতে এসে আশু বদ্যির মেয়ে মনোরমাকে বার দুই বলতে শুনেছি বাবা ওঠো, তোমার। ঠাণ্ডা লাগবে। নিজে হাতে কিছু করে নি। মোট কথা, ওভাবে চাদর জড়িয়ে দেওয়াটা বাবা মেয়ের সম্পর্কের মতো আমার একটুও মনে হয় নি।

কি বলতে চান বিভা অতটা তলিয়ে না ভেবেই জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে কি অনেক ছোট বোন-টোন হবে?

মোহিনী সরকার হালছাড়া গলায় বললেন, এত আধুনিক বই গিলে শেষে এই ছন্দপতন! ভাই-বোনের ছাদ-ছিরিতে এমন অসম্ভব তফাৎ হয়! হলেও আমার ভাবতেই নীরস লাগে। আমি বলছিলাম, ভদ্রমহিলা ভদ্রলোকের তৃতীয় বা চতুর্থ পক্ষের উনি হতে বাধাটা কি–তা হলে অনেকগুলো কনডাক্ট রুল মনে আচরণ-বিধি মেলে।

বিভা সরকার বক্র শ্লেষে তক্ষুণি সেই সম্ভাবনা বাতিল করেছেন।-হুঁ, খোঁজ নিয়ে দেখো গে যাও বয়েসকালে প্রথম পক্ষ করার জন্য কত ছেলে ও মেয়ের পায়ের কাছে গড়াগড়ি খেয়েছে–দেখলে বুঝতে পারো না? অমন খ্যাংরাকাঠির তৃতীয়-চতুর্থ হবার তার দায় পড়েছে।

-তা অবশ্য ঠিক, কিন্তু অমনটি হলেই একটু রসের হয় না?

-বাজে বোকো না, শেষে দেখবে বাপ-মেয়ে বা সেই গোছের কিছু, তখন সে বেরিয়ে যাবে। তুমি যে বলেছিলে, কদিন দেখার পর ভদ্রলোকের মুখখানা একটু চেনা চেনা ঠেকছে, কোথাও দেখেছ মনে হচ্ছে–মনে পড়ছে?

দুতিন দিন দেখার পর মোহিনী সরকারের সত্যি মনে হয়েছে ভদ্রলোকের ওরকম একখানা মুখের আদল, বিশেষ করে ওই গোছের একটু মিষ্টি মিষ্টি হাসি কবে কোথাও দেখেছেন। ওকালতিতে আইনের ধারা পড়ে পড়ে হোক বা যে কারণেই হোক, আজও তাঁর প্রখর স্মরণশক্তি। কিন্তু অনেক ভেবেও তিনি ঠিক করতে পারেন নি, এই ভদ্রলোকটিকে কোথাও তিনি দেখেছেন কি দেখেন নি। অথচ মনে হয় দেখেছেন।

জবাব দিলেন, না, কত অচেনা লোককেই তো অনেক সময় চেনা-চেনা মনে হয়।

স্ত্রীটি তক্ষুণি সন্দিগ্ধ।–আসলে তোমার মেমরি খারাপ হয়ে যাচ্ছে।

আরো দুদিন বাদে চাক্ষুষ দেখা আর সামনা-সামনি আলাপ। বিকেলের দিকে মোহিনী সরকার আর বিভা সরকার রেল লাইনের দিক ধরে বেড়াতে বেড়াতে আসছিলেন। ওই দু ঘরের বাংলোর সামনের ঘরের দরজা খোলা। দরজা আগলে বৃদ্ধ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। গায়ে একটা আধা গরম চাদর জড়ানো। তাঁদের দিকেই চেয়ে আছেন।

মোহিনী সরকারও তার দিকে চেয়ে হঠাৎ হাসলেন একটু। অবশ্যই সৌজন্যের হাসি।

ভদ্রলোকও তক্ষুণি হাসলেন এবং মিষ্টি হাসি।

মোহিনী সরকার আর বিভা সরকার তখন বাংলোর দশ গজের মধ্য দিয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিলেন। মোহিনী সরকার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হাসিমুখে দু হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার জানালেন।

ভদ্রলোকও তক্ষুণি প্রতি-নমস্কার করে অন্তরঙ্গ অভ্যর্থনা জানালেন, আসুন আসুন –বেড়িয়ে ফিরছেন?

মোহিনী সরকার ঘুরে স্ত্রীর হাসিছোঁয়া মুখখানা একবার দেখে নিয়ে ভদ্রলোকের দু গজের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন।-হা… আপনারা আজ বেরোন নি?

মুখখানা একটু বিরস করে ভদ্রলোক জবাব দিলেন, নাঃ, আমার শরীরটা নাকি আজ খুব ভালো নেই।

শুনে মোহিনী সরকার এবং তার পিছনে বিভা সরকার অবাক। নিজে বলছেন, শরীরটা নাকি ভালো নেই–এ আবার কি কথা?

ভদ্রলোক আবার সাদর আহ্বান জানালেন, আসুন, ভিতরে আসুন।

তাঁরা তবু একটু দ্বিধান্বিত। অসুবিধে হবে কিনা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই ভদ্রলোকের পিছন থেকে কচি ছেলের গলার মতো মিষ্টি রমণীকণ্ঠ শোনা গেল, কার সঙ্গে কথা হচ্ছে?

ভদ্রলোকের এবারের জবাবও অদ্ভুত। পাশের ঘরের দিকে সামান্য ঘাড় ফিরিয়ে জবাব দিলেন, আমাদের সেই ওঁরা–

না বুঝে ঈষৎ বিস্ময়ে ভিতরের মহিলা এগিয়ে এসে ভদ্রলোকের পাশ দিয়ে দেখলেন। তারপরেই হাসিমুখে ব্যস্ত আহ্বান জানালেন, ও… আসুন আসুন। আঃ, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকলে ওঁরা আসেন কি করে!

শেষেরটুকু ভদ্রলোকের উদ্দেশে। তিনি অপ্রস্তুত মুখে সরে দাঁড়ালেন। মোহিনী আর বিভা সরকার ভিতরে ঢুকলেন। মহিলা সামনের কাঠের চেয়ার দুটো দেখিয়ে বললেন, বসুন–

চেয়ার দুটোর পাশেই একটা ইজিচেয়ার পাতা। বিভা হাসি হাসি মুখে একটা কাঠের চেয়ারে দিকে এগোলেন। কিন্তু বসার আগেই বাধা পড়ল। মোহিনী সরকার প্র্যাকটিস অনেক ছেটে দিলেও বাঘা উকিল তো বটেন। মনে মুখে তেমন লাগাম টেনে কথা বলার অভ্যেস নেই। তিনি ভদ্রলোকের দিকে ফিরে বলে উঠলেন, দাঁড়ান, একটা জিনিস আগে বুঝে নিই, উনি (মহিলা) কার সঙ্গে কথা হচ্ছে জিজ্ঞেস করতে আপনি জবাব দিলেন, আমাদের সেই ওঁরা–মানে, আপনাদের আমরা… কি রকম ব্যাপার?

বিভা সরকারের চোখে কৌতুক, মহিলার অপ্রতিভ মিষ্টি মুখ। ভদ্রলোকের বাইরেটা একটু নির্লিপ্ত গম্ভীর বটে, কিন্তু কথা একটু কৌতুক-ছোঁয়া হেঁয়ালি গোছের। বিনীত জবাব দিলেন, আমার বলার মধ্যে একটু ভুল হয়েছে। বলা উচিত ছিল বাইরে দেখা হয়ে গেলে আমরা যাঁদের সেই ওঁরা।

জবাব শুনে তুখোড় চালাক মানুষ মোহিনী সরকার ভিতরে ভিতরে একটু হোঁচট খেলেন। অথচ কথাগুলো সঠিক বোধগম্য হল না। মহিলা তাড়াতাড়ি ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, আপনারা বসুন, ওঁর কথায় কান দেবেন না।

বসার আগে মোহিনী সরকার বললেন, দাঁড়ান, আগে নিজেরা নিজেরা পরিচয় করে নিই। আমি মোহিনী সরকার, পেশা হাইকোর্টের ওকালতি-আর ইনি আমার স্ত্রী মিসেস সরকার–আপাতত প্র্যাকটিস অর্ধেকের বেশি ছেড়ে দিয়ে এঁর শাসনে আছি

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, আ-হা, সুশাসন বলুন। নমস্কার, নমস্কার। আমার যে নামটা ইদানীং সব থেকে প্রিয় সেটা হল খোকা–যত বয়েস হচ্ছে এই নামের টান তত বাড়ছে। তাই আমি খোকা গাঙ্গুলি।

মোহিনী সরকার এবারে বুঝলেন, ভদ্রলোক বাইরে যেমনই হোক ভিতরে রসিক মানুষ। হাসিমুখে নিজেও তক্ষুণি একটু রসিকতা করে বসলেন, আপনাকে তাহলে খোকাবাবু বলে ডাকব?

নিশ্চয় ডাকবেন। একদিকে মিষ্টি, অন্যদিকে লোকে শুনলে মজা পাবে।

পরিচয় শেষ হবার আগেই থেমে যাবার উপক্রম দেখে একটু বেশি আগ্রহ নিয়েই। হয়তো মহিলাকে দেখিয়ে মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, ইনি…?

নির্লিপ্ত গম্ভীর গলায় খোকা গাঙ্গুলি বললেন, ইনি আমার ছোট শালী।

শোনামাত্র মোহিনী সরকার আর বিভা সরকার বিমূঢ়, হতচকিত। এটা বাইরের ঘর, যত বয়সই হোক শালী নিয়ে একঘরে…

– কিন্তু ভালো করে মাথায় কিছু ঢোকার আগেই ভদ্রলোকের উদ্দেশে মহিলার ধমক শোনা গেল।–কি হচ্ছে? মুখ লাল করে অভ্যাগতদের দিকে ফিরে সুন্দর দুখানা হাত জোড় করে বললেন, আমি মিসেস গাঙ্গুলি।

পলকে ঘর ছেড়ে পাশের ঘর থেকে একটা মোড়া নিয়ে এলেন।-বসুন আপনারা, আমি এতে বসি।

যে যার আসন নিলেন। সরকাররা দুজন কাঠের চেয়ারে, খোকা গাঙ্গুলি ইজি চেয়ারে। বসার পরেই মোহিনী সরকার অপ্রস্তুত। কারণ বসার ফাঁকটুকুর মধ্যে স্ত্রীর। দিকে চেয়ে তিনি একটা বিজয়ীর দৃষ্টি হেনেছেন, তারপর মুখ ফিরিয়েই দেখেন, ভদ্রলোকের নির্লিপ্ত দুচোখ তারই মুখের ওপর। চোখোচোখি হওয়ামাত্র খোকা গাঙ্গুলি আলতো করে জিজ্ঞেস করলেন, কি হল? আপনি জিতেছেন আর আপনার স্ত্রী হেরেছেন?

শুনে বরাবরকার স্মার্ট মানুষ মোহিনী সরকার হঠাৎ ভ্যাবাচ্যাকাই খেলেন একটু। –কি বলছেন?

–দাঁড়ান মশাই দাঁড়ান, না, মানে সবুর করুন। গম্ভীর মুখে ঈষৎ ভ্রূকুটি।–সেই প্রথম থেকে দেখছি আপনি আমার সোজা-সোজা কথাগুলোও বুঝতে পারছেন না। আচ্ছা, গোড়া থেকে একে একে বোঝাপড়াটা হয়ে যাক–

এ পর্যন্ত বলেই স্ত্রীর দিকে ফিরলেন।–এঁদের একটু চা দিতে বলো… আমি আধ পেয়ালার বেশি না।

সকোপে তার দিকে ফিরে তাকাতে গিয়ে মহিলা হেসে ফেললেন। অতিথিদের বললেন, আসলে এঁর দুবার হয়ে গেছে বলে আর সিকি পেয়ালাও জোটার কথা নয়–

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় তাগিদ দিলেন, তাড়াতাড়ি। এঁদের সঙ্গে বোঝাপড়াটা শুরু করতে পারছি না।

মহিলা তক্ষুণি উঠে গেলেন। প্রথম পরিচয়পর্ব এমনি অভিনব যে সৌজন্যের খাতিরেও দুজনের কেউ চা থাক বলার ফুরসত পেলেন না। খোকা গাঙ্গুলি আধবসা থেকে তিন কোয়ার্টার শুয়ে পড়লেন। আর সেই ফাঁকে সরকার-দম্পতি বার দুই দৃষ্টিবিনিময় করে নিলেন। কাজের লোকটিকে চায়ের কথা বলে মিসেস গাঙ্গুলি এক মিনিটের মধ্যে ফিরে হাসিমুখে আবার মোড়ায় বসলেন।

মোহিনী সরকার ভিতরে ভিতরে বেশ কৌতুকবোধ করছিলেন। সপ্রতিভ মুখে। বললেন, খোকাবাবু এবারে বোঝাপড়া শুরু হোক–

খোকাবাবু আবার সোজা হলেন। কিন্তু অতিথির কথা কানেও গেল না যেন। স্ত্রীর দিকে ঝুঁকলেন, বেন্দাটাকে কি বলে এলে, আমাকে এই একটুখানি অন্তত দেবে তো? আঙুলে করে পরিমাণ দেখালেন।–না কি এঁরা খাবেন আমি বসে বসে দেখব?

সরকার-দম্পতি একটু জোরেই হেসে উঠলেন। মহিলার হালছাড়া হাসিটুকু আরো সুন্দর। বললেন, এই রকমই বলার স্বভাব, আপনারা ভাবছেন আমি ভালো করে খেতেই দিই না,

সঙ্গে সঙ্গে খোকা গাঙ্গুলির ভুকুটি এবং বিস্ময়।–সোমা! তুমি আর যা-ই করো, মিথ্যের আশ্রয় তো নাও না। ওঁরা ভাবছেন কি রকম? সামান্য একটু চা নিয়েই যা। ব্যাপার, বৃহৎ ব্যাপারে তুমি কি করো সে-কি এঁদের বুঝতে বাকি যে তুমি এঁদের অন্যরকম ভাবাতে চাইছ!

এ কদিনের দূর থেকে দেখা মানুষটার এমন রসের ফন্নধারা কল্পনা করা যায়। নি। তাদের বিশেষ জল্পনা-কল্পনা ছিল এই সোমা গাঙ্গুলিকে নিয়ে। সোমা নামটাও বেশ লাগল মোহিনী সরকারের। খোকা গাঙ্গুলি ছাড়া হাসছেন সকলেই। সোমা বললেন, লোকের সামনে আমাকে নাকাল করতে পারলেই ওঁর খুব আনন্দ।

মোটা ফ্রেমের পুরু কাঁচের চশমার ওধারে খোকাবাবুর দু চোখ এবার মোহিনী সরকারের মুখের ওপর।–কি বলছিলেন… বোঝাপড়া? হ্যাঁ, আমি বলছিলাম আপনি আমার জলের মতো কথাগুলোও বুঝতে পারছেন না। যেমন, এক–যেমন, আমরা আজ বেরুইনি কেন জিজ্ঞেস করতে আমি বললাম, আমার শরীরটা নাকি আজ ভালো নেই। ওই নাকি শুনে আপনি অবাক। অথচ একটু আগে আপনি নিজেই বললেন, প্র্যাকটিস অর্ধেকের বেশি ছেড়ে এখন স্ত্রীর শাসনে আছেন। সেই শাসনটা যদি আস্তে আস্তে নিখাদ সুশাসনের দিকে গড়ায় তাহলে দেখবেন আপনার শরীরের খবর আপনার। থেকে আপনার স্ত্রী ঢের বেশি রাখেন।

–দুই। আমি স্বীকারই করলাম, আপনাদের আমাদের সেই ওঁরা বলা ঠিক হয়নি।–বলা উচিত ছিল, বাইরে দেখা হয়ে গেলে আমরা যাঁদের সেই ওঁরা। তাই শুনেও আপনি বিলক্ষণ অবাক। অথচ বাইরে দেখা হয়ে গেলেই আপনারা যে আমাদের বেশ খুঁটিয়ে দেখেন, একজনের চোখে না পড়লে আর একজনকে খোঁচা দিয়ে বা ইশারায় আমাদের দেখান, আর আমাদের নিয়ে আলোচনা করেন–এসব আমার থেকে আপনারাই ভালো জানেন। এবারে আমার জবাবটা বুঝতে আর বোধহয় খুব অসুবিধে হচ্ছে না।

–তিন। সোমা আমার স্ত্রী শুনেই যেভাবে আপনি আপনার স্ত্রীর দিকে তাকালেন, আমার ধারণা, শুধু বাজী জিতলেই অমন করে তাকানো যায়। কিন্তু আমি জেতা হারার কথা বলতে আপনি বুঝতেই পারলেন না।

বিভা সরকারের দু চোখ কপালে। লজ্জিত আর অপ্রস্তুত তো বটেই, অদ্ভুত ভালোও লাগছে। অথচ এই মানুষকে দেখে দূর থেকে স্বল্পভাষী মনে হত। অ্যাডভোকেট মোহিনী প্রকার চক্ষুলজ্জার ধার ধারেন না। এ যাবৎ অনেক মানুষ দেখেছেন, অনেক মানুষ চরিয়েছেন। সামান্য আলাপে এই লোকের বিচক্ষণ দৃষ্টিশক্তি আর অতি সহজে দুয়ে দুয়ে চারে পৌঁছানোর ক্ষমতার প্রশংসা না করে পারলেন না। কোনো কথার প্রতিবাদ না করে অল্প অল্প হাসছিলেন তিনি। মুখের দিকে চেয়েছিলেন। হঠাৎ একটু উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, এর আগে আপনাকে কি আমি কখনো কোথাও দেখেছি–অথবা আপনি আমাকে দেখেছেন?

