অন্য শিকার
এদিকের জঙ্গলে কখনও আসিনি ঋজুদার সঙ্গে। ঋজুদাও যে এর আগে খুব বেশি এসেছে মধ্যপ্রদেশে, এমনও নয়। তবে, বার দশেক এসেছে। ঋজুদার ভালবাসার জায়গা ছিল হাজারিবাগ, পালামৌ, রাঁচি এবং ওড়িশার মহানদীর অববাহিকা। সুন্দরবন এবং আফ্রিকার কথা বাদ দিয়েই বলছি। এখন তাকে মধ্যপ্রদেশে পেয়েছে। দারুণ লাগে! ঋজুদা বলে।
মিস্টার ভটকাইয়ের মেজকাকা বহুদিন হল মধ্যপ্রদেশে আছেন। ঋজুদা অ্যান্ড কোম্পানিকে বহুবার দাওয়াতও দিয়েছেন। তিনি জবলপুরের পাচপেডিতে থাকেন, সিভিল লাইন্সে। আর্মিতে ফুলকর্নেল ছিলেন। রিটায়ার করে নর্মদায় মাছ ধরছেন আর বড় নাতিকে বাংলা পড়াচ্ছেন। এই তাঁর হোলটাইম অকুপেশান। পার্টটাইম অকুপেশান কাকিমার সঙ্গে ঝগড়া করা। কাকিমা ভাল গান গাইতেন একসময়। এখন মোটে রিয়াজ করেন না। তাই মেজোকাকা ব্যাপারটাকে ঝগড়া না বলে কণ্ঠ-চর্চা বলেন, স্ত্রীকে প্র্যাকটিস দেন, যাতে গলাটা থাকে। কাকার গলা ‘তারা’য় বলে।
ঋজুদাকে তিনি একাধিক চিঠি দিয়েছিলেন আসার আগে নিমন্ত্রণ জানিয়ে। তাই আমাদের এই আগমন। কাকার ভাষায়, ধন্য হলাম আমরা। কাকা ধন্য হলেন অথবা ঋজুদা ধন্য করলেন, তা জানি না। আমি আর ভটকাই রিয়্যালি হ্যাপি।
যতই ঘুরছি, ততই দেখছি ভারী সুন্দর রাজ্য এই মধ্যপ্রদেশ। অনেক জায়গাই দেখা হয়ে গেল এর মধ্যে। মাৰ্বল রক, কানহা, কিসলি, মুক্কি, সুফকর, পাঁচমারি, ইন্দোর, উজ্জয়িন, ভোপাল ইত্যাদি ইত্যাদি।
তিতির আসেনি, তাই ঋজুদা একটু গিলটি ফিল করছে। কিন্তু ভটকাই প্রথম থেকেই তার মতামতে দৃঢ়। সে বলেছে, তোমরা যখন গুগুনোগুম্বারের দেশে এবং রুআহাতে গেলে আফ্রিকায়, তখন তিতিরকেই নিয়ে গেলে। আমার মতো এমন এক কোয়ালিফায়েড জাঙ্গল এক্সপার্ট এবং ক্রাইম-বাস্টারকে রেখে গেলে। আমাকে বললেও না পর্যন্ত একবার। এবার আমারই বন্দোবস্ত। নো মেয়ে-ফেয়ে। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের বই পড়িসনি? কী রে রুদ্র? মেন উইদাউট উইমেন। মেয়েদের নিয়ে অ্যাডভেঞ্চার করা যায়? ছোঃ। পথি নারী বিবর্জিতা।
ঋজুদা বান্ধবগড়ের রাজাদের পুরনো শুটিং লজের বারান্দায় বসে সামনের একটি তেপায়াতে পা তুলে জম্পেশ করে পাইপটা ধরিয়ে একটু হেসে বলল, একেই বলে অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী। ফর হুম দ্য বেল টোলস বুঝি পড়িসনি ভটকাই? অথবা স্লেজ অব কিলিমানজোরো? সেগুলো বুঝি হেমিংওয়ে নয়?
তা পড়েছি। তাতে মেয়েরা আছে। কিন্তু ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি? তাতে? তাতে তো শুধু একটা বুড়ো, একটা ছোট্ট ছেলে আর একটা মস্ত মাছ। সমুদ্র। সমুদ্রই তো আসল।
তাইই বুঝি? ঋজুদা বলল। তারপর বলল, সমুদ্র মোটেই আসল নয়। কী যে আসল, তা তোকে নিজেকেই বের করতে হবে বারবার পড়ে। বিভিন্ন সময়ে পড়ে। সাহিত্য তো ব্যাকরণ নয় রে ভটকাই! সাহিত্য টেম্পারা বা ওয়াশের কাজের ছবির মতন। অথবা অয়েল পেন্টিংয়েরই মতো কোনও ছবি। সময়ের সঙ্গে এর তাৎপর্য ফুটতে থাকে, পরতে-পরতে খুলতে থাকে, সাহিত্য যদি সত্যিকারের সাহিত্য হয়। একই বই, বিভিন্ন বয়সে পড়ে বিভিন্ন মানে আবিষ্কার করবি। আফ্রিকার গোবরাংগোরোর বা মাণ্ডুর প্রাগৈতিহাসিক বাওবাব গাছগুলির মতনই যে-কোনও মহৎ সাহিত্যের মধ্যেই বোধহয় প্রাগৈতিহাসিকতার সঙ্গে মিশে গেছে ভবিষ্যৎ। একসময়ে, একবার পড়ে, কোনও মহৎ সাহিত্যই বোঝা যায় না। হিরেরই মতো চমকে দেয় তা, বিভিন্ন কোণ থেকে চাইলে। একটু থেমে ঋজুদা বলল, কী রে? বুঝলি কিছু ভটকাই?
বেশি জ্ঞান হয়ে গেল। বুঝলে না ঋজুদাদা, আমাদের জেনারেশনের ছেলেমেয়েদের এই জ্ঞান-ফ্যানে ভীষণ অ্যালার্জি। তাও স্মল ডোজে দিলে হয়, টু মিলিগ্রাম মতো। এ যে স্যালাইন ইনজেকশনের সিরিঞ্জে জ্ঞান। বাপস্।
কাকার রাজ্যে বেড়াতে-আসা ভটকাইয়ের জ্যাঠামো দেখে আমরা সকলেই হেসে উঠলাম।
ঋজুদাও। বলল, থাক, তাহলে তোরা অজ্ঞানই থাক। মন থেকে যে জ্ঞান নিতে না চায়, তাকে জ্ঞান কি কেউ দিতে পারে?
সবে ব্রেকফাস্ট করেছি ঋজুদা। স্টম্যাক ফুল। চারটে ডিমের স্ক্র্যাম্বল খেয়েছি। এখন, দেয়ার নো রুম ফর এনি জ্ঞান। প্লিজ। সাম আদার টাইম। পেট যখন খালি থাকবে।
আমি বললাম, ব্রেকফাস্ট তো হয়েই গেল। এবার চলো না ঋজুদা, আমরা বান্ধবগড় ফোর্টে যাই। সেখানেই তো বাঘেদের আড্ডা। আসলে আমি কথা ঘোরাতে চাইলাম।
ভটকাই তো ঋজুদাকে অত ভাল চেনে না। বড্ড বাড়াবাড়ি করছে। ফট করে যদি ঋজুদা রেগে যায় তো পালিয়ে বাঁচবে না। ঋজুদার মেজাজ বাঘের মতো। এমনিতে কুলফি, রাগলে উরিব্বাবা!
ওঁদের নিয়মকানুন আছে না সব? ঋজুদা বলল।
আরে! পাওয়ারসাহেব, দত্তসাহেব; এখানকার সবাইকে বলে দিয়েছেন। মিস্টার ঋজু বোস বলে কতা। আমাদের বেলা কানুনফানুন খাটবে না, ভটকাই বলল, আমরা হলাম গিয়ে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অনার্ড গেস্ট।
আমি বললাম, গিয়ে কী হবে? বাঘের গুহায় ঢুকে বাঘ দেখবি? বাঘেদের আড্ডায়? আগে চিড়িয়াখানায় দেখে দেখে অভ্যস্ত হ। কটা এনেছিস?
কী? কটা?
আন্ডারওয়্যার।
শাট আপ য় ব্র্যাগিং ব্রাট, বলে ভটকাই বলল, না। তার চেয়ে বাঘেদের আড্ডাখানায় বসে আমরা একটু আড্ডা মেরে আসি। কথা ঘুরিয়ে তারপর বলল, ঋজুদার দিকে চেয়ে, কী করব স্যার, সুন্দরীমোহন অ্যাভিনুর রকবাজ লাইফ মেম্বার, একটু আড্ডা-ফাড্ডা না হলে পেট যে ফুলে উঠছে। তোমার জ্ঞান বন্ধ করো এখন, প্লিজ।
ঋজুদা হেসে ফেলল, ও. কে.। নো জ্ঞান। মানে অজ্ঞানই।
দেখলাম, আজ ফার্স্ট ক্লাস মুডে আছে ঋজুদা।
ওঠা হল সকলের। বান্ধবগড় দুর্গের পেছনে খাড়া উঠতে সময়ও লাগল কিছুটা। উপরে উঠে চোখ জুড়িয়ে গেল। শিকার করার জন্যে দুর্গের নীচের এই লজ বানিয়েছিলেন রাজারা। সামনে একটি ঝিল। পদ্ম, কুমুদিনী সব ফুটে আছে। শীতের হাওয়ায় পাতারা মাথা নাড়াচ্ছে, হেলছে, দুলছে; জলে বিলি কেটে সেই উত্তুরে রুখু-হাওয়া-হিহি-জলে চিতসাঁতার দিয়েই বসন্তের হাওয়া হয়ে এসে এপারে উঠছে। কখনও বা ডুবসাঁতারে। আর গভীর ব্যঞ্জনাময় অস্ফুট সব স্বগতোক্তি করছে নানা জাতের পরিযায়ী হাঁসেরা। ম্যালার্ড, পোচার্ড, নানা ধরনের টিলস্, রাশিয়ান এবং সাইবেরিয়ান রাজহাঁস। সব বছর নাকি আসে না এরা। এদের এই স্বগতোক্তিতে ঘুম পেয়ে যায়। সোপোরিফিক এফেক্ট বয়ে আনে এই পরিবেশ। স্নায়ুগুলো শীতের সাপের মতো নেতিয়ে পড়ে। চোখ বুজে আসে আবেশে।
একটা মস্ত শালগাছের নীচের বড় পাথরে শুকনো পাতা-টাতা সরিয়ে আরাম করে বসলাম আমরা। গাছে পিঁপড়ে বা ফোকর আছে কি নেই দেখে নিয়ে, গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসল ঋজুদা, পায়জামা-পাঞ্জাবির উপর শাল জড়িয়ে নিয়ে; যেন বিয়েবাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে এসেছে। শীতটাও বেশ জাঁকিয়েই পড়েছে। উপর থেকে চারধারের গভীর জঙ্গল-পাহাড়ের গায়ের শীত-শীত গন্ধের সঙ্গে মেশা চামচিকের ও বাঘের চিমসে গন্ধ মাঝে-মাঝে ভেসে আসছে ঝলক ঝলক হাওয়ায়। রোদ এসে পড়েছে ঘাড়ে। কী এক গভীর সুখের নিবিড় সুগন্ধি আমেজে দু চোখ সত্যিই বন্ধ হয়ে আসছে। ঘুমিয়েই পড়তে ইচ্ছে করছে একেবারে।
হঠাৎ ভটকাই শান্তি ভঙ্গ করে বলে উঠল, একটা গল্প বলো না ঋজুদা। জঙ্গলের।
এমনই ভাব, ও যেন পাঁচ বছরের খোকা। ঠাকুরমার কাছে গল্প শুনতে চাইছে। এদিকে গত বছর কলেজের স্পোর্টসের দিন সিগারেট খেতে দেখেছে রাজীব ওকে। ন্যাকা! এই জন্যেই চটকাতে ইচ্ছে করে ভটকাইকে।
কী গল্প? ঋজুদা পাইপ ভরতে ভরতে নীচের ঝিলের দিকে চেয়ে বলল।
ওখানে পাখিরা উড়ছে আর বসছে। মাথার উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে। বাজ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হেনে। কোনও অশক্ত, বৃদ্ধ বা শিশুপাখি দেখলে আর রক্ষে নেই।
আমি বললাম, সেই যে অনেক বছর থেকে তুমি বলছ, তোমার মাথার মধ্যে একটা গল্প খালি ঘোরে। বারবারই ঘুরেফিরে আসে। সেই যে, একজন বুড়ো সাদা-দাড়ি পাইপমুখো, শিকারি আর একটি অল্পবয়সী আদিবাসী ছেলে, আর এক বুড়ো বাঘের গল্প। যে-বাঘ সাংঘাতিক। অনেক বাঘা বাঘা শিকারি যার হাতে ঘায়েল হয়েছিল, অথচ বাঘাকে ঘায়েল করতে পারেনি তারা কেউই। এবং আশ্চর্য, সেই বাঘটি মানুষখেকো ছিল না। মানুষের বা তার গৃহপালিত কোনও পশুরই কোনও ক্ষতি কখনও সে করত না। সেই ভূতুড়ে গল্প। বলবে?
ভটকাই বলল, তাহলে তো দারুণ হয়। জমে যাবে। ফিরে গিয়ে সুন্দরীমোহন অ্যাভিনুর রকে যা ছাড়ব না! ইক্কেরে রক্ শেল্টার হয়ে যাবে।
থামা তো আর ইকির-মিকির ভাষা ভটকাই। আমি বললাম। তারপর বললাম, তা হলে বলল ঋজুদা। তিতির থাকলে খুশি হত খুব। ওরই বেশি ইচ্ছে ছিল শোনার।
গল্পটা কোনওদিন কাগজে কলমে লেখার ইচ্ছে আছে। মাথার মধ্যে এখনও জমাট বাঁধেনি। বলছি তোদের, শোন। যতক্ষণ এই গল্প বলব, তোরা কেউ কোনও প্রশ্ন করবি না আমাকে। প্রশ্ন করলেই গল্প ছিঁড়ে যাবে। এ-মালা এখনও গাঁথা হয়নি। খড় করেছি শুধু, এরপর মাটি লাগবে, চোখ মুখ থুতনি ভুরু–সব গড়তে হবে। তারও পর রঙ।
ভটকাই বলল, প্রমিস। কথা বলব না একটাও। শুরু করো তুমি, ঋজুদা।
.
তুরু বলল, বাপ্পা, কোন দিকে এবার?
সাদা দাড়ির বুড়ো শিকারি বলল, মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে, সোজা।
সোজাই তো এলাম এত মাইল।
আরও সোজা…যেতে হবে।
তোমার কথার মানে বুঝি না আমি। পাহাড়টা তো উঁচু ভীষণ সোজা যাব কী করে?
কারও কথার মানেই কেউ বোঝে না। দাঁড়িয়ে পড়ে বোঝার চেষ্টা করিস না। চলতে-চলতেই বোঝার চেষ্টা কর তুরু। মানে বুঝবি।
তোমার কথার মানে সত্যিই বুঝি না আমি।
যা বলি, তাইই কর। সব কথার মানে খুঁজিস না।
কী খুঁজছ তুমি এই জঙ্গলে বাপ্পা?
নিজেকে খুঁজছি।
তুমি বড় হেঁয়ালি করো। ইতিয়া বাইগা বলছিল যে, তুমি সোনার খনির খোঁজ পেয়েছ বুড়হা বুডাং পাহাড়ের কোলে।
কে বলছিল, বললি? কানে শুনি না আজকাল ভাল আমি। সাদাদাড়ি বুড়ো শিকারি বলল।
ইতিয়া বাইগা। বললামই তো!
বলল বুঝি?
হ্যাঁ। বলল, তুমি সোনা খুঁজে পেলে ধরতির সবচেয়ে বড়লোক হয়ে যাবে।
তাও বলল?
হ্যাঁ। আরও বলল..
কী বলল রে আরও?
বলল, সোনা খুঁজে পেলেই তুমি আমাকে মেরে ফেলবে, যদি আমি দেখে ফেলি। তারপর সেই সোনার গুহায় পুঁতে ফেলবে। যক করে দেবে আমাকে। অনন্তকাল ধরে আমি তোমার ধনরত্ন পাহারা দেব। যা হতে পারত তোমার, তা আমার হয়ে যাবে। যকের ধন।
বুড়ো শিকারি হেসে ফেলল। বলল, তুই একটা গাধা। যে-ধনকে পাহারা দিয়ে রাখতে হয়, সে-ধন ধনই নয়। সোনা আমি খুঁজছি ঠিকই। তবে সে-সোনার রঙ সোনালি নয়।
আবারও হেঁয়ালি? তোমার কথা বুঝি না আমি।
বোঝার দরকার নেই রে তুরু। পথ দেখে পা ফেল। এক পা এক পা করে। দেখবি, একসময় বুড়হা বুডাং পাহাড়ের চুড়াতেই পৌঁছে গেছিস না-জেনেই। সোনাও পেয়েছিস।
তুরু দাঁড়িয়ে পড়ল একটা খয়েরগাছের চিকন ছায়ায়। দুহাতের পাতা শালপাতার দোনার মতো করে মুড়ে পাহাড়ের চুড়োর দিকে চাইল।
বলল, ইরেঃ। ই কম্ম আমার দ্বারা হবে না গো। এটা কি যে-সে পাহাড়? কম কি উঁচু? আমার দ্বারা বুড়হা বুডাং-এ চড়হা হবেই না। তায় আবার কাঁধে এই ভারী রাইফেল।
বুড়ো শিকারি আবারও হাসল। বলল, চুড়োটা দেখলি বুঝি? যারা চুড়োয় পৌঁছতে চায়, তারা কখনও চুড়োর দিকে চেয়ে দেখে না।
কী যে বলো না? চুড়োর দিকে না-দেখলে চুড়োয় পৌঁছবে কী করে?
যারা এক লাফে চুড়োয় চড়তে চায় এবং কখনও তা পারে না, তারাই নীচে দাঁড়িয়ে চুড়োর দিকে চেয়ে থাকে। তুই তোর ডান পাটা এর পরে কোন্ পাথরে বা খাঁজে ফেলবি, সেইদিকে শুধু চেয়ে দ্যাখ। পায়ের পর পা ফেলে যা। একসময় দেখবি, পাহাড়চুড়ো তোর তামারঙা পায়ের নীচে লুটোচ্ছে।
জানি না কী হবে। তবে শুনলাম কথা, তোমার। কিন্তু মুক্কির লোকেরা বলল যে, তুমি বুড়ো বাঘাকে মারতে এসেছ। এদিকে বানজার বামনি বস্তির লোকেরা বলছে যে, তুমি সোনার খনি খুঁজতে এসেছ। তুমি এদিকে ওই দুইয়ের কিছুই না করে জঙ্গল তোড়পাড় করে বেড়াচ্ছ আর বলছ, তুমি নিজেকে খুঁজতে এসেছ! এটা হেঁয়ালি নয়? তুমিই বলো?
বেঁচে থাকাটা, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি হেঁটে যাওয়াটাই একটা হেঁয়ালি তুরু। যখন বড় হবি, তখন বুঝবি। এখন এসব কথা থাক।
বড় হব? আর কত বড় হব? তিন হাত লম্বা হলাম, বাঘ মারলাম, ভালুক মারলাম, তামাক আর ধান বুনলাম, তুললাম গোলা ভরে, বছরের পর বছর। বিয়ে করব আজ বাদে কাল। আরও বড়? কত বড়? তুমি পাগল হয়েছ বুড়ো শিকারি? বাপ্পা!
না রে, হইনি। তুই যা হয়েছিস, তাতে তোর ঘর ভরেছে, পেট ভরেছে, খেত ভরেছে ধান-তামাকে, তুই লম্বা হয়েছিস, ফুলে উঠেছিস, কিন্তু বড় হোসনি।
সে কী কথা বাপ্পা! এ আবার কোন নতুন হেঁয়ালি?
হেঁয়ালি নয় তুরু। এইটেই কথা। তুই যখন বড় হবি, তখন বুঝবি। সত্যিই বুঝবি রে।
বুঝে কাজ নেই আমার। এখনও দাঁড়াও দেখি একটু। ওয়াটারবটল থেকে জল খেয়ে নিই। এতখানি কি চড়া যায় একটানা?
তুরু দাঁড়িয়ে পড়ল প্রথমে। তারপর বসল একটা পাথরে। তার কোমরে বাঁধা গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছল। বলল, দেখেছ, এই শীতেও কী ঘাম!
শীতের ঘাম গরমের ঘামের চেয়ে অনেক দামি। আরামেরও রে।
কী জানি! তুমি জল খাবে তো এই নাও।
নাঃ। আমি খাব না। বলে, বুড়ো শিকারি দূরবীন দিয়ে পাহাড়ের চুড়োর দিকে দেখতেই লাগল।
পাহাড়ের উপরটা মনে হয় মালভূমির মতো। বড় বড় পা সোনারঙা; রেশমি-নরম ঘাসের উধাও মাঠ আর আফ্রিকান টিউলিপগাছে ছাওয়া। ভাল বোঝা যায় না, চুড়োয় কী আছে। আদৌ কিছু আছে কি নেই। গুহা যে আছে অনেকগুলো, তা বোঝা যায়। একেবারে চুড়োয় একটা মস্ত শিঙাল শম্বর ছবির মতো শিংয়ের ডালপালা বিছিয়ে নীল আকাশের পটভূমিতে কালোরঙা পুতুল-শম্বরের মতো একটা চ্যাটালো পাথরের উপর দাঁড়িয়ে আছে। তুরুর মনে হল, পৃথিবী বোধহয় ঠিক ওইখানেই গিয়ে শেষ হয়েছে। দেবতারা সব যে ওইখান থেকেই মেঘের গাড়িতে চড়ে দেবলোকের দিকে উড়ে যান, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
তুরু শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকল ওইদিকে। অনেকক্ষণ। তারপর মুখ ঘুরিয়ে একবার বুড়োর মুখে তাকাল।
বুড়ো একদৃষ্টে তাকিয়েই ছিল পাহাড়চুড়োর দিকে। তার সাদা দাড়ি উড়ছে উত্তুরে হাওয়ায় কাঁপাসতুলোর মতো। তার ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত এক হাসি।
সে-হাসির কোনও ব্যাখ্যা হয় না।
তুরু বলল, এতক্ষণ ধরে অত দেখছ কী? শম্বরটা রাইফেলের রেঞ্জের অনেক বাইরে আছে। তা ছাড়া ওকে মারলে তো ধ্বপধপিয়ে পড়বে নীচের খাদেই। শেয়াল হায়নাতে বা চিতাতে খেয়ে যাবে। আমার বা বস্তির লোকদের কাজে লাগবে, না ঘন্টা। বলো তো আমি আরও একটু এগিয়ে গিয়ে ধড়কে দিই। কড়াক পিং। এমন করে, যাতে গুলি খেয়ে নীচে না পড়ে। ওখানেই থাকে।
বুড়ো তবু কথা বলল না। দূরবীন চোখে লাগিয়ে এদিক থেকে ওদিক–একশো আশি ডিগ্রি দেখল। একবার নয়। বারবার।
তুরু মনে মনে ভাবল, সত্যিই পাগল। পাগলই হয়ে গেছে। আসলে বুড়ো হলে সব মানুষই একটু শিশু-শিশু, খ্যাপাটে, পাগলাটে হয়। সাদাদাড়ি শিকারি বুঝি বদ্ধ পাগলই হয়ে গেছে। কী কুক্ষণে যে এবারে এল পাগলের সঙ্গে! না এলেই ছিল ভাল।
এবার অধৈর্য গলায় তুরু বলল, দেখছ কী বাপ্পা? পেলে, সোনার খনি? এগোবে তো এগোও।
বুড়ো অস্ফুটে বলল, হল্লা করিসনি ছোঁওড়া। দেখছি।
আরে, দেখছ যে, সে তো আমি নিজেও দেখছি। দেখছটা কী তা তো বলবে।
জঙ্গল।
সেও তো আমিও দেখছি। অত করে দেখার কী আছে? জঙ্গল তো জন্মাবার পর থেকেই দেখছি। দেখে দেখে তো পচে গেল চোখ।
আছে রে তুরু, আছে। পরতের পর পরত। কত সব পাথর, পাথরের বুকে বুকে মাটি, কিচুলরাজার কত যত্ন করে বয়ে-আনা মাটি, কত নাম-না-জানা পাখিদের ঠোঁটে করে বয়ে-আনা কত-রঙা বীজ তাতে পড়েছিল যুগ-যুগ ধরে। তাই তো ঘাস জন্মাল। তারপর ঝোপঝাড়। ফুলদাওয়াই, পুটুস, কেলাউন্দা, গিলিরি, না-নউরিয়া, পোকামাকড়, লাল সবুজ নীল। প্রজাপতি, রামধনুরঙা পাখি, চিকন পালকের, মেঠো ইঁদুর–নতুন চালের গন্ধে-ভরা যাদের সাদা শরীর, বর্ণালি সাপ, যারা ধীর স্বপ্নের মতো চারিয়ে যায় বনের গভীরে, কোটরে; ফাঁকে-ফোকরে। হরিণ, চিতা, চিল। তারও পর বড়-বড় সব মহীরুহ এল। সময় লাগল কত। তোর বড় হয়ে ওঠার চেয়েও কত্ব কত্ব বেশি সময় বল? জঙ্গল কী অত সহজে হয়েছিল রে তুরু যে, এত সহজেই দেখা ফুরিয়ে যাবে?
কোনও জানোয়ার দেখেছ কি বাপ্পা তুমি ওই জঙ্গলে? শম্বরটা ছাড়া? বুড়হা-বাঘা কি? দেখলে বোলো। তোমার বকবকানি বুঝি না আমি। বুড়হা-বাঘার সঙ্গে মোলাকাত হলে ঝামেলা মেটে।
নাঃ। সে দেখা দেয়নি। দেবে না সহজে। সেও তো আমারই মতো।
কী রকম?
সেও তো হেঁয়ালিই। গুমোর-ভরা বুড়ো এক আমারই মতো। দুজনে দুজনকেই খুঁজছি। দেখা হয়ে গেলে তো মিটেই গেল। তবে, তাকে খুঁজতে হবে না। কোনও সন্ধের মুখে সে আপনিই এসে দাঁড়াবে মুখোমুখি। তখন…
তখন কী?
বোঝাপড়া।
কী?
শোধবোধ।
তবে? এত কী খুঁজছ তুমি বাপ্পা? যদি জানোই যে, শুভদৃষ্টি আপসেই হয়ে যাবে কোনওদিন, তবে এত তকলিফ কিসের? তবুও কী খুঁজছ এখনও?
নিজেকে। বলেইছি তো।
নিজেকে? নিজে তো এই দাঁড়িয়েই আছ জলজ্যান্ত আমার সামনে। তোমার পাইপ থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, তোমার জার্কিনের গন্ধ পাচ্ছি নাকে। নিজেকে খুঁজছ তুমি, দূরে? অত দূরে? মানে?
ঠিক। তুরু! নিজেকে নিজের থেকে বাইরে অনেক দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার উপরে আলো ফেলে তাকে না দেখলে দেখাই হয় না, জানা হয় না। বিশ্বাস কর আর না-ই কর, নিজেকেই খুঁজছি আমি। সকলেই হয়তো খোঁজে। চুরি করে। কেউ পায়, কেউ পায় না খুঁজে।
মরোগে যাও। তুমি কি ওই দূরের শম্বরটা, যেটাকে পুতুলের মতো দেখাচ্ছে, তার মধ্যে ঢুকে গেছ? তুমি কি দারহা? উইক্কে বা সাইআম্-এর শক্তি কি ভর করেছে তোমার শরীরে?
না, না, ওসব নয়। সব কথা যে তোর বোঝার নয় রে। এত প্রশ্ন করিস কেন তুরু? তার চেয়ে তুই জল খা।
খেয়েছি।
খেয়েছিস? তো আরও খা।
খেয়েছি।
তো কফি খা। দূরবীন থেকে চোখ না নামিয়েই বলল, সাদা-দাড়ির বুড়ো শিকারি।
কফি নেই। ফুরিয়ে গেছে।
তবে হাওয়া খা, রোদ খা, জীবন খা, মরণ খা, যা খুশি কর তুই, শুধু এত কথা বলিস না, প্রশ্ন করিস না। জঙ্গলে এসে কথা বলিস না তুরু, শিকার কর, আর না-ই কর। জঙ্গল যে যুগযুগান্ত থেকে অনেক কথাই জমিয়ে রেখেছে তার বুকের মধ্যে। বলার জন্যে। অনেক দীর্ঘশ্বাস, অনেক হাসি, অনেক গান, কান্নাও অনেক। অনেক রঙ আর গন্ধ বুনে বুনে বাস্তারের ঠাসবুনোন বাইসন-হর্ন মারিয়াদের কম্বলের মতো মেলে রেখেছে বনস্থলীতে। তুই কী বোকা রে তুরু! এতদিন হল জঙ্গলে আসছিস আর জঙ্গলকে দু চোখ মেলে, দু কান খুলে তোর সব বোধবুদ্ধি দিয়ে একবার অনুভবও করলি না? তুই ব্যাটা এক নম্বরের বুদ্ধুই রয়ে গেলি। বুদ্ধু নাম্বার ওয়ান। তোর বাবা অন্য রকম ছিল।
আমি আমার মতো হতে চাই। অন্য কারও মতে, এমনকী বাবার মতোও হতে চাই না। আমি না হয় বুদ্ধু, জঙ্গল দেখলাম না বলে। কিন্তু তুমিও কম বুদ্ধু নও বাপ্পা।
বুড়ো দূরবীন নামিয়ে দিল। পেটের কাছে দুলতে লাগল সেটা। পা ফেলল সামনে। একটা পাহাড়ি বাজ, ভয় পেয়ে, ভুল করে ঝোপঝাড়ের আলোছায়ার আশ্রয় ছেড়ে উপরের নীল, বেআবরু আকাশে হঠাৎ উড়ে-যাওয়া একটা কালি-তিতিরকে ধাওয়া করে ধরে ফেলল। মওত। জঙ্গলের নিয়ম। জীবনেরই মতো। ময়ূর, বনের ছায়াচ্ছন্ন গভীরে শঙ্খচূড় সাপের উদ্ধত ফণার দর্পচূর্ণ করে তাকে ধরাশায়ী করে বিজয়োল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ কেঁয়া কেঁয়া কেঁয়া। ময়ুর বড় গর্বিত পাখি। রূপ আর গুণের গায়ে গর্ব লেগে থাকে। একটা কপারস্মিথ পাখি ঘনান্ধকার শীতার্ত উপত্যকা থেকে ডাকতে লাগল টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। টাকু! টাকু!
বুড়ো শিকারি দু নাক ভরে টেনে শীতের সকালের বনের স্নিগ্ধ সুগন্ধি হিমেল নিশ্বাস নিল। তারপর বুনো গোলাপের উপর জমে-থাকা শবনমকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে নাড়িয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো রামধনু করে উড়িয়ে দিল, চারিয়ে দিল সবুজের আর লালের এই দেশে। তারপর আবার পাহাড় চড়তে লাগল।
পেছন-পেছন তুরু। কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা মন্ত্রমুগ্ধ, কিছুটা ক্লান্ত আর সব থেকে বেশি অবাক হয়ে। এই বুড়ো এবারে একটা খতরা বানাবেই বানাবে। তার জন্য তার নিজেরই কোনও বিপদ ঘটে যাবে। মা তাকে মানা করেছিল এত করে। বাবার বন্ধু এই বাপ্পা। এতদিনের সঙ্গী বাবার। মরে যাওয়া সোজা। খুব সোজা। মরতে ভয় পায় না তুরু। ভয় যদি কর্তব্য না করতে পারে! কর্তব্যবিমুখ মানুষে আর মরা মানুষে তফাত কী? তুরু তাইই বোঝে। তার বাবা তাকে তাইই শিখিয়ে গেছিল। এই বুড়োর কাছে, বাপ্পার কাছে তাদের পরিবার নানাভাবে ঋণী। অনেক নুন খেয়েছে। শুধু নুনই নয়, খেয়েছে ভালবাসা দু আঁজলা ভরে। বুড়ো যতদিন আছে, ততদিন শোধ দিতে পারুক আর না-ই পারুক, স্বীকার তো করবে! তা নইলে মানুষ কী! তুরুর মা বলেন, দুটি হাত, দুটি পা, দুটি চোখ আর একটি মুখ থাকলেই মানুষ মানুষ হয় না। তুরু মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে চায়, যতদিনই বেঁচে থাকুক না কেন। এই মানুষ হতে গিয়ে বাঁচা যদি না-ই হয়, তবে নাই-ই বা হল!
তুরু টুপিটা রেখে গেল টেবিলে। রাইফেল, গুলি, পাইপের তামাকের, টিন। সবই যেমন তেমন পড়ে রইল।
বাপ্পা যেন মনে মনে অন্য কোথাও চলে গেছে।
দূর ছাই!
মনে-মনে বলল তুরু।
এই পাহাড়টাও মস্ত। পাহাড়ে অনেক গুহা। গুহা আর রক-শেলটার। তার মধ্যে হাজার-হাজার বছর আগে প্রাগৈতিহাসিক সব মানুষ বাস করত। লাল আর হলুদ রঙে তারা নানারকম ছবি এঁকে গেছিল সেই সব গুহার গায়ে গায়ে। বাইসন, শম্বর, আর বুনো বুড়ো দাঁতাল শুয়োরদের শিকারের ছবি। পাথরের অস্ত্র দিয়ে শিকার করত তখন। আগুন আবিষ্কার হয়নি। সে সব অনেক হাজার বছর আগের কথা।
যে-গুহাতে বুড়হা-বাঘার বাস, তার সামনেই মস্ত একটা কালো পাথরের চ্যাটালো চাতাল। আদিবাসী গোঁন্দ ছেলের বুকের মতো। তার উপরে দুটি থাবা মেলে বসে ছিল বুড়ো বাঘটা।
মাঘী সন্ধ্যার নরম পাটকিলেরঙা রোদ পাহাড়ের গায়ের আর নীচের ঘন জঙ্গলের গায়ে শেষবারের মতো হাত রেখেছিল। একটু পরেই সূর্য পশ্চিমের পাহাড়টার আড়ালে চলে যাবে। শূন্যে তাদের আত্মা পাদুটি দুলিয়ে দুলিয়ে ডুবন্ত সূর্যকে ধাওয়া করে দিগন্তবেলার সূর্যের ধতি-মায়ের কপালের মস্ত এক টিপেরই মতো লাল গোলকের মধ্যে ঢুকে যাবে একদল টি-টি পাখি। কাঁপতে কাঁপতে, ডাকতে ডাকতে হট্টিটি-হুট-টি-ট্টি-টি-হুঁট।
ঔৎসুক্যের প্রতীক যেন এই পাখিগুলো!
যে-পাহাড়ে বুড়ো বাঘা বসে ছিল, সেই পাহাড়ের নীচের উপত্যকায়, একুট দূরে মেমসাহেবর মতো ফর্সা, নরম, চলকে-চলা সুন্দরী বানজার নদী। এঁকেবেঁকে চলে গেছে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বিন্ধ্য, সাতপুরা আর মাইকাল পর্বতশ্রেণীর মিলনস্থানের খোঁজে।
নদীর পাশে, উঁচু ডাঙায় ছির ঘাসের খোলা সুগন্ধি প্রান্তরে একটা সাদা তাঁবু। তাঁবুর সামনে ত্রিপলের ফোল্ডিং টেবলের কছে চেয়ার পেতে বসে আছে সেই বুড়ো-শিকারি। সাদা হয়ে গেছে তার চুল-দাড়ি। অথচ ছিপছিপে, মজবুত তার শরীরের গড়ন। বুড়ো বাঘারই মতো। রোদে জলে চাঁদে পুড়ে শিকারির গায়ের রঙ তামাটে হয়ে গেছে। মুখে একটা পাইপ। সামনে কলাই-করা মগে কফি। শিকারির কাছেই, বাঁ-দিকে আসন্ন হি-হি শীতের রাতের জন্যে তৈরি হচ্ছে তুরু, একটি হা-হা-হাসি অল্পবয়সী গোঁন্দ ছেলে। বুড়ো শিকারির একমাত্র অনুচর সে। আগুন করার বন্দোবস্ত করছে কাঠকুটো এনে। একটা জংলি আমগাছের মস্ত বড় গুঁড়ি ফেলে রাখা আছে সেখানে। গুঁড়িটার আধখানা পুড়ে গেছে গত কদিনের রাতের ধিকিধিকি আঁচে।
নদীর দিকে উদাস চোখে চেয়ে ছিল বুড়ো শিকারি। কনে হাওয়ায় তার দাড়ি নড়ছে এপাশ ওপাশ। মানুষটার চেহারা দেখলে বোঝা যায় না যে, সে শিকারি। কবি বা গাইয়ের মতো হাবভাব তার। তার দু চোখভরা ভালবাসা। পাখির জন্যে, নদীর জন্যে। এমনকী, মনে হয়, বাঘের জন্যেও।
বুড়ো বাঘটা তার গুহার, ঠিক নীচের চাতালের সামনে বসে বুড়ো শিকারিকে দেখছিল। শিকারি জানে না যে, বাঘ তাকে বাজপাখির মতো পাহাড়ের উপর থেকে দেখছে। চাতালে বসে বাঘটা নীচের ঘন জঙ্গল আর নদীতে ঘেরা অনেকখানি এলাকাই দেখতে পায়। দেখতে পায়, কোথায় শম্বর বা বারাশিঙার দল চরছে ছির ঘাসের লালচে ফুলে-ভরা বনে। কোথায় বাইসনের বাচ্চা মায়ের দুধ খাচ্ছে লাফিয়ে লাফিয়ে; মাকে বিরক্ত করে। দেখছে, বানজার নদীর কোন্ জায়গা দিয়ে চিতল হরিণের ঝাঁক বা বুড়ো শুয়োরের দল তাদের চঞ্চল খুরে-খুরে বানজার নদীর রুপোলি জল ছিটিয়ে বনে ঢুকল। কোথায় একলা দলছুট বারাশিঙার বাচ্চা ভীরু পায়ে ইতিউতি ঘুরছে।
অনেকদিনই শজারু খায় না বুড়ো বাঘটা। আর বাঁদরও। বাঁদরদের উপর খুব রাগ তার। মানুষেরা নাকি সব বাঁদরেরই বাচ্চা। শুনেছিল, এক বাঘিনীর, কাছে। মুখ বদলাবার জন্যে আজ সে ভাবছে যে, পাহাড়ের নীচের মস্ত ঝাঁকড়া পিপ্পলগাছটার উপরে যে বাঁদরের দলের বাসা, সেখানে গিয়ে উপরে তাকিয়ে কয়েকবার হালুম-হুলুম করবে। ঘন বনের মধ্যে বড় বাঘের হালুম-হালুম ডাক শুনে মানুষেরই নাড়ি ছেড়ে যায়, তা তুচ্ছ মর্কটের কথা! ভয়ের চোটে হাত-পায়ের মুঠি শিথিল হয়ে যাবে বিস্তর বাঁদরের বুড়হা বাঘার ডাক শুনেই। চি চি-চ্যা চ্যাঁ-খ্যাঁক্-খরর-খরর-খরর-খক্ করবে ঝাঁপাঝাঁপি করতে করতে বাঁদরগুলো দু-চারটে, পাকা আমেরই মতো, ডাল-ফসকে ঝরে পড়বে নীচে। তখন বুড়ো বাঘা ক্যাঁক করে গলা টিপে ধরবে একটার। তারপর বনের গভীর শিশিরভেজা অন্ধকারে টেনে নিয়ে গিয়ে ভোজ লাগাবে।
তুরু! বুড়ো শিকারি ডাকল।
বাপ্পা। উত্তর দিল তুরু, আগুন জ্বালতে জ্বালতে, জড়োকরা শুকনো পাতায়।
কাল কিন্তু খুব ভোরে বেরোব আমি।
কোনদিকে?
যেদিকে বুড়হা বাঘার পায়ের ভাঞ্জ মিলিয়ে যেতে দেখলাম আজ। তার আস্তানাটা যে কোথায়, তা না জানলে যে হচ্ছে না। বড়ই সেয়ানা বাঘটা। বোদে বাঁধলাম, ছাগল বাঁধলাম, তাদের ছুঁল না পর্যন্ত!
হঁ! তুমি তো জানোই যে, অনেক শিকারিই ওকে মারার চেষ্টা করেছে আগে। কত সাহেব-সুবো। মুক্কির সাজানা সাহেব। ঠুঠা বাইগা। দেবী সিং। জাত শিকারি সব। হুঁশিয়ার হয়ে গেছে বাঘটা। মাচা থেকে অনেক বারই গুলি চলেছে ওর উপর। চালাক হয়ে গেছে খুব। হুঁশিয়ার! তুমিও।
হুঁ! কফির কাপে চুমুক দিয়ে, শিকারি বুড়ো বলল। মানুষের কাছাকাছি এলে সকলেই ধূর্ত হয়ে যায়। মানুষের মতো ধূর্ত জানোয়ার যে আর নেই। বুঝলি তুরু।
তা ঠিক। কিন্তু কী হবে? বাপ্পা?
কী, কী হবে?
এই বুড়হাবাঘাকে মেরে তোমার কী হবে? বাঘ তো সারাজীবনে অনেকই মারলে। তোমার সাহসের কথা রাইপুরে, বিলাসপুরে, জবলপুরে, এমনকী ভোপালেও কে না জানে? আমার বাবার সঙ্গেই তো কত শিকার করলে তুমি। শখ কি মেটেনি এখনও? কী চাও তুমি বাপ্পা?
বুড়ো চুপ করে রইল।
কী চাও? আরও নাম? খবরের কাগজের পাতায় ছবি ছাপতে তোমার?
তুরু শুধোল আবার।
বুড়ো হাসল। বলল, নাম কোনও ব্যাপারই নয় রে তুরু। যারা নামের বা যশের যোগ্যই নয়, তারাই চিরদিন নাম-যশের পেছনে মানসম্মান চুলোয় দিয়ে দৌড়োয়।
তবে? কিসের ব্যাপার এটা? তোমরা এত শিকার করলে বলেই তো শুনতে পাচ্ছি বাঘ শিকার করা একেবারেই বন্ধ করে দেবে মধ্যপ্রদেশ সরকার। এই বুড়ো বাঘ তো আমার বাবাকে খায়নি! তোমারও তো ক্ষতি করেনি কোনও। অন্য একটা বাঘ আর বাঘিনী তো সুফকর আর মুক্কির কাছে আমাদের টোপ-দেওয়া দুদুটো গাবদা-গোবদা বোদে মেরে এবং খেয়ে সাবড়ে দিল। না তুমি নিজে বসলে মাচায়, না আমাকে বসতে দিলে। গত দশদিনে দু-দুটো বাঘ হুম্মচকে পটকে দেওয়া যেত। পারমিটে সময় তো আছে আর মাত্র পাঁচদিন। একমাত্র ওই বুড়ো বাঘাকেই তোমার মারতে হবে, এমন জেদ ধরেছ যে কেন তুমি, তা তুমিই জানো। একটা ভাল বারাশিঙা মারলে না, শম্বরও মারলে না একটাও; মুক্কি আর সুফকর বস্তির লোকেরা কত মাংস খেতে পারত। তোমাকে সত্যিই বুঝি না আমি বাপ্পা। আমার নিজের বাবা মরে গিয়ে বড়ই বিপদে ফেলে গেল আমাকে। তোমাকে বোঝা ভারী মুশকিল।
সব কথা সবার বোঝার নয় রে তুরু। সব কথা বোঝার চেষ্টাও করিস না কখনও, জীবনে সুখী যদি হতে চাস।
তুরু চুপ করে রইল। উত্তর দিল না।
এবার আগুনটা জোর হলে খিচুড়ি চাপা। কী আছে আর? বুড়ো শিকারি বলল।
কী আর থাকবে? শিকারই করলে না কিছু। আমি পয়েন্ট টু টু রাইফেল দিয়ে একটা খরগোশ মেরেছিলাম। সেটাকে ছাড়িয়ে ঝলসে নেব। পাথুরে নুন আর লঙ্কা আছে।
আমি খাব না। তুই-ই খাস্।
কেন? খাবে না কেন?
মাটি-মাটি গন্ধ লাগে আমার। খরগোশের গায়ে মাটি-মাটি গন্ধ।
পৃথিবীর সব কিছুতেই তো মাটি-মাটি গন্ধ। পৃথিবী যে ধরতি-মা।
তা জানি। কিন্তু মাটির গন্ধ ভাল লাগে না আমার।
তো খাবে কী?
কেন? খিচুড়ি!
শুধু-শুধু?
শুধু-শুধুই। বুড়োদের বেশি খেতে নেই। আমি কি তোর মতো জোয়ান? আমি যে তোর বাবার চেয়েও অনেক বড় রে বয়সে। আমি যে বুড়ো থুথথুরে।
এতই বুড়ো তো এই বুড়ো বাঘাকে মারা জন্যে দাঁতে দাঁত দিয়ে পড়ে থাকার দরকার কী তোমার? ফিরে যাও না রায়পুরে।
যাব। বুড়ো বলল।
তোমাকে বুঝি না একটুও।
কেই বা কাকে বোঝে? নিজেকেও কি তুই বুঝিস? ভাবিস যে, বুঝিস! তুই বুঝিস না তোকে। আমিও বুঝি না আমাকে।
জানি না, তোমার এই একগুঁয়েমি, এই জেদ, ভাল লাগে না আমার।
যার জেদ নেই, সে কি মানুষ?
খারাপ জেদ খারাপ। ভাল জেদ ভাল। আমার মা বলে। মা তো তোমাকেও বলল সেদিন।
কী?
বলল না? এই বাঘটার হাতে দশজন শিকারি মারা গেছে গত পনেরো বছরে। এই বুড়ো বয়সে একে মারার জেদ ভাল নয়। বলেনি? কী দরকার? সুখে থাকতে ভূতে কিলানোর? এ-বাঘকে মারতে পারে এমন শিকারিই নেই। সারা দেশের কথা আমি জানি না। ভারতবর্ষ তো মস্ত দেশ। মুখ্যু আমি। অন্তত মধ্যপ্রদেশে নেই। মাঝখান দিয়ে তোমারই প্রাণটা যাবে।
বুড়ো শিকারি তুরুর কথার উত্তর দিল না কোনও।
বলল, তাঁবুর ভিতর থেকে আমার রাইফেল, গুলি, মাথার টুপিটা আর পাইপের তামাক নিয়ে আয় তো তুরু। আর কফিটা খেয়ে নে। পটে অনেক কফি আছে। বিস্কিট আছে প্যাকেটে। খাবি-দাবি ভাল করে তো এখন তোরাই। ছেলেমানুষ যারা।
কফি-টফি বেশি খাই না আমি, তুরু বলল। বাথানে গিয়ে বিকেলে আমি মোষের দুধ খেয়ে এসেছি। বাথানের আহিররা বলল যে, একটা ছুকরি বাঘিনী আর তার দুটো বড়-হয়ে-যাওয়া বাচ্চা তাদের বাথানে কাল রাতে নাকি খুবই হামলা করেছে। ওই বাঘিনী আর বাচ্চাদুটোকে মারতে বলেছে অনেক করে। তোমার কাছে কাল ভোরে অনেক ভেট-টেট নিয়ে আসবে ওরা। দুধ, ঘি, মাখন, সর, মুরগি।
ওরা এলে ওদের ফিরিয়ে দিস।
কেন? পারমিটে তো দুটো বাঘ আছেই তোমার। দাওই না মেরে। তুমি না মারো, অন্তত আমাকে ইজাজত দাও; কাল রাতেই সাবড়ে দিচ্ছি। বাথানের বাইরে একটা বোদে বেঁধে দিলেই হল। দেখতে হবে না আর। আসবে, আর সঙ্গে-সঙ্গে কড়কে দেব। আমার বাপ কী করে সোজা করে গুলি করতে হয় তা তো শিখিয়ে গেছে। আর কিছু শেখাক আর না-ই শেখাক। শুধু তোমার দোনলা বন্দুকটা ধার দিও আমাকে একরাতের জন্যে। আমার একনলাটা নিয়ে বড় বাঘের মোকাবিলা করার সাহস হয় না।
না।
গম্ভীর গলায় সাদা-দাড়ি বুড়ো শিকারি বলল।
বাপ্পা! কেন না? না কেন?
না বলেছি, না। বড় বেশি কথা বলিস তুই তুরু। এবারে চুপ কর। রান্না হয়ে গেলে থালা করে দুহাতা খিচুড়ি এনে দিবি আমাকে। ব্যস্। খেয়েই শুয়ে পড়ব। কাল ভোর পাঁচটায় বেরিয়ে যাব। তোর যেতে হবে না আমার সঙ্গে। আহিররা তোর জন্যে ভেট-টেট নিয়ে আসবে বলছিলি। তুই ওসব নিয়ে নিস। পরে দেখা যাবে। যদি বেঁচে থাকি তো দেব তোকে মারতে।
তুমি একাই যাবে? পায়ে হেঁটে? একা! অত বড় বাঘ! এ যে বুড়ো বাঘা?
তা কী করা যাবে? যে বাঘ মড়ি করে না, মাচা থেকে যাকে কায়দা করার কোনওই উপায় নেই, যে হাঁকোয়া কালে হাঁকাওয়ালাদেরই মেরে দিয়ে লাইন ক্রস্ করে বেরিয়ে যায়, তাকে হেঁটে ছাড়া আর কীভাবে মারা যেতে পারে?
না। একা যাবে না বাপ্পা।
ঠিক করেছি, কাল থেকে একাই যাব। সময় ফুরিয়ে আসছে। আজ রাত পোয়ালে, থাকবে মোট পাঁচটা দিন। সময় বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাচ্ছে। এত তাড়াতাড়ি আর কিছুই ফুরোয় না।
এই পাঁচদিন শেষ হলেও তোমার জীবনে আরও অনেক সময় বাকি থাকবে বাপ্পা।
যে-সময় নিয়ে কিছুই করার নেই, থাকে না, তা থাকা না-থাকা সমান। সে সময় নয়; সময়ের বোঝা।
কিন্তু আমি তোমার সঙ্গে গেলে ক্ষতিই বা কী? আমি কি আনাড়ি? আমি ভিতু কি? কোনও বিপদ হলে, একটা বেশি বন্দুক থাকলে তো ভালই। কী? ভাল না?
কিছু-কিছু ফয়সালা থাকে তুরু, কী বলব; তোর জীবনেও হয়তো সেসব ফয়সালার দিন আসবে; প্রত্যেক মানুষের জীবনেই আসে, একবার নয়, অনেকবারই; যখন সেই সময় আসে, তখন একা-একাই তার মোকাবিলা করতে হয়। তখন সঙ্গে যদি একদল লোকও থাকে, তবুও তাকে একাই। সে একাই। আসলে, আমরা সকলেই একা। জানলি! ভীষণই একা। যা-কিছুর মানে আছে, মানে থাকে একজন মানুষের জীবনে, সেই সবকিছুই তাকে একা-একাই করতে হয়।
বুঝি না তোমার এসব বড় বড় কথা বাপ্পা।
বলেছি তো। সব কথা তোর বোঝার জন্যে নয়।
বুড়ো শিকারির চোয়াল শক্ত হয়ে এল।
বুড়ো বলল, এ নিয়ে আমি আর কোনও আলোচনা তোর সঙ্গে করতে চাই তুরু। যা আমি বলব, তাইই হবে। এমন বন্দোবস্তেই আমি চিরদিন অভ্যস্ত।
তাই হোক। আমার কী? তবে, তোমার হরকত দেখে মনে হচ্ছে, এই বানজারের বালিতেই তোমার চিতা সাজিয়ে তোমায় জ্বালিয়ে দিয়ে আমার ফিরতে হবে সীওনীতে। লোকে বলবে, কী বাহাদুর তুরু! ধনুয়া শিকারির ব্যাটা তুরু এমনই শিকারি যে, বাপ্পাকেও মারিয়ে ছাড়ল বুড়হা বাঘাটার হাতে!
তারপরই রীতিমত রেগে তুরু বলল, তুমি কি জানো না যে, বুড়হাবাঘাকে কেউই মারতে পারেনি? পারবেও না। শুনে নাও তুমি। আমার এই-ই শেষ কথা বাপ্পা; তুমিও না। মরবে তুমি। তারপর যা খুশি তোমার তাই-ই কোরো।
আগুনটা জোর হয়েছিল ততক্ষণে। বুড়ো শিকারির চোখদুটি চকচক করছিল। দু চোখ তুলে সে আগুনের লাল হলুদ সবুজ নীল উজ্জ্বল সাদা রঙা লাফিয়ে লাফিয়ে ওঠা শিখাগুলির দিকে চেয়ে রইল। বুড়ো শিকারির মুখটা স্থির। চোখের দৃষ্টি আগুনের সঙ্গে মিশে গেল।
আগুন এক দারুণ সাপুড়ে। কত রঙ্গ আর কত মাপেরই অসংখ্য সাপ যে আছে তার ঝুলিতে! যার দেখার চোখ আছে, সেই-ই দেখতে পায়।
ভাবছিল তুরু। চুপ করে আগুনের দিকে চেয়ে।
একটা হলুদ কাঠের টুকরো দিয়ে বাড়ি মারল তুরু ধিকিধিকি-জ্বলা জংলি আমের গুঁড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে তুবড়ি জ্বলে উঠল চিড়বিড় শব্দ করে। বুড়োর স্বপ্ন ছিটকে গেল। কাঠের মধ্যেও কত লোহাচুর থাকে! ভাবল তুরু। নইলে এমন তুবড়ি ওঠে কী করে!
বুড়ো শিকারি তবু তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে আগুনের দিকে।
তুরু মনে মনে বলল, দেখে নাও। এই আগুনেই ছাই হয়ে যাবে তুমি। ছাই হবে, তোমার ওই জেদে। শিকার তো বড়লোকদের একটা খেলাই। কত শিকারিই সে দেখল তার বাবার আমল থেকে। খাওয়া-দাওয়া, গান বাজনা, মজা, দল বেঁধে শিকার। হরিণ, শম্বর, পাখি; সবরকমের। বাঘ যদি মারা যায় কোনওরকম ঝুঁকিই না নিয়ে, তবেই বাঘ। নইলে ওই সবেই তারা সন্তুষ্ট। কিন্তু বুড়ো শিকারির এ আবার কী রকম শিকার! এ যে দেখছি কার্মা-নাচা মেয়েদেরই মতো গোঁ। জেদের শেষ কথা। গাঙ্গারিয়া বা গান্ধালা ফুল খোঁপায় গুঁজব না; আমাদের পলাশ ফুলই চাই। চাই। চাই। চাইই।
বুড়ো নিথর হয়ে বসে ছিল আগুনের দিকে চেয়ে।
.
বুড়হা-বাঘাটা তখনও সেই চ্যাটালো কালো পাথরের উপরেই বসে ছিল। এখন অন্ধকার হয়ে গেছে। সূর্য ডুবলে যে-তারাটা সবচেয়ে আগে ওঠে, সেটা জ্বলজ্বল করছে। আকাশে আরও কত তারা। বাঘেদের ভাষা নেই মানুষের মতো। বাঘেদের ভাবনাগুলি তাদের মৃত্যুর সঙ্গেই গলে পচে যায়। শকুনে শেয়ালে হায়নায় ছিঁড়ে খায়। মানুষ যা ভাবে, তা লিখে রেখে যেতে পারে। সেদিক দিয়ে মানুষরা খুবই ভাগ্যবান। বাঘেদের ভাষা নেই, সাহিত্য নেই; তাই কৃত্তিকা, রোহিণী শতভিষা, স্বাতী, কারওই নাম জানে না তারা। কিন্তু চেনে তাদের। অন্ধকার রাতে পথভোলা বাঘেরাও তারাদেরই দিকে চেয়ে পথ চিনে নেয়।
লেখাপড়া শেখেনি বুড়হা বাঘা। মনের ভাব প্রকাশ করে বাঘেরা, অঙ্গভঙ্গি করেই। চোখ দিয়ে। অথবা কয়েকটি মাত্র শব্দ করে। মানুষেরা অবশ্য বড় বেশিই কথা বলে। ভাষা আছে বলেই তা নষ্ট করা ঠিক নয়। এত কথা বলার প্রয়োজন বা কী ছিল? তাই-ই বোধ হয় খুব কমই সময় পায় ওরা ভাবনার। না ভাবলে, যে-কোনও প্রাণীই বোধহয় বুদ্ধিতে খাটো হয়ে যায়। মানুষও।
বাঘা ভাবে। বাঘেরা রাতে এবং অনেক সময় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস চুপ করেই থাকে। চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে। আর ভাবে। শুধু ভাবেই। বাঘের মতো নীরব জানোয়ার, কম কথা বলা জানোয়ার বনে-পাহাড়ে খুব কমই আছে। অথচ সে সবসময়ই সক্রিয়। সবসময়ই কিছু-না-কিছু করছে। একমাত্র ঘুমুবার সময়টা ছাড়া, এই চুপচাপ বাঘেরা।
চারধার অন্ধকার হয়ে গেছে। নীচের জঙ্গল থেকে একটানা ঝিঁঝির ডাক ভেসে আসছে। পাহাড়ের নীচেই, তার যাতায়াতের পথের পাশে একটা মস্ত শিমূলগাছ আছে। তার জন্মের পর থেকেই সে দেখে আসছে এই গাছটাকে। যদিও ছোটবেলায় বুড়হা-বাঘা এই গুহাতে থাকত না। থাকত, বাজার নদীর ওপারের অন্য একটি গুহাতে। সেই গুহাটিরই কাছে, বছর পনেরো আগে সাদা মানুষদের ছুলোয়া শিকারে তার মা আর তার বোন মারা পড়ে। একই সঙ্গে। এক শীতের সকালে। কড়াক্কড় করে বাজ পড়ার মতো শব্দ হয়েছিল কয়েকটা। নদীর একটা সোঁতার মধ্যে গা-ডুবিয়ে দূর থেকে বুড়হা-বাঘা দেখেছিল যে, যন্ত্রণায় কারাতে কারাতে তার মা স্থির হয়ে গেল। রক্তে লাল হয়ে গেল জায়গাটা। ঘন লাল রক্তে ভিজে গেল ঝোপঝাড়ের গাঢ় সবুজ।
অনেকই জানোয়ারের রক্ত খেয়েছে বুড়হা-বাঘা। আজ অবধি। শুধু বাঘেরই রক্ত খায়নি কখনও। যদি কাছাকাছি থাকত তখন, হয়তো খেয়ে দেখত ও। বোনটা নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারেনি। ঘাড়ে গুলি লেগেছিল তার। চিত হয়ে স্থির হয়ে শুয়ে ছিল দুপা উপরে তুলে একটা গিলিরি ফুলের ঝোপের পাশে।
দুঃখ হয়নি বাঘটার একটুও। ভয় হয়েছিল। ভয়ের মুখে, দুঃখ-টুঃখ সব ঝড়ের মুখে ঝরাপাতার মতোই উড়ে যায়। বিলাসী মানুষের মতো দুঃখ-দুঃখ নেইও বাঘেদের। ভয় আছে। রাগ আছে। আর আনন্দও আছে। খিদে-তৃষ্ণা আছে সব রকমেরই। মান-অভিমান, আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ, উচ্চাশা, হতাশা, ঈর্ষা, এসব ফালতু ব্যাপার। দুপেয়ে মানুষদেরই ব্যাপার। বাঘেদের কিছুমাত্রই নেই ওসব বাড়তি বোধ।
বড় নির্ঝঞ্ঝাট জীবন ওদের।
সেই দুর্ঘটনার পরেই, একা, জোয়ান, প্রকাণ্ড বাঘটা পালিয়ে চলে এসেছিল এই গুহাতে। এই গুহাতেই বুড়ো হল জোয়ান। সব জোয়ানই বুড়ো হয় একদিন। এই গুহাটা সত্যিই খুব দুর্গম। মাত্র একদিক দিয়েই পৌঁছনো যায় এখানে। অন্য তিন দিকেই দুর্ভেদ্য ন্যাড়া পাহাড়। যেদিক দিয়ে আসা যায়, সেদিক দিয়েও কোনও শিকারি উঠে আসার অনেক আগে তার শব্দ পাওয়া যাবে। কোনও শিকারিই অবশ্য আজ অবধি আসেনি এখানে। এলে, সে বুড়ো বাঘার এগারো নম্বর হত। গত বছর, গরমের এক রাতে অন্য এলাকার একটা বাঘ এসেছিল। সমস্ত রাত এবং পরের দিন সকাল দশটা অবধি দুজনের লড়াই চলেছিল। লড়াই করতে করতে পাহাড়ে গড়িয়ে গেছিল তারা। গাছপালা, ঘাস-পাথর সব নড়ে গেছিল। দেওতা, ঘামসেনবাওয়ার ঘুম ভেঙে গেছিল। লড়াই শেষ হলে, বুড়হা বাঘা মরা বাঘটাকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিল পাহাড়ের মাঝামাঝি জায়গার একটা খাঁজ থেকে নীচের উপত্যকায়। যেখানে, সাদা-দাড়ি শিকারি তার সাদা তাঁবুর সামনে কালো রাতে বসে আছে এখন; সাদা নদীর পাশে। বুড়ো-বাঘার খুব ভাল লেগেছিল।
বাঘেরা নামেই বুড়ো হয়; আসলে নয়। সত্যি-সত্যি বুড়ো হাওয়ার আগেই মরে যায় তারা। বুড়োদের জায়গা নেই জঙ্গলে। তা ছাড়া দুটো বড় বাঘ কখনওই এক এলাকাতে থাকতে পারে না। বাঘেরা মানুষের মতো সামাজিক নয়। দুর্বল এবং প্রত্যাশী যারা, তাদেরই দরকার সমাজকে। বড় বাঘ সমাজের তোয়াক্কা করে না, ভীরু চিতল হরিণী বা ভিখিরি, পরনির্ভর, ইতর, স্বার্থান্বেষী মানুষের মতো।
এই বুড়ো শিকারির সঙ্গে বুড়হা-বাঘার ফয়সালা আছে। মানুষের মতো দুপেয়ে জানোয়ারের এত দম্ভ সহ্য করা যায় না। কারও দম্ভই সহ্য করেনি বুড়হা বাঘা।
গত আটদিন ধরেই বাঘটা লক্ষ করছে যে, বুড়ো-শিকারি তাকে ছায়ারই মতো অনুসরণ করছে। গতকাল গুহা-ফিরতি পথে সে শিকারির নরম জুতোর ছাপ দেখেছিল তারই পায়ের দাগের উপর। অনেকদূর অবধি সেই কারণেই শিকারিকে ছুপকি দেওয়ার জন্যে সে ইচ্ছে করেই বানজারের জলে নেমে গেছিল। যেন, পায়ের ভাঞ্জ দেখে শিকারির মনে হয়, নদী পেরিয়ে ওপারেই চলে গেছে বুড়হা বাঘা। তারপর নদীর জলের মধ্যে দিয়ে, তার বুক-অবধি ভিজিয়ে, হি-হি শীতের রাতে আধ মাইলটাক উল্টোদিকে গিয়ে অনেক চোরাপথে চড়াই ভেঙে ফিরে এসেছিল নিজের গুহার দিকে। গুহার হদিস যদি এই বুড়ো শিকারি জেনে যায়, তাহলে বুড়হাবাঘার বিপদ আছে।
একথা না-বোঝার মতো বোকা সে নয়।
দশ-দশটা শিকারি মানুষকে টুঁটি কামড়ে মেরেছে বুড়হাবাঘা। রাগেই। যদিও খায়নি কাউকেই। মানুষের অমন নরম প্যাতপেতে নোনতা মাংস খাওয়া না-খাওয়া সমান। আধঘন্টা পরই হয়তো খিদে পেয়ে যাবে। যা তার খাদ্য নয়, তা সে খেতেই বা যাবে কেন? বাঘেদের দেওতা ঘামসেনবাওয়া, বাঘেরা কী খাবে আর খাবে না তা ঠিক করে দিয়েছেন।
বুড়হাবাঘার মন ভাল নেই।
ওই সাদা-দাড়ি শিকারি যে কী চায়! কেন যে সে তার পিছু নিয়েছে এমন নাছোড়বান্দার মতো, তা কিছুতেই বুড়হা বাঘা বুঝে উঠতে পারছে না।
সে অনেকবারই মানুষের হাতে গুলি খেয়ে মরতে মরতে বেঁচে গেছে। মা, বোন এবং তার দুবউকেও সে তার গায়ের পাশে একেবারে দাঁড়ানো অবস্থাতেই গুলি খেয়ে মরতে দেখেছে। তাদের রক্তের রঙ এখনও চোখ থেকে মোছেনি বুড়হা-বাঘার। কুটিল ভীরু মানুষের হাতে সরল সাহসী বাঘেদের মৃত্যু বুড়হাবাঘার কাছে নতুন কিছু নয়। অবশ্য বদলা হিসেবে, তিনজন শিকারি মানুষকেও সে তার দিকে গুলি ছোঁড়ার পরেই মাচা থেকে নামিয়ে ফেলে, শেয়াল যেমন করে বর্ষাকালের পাড়হেন মাছের মাথা চিবোয় তেমনি করে চিবিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। আরও পাঁচজনকে মেরেছে ছুলোয়া শিকারের সময় মাটিতেই। তাকে মারতে এসে তারা ফওত হয়েছে। আরও দুজন ঘোড়ায় চড়ে মারতে এসেছিল তাকে। তাদেরও। ভয় পেয়ে সওয়ারহীন ঘোড়া চিহাহ্-চিহাহ করতে করতে ছুটে গেছে মুখে আতঙ্কের ফেনা তুলে।
তারপর থেকে মানুষকে সে এড়িয়েই চলে। মানুষের গোরু-মোষ-ঘোড়া কিছুই সে ধরে না আর। টোপ দিলেও না। ছাগল, কুকুর, এসব তো বড় বাঘের খাদ্যই নয়। ফিচেল্ চিতা-ফিতারা, শেয়াল-হায়েনারা, এসব ফিচলেমি করে। মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন জানোয়ারের মধ্যে বুড়হা বাঘা খেতে ভালবাসত একমাত্র দিশি ঘোড়া আর গাধা। কিন্তু সেই সুস্বাদু, দিশি ঘোড়া-গাধার স্বাদও ইচ্ছে করেই ভুলে গেছে ওই ঝঞ্ঝাটিয়া মানুষদের এড়াবার জন্যে। কিন্তু তবুও এই সাদা-দাড়ি শিকারি কেন যে লেগেছে তার পিছনে! বুড়হা-বাঘা তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না; তার সব বুদ্ধি সামনের পায়ের দুথাবাতে জড়ো করেও।
আজ রাতে তাঁবুর মধ্যে সামনের আগুন একটু নিভু নিভু হলেই বুড়হা বাঘা গুহা থেকে নেমে প্রথমে ওইদিকেই যাবে। কাল রাতে একটা বারাশিঙা মেরে আধখানা খেয়ে এসেছিল। সেইদিকেও যাবে। খুবই সাবধানে। যদি বারাশিঙার মড়িটা সাদা দাড়ির দলের কেউ দেখে ফেলে থাকে, তাহলে তারা বুড়হাবাঘার জন্যে সেখানে ওৎ পেতে থাকতে পারে। তাই সরেজমিনে তদন্ত করতে আগে তাঁবুতে যাবে, তারপর খাওয়ার চিন্তা। আড়াল থেকে বুড়ো শিকারিকে দেখবে বুড়হা বাঘা ভাল করে। অনেকক্ষণ ধরে। তবে, তাকে মারবে না চোরের মতো চুরি করে। শিকারি-মানুষকে মারতে হলে, সে নিজে শিকারি বলেই সামনাসামনি মারবে এবং যদি সে ক্ষতি করে কোনও, তবেই। বাঘে আর মানুষে তফাত আছে। বুড়ো-বাঘা, ল্যাংড়া খোঁড়া আদৌ নয়, অথবা শজারুর কাঁটার ঘায়ে ঘেয়ো বা মানুষের গুলি-খেয়ে কঁকিয়ে-বেড়ানো লোম-ওঠা কোনও মানুষখেকো বাঘও সে নয়। বাঘেদের কুলাঙ্গার নয় সে। বড় বাঘা বরং বাঘেদের গর্বই! সব বাঘেরই ঠাকুর্দা সে। কারও কাছেই মাথা সে নোয়ায়নি। নোয়াবেও না কখনওই। না অন্য বাঘের কাছে, না অন্য কোনও জানোয়ারের কাছে; বুড়হাদেব আর ঘামসেনবাওয়ার ধরতিতে সবচেয়ে ধূর্ত, নিকৃষ্ট, কিন্তু সবচেয়ে ক্ষমতাশালী জানোয়ার যে মানুষ, তার কাছেও মাথা সে নোয়ায়নি কখনও। মাথা নোয়াতে শেখায়নি বাঘের রক্ত। যে বাঘ মাথা নুইয়ে বেঁচে থাকে, বেঁচে থাকার জন্যে মাথা নোয়ায়, সে বাঘই নয়, বাঘের মতো চেহারার অন্য কোনও নিকৃষ্ট জানোয়ার।
অথচ ওই সাদা-দাড়ি বুড়ো শিকারিও তো মানুষ। যারা চাকরির জন্যে, দুমুঠো খেতে পাওয়ার জন্যে, নাম কেনার জন্যে, প্রাইজ পাওয়ার জন্যে, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি তাদের মাথা এর পায়ে তার পায়ে নুইয়েই বাঁচে, সেই সব ধূর্ত বাঁদরের বংশধরেরা, ঋজু, বুড়হা বাঘার চরিত্রর কতটুকু জানে? এক কণাও জানে কি?
.
এখন অন্ধকার। বাইরে ঝিঁঝি ডাকছে একটানা। ভোঁর ঘাসের মাঠের মধ্যে দিয়ে বারাশিঙার দল রাত পেরিয়ে যাচ্ছে, হাঁটুতে ঝাঁকি তুলে তুলে, মানুষদের বিয়েবাড়ির সোনার বেনারসি-পরা, কোমরে রুপোর চাবির গোছা-ঝুলনো, পাঁয়জোর-পরা মেয়েদেরই মতো। নৈঃশব্দ্যের শব্দ যারা শুনতে পায়, শুধু তাদেরই কানে এই ঝুমঝুমি বাজে।
বানজার নদীর ঠিক মধ্যিখানে, সাদা-দাড়ি শিকারির তাঁবুটা থেকে দুআড়াই শো মিটার দূরে একটি আবর্ত-মতো আছে। জল সেখানে জোরে ধাক্কা খেয়েই উছলে ওঠে। অনন্তকাল থেকেই উছলে উঠছে, সমুদ্রের ঢেউ যেমন বেলাভূমিতে আছড়ে পড়ে চরকি-খাওয়া ঘোলের মতো। পাথরের মধ্যে মধ্যে জমে আছে আঁজলা আঁজলা নিশ্চল জল। গান্ধালা আর গাংগারিয়া ফুল ফুটে আছে সেই জলে। পাথরের খাঁজে খাঁজে। ফুলগুলোকে অন্ধকারে বোঝা যায় না। চাঁদ উঠলে তারা রুপোর ফুল হয়ে রূপের হাট মেলে বসে।
দিনের বেলা, নদীর উজানে তিন মাইল দূরের বাইগাদের গ্রাম রুজঝানি থেকে জঙ্গলের সুঁড়িপথে হেঁটে এসে একটি অথর্ব বুড়ো এবং তার শিশু নাতি ওই পাথরগুলোরই উপরে ছিপ ফেলে বসে থাকে সারাদিন। পৃথিবীর সব ঘুম চোখে নিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী বুড়ো শীতের সূর্যের দিকে কালকেউটের মতো চৰ্চকে সরু কোমর ফিরিয়ে ঝরনার মধ্যে ঝিমোয়। আর তখন মুখে দুধের-গন্ধ-ভরা তার ছোট্ট-নাতি ওম-ধরা রোদে উবু হয়ে বসে নানারকম স্বপ্ন দেখে। মাছের স্বপ্ন। গানের স্বপ্ন। পরীর স্বপ্ন। যে-জীবন তার সামনে পড়ে আছে, বাঁকের ওপাশের অদেখা, অজানা নদীরই মতো; সেই না-হাঁটা, না-দেখা জীবনের স্বপ্ন। যে-জীবনে সেই শিশু একদিন বয়ে যাবে এই চকে-চলা বাজার নদীরই মতো, যৌবনে পৌঁছে।
বেচ্চারি! ছোট্ট ছেলে তো! জানে না তাই যে, নদীরই মতো বয়ে যেতে যেতে, জীবনের বেগ বাড়তে বাড়তে, একসময় নিজের আর কোনওই জারিজুরি খাটবে না নিজের জীবনেরই উপরে। জীবনের ভারে চাপা পড়ে গিয়ে হয়তো ভেসেই যাবে স্রোতের শিকড়-আলগা-হওয়া গান্ধালা ফুলেরই মতো। বেশির ভাগ মানুষই যেমন ভাসে।
তার দাদুর সব স্বপ্নই দেখা শেষ হয়ে গেছে এ-জন্মের মতো। সে কুঁজো হয়ে বসে, জীবন আর মৃত্যুর মোহানার কাছে পৌঁছে মনে-মনে পেছন ফিরে চেয়ে এখন শুধুই ভাবে। ভাবে, ভাবে আর ভাবে। বুড়ো, অকেজো ষাঁড় যেমন করে গলকম্বলের নীচে অনেক খড়কুটোর মতো পৃথিবীর সমস্তটুকু সময় গলার মধ্যে ভরে নিয়ে জাবর কাটে; তেমনি করে।
যে-জায়গায় বুড়ো আর নাতি বসে মাছ ধরছে সে-জায়গা থেকে অনবরত উঠে-আসা জলের ছলছলানি অন্ধকার শীতের রাতের হিমেল স্তব্ধতাকে একটানা ছলাত ছলাত শব্দে স্তব্ধতর করে তুলছে। সমস্ত শব্দের মধ্যেই শব্দহীনতা ঘুমিয়ে থাকে। সমস্ত শব্দহীনতার মধ্যেও সজাগ থাকে শব্দ। নাতি জানে না। দাদু জানে।
বুড়হা বাঘাটা বানজার নদীর পারের আড়াল দিয়ে এগিয়ে আসছিল তাঁবুটার দিকে। তাঁবুর বাইরের আগুন নিভুনিভু হয়ে এসেছে। আগুন যখন নিভে আসে, তখন সে নিজের সঙ্গে চাপা, ফিসফিসে গলায় কথা বলে। হাতেখড়ির আগুন, বিয়ের আগুন, চিতার আগুন, সব আগুনই। রাতের আগুন লাল নীল সবুজ কমলা হাসি হাসছিল। নিজের সঙ্গে নিজে কথা বলছিল ফুট-ফাট করে।
বুড়ো শিকারি ক্যাম্প-খাটে পাশ ফিরে শুয়ে ছিল। গায়ের উপর জলপাইরঙা কম্বল। তাঁবুর অন্য কোণে আরেকটি ক্যাম্পখাটে তুরু শুয়ে আছে। বাস্তারের বাইসন-হর্ন মারিয়াদের হাতে-বোনা কম্বলে মাথা মুড়ে। তারার আলোতে, তাঁবুর পাশে একটা মস্ত কাসসিগাছের নীচে দাঁড় করিয়ে রাখা রায়পুরের নাম্বার-প্লেট লাগানো জিপটাকে একটা ভুতুড়ে ছোট্ট কুঁড়ে বলে মনে হচ্ছে। শিশিরে ভিজে সপে করছে জিপের বনেট। উইন্ডস্ক্রিনের উপর শিশিরের মেঘ জমেছে। বুড়ো শিকারির মাথার কাছে বাঁশ দিয়ে বানানো গার্যাকে ফোর-সেভেন্টি ডাবল-ব্যারেল জেফরি নাম্বার টু রাইফেল আর হল্যান্ড-অ্যান্ড-হল্যান্ডের ডাবল-ব্যারেল টুয়েলভ-বোর শটগানটা দাঁড় করানো আছে। তুরুর মাথার কাছেই তাঁবুর গায়ে হেলান-দেওয়ানো আছে পয়েন্ট টু টু ব্রুনো রাইফেল আর তুরুর একনলা বন্দুকটা।
রাবারের বালিশে মাথাটা কাত হয়ে রয়েছে বুড়ো শিকারির। তুরুর নাক এমনই ডাকছে যে, মনে হচ্ছে একটা ধাড়ি শুয়োরই বুঝি ঢুকে পড়েছে তাঁবুর মধ্যে।
বুড়ো শিকারিকে সকলেই খুব সুখী লোক বলে জানে। খুবই বড় চাকরি করত সে। বুড়োর একমাত্র সন্তান, ছেলে। সে অ্যামেরিকায় থাকে। অ্যামেরিকান মেয়ে বিয়ে করে অ্যামেরিকান সিটিজেনশিপ নিয়ে নিয়েছে। এই পোড়া দেশে আর থাকবে না ঠিক করেছে। ফিজিসিস্ট সে। নিউক্লিয়ার বোমা বানাতে জানে। ধ্বংসবীজ বোনে। অনেক টাকা রোজগার করে। কালো ক্যাডিলাক গাড়ি আছে তার। নিজের বাগানওয়ালা বাড়ি। বউ কম্পুটার প্রোগ্রামার : মৃত্যু বোনে।
এখানে আর আসে তারা। ফিরবেও না বলেছে। বুড়োকে বড়দিন আর জন্মদিনে কার্ড পাঠায় কিন্তু কর্তব্য করে।
বুড়ো শিকারি চেয়েছিল, তার ছেলে দেশে ফিরে এসে এ দেশের ভাল করুক। তার বিদ্যাবুদ্ধি দেশের কাজে লাগাক। একটু না-হয় খারাপই থাকবে, খারাপই খাবে-পরবে, না-হয় দিশি গাড়িই চড়বে। কিন্তু হয়নি তা। মাঝে-মাঝেই ওখানে যাওয়ার জন্যে লেখে ছেলে-বউ। টিকিট কেটেও পাঠিয়ে দিতে চায়। তবুও বুড়ো যায় না। অদ্ভুত টেটিয়া বুড়ো একটা। অ্যামেরিকায় বারবার যাওয়ার সুযোগ থাকতেও যায় না। অন্য অনেক ফোরেন-প্রেমী ভারতীয় মানুষ একথা শুনে বুড়োকে পাগল বলে।
বুড়ো দশ বছর আগে একবার শুধু গেছিল। ছেলে-বউকে দেখে এসেছিল। তারপর যায়নি আর। যাবেও না।
ভাল লাগে না বুড়োর। এই দেশ গরিব কিন্তু বড় সুন্দর। যে দেশে এই বুড়ো শিকারির জন্ম, তার বাবা ও ঠাকুর্দার জন্ম, এই জঙ্গল-পাহাড়, নদী-নালা, এই বিরাট নানা-ভাষাভাষী, নানাজাতের, নানাপথের, নানামতের দেশকেই বুড়ো শিকারি তার সব কিছু বলে জানে। ভাবে, এই দেশেই তার জন্ম, যেন এই দেশেতেই সে মরে। দেশের মানুষরা যদি নিজের দেশ ছেড়ে ভাল খাওয়া, ভাল পরার জন্যে বিদেশেই চলে যায়, তাহলে দেশের কী হবে? যে-কোনও দেশের পরিচয় তো সে-দেশের মানুষদেরই দিয়ে!
বুড়ো শিকারির ভাল লাগে না। যারা দেশ ছেড়ে অভিমানে চলে যায়, তাদের অভিমানটা চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার মতোই এক অভিমান। ভাবে, বুড়ো। কিন্তু ছেলে বোঝেনি। দেশের কথা দশের কথা বোঝে, ভাবে, এমন লোক এখন দেশে যে বেশি নেই। বড় অভাগা এই দেশ; ভারতবর্ষ।
বুড়ো শিকারির নিজের চলে-যাওয়ার মতো টাকা পয়সা আছে। নিজের বেঁচে থাকা, এমনকী ছোটখাটো শখের জন্যেও সে কারও দয়ার ওপর নির্ভর করে না। বুড়োর বন্ধু-টন্ধু বেশি নেই। যে-মানুষ গভীর, বোধহয় তার বন্ধুবান্ধব কখনও বেশি থাকে না। যে-পাখি আকাশে উঁচুতে ওড়ে, তাকে একা-একাই উড়তে হয়। অনেক বন্ধু থাকে শুধু চড়ুই, আর কাকেদেরই। খুব উঁচুতে কালো বিন্দুর মতো যাকে দেখা যায়, সেই বাজপাখিরই বন্ধু থাকে না কোনও।
বুড়োর স্ত্রীও নেই। মারা গেছেন বহুবছর আগে। তার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এবং তার একমাত্র ভাইও তাকে খারাপ বাসে না। বুড়োর জীবনে কোনও অসুখ নেই, অভাই নেই, অনুযোগ নেই। সবকিছুই ঠিকঠাক চলে। সময়মতো চা, খবরের কাগজ, ভোপালের আহমেদনগরের পথে প্রাতঃভ্রমণ, গরম জলে চান, ব্রেকফাস্ট খাওয়া, ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে বই এনে পড়া, গান-বাজনা শোনা। তারই মতো বুড়ো-হয়ে-যাওয়া দুএকজন শিকারি বন্ধুর সঙ্গে কখনও সখনও পুরনো দিনের শিকারের গল্প, জঙ্গলের গল্প করা; এই-ই। মানসম্মান, শখ, শান্তি কোনও কিছুরই ঘাটতি ছিল না বুড়োর জীবনে। তবুও এই সাদা-দাড়ির শিকারি যে কেন এই বয়সে একেবারে একা একাই এই বুড়হা বাঘার মোকাবিলা করতে চায়, তার কারণটা কারও জানা নেই।
কারণটা, বুড়ো শিকারি শুধু নিজেই জানে। কিন্তু বলে না কাউকেই।
শিকারি বন্ধুদের মধ্যে দুজন নামী শিকারি সাদা-দাড়ির সঙ্গে আসতেও চেয়েছিল। বুড়োর ছোট ভাই অনেক করে মানা করেছিল। বুড়োর শালা এবং এক শালিও অনেক অনুনয় বিনয় করেছিল। কারও কথাই শোনেনি একগুঁয়ে। বুড়ো। হেসেছিল শুধু, আর ভুসস্ ভুসস্ করে পাইপের ধোঁয়া ছেড়েছিল।
শিকারি, সাদা-দাড়ি বুড়োটা চিরদিনই বুনো শুয়োরেরই মতো একগুঁয়ে।
এখনও জঙ্গলে কেন যান দাদা? কী আছে সেখানে আপনার?
ভাইয়ের স্ত্রী অনুযোগ করে জিজ্ঞেস করেছিল। বুড়ো হেসে বলেছিল, আছে, আছে। এখনও বাকি আছে কিছু। সব যে পাওয়া হয়নি, সব নেওয়া হয়নি এখনও। সব দেওয়াও হয়নি; যা দেওয়ার, জঙ্গলকে। বুঝেছ রানু?
তার জানাশোনা সব শিকারিই যে বাঘকে মারতে গিয়ে নিজেরা মরেছে, নয় কোনওক্রমে প্রাণ নিয়ে ফিরে এসে আতঙ্কে শিকারই ছেড়ে দিয়েছে জন্মের মতো, বন্দুক রাইফেল পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছে দু-একজন; সেই সাংঘাতিক বাঘটার চেয়েও বোধহয় অনেক বড় কিছু মারতে এসেছে এবারে বুড়ো শিকারি, এই বাজারের তীরের, বিন্ধ্য, সাতপুরা আর মাইকাল পর্বতশ্রেণীর পাহারা-ঘেরা গহন জঙ্গলে।
যা সে মারতে এসেছে, সেটা কী? সেটা ভূত? না কোনও অপদেবতা? নাকি ড্রাগন বা ডাইনোসারের মতোই কোনও প্রাগৈতিহাসিক জন্তু? সে সম্বন্ধে বুড়োর পরিচিতদের কারও কোনও স্পষ্ট বা অস্পষ্ট ধারণাও নেই। এমনিতে সকলেই জানে যে, বুড়ো-শিকারি বুড়হাবাঘাকেই মারতে এসেছে। একটা আত্মম্ভরী, জেদি, গর্বিত, খ্যাপাটে বুড়ো। বড়ই বাড় বেড়েছে মানুষটার। বুড়হাবাঘার হাতে তার মৃত্যু অবধারিত। তার দিন ঘনিয়ে এসেছে।
বুড়োর ঘুমের মধ্যে, তার ঘুমন্ত মুখের আধফোঁটা হাসির মধ্যে, সেই না-বলা গোপন কথাটিই যেন দুলছে গাঢ় নিশ্বাসের সঙ্গে বাজার নদীর বুকের মধ্যের আধো-ফোঁটা গান্ধালা ফুলেরই মতো।
সব বুড়োরাই বড় মিষ্টি হয়। শিশুদেরই মতো। বুড়োদের মুখেও দুধের গন্ধ থাকে।
.
মাঝরাতের গা-ছমছম জঙ্গলে বুড়হাবাঘটা নদীর পাড় ছেড়ে ঘাসবনে নেমে এল মাঘ মাসের শিশিরভেজা বরফের মতো মাটি আর ঘাসের গভীরে। মাটি আর ঘাসের সঙ্গে যেমন করে একমাত্র বাঘেরাই মিশে যেতে পারে, তেমন করেই সে মিশে গিয়ে বুকে হেঁটে-হেঁটে তাঁবুটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল, অন্ধকারের বুকে অন্ধকারতর নিঃশব্দ এক দুঃস্বপ্নের মতো, থেমে থেমে; শামুকের চেয়েও আস্তে আস্তে। বুড়হা-বাঘার পেছনে, ফ্রিজ খুললে যেমন ঠাণ্ডা ধোঁয়া বেরোয়; তেমনই বরফের ধোঁয়া উঠছে শীতের রাতে প্রায়-জমে-যাওয়া বাজারের স্লেট-রঙা জল থেকে।
নদী কথা বলছে রাতের বনের সঙ্গে, তারাদের সঙ্গে; যে-ভাষা শুধু নদী, বন আর তারারাই জানে।
তাঁবুর আর নদীর ঠিক মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে এবারে বুড়হা-বাঘা। নদীর এপারের জঙ্গলের গভীর থেকে কপার-স্মিথ পাখি ডাকছে। টাকু-টাকু-টাকু-টাকু-টাকু। তার দোসর সাড়া দিচ্ছে নদীর ওপার থেকে। হঠাৎই পঞ্চমীর চাঁদ উছলে উঠল সেগুনবনের মাথার উপর। হাতির কানের মতো বড় বড় শিশিরভেজা সেগুনপাতাদের উপর পড়ে, মাঘী-পঞ্চমীর চাঁদের আলো পিছলে যেতে লাগল। কোনও কালো কুচকুচ গোঁ যুবকের হিমেল মৃতদেহেরই মতো রাতের শিশিরভেজা ভোঁর ঘাসের মাঠটিকে, ভেজা চাঁদের ঘোলা আলো মুহূর্তের মধ্যে কোরা কাপড়ে ঢেকে দিল যেন!
সেই শীতার্ত, ভিজে, পিছল রাতে ফিসফিস করে কারা যেন বলে উঠল : রাম নাম সত হ্যায়। রাম নাম সত হ্যায়!
থমকে থেমে গেল বুড়হা-বাঘা।
আলোতে মানুষের আনন্দ, বাঘের ভয়। কিছুক্ষণ মাটি কামড়ে পড়ে থাকল সে। মৃতের চেয়েও অনেক বেশি মৃতের মতো। বড় মিষ্টি এই মাটি। বুড়হা বাঘার দেশের মাটি। ভারতবর্ষের মাটি। যে-মাটি, একদিন প্রাগৈতিহাসিক গোঁন্দদের রূপকথার পৃথিবীর জন্ম-ইতিহাসের দারুণ-বলশালী কচ্ছপ কিচু রাজা বয়ে এনেছিল ইন্দ্রলোক থেকে। সাপেদের রাজা বুড়হা-নাঙ্গ আর তার বউ দুধ-নাঙ্গের রাজ্য ইন্দ্রলোক। সেখানে গিয়ে কিচুল রাজা সেখানের মাটি গিলে ফেলে লুকিয়ে তার পেটের মধ্যে করে বয়ে নিয়ে এসেছিল এই প্রস্তরময় পৃথিবীতে ফুল, ফল, শস্য ফলাবে বলে। পৃথিবীর আগের নাম ছিল সিঙ্গার দ্বীপ। তখনও নাঙ্গা-বাইগা আর নাঙ্গা বাইগিকে তৈরি করেননি ভগবান, তাঁর গায়ের ময়লা দিয়ে। তৈরি করেননি বুড়হা দেবকে, উইকে, কুসরো, সাইআম, ঘামসেনবাওয়া ইত্যাদি দেবতাদেরও। সেই সিঙ্গার দ্বীপ, অথবা ভারতবর্ষের মাটিতে নাক ছুঁইয়ে যুগ-যুগান্তরের গন্ধ নিচ্ছিল বুড়হাবাঘা।
হঠাৎ-ওঠা চাঁদের আলোয় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে পৃথিবীর সব শিকারির বড় শিকারি সাবধানী বুড়হা বাঘা অনেকক্ষণ মাটি কামড়ে মরা মাঠের উপর মড়ারই মতো পড়ে থাকল। নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু হয়ে। অন্ধকারে অভ্যস্ত দুটি চোখকে চাঁদের আলো আস্তে আস্তে সইয়ে নিয়ে ভুতুড়ে রাতে একটা ভুতুড়ে প্রায়-নিশ্চল ছায়ারই মতো ভেজা ঘাসের মধ্যে এগিয়ে যেতে লাগল সে। প্রায় পৌঁছেই গেছে এখন তাঁবুর কাছে।
সাদা তাঁবুর দরজাটা বন্ধ। চাঁদের আলোয় একটা সফেদ হাতির মতো দাঁড়িয়ে আছে তাঁবুটা।
বুড়হা-বাঘা আস্তে আস্তে তাঁবুটার চারদিকে ঘুরতে লাগল। ভিজে ঘাসের বনে, বনের রাজা, সব বাঘের সেরা বাঘার পায়ে কোনওই আওয়াজ হল না। বোঝা পর্যন্ত গেল না যে বাঘ এল। একজন ভালমানুষের বুকের মধ্যে খারাপত্ব যেমন করে চলে আসে চোরের মতো চুপিসাড়ে, শীতের রাতের বুড়হাবাঘা ঠিক তেমন করেই আসে।
দেখতে পেল যে, তাঁবুর একটামাত্র জানলার পর্দাটা খোলা। বুড়ো-শিকারির হাঁপানি আছে বলে বদিক বন্ধ করে শুতে পারে না সে। তাই তার মাথার দিকের জানলাটির পর্দা নামানো নেই। বুড়হা-বাঘা ভাবল, এই অদ্ভুত শিকারিকে একবার কাছ থেকে ভাল করে দেখবে সে। কে এই শিকারি? কী সে চায়? বুড়হাবার পায়ে-পায়ে কী কারণে সে এমন করে ছায়ার মতো ঘোরে? কেন সে হাঁকোয়া বা ছুতোয়া করাল না একবারও? সবাই যা করে, তা কেন করতে চায় না সাদা-দাড়ি? এর রহস্যটা বোঝা দরকার।
বুড়হা-বাঘা জানলার কাছে পৌঁছবে ঠিক সেই সময়ই একটা কুটরা হরিণ তাকে নদীর ওপারের ছির ঘাসের উঁচু ডাঙা থেকে দেখতে পেয়েই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে ধ্বাক্ ব্বাক্ ব্বা করে ডাকতে লাগল। তার ডাক শুনে হনুমানের দল হুপ-হুপ-হুপ-হুপ-হুপ করে ডালপালা ঝাঁকিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করে সমস্ত বনের প্রাণীদের চিৎকার করে জানিয়ে দিল বুড়হা-বাঘার অস্তিত্ব। তাঁবুর পেছনের সেগুনবন থেকে শম্বরের দল ঢাংক ঢাংক করে ডাকতে ডাকতে বনের বুকের আগাছা এবং ঝোপঝাড় ভেঙে দৌড়ে গেল চৈত্রমাসের ঝড়ের মতো। নিরাপদ আশ্রয়ে। টিটিপাখি ডাকতে লাগল হট্টিটি-হুঁট-টি-টি-টি-হুট-টিটিটি-হুট।
হঠাৎ তাঁবুর দরজা খুলে বুড়ো শিকারি বেরিয়ে এল সাদা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে। রাইফেল হাতে। তার সাদা দাড়ি, সাদা চুল, সাদা গোঁফ সেগুনবনের পাতায় পাতায় ক্রমশ-জোর-হওয়া চাঁদের আলোয় সুন্দর দেখাচ্ছিল। বুড়হা-বাঘাটার মনে হল, মানুষটা ভাল। সেও যেন ভাল বাঘ। তবে কেন সে তার পেছনে লেগেছে? কিসের শত্রুতা বুড়োর তার সঙ্গে? ভাল মানুষ আর ভাল বাঘের মধ্যে কোনও শত্রুতা থাকা তো উচিত নয়।
বুড়ো শিকারির হাতে বণ্ড-এর পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। অ্যামেরিকা থেকে কিনে নিয়ে এসেছিল, বুড়ো যখন গেছিল ছেলে-বউয়ের কাছে। টর্চ ফেলল নদীর দিকে সে। বুড়হা-বাঘা ঘাসের মধ্যে ঘাস হয়ে মিশে রইল। দেখল তাঁবু থেকে একজন আদিবাসী ছেলে বেরিয়ে এল। আরও একটা টর্চ নিয়ে। কেন, বুঝল না বুড়হা বাঘা, ওরা দুজনেই বানজার নদীর দিকে টর্চ ফেলতে লাগল। বোধহয় কুরাটা ঐদিক থেকে ডেকেছিল বলেই।
বুড়হা বাঘা চাপা হাসি হাসল একবার। শব্দ না করে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে জিপের পেছনের কাসসি গাছের ছায়ায় এবং তারও পেছনের সেগুনবনের গভীরে অনেকখানি ঢুকে গিয়ে চার পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে, মুখ ঘুরিয়ে একবার ডাকল—হুঁ-য়া-উ-উ…।
সমস্ত জঙ্গল থরথর করে কেঁপে উঠল। মনে হল, কামান দাগল যেন কেউ। সেগুনবনের গাছেদের হাতির কানের মতো পাতায় পাতায় চমক লেগে রুপোচুর-এর মতো শিশির ঝরতে লাগল টুপটুপ করে। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে সে-ডাকের প্রতিধ্বনি ফিরে এল নদী-নালার ঠাণ্ডা বুক ধরে, ছুটে গেল আঁক-বাঁক পেরিয়ে, উঠে গেল পাহাড়চুড়োর দিকে।
চমকে উঠল বুড়ো শিকারি। ভয় পেয়ে গেল তুরু।
কথা তো শুনলে না। দ্যাখো এবার। যার খোঁজ করো তুমি, সেই-ই খোঁজ করছে তোমার। বলেই, টর্চের আলো ফেলল তুরু, তাঁবুর চারপাশের ঘাস-নিড়োনো পরিষ্কার জায়গার নরম ভিজে মাটিতে। আতঙ্কিত গলায় বলল, এইই দ্যাখো! সেইই নিজে এসেছিল তোমার খোঁজে। এত বড় বাঘের পায়ের ভাঞ্জ না কেউ আজ অবধি দেখেছে, না দেখবে কখনও ভবিষ্যতে। মধ্যপ্রদেশের কোনও জঙ্গলে, কানহা-কিসলি, সীওনী, পেঞ্চ, বান্ধবগড় কোনও জঙ্গলেই এত বড় বাঘ আর একটিও নেই। বাঘের পায়ের দাগ তো নয়, যেন হাতির পায়ের ছাপ!
তুমি কী খুঁজবে তাকে বাপ্পা! সে তোমাকেই শুনিয়ে দিয়ে গেল যে, তাকে খোঁজার দরকার নেই। সে নিজেই হাজির। সাবধান করে দিয়ে গেল।
বলে গেল, আমি আছি। আমি অমর। মানুষের কাছে আমি হারিনি। হারব না কখনওই। আমিও অজেয়।
বাঃ। বলল শিকারি-বুড়ো।
বাঃ কী? তুরু উত্তেজিত হয়ে বলল।
বাঃ।
আবারও বলল, বুড়ো শিকারি।
.
রোদ উঠে গেছে। কিন্তু মাঠ-প্রান্তর পাহাড়-জঙ্গল সবই ভেজা রয়েছে এখনও। রোদ পড়ে শিশিরভেজা পাতায় আর ভোঁর আর ছির ঘাসের ফিকে হলুদ মাঠে, লান্টানার ফুলে, মাকড়সার জালে অসংখ্য হিরে ঝিমিকিয়ে উঠছে।
বুড়ো শিকারি হৈঁটে যাচ্ছে সেগুনবন পেরিয়ে, বাঁশের বনের পাশ দিয়ে; দূরের শান্ত শিশিরভেজা গাঢ় সবুজ শাল-জঙ্গলের দিকে।
তাঁবু থেকে অনেকই দূরে চলে এসেছে সে, ছোট ছোট সাবধানী পা মেলে ফেলে বুড়হা-বাঘার পায়ের দাগ খুঁজে খুঁজে। বুড়োরাও শিশুর মতোই হাঁটে অনিশ্চিত টালমাটাল পায়ে।
অনেক দূরে, ডানদিকে দেখা যাচ্ছে মুক্কি গ্রামটা। একটা ছোট্ট গ্রাম, বাজারের তীরে। নদীর অন্য পারে আছে আরও একটি গ্রাম। যদিও অনেকখানি ভিতরে। সে-গ্রামের নাম বানজার-বামনি। তা ছাড়াও আছে রুঝঝানি। কোনও কোনও রাতে বাজার বানি থেকে ভেসে আসে মাদলের শব্দ আর মেয়ে-পুরুষের গলার ঘুমপাড়ানি গান। কার্মা নাচের গান। বুড়ো, সাদা-দাড়ি শিকারির হাড়ে হাড়ে ভোরে শিশির ভেজা এই প্রকৃতি, এই রোদ, এই নদী, সবই গেঁথে রয়েছে। সেঁধিয়ে গেছে তার মজ্জার মধ্যে এই দেশ। এই দেশের গ্রীষ্ম, এর শীত, বর্ষা এবং বসন্ত। তার কান ভরে রয়েছে এদেশের নদী-নালার ঝরঝরানি গানে, ঝরাপাতার মর্মরধ্বনিতে, মৌটুসিপাখির ফিসফিসে সুরে, বড় বাঘেদের বন পাহাড় গমগমানো পুরুষালি ডাকে। এই দেশের বন-জঙ্গলের দিন ও রাতের সমস্ত স্পষ্ট ও অস্পষ্ট শব্দে। নাক ভরে রয়েছে চিতল হরিণের নীল গাইয়ের আর বসন্তবৌরি পাখির গায়ের গন্ধে।
কোনওই দুঃখ নেই বুড়োর। অনুযোগ, অভিযোগ, আক্ষেপও নেই। তবুও এই হেঁয়ালিভরা বুড়ো হেঁটে চলেছে হেঁয়ালির মতো আঁকাবাঁকা সুঁড়িপথ বেয়ে। কাঁধের স্লিপিং-এ ভারী দোনলা রাইফেলটাকে ঝুলিয়ে নিয়ে, সামনে একটু ঝুঁকে, দুঃখ-সুখের বাঁচা-মরার শেষ দেখার জন্যে চলেছে সে। পিঠে তার ছোট্ট একটি র্যাক-স্যাক। জলপাই-সবুজ। তার মধ্যে জলের বোতল আর কিছু চিড়ে আর গুড়। পাইপের তামাকের টিন। পাইপ পরিষ্কার করার জিনিস। একটি টর্চ। আর তার প্রিয় কবি ওয়াল্ট হুইটম্যানের বই লীভস অফ গ্রাস।
সকালবেলার বনের পটভূমিতে মাঝে-মাঝে সে হারিয়ে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে মুছে যাচ্ছে; যেমন করে খয়েরি ডানার চিল মুছে যায় ঝড়ের আগের খয়েরি মেঘে।
তুরু চলেছে তার পেছন পেছন। বিরক্ত মুখে। চিন্তিত মনে। যতক্ষণ না বারণ করবে বুড়ো, ততক্ষণ সে যাবেই। তুরুর হাতে বুড়োর দোনলা বন্দুকটি। ফেরার সময় অথবা এখনই যদি কায়দামতো পায়, তবে একটি নধর অল্পবয়সী চিতল বা ননদে শুয়োর ধড়কে দেবে তুরু। নয়তো কুটরা বা চিংকারা বা কৃষ্ণসার। রাতে ঝাবে, মোষের ঘি ঢেলে-ঢেলে; তাঁবুর সামনের আমকাঠের আগুনে। মাংস না খেলে গায়ে জোস্ত হয় না। বুড়ো কিছুই খায়ই না বলতে গেলে, তবুও এই বুড়োর পাল্লায় পড়ে জোয়ান তুরুও হাঁফিয়ে উঠেছে। ভেলকি জানে এই হেঁচকি-তোলা বুড়ো। জোয়ান তুরুর আগে আগে যেন বার্ধক্যর ভাঙা ঘর থেকে বেরিয়ে যৌবনের নতুন চকচকে বাড়ির দিকে নিঃশব্দে হেঁটে যাচ্ছে বুড়ো।
আধঘন্টা পর ওরা দুজনেই ঝুঁকে পড়ে দেখল যে, কাল রাতের বুড়হা-বাঘার পায়ের দাগ মুক্কি গ্রামের দিকের পায়ে-চলা পথ ধরেই এগিয়ে গেছে। বনের ধারেই, তার মাটির ঘরের সামনেই, তামাক পাতার গাছ লাগিয়েছে বেড়া দিয়ে ঘিরে একজন গরিব গোঁন্দ। শীতের রোদ পড়ে সতেজ হলদে-সবুজ বড় বড় গোল গোল তামাক পাতাগুলোকে ভারী সুন্দর দেখাচ্ছে দূর থেকে। মোষের পিঠে চড়ে বাঁশি বাজাতে বাজাতে দুলে দুলে চলেছে একটি বাইগা কিশোর। জঙ্গলের গভীরে। তার মাথার উপর দিয়ে, শীতের সকালের হিমেল আড়ষ্টভাবে হঠাৎ চমকে দিয়ে চলে যাচ্ছে একঝাঁক টিয়া নীল আকাশে মুঠো মুঠো সবুজ আবির ছুঁড়ে দিয়ে।
পথটার কাছে এসে, সাদা-দাড়ির বুড়ো শিকারি থামল।
একটা খুব পুরনো শিমুলগাছের নীচের বড় সাদা পাথরে বসে, রাইফেলটা নামিয়ে রাখল পাশে বুড়ো শিকারি।
বাঁচা গেল।
ভাবল তুরু।
তুরু বলল, খাবে নাকি একটু? কফি?
দে, বুড়ো বলল, পাইপটা খোঁচাতে খোঁচাতে। এবার তুই তোর পথে যা। আমি যাব আমার পথে।
বিরক্ত গলায়, থার্মোসের কাপে কফি ঢালতে ঢালতে তুরু বলল, ঠিক আছে। তবে তুমি যে-পথে যাও সে পথে কি যেতে মানা?
মানা নেই কোনও। তবে প্রত্যেকেরই পথ আলাদা আলাদা।
বনের মধ্যে যখন অনেকগুলো পায়ে-চলা-পথ একসঙ্গে এসে মেলে, তখন পথ চিনতে ভুল হয় না তোমার বাপ্পা?
হয়। সেই জন্যেই তো ঘুরে মরা। জীবনভর। যে পথ চিনেছে, সে সে তো গন্তব্যেই পৌঁছে গেছে রে তুরু। তার আর চিন্তা কী?
এই শিমুলটাতে অনেক ফুল হয় গরমের সময়।
একটুখন চুপচাপ দুজনেই।
একসময় বুড়ো-শিকারি নিজের মনেই বলল, তাই?
হ্যাঁ।
তোর বাবা এই শিমুলের নীচে প্রায়ই কুটরা হরিণ মারত। শিমুলের ফুল খেতে খুব ভালবাসে তো কুটরারা।
জানি। তুরু বলল।
তারপর উপরে চেয়েই বলল, ওই দ্যাখো।
বুড়ো শিকারিও উপরে চাইল। দেখল, একটা বুড়ো বাজ একেবারে মগডালে রোদের রঙিন বালাপোশে ডানা মেলে বসে আছে।
তুরু বলল, বুড়ো বাজ।
হুঁ।
বুড়োদের শীত বেশি? না?
হুঁ।
তোমার?
হুঁ।
তুমি একটা অদ্ভুত বুড়ো। সব বুড়োরা শুধু ভাবেই। বেশি ভাবলে, কাজ করা যায় না কোনও। ঠিক না, বাপ্পা?
তুমি বুড়ো হয়েও এমন কেন? জোয়ানের মতো? যাকে যেমন মানায় তেমনই হওয়া উচিত।
আমি আমারই মতো। আমি ঠিকই মানিয়ে যাই আমাতে।
জানি না! কী তুমি চাও বাপ্পা?
সে তুই বুঝবি না।
কেন? আমি কি বোকা?
বোকা-চালাকের ব্যাপার নয় এটা।
তবে?
এটা একটা অন্য ব্যাপার। বলেইছি তো। অন্য ব্যাপার। কিছু কিছু ব্যাপার থাকে তা পৃথিবীর সব চালাকি দিয়েও ছোঁওয়া যায় না, বুঝবি না তুই।
কী তুমি খুঁজছ বাপ্পা? এমন পাগলের মতো করছ কেন? বাঘ শিকার কি আমিও করিনি, না দেখিনি? আমিও আমার বাবার আমল থেকেই… এ তোমার কী হরকত? আসলে, তুমি বাঘ শিকারে আসেনি। এসেছ, অন্য কিছু শিকার করতে।
হবে। কী জানি!
বিড়বিড় করে বলল বুড়ো দূরে তাকিয়ে।
আজই তুমি মুখ ফুটে বলো তো ভাল করে হাঁকোয়ার বন্দোবস্ত করি। বুড়হা-বাঘা ওই বড় পাহাড়টাতে থাকে যে, তা সকলেই জানে। তবে, ঠিক কোথায় যে থাকে তা কেউই জানে না। কেউ কখনও জানতে যায়নি। সকলকে তো আর তোমার মতো সুখে থাকতে ভূতে কিলোয় না!
সেই তো! ভাসা-ভাসা জানা সকলেই জানে। তলায় যায়নি কেউই। বাঘটা কোথায় থাকে সেটাই আমি সঠিক জানতে চাই। কোনও কিছুই ভাসা-ভাসা জানা আমি পছন্দ করি না। আমি ভাসমান মানুষ নই। ভেসে থাকার মধ্যে কষ্ট নেই কোনও।
কিন্তু তোমাকে বলছি বাপ্পা, বাঘটাকে তুমি মারতে পারবে না। শুধু দম্ভ দিয়ে কিছু পাওয়া যায় না। যোগ্যতা লাগে।
জানি।
সে কী? জানো? তবু…?
হুঁ। মানুষের মতো মানুষ যারা, তাদের কিছু দম্ভ থাকেই। বাঘের মতে, যে বাঘ, তারও থাকে।
তাহলে? করাব হাঁকোয়া?
হাঁকোয়া করাবি কী করে? দশজন শিকারিকে মেরে বাঘটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে সকলেরই শিরদাঁড়ায়। হাঁকোয়া করে বাঘকে বের করা সোজা। কিন্তু ভয়কে কি পারবি হাঁকোয়া করে মানুষগুলোর বুকের মধ্যে থেকে টেনে বের করতে? রাজিই হবে না ওরা। ভয়ও রাজি হবে না। ভয় নিজেও কম ভিতু নয়।
সে-ভার আমার। এবার বুঝেছি, তুমি কী চাও। বুড়হা-বাঘা যেসব মানুষকে ভয় পাইয়ে এত বছর জুজু করে রেখেছে, সে ভয়টাকেই তুমি মারতে চাও, ভাঙতে চাও, তাই না?
না।
তাও না! তবে?
তুই বুঝবি না।
কী খুঁজতে পারো তুমি আর? বুড়হা-বাঘা তো কাল রাতে নিজে এসেই জানিয়ে গেল যে, সে আছে। এবং বনের রাজা হয়েই আছে। এবং থাকবেও। আরও কী খোঁজার আছে?
আছে। নে, কাপটা ধর তুরু। তুই বড়ই বেশি কথা বলিস। বনের মধ্যে এত কথা বলতে নেই। বনের পরিবেশ তাতে নোংরা হয়ে যায়। যা এবার। ফিরে যা তুই। এবার আমি একা এগোব। আসলে একা সবাই-ই।…একা একাই..
রাতে কী খাবে? শুয়োর না চিতল না চিংকারা?
অনেক খেয়েছি রে তুরু এ জীবনে। অনেকই রকম খাবার। খাওয়ার সাধ আর নেই।
শিকারি বুড়ো পাইপটা পরিষ্কার করে, তামাক ভরল নতুন করে। তারপর আগুন ধরাল পাইপে, লাইটার দিয়ে।
তুরু হাত পাতল।
বুড়ো তামাকের টিন খুলে কিছুটা সুগন্ধি তামাক দিল ডান হাতের খোলা পাতায়। তামাকটুকু নিয়ে খৈনির মতো মারতে লাগল তুরু, বাঁ হাতের তেলোতে রেখে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে।
বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে আস্তে রাইফেলটাকে কাঁধে তুলে নিল। মাথার টুপিটা খুলে রাকস্যাকে রাখল।
বলল, চলি রে।
ফিরবে কখন বাপ্পা?
শিকারি আকাশের দিকে তাকাল। বলল, দেখি…সন্ধের মুখেই ফিরব। আশা করি। যদি সন্ধে লাগার পরও না ফিরি…সন্ধের আগেই ফিরে না আসতে পারলে ফেরা মুশকিল..।
খুঁজতে যাব তোমাকে? যদি না ফেরো?
একদম্ না। যারা না-ফেরে, তাদের খোঁজা বৃথা।।
আমি যাবই। তুমি পাগল বলে তো আর আমি নই।
গেলে, একেবারে পরদিন ভোরে যাবি। অন্ধকারে একদমই না। তোর মাকে আমি কথা দিয়ে এসেছি যে, তোকে তার কাছে ফিরিয়ে দেব।
হুঁ! যেন কচি-খোকা আমি। ফিরিয়ে দেব?
যা বলছি, তাই-ই করবি।
গুলির শব্দ যদি পাই, তা হলে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই যাব আমি। ওই পাহাড়ে ফোর-সেভেন্টি রাইফেলের গুলি হলে তার শব্দ এখানে ঠিকই পৌঁছবে।
একদমই না। বলেছি, না। না, তো নাই-ই। মনে থাকে যেন!
তাহলে আমাকে আনলে কেন? তোমাকে রান্না করে খাওয়াব বলে? আমি কি তোমার রাঁধুনি, না বেয়ারা? আমিও তো শিকারি একজন। তোমার গুমোর আছে, আমার নেই?
অভিমানের গলায় বলল তুরু।
বুড়ো তুরুর কাঁধে হাত রেখে বলল, নিশ্চয়ই। তোর মতো ভাল শিকারি কজন আছে? তা ছাড়া, যে-মানুষের গুমোর নেই, সে তো…। কিন্তু তুরু, এটা শিকারের ব্যাপারই যে নয়!
তুমি পুরোপুরিই পাগল হয়ে গেছ বাপ্পা। এটা শিকারের ব্যাপার নয় তো কিসের ব্যাপার? অবাক করলে তুমি!
এটা অন্য ব্যাপার। বলেছি তো।
এবারে বুঝেছি। সাহসের ব্যাপার? তা, আমার বুঝি সাহস নেই? সব সাহস বুঝি তোমার একারই? আমার বাবা মরেছে বাইসনের পায়ে আর শিং-এ। দশ বছর বয়স থেকে আমিও শিকার করছি বাপ্পা। অন্যকে এত ফালতু ভাবা তোমার উচিত নয়। তুমি মনে করো, তুমি একাই ভীষণ সাহসী!
তুত্ তুত করে জিভ দিয়ে একরকম বিরক্তিসূচক শব্দ করল বুড়ো। কী বলল, তা শোনা গেল না ভাল করে।
তারপর বলল, বড়ই বিপদে ফেললি তুই। কী যে বলি তোকে! মিছিমিছি তুই…
বলেই বলল, বাঘ মারাতে কোনওই বাহাদুরি নেই। সে তো ফালতু শরীরের সাহস রে। শরীরের সাহস হচ্ছে সবচেয়ে কম দামি সাহস। ওটা কোনও সাহস নয়। বুঝলি?
তুরু বড় বড় চোখে তাকিয়ে থাকল বুড়োর দিকে অনেকক্ষণ।
বিড়বিড় করে বলল, আজই তোমার শেষদিন। কালকে তোমাকে আমি জোর করেই ফিরিয়ে নিয়ে যাব ভোপালে। তোমার চিকিৎসার দরকার। আর যদি না যাও তাহলে মুক্কি আর বানজার বামনির পাহানদেরও ডেকে নিয়ে আসব। দেখি, তুমি কেমন না ফিরে চলো। গাওয়ানদেরও বলছি আমি গিয়ে।
ঠিক আছে রে, ঠিক আছে। কালকের কথা কালকে। আজ তো যেতে দে।
শেষবার বলো বাপ্পা। আমাকে নেবে কি নেবে না?
না। তুই যা। এগোচ্ছি আমি তাহলে। দেরি হয়ে গেল। লক্ষ্মীছেলে হয়ে থাকিস কিন্তু। রাগ করিস না বুড়োর উপরে। আমি তোর মরে-যাওয়া বাবার চেয়েও অনেক বেশি বুড়ো রে। বুড়ো বাপের উপর কোনও ছেলে রাগ করে? তোর মতো ভাল ছেলে?
তবুও, তুরু ফিরে গেল না। বন্দুক কাঁধে, বনপথেই দুপা ফাঁক করে টেটিয়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। বুড়ো যে পথে যাবে, সেই পথের দিকে চেয়ে।
সাদা-দাড়ি শিকারি রাইফেলটার ভারে সামনে একটুখানি কুঁজো হয়ে খুব আস্তে-আস্তে হেঁটে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে সুঁড়িপথের বাঁকে মিলিয়ে গেল বুড়ো। জঙ্গল গিলে নিল জংলিকে।
তুরু, মুক্কির দিকে পা বাড়াল। চাল, ডাল, তেল-মশলা, লঙ্কা, পেঁয়াজ যে-সবের জন্যে তুরুর মতো সাধারণ মানুষের সব খাটাখাটনি, যে-সবের জন্যে ঝগড়া মারামারি স্ট্রাইক ল-আউট; যা-কিছু খেয়ে সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকে; সেই সব জিনিসেরই খোঁজে। তুরু একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ। সাদা-দাড়ি বুড়ো শিকারির মতো পাগল তো নয়।
.
বনপথটি সেই উঁচু পাহাড়টির মধ্যে এমন করে সেঁধিয়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে মৃত্যুর মধ্যে সেঁধিয়ে গেছে জীবন, অথবা জীবনের মধ্যে মৃত্য।
বুড়ো ভাবতে-ভাবতে চলেছে, মানুষ কী নিয়ে বাঁচে? কেন বেঁচে থাকে মানুষ? শুধু কি রোজগার করারই জন্যে? শুধুই কি চাল, ডাল, তেল মশলারই জন্যে? মানুষ হয়ে জন্মানো কি শুধু এইটুকুরই জন্যে?
বাঘেরা রাতে জাগে দিনে ঘুমোয়। বুড়হা-বাঘার ঘুম আসছিল না। যদিও কাল সারারাত রোঁদে ছিল সে। এইক্ষণে গুহার মুখটিতে গাঢ় ঘুমেই শুয়ে থাকার কথা ছিল। শরীরের আধখানাতে রোদ এসে পড়ার কথা ছিল। মুখটিকে ছায়ায় রেখে শরীরটিকে রোদে টানটান করে শুয়ে থাকারই কথা ছিল এখন।
কিন্তু…নীল আকাশের অনেক উঁচুতে ঘুরে ঘুরে উড়ে-বেড়ানো একা বাজপাখিটা রোজই এই সময় তার তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে পায় যে ঘুমন্ত ডোরাকাটা বাঘের সাদা তুলোর নরম লোমে-ভরা পেটটা উঠছে আর নামছে। কিন্তু আজ সকালে বাঘটা জেগে আছে। সামনের দুটি থাবায় মাথা রেখে সামনে চোখ মেলে চেয়ে আছে। বুড়হা বাঘাটার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে বলেছে যে, আজ সকালে কিছু একটা ঘটবে। অনেক রোদ-ঝলম শীত-সকালে আরামে ঘুমিয়েছে বাঘা। আজ সকাল, জেগে থাকার সকাল।
ছেলেটা বড় বোকা। এমন দেশ ছেড়ে চলে গেল একটু ভাল খাওয়া, ভাল থাকা, একটু ভাল পরার জন্যে। খাওয়া-পরাই কি সব মানুষের?
শিকারি হাঁটছিল। শীতের সকালের রোদেরও এক আলাদা গন্ধ আছে। যে-রোদে প্রজাপতি আর কাঁচপোকারা ওড়ে, যে-রোদে বন-বনানীর শিশিরভেজা মাকড়সার জালে জালে কুবের রাজার হিরে-মানিক ঝমলিয়ে ওঠে। ভিজে মাটির হিমেল গন্ধে নাক ভরে যাচ্ছে বুড়োর। পুটুস আর পাঁচমিশেলি বুনো ফুলের গন্ধে। তার পাইপের তামাকের গন্ধের সঙ্গে সেই গন্ধ মিশে যাচ্ছে।
ভারী পরিপূর্ণ, ভরন্ত একটি সকাল, প্রত্যাশাতে ভরা। মনে মনে বলল বুড়ো শিকারি।
বুড়ো কোনও দিনও কোনও পরীক্ষাতেই প্রথম হতে পারেনি। না স্কুল-কলেজের পরীক্ষাতে, না জীবনের পরীক্ষাতে। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ হয়েই কাটিয়ে দিয়েছে জীবন। তার জীবনের এই গভীর গ্লানি ও লজ্জা থেকে নিজেকে সে মুক্ত করবে আজ। প্রথম না হলে, প্রথম হয়ে বাঁচতে না পারলে, বাঁচার কোনওই মানে নেই। জীবনে পারেনি, পারল না; তাই-ই প্রয়োজনে মৃত্যুতেই সেই গ্লানি থেকে বাঁচাবে আজ নিজেকে। বুড়হা-বাঘাকে মেরে, প্রথম হবে। বেঁচে থাকা বা মরে যাওয়াতে যায় আসে না কিছুমাত্রই, যদি না মানুষের মতো মানুষ না হল, প্রথম-হওয়া মানুষের মতোই না বাঁচল অথবা না মরল।
চঞ্চল সাত-বোন পাখিরা শোরগোল তুলেছে শীতের আড়ষ্ট ঝোপে-ঝাড়ে। নড়ছে চড়ছে। কুঁদুলে বোনেদের মতো সরে সরে বসছে এ ওর গায়ে। শিশিরভেজা ডানা সপসপ করে ময়ূর উঠল জংলি সাঁওয়া ধানের খেত থেকে উডে। বনমোরগের ঘন লাল আর হলুদ ডানায় রোদকণা ছিটকে গেল। পথের ডানদিকের বাইসন-চরুয়া মাঠে ধীর পায়ে চরে-বেড়ানো একদল বাইসনের মধ্যে একটি বুড়ো বাইসন জোরে নাক ঝাড়ল। সেই হঠাৎ-শব্দে ভয় পেয়ে গাছগাছালির মাথা ছেড়ে ছত্রাকারে ছড়িয়ে গেল ঝোড়ো-হাওয়ার মুখের ঝরাপাতার মতো নানা জাতের ছোট পাখিরা। বুড়ো-শিকারি ছায়াচ্ছন্ন জায়গাটা পেরিয়ে এখন পাহাড়তলির রৌদ্রালোকিত প্রান্তরে এসে পৌঁছল।
বুড়হা-বাঘা এতক্ষণে দেখতে পেল তাকে। সঙ্গে সঙ্গে সাদা-দাড়ি শিকারি, তার জাত-শিকারির ষষ্ঠবোধে বুঝতে পারল; কেউ নিশ্চয়ই তার মুখে চেয়ে আছে আড়াল থেকে।
কে? সে কে?
বুড়ো অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে দেখতে-না পাওয়া তাকে, সেই অদৃশ্য চোখ দুটিকে ভাল করে দেখে নিতে দিল। এই খেলাতে, যার যার তাস প্রতিপক্ষকে দেখাতে হয়। মৃত্যু দেখে জীবনকে; জীবন মৃত্যুকে। বুড়হা-বাঘা ভাল করে দেখল বুড়ো শিকারিকে। গুহার সামনের চ্যাটালো কালো পাথরের আরামের বিছানা ছেড়ে বুড়হা-বাঘা সাবধানী থাবা মেলে মেলে উপর থেকে নিঃশব্দে নেমে আসতে লাগল। হলুদ-কালো আলখাল্লা পরা মযদূতেরই মতো।
মানুষ কিসে বাঁচে?
কী নিয়ে বাঁচে মানুষ? ডাবল-ব্যারে রাইফেলের দুব্যারেলে দুটি সফট-নোজড বুলেট পুরে নিতে নিতে বুড়ো শিকারি ভাবছিল। একের পর এক দিন, মাস, বছর মাড়িয়ে যাওয়ার নামই কি বেঁচে থাকা?
এবার আবারও ঘন বনের মধ্যে ঢুকতে হবে। এই রৌদ্রোজ্জ্বল সকালেও সেই বন প্রায়ান্ধকার। ভিজে স্যাঁতসেঁতে। মৃত্যুর গন্ধে ভরা। জীবনের উষ্ণ এলাকায় আরও কিছুটা দূর হেঁটে গিয়েই বুড়ো ঢুকে পড়ল মৃত্যুর গা-ছমছম্ শীতার্ত অন্ধকার এলাকাতে।
হঠাৎ।
যে-কোনও দুঃসাহসিক কাজই হঠাৎ না করলে করাই হয়ে ওঠে না।
বাঘটাও নেমে এসেছে ততক্ষণে সমতলে। এবার একটা শুকনো নালার বুক ধরে বালি-পাথরের উপরে উপরে সে এগিয়ে চলেছে। হনুমান, পাখি, প্রজাপতি, কাঠবিড়ালি সম্ভ্রমের সঙ্গে চেয়ে আছে তার চলার দৃপ্ত ভঙ্গির দিকে। বুড়ো শিকারির পথও এই নালাটার সঙ্গে মিশে গেছে। বুড়ো শিকারিকেও দেখছে বনের বাসিন্দারা। সম্ভ্রমের চোখে। বয়স শরীর ক্ষয় করে, কিন্তু মর্যাদা বাড়ায়, যাদের তা থাকে। মানুষটা অন্য দশটা মানুষের মতো নয় যে!
দুটো খরগোশ ঘাস খাচ্ছিল নদীর পাশের সবুজ একফালি মাঠে। বুড়ো বাঘাকে দেখেই, দৌড়ে পালিয়ে গেল তারা।
এই-ই বুড়হা বাঘার জীবনের অভিশাপ! ওকে দেখে সকলেই পালায়। পাখি, হরিণ, মানুষের মেয়ে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে এই-ই দেখে আসছে। অথচ, কখনও-সখনও ও-ও একটু ভালবাসতে চায়, গল্প করতে চায় ওদের সঙ্গে, ওদের সমান হয়ে যেতে চায় বলে, শৌর্যে।
তাই মাঝে-মাঝে বড়ই অভিমান হয়। বনের এমন রাজা হয়ে লাভ কী? বনের সব প্রজারা যদি তাকে দেখামাত্র দৌড়তেই থাকে? রাজত্ব যদি রাজার একার হয়, প্রজাদের না হয় তবে তার দাম কী? এতদিনে একজন মানুষের খোঁজ পেয়েছে বুড়হা-বাঘা। যে না-পালিয়ে স্থির পায়ে তার দিকেই আসছে। তাকেই সেই মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে। একথা ভেবেই ভাল লাগছে বাঘার। উল্টো কিছু ঘটতে যাচ্ছে এতদিনে! সত্যি নিত্য?
বুড়ো শিকারি ভাবছিল যে, আজ দু-দুটো বাঘকে মারবে সে। ডান দিকের ব্যারেল ফায়ার করে মারবে বুড়হা-বাঘাকে, আর বাঁদিকের ব্যারেল ফায়ার করে মারবে তার পানাপুকুরের মতো জীবনের এই ঘটনাবিহনী একঘেয়েমিকে। যা কেউই আগে পারেনি। তাইই আজ করে, একদৌড়ে ফিনিশিং-টেপ বুক দিয়ে ছিঁড়ে ফেলে, অনেক নীরব হাততালি আর অভিনন্দনের মধ্যে নিঃশব্দে বুড়হা-বাঘাকে মৃত্যুর মধ্যে সেঁধিয়ে দিয়ে প্রথম হবে সাদা-দাড়ি।
জীবনে যা পারেনি, মৃত্যুতে তাই-ই পারবে।
বুড়হা-বাঘাটাও বড় ক্লান্ত ছিল। অনেক বছর ধরে সেও বড় একঘেয়ে জীবনই কাটিয়ে আসছে। সেই ভিন্ এলাকার সাহসী বড় বাঘটাকে প্রচণ্ড লড়াই করে মেরে ফেলার পর তার জীবন বড়ই সাদামাঠা হয়ে গেছে। মানুষরাও কেউ ভয়ে তার কাছ মাড়ায় না। তার জীবনে কোনও ভয় নেই, অনিশ্চিতি নেই; চ্যালেঞ্জ নেই। শিকারিরা সবাই তাকে সেলাম জানিয়েই চলে গেছে দূর থেকে। স্বীকার করে গেছে, হয় তার হাতে মরে, নয় অপমানিত হয়ে যে বুড়হাবাঘাই শ্রেষ্ঠ। বুড়হা-বাঘার সম্মানে কেউই আর হাত দিতে আসেনি। শ্রেষ্ঠত্বর ক্লান্তিতে ক্লান্ত, বড় ক্লান্ত হয়ে গেছে বুড়হা-বাঘা। একঘেয়ে এই সম্মানের ক্লান্তি বড় ক্লান্তি। চিরদিন প্রথম হওয়ার এবং প্রথম হয়েই থাকাটা বড় বেশি বাজে; যদি না সেই প্রথমত্ব অটুট রাখতে সব সময়ই লড়াই করতে হয়। বহু বছর হয়ে গেছে কোনও শিকারিই গুলি ছোঁড়েনি তার দিকে তাক করে। তার সঙ্গে টক্কর দিতে আসেনি। আর কোনও বড় বাঘও তার এলাকায় ঢোকেনি সাহস করে। বুড়হা বাঘার নখে মরচে পড়ে যাচ্ছে। নখ দিয়ে সে শুধুই মাংস ছিঁড়ে পেট ভরায়। এই একঘেয়ে প্রথমত্ব থেকে মুক্তি পেতে চায় বাঘটা।
বুড়ো-শিকারি বড় ভালবেসেছিল তার জীবনের পরিবেশকে। যেহেতু সে মানুষ, তাই শুধুই শ্বাস নিয়ে আর নিশ্বাস ফেলে সে বেঁচে থাকতে চায়নি। বাঁচতে চেয়েছিল, সব মানুষেরই যেভাবে বাঁচা উচিত। বাঁচার চেষ্টা করা উচিত।
শিকারি বড় ভালবেসেছিল এই দেশের বৈশাখের ভোরের হাওয়াকে, গ্রীষ্মের স্নিগ্ধ নীল-সবুজ তারাভরা উলা রাতকে, বসন্তের সকালকে, শ্রাবণের দুপুরকে আর শীতের সন্ধেকে। ভালবেসেছিল তার লাইব্রেরির বইগুলিকে, তার মৃতা স্ত্রীর চোখ দুটিকে, তাঁর নির্মল হাসিকে, তার শিশু-ছেলের হাতের পাতার উষ্ণতাকে। একসময়। অন্য কোনও মানুষের কাছেই তার চাইবার ছিল না কিছুই। অন্য দশজন মানুষ দুঃখ-কষ্ট বলতে যা বোঝে, বুডোের জীবনে তেমন কোনও দুঃখ-কষ্ট ছিল না। তবুও এক গভীর কষ্টে বুড়ো সবসময়ই ছটফট করেছে। সকলে যখন বলেছে, অনেক কিছুই তো হল তোমার, আর কী চাই, তখন বুড়ো বলেছে মনে মনে, মাথা নেড়ে; কিছুই তো হল না।
যা-কিছুই পেয়েছে সে-সব তো সে চায়নি! সে যে অন্য কিছু চেয়েছিল।
এবার নাকে মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছে বুড়ো শিকারি। যদিও বাঘের পায়ের শব্দ পায়নি, বাঘের গায়ের গন্ধ পায়নি। হাওয়াটা এখন স্থির। প্রকৃতি রুদ্ধ নিশ্বাসে স্তব্ধ। মাঝে-মাঝে হঠাৎ উঁচু গাছের পাতা খসে গিয়ে নীচে পড়ছে। সেই সামান্য শব্দতেই বনের আনাচকানাচ ভরে যাচ্ছে। শিশির আর বুনোফুল আর গাছেদের গায়ের সঙ্গে তার পাইপের তামাকের গন্ধ আর মৃত্যুর গন্ধ মিলেমিশে গেছে। দারুণ লাগছে বুড়োর।
এবার আবার বনপথের অন্ধকার সরে গেল।
বাঘটা মাথাটাকে নামিয়ে সামনের দুকাঁধের মাঝে ঢুকিয়ে নিল। জমির সঙ্গে মিশে গেল। তখন মনে হচ্ছিল যেন বাঘ নয়, বিড়াল। বাঘটা ছোট্ট এক হঠাৎ-দৌড়ে, নিঃশব্দ পায়ে এগিয়ে গেল কিছুটা। তারপর একটা বড় কালো পাথরের পেছনে সারা শরীরটা আড়াল করে শুধু মাথাটা একপাশে বের করে জমির সঙ্গে লেপটে গেল একেবারে। লেজটা, সোজা লাঠির মতো শক্ত হয়ে পেছনে সমান্তরাল হয়ে রইল।
খুবই আনন্দ হচ্ছিল বাঘটার। ও বেঁচে আছে কি নেই তার পরীক্ষা হবে নতুন করে আজ। বেঁচে থাকলেই কিছু বেঁচে থাকা হয় না। বুড়হা-বাঘা, বুড়ো ঘেয়ো শম্বরের মতো যে বাঁচতে চায়নি। সেরা বাঘের মতোই বাঁচতে চেয়েছিল, যেমনভাবে বাঁচার খোঁজ অন্য সব বাঘ রাখে না। সব বাঘই বুড়হা-বাঘা হতে পারে না।
আসছে। এসে গেছে সেই সাদাদাড়ি শিকারি কাছে। শুকনো পাতা, কাঠকুটো এড়িয়ে, নিঃশব্দে অভিজ্ঞ সাবধানী পা ফেলে ফেলে, রাইফেলটাকে রেডি-পজিশনে ধরে এগিয়ে আসছে বুড়ো শিকারি। তার সাদা দাড়ি, সাদা চুলে, ঋষির মতো দেখাচ্ছে তাকে। বড়ই স্পর্ধা মানুষটার। দম্ভ হয়েছে বড়। আজকে তার দুই থাবার নীচে তার সব স্পর্ধা আর দম্ভ শুকনো পাতার মতো মুচমুচিয়ে গুঁড়িয়ে দেবে বুড়হা-বাঘা।
বুড়ো শিকারির তর্জনী ট্রিগার-গার্ডে। বুড়ো আঙুল, সেফটি ক্যাচে। বুড়হা-বাঘার বড়ই বাড় বেড়েছিল। মানুষকে সে তোয়াক্কাই করে না। বাঘ, সে যত বড়ই হোক, কখনও কি মানুষের সমান হতে পারে? রাইফেলের গুলিতে সেই গর্বিত বোকা বাঘটার বুক এ-ফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে আজ শিকারি। প্রমাণ করে দেবে অন্য মানুষদের কাছে যে, বেঁচে থাকা কাকে বলে তা বুড়ো-শিকারি জানত।
হঠাৎই নিঃশব্দ বনে আলো-ছায়া আর রঙের হোলি শুরু হয়ে গেল। লাল কালো হলুদ সবুজ পাটকিলে সাদা–সব রঙই নিঃশব্দে জীবনের পিছকিরির মুখে এসে মৃত্যুর দিকে দৌড়ে যেতে লাগল। সেই উৎসবের মধ্যে বুড়ো শিকারি পথের বাঁকে এসে পৌঁছতেই লাফ দিল বুড়ো-বাঘা। কোনাকুনি। বুড়ো শিকারির ডান কাঁধ আর গলার মাঝামাঝি কামড়ে ধরে এক ধাক্কায় তাকে নিয়ে নীচে পড়বে বলে।
বাঘটা লাফানোর সঙ্গে-সঙ্গেই বুড়ো শিকারিও চকিতে রাইফেলসমেত গোড়ালির উপর আধপাক ঘুরে গেল। একটাই গুলি করার সুযোগ পেল শুধু। গুলির আওয়াজ আর বুড়ো বাঘার গর্জন মিশে গেল। গুলিটা লাগল বাঘার গলার আর বুকের ঠিক মাঝামাঝি। দুটি ট্রিগার টানার সময় পেল না শিকারি। বুড়ো-শিকারিকে নিয়ে বুড়হা-বাঘা আছড়ে পড়ল নীচে ঝরাপাতা বিছোনো শীতের নরম হিমেল বনপথে জড়াজড়ি করে। ভয় পেয়ে কাঠঠোকরা উড়ে গেল রঙিন ঘুড়ির মতো। কাঠবিড়ালি দৌড়ে উঠল গাছের গুঁড়ি বেয়ে। ইতিউতি চাইল উপরে উঠে। সমস্ত জঙ্গল বাঘের ডাককে আর গুলির আওয়াজকে সমীহ জানিয়ে কলকাকলিতে সেলাম জানাল।
বুড়হা-বাঘার বুক ভেসে যেতে লাগল সাহসী বাঘের রহিস্ খানদানের রক্তে। বুড়ো-শিকারির বুক গলা ঘাড় ভেসে যেতে লাগল একজন মানুষের মতো মানুষের রক্তে। বুড়োর বুকে রক্তাক্ত দুটি থাবা রেখে, বেড়াল যেমন করে সাদা কবুতর ছিন্নভিন্ন করে, তেমন করে সাদা চুল সাদা দাড়ির বুড়োকে ছিঁড়তে লাগল বুড়হাবাঘা।
বড় ভাল লাগতে লাগল বুড়োর। এই রকমই কিছু ঘটবে যে, তা জানত মানুষটা। মৃত্যুরও তো ভালমন্দ থাকে।
রাইফেলটা বুড়োর হাত থেকে আলগা হয়ে এল। ভোরের সূর্যের আলো পড়েছিল চোখে, চোখ বন্ধ করে নিল। অনেক ঘুম জমেছিল। এখন নিজের রক্তের গন্ধের সঙ্গে নিজের দেশের মাটির গন্ধ, গাছের গন্ধ, ফুলের গন্ধ সব মিলেমিশে গেছে।
ছেলেটা…
ছেলেটা এমন সোনার দেশকে ফেলে, নিজের দেশকে ফেলে অন্য দেশে চলে গেল? একটু ভাল খাবে, ভাল পরবে, ভাল থাকবে বলে?…
ছিঃ ছিঃ…ছেলেটা…! তার ছেলে!
বুড়হা বাঘাটার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। রক্ত কুলকুচি করল সে। তারপর বুড়ো-শিকারির পাশে চিত হয়ে হঠাৎ শুয়ে পড়ল।
সূর্যটা ঠিক তার চোখেরই উপর একটা লাল বলের মতো ছোট থেকে বড় হতে হতে ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হতে লাগল। পৃথিবীকে খেয়েই নেবে সূর্য আজ মনে হল। শীতের সূর্যকে বড় ভালবাসত বুড়হা বাঘা। কিন্তু জীবনে আজ এই প্রথম শীতের সূর্যকে তার ভাল লাগল না। সূর্য সবকিছুকে বে-আব্রু করে দেয়। মৃত্যুর মতো গোপন কিছুকেও।
ডান থাবার এক থাপ্পড়ে মাকাল ফলের মতো ফাজিল সূর্যটাকে ছিঁড়ে নামাবে বলে থাপ্পড় তুলল বুড়হা বাঘা। কিন্তু থাবা উঠল না। আরাম! আঃ কী আরাম!
বুড়ো-শিকারি তার ডান পাটা বুড়হা-বাঘাটার পেটের উপর তুলে দিল। ঘেন্নায় নয়, ভালবাসায়।
আঃ, কী আরাম!
বুড়হা-বাঘার শরীর থেকে তার তীক্ষ্ণ ইন্দ্রিয়গুলো এক এক করে ছুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। তার হালকা লাগতে লাগল খুব। বুড়হা বাঘা বলতে গেল গভীর আরামে গররররর…।
কিন্তু আওয়াজ বেরুল না।
সব প্রাণী আর মানুষই তাকে দূর থেকে দেখে ভয়ে ঘেন্নায় পালিয়ে গেছে চিরদিন। একটা মানুষ, তবু তার কাছে এসেছিল; তাকে চেয়েছিল। শেষের দিনে হলেও। ভাল, খুবই ভাল।
একটা কাঁচপোকা বুঁবুঁইইই.করে উড়ে এসে একবার মৃত বাঘটার মুখের কষে আরেকবার মৃত মানুষটার ঠোঁটের উপর বসল। উড়তে-বসতে লাগল। সামান্যক