অভিজিৎকে কেন মরতে হলো
কেন অভিজিৎ গেল দেশে! সম্ভবত ফেসবুকে দেওয়া হুমকিকে বড় কোনও হুমকি বলে মনে করেনি। আমাকেও তো ফেসবুকে-টুইটারে-ইমেইলে হত্যার হুমকি দেয়। লোকেরা। আমি তো গা করি না। তাঁর বাবাও বলেছিল দেশে না যেতে। দেশে না যেতে তো আমাকেও কত লোকে বলে, তারপরও তো আমি মনে করি, যে করেই হোক দেশে যাবোই আমি। অভিজিৎএর জায়গায় আমি হলে আমি হয়তো ঠিক তা-ই তা-ই করতাম, অভিজিৎ যা যা করেছে। আমাকে যদি দেশে ঢুকতে দিত সরকার, বইমেলায় আমি ঠিক ঠিক যেতাম, বিশেষ করে সে বইমেলায় যদি আমার দুটো নতুন বই বের হয়ে থাকে। একজন লেখকের জন্য বইমেলায় ঘুরে বেড়ানো, বইয়ে অটোগ্রাফ দেওয়া, পাঠকের সঙ্গে মত বিনিময় করা যে কী ভীষণ আনন্দের, তা সব লেখকই জানেন।
এখন আমি জানি, দেশে যদি বাস করতাম আমি, বা দেশে যদি কখনও বেড়াতেই যেতাম, আমাকে ঠিক এভাবে অনেক আগেই কুপিয়ে মেরে ফেলতো ওরা, যেভাবে অভিজিৎকে মেরেছে। আশি নব্বই এর দশকে বড় বড় মুফতি, ইমাম, মাদ্রাসায় পড়া মাতব্বর গোছের লোকেরা ফতোয়া দিত, মানুষের মাথার দাম ঘোষণা করতো। লক্ষ লোক মিছিল করতো, লং মার্চ করতো। আজকাল ফেসবুকে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা মেরে ফেলার হুমকি দেয়। যাকে হুমকি দেয়, তাকে ঠিক ঠিক একদিন পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে, ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মারে। চোখে পড়ার মতো এই বদলটাই সম্ভবত বাংলাদেশে গত কবছরে হয়েছে।
অভিজিতের নৃশংস হত্যাকাণ্ড দেখার পর দেশে ফেরার আমার যে দুর্দমনীয় ইচ্ছে ছিল, সেটি মরে পড়ে রয়েছে উপুড় হয়ে, যেভাবে অভিজিৎ পড়ে ছিল নিজের রক্তের ওপর। একুশ বছর আমি দেশে নেই, এ কারণে নিরন্তর বয়ে বেড়িয়েছি এক দুঃখের বোঝা। দুঃখগুলো এখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। ভাগ্যিস আমাকে দেশে ঢুকতে দেয়নি বাংলাদেশের কোনও সরকারই। ঢুকতে দিলে আমি দেশে ফিরতাম। আগে না জানলেও এখন বেশ জানি যে দেশে ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যে আমার নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে থাকতে হতো আমাকে, কোপানো মস্তিষ্কের টুকরো ভেসে থাকতো রক্তে।
ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা একদিনে বাড়েনি বাংলাদেশে। উনসত্তরের গণআন্দোলন দেখেছি, একাত্তরের যুদ্ধ দেখেছি, মৌলবাদের লম্ফ ঝম্ফ দেখিনি। আশির দশকে ধর্মের এবং ধর্মের মহাপুরুষদের নিন্দা করে আমার যেসব কলাম ছাপা হত বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, তা আজ কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। হ্যাঁ, সেসব কলামে ধর্ম নিয়ে আমার ভিন্নমত ছিল। আজ ভিন্নমতের কোনও স্থান বাংলাদেশের সমাজে নেই। মানুষ কী খাবে, কী পান করবে, কী গান শুনবে, কী ছবি আঁকবে, কী ভাববে, কী পড়বে, কী লিখবে, কী বলবে, কোথায় যাবে, কোথায় যাবে না, কী পোশাক পরবে, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে শোবে –তা বলে দেওয়ার লোক বাড়ছে। মনস্টার বাড়ছে। তাদের আদেশ অমান্য করলে রাজপথে নিজের রক্তের ওপর উপুড় হয়ে মরে পড়ে থাকতে হবে।
আমার মনে হয়, বাংলাদেশের প্রগতিশীল মানুষেরা যদি ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের শক্ত হাতে দমন করতো, তাহলে ওদের এত বাড় বাড়তো না। কী করে ভুলবো নব্বইয়ের শুরুর দিকে কী ঘটেছিল। আমার মাথার মূল্য ধার্য করা হচ্ছে, আমার ফাঁসির জন্য সারা দেশ জুড়ে মৌলবাদীরা তাণ্ডব করছে, ইসলামী ঐক্যজোট মরিয়া হয়ে উঠছে আমাকে হত্যা করার জন্য, মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে, মামলা করছে, গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হচ্ছে–কোনও লেখকের ওপর দেশজুড়ে অমন ভয়ংকর দুর্যোগ এর আগে আসেনি। প্রগতিশীলরা তখন বেশির ভাগই মুখ বন্ধ করে ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল। বেরিয়েছে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেউ আমার নাম উচ্চারণ করেনি। করবে কেন? নাস্তিক নারীবাদীর বিরুদ্ধে শুধু যে মৌলবাদীরাই নয়, মৌলবাদীবিরোধীরাও। পুরুষতন্ত্রবিরোধী নাস্তিক নারীবাদীদের মত প্রকাশের অধিকারে বাংলাদেশের মৌলবাদী গোষ্ঠী এবং মৌলবাদবিরোধী ধার্মিক গোষ্ঠী কোনও গোষ্ঠীই বিশ্বাস করে না। দেশসুদ্ধ লোকের সামনে আমাকে আমার দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হল, এবং একুশ বছর হয়ে গেল, দেশে আজও পা রাখতে দেওয়া হয়নি। এর কোনও প্রতিবাদ সত্যিকার অর্থে হয়নি। প্রতিবাদ একা আমিই নিরলস করে গেছি। আজও করি। নিজের জন্য নয়, দেশটার জন্য করি। কারণ আমি জানি, অন্যায়ের প্রতিবাদ না করলে অন্যায়টা বড় হতে হতে অজগরের মতো হয়ে যায় আর যাকে সামনে পায়। তাকেই গিলে খায়।
৮০
মৌলবাদীদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে দেশের তথাকথিত প্রগতিশীলরা আমার বিরুদ্ধে গত দুদশক ধরে মিথ্যে অপবাদ রটিয়েছে পত্র-পত্রিকায়। প্রগতিশীল নামে খ্যাত সুবিধেবাদীগুলো চুপচাপ দেখে গেছে মানুষের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে এই ছুতোয় সরকার একের পর এক আমার বই নিষিদ্ধ করেছে। কোনও কোনও সময় তো নিজেরাই আদালতে গিয়ে বই নিষিদ্ধ করেছে। নারীবাদী সমিতির নির্বোধ নারীরা আমাকে দোষ দিয়েছে আমি নাকি মৌলবাদীদের উত্থানের কারণ। তাদের এটুকু বোঝার ক্ষমতা হয়নি যে আমার লেখার কারণে মৌলবাদের উত্থান হয়নি। মৌলবাদের উত্থানের পেছনে অনেক কারণের মধ্যে একটি কারণ তাদের মৌনতা এবং আপোস। মৌলবাদীরা আমাকে চায়নি, সুতরাং ওদের খুশি করার জন্য, ওদের জিতিয়ে দেওয়ার জন্য সরকার আমাকে তাড়িয়েছে। জনগণ তা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে। এই তো ছিল ঘটনা! মৌলবাদীরা কি আর তারপর হাত গুটিয়ে গুহায় বসে থেকেছে? তারা যা ইচ্ছে তাই করার সবুজ সংকেত পেয়ে গেছে। তাই মহাউৎসাহে নেমে পড়লো একের পর এক বাক-স্বাধীনতা হরণে। মুক্তচিন্তার মানুষের ওপর ক্রমাগত আঘাত আসতে লাগলো, আসলে লাগলো খুনের হুমকি, বীভৎস শারীরিক আক্রমণ, খুনের চেষ্টা, খুন।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, সেদিন যদি আমার ওপর মৌলবাদী আর সরকারী নির্যাতনকে রোধ করা হতো, তবে মৌলবাদীর পেশিতে হয়তো এত শক্তি আসতো না, তাদের আত্মবিশ্বাস এত ভয়ংকরভাবে বাড়তো না। যদি আমার নির্বাসনকে সেদিন বন্ধ করা যেতো, তবে মৌলবাদী অপশক্তিকে অন্তত বুঝিয়ে দেওয়া যেতো, তাদের জয় অনিবার্য নয়।
ধর্মান্ধ বর্বরদের সঙ্গে বছরের পর বছর আপোস করতে থাকলে শেষ অবধি এই দাঁড়ায়। সমাজটা পচে গলে নষ্ট হয়ে যায়। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের অবস্থা আজ পচা গলা। আশির দশকের মাঝামাঝি প্রেসিডেন্ট এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম নিয়ে এলো, যদিও কেউ তাকে রাষ্ট্রধর্ম আনার জন্য অনুরোধ বাআবদার করেনি। সেই থেকে ইসলামের জয়জয়কার শুরু হয়ে গেল সমাজে। ইসলামি ব্যাংক, ইসলামি ইস্কুল, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি নার্সিং হোম, ইসলামি হাসপাতাল….. সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে গেল ইসলাম, প্রবেশ করে গেল ভিনদেশি পোশাক এবং আচার আচরণ। নানা ধর্মের লোক যেখানে বাস করে, সেখানে তুমি কোনও একটা ধর্মকে রাষ্ট্র ধর্ম বানাতে পারো না। বানালে সেই ধর্মটি অন্য ধর্মের চেয়ে গুরুত্ব বেশি পায়। এবং সেই ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষদের চেয়েও বেশি প্রাধান্য পায়, গণতন্ত্র বা সমানাধিকার বলে বলে কিছু আর অবশিষ্ট থাকে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম আসার পর থেকে অমুসলিম সংখ্যা কমতে কমতে, মুসলিম সংখ্যাকে আট থেকে নয়ের ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে চললে ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হয়ে উঠতে খুব বেশি সময় নেবে না বাংলাদেশ। ১০০ ভাগ মুসলিমের দেশ হওয়ার আভাসটা এরকমই দেখতে পাচ্ছি। অমুসলিমরা বিদেয় হলে কি মুসলিমারা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে? আমার কিন্তু তা মনে হয় না। যত বেশি মুসলমান, তত বেশি মৃত্যু। সুন্নিরা শিয়া মারছে, নাস্তিক মারছে, আহমদিয়া মারছে; শিয়ারা সুন্নি মারছে, কাফের মারছে। তাদের হাতে শুধু তরবারির ঝনঝনানি। আইসিসরাই দেখিয়ে দিচ্ছে, খাঁটি মুসলমানের দেশ বলতে ঠিক কী বোঝায়। খাঁটি মুসলমানের দেশে ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটা, সত্যি বলতে কী, চলে না।
ধর্মনিরপেক্ষ জিনিসটায় আজকাল আমি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি মনে করি না সব ধর্ম সমান। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মকে আমি সমান বলে মনে করিনা। ইহুদি আর জৈন ধমর্কেও নয়। বর্বরতাগুলো একেক ধর্মে একেকরকম। তবে নিরপেক্ষ কী করে হবে মানুষ? যদি দুই বর্বরের মধ্যে এক বর্বরের পাশে আমাকে দাঁড়াতেই হয়, তবে তুলনায় কম বর্বরের পাশেই দাঁড়াবো। তাই নয় কি? যেহেতু ধর্মগুলো বর্বরতার দিক দিয়ে বা উদারতার দিক দিয়ে সমান নয়, তাই সকল ধর্মের প্রতি সবারই সমান শ্রদ্ধাশীল হওয়া এবং সকল ধর্মের প্রতি নিরপেক্ষ থাকাও সম্ভব নয়। বরং সকল মানুষকে, সে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান, ইহুদি, জৈন, শিখ, নাস্তিক যাই হোক– সমান চোখে দেখাটা সম্ভব হতে পারে। আমি মনে করি মানুষ হিসেবে প্রত্যেকের অধিকার সমান হওয়া উচিত। সে ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার বদলে বিশ্বাসী-নিরপেক্ষতা অথবা এরকম একটি শব্দ আমাদের ব্যবহার করা উচিত। যে কোনও ধর্মে এবং ধর্মহীনতায় বিশ্বাসীদের আমি নিরপেক্ষ ভাবেই দেখি যতক্ষণ না তারা কোনও অপরাধ করছে।
কে মেরেছে অভিজিৎকে? ফারাবি? খুনীরা কি ফেসবুকে বলে বেড়ায় আমি খুন করব? আইসিসএর রাজ্যে বলে। কিন্তু এখনো তো বাংলাদেশ পুরোপুরি আইসিস রাজ্য হয়ে ওঠেনি। আমার মনে হয় ফারাবীর চেয়েও ভয়ংকর জিহাদী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অভিজিৎকে হত্যা করেছে। যে-ই করুক, খুনী ধরা পড়ক চাই। খুনীর শাস্তি হোক চাই। আমি বরাবরই মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইদানীং প্রায়ই আমার মনে হয়, আইসিসরা, বোকো হারামরা, আল শাবাবরা, আর বাংলাদেশে রাজিব হায়দার, হুমায়ুন আজাদ আর অভিজিৎ রায়ের খুনীদের মৃত্যুদণ্ড হলে আমি অখুশী হবো না।
খুনীদের যে শাস্তিই হোক, অভিজিৎ আর ফিরে আসবে না। বাঙালিকে মানুষ বানাবার স্বপ্ন আর সে দেখবে না। একজন প্রতিভাবান বাঙালিকে, যে দেশ আর দশের জন্য খুব জরুরি কাজ করছিল, বাঙালিরাই মেরে ফেললো। টিএসসির সামনে যে ফুটপাতে অভিজিৎকে খুন করা হয়েছে, তার রক্তের ওপর মস্তিষ্কের কাটা টুকরো আর তার চশমাটা ভাসছিল ঠিক যে জায়গাটায়, সে জায়গায় একটা মনুমেন্ট গড়া হোক। মুক্তমনা মনুমেন্ট। মানুষ খুব দ্রুত অতীতকে ভুলে যায়। মনুমেন্টটা থাকলে ভুলতে চাইলেও ভুলতে পারবে না। মনুমেন্টটাই এ দেশের মানুষকে প্রতিদিন মনে করিয়ে দেবে যে ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ, কুসংস্কার, নারীবিদ্বেষ, বৈষম্য ইত্যাদিকে পরাজিত করে মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা, সমতা, বাক স্বাধীনতা যদি সামনে না এগোয়, তবে অচিরেই জাতি হিসেবে বাঙালির মুখ থুবড়ে পড়ে মৃত্যু ঘটবে।