কল্লোলিনী তিলোত্তমা
আজ ২৪ আগস্ট। আমার জন্মদিন। আমি শুনাছি
১৬৯০ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলা জোব চার্নক্য আমার মাটিতে পা রেখেছিলেন। সেই থেকে দিনটি আমার জন্মদিন হিসেবে পালিত
হয়ে আসছে।ব্রিটিশ ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ১৬৫৬ সালে ২৬ বছর বয়সে ভারতে
আসেন জোব চার্নক্য।অবশ্য আমার জন্মদিন নিয়ে বহু বিতর্ক রয়েছে। তবুও আমাকে নিয়ে সবাই মেতে ওঠে এই একটা দিন।
দেখেছি পলাশীর প্রান্তরে ১৭৫৭ সালে এদেশের
স্বাধীনতার সূর্য ডুব দিয়েছিল। তখন সিরাজদৌল্লাকে পরাজিত করে হত্যা করে রবার্ট ক্লাইভ সদর্পে এসে জাঁকিয়ে বসলেন আমার বুকে।
তখন থেকেই মূর্শিদাবাদ নয় আমি হলাম বঙ্গদেশের রাজধানী। তিলোত্তমা হয়ে গড়ে উঠতে
শুরু করলাম।ডিহি কলকাতা সুতানুটি ও গোবিন্দপুর এই তিন মিলে আমার পত্তন হয় ১৬৯০ সালে।এর আগে ওই,তিন গ্রামের শাসনকর্তা ছিলেন মুঘল অধীনস্থ বাংলার নবাব।
১৬ ৯০ সালের ২৩ এপ্রিল এক আদেশনামায়
মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব বার্ষিক তিন হাজার
টাকা শুল্কের বিনিময়ে ইংরাজদের বাংলায় বাণিজ্যের অনুমতি দেন।ফিরে আসেন চার্নক্য
সুতানুটিতে ২৪ আগস্ট। বাণিজ্য সনদ লাভ করে
দুর্গবেষ্টিত বাণিজ্যকুঠি তারা গড়ে তুলেছিল আমার বুকেই। শুনেছি সাবর্ণ চৌধুরীর থেকে
ওরা আমাকে কিনে নিয়েছিল মাত্র ১৭৬০ টাকায়।
পত্তনের পর থেকে ক্রমশ বাড়তে থাকে আমার গৌরব। ইংরেজরা আমাকেই গড়ে তুললেন প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে আমার মালিকানা ইংরেজদের হাতে চলে যায়।যুদ্ধে জেতার পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার যে বিপুল সম্পদ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হস্তগত হয়েছিল, তা দিয়ে আমার উন্নয়নের কাজ শুরু হয়। ১৭৭২ সালে তৎকালীন বড়লাট লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদকে সরিয়ে আমাকে রাজধানী করেন।এতদিন শুধু বাণিজ্যিক গুরুত্ব ছিল আমার। হেস্টিংসের এই সিদ্ধান্তে রাতারাতি আমার রাজনীতিক, প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক গুরুত্বও বেড়ে যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাংলা তথা ভারতে যে নবজাগরণ শুরু হয়েছিল, তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম আমি।
ব্রিটিশ শাসনের কিছু গৌরবজনক ঘটনার সাক্ষী হই আমি। যেমন ১৮৩৫ সালে এশিয়ার প্রথম মেডিকেল কলেজ স্থাপিত হয় কলকাতাতেই। কলকাতা মেডিকেল কলেজে তখন এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকেও ছেলেরা পড়তে আসত। ১৮৫৭ সালে তৈরি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল গোটা পূর্ব ভারতে (এখনকার বাংলাদেশ ধরে) প্রথম এমন কুলীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৯১১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত ভারতবর্ষের রাজধানী ছিলাম আমি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার পর থেকেই আমার দুর্দশা শুরু। তখন থেকে আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়তে শুরু করি আমি।এর পর খাদ্য সঙ্কট, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীদের আগমন আমাকে সঙ্কটে ফেলে। সেই থেকে সঙ্কটের বৃত্ত কেটে
আজও আমি বেরোতে পারিনি। ক্রমশ অধোগতি আমার।শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প ও কর্মসংস্থান, পরিকাঠামো সব দিক থেকেই আমি এখন মুম্বই, ব্যাঙ্গালোর, চেন্নাই, হায়দরাবাদের কাছে হেরো।
আমার ৩২৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আমার বিভিন্ন প্রান্তে নানা বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান হচ্ছে। আজ আমি খুবই খুশি। সকলের উৎসাহ উদ্দীপনায় আমি জবুথবু না থেকে প্রগতির লক্ষ্যে দৌড় শুরু করব এটাই আমার আজকের মনবাসনা।
আমি ভালবাসি মানুষ। তাই প্রতিদিন আমার বুকে
ভিড় করেন অসংখ্য মানুষ। বনেদীয়ানার সঙ্গে
আধুনিকতার মেল বন্ধন ঘটিয়েছি আমি।আজও
মনে হয় আমি চিরহরিৎ। জাত পাত ধর্ম সব ভুলে
সবাইকে বুকে আগলে রেখেছি আমি।আমার
জন্মদিনে সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক ভালবাসা ও শুভেচ্ছা।
ভালো থেকো আমার সকল মানবজাতি।