হাইকোর্টে দেবকুমারবাবুর মামলা
হাইকোর্টে দেবকুমারবাবুর মামলা শেষ হইয়া গিয়াছিল।
মাঘ মাসের মাঝামাঝি। শীতের প্রকোপ অক্সে অল্পে কমিতে আরম্ভ করিয়াছে। মাঝে মাঝে দক্ষিণা বাতাস গায়ে লাগিয়া অদূর বসন্তের বার্তা জানাইয়া দিলেও, সকালবেলায় সোনালী রৌদ্রটুকু এখনও বেশ মিঠা লাগে।
সেদিন সকালে আমি একাকী জানালার ধারে বসিয়া রৌদ্র সেবন করিতে করিতে সংবাদপত্রের পাতা উল্টাইতে ছিলাম। ব্যোমকেশ প্রাতরাশ শেষ করিয়াই কি একটা কাজে বাহির হইয়া গিয়াছিল; বলিয়া গিয়াছিল, ফিরিতে দশটা বাজিবে।
খবরের কাগজে দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমার শেষ কিস্তির বিবরণ বাহির হইয়াছিল। কাগজে বিবরণ পড়বার আমার কোনও দরকার ছিল না, কারণ আমি ও ব্যোমকেশ মােকদ্দমার সময় বরাবরই এজলাসে হাজির ছিলাম। তাই অলসভাবে কাগজের পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে ভাবিতে ছিলাম–দেবকুমারবাবুর অসম্ভব জিদের কথা। তিনি একটু নরম হইলে হয়তো এতবড় খুনের মোকদ্দমা চাপা পড়িয়া যাইত; কারণ উচ্চ রাজনীতি পিনাল কোডের শাসন মানিয়া চলে না। কিন্তু সেই যে তিনি জিদ ধরিয়া বসিলেন আবিষ্কারের ফরমুলা কাহাকেও বলিবেন না–সে-জিদ হইতে কেহ তাঁহাকে টলাইতে পারিল না। দেশলাই কাঠি বিশ্লেষণ করিয়াও বিষের মূল উপাদান ধরা গেল না। অগত্যা আইনের নাটিকা যথারীতি অভিনীত হইয়া এই শোচনীয় ব্যাপারের শেষ অঙ্কে যবনিকা পড়িয়া গেল।
চিন্তা ও কাগজ পড়ার মধ্যে মনটা আনাগোনা করিতেছিল, এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। উঠিয়া গিয়া ফোন ধরিলাম। দারোগা বীরেনবাবু থানা হইতে ফোন করিতেছেন, তাঁহার কণ্ঠস্বরে একটা উত্তেজিত ব্যগ্রতার আভাস পাইলাম।
‘ব্যোমকেশবাবু আছেন?’
‘তিনি বেরিয়েছেন। কোনও জরুরী দরকার কি?’
‘হ্যাঁ–তিনি কখন ফিরবেন?’
‘দশটার সময়।’
‘আচ্ছা, আমিও দশটার সময় গিয়ে পৌঁছুব। একটা খারাপ খবর আছে।’
খবরটা কি জিজ্ঞাসা করিবার পূর্বেই বীরেনবাবু ফোন কাটিয়া দিলেন।
ফিরিয়া গিয়া বসিলাম। ঘড়িতে দেখিলাম বেলা নটা। মন ছটফট করিতে লাগিল, তবু সংবাদপত্রটা তুলিয়া যথাসম্ভব ধীরভাবে দশটা বাজার প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম।
কিন্তু দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে হইল না, সাড়ে ন’টার পরই ব্যোমকেশ ফিরিল।
বীরেনবাবু ফোন করিয়াছেন শুনিয়া সচকিতভাবে বলিল, ‘তাই নাকি! আবার কি হল?’