ভালো করে মুখের ওপর একটু চোখ বুলিয়ে খোকাবাবু জবাব দিলেন, শাস্ত্রমতে দুজনেই দুজনকে দেখেছি।

–সেটা কি রকম? মোহিনী সরকার উৎসুক।

–শাস্ত্র বলে আমাদের প্রত্যেকটা যোগাযোগ পূর্বনির্দিষ্ট। আগের যোগাযোগ ভিন্ন কোনদিন কারো সঙ্গে পরের যোগাযোগ হয় না।

–আগের বলতে?

–আগের বলতে আগের জন্মের হতে পারে–তার আগেরও হতে পারে।

মোহিনী সরকার হাসলেন একটু।–না আমি এই জন্মের কথাই বলছি।

খোকাবাবু আবার তাকে দেখলেন। বললেন, মনে পড়ছে না।

বৃন্দাবন ট্রে-তে তিন পেয়ালা চা আর ডিশে বিস্কুট নিয়ে এলো। সোমা মোড়া ছেড়ে উঠে ভরতি পেয়ালা দুটো অভ্যাগতদের দিলেন আর কম চায়ের পেয়ালাটা তৃতীয় জনকে। বিভা সরকার জিজ্ঞেস করলেন, আপনারটা?

জবাব দেবার আগেই খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, চলে না, চলে না–আমার আর এক দুর্ভাগ্য দেখুন, চায়ের সঙ্গী পর্যন্ত নেই। স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, তুমি আর এক পেয়ালা দুধ নিয়ে বোসো না, লজ্জা কি?

অন্যদিক থেকে কোপের প্রতিক্রিয়াটুকু অবিমিশ্র মিষ্টি লাগল মোহিনীবাবুর।

পরপর কয়েক চুমুকে নিজের পেয়ালা খালি করে এবং সেটা ইজিচেয়ারের পাশে রেখে খোকা গাঙ্গুলি নিশ্চিন্ত। একটু চুপ করে থেকে বললেন, এবারে আমাদের নিয়ে আপনাদের আসল যা কৌতূহল সেটা ব্যক্ত করে ফেলুন–একটুও লজ্জা করবেন না, আমি ও জিনিসটা অনেককাল বর্জন করেছি।

মোহিনী সরকার ঠোঁট-কাটা মানুষ, কিন্তু এ এমনি এক পরিস্থিতি যে অজ্ঞতার ভান করা ছাড়া উপায় নেই। বললেন, আর কি কৌতূহল?

-বলেন কি মশায়! ভদ্রলোক সত্যের অপলাপ দেখেই যেন আরো অবাক।–উনি আমার দ্বিতীয় পক্ষ না তৃতীয় পক্ষ নাকি চতুর্থ পক্ষ এই প্রশ্ন আপনাদের মনে নেই বলতে চান?

কর্তার থেকেও এবারে বিভা সরকার বেশি ফাঁপরে পড়লেন। সোমা গাঙ্গুলি এবারে ধমকেই উঠলেন, সেই থেকে তুমি যা করছ ওঁরা আর এদিক মাড়াবেন না।

মোহিনী সরকার বললেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, আপনারা না চাইলেও আমরা নিশ্চয়। মাড়াবো, কারণ দোষী হয়েও এত আনন্দ কমই মেলে–লোকচরিত্র পাঠে উনি সিদ্ধ মানুষ এ অস্বীকার করতে পারছি না।

লজ্জা পেয়েও সোমা গাঙ্গুলি বলতে গেলেন, শুনুন এর মধ্যে ওঁর শরীরটা

খোকা গাঙ্গুলি একটা হাত তুলে বাধা দিলেন।–থামো, অপ্রাসঙ্গিক কথা আমি বরদাস্ত করি না জানোই তো। গম্ভীর।–কথা তোমাকে নিয়ে আমাকে নিয়ে নয়। এঁদের কৌতূহল এমন বৃদ্ধের অমন প্রায়-তরুণী ভার‍্যা কেন–বা কোন্ পক্ষের। মোহিনী সরকারের দিকে ফিরলেন।–ঠিক কি না?

মোহিনী সরকার ওকালতির মাথা খাটালেন। জবাব দিলেন, কৌতূহল যদি অস্বাভাবিক না হয়, অপরাধ স্বীকার করছি।

-খুব স্বাভাবিক। আমার মতো বৃদ্ধ কারো কৌতূহলের বিষয় নয়, ওঁর মতো মেয়েও কারো কৌতূহলের ব্যাপার নয়–দুই অসমের সাতপাকের অঘটনটুকুই কৌতূহলের স্বাভাবিক কারণ। এই কারণ না থাকলে আপনারা হয়তো আসতেনই না। স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, অতিথিদের বিমুখ না করে তুমিই বলে দাও কোন পক্ষ। এর মধ্যে লজ্জা পাবার বয়েস তো কারো নেই

সোমা গাঙ্গুলি প্রায় ধমকের সুরে বললেন, চালাকি করে কেবল কথা ঘোরাচ্ছ, তুমি আমাকে বলতে দিচ্ছ? বিভার দিকে ফিরলেন।–শুনুন, যা বলছিলাম, এই ছ মাস হল

-অবজেকশন মাই লর্ড অ্যান্ড লেডি-অবজেকশন। ইরেগুলার, ইর্যাশানাল অ্যান্ড ইমমেটিরিয়াল! মোহিনী সরকারের দিকে তাকিয়ে গলা খাটো করলেন খোকা গাঙ্গুলি। আপনাদের ভাষাটা ঠিক হল? তারপরেই আবার গলা চড়ালেন।-শুনুন, মেয়েরা–না। মানে আমার স্ত্রী অন্তত ঘোরা পথে চলেন, অর্থাৎ সোজা প্রশ্নের সোজা জবাব দিতে চান না, এ প্রমাণ তাহলে হয়েই গেল। ঠিক আছে, জবাব আমিই দিচ্ছি। পক্ষ বিচারে আপনাদের সব অনুমানই ভুল, এ সম্পর্কে একটা বিচারই খাটে–উনি চিরদিনই আমার বিপক্ষ।

হাসির মধ্যেই বিভা সরকার ঈষৎ বিস্ময়ে বলে উঠলেন, তার মানে উনি তাহলে প্রথম পক্ষ?

–একেবারে খাঁটি ধরেছেন ম্যাডাম। আদি এবং অকৃত্রিম। স্ত্রীর লাল মুখের দিকে চেয়ে এবারে গম্ভীর আবার।–তাহলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়–প্রজাপতির এমন অসম নির্বন্ধ ঘটে কি করে। অতিথি দুজনকে সচকিত করে স্ত্রীকে হঠাৎ রুক্ষ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন তিনি, কতদিন বলেছি বয়েসের সার্টিফিকেটটা গলায় ঝুলিয়ে নাও-লোকের কাছে আমাকে এমন অপ্রস্তুত করার মানে কি?

বকুনির শেষ শুনে সরকার-দম্পতি আরও মজাদার বিস্ময়ের আঁচ পেলেন। সোমার লালচে মুখে হাসি চুয়ে পড়ছে। বললেন, নিজে অসময়ে সাত বুড়োর এক বুড়ো সেজে বসে আছ লজ্জাও করে না।

অন্য দুজন মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন। খোকা গাঙ্গুলির মুখে স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্যের ফাঁকে টিপটিপ হাসি। বললেন, এবারে তাহলে উপসংহারে আসা যাক। যদিও মেয়েদের বয়েস নিয়ে আলোচনা এটিকেটের বাইরে, তবু এই জমাটি পরিবেশের খাতিরে আমরা অকপট হতে পারি। বিশেষ করে যা নিয়ে এত কাণ্ড–দুচোখ মোহিনী সরকারের দিকে।-এবার আপনি তাহলে আমার মিসেসের বয়েসটা অনুমান করুন।

মোহিনী সরকার বোকা নন আদৌ। অনুমানের বেশ ওপরেই উঠলেন–পঞ্চাশ একান্ন…

হাসিমুখে সোমা গাঙ্গুলি ঘোষণা করলেন, আটান্ন।

-কক্ষনো না। প্রতিবাদ বিভা সরকারের। তার থেকেও মহিলা এক বছরের বড় এ বিশ্বাস করেন কি করে?

সোমা গাঙ্গুলি তেমনি হেসেই বললেন, তা হলে কলকাতায় ফিরে একদিন বাড়িতে আসুন, এজ সার্টিফিকেট দেখাব।

মোহিনী সরকার বলে উঠলেন, তাহলে কংগ্রাচুলেশন–অনেক কংগ্রাচুলেশন সোমা দেবী। এভাবে বয়সের চোখে ধূলো দেওয়াটা আমি দস্তুরমতো ক্রেডিট মনে করি।

ঘরের লোককে দেখিয়ে এবারে টিপ্পনীর সুরে সোমা গাঙ্গুলি বললেন, তাহলে ওঁকেও একটু কংগ্র্যাচুলেট করুন, আমার থেকে উনিও বয়েসের চোখে কম ধুলো দেননি–উনি সবে তেষট্টি এ কেউ বিশ্বাস করবেন, আমার থেকে মাত্র পাঁচ বছরের বড়।

অর্থাৎ মোহিনী সরকারের সমবয়সী। অন্য দুজনকে এবারেও একটু হকচকিয়ে যেতে দেখা গেল। খোকা গাঙ্গুলি বললেন, বিশ্বাস করবেন না। আপনার বৃদ্ধের তরুণী ভার্যার রসটুকুই মাটি তাহলে।

-থামো। অন্যদের দিকে ফিরলেন সোমা গাঙ্গুলি।–এই জন্যেই আমাকে বার বার থামিয়ে দিচ্ছিলেন, বুঝলেন?… কমাস আগে ওঁর একটা অপারেশন হয়ে গেল, প্রোসট্রেট অপারেশন–সঙ্গে আরো সতের ব্যাপার–অপারেশনের পরেই তার ওপর। নিউমোনিয়া–যমে-মানুষে এমন টানাটানি আমি আর দেখিনি। তারপরেই মাথার চুলগুলো সব সাদা হয়ে গেল আর শরীরের এই হাল। দেখলে কেউ ভাবতেও পারবে না কি চেহারা কি হয়ে গেল।

খোকা গাঙ্গুলি গম্ভীর।–অর্থাৎ তখন ওঁর মতে আমি রূপবান পুরুষ ছিলাম।

মোহিনী সরকার আর বিভা সরকারের সত্যি ভারি ভালো লাগছিল। বিভা বললেন, আপনি যা-ই বলুন, অনেক ঠকেছি আমরা, আর আপনার কথার ফাঁদে পড়তে রাজি নই।

খোকা গাঙ্গুলি স্ত্রীকে বললেন, এবারে শুধু ওঁদেরই তাহলে আর এক পেয়ালা করে চা হোক।

মোহিনী সরকার তাড়াতাড়ি বাধা দিলেন, আর চা না, আমারও বেশি চায়ে একটু অসুবিধে আছে–গল্প করতে খুব ভালো লাগছে… আপনাদের সময় নিচ্ছি না তো?

দয়া করে সময় দিচ্ছেন, খোকা গাঙ্গুলির বিনীত জবাব, একটা বিকেল সন্ধ্যা ভালো কাটছে।

ভালো বিভারও খুব লাগছে। গলা একটু খাটো করে সোমাকে বললেন, অসুস্থ। মানুষকে একলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন, আপনার ছেলেপুলে…?

খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, সে কথা তুলে আর লজ্জা দেবেন না, একটা দুটো নয়, একেবারে পাঁচটি। প্রথমে দুই ছেলে পরে তিন মেয়ে। গেলবারে ছোট মেয়েটারও বিয়ে হয়ে যেতে এখন আমাদের নির্ঝঞ্ঝাট হনিমুন।

যিনি বলছেন, তারই শুধু সিরিয়াস মুখ। অন্য সকলের হাসির ফাঁকে বিভা সরকার। পাঁচ ছেলেমেয়ের মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর আর একবার চোখ না বুলিয়ে পারলেন না। সোমা গাঙ্গুলি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারাও তো দুজনেই এসেছেন দেখছি… আপনার?

-একটি ছেলে। ব্যারিস্টার। উনি প্র্যাকটিস কমিয়ে দিতে ওর ওপর চাপ বেশি–বেড়াবার সময়-টময় হয় না।

খোকা গাঙ্গুলি গম্ভীর মন্তব্য করলেন, ইন্দিরা গান্ধীর প্রাইজ দেওয়া উচিত আপনাদের–ছোট পরিবার সুখী পরিবার।

তেমনি নকল গাম্ভীর্যে মোহিনী সরকার বললেন, আপনাদের দেখে অসুখী যারা বলবে তাদের জরিমানা হওয়া উচিত। একটু কৌতূহল হচ্ছে, আপনার পেশাটি জানতে পারি?

খোকা গাঙ্গুলি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ব্যবসা।

-ব্যবসা বলতে?

–মিথ্যেকথার ব্যবসা। যত মিথ্যে বলি লোকে ততো খুশি আর ব্যবসাও ততো জমজমাট।

মোহিনী সরকার বিভা সরকার দুজনেই চেয়ে আছেন। সোমা অল্প অল্প হাসছেন। খোকা গাঙ্গুলি বললেন, বুঝলেন না তো? তাহলে শুনুন

নিজের ইজি-চেয়ারেই জমিয়ে বসলেন একটু। তেমনি গম্ভীর। পুরনো দিনের কথা মনে করার মতো করে বলে গেলেন, সে অনেক কাল আগের কথা, বিলেত থেকে এক জাহাজ মিথ্যেকথা চালান এসেছিল আউট্রাম ঘাটে। আমার তখন বেকার দশা। শুনে পড়িমরি করে ছুটলাম। কিন্তু গিয়ে দেখি সর্বনাশ কাণ্ড। আগেভাগে টের পেয়ে বাঘা-বাঘা ব্যবসায়ীরা এসে সব কিনে নিয়ে গেছে। আমার মনে দুঃখ শুধু হল না, ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখতে লাগলাম। রাগে শোকে ওই গঙ্গাতেই প্রাণ বিসর্জন দেব ঠিক করে ফেললাম। বেগতিক দেখে মা গঙ্গা উঠলেন। বললেন, বাছা আত্মঘাতী হয়ে কাজ নেই, এখন থেকে মিথ্যাই তোর স্বচ্ছন্দ জীবিকার অবলম্বন হবে। ব্যস, আর কি, তারপর থেকে ওই মিথ্যের নৌকোতেই ভেসে চলেছি।

বিভা সরকার হাসতেও পারছেন না, হাসি চাপতেও পারছেন না। সোমা গাঙ্গুলি সকৌতুকে স্বামীর গম্ভীর মুখের দিকেই চেয়ে আছেন। মোহিনী সরকার ধরে নিলেন, ব্রোকারি অর্থাৎ দালালি-টালালি হবে ভদ্রলোকের জীবিকা। মিথ্যের ফুলঝুরি ওই লাইনেই বেশি ছোটাতে হয়। তাই আর জেরার মধ্যে না গিয়ে তারিপ করলেন, আপনি তো ভাগ্যবান, অসং রাস্তা ধরেন নি-আমরা সত্যকে মিথ্যে করছি আর মিথ্যেকে সত্য বানাচ্ছি। যাক, এখানে আছেন কতদিন?

-জানি না। উনি যদি মনে করেন আমার শরীর ভালো যাচ্ছে তাহলে চট করে নড়া-চড়ার কোনো প্রশ্ন নেই। আপনারা?

-আপনার মতো অতটা না হলেও আমারও উনিশ বিশ একই ব্যাপার। দুবছর আগে একটু মাইলড স্ট্রোক হয়েছিল, সেই থেকে ওঁর বিবেচনায় খুব সুস্থ থাকছি না।

খোকা গাঙ্গুলি বলে উঠলেন, বাঃ এদিক থেকে আমরা তাহলে সতীর্থ।

বিভা সরকার এবারে উঠে দাঁড়ালেন, এখন চলো, অনেক জ্বালিয়েছি, আর না। খোকা গাঙ্গুলির দিকে ফিরলেন, আপনারা আমাদের বাড়িতে কবে যাচ্ছেন বলুন, অনেকক্ষণ সময় নিয়ে যেতে হবে–আর আপনি কি খেতে ভালবাসেন বলুন।

খোকা গাঙ্গুলি নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। দেখলে, কেবল তুমিই বলো কথার চোটে কান ঝালাপালা–কথার জাদু দেখলে? বিভার দিকে ফিরলেন, খাওয়ার ব্যাপারে আমি ভেজ নভেজ দুইয়েরই উপাসক-মোচার কাটলেট আর চিকেন কাটলেট দুইই সমান রেলিশ করে খাই। আপনি যেভাবে বলছেন, কাল যেতে পারি, পরশু যেতে পারি, তরশু যেতে পারি–আবার কাল পরশু-তরশু রোজই যেতে পারি।

বিভা সরকার হাসি মুখে মাথা নাড়লেন, বেশ তো যাবেন–এমন কান ঝালাপালার আশায় আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করব।

পরদিন না হোক, তার পরদিন সত্যিই এসেছেন তারা। সরকার-দম্পতি খুশির অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। আর ভদ্রলোকের গল্প জমাবার প্রতিভা দেখে এদিনও মুগ্ধ হয়েছেন। আর খোকা গাঙ্গুলি মুগ্ধ হয়েছেন এমন অল্প সময়ের মধ্যে খাওয়ার ব্যবস্থা। দেখে। সত্যি গরম চিকেন কাটলেট এসেছে, চমৎকার স্যালাড এসেছে, ফ্রায়েড পোটাটো এসেছে, শেষে পুডিংও। খোকা গাঙ্গুলি হাঁ করে খানিক দেখলেন। তারপর না হেসে সোল্লাসে বলে উঠলেন, আপনি একি জাদু জানেন–ঘাটশিলায় এই সব!

বিভা বললেন, আমার বাহাদুরি নেই, উনি বাইরে বেরুলে আমি সঙ্গে না থাকলেও চলে–পুরনো খানসামাটা না হলে চলে না–তাকে সঙ্গে আনাই চাই।

-খানসামা! আহা! সোমার দিকে ফিরলেন, দেখো, এবার থেকে ওঁদের আর কষ্ট করে আমাদের ওখানে যাওয়ার দরকার নেই, আমরাই যখন পারি এসে যাবখন।

বিভা খুশিমুখে রাজি।–আসবেন, ও জন্যে ঘাবড়াই না। স্বামীকে দেখিয়ে শোনালেন, উনি সেদিন বলছিলেন, ভদ্রলোকের কথা শুনলে আর তার সঙ্গে কথা বললে মনে হয় খানিকটা আয়ু বাড়ল। তবে এর পরে আপনার খাওয়ার ব্যাপারে আপনার মিসেসের মতামত নেব কিন্তু।

–নিশ্চয় নেবেন। সঙ্গে সঙ্গে গম্ভীর সায়।তবে দয়া করে আমার খাওয়ার আগে নয়, পরে।

খাওয়ার শেষে বড় করে একটা তৃপ্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন।–আঃ, আমারও পরমায়ু কিছু বাড়ল!… তবে আমাদের তফাৎ খুব নেই বুঝলেন, আমি খাই-খাই করে খাই আর উনি (স্ত্রীকে দেখিয়ে) ভালো জিনিস হলে খাই-না খাই-না ভাব দেখিয়ে খান।

সোমা গাঙ্গুলির পুডিং খাওয়ায় ছেদ পড়ল। হেসে ফেললেন।

বিভা তাড়াতাড়ি বললেন, আপনি খান তো। ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন, আপনি সব থেকে বেশি মজা পান দেখছি ওঁর পিছনে লেগে।

খোকা গাঙ্গুলির নিরীহ মুখ।-অন্যের পিছনে লেগে অত নিরাপদ বোধ করি না।

মোহিনী সরকার হা-হা শব্দে হেসে উঠলেন।–আপনাকে কথাশিল্পী বলি, না কথাসাগর বলি।

এই সামান্য কথায় সোমা গাঙ্গুলির বেশ একটু আনন্দ দেখা গেল। মন্তব্য করলেন, তাই বললে যদি একটু জব্দ হন।

আর এই সামান্যতেও খোকা গাঙ্গুলি দমে গেলেন।–অমন কাণ্ডটি করবেন না, শুনলে সাহিত্যিকের দল আপনাকে ঘেরাও করবে। যাক, ঘাটশিলায় বেড়ালেন কেমন?

বিভা জবাব দিলেন, এখানে ওই সরু পাথুরে সুবর্ণরেখা আর ওই ঢিবি ছাড়া বেড়াবার কি আছে–দেখারই বা কি আছে!

খোকা গাঙ্গুলি বললেন, সুবর্ণরেখার বিক্রম দেখতে হলে বর্ষায় আসবেন। মৌভাণ্ডারের কপার কর্পোরেশন তো মাত্র দেড় মাইলের মধ্যে–দেখে আসতে পারেন। …কপার মাইন অবশ্য মাইল ছয়েক হবে এখান থেকে, মোসাবাণী থেকে রাখা মাইনস পর্যন্ত চলে গেছে। সাইকেল রিকশ নিয়ে তা-ও ঘুরে আসতে পারেন। একটু থেমে আবার বললেন, এই ঘাটশিলাকে হেলাফেলা করবেন না-একদিন এই ঘাটশিলা ছিল। ধলভূমের রাজধানী। ধলভূম রামের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রংকিণীর মন্দিরও দেখে আসতে পারেন–এই আশ্বিনেই সেখানে সাঁওতালদের বিন্দ মেলা হয়, টানা পনের দিন চলে –ওদের সব থেকে বড় উৎসব এখানকার।

সরকার-দম্পতি মন দিয়ে শুনছিলেন। বিভা সরকার বললেন, কিছুই তো দেখি নি এখনো… আপনি বুঝি অনেকবার এখানে এসেছেন?

খোকা গাঙ্গুলি তক্ষুণি মাথা নাড়লেন।-আমারও এখানে এই প্রথম, আর এখন পর্যন্ত সুবর্ণরেখা ছাড়া আর কিছুই দেখি নি।

তারা অবাক।–সে কি?

সোমা মুখ টিপে হেসে জবাব দিলেন, এটা মিথ্যে নয়, যেখানে যখন যান, আগে লাইব্রেরি থেকে বই আনিয়ে সে জায়গা সম্পর্কে খুঁটিয়ে পড়ে নেন।

অন্য দুজনের কৌতূহল স্বাভাবিক। মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, কেন, পরে দেখতে সুবিধে হয় বলে?

সোমা গাঙ্গুলি তেমনি জবাব দিলেন, মিথ্যের ব্যবসারও কিছু সুবিধে হয় বোধহয়।

ওঁরা না বুঝেও হাসলেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে, এবার ওঠার তাড়া। অবশ্য রিকশতেই যাবেন, অল্প রাস্তা হলেও হিম লাগার ভয়ে সোমা তার ভদ্রলোককে হাঁটতে দেবেন না।

সকলে একসঙ্গে নেমে আসতেই খাৈকা গাঙ্গুলির দুচোখ তামার খনির দিকে গেল। ওদিকটা গনগনে লাল। সেই লালের আভা আকাশ পর্যন্ত ছড়িয়েছে। রাত হতে না হতে রোজই সকলের চোখে পড়ে তামার খনির অগ্নিকুণ্ডের আগুন। সেদিকে চোখ রেখে খোকা গাঙ্গুলি নিস্পৃহ মন্তব্য করলেন, ওই তপতপে লাল দেখতে বেশ লাগে আমার, ঘরে যিনি আছেন তাঁর সঙ্গে ওটার প্রায়ই খুব মিল দেখি।

মোহিনী সরকার জোরেই বলে উঠলেন, অবজেকশন-অবজেকশন! একজন। মহিলার ওপর আপনি মিথ্যে অপবাদ চাপাচ্ছেন।

সোমা চাপা গলায় ঠেস দিলেন, মিথ্যের ব্যবসা পেশা নিজেই তো স্বীকার করেছেন–অবজেকশন দিয়ে কি লাভ।

পরের তিনদিন রোজই হাটে বা বাজারে আর সুবর্ণরেখার ধারে দেখা হয়েছে। এই অন্য জুটিকে পেয়ে সরকার-দম্পতির দিন বেশ হাসিখুশির মধ্যে কাটছে। সেদিন বাজারে এসে তারা অন্য জুটিকে দেখলেন না। অবশ্য বাজারে ওঁরা রোজ আসেন না, মাঝে মাঝে বৃন্দাবন আসে। তাকেই দেখলেন। তক্ষুণি দুজনের মধ্যে প্ল্যান হল। একটু ঘটা করেই বাজার সারলেন তারা। বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ দুজনে বেড়াবার জন্য তৈরি হয়ে বাংলো থেকে বেরুলেন। সোজা রেল লাইনের দিকে অর্থাৎ গাঙ্গুলি বাড়ির দিকে চললেন। উদ্দেশ্য রাতে বাড়িতে ওঁদের ডিনারের নেমন্তন্ন করবেন। সকলে একসঙ্গে বেড়ানো সেরে ওঁদের সঙ্গে করে বাংলোয় ফিরবেন।

পৌঁছুলেন। সামনের ঘরের ভেজানো দরজা দুটো চার-ছ আঙুল ফাঁক। মোহিনী সরকার দরজা ঠেলতেই মেঝেতে তিনটে খাম চোখে পড়ল। ডাক-পিওন দরজার ফাঁক দিয়ে ফেলে দিয়ে গেছে। খাম তিনটে তিনি ম্যাট থেকে কুড়িয়ে নিয়ে সোজা হবার ফাঁকে একটা খামের ওপরে চোখ পড়তেই থমকালেন একটু। তারপরেই বিমূঢ় কেমন। ভুরু কুঁচকে পরের খামটার নাম ঠিকানা দেখলেন। তার পরেরটারও। তারপর আকাশ থেকে পড়া মুখ করে স্ত্রীর দিকে তাকালেন।

স্বামীর এই আচরণ দেখে বিভা সরকারও কম অবাক নন। তিনি কিছু বলতে যেতেই একটা আঙুল ঠোঁটে ঠেকিয়ে মোহিনী সরকার তাঁকে কথা বলতে নিষেধ করলেন। তার পরে তিনটে খামেরই ওপরের নাম দেখালেন। ঠিকানার ওপরে প্রত্যেকটাতে নাম লেখা, মহাদেব গাঙ্গুলি।

বিভা সরকারও প্রথমে বিমূঢ় কয়েক মুহূর্ত। তারপরেই বেশ বড় সড় ঝাঁকুনি খেলেন একটা। ওই খামের নামের ওপর দু চোখ ঠিকরে পড়ার দাখিল–দেখেও বিশ্বাস করতে পারছেন না। নিজের অগোচরে গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দই বেরিয়ে এলো। সেটা আনন্দের থেকে ঢের বেশি বিস্ময়ের।

ভিতর থেকে খোকা গাঙ্গুলির গলা শোনা গেল, দেখ তো ওঁরা এলেন বোধ

সোমা গাঙ্গুলি এলেন। হেসে আপ্যায়ন জানাতে গিয়েও থমকালেন। বিশেষ করে বিভা সরকারের মুখ আর চাউনি কি রকম লাগল, বললেন, কি ব্যাপার, ওঁকে কি ছুটিয়ে নিয়ে এলেন নাকি?

মোহিনী সরকারের হাত দুটো পিছনে। জবাব দিলেন, না, এখানে এসে ছুটছেন। আপনার ভদ্রলোককে ডাকুন।

ডাকতে হল না। নিজেই এলেন। সেই চিরাচরিত গম্ভীর মুখ।–এই যে আসুন, আজ একটু সকাল সকাল মনে হচ্ছে…।

সে কথার জবাব না দিয়ে মোহিনী সরকার একটা খাম তার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। –এই মেঝেতে পড়েছিল, দেখুন তো পিওনটা ভুল করে দিয়ে গেল নাকি!

খামটা হাতে নিয়ে চোখ বোলাবার সঙ্গে সঙ্গে মোহিনী সরকার এই প্রথম ভদ্রলোকের মুখে চকিত বিড়ম্বনার ছায়া দেখলেন একটু। অস্ফুট কথাও শুনলেন, তাই তো দেখছি…

-এটা? দ্বিতীয় খাম সামনে ধরলেন মোহিনী সরকার।

–এ-ও তো….

–আর এটা? কিছু বলার আগেই তৃতীয় খাম।

তৃতীয় খামটাও হাতে নেবার পর ভদ্রলোকের মুখে বিড়ম্বনার হাসি একটু। এ যে দেখি মহাদেব গাঙ্গুলির ট্রায়ো একেবারে।

সোমা গাঙ্গুলি দ্বিতীয় খাম দেখার পরেই ব্যাপার বুঝেছেন। হাসি চাপার চেষ্টায় মুখে আঁচল চাপা দিয়েছেন।

মোহিনী সরকার তার স্ত্রীর দিকে ফিরলেন। গম্ভীর আদেশের সুরে বললেন, চলো–

সোমা ব্যস্ত।-ও কি, বসুন!

-বসব! ওঁর নামে আমি ক্রিমিন্যাল কেস আনব–নাম ভাড়ানোর মজাখানা উনি টের পাবেন।

সোমা হেসে বললেন, বেশ আনবেন। এখন তো বসুন।

বিভা সরকারের মুখে রাগ-বিরাগের কোনো চিহ্নই নেই। দেখলে মনে হবে হঠাৎ যেন তিনি এক নতুন জগতে ঢুকে পড়েছেন। সেই উত্তেজনায় দাঁড়াতেও পারছেন না। একটা চেয়ারে বসে পড়লেন। দ্বিতীয় চেয়ারের দিকে এগোতে এগোতে মোহিনী সরকার বললেন, হ্যাঁ মশাই এতগুলো দিন দিব্যি নিজেকে খোকা গাঙ্গুলি বলে চালিয়ে দিলেন?

মহাদেববাবুর শুধু ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি। জবাব দিলেন, মা গঙ্গার সেই আশীর্বাদে আমার অদৃষ্টখানা দেখুন–সত্যি বললেও সেটা মিথ্যে হয়ে যায়। ওই নামটাও মিথ্যে নয়, বাপ-মায়ের আদরের নাম।

-আমরা তো আপনার বাপ-মা নই, আমাদের কাছে ওই আদরের নাম চালানোর অর্থ কি?

ইজি-চেয়ারে শরীরটাকে আরো একটু শিথিল করে জবাব দিলেন, প্রাণের দায়ে মশাই, প্রাণের দায়ে। এখানে একটা কলেজ আছে জানি, আর এসে জানলাম বড় একটা পাবলিক লাইব্রেরি আছে–আর অন্যদিকে দেয়ালেরও কান আছে। তাই এখানে এসেই আমি খোকা গাঙ্গুলি।

মোহিনী সরকার জিজ্ঞেস করলেন, কলেজ আর লাইব্রেরি আছে তাতে কি?

–এরা থাকা মানেই সাহিত্যিক শিকারের ফাঁদ পাতা–সাহিত্য সভা-সাহিত্য মিটিং-হরি।

-আর এখন যদি আমরাই খবর দিয়ে দিই?

–প্রাণে মারা যাব। ওঁর (স্ত্রীকে দেখিয়ে) সেই মূর্তি আপনারা দেখতে পারবেন?

সোমা গাঙ্গুলি হাসতে হাসতে বললেন, বসুন, চা আনি।

মোহিনী সরকার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন দাঁড়ান!

নিজেই গটগট করে ভিতরের ঘরে ঢুকে মোড়াটা এনে পেতে দিলেন।-বসুন! এখানে চা নয়। যে ভাওতাবাজি ইনি আমাদের সঙ্গে করেছেন, আপনিও চুপ করে থেকে ওঁর অ্যাকসেসুরি হয়েছেন, তার জের আপনাদের সামলাতে হবে। আমার রায় আমি পরে দিচ্ছি। তাছাড়া আমার আবার না ডাক্তারের কাছে ছুটতে হয়, ইনি কে জানার পর আমার স্ত্রীর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। যাক, আগে আপনি বসুন

নিজের চেয়ার টেনে নিয়ে আবার মহাদেব গাঙ্গুলির মুখোমুখি।–আপনার মিথ্যের ব্যবসাটা তাহলে এই?

মহাদেববাবু অম্লানবদনে সায় দিলেন। এই।

বিভা সরকারের এতক্ষণে জিভ নড়ল।–আপনি এত বড় স্রষ্টা বলেই নিজের সৃষ্টিকেও অনায়াসে মিথ্যে বলতে পারছেন।

মোহিনী সরকার মন্তব্য করলেন, বাঁচা গেল, ডাক্তারের কাছে যেতে হবে না। সোমাকে বললেন, ওঁর এখনকার কথার মধ্যে কেবল সুপারলেটিভ ডিগ্রিটা লক্ষ্য করে যাবেন!

সোমা হেসেই বললেন, আপনিও তো ওঁর পিছনে কম লাগেন না দেখি। উনি বুঝি গল্প-উপন্যাস পড়তে খুব ভালবাসেন?

-মুখ দেখে বুঝে নিন। তবে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মাত্র দুই একজনকে মারাত্মক ভালবাসেন। এখন আমিই ওঁকে নিয়ে কলকাতায় সরে পড়ব কিনা ভাবছি।

মহাদেব গাঙ্গুলি গুরুগম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, কি ভাগ্য–কি ভাগ্য!

মহিলারা দুজন কেবল হাসছেন। মোহিনী সরকার ভদ্রলোকের দিকে ফিরলেন।–এই বছর তিনেক আগে আপনাকে একবার কলকাতার রোটারি ক্লাবে আনা হয়েছিল?

একটু ভেবে মহাদেববাবু জবাব দিলেন, হয়েছিল।

–আপনি সেদিন অ্যাংরি জেনারেশন আর জেনারেশন-গ্যাপ সম্পর্কে বলেছিলেন?

আবারও ভেবে জবাব দিলেন, হবে…।

হবে না। আমি রোটারিয়ান, সেদিন উপস্থিতও ছিলাম। চেনা-চেনা মনে হতেও চিনতে পারি নি, কারণ উনি (সোমা) ঠিক কথাই বলেছিলেন–আপনার ওই অসুখ। আপনার কতটা খেয়ে দিয়েছে এখন বুঝতে পারছি। যাক, রোটারি থেকে ফিরে আমার স্ত্রীকে আপনার কথা বলতে উনি টানা তিন দিন অভিযোগ করেছিলেন, কেন কিছু একটা ব্যবস্থা করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল না।

মহাদেব গাঙ্গুলি আবার বলে উঠলেন, ভাগ্য–ভাগ্য।

এবারে জোরালো অনুযোগের সুরে বিভা সরকার বললেন, কিন্তু আমাদের তো আপনি দুর্ভাগ্যের দিকেই ঠেলে দিয়েছিলেন। আপনার লেখা পড়ে মনে হয় মানুষের জন্য আপনার কত মমতা, কিন্তু নিজে কত নির্মম হতে পারেন তার প্রমাণ পেলাম। আজ এই খাম কটা ওঁর হাতে না পড়লে আমরা জানতেও পারতাম না কার সঙ্গে এত দিন ঘুরলাম বেড়ালাম কথা কইলাম। এ কথা মনে হতে এখন আপনার ওপর আমার রাগই হচ্ছে।

জবাবে মহাদেববাবু আবার একটা ভারী নিঃশ্বাস ছেড়ে শুধু বললেন, বেচারা খোকা গাঙ্গুলি।

গম্ভীর মুখের যে কৌতুক এতদিন এমনি ভালো লাগছিল এখন সেটা দ্বিগুণ ভালো লাগছে দুজনেরই। মোহিনী সরকার এবার হুকুমের সুরে সোমাকে বললেন, দশ মিনিট সময় দিলাম, এর মধ্যে রেডি হয়ে আসুন।

সোমা বললেন, দাঁড়ান, আগে চা হোক, ওঁরও এখন পর্যন্ত জোটেনি।

–নো টি! মোহিনী সরকারের বিচারের মুখ।-এখন আপনারা দুজনেই আমাদের আসামী–আমাদের খুশিমতো আমরা, আসামী ধরে নিয়ে যাব। চটপট রেডি হোন।

সোমাই জিজ্ঞেস করলেন, কোথায়?

-আগে ঠিক ছিল এখানে এসে আপনাদের নিয়ে বেড়াতে বেরুব। বেড়িয়ে আপনাদের আমার বাড়ি নিয়ে যাব, কারণ সেখানে আপনাদের রাতের ডিনার রেডি থাকবে

মহাদেব গাঙ্গুলি তার বলার মাঝে গুরুগম্ভীর আর্তনাদ করে উঠলেন, যাঃ কলা, এখন সেটা বাতিল নাকি?

বিভা সরকার হেসে উঠলেন। মোহিনী সরকার বললেন, না, আজ বেড়ানো বাতিল–এক্ষুণি আমাদের বাড়িতে আপনাদের হাজতবাস, রাতেও ফিরতে পারছেন কিনা সন্দেহ। স্ত্রীর দিকে ফিরে গলা খাটো করলেন, কেমন, জাঁদরেল লেখকের সঙ্গে কথাবার্তা সমান তালে হচ্ছে তো?

জবাব মহাদেববাবুই দিলেন, বললেন, বেশ হচ্ছে। কিন্তু নিয়ে গিয়ে তারপর উত্তরপ্রদেশ থেকে মধ্যপ্রদেশ পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থাটা কেমন হবে?

প্রশ্নটা হঠাৎ না বুঝে মোহিনী সরকার থতমত খেলেন একটু। তারপর জোরে হেসে উঠলেন।–মুখ থেকে পেট পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা?… তা ভালোই হবে। ইংরেজি, বাংলা দুরকমেরই শাস্তির আয়োজন। মোচার কাটলেট পাবেন আবার চিকেন কাটলেটও পাবেন, ফ্রায়েড পোটাটো পাবেন ফ্রায়েড ফিশও পাবেন, ভাত পাবেন ফ্রায়েড রাইসও পাবেন, মাছের কালিয়া পাবেন চিকেন কারিও পাবেন, কাস্টার্ড পাবেন আবার রসগোল্লাও পাবেন

-ব্যস ব্যস ব্যস, আমি রসের অতলে মানে রসাতলে চলে যাচ্ছি! স্ত্রীর দিকে ফিরে তাড়া দিলেন, কই, ওঠো না শীগগির। এত শাস্তি কি একবারে সহ্য করতে পারব–এখন থেকেই শুরু হোক। শীগগির যাও, আর দেরি কোরো না।

.

বাংলোয় পা দিয়ে এইদিন মোহিনী সরকার সোজা তাদের শোবার ঘরে নিয়ে এলেন। সামনে বইয়ের তাকে তিনটে মোটা বই, আর তিনটে বিপুল আকারের পূজাসংখ্যা। তিনটে বইয়েরই লেখক মহাদেব গাঙ্গুলি। একটা শ্রেষ্ঠ গল্পের সংকলন, একটা লেখকের নির্বাচিত গল্পগুচ্ছ আর একটা হালের ছাপা পরিপুষ্ট আকারের উপন্যাস। এবারের ওই পূজাসংখ্যা তিনটেতেও মহাদেব গাঙ্গুলির তিনখানা উপন্যাস আছে। মোহিনী সরকার বললেন, তাহলে বুঝুন আমার গৃহিণীর হৃদয়ে আপনার জায়গাটি কোথায়।

বিভা সরকার প্রতিবাদ করলেন, কেন, তুমি পড়ো না?

মোহিনী সরকার জবাব দিলেন, পড়তে হয়। কারণ আলোচনা যখন হয় তখন আমি তোমাকে বিপাকে ফেলার মতো তবলচির কাজ করি। যেমন ধরো ওই পূজাসংখ্যাটায় ওঁর এবারের উপন্যাস দ্বিতীয় বাসর পড়ে আলোচনায় আমি তোমাকে যে-রকম কোণঠাসা করেছিলাম, যার ফলে তুমি একেবারে দাম্পত্য কলহের পর্যায়ে চলে গেছলে।

বিভা সরকার তক্ষুনি তাকে সামলাবার জন্য ব্যস্ত।থাক থাক, আমি ঠিক জানি তুমি সব ছেড়ে ওঁর এই লেখাটা নিয়েই পড়বে। লেখকের দিকে ফিরলেন, ওকালতি করে করে লোকের কেবল ছিদি বার করতেই শিখেছে-বুঝলেন?

-বুঝলাম। মহাদেববাবু গম্ভীর মুখে সায় দিলেন। কিন্তু আমাদের তো বিকেল থেকেই শাস্তি শুরু হবার কথা ছিল!

সাহিত্য-বিতর্ক আপাতত চাপা পড়ে গেল। চা আর পরিপাটি জলখাবার সহযোগে গল্পে-গল্পে শীতের ছোট বেলা পার। সন্ধ্যার একটু পরেই মোহিনী সরকার মহাদেববাবুর কানে কানে কি বলতে তিনি মুখখানা এমন করলেন যেন দুনিয়ার সব থেকে বড় সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। বলে উঠলেন, নিশ্চয় নিশ্চয়, আপনার নিখুঁত আতিথেয়তা নিয়েই আমাকে কিছু লিখতে হবে–বিকেলে মধ্যপ্রদেশে যা চালান গেছে একটু ওষুধ না পড়লে রাতে ওর ওপর আবার চাপাব কি করে! আপনার বিবেচনার জয় হোক!

অন্য দুই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে বুঝলেন ব্যাপারখানা। বিভা সরকার ঈষৎ বিব্রত মুখে সোমা গাঙ্গুলির দিকে তাকালেন একবার, তারপর সকোপে স্বামীর দিকে ফিরলেন। –আজ খুব সুবিধে পেয়ে গেছ, না?

মোহিনী সরকার বললেন, অতিথির দরকার কিনা খোঁজ নিলাম।… তুমি সঙ্গ দাও তো আমি ছোঁবও না। লেখকের দিকে ফিরলেন, গৃহিণী ডাক্তার হলে যে কি বিপদ মশাই আপনিও তো নিশ্চয় জানেন। ডাক্তার পরোয়ানা দিয়েছে, একটু-আধটু চলতে পারে, তাতে হার্টের ক্ষতি হবার কোনো আশংকা নেই। কিন্তু ওঁর বিশ্বাস সাংঘাতিক ক্ষতি হবার আশংকা, আমি ঘুষ দিয়ে ডাক্তারকে বশ করেছি। সঙ্গে আছে। অথচ নির্জলা রাত কাটছে। যাক, অতিথির দরকার যখন কি আর করা যাবে?

বিভা সরকার মাথা নেড়ে সোমাকে দেখালেন, ওঁর পারমিশন না হলে দেব না।

সোমা গাঙ্গুলি হেসে ফিরে বললেন, আপনার কি ধারণা, উনি আমার কথায় ওঠেন-বসেন?

বিভা হালকা জবাব দিলেন, আপনাদের সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাই কিন্তু ভাবতাম। এখন দেব কিনা বলুন

-কটা দেবেন আগে কড়ার করে নিন।

বিভা সরকার হাসিমুখে মহাদেববাবুর দিকে তাকালেন। জবাবে তার সীরিয়াস মুখ।-খেলে উনি আমাকে দুটোর বেশি খেতে দেন না, আজ মনে হচ্ছে, তিনটেতে আপত্তি করবেন না।

বিভা সরকার বলে উঠলেন, ওঁর কিন্তু দুটোর বেশি কখখনো চলবে না। দুটোতেই দেখবেন কেমন স্পষ্ট বক্তা হয়ে উঠেছেন।

মহাদেববাবু সায় দিলেন, দুটোর বেশি চলার দরকার নেই তাহলে। প্রথমে ওঁকে একটা পুরো দেবেন, পরের দুটো হাফ হাফ।

বিভা সরকার উঠে হুইস্কির বোতল গেলাস আর জল এনে সামনে রাখলেন। বিলিতি জিনিস দেখে কর্তার দিকে চেয়ে মহাদেব্বাবু মন্তব্য করলেন, উকিল না হয়ে আপনার ওমর খৈয়াম হওয়া উচিত ছিল–ঘাটশিলায় বিলিতি জিনিস! স্ত্রীর দিকে ফিরলেন, ও-গো, তুমি কি তিনটাকে চার করতে পারমিশান দেবে?

সোমা গাঙ্গুলি বললেন, আমার তিনেই আপত্তি।

–থাক থাক, তাহলে আর চা-রে কাজ নেই।

প্রথম দফা শুরু হতে নিজের গেলাসে বারকয়েক ছোট ছোট চুমুক দিয়ে মহাদেববাবু একটা আরামের নিঃশ্বাস ফেলে স্ত্রীর কথাই সমর্থন করলেন যেন। সীরিয়াস মুখ করে বললেন, বেশি না খাওয়াই ভালো।… একবার এক ভদ্রলোক বার থেকে বেরিয়ে নিজের গাড়িতে উঠে হাঁ। ড্রাইভ করবেন কি, তার স্টিয়ারিং, ব্রেক, অ্যাকসেলারেটর, ক্লাচ, ড্যাশবোর্ড–সব কিছু চুরি হয়ে গেছে। তক্ষুণি নেমে ছুটে গিয়ে তিনি ওই বার থেকেই পুলিশে ফোন করলেন। এমন তাজ্জব চুরির কথা শুনে পুলিশও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ছুটে এলো। এসে দেখে স্টিয়ারিং-এ হাত দিয়ে ভদ্রলোক বিমর্ষ মুখে বসে আছে। তারা উঁকি দিয়ে দেখল, কিছুই চুরি যায় নি। সবই ঠিক আছে। তখন তারা রেগে আগুন। ভদ্রলোক তখন বললেন, আমার সত্যি একটু ভুল হয়ে গেছে, তখন আমি ভুল করে পিছনের সীটে উঠে বসেছিলাম…।

সকলকে ছাড়িয়ে মোহিনী সরকার হা-হা শব্দে হেসে উঠলেন। বললেন, আপনি তাহলে সর্বদা অত সীরিয়াস গল্প লেখেন কেন মশাই–হাসির গল্প লিখলে তো এর থেকে ঢের বেশি ভালো করতেন।

শুনেই মহাদেববাবু দস্তুরমতো গম্ভীর। একচুমুকে গ্লাসের বাকিটুকু শেষ করলেন। বিভা সরকারের দিকে তাকাতে তিনি উঠে দ্বিতীয় দফা তার গেলাস সাজিয়ে দিলেন। দেখাদেখি মোহিনী সরকারও চটপট তার গেলাস শেষ করে ওটা সামনে এগিয়ে দিলেন। বিভা সরকার তাকে মেপে অর্ধেকই দিলেন।

নিজের গেলাসটা তুলে নিয়ে মহাদেব গাঙ্গুলি আগের কথার জের টেনে মোহিনী সরকারকে জিজ্ঞেস করলেন, সীরিয়াস গল্প বলতে একটা নমুনা দিন।… দ্বিতীয় বাসর?

দ্বিতীয় গেলাস হাতে নেবার পর মোহিনী সরকারেরও ভিতর চাঙ্গা একটু। জবাব দিলেন, তা তো বটেই, ওটা আপনার সীরিয়াস উপন্যাসের সব থেকে অসার নমুনা–

বিভা সরকার বলে উঠলেন, তখনই বলেছিলাম এসব খেলে–

একটা হাত তুলে মহাদেব গাঙ্গুলি তাকে থামিয়ে দিলেন। গেলাসে একবার চমক দিয়ে ওটা সামনে রাখলেন। পলকা গম্ভীর চাউনি মোহিনী সরকারের মুখের ওপর। –দ্বিতীয় বাসর আপনি মন দিয়ে পড়েছেন?

পড়েছি।

–দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি পড়েছেন?

-তা-ও পড়েছি।

-কোনটা আগে পড়েছেন?

মোহিনী সরকার একটু আমতা-আমতা করার ফাঁকে বিভা সরকার জানান দিলেন, দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি পড়েই তো আমাকে জব্দ করার জন্য তাড়াতাড়ি ওই পূজাসংখ্যাটা নিয়ে বসেছিলেন।

দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি একজন রূঢ় অথচ নামী সমালোচকের সমালোচনার হেড-লাইন। একে একে তিনি এবারের নামী লেখকদের লেখা নিয়ে একটা নামকরা কাগজে আলোচনা করেছেন। প্রথমেই মহাদেব গাঙ্গুলির দ্বিতীয় বাসর নিয়ে পড়েছেন। আর বাস্তবশূন্যতার তীক্ষ্ণ মন্তব্য করে হেড-লাইন দিয়েছেন, দ্বিতীয় বাসর গাঁজাখুরি!

নিজের গেলাসে আর একটা চুমুক দিয়ে মহাদেব গাঙ্গুলি বললেন, বেশ।.. পূজাসংখ্যায় কিছুটা তাড়াহুড়োর মধ্যে লিখতে হয়, কি লিখেছি না লিখেছি মনেও থাকে না। নিজেকে ডিফেন্ড করতে হলে গল্পটা আগে ভালো করে মনে পড়া দরকার। দ্বিতীয় বাসরে কি আছে আপনি ছোটর ওপরে বলতে পারবেন?

চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মতো করে মোহিনী সরকার জবাব দিলেন, নিশ্চয় পারব।

–বলুন তাহলে। আমার বক্তব্য পরে।

পরিবেশ জমে উঠেছে। মোহিনী সরকার মাঝে মাঝে গেলাসে চুমুক দিয়ে যা বললেন, সংক্ষেপে দ্বিতীয় বাসর-এর কাহিনী মোটামুটি তাই। এবং সেটা এইরকম।

–দুটি গ্রামের ছেলেমেয়েকে নিয়ে গল্প। ছেলেটি জগৎ মিত্র। কাছাকাছির শহরের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে তিন বছর যাবৎ কলকাতার এক বে-সরকারী অফিসে চাকরি করছে। বয়েস চব্বিশ। চাকরি করলেও গান তার ধ্যানজ্ঞান। কলেজে পড়তে ছাত্রমহলে তার গানের সুনাম হয়েছিল। কলকাতার ছোট, মাঝারি, বড় আধুনিক গানের আসরেও ইদানীং তার ডাক পড়ছে। রেডিওয় চান্স পাচ্ছে। তার গাওয়া এক ছবির দুটো গান রীতিমতো হীট করেছে। জগৎ মিত্র আশা করছে, শীগগিরই আর তার চাকরি করতে হবে না। কারণ গানের রোজগার আশাতিরিক্ত বাড়ছে।

মেয়েটির নাম রত্না। একই গাঁয়ের মেয়ে। বসু ছিল, মিত্র হয়েছে। সে-ও ওই কাছাকাছি শহরের আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিল। চেনা-জানা ঘর, জগৎ মিত্রের অথর্ব বাবার আগে থাকতে মেয়েটার ওপর চোখ ছিল। ছেলে চাকরিতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। এই বিয়েতে প্রেমট্রেমের কোনো ব্যাপার নেই। মেয়েটাকে রূপসী না বললেও বেশ সুশ্রীই বলতে হবে। তার বয়েস উনিশ। সে গ্রামে। থেকে প্যারালিটিক শ্বশুরের পরিচর্যা করে। বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই চঞ্চল বউটিকে দারুণ ভালবাসেন। তার শাসন নেই বলেই রত্নার আচরণ গাঁয়ের বউয়ের মতো নয়-শ্বশুরের আদুরে মেয়ের মতো। শ্বশুরের সেবা-যত্ন করে, পুকুরে সাঁতার কাটে, ওর থেকে বয়সে ছোট ছেলেমেয়েদের ধরে ধরে চোবায়, দুপুরে নিরিবিলি। পেয়ারা, কুল, আতা, জামরুল গাছে ওঠে, নয় তো এক মাইল দূরের বাপের বাড়িতে টহল দিয়ে আসে। প্রত্যেক শনিবারের বিকেলে জগৎ আসে, সোমবার খুব ভোরে চলে যায়। এই শনিবারটার জন্য রত্না যে উন্মুখ হয়ে থাকে জগৎকে তা বুঝতে দেয় না। দুষ্টুমি মাথায় চাপলে সে আসার পর বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত শ্বশুরকে নিয়ে বা রাঁধা-বাড়া নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে যে, জগৎ তাকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পায় না। ফলে তার রাগ হবেই। সে অন্য পাশ ফিরে চুপচাপ শুয়ে থাকে। কিন্তু রত্নার রাগ ভাঙানোর রীতিটাও আসুরিক। সুড়সুড়ি দেবে, কথা না বলে খুনসুড়ি করবে, তারপর একসময় জগৎকে জাপটে ধরে খাটেই গড়াগড়ি খাবে। জগৎ তখন ছাড়াতে চেষ্টা করেও পারে না। তবু রাগ দেখায়। বলে, সামনের শনিবার আমি আসছি না–

রত্না বড় বড় চোখ করে বলে, তুমি হলে গিয়ে আমার জগৎ। না এলে তো অন্ধকার দেখব।

-অন্ধকার দেখবে। তাহলে এতক্ষণ কি হচ্ছিল?

রত্না হেসে গড়িয়ে জবাব দেয়, এতক্ষণ জগৎ-এর সঙ্গেই রসকরা হচ্ছিল।

এর পরে আর রাগের আয়ু কতক্ষণ? গুনগুন করে অন্তত চার-পাঁচখানা গান শোনাতে হয়। জোরে গাওয়ার উপায় নেই, বাবার ঘুম ভেঙে যাবে। কলকাতায় কবে কোথায়, কি গাইল সেই গল্প করে। মাসের রোজগারের বাইরে গানের কল্যাণে কত বাড়তি রোজগার হল বলে। আর, আরো কিছু রোজগার বাড়লে কলকাতায় বাসা ঠিক করে রত্নাকে আর বাবাকে নিয়ে যাবার কথাও বলে। রত্না সাগ্রহে শোনে, কিন্তু রুগ্ন শশুর যে গাঁয়ের বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তাও জানে। আর এত সুন্দর জায়গা ছেড়ে ওর নিজেরও দুখানা খুপরির মধ্যে গিয়ে উঠতে কেমন লাগে সে সন্দেহও আছে।

জগৎ-এর ইচ্ছা ছিল, বউ কলেজে পড়ক। ফার্স্ট ডিভিসনে ম্যাট্রিক পাশ করেছে, কলেজে পড়লেও খারাপ রেজাল্ট করবে না নিশ্চয়। কিন্তু শ্বশুরের দোহাই দিয়ে রত্ন সে-প্রসঙ্গ এড়াতে চেষ্টা করে। আসলে দিব্যি আনন্দে আছে, এর মধ্যে আবার পড়াশুনার ঝামেলার মধ্যে কে ঢোকে। জগৎ প্রাইভেটে আই. এ. পরীক্ষা দেবার জন্য তাকে তৈরী হতে বলে। রত্না তখন তাকে কাজের যে ফিরিস্তি দেয়, তাতে পড়াশুনা ছেড়ে কারো নিঃশ্বাস ফেলারও সময় হবার কথা নয়।

এই সুখের দিন হঠাৎ ফুরালো।

তার সূচনাও আকস্মিক। কলকাতার সমস্ত অফিসের কর্মচারীরা হঠাৎ একদিনের ধর্মঘটে নেমেছিল। তাদের মিছিলে জগৎকেও টেনে নামানো হয়েছিল। সেটা একচল্লিশ সাল। স্বাধীনতার দাবি বা ইংরেজ শাসনের কোন-না-কোন অন্যায় উপলক্ষে কলকাতায় তখনও মিছিল লেগেই ছিল। অভিযোগ অন্য কোন অফিসের একজন কর্মচারীকে ইংরেজের পুলিশ ঠেঙিয়ে মেরে ফেলেছে। তাই সমস্ত অফিসের কর্মচারীদের পরদিন অফিস বয়কটের ডাক। একে যুদ্ধের সময় সেটা। দু-পক্ষই মারমুখী। সরকার ট্রাম বাস গাড়ি চলাচল বন্ধ হতে দেয়নি। অন্যদিকে এই বিশাল মিছিলও পথ আগলে মনুমেন্টের দিকে এগোচ্ছে। ফলে রাস্তা জ্যাম। ট্রাম, বাস, মোটর, লরির লম্বা জট। এক জায়গায় মিছিলও দাঁড়িয়ে গেছে, ওগুলোও। জগৎ মিত্র কেটে পড়ার তাল খুঁজছিল। এক্ষুণি হয়তো পুলিশ এসে কাঁদানে বোমা ছুঁড়বে আর লাঠিপেটা করে মিছিল ভেঙে দিতে চাইবে।

এই সময় পাশের একটা গাড়ির দিকে দুচোখ আটকে গেল। পিছনের সীটে একটি মেয়ে বসে আছে, বছর একুশ হবে বয়েস। মেয়েটির চোখে বড়-সড় একটা সানগ্লাস। একটু লালচে চুল, বেশ ফর্সা। গাড়ি এভাবে আটকে যাওয়ার দরুন মুখে রাজ্যের বিরক্তি। জগৎ হাঁ করে তাকেই দেখতে লাগল। মেয়েটা তার পাশেই দুহাতের মধ্যে।

সেই মেয়েও দেখল তাকে। বার কয়েকই দেখল। দেখছে যে, সানগ্লাসের দরুন জগৎ সেটা বুঝতে পারল না। নইলে অমন বোকার মতো চেয়ে থাকত না।

মেয়েটা হঠাৎ একঝটকায় সানগ্লাসটা খুলে ফেলে মুখটা গাড়ির জানালা দিয়ে একটু বার করে, দুচোখ টান করে তার দিকে চেয়ে রইল। রাগত মুখের ভাবখানা, কত দেখবে দেখো, খুব ভালো করে দেখো! এই যাদের স্বভাব তারা আবার পথ আগলে দেশ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে!

জগৎ হঠাৎ এত ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেল যে, মেয়েটা একটু বাদে ফিক করে হেসেই ফেলল। আর কথা নেই। জগৎ এদিক-ওদিক চেয়ে হঠাৎ লাইন থেকে সটকান। গাড়িটার পাশ দিয়ে পালানোর সময় মেয়েটা জোরেই হেসে উঠল। জগৎ-এর দুকান গরম। এদিকের ফুটপাথে উঠে ঘুরে তাকালো। মজা পেয়ে মেয়েটা এদিকের জানলায় সরে এলো। আর সোজা ওর দিকে চেয়েই হাসতে লাগল। জগৎ হনহন করে উল্টো দিকের রাস্তা ধরল।

মেয়েটার ওই হাসি আর ওই চাউনি ওর গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিল। অন্যদিকে আত্মাভিমানও চাড়িয়ে উঠতে লাগল। আগামী দিনের কতবড় এক গায়ক ঐ মিছিলে। দাঁড়িয়েছিল মেয়েটা যদি জানত, আক্কেল হত। মেসে ফিরে কল্পনায় আক্কেল হওয়ার। ছবিটা ধরতে চেষ্টা করল। করে প্রতিশোধ নিতে পারার আনন্দ পেতে চেষ্টা করল। শেষে কলম নিয়ে বউকে চিঠি লিখতে বসল। সেটা সবে সোমবার, শনিবার পর্যন্ত ঘটনাটা পেটে চেপে রাখা কঠিন।

লিখে সেই দুপুরেই পোস্ট করে দিল।

তার ঠিক দুদিনের মধ্যে সত্যিই এক বিচিত্র যোগাযোগ। বালিগঞ্জের এক বড়লোক বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে নেমন্তন্ন খেতে গেছল। জগৎ মিত্র সেখানে মাননীয় অতিথি। তার সোলো গানের আসর হবে। বন্ধুর বায়না অন্তত দশখানা গাইতে হবে। গাড়ি পাঠিয়ে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেই গাড়িতে জগৎ তার হারমোনিয়াম নিয়েছে। তবলচি বন্ধুই জোগাড় করে রেখেছে। রেডিও আর্টিস্ট, কয়েকটা গান রেকর্ড হয়েছে, দু দুটো গান ছবিতে সুপারহীট–এমন ছোট আসরে দারুণ খাতির কদর হবে না কেন?

ছেলের থেকে মেয়ের ভিড়ই বেশি। তাদের মুখে মুখে বায়না এটা গান, ওটা গান। এক-একটা গান শেষ হলেই আবার বায়না। পাঁচখানা গান গাওয়ার পর ষষ্ঠ গান সবে শুরু করবে, সামনের মেয়ে পুরুষদের ঠেলে সরিয়ে যে মেয়েটি সামনে। এসে দাঁড়ালো তাকে দেখেই জগৎ-এর দুচক্ষু স্থির। মিছিলের রাস্তার সেই মোটরগাড়ির মেয়ে। কল্পনার প্রতিশোধ যে এমন বাস্তব হয়ে উঠতে পারে ভাবা যায় না।

মেয়েটি খুব সপ্রতিভ মুখে বলল, আমার নাম সুমিত্রা চৌধুরী–আমি আপনার এখানকার বন্ধুর স্ত্রীর বন্ধু। আচ্ছা, আপনাকে আমি খুব শীগগিরই কোথায় দেখেছি বলুন তো–দেখেছি ঠিক, কিন্তু মনে করতে পারছি না।

একটু দম নিয়ে জগৎ বলল, তরশুদিন দুপুরে রাস্তায় মিছিলে দেখেছিলেন… আপনি গাড়িতে বসেছিলেন, আমি আপনার পাশেই মিছিলে ছিলাম।

শোনার সঙ্গে সঙ্গে এবারে আকাশ থেকেই পড়ল সুমিত্রা চৌধুরী।–এই খেয়েছে। আমি কার সঙ্গে কি ব্যবহার করেছি! তাই তো–আপনিই তো সেই–মিছিল ছেড়ে একেবারে ছুটেই পালিয়ে গেলেন। ছি ছি ছি, আচ্ছা আপনার গান শেষ হোক, তারপর ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

জগৎ আবার গান ধরল। এমন মনপ্রাণ ঢেলে আর কখনো গেয়েছে কিনা জানে না। একে একে আরো চারখানা গান। সকলে বাহবা বাহবা করে উঠল। খাওয়ার পরে সুমিত্রা চৌধুরী এসে ধরল তাকে।চলুন, আমার বাড়ি একবারটি যেতে হবে।–এই কাছেই।

জগৎ মিত্র বলল, আজ থাক, সঙ্গে হারমোনিয়াম আছে, গাড়ি না পেলে অসুবিধে হবে।

কানেই তুলল না। বলল, আপনার হারমোনিয়াম অলরেডি আমি আমার গাড়িতে তুলিয়েছি-ওটা আর তার মালিককে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা হবে। আসুন, ছাড়া পাচ্ছেন না–সেদিনের কাণ্ড আমি বাড়ি এসেই বাবা-মাকে বলেছিলাম আর হেসে গড়িয়েছিলাম–ছি ছি ছি! না জেনে–কি কাণ্ড করেছি বলুন তো!

জগৎ বলল, দোষ হয়তো আমারও কিছু ছিল।

অম্লানবদনে সুমিত্রা চৌধুরী বলল, তা তো ছিলই। মিছিলে দাঁড়িয়ে আপনি ড্যাবড্যাব করে আমাকে দেখছিলেন–আপনি জগৎ মিত্র সেই লোক জানলে তো উল্টে গর্ববোধ করতাম।

জগৎ আরো লজ্জা পেল। তাকে বাড়িতে ধরে নিয়ে গিয়ে সেই মেয়ে এক হৈ-চৈ কাণ্ড বাধিয়ে দিল। কত বড়লোকের মেয়ে বাড়িতে ঢুকেই জগৎ টের পেয়েছে। তকতকে সাজানো-গোছানো সব ঘর, জেল্লা ঠিকরানো আসবাবপত্র। সুমিত্রার বাবা-মায়ের সঙ্গে আলাপ হল। তারাও অমায়িক। আর একমাত্র মেয়ের প্রতি বাবা-মায়ের অন্ধ স্নেহেরও আঁচ পেল। চাকর দিয়ে হারমোনিয়াম নামিয়ে। জোর করে আবার তাকে বসিয়ে দিল–বাবা-মাকে দুটো গান অন্তত শোনাতে হবে।

জগৎ-এর মনে হল, এই মেয়েটার ইচ্ছেতেই যেন জগৎ চলছে। কোনো বাধা। মানার বা আপত্তি শোনার পাত্রী নয় সে। দুটো গানের পর বাবা-মায়ের সামনে সে কথা আদায় করতে চাইল, সামনের রবিবার সন্ধ্যায় এখানে আসবে এবং খাবে। কারণ আজ নেমন্তন্ন খেয়ে আসার পর আর খাওয়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। ফাঁপরে পড়ে জগৎ মিত্র বলল, রোববারে আমি কলকাতায় থাকি না, দেশে যেতে হয়।

সুমিত্রার মা জিজ্ঞেস করলেন, দেশে কে আছে তোমার?

–অসুস্থ বাবা। আর কে আছে সেখানে সেটা যে বলা হল না জগৎ মিত্রর। ও-বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরে মনে হয়েছে।

রবিবার বাদ দিয়ে পরের সোমবার জগৎ এখানে আসবে, গাইবে, গল্প করবে, খাবে কথা দিয়ে তবে নিষ্কৃতি। একেবারে নিষ্কৃতি, ঠিক বলা যায় না। কারণ, সুমিত্রাও তার সঙ্গে এসে গাড়িতে উঠল। মেসে পৌঁছে দিয়ে ফিরবে। তার বাবা-মা আদরের মেয়ের স্বাধীনতায় এতটুকুও কটাক্ষ পর্যন্ত করেন না লক্ষ্য কুরল।

জগৎ-এর ভালোও লাগছে, আবার বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। দুজনের মাঝখানে। চার-ছ আঙ্গুলও ফারাক নেই, মেয়েটার সেদিকে হুশ নেই। মাঝে মাঝে কাঁধে কাধ ঠেকছে, ওর তপ্ত নিঃশ্বাস মুখে লাগছে। খুশি মেজাজে সুমিত্রা বকেই চলেছে। এ রকম এক অদ্ভুত যোগাযোগের ফলে ওর নাকি দারুণ মজা লাগছে। আজকের গানগুলোর প্রশংসা করল, এমনি একখানা রেকর্ড আর ছবির হট গানের রেকর্ড তার কালেকশানে আছে জানালো। আবার কবে নতুন রেকর্ড বেরুবে খোঁজ নিল। ফাঁকে ফাঁকে নিজের কথাও ঘুরিয়ে বলল। বি-এ পাশ করে এবারে এম-এতে ভর্তি হয়েছিল–আর পড়তে ভালো লাগল না বলে ছেড়ে দিল। গান তার দারুণ ভাল লাগে–ওরও ইচ্ছে করে বড় বড় শিল্পীর মতো গাইতে। একজন ওস্তাদ রাখা হয়েছিল, কিন্তু তিন মাস ধরে সে সা রে গা মা পা ধা নি নিয়ে ওকে এমন নাকানি-চোপানি খাওয়াতে লাগল যে, সুমিত্রা তাকে বিদায় করে বাঁচল। আর শেষে জিজ্ঞেস করল, আপনি সেদিন মিছিলে দাঁড়িয়েছিলেন কেন–চাকরি করেন নাকি?

এত বড়লোকের মেয়ের কাছে সামান্য চাকরির কথা বলতেও লজ্জা। জবাব দিল, এখনো করছি, আর বেশিদিন বোধহয় দরকার হবে না।

–তা তো হবেই না, এরই মধ্যেই যা নামখানা করে ফেলেছেন। জানেন, আপনার বন্ধুর বউ প্রমীলার সঙ্গে আমার এমন কিছু খাতির নেই–ও মনে মনে আমাকে হিংসা করে–কিন্তু আপনি আসছেন খবর পেয়ে ফোন করে নিজে সেধে নেমন্তন্ন নিলুম। তখন কি জানি আপনি–সেই মিছিলের আপনি।

গলির মধ্যে মেসবাড়ি। গাড়ি ঢোকে না। হারমোনিয়ামটা ড্রাইভারকে দিয়ে মেসে পাঠানো হল। দ্বিধা কাটিয়ে জগৎ বলল, মেসবাড়ি ১ দশা আপনাকে ডাকতে পারছি না–

–আর ডেকে কাজ নেই। কিন্তু আপনিই বা এ-রকম একটা জায়গায় থাকেন কেন? খুব পয়সা জমাচ্ছেন বুঝি?

-না… দেখেশুনে উঠে যাব ভাবছি কিন্তু সময় হয়ে ওঠে না।

তার অফিসের ফোন নম্বর লিখে নিয়ে আর সোমবার রাতের কথা আবার মনে করিয়ে দিয়ে সুমিত্রা চলে গেল। জগৎ মিত্রের মনে হল একঝলক বিদ্যুৎ সরে গেল।

পরদিন রত্নার চিঠি পেল। পারতে চিঠি লেখে না। কিন্তু মিছিলে এক মেয়ের কাছে হেনস্তার খবর জেনেই লিখেছে নিশ্চয়। তাই। ছোটর ওপর সুন্দর চিঠি।–তোমার চোখের ভাষায় নিশ্চয় কিছু ছিল। নইলে অচেনা অজানা ভদ্রলোকের মেয়ে ও-রকম করতে যাবে কেন? যাক, ওতেও যদি তোমার শিক্ষা না হয়ে থাকে তাহলে বাকি শিক্ষা আমি দেব। তবে একটু আশ্বাস দিতে পারি, সুন্দরী মেয়ের দিকে তাকানো। আমার মতে ছেলেদের খুব বড় অপরাধ নয়। আর বে-আবরু না তাকালে মেয়েরা। সেটা অপছন্দও করে না। তুমি সেই মেয়ের দিকে কিভাবে তাকিয়েছিলে এখানে এসে তার মহড়া দিতে হবে–তবে বিচার করতে পারব। এরপর বাবার সম্পর্কে খুঁটিনাটি খবর। তার শরীরটা নাকি বেশ ভেঙেই পড়ছে।

শনিবারে দেশে যেতে পরের খবর বিস্তারিত শোনার পর রত্না হাঁ একেবারে। তারপর সে কি হাসি। হাসি আর থামতেই চায় না। শেষে বলল, বেচারি সুমিত্রা চৌধুরী –তোমার ঘরে যে বউ আছে তাকে সেটা বললেই না?

-বলার আর চান্স পেলাম কোথায়! সোমবারে নেমন্তন্ন খেতে গিয়ে বলব।

রত্না সাবধান করল, তাহলে খাওয়ার পরে বোলো, নইলে কপালে কি জুটবে কে জানে!

কিন্তু সোমবার নেমন্তন্ন খেতে এসে জগৎ মিত্রের আবারও দিশেহারা দশা। সুমিত্রা তার একগাদা বান্ধবীকে নেমন্তন্ন করেছে, ডজনখানেক বন্ধুকে নেমন্তন্ন করেছে, সেই সঙ্গে আর যাকে নেমন্তন্ন করেছে তাকে দেখে তো জগৎ-এর দস্তুরমতো রোমাঞ্চ। এক রেকর্ড কোম্পানীর হর্তা-কর্তা সেই ভদ্রলোক। এদিকে হারমোনিয়াম আর তবলার ব্যবস্থাও করে রেখেছিল। এদিনও গুণে গুণে দশখানা গান হল। রেকর্ড কোম্পানীর ভদ্রলোক প্রশংসা করতেই সুমিত্রা তাকে নিয়ে পড়ল।মাত্র দু-খানা রেকর্ড কেন ওঁর? শুধু মুখে প্রশংসা করলেই হবে? কবে রেকর্ড করবেন বলুন, আমি নিয়ে যাব।

ভদ্রলোক দিন তারিখ বলার পর রেহাই পেলেন। আর তার পরেও মাঝে মাঝে রেকর্ড করবেন কথা দিলেন।

খাওয়া-দাওয়া সারা হতে এই রাতেও সুমিত্রা তাকে নিজের গাড়িতে পৌঁছে দিতে এলো। আগের দিনের থেকেও বেশি ঘন হয়ে বসে ফিক করে হেসে বলল, কেমন–মিছিলে ওভাবে জব্দ করার পুরস্কার পেলেন তো? বছরে ক-খানা করে আপনার। রেকর্ড করাই এবারে দেখবেন।

জগৎ মিত্র জিজ্ঞেস করল, ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনাদের কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক আবার কি উনি চ্যাটার্জি আর আমরা চৌধুরী ক্রিশ্চিয়ান। বাবার সঙ্গে অল্পস্বল্প খাতির ছিল, বাবা নিজে ইন্টারেস্ট নিয়ে ওঁর বাড়িটা খুব কম খরচে করে দেবার পর থেকে আমাদের বাড়ির সঙ্গেই এখন দারুণ খাতির। উনি নিজের ক্ষমতায় ডবল খরচ করেও অত বড় বাড়ি করতে পারতেন না। বাবা বিরাট কন্ট্রাক্টর জানেন তো?

জগৎ বলল, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেব জানি না।

-হুঁ। শুকনো ধন্যবাদ নিতে আমার বয়ে গেছে। আর শোনো, ওসব আপনি টাপনি আমার ভালো লাগে না, ফ্রম নাও অন উই আর ফ্রেন্ডস–বুঝলে?

বোঝার চমকে জগৎ-এর ঘাম ছোটার দাখিল। গলির মুখে নামতে সুমিত্রা মনে করিয়ে দিল, রেকর্ড করার ডেট মনে আছে তো? ঠিক সময় ধরে গলির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে, আমি গাড়ি নিয়ে আসব।

জগৎ মাথা নাড়ল। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আর ভিতরটাও কি-রকম মোহাচ্ছন্ন। গাড়িতে আজ অনেকবার কাঁধে কাঁধ ঠেকেছে, গায়ে গা ঠেকেছে। ও চলে যাবার পরেও একটা উষ্ণ স্পর্শ যেন তাকে ঘিরে আছে। সেই কারণে প্রচণ্ড অস্বস্তি। কিন্তু তারই তলায় কোথায় একটু লোভও টের পাওয়া মাত্র নিজের ওপরেই রাগ। মাথা ঝাঁকিয়ে সেটা অস্বীকার করেছে। রত্নাকে সে ভালবাসে–দারুণ ভালবাসে।

কিন্তু এবারে দেশে গিয়ে রত্নার অনেক জেরার জবাবে মুখ যদি বা একটু-আধটু খুলল মন খুলতে পারল না। দু-চার কথায় শুধু জানালো, নেমন্তন্ন খেতে গেছল, খুব আদরযত্ন পেয়েছে, অনেকগুলো গানও গাইতে হয়েছে।

এর বেশি আর কিছু বলল না। বলা সহজ নয়। রত্নার তাতে ভুল বোঝার সম্ভাবনা। ষোল আনা। তাছাড়া বাবার শরীরটা বেশি খারাপ বলে রত্না বারবার সে-প্রসঙ্গ তোলবারও খুব সময় পেল না। বাবাকে শহরের ডাক্তার এনে দেখানো নিয়েই বেশি কথা হল। জগৎ একদিন কামাই করে ডাক্তার দেখিয়ে সোমবারের জায়গায় মঙ্গলবার কলকাতায় ফিরল।

টিফিনে সুমিত্রার টেলিফোন। দেশে যাবার আগে ও প্রায় রোজই টেলিফোন করেছে। প্রথম দিনেই জগৎ বলে দিয়েছিল, ফোন করলে যেন টিফিনে করে, সেকশনাল হেড-এর ঘর তখন ফাঁকা থাকে।

-কাল অফিসে আসোনি কেন?

–দেশে বাবার অসুখ বেড়ে যেতে শহরের ডাক্তার এনে দেখাতে হয়েছে।

–এখন ভালো?

–ভালো খুব না।

–সেরে যাবে, ভেব না। পরশু রেকর্ডিং তোমার মনে আছে তো?

–আছে।

–কি গাইবে ঠিক আছে?

–আছে।

–আচ্ছা, দুটো গানেরই এক লাইন করে শোনাও তো?

জগৎ আঁতকে উঠল, টেলিফোনে শোনাব কি।

–আঃ শুধু সুরটা শোনাও না! ঘর তো ফাঁকা?

–হ্যাঁ, তবু এটা ঠিক হবে না…।

ওধার থেকে সুমিত্রা রেগেই গেল, দেখো, আমার মুখ দিয়ে একবার বেরিয়েছে যখন, রেহাই পাচ্ছ না–এক লাইন করে শোনাও!

অগত্যা খুব গলা চেপে এক লাইন করে শোনালো।

-ঠিক বুঝতে পারলাম না কতটা ভালো। আচ্ছা, পরশু আগে গাড়িতে বসে শুনব।

গাড়িতে বসে জোর করেই পুরো দুটো গান শুনল। তার আগে দু-দিকেরই জানলার কাঁচ তুলে দিয়েছিল জগৎ। তার পরেও চাপা গলায় গেয়েছে। গায়ে গা ঠেকিয়ে বসে প্রায় মুখের কাছে কান এনে সুমিত্রা প্রথম গানটা শুনেছে। শেষ হতেই ধমক।–অমন গলা চেপে গাওয়ার কি হয়েছে–আচ্ছা নার্ভাস লোক তো! পরেরটা। জোরে গাও!

.

দু-মাস কেটে গেল। জগৎ মিত্রের ভিতরটা সর্বদা অস্থির। এক মুহূর্তের শান্তি নেই। রাত্রে ঘুম নেই। দ্রুততালে সে একজনের দখলের মধ্যে চলে যাচ্ছে বুঝেও যেন অসহায়। সুমিত্রা প্রায় রোজই টেলিফোন করে, দুই-একদিন পরে পরে ঠিক ছুটির। মুখে গাড়ি নিয়ে অফিসে আসে, বাড়িতে ধরে নিয়ে যায়, সিনেমায় নিয়ে যায়, নয় তো এমনিই কলকাতার রাস্তায় চষে বেড়ায়। তার চোখে জগৎ মিত্র এক দুর্লভ আবিষ্কার। গানের জগতে তাকে একেবারে সামনের সারির প্রথম দিকে এগিয়ে আনা যেন তারই গুরুদায়িত্ব। কিছুটা এগিয়ে আনতে পারলে আনন্দে আটখানা হয়। না পারলে ফুঁসে ওঠে। যা চায় তা হতেই হবে। যা চায় তা পেতেই হবে। এর মধ্যে কোনো মাঝপথ নেই। আপস নেই। সভায় বা রেডিওতে গাইতে গেলে সে নিজেই আগে থাকতে গাড়ি নিয়ে চলে আসে। রেকর্ড কোম্পানীর–সেই ভদ্রলোককে ধরে আবার দুটো গান রেকর্ড করিয়েছে। যতক্ষণ সুমিত্রা চৌধুরী কাছে থাকে, জগৎ মিত্রর মোহগ্রস্ত দশা। চোখের আড়াল হলে যন্ত্রণা, বিবেকের দংশন। হ্যাঁ, ভালো সে আজও রত্নাকেই বাসে। তার জায়গায় আর কাউকে ভাবতে পারে না। কতবার ভেবেছে, আর না, এবার সুমিত্রাকে বলবে সে বিবাহিত। কিন্তু সুমিত্রা কাছে এলেই সব ভণ্ডুল। বলি-বলি করেও বলতে পারে না। তখন সুমিত্রা যেন কাঁচের আবরণে একঝলক আগুনের শিখা। সেই কাঁচে পতঙ্গের মতো মাথা খুঁড়ে মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

এই দু-মাসেও প্রতি শনিবার জগৎ বাড়ি এসেছে। বাবার অসুখটা বেশি বাড়াবাড়ির দিকে বলে রত্না একটু ব্যস্ত। জগৎও ব্যস্ত ভাব দেখাতেই চেষ্টা করে। তবু রত্না কিছু পরিবর্তন আঁচ করছে, লক্ষ্য করছে তা-ও টের পায়। পাওয়ার কথাই। ভালো করে রত্নার দিকে তাকাতে পারে না, আগের মতো কথা বলতে পারে না। রাতে আগে ভাগে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। অবশ্য বাবাকে ঘুম পাড়িয়ে ওর ঘরে আসতে বেশ দেরিই হয়। কিন্তু তবু যে-ভাবে রাত কাটে সেভাবে কাটার কথা নয়।

গোড়ায় গোড়ায় রত্না জিজ্ঞেস করেছে তোমার কি হয়েছে বলো তো দিন দিন তুমি এ-রকম হয়ে যাচ্ছ কেন?

জগৎ মিত্র তাতেই বিরক্ত-অফিসে নানারকম ঝামেলা শুরু হয়েছে বলেছি না? এরপর শনিবার আসতে পারব কিনা তারও ঠিক নেই।

রত্না একদিন বলেছিল, ঝামেলা তো চাকরি ছেড়ে দাও না–অন্যদিকের রোজগার তো এখন ভালই হচ্ছে।

জগৎ আরো তেতে উঠেছিল।–যা বোঝে না তা নিয়ে কথা বোলো না। আবার। অসুখ, খরচের অন্ত নেই–চাকরি ছেড়ে বসে থাকলেই হল! ৪৯৪

রত্না এখন কিছু বলে না, কিছু জিজ্ঞাসাও করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে লক্ষ্য যে করে হঠাৎ হঠাৎ সেটা টের পায়। জগৎ বেশিরভাগ সময়। অন্যমনস্ক থাকে, তারপর হঠাৎ টের পেয়ে ধড়ফড় করে ওঠে।

কলকাতায় সেদিন। সুমিত্রা অফিসে এসে জগৎকে বাড়ি ধরে নিয়ে গেছে। বিকেল থেকে বেশ বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই গাড়ি নিয়ে এসেছে। তুলে নিয়ে গেছে। ওদের বাড়ি পৌঁছানোর পরেও অঝোরে বৃষ্টি হচ্ছে। বিকেলের জলখাবারের পাট চুকতেই মা-কে বলে দিয়েছে রাতে বিরিয়ানি আর কষা চিকেন খাবে তারা। মুখের কথা খসলেই এখানে সেটা তামিল করা জলভাত। বৃষ্টির বিরাম নেই।

সন্ধ্যার পরে সুমিত্রার বাবাও আড্ডায় যোগ দিলেন। কথায় কথায় হঠাৎ তিনি মেয়েকে বললেন, তোরও তো একসময় বেশ মিষ্টি গলা ছিল, এখনো গুনগুন করে নিজের মনে গান করিস যখন ভালো লাগে–জগৎকে পেয়েছিস যখন পছন্দমতো দুই একখানা গান তুলে নে না!

সুমিত্রা লাফিয়ে উঠল–দি আইডিয়া! একটা গান তুলে নেবার কথা তো আমার অনেকবার মনে হয়েছে। জগৎকে ডাকল, চলে এসো, আজই চেষ্টা করা যাক–

তাকে ধরে নিয়ে নিজের ঘরে এলো। তারপর দরজা বন্ধ করল। সামনের জানালাটাও। বলল, যা গলার ছিরি আমার এখন, জানলেই আশপাশের বাড়ির লোক গলা বাড়াবে।

কাছে এসে দাঁড়ালো। খুব কাছে। কপট গম্ভীর।–কি মাইনে দিতে হবে?

জগৎ-এর অজানা অস্বস্তি।–মাইনে আবার কি, হারমোনিয়াম আনো—

–না, এমনিতে আমি কাউকে খাটাই না।

বলেই আচমকা দু-হাত বাড়িয়ে তাকে বুকে টেনে আনল। তারপর পায়ের। আঙুলের ওপর দাঁড়িয়ে উষ্ণ ঘন নিবিড় চুমু খেল একটা।

-হল?

জগৎ তখনো তার বাহুবন্দী। ঠোঁট দুটো জ্বলে যাচ্ছে। তার মুখের অবস্থা দেখে। সুমিত্রা খিল খিল করে হেসে উঠল। বলল, তুমি একটা রামভীতু। এতদিন তোমার সঙ্গে যেভাবে মিশেছি, অন্য কেউ হলে ঢের আগেই হাত বাড়াতো। বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার চুমু। আবার হাসি। বলল, যতক্ষণ না তুমি খাচ্ছ ততক্ষণ আমি খেয়ে যাব।

জগৎ মিত্র আস্তে আস্তে তার হাত ছাড়িয়ে নিল। মাথা টলছে। শরীর জ্বলছে। বলল, সুমিত্রা একটা কথা তোমাকে অনেকবার বলতে চেষ্টা করেছি। আমি বিবাহিত। দেশে আমার বউ আছে।

সুমিত্রা ছিটকে তিনহাত পিছনে সরে গেল। স্তম্ভিত চোখে দেখল একটু। তারপর। চেঁচিয়ে উঠল।–কি বললে? তুমি কি?

–বিবাহিত।

-স্কাউনড্রেল! জোচ্চোর! আমি তোমাকে জেল খাটাব! প্রথম দিনেই তুমি মা কে বলেছিলে; দেশে কেবল তোমার বাবা আছেন।

-বাবার অসুখ, তার জন্যেই প্রতি রবিবারে দেশে যেতে হয় বলেছিলাম।

–কিন্তু এত দিনের মধ্যে তুমি বলারই সময় পেলে না?

এর জবাব কি দেবে-জগৎ মিত্র চুপ।

সুমিত্রা তার খাটে বসল। রাগে সমস্ত মুখ লাল। দু-চোখে খানিক ভস্ম করল সামনের মানুষটাকে। তারপর আচমকা আবার হেসে উঠল। বলল, তুমি হাড়বজ্জাত আর অতিমাত্রায় লোভী। বাবা-মা শুনলে কি বলবে বল তো?

–তাদের কাছে আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

–থাক, তোমাকে আর ঘটা করে কিছু করতে হবে না। বিয়ে করা বউকে কত যে ভালোবাসো আমার সঙ্গে মেশা দেখেই বুঝেছি।… তোমাকে ক্রিশ্চিয়ান হয়ে রেজিস্ট্রি বিয়ে করতে হবে। ও কি? আঁতকে উঠলে কেন–তোমাদের হিন্দু বিয়ে একটা ছেড়ে পাঁচটা করলেই বা আটকাচ্ছে কি–এখন পর্যন্ত তো আইনের বাধা কিছু নেই। বোসো। এখানে, আমি আসছি।

বেরিয়ে গেল।

জগৎ মিত্র স্তব্ধ। বাইরে মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। কলকাতা ভেসে গেল বুঝি।

মিনিট কুড়ি বাদে একেবারে বাবা-মাকে নিয়ে সুমিত্রা ফিরল। তাঁরা গম্ভীর। ভদ্রলোক তার মেয়েকেই বললেন, বুঝলাম ওর কোনো দোষ নেই–কিন্তু তুই আর কটা দিন ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে নে না, এত তাড়াহুড়ো করার কি আছে?

–আঃ বাবা, তোমাকে অত করে বললাম কি? আমার ভাবার আর কিছু নেই –ওকে ছাড়া আমার চলবে না–আমাকে ছাড়া ওর চলবে না–ব্যস। যত টাকা লাগে লাগুক, একমাস আগের তারিখে নোটিশ দিয়ে তুমি সাত দিনের মধ্যে আমাদের রেজিস্ট্রি বিয়ের ব্যবস্থা করে দাও। তুমি তো বললে টাকা খরচ করলে হতে পারে।

–তা পারে, কিন্তু

–আর কিন্তু টিন্তু নেই। ডান।

.

রাতে এ বাড়িতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে জগৎ মিত্রর। রাস্তায় বেরুনোর উপায় নেই। কলকাতা জলের তলায়। এত বৃষ্টি স্মরণীয়কালের মধ্যে আর হয়েছে মনে পড়ে না। ডানলোপিলোর নরম শয্যায় শুয়ে জগং ছটফট করছে।তার চোখে ঘুম নেই। দোতলার সব আলো অনেকক্ষণ নিভে গেছে। নিঝুম। জগৎ মিত্রর সংকল্প স্থির কাল সকালে উঠে ও কাউকে কিছু বুঝতে দেবে না।… যতটা সম্ভব স্বাভাবিক থাকতে হবে। অফিসে গিয়ে বাবার অসুখের কথা লিখে লম্বা ছুটি নেবে। তারপর বেলা সাড়ে এগারোটার ট্রেনেই দেশে চলে যাবে। দেশের হদিস এরা জানে না। যাতে না পায়। সে ব্যবস্থাও করে যাবে। পেলেও জগৎ নিপাত্তা হলেই সব বুঝতে পারবে। আর দেশ পর্যন্ত ধাওয়া করবে না।

হঠাৎ বিষম চমকে উঠল জগৎ মিত্র। অন্ধকারে তার শয্যায় বসল কেউ। নারী দেহ। পরনে রাতের বাস। তাকে ঠেলে পাশে শুয়ে পড়ল। উষ্ণ নরম দুই বাহু বেষ্টনে টেনে আনল। তারপর অমোঘ অব্যর্থ রসাতলের দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল।

সকাল। দুপুর। বিকেল। জগৎ মিত্র মেসে ফিরল। একে একে দিন গড়াতে লাগল। শনিবার এলো। দেশে গেল না। অফিসে যাচ্ছেই না।

আট দিনের দিন রেজিষ্ট্রি বিয়ে হয়ে গেল।

তার দু-দিন বাদে রত্নাকে রেজিষ্ট্রি চিঠি পাঠালো একটা। আর কারো হাতে না পড়ে, তাই। আর অবশ্য যাতে পায়, তাই। কি ঘটেছে সংক্ষেপে লিখল। আর লিখল, বাকি জীবন কেবল অভিশাপ দিয়ে যাও। সেটা আমার প্রাপ্য। জগৎ নতুন শ্বশুরবাড়িতে আছে। সেই ঠিকানা দিল।

চারদিন বাদে রত্নার জবাব এলো। খুব ছোট চিঠি। তোমার বাবার শরীরের অবস্থা এখন আশংকাজনক। সময় হয়ে আসছে বোঝা যায়। তাকে কিছু বলার দরকার নেই। এ শনিবারও যদি দেশে না আস তাহলে পরের শনিবার পর্যন্ত টিকবেন কিনা বলা যায় না। এক সপ্তাহ না আসাতে তিনি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন।

জগৎ অফিসের চাকরি রিজাইন করেছে। সে করেনি, সুমিত্রা করিয়েছে। তবু শনিবার পর্যন্তই অপেক্ষা করল। শনিবার আরো অনেক দূরে হলে যেন ভালো হত।

বাবার অবস্থার কথা সুমিত্রাকে জানিয়ে শনিবার দেশে গেল। বাবা তার হাত দুটো ধরে কাঁদতে লাগলেন। বললেন, আমার এই অবস্থা আর তুই পনের দিন পরে। এলি! আমি যে তোকে দেখার জন্যেই প্রাণটা ধরে বসে আছি।

সত্যিই তাই। তিনদিনের মধ্যে ছেলের কলকাতায় ফেরা হলনা। তিনি চোখ বুজলেন। দাহ কাজ শেষ করে জগৎ সেদিনই কলকাতায় এলো। টাকা নিয়ে আবার সেদিনই রাতে ফিরল। এ কদিনের মধ্যে রত্নার সঙ্গে তার একটিও কথা হয়নি। সে শ্বশুরের ঘরে শ্বশুরের কাছেই থেকেছে। এরই মধ্যে দু-বেলার রান্না সারতে হয়েছে। জগৎ-এর খাবার তার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে। তার খাওয়ার সময়েও সামনে থাকেনি।

রাতে ফিরতে খুব ঠাণ্ডা মুখে রত্না সামনে এলো। বলল, গ্রামের লোককে জানিয়ে দিতে হবে ব্রাবার কাজ কলকাতার কালীঘাটে হবে।

মনের অবস্থা যা-ই হোক জগৎ অবাকই হল একটু।–কালীঘাটে হবে?

–হ্যাঁ। তা না হলে আমার কাজ করতে অসুবিধে।

–তুমি কাজ করবে!

রত্না ঠাণ্ডা দু-চোখ তার মুখের উপর তুলল।আমি ছাড়া আর কে করবে?

ঘর ছেড়ে চলে গেল। কথাটা জগৎ-এর মাথায় ঢুকল। সে এখন ক্রিশ্চিয়ান। শাস্ত্রমতে বাবার কাজ করার অধিকার এই জন্যেই নেই। কিন্তু ছেলে থাকতে এখানে বসে পুত্রবধূ শ্বশুরের কাজ করছে দেখলে সকলে হাঁ হয়ে যাবে।

রাতে রান্নার প্রশ্ন নেই। কারণ ফলাহার জলাহার বিধি। রত্না দুধ আর ফল তার ঘরে ঢাকা দিয়ে রেখে গেল। তার দিকে তাকালো না বা একটি কথাও বলল না। জগৎ মিত্রর বুকের ভিতরটা একটা যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগল। একবার ইচ্ছে হল রত্নাকে জোর করে ধরে আনে, বলে কি অবস্থায় পড়ে তাকে এ কাজ করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা আরো হাস্যকর।

পরদিন সকালে বাবার ঘরে এসে রত্নাকে বলল, ব্যবস্থাপত্রর জন্য আমি তাহলে। কলকাতায় চলে যাই?

রত্না জবাব দিল, হ্যাঁ। না গেলে আমার এখানে তিন রাত থাকতে অসুবিধে হবে–যিনি চলে গেছেন তার জন্যে এখানে তিন রাত থাকা দরকার। ব্যবস্থা করার কিছু নেই, আমার বাবা কলকাতা চলে গেছেন, সেখানে মামারা ব্যবস্থা করবেন।

কলকাতায় রত্নার মামার বাড়ি। বড় অবস্থা তাদের। জগৎ এ-ও বুঝল তার। শ্বশুরকে মেয়ে সব জানিয়েছে। এমন অসহায় অবস্থা বলেই জগৎ হঠাৎ রেগে গেল। -আমার বাবার শ্রাদ্ধের খরচ যোগাবেন তোমার বাবা আর মামারা?

ঠাণ্ডা দু-চোখ এবারে তার মুখের ওপর উঠে এলো। বলল, যা খরচ হবে বাবা তার হিসেব রাখবেন। কাজের পর তাকে দিলে সে টাকা যেন তিনি নেন আমি বলে দেব।

তেমনি রাগত মুখেই জগৎ আবার বলল, আমিই যখন তোমার আর কেউ না, আমার বাবার জন্য তুমি এত কষ্ট করতে যাবে কেন?

-সেটা আমার রুচি। আপত্তি থাকলে টাকা দেবার দরকার নেই।

এর আধঘণ্টার মধ্যে জগৎ কলকাতায় রওনা হল।

বাবার কাজের দিন কালীঘাটে এলো। কাজের ব্যবস্থা, দান-সামগ্রী সবই পরিমিত বটে, কিন্তু পরিচ্ছন্ন সুন্দর। জগৎ অদূরে দাঁড়িয়ে সমস্তক্ষণ কাজ দেখল। কেউ তার সঙ্গে একটি কথাও বলল না। শ্বশুর বা মামাশ্বশুর বা রত্না তার দিকে একবার তাকালোও না। পুরোহিত মন্ত্র পড়িয়ে গেলেন, অনুষ্ঠান পালন করালেন। রত্না মন্ত্র পড়ছে, যা বলা হচ্ছে, তাই করছে। তার পরনে টকটকে লালপেড়ে গরদ। মাথার খোলা চুল। পিঠ বেয়ে কোমর ছুঁয়ে আছে। কপালে সিঁথিতে টকটকে সিঁদুর। জগৎ মিত্রর ভিতর থেকে একটা অব্যক্ত কান্না গুমরে উঠতে লাগল। দুচোখ খরখরে শুকনো।

কাজ শেষ হল। জগৎ রত্নার এক মামাতো ভাইকে বলল, কত খরচ হল একটু জেনে দিতে হবে।

দু মিনিটের মধ্যে সে ফিরে এসে দু পাতার একটা হিসেব তার হাতে দিল। খবচের শুধু মোট অঙ্কটা দেখে নিয়ে জগৎ সে-টাকা রত্নার মামাতো ভাইয়ের হাতে দিয়ে চুপচাপ চলে গেল।

দেশে এলো একমাস বাদে। রত্নার ভরণপোষণের দায়িত্ব যখন আইনত আর ন্যায়ত তার, একটা ফয়সালা করতেই হবে। সেজন্যেই আসা।

বাড়ি তালা বন্ধ। তাই হবে ভেবেছিল। শ্বশুরবাড়িতে এলো। শ্বশুর বাইরেই বসেছিলেন। ভিতরে ডাকলেন না বা বসতে বললেন না। গলা দিয়ে কয়েকটা শব্দ উচ্চারণ করলেন। –রত্না এখানে থাকে না।

দ্বিধা কাটিয়ে জগৎ জিগ্যেস করল, কোথায়..?

–জানার দরকার নেই।

জগৎ চলে এলো। অপমানে মুখ কালি। তার কেন আসা শ্বশুরকে সেটা শুনিয়ে আসতে পারত। তা-ও পারল না।

কলকাতা। জগৎ মিত্রর ষষ্ঠ অনুভূতি প্রখরই বলতে হবে। তার ধারণা, রত্না কলকাতায়। মামাবাড়িতে থেকে কলেজে পড়ছে। ভবিষ্যতে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভাবনা থাকলে সেটাই স্বাভাবিক।

এক রবিবারে সেখানে গেল। নীচে রত্নার সেই মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জিগ্যেস করল, রত্না এখানে?

বিরস মুখে সে মামাতো ভাই মাথা নাড়ল। এখানেই।

-কোন কলেজে পড়ছে?

কোন কলেজে বলল।

-একবার ডেকে দিতে হবে। তার খরচপত্র চালানোর দায়িত্ব আমার। সে-সম্পর্কে কথা বলব।

সে চলে গেল। মিনিট তিনেকের মধ্যে ফিরেও এলো।রত্না বলল, তোমার কোনো দায়িত্ব নেই। তাই দেখা করারও দরকার নেই।

দিন যায়। জগৎ মিত্রর ভিতরটা দিনে দিনে অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। আর সুমিত্রার ততো মোহ ভাঙছে। তার ইচ্ছেয় লোকটার ছবিতে গান গাওয়া, রেকর্ড করা, সভায় গাইতে যাওয়া, সিনেমা-থিয়েটার দেখা, ওঠা-বসা-চলা-ফেরায় বাধা আসতে পারে এ তার কল্পনার বাইরে। কিন্তু ক্রমে সেইরকমই ব্যাপার দাঁড়াতে লাগল। ফলে একতরফা ঝগড়াঝাটি আর শাসনও বাড়তেই থাকল। সে-ও মেয়েই। মেয়েলি অনুভূতিতে সন্দেহের আঁচড় পড়তে লাগল। বিয়ের পর থেকেই লোকটাকে অন্যরকম দেখছে, বদলে যেতে দেখছে। তার সন্দেহ, এই লোকের মন আর একদিকে পড়ে আছে। তাহলে সেটা আগের বউ ছাড়া আর কার দিকে হবে? নইলে বিয়ের পর থেকেই এমন হয়ে যাচ্ছে কেন? এই সন্দেহ মনে এলেই সুমিত্রা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। যা মুখে আসে তাই বলে। গালাগালি করে। অন্যদিকে মুখে রা নেই। তার কানে তুলো, পিঠে কুলো। কিন্তু সে যেমন চলছে, তেমনই চলছে।

মোহ-একেবারেই ছুটে গেল, বা আচমকা জগৎ মিত্রই ছুটিয়ে দিল ন মাসের মাথায়। সুমিত্রার শাসন আর আগের বউ নিয়ে ঠেস সেদিন মাত্রা ছাড়িয়েছে। তার ওপর দিয়ে জগৎ মিত্র হঠাৎ গর্জন করে উঠল। বলল, তুমি আমার সর্বনাশ করেছ–বুঝলে? এত বড় সর্বনাশ কেউ কারো করে না–যার কাছ থেকে তুমি আমাকে। ছিনিয়ে এনেছ তুমি তার পায়ের নখের যোগ্যও নও-বুঝলে?

বোঝার সেখানেই শেষ। সুমিত্রার বাবা তাকে কেবল গলাধাক্কা দিয়ে বার। করতে বাকি রেখেছেন। আর শাসিয়েছেন, বিয়ে ভাঙিয়ে ফের বিয়ে করার জন্য তিনি তাকে জেল খাটাবেন–আর মেয়ের খোরপোষ আদায় করে তাকে ফতুর করবেন।

শেষ পর্যন্ত কিছুই করেন নি। মেয়ে রেজিষ্ট্রি বিয়ে নাকচের ডিভোর্স সুট ফাইল করেছে। তাতে অনেক অত্যাচার, অসদাচরণের অভিযোগ। জগৎ মিত্র কনটেস্ট করা দূরে থাক, কোর্টে পর্যন্ত যায় নি। তারা একতরফা ডিক্রি পেয়েছে।

জগৎ মিত্র মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে বেঁচেছে।

আরো মাসখানেক অপেক্ষা করে রত্নাকে একখানা চিঠি লিখেছে। তার প্রায়শ্চিত্তের কথা লিখেছে। মুক্তির কথা লিখেছে আর একটিবার দেখা করার অনুমতি ভিক্ষে করেছে।

– চিঠির জবাব মেলে নি।

আরো পনের দিন পরে তাকে কলেজে যাবার পথে ধরেছে। রত্না আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। চোখে চোখ রেখে অনুচ্চকঠিন গলায় বলেছে, আর কখনো এ-ভাবে থামালে রাস্তার নোক ডাকতে হবে।

চলে গেছে।

একে একে বছর ঘুরেছে। একটা, দুটো করে ছটা। প্রতিবারের পরীক্ষার ফল বেরুলে জগৎ মিত্র গেজেট দেখেছে। রত্না মিত্র আই-এ পাশ করল, ইংরেজিতে ভালো অনার্স পেয়ে বি-এ পাশ করল, তারপর ইংরেজিতেই ভালোভাবে এম-এ পাশ করল। এখন সে একটা নতুন বেসরকারী মেয়েকলেজে ইংরেজি পড়ায়। জগৎ মিত্রর বয়েস একত্রিশ-রত্নার সাতাশ।

জগৎ মিত্র একটাই আশা বুকে ধরে নিয়ে বসে আছে। রত্নার নামের পরে এখনো মিত্র চলছে, মিত্র বাতিল করে এখনো বাপের পদবী বসুতে ফিরে যায় নি। আর সেই যে রাস্তায় দেখা হয়েছিল তখনো সিঁথিতে খুব সূক্ষ্ম সিঁদুরের আঁচড় দেখেছিল। জগৎ মিত্র গান ছাড়ে নি। গান নিয়ে আছে। নাম ডাকও হয়েছে। রেকর্ডের সংখ্যা বেড়েছে। বাড়ছে। রোজগার ভালো। কিন্তু তার গানের ধারা বদলেছে। যে গানের স্পর্শ প্রাণের গভীরে পৌঁছয় সেই গানই শুধু গায়। রেকর্ডে, রেডিওয়, উৎসব-অনুষ্ঠানেও তাই। সিনেমায় হালকা চটুল গানের ডাক পড়লে বাতিল করে দেয়।

এইবার সে শেষ চেষ্টার জন্য প্রস্তুত হল। রত্নার কলেজে গেল। দারোয়ানের হাত দিয়ে একটা স্লিপ পাঠালো। স্লিপে শুধু নিজের নাম। তারপর অফিসঘরে বসে অপেক্ষা করতে লাগল।

মিনিট পাঁচ-সাত বাদে হিন্দুস্থানী দারোয়ান সেই স্লিপটাই তার হাতে দিল। ভাঁজ খুলে দেখল, উল্টোদিকে লেখা, দেখা হবে না।

জগৎ মিত্র চলে এলো। তার প্রতীক্ষার শেষ। আশারও।

পরের টানা নয় মাসের মধ্যে জগৎ মিত্রর আর কেউ দেখা পেল না। উৎসব অনুষ্ঠান, রেডিও, রেকর্ড, সিনেমা–সর্বত্র সে অনুপস্থিত। রেডিও-শ্রোতার সন্ধিৎসু চিঠির জবাবে সেখানকার কর্মীরা বেতারেই শ্রোতাদের জানাচ্ছে, জগৎ মিত্র দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ বলেই দীর্ঘদিন ধরে তাঁর গান বেতারে শোনা যাচ্ছে না। সিনেমার পত্র পত্রিকাগুলোতেও জগৎ মিত্রকে নিয়ে কিছু জল্পনা-কল্পনা চলেছে।

নমাস বাদে একদিন কলকাতার সব কাগজে বড়বড় হরফে খবর বেরুলো সঙ্গীতশিল্পী জগৎ মিত্রর সন্ধান মিলেছে। দীর্ঘদিন ধরেই তাকে হিমালয়ের দূর-দুর্গমের নেশায় পেয়েছিল। চরৈবেতির ডাক শুনে মুসাফিরের মতো তিনি মাসের পর মাস পাহাড়ে ঘুরেছিলেন। এবারে যমুনোত্রী থেকে ফেরার পথে তিনি প্রাকৃতিক দুর্যোগে গুরুতর আহত হন। আশংকাজনক অবস্থায় তিনি এখন দেরাদুন হাসপাতালে।

খবর মিথ্যে নয়! জগৎ মিত্র সব থেকে বেশি চোট পেয়েছিলেন মাথায়। দেরাদুনের ডাক্তাররা সেই কারণেই অবস্থা আশংকাজনক ঘোষণা করেছিলেন। অবশ্য দুদিন বাদে তারা ফাড়া কাটার কথাও বলেছেন।

রাতে ঘুমের ওষুধের ঘোরে জগৎ মিত্র বেশ বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে। চোখ মেলে তাকাতেই মাথার পাশের চেয়ারে যাকে দেখল সে স্বপ্ন না সত্যি–হঠাৎ ভেবে পেল না।

রত্না। সে চোখ মেলে তাকাতে চেয়ারটা আরো একটু কাছে টেনে নিয়ে এলো।

দুজনে দুজনার দিকে চেয়ে আছে।

দ্বিতীয় বাসর এখানেই শেষ।

চেয়েই আছে।

.

মোহিনী সরকারের বলার ফাঁকে তার গেলাসের শেষের হাফ শেষ। আর মহাদেব গাঙ্গুলির তৃতীয় গেলাসও শেষ। তিনি বললেন, আপনি তো খুব মন দিয়েই গল্পটা পড়েছেন দেখছি।

মোহিনী সরকার এখন একটু মেজাজে আছেন। ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, তাতে কি প্রমাণ হল?

-কিছু না। মহাদেব গাঙ্গুলির গম্ভীর দুচোখ এবার বিভা সরকারের দিকে। গল্পটা আপনার গাঁজাখুরি মনে হয়েছে?

একটু ইতস্তত করে বিভা সরকার জবাব দিলেন, উনি যে-রকম বলছেন, সে রকম নয়। পড়তে তো আমার বেশ ভালোই লেগেছে।… তবে আপনার অন্য বইয়ের মতো অতটা বাস্তব নয়।

-কোন কোন জায়গা অবাস্তব?

বিভা সরকার একটু ফাঁপরে পড়লেন। আগ বাড়িয়ে জবাব দিলেন মোহিনী সরকার। বললেন, আপনি সত্যি বড় লেখক, কিন্তু এই গল্পের কোথায় অবাস্তব আপনার সত্যি চোখে পড়ছে না? এই গল্পের ভিতটাই তো অবাস্তব। বিবাহিত জগৎ মিত্রর ওভাবে এক মেয়ের পাল্লায় পড়া অবাস্তব, রত্নার মতো বউকে ছেড়ে তাকে বিয়ে করা অবাস্তব, সব থেকে বেশি অবাস্তব আপনার কলমের খোঁচায় রত্নাকে আই-এ, বি-এ, এম-এ ভালভাবে পাশ করিয়ে প্রোফেসারির চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া-সেদিক থেকে রবিঠাকুরের সাধারণ মেয়ের অসাধারণ হয়ে ওঠার কল্পনাকে আপনি হার মানিয়েছেন–তারপরে বিরহী নায়কের হিমালয় ভ্রমণ অবাস্তব, অ্যাকসিডেন্ট এত মামুলি বলেই অবাস্তব –মিলনও অবাস্তব। এ সবই লেখকের ইচ্ছেয় হয়েছে।

-বুঝলাম। গম্ভীর মুখে সামান্য মাথা নেড়ে মহাদেব গাঙ্গুলি সায় দিলেন!… মা গঙ্গার আশীর্বাদের অমোঘ ফল বুঝতে পারছি। নড়েচড়ে সোজা হলেন একটু। দুচোখ সোজা নিজের স্ত্রীর মুখের ওপরে।-তুমি কি বলো?

অন্য দুজনের এবার খেয়াল হল, সোমা গাঙ্গুলির সমস্ত মুখ টকটকে লাল। ওই মুখে কেউ যেন হালকা করে আবির গুলে দিয়েছে। আগেও মাঝে মাঝে ওই মুখের ভাবান্তর লক্ষ্য করেছিলেন দুজনেই। তাই তারা অবাকই একটু।

সোমা গাঙ্গুলি বসা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ওদের দুজনের দিকে চেয়ে তেমনি আরক্ত মুখে বললেন, উপন্যাসের সব জায়গায় গায়ক আর গান বদলে লেখক আর লেখা করে নিন, রেকর্ড কোম্পানীর জায়গায় পাবলিশার করুন, ছবির গানের জায়গায় রেডিওর গল্প পড়া করুন–আর… আর (মুখ আরো লাল) নায়ক-নায়িকার নাম দুটো শুধু বদলে নিন–তাহলে কিছুই অবাস্তব নয়–সবই ঘটেছে।

বলতে বলতে সোমা গাঙ্গুলি ঘর ছেড়ে দ্রুত বারান্দায় চলে এলেন।

মোহিনী সরকার আর বিভা সরকারের অবাক দৃষ্টি প্রথমে বারান্দার দিকে। তারপর হতভম্ব বিমূঢ় চোখে পরস্পরের দিকে চেয়ে রইল।

সদা-গম্ভীর মহাদেব গাঙ্গুলির ঠোঁটের ফাঁকে টিপটিপ হাসি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress