হয়তো একদিন
বসন্তকাল আসলেই রিয়ার বুকের ভিতরটা হু হু করে ওঠে। চারি দিকে কত রং কত আনন্দ অথচ ওর জীবনে কোন রং নেই। প্রায় দশ বছর হতে চলল ওর জীবনের সব রং ছিনিয়ে নিয়ে গেছে এই বসন্তকাল। তবু বসন্তকাল ওকে খুব টানে। এবারও বসন্ত উৎসবে রিয়া শান্তিনিকেতনে এসে একা একা দাঁড়িয়ে আছে। দূর থেকে দেখছে কত ছেলে মেয়ে হলুদ পোশাকে সেজে উঠেছে। মেয়েদের কবরীতে পলাশ ফুল, ছেলেদের গলায় পলাশের মালা। সবাই কি এক আমেজে বুঁদ হয়ে রয়েছে।এ হয়তো বসন্তের আমেজ! বিশ্বভারতীর সামনের মাঠটা জুড়ে চলছে বসন্ত উৎসব। নৃত্য-গীতে ভরে উঠেছে প্রাঙ্গণ। সব দেখছে রিয়া দূর থেকে। মাঠের প্রায় শেষে একটা পলাশ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। এই খানেই তো ওর সাথে পলাশের প্রথম পরিচয়।ওরা দুজনেই তখন ওখানকার পড়ুয়া। রিয়া এসেছে কলকাতা থেকে, আর পলাশ এসেছে আসাম থেকে। দুজনের ঘনিষ্ঠতা হয় এই বসন্ত উৎসবকেই কেন্দ্র করে। উৎসবে কি কি নাচ গান হবে সেই সব ঠিক করে রিহার্সাল চলছে। এমন সময় একদিন পলাশ রিয়াকে ডেকে বলল ” শোনো তুমি যে গানটা গাইছ সেই গানটা না করে তুমি এই গানটা করো- ‘বসন্তে আজ ধরার চিত্য হলো উতলা’
রিয়া খুব রেগে গিয়ে বলল “কেন আমি যে গানটা করছি তাতে তোমার কি অসুবিধা?”
“না আমার কোনো অসুবিধা নেই, তবে আমার মনে হয় তোমার কণ্ঠে ওই গানটা বেশি ভালো লাগবে। আমি যা বললাম ভেবে দেখতে পারো একবার।”
রিয়ার প্রথমে খুব রাগ হলেও কেন জানিনা ও পলাশের কথাটা ফেলতে পারে নি। তারপর রিহার্সাল থেকে বেরিয়ে দুজন কিছুক্ষণ গান নিয়ে কথা বলে যে যার হোস্টেলে ফিরে যেত।এই ভাবেই ওরা বুঝতেই পারে নি কখন দুজন দুজনের খুব কাছে চলে এসেছে। রবীন্দ্রসংগীত গাইতে গাইতে কখনো খোয়াই এর ধারে, কখনো সোনাঝুরির বনে দুজনে হাত ধরে হেটে যেত। কত দিন দুজনে বিকেলের সূর্য ডুবে যাওয়া পর্যন্ত চুপ করে দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকেছে।চোখে চোখে কত না বলা কথা বলা হয়ে গেছে। একদিন তখন কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়েছে, ছাত্র-ছাত্রীরা যে যার বাড়ি যাচ্ছে রিয়াও কলকাতায় ফিরবে। আগের দিন পলাশের সঙ্গে দেখা করে অনেকটা সময় দুজনে একান্তে কাটালো। পলাশ শুধুই বলছিল “এবার বাড়ি না গেলেই নয়?”
“না গো! আমার মা তাহলে বাবাকে পাঠিয়ে দেবে আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি দু সপ্তাহ বাদেই ফিরে আসবো। তুমি বাড়ি যাবে না?”
“না আমি বাড়ি যাবো না। আমার বাড়িতে আমার জন্য অপেক্ষা করার মা তো নেই! তাই আমি এবার বাড়ি যাবো না।”
পলাশের এই কথায় রিয়ার মনে হলো ও মা’র কথা না বললেই পারতো। পলাশের এটা একটা ব্যথার জায়গা। গত বছর ওর মা হঠাৎ মারা যান। তারপর থেকে মা’র কথা উঠলে পলাশ খুব কষ্ট পায় তা ওর মুখ দেখলেই বোঝা যায়। ওই জন্য রিয়াও পারতপক্ষে মা’র প্রসঙ্গ পলাশের সামনে উত্থাপন করে না। কিন্তু আজ অতো খেয়াল করেনি এমনিই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। “রিয়া বলল তুমি দেখবে মাত্র পনের দিন দেখতে দেখতেই কেটে যাবে।”
পনের দিন বাদে রিয়া ফিরে এসে পলাশের খোঁজে ছেলেদের হোস্টেলে গিয়ে দারোয়ানকে পলাশের কথা জিজ্ঞেস করলে দারোয়ান বলল “পলাশ দাদা তো কদিন আগে চলে গেছে।”
“পলাশ চলে গেছে?” কথাটা বলে রিয়া মনে মনে ভাবছে কোথায় গেল? তবে কি বাড়ি গেছে? আর কদিন পরেই তো বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে তখন ঠিক এসে পড়বে।
এর পর কলেজ খুলল। কিন্তু পলাশ এলো না। দিন গড়িয়ে মাস গেল, মাস গড়িয়ে বছর, না,পলাশ এলো না; রিয়া অনেক কষ্টে পড়াশোনায় মন বসাতো। বার বার পলাশের মুখটা ওর করুন চাহনি ওর আকুতি “এবার বাড়ি না গেলেই নয়?” রিয়ার মনে পড়তো। ওর মন বিচলিত করে দিত। বুকের মধ্যে চাপা ব্যাথা যেন মোচড় দিয়ে উঠত। এর মধ্যে ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেছে।পরীক্ষা দিয়ে রিয়া বাড়ি চলে এলো। কিন্তু পলাশকে কিছুতেই ভুলতে পারছিল না। পলাশের জন্য রিয়া প্রতি বার বসন্ত উৎসবে এই শান্তিনিকেতনে ফিরে আসে। হঠাৎ একজন এসে ওর গলায় একটা পলাশ ফুলের মালা পরিয়ে দিল। রিয়া চমকে উঠলো; পলাশ! তার সামনে দাঁড়িয়ে! ভুল ভাঙলো পাগলটার মুখের দিকে ভালোকরে চেয়ে।
কোন এক অমোঘ টানে রিয়া বার বার ফিরে আসে এই বসন্ত উৎসবে; কোথাও ক্ষীণ আশা পলাশ একদিন ফিরে আসবে। তার জীবনে আবার রঙিন বসন্ত আসবে।