আমি নীরবে মাথা নাড়িলাম। ব্যোমকেশ তখন পুঁটিরামকে ডাকিয়া চায়ের জল চড়াইতে বলিল; কারণ, বীরেনবাবুকে অভ্যর্থনা করিতে হইলে চায়ের আয়োজন চাই; চা সম্বন্ধে তাঁহার এমন একটা অকুণ্ঠ উদারতা আছে যে তুচ্ছ সময় অসময়ের চিন্তা উহাকে সঙ্কুচিত করিতে পারে না।
চায়ের হুকুম দিয়া ব্যোমকেশ চেয়ারে হেলান দিয়া বসিয়া সিগারেট বাহির করিল; একটা সিগারেট ঠোঁটে ধরিয়া পকেট হইতে দেশলাই বাহির করিতে করিতে বলিল, ‘বীরেনবাবু যখন বলেছেন খারাপ খবর, তার মানে গুরুতর কিছু। হয়তো—‘
ব্যোমকেশ হঠাৎ থামিয়া গেল। আমি মুখ তুলিয়া দেখিলাম সে বিস্ময়-বিমূঢ়ভাবে হস্তধৃত দেশলায়ের বাক্সটার দিকে তাকাইয়া আছে।
ব্যোমকেশ মুখ হইতে অ-জ্বলিত সিগারেট নামাইয়া ধীরে ধীরে বলিল, ‘এ তো বড় আশ্চর্য ব্যাপার দেখছি! এ দেশলায়ের বাক্স আমার পকেটে কোথা থেকে এল?’
‘কোন দেশলায়ের বাক্স?’
ব্যোমকেশ বক্সটা আমার দিকে ফিরাইল। দেখিয়া কিছু বুঝিতে পারিলাম না, সাধারণ দেশলায়ের বাক্স যেমন হইয়া থাকে উহাও তেমনি, কোন বৈশিষ্ট্য নাই।
আমি অবাক হইয়া তাকাইয়া আছি দেখিয়া ব্যোমকেশ পূর্ববৎ ধীরস্বরে বলিল ‘দেখতে পাচ্ছ বোধহয়, বাক্সটার ওপর যে লেবেল মারা আছে তাতে একজন সত্যাগ্ৰহী কুডুল কাঁধে করে তালগাছ কাটতে যাচ্ছে। অথচ আমাদের বাসায়–’
আমি তাড়াতাড়ি বলিলাম, ‘বুঝেছি, ঘোড়া মার্কা ছাড়া অন্য দেশলাই আসে না।’
‘ঠিক। সুতরাং আমি যখন বেরিয়েছিলুম। তখন আমার পকেটে স্বভাবতই ঘোড়া মাকৰ্গ দেশলাই ছিল। ফিরে এসে দেখছি সেটা সত্যাগ্ৰহীতে পরিণত হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আজকালিকার এই স্বরাজ-সাধনার যুগেও এতটা পরিবর্তন সম্ভব হয় কি করে? তারপর গলা চড়াইয়া ডাকিল, ‘পুঁটিরাম ‘
পুঁটিরাম আসিল।
‘এবার বাজার থেকে কোন মার্কা দেশলাই এনেছ?’
‘আজ্ঞে, ঘোড়া মার্কা।’
‘কত এনেছ?’
‘আজ্ঞে, এক বাণ্ডিল।’
‘সত্যাগ্ৰহী মার্কা আনোনি?’
‘আজ্ঞে, না।’
‘বেশ, যাও।’
পুঁটিরাম প্রস্থান করিল।
ব্যোমকেশ ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া দেশলায়ের বাক্সটার দিকে তাকাইয়া রহিল; ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘মনে পড়ছে, ট্রামে যেতে যেতে সিগারেট ধরিয়েছিলুম, তখন পাশের ভদ্রলোক দেশলাইটা চেয়ে নিয়েছিলেন। তিনি সিগারেট ধরিয়ে সেটা ফেরৎ দিলেন, আমি না দেখেই পকেটে ফেললুম;–অজিত!’
‘কি?’
উঠিয়া দাঁড়াইয়া সে বলিল, ‘অজিত, সেই লোকটাই দেশলায়ের বাক্স বদলে নিয়েছে।’ দেখিলাম, তাহার মুখ হঠাৎ কেমন ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘লোকটা কে? তার চেহারা মনে আছে?’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল, ‘না, ভাল করে দেখিনি। যতদূর মনে পড়ছে মাথায় মাঙ্কিক্যাপ ছিল, আর চোখে কালো চশমা–’ ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিল, তারপর ঘড়ির দিকে তাকাইয়া বলিল, ‘বীরেনবাবুকখন আসবেন বলেছেন?
‘দশটায়।‘
‘তাহলে তিনি এলেন বলে। অজিত, বীরেনবাবু আজ কেন আসছেন জানো?’
‘না—কেন?’
‘আমার মনে হয়-আমার সন্দেহ হয়–‘
এই সময় সিঁড়িতে বীরেনবাবুর ভারী পায়ের শব্দ শোনা গেল, ব্যোমকেশ কথাটা শেষ করিল না।
বীরেনবাবু আসিয়া গভীর মুখে উপবেশন করিলেন। ব্যোমকেশ তাঁহাকে সিগারেট দিয়া বলিল, ‘নিজের দেশলাই দিয়ে ধরান। দেবকুমারবাবুর দেশলায়ের বাক্স কবে চুরি গেল?’
‘পরশু’–বলিয়াই বীরেনবাবু বিস্ফারিত নেত্ৰে চাহিলেন–’আপনি জানলেন কোত্থেকে? একথা তো চাপা আছে, বাইরে বেরুতে দেওয়া হয়নি।’
‘স্বয়ং চোর আমাকে খবর পাঠিয়েছে’–বলিয়া ব্যোমকেশ ট্রামে দেশলাই বদলের ব্যাপারটা বিবৃত করিল।
বীরেনবাবু গভীর মনোযোগ দিয়া শুনিলেন, তারপর দেশলায়ের বাক্সটা উল্টাইয়া পাল্টাইয়া দেখিয়া সন্তৰ্পণে সরাইয়া রাখিয়া বলিলেন, ‘এর মধ্যে একটা মারাত্মক কাঠি আছে–বাপ! লোকটা কে আপনার কিছু সন্দেহ হয় না?’
‘না। তবে যেই হোক, আমাকে যে মারতে চায়, তাতে সন্দেহ নেই।’
‘কিন্তু কেন? এত লোক থাকতে আপনাকেই বা মারতে চাইবে কেন?’
আমি বলিলাম, ‘হয়তো সে মনে করে ব্যোমকেশকে মারতে পারলে তাকে ধরা কঠিন হবে তাই আগেভাগেই ব্যোমকেশকে সরাতে চায়।’
ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল—’আমার তা মনে হয় না। পুলিসের অসংখ্য কর্মচারী রয়েছেন যাঁরা বুদ্ধিতে কর্মদক্ষতায় আমার চেয়ে কোনো অংশ কম নয়। বীরেনবাবুর কথাই ধর না। চোরের যদি সেই উদ্দেশ্যই থাকতে তাহলে সে আমাকে না মেরে বীরেনবাবুকে মারবার চেষ্টা করত।’
প্ৰশংসাটা কিছু মারাত্মক জাতীয় হইলেও দেখিলাম বীরেনবাবু মনে মনে খুশি হইয়াছেন। তিনি বলিলেন, ‘না-না—তবে-অন্য কি কারণ থাকতে পারে?’
ব্যোমকেশ ভাবিতে ভাবিতে বলিল, ‘সেইটেই ঠিক ধরতে পারছি না। যতদূর মনে পড়ছে আমার ব্যক্তিগত শত্ৰু কেউ নেই।’
বীরেনবাবু ঈষৎ বিস্মিতভাবে বলিয়া উঠিলেন, ‘বলেন কি মশায়! আপনি এতদিন ধরে চোর-ছাঁচড় বদমায়েসের পিছনে লেগে আছেন, আর আপনার শত্ৰু নেই! আমাদের পেশাই তো শত্ৰু তৈরি করা।’
এই সময় পুঁটিরাম চা লইয়া আসিল। একটা পেয়ালা বীরেনবাবুর দিকে আগাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ মৃদুহাস্যে বলিল, ‘তা বটে। কিন্তু আমার অধিকাংশ শত্ৰুই বেঁচে নেই। যা হোক, এবার বলুন তো কি করে জিনিসটা চুরি গেল?’
বীরেনবাবু চায়ে এক চুমুক দিয়া বলিলেন, ‘ঠিক কি করে চুরি গেল তা বলা কঠিন। আপনি তো জানেন দেশলায়ের বাক্সটা দেবকুমারবাবুর মোকদ্দমায় একজিবিট ছিল, কাজেই সেটা পুলিসের তত্ত্বাবধান থেকে কোর্টের এলাকায় গিয়ে পড়েছিল। পরশু মোকদ্দমা শেষ হয়েছে, তারপর থেকে আর সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর আর কি! সন্দেহের ওপর কয়েকজন আদলি আর নিম্নাতন কর্মচারীকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। কিন্তু ঐ পর্যন্ত, আর কিছু হচ্ছে না। এই নিয়ে ভেতরে ভেতরে মহা হৈচৈ পড়ে গেছে, খোদ গভর্নমেন্টের পর্যন্ত টনক নড়েছে। এখন আপনি একমাত্র ভরসা!’
‘আমাকে কি করতে হবে?’
‘খাস ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট থেকে হুকুম এসেছে, চোর ধরা পড়ুক বা না পডুক, দেশলায়ের বাক্স উদ্ধার করা চাই। এর ওপর নাকি আন্তজাতিক শান্তি নির্ভর করছে।’
‘বুঝলুম। কিন্তু আমাকে যে আপনি এ কাজে ডাকছেন–এতে কর্তৃপক্ষের মত আছে কি?’
‘আছে। আপনাকে তাহলে সব কথা বলি। দেশলায়ের বাক্স লোপাট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেসটা সি আই ডি পুলিসের হাতে যায়। কিন্তু আজ তিন দিন ধরে অনুসন্ধান করেও তারা কোনও হদিস বার করতে পারেনি। এদিকে প্রত্যহ তিন-চার বার গভর্নমেন্টের কড়া তাগাদ আসছে। তাই শেষ পর্যন্ত বড়সাহেব আপনার সাহায্য তলব করেছেন। তাঁর বিশ্বাস এ ব্যাপারে সমাধান যদি কেউ করতে পারে তো সে আপনি।’
ব্যোমকেশ উঠিয়া একবার ঘরময় পায়চারি করিল, তারপর বলিল, ‘তাহলে আর কোনও কথা নেই। কিন্তু–আমি একবার কমিশনার সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই।’
‘আপনি যখন যাবেন তখনই তাঁর সঙ্গে দেখা হবে।’
‘বেশ–একটু চিস্তা করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আজ আর নয়, কাল তাঁর সঙ্গে দেখা করব। আজকের দিনটা আমাকে ভাবতে দিতে হবে।’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘কিন্তু যতই দেরি হবে–‘
‘সে আমি বুঝেছি, কিন্তু তাড়াতাড়ি যাহোক একটা কিছু করলেই তো হবে না। একটা অজানা লোককে ধরতে হবে, অথচ এমন সূত্র কোথাও নেই। যা ধরে তার কাছে পৌঁছুঁতে পারা যায়। একটু বিবেচনা করে পন্থা স্থির করতে হবে না?’
‘তা বটে—‘
‘ইতিমধ্যে যে লোকগুলিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে যদি কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে পারেন তার চেষ্টা করুন। যদি–’
বীরেনবাবু গম্ভীর মুখে একটু হাসিলেন–‘তিন দিন ধরে অনবরত সে চেষ্টা হচ্ছে, কোনো ফল হয়নি। আপনি যদি চেষ্টা করে দেখতে চান, দেখতে পারেন।’
‘পারব মনে হয় না। তারা হয়তো নির্দোষ। যাক, তাহলে ঐ কথা রইল, কাল আমি সাহেবের সঙ্গে দেখা করব; তারপর যাহোক একটা কিছু করা যাবে। এ ব্যাপারে আমার নিজের যথেষ্ট স্বাৰ্থ রয়েছে, কারণ চোর মহাশয় প্রথমে আমার ওপরেই কৃপা-দৃষ্টিপাত করেছেন।’
অতঃপর আরো কিছুক্ষণ বসিয়া বীরেনবাবু গাত্ৰোত্থান করিলেন। তিনি প্ৰস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিয়া গিয়া দেশলায়ের বাক্সটা নিজের লাইব্রেরি। ঘরে রাখিয়া আসিল। তারপর পিছনে হাত রাখিয়া গভীর ভ্রূকুঞ্চিত মুখে ঘরে পায়চারি করিতে লাগিল।
এগারোটা বাজিয়া গেলে পুঁটিরাম আসিয়া স্নানের তাগাদ দিয়া গেল, কিন্তু তাহার কথা ব্যোমকেশের কানে পৌঁছিল না। সে অন্যমনস্কভাবে একটা ‘হুঁ’ দিয়া পূর্ববৎ ঘরময় ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল।
এই সময় ডাকপিওন আসিল। একখানা খাম ব্যোমকেশের হাতে দিয়া বলিল, ‘দেখুন তো এটা আপনার চিঠি কিনা।’
ব্যোমকেশ খামের শিরোনামা দেখিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ, আমারই। কেন বল দেখি?’
পিওন কহিল, ‘নীচের মেসে এক ভদ্রলোক বলছিলেন এটা তাঁর চিঠি।’
‘সে কি! ব্যেমকেশ বক্সী আরো আছে নাকি?’
‘তিনি বললেন, তাঁর নাম ব্যোমকেশ বোস।’
ব্যোমকেশ চিঠিখানা আরো ভাল করিয়া দেখিয়া বলিল, ‘ও–তা হতেও পারে বাগবাজারের মোহর দেখছি।–কলকাতা থেকেই চিঠি আসছে। কিন্তু আমাকে কলকাতা থেকে খামে চিঠি কে লিখবে? যা হোক, খুলে দেখলেই বোঝা যাবে। যদি আমার না হয়—কিন্তু নীচের মেসে ব্যোমকেশ নামে আর একজন আছেন এ খবর তো জানতুম না।’
পিওন প্রস্থান করিল। ব্যোমকেশ কাগজ-কাটা ছুরি দিয়া খাম কাটিয়া চিঠি বাহির করিল, তাহার উপর চোখ বুলাইয়া আমার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বলিল, ‘আমার নয়। কোকনদ গুপ্ত–অদ্ভুত নাম—কখনও শুনেছি বলে মনে হয় না।’
চিঠিতে লেখা ছিল–
সম্মান পুরঃসর নিবেদন,
ব্যোমকেশবাবু্, অনেকদিন আপনার সহিত দেখা হয় নাই, কিন্তু তবু আপনার কথা ভুলিতে পারি নাই। আবার সাক্ষাতের জন্য উন্মুখ হইয়া আছি। চিনিতে পারিকেন তো? কি জানি, অনেকদিন পরে দেখা, হয়তো অধমকে না চিনিতেও পারেন।
আপনার কাছে আমি অশেষভাবে ঋণী, আপনার কাছে আমার জীবন বিক্রীত হইয়া আছে। কিন্তু কর্মের জন্য বহুকাল স্থানান্তরে ছিলাম বলিয়া সে-ঋণের কণামাত্র পরিশোধ করিতে পারি নাই। এখন ফিরিয়া আসিয়াছি, সাধ্যমত চেষ্টা করিব।
আমার কৃতজ্ঞতাপূর্ণ প্রীতিনমস্কার গ্রহণ করিকেন।
ইতি
আপনার গুণমুগ্ধ
শ্ৰীকোকনন্দ গুপ্ত
চিঠিখানা পড়িয়া আমি বলিলাম, ‘এ চিঠি আমাদের পড়া উচিত হয়নি। অবশ্য গোপনীয় কিছু নেই, তবু এমন আন্তরিক কথা আছে যা অন্যের পড়া অপরাধ।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তা তো বুঝছি। প্রেমিক প্রেমিকার চিঠি চুরি করে পড়ার মত এ চিঠিখানা পড়লেও মনটা লজ্জিত হয়ে ওঠে। কিন্তু উপায় কি বল। চিঠি আমার কিনা যাচাই করা চাই তো। কোকনন্দ গুপ্ত বলে কাউকে আমি চিনি না, আর চিনলেও তার কোনও মহৎ উপকার করেছি বলে স্মরণ হচ্ছে না।’
‘তাহলে যার চিঠি তাকে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত।’
‘হাঁ। পুঁটিরামকে ডাকি।’
কিন্তু পুঁটিরাম আসিবার পূর্বেই চিঠির মালিক নিজে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। নীচের মেসের সকল অধিবাসীর সঙ্গেই আমাদের মুখ চেনাচিনি ছিল, ইহাকে কিন্তু পূর্বে দেখি নাই। লোকটি বেঁটে-খাটো দোহারা, বোধ করি মধ্যবয়স্ক–কিন্তু তাঁহার মুখ দেখিয়া বয়স অনুমান করিবার উপায় নাই। কপাল হইতে গলা পর্যন্ত মুখখানা পুড়িয়া, চামড়া কুঁচকাইয়া এমন একটা অস্বাভাবিক আকার ধারণ করিয়াছে যে পূর্বে তাঁহার চেহারা কিরূপ ছিল তাহা অনুমান করাও অসম্ভব। হঠাৎ মনে হয় যেন তিনি একটা বিকট মুখোশ পরিয়া আছেন। মুখে গোঁফ দাড়ি নাই, এমন কি চোখের পল্লব পর্যন্ত চিরদিনের জন্য নষ্ট হইয়া গিয়াছে। চোখের দৃষ্টিতে মৎস্যচক্ষুর ন্যায় অনাবৃত নিষ্পলক ভাব দেখিয়া সহসা চমকিয়া উঠিতে হয়।
ভদ্রলোক ঘরে প্রবেশ করিয়াই আমাদের চোখে ধাঁধা লাগাইয়া দিয়াছিলেন, তাই তাঁহার সহজ সাধারণ কণ্ঠস্বর শুনিয়া যেন রূপকথার রাজ্য হইতে ফিরিয়া আসিলাম। তিনি দ্বারের নিকট হইতে ঈষৎ কুষ্ঠিত স্বরে বলিলেন, ‘আমার নাম ব্যোমকেশ বসু। একখানা চিঠি—‘
ব্যোমকেশ তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিল, ‘আসুন। চিঠিখানা আপনাকে পাঠিয়ে দিচ্ছিলুম। আপনি এসেছেন–ভালই হল। বসুন। কিছু মনে করবেন না, নিজের মনে করে খাম খুলেছিলুম। এই নিন।’
পত্রটা হাতে লইয়া ভদ্রলোক ধীরে ধীরে পাঠ করিলেন, তারপর বলিলেন, ‘কোকনন্দ গুপ্ত! কৈ আমার তো–’ ব্যোমকেশের দিকে চোখ তুলিয়া বলিলেন, ‘আপনার চিঠি নয়? আপনি পড়েছেন নিশ্চয়।’
অপ্ৰস্তুতভাবে ব্যোমকেশ বলিল, ‘পড়েছি, নিজের মনে করে—কিন্তু পড়ে দেখলুম আমার নয়। পিওন বলেছিল বটে। কিন্তু খামের ওপর ‘বোস’ কথাটা এমনভাবে লেখা হয়েছে যে বক্সী বলে ভুল হয়। জানেন বোধহয়, আমার নাম ব্যোমকেশ বক্সী?’
‘জানি বৈকি। আপনি এ মেসের গৌরব; এখানে এসেই আপনার নাম শুনেছি। কিন্তু চিঠিটা আমার কি না ঠিক বুঝতে পারছি না। কোকনদ গুপ্ত নামটা চেনা-চেনা মনে হচ্ছে বটে, তবু–, যা হোক, আপনি যখন বলছেন আপনার নয়। তখন আমারই হবে।’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘মহৎ লোকের পক্ষে উপকার করে ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক।’
‘না না, তা নয়—অনেক দিনের কথা, তাই হঠাৎ মনে পড়ছে না। পরে হয়তো পড়বে।—আচ্ছা, নমস্কার।’ বলিয়া তিনি প্ৰস্থানোদ্যত হইলেন।
ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল, ‘আপনি এ মেসে কত দিন এসেছেন?’
‘বেশি দিন নয়। এই তো দিন পাঁচ-সাত।’
‘ও’-ব্যোমকেশ হাসিল, ‘যা হোক, তবু এতদিনে একজন মিতে পাওয়া গেল। আচ্ছা, নমস্কার। সময় পেলে মাঝে মাঝে আসবেন, গল্প-সল্প করা যাবে।’
ভদ্রলোক আনন্দিতভাবে সম্মতি জানাইয়া প্ৰস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ একবার ঘড়ির দিকে তাকাইয়া জামার বোতাম খুলিতে খুলিতে বলিল, ‘অনেক বেলা হয়ে গেল, চল নেয়ে খেয়ে নেওয়া যাক; তারপর দেশলাই চুরির মামলা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবা যাবে। অনেক ভাববার কথা আছে; যে-বনে শিকার নেই সেই বন থেকে বাঘ মেরে আনতে হবে। আচ্ছা, আমাদের এই দুনম্বর ব্যোমকেশবাবুটকে আগে কোথাও দেখেছ বলে বোধ হচ্ছে কি?’
আমি দৃঢ়স্বরে বলিলাম, ‘না, ও-মুখ কদাচ দেখিনি। তুমি দেখেছি নাকি?’
ব্যোমকেশ ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘উহঁ। কিন্তু ওঁর চলার ভঙ্গীটা যেন পরিচিত, কোথাও দেখেছি। সম্প্রতি নয়-অনেক দিন। যাকগে, এখন আর বাজে চিন্তা নয়।’ বলিয়া মাথায় তেল ঘষিতে ঘষিতে স্নানের উদ্দেশ্যে প্ৰস্থান করিল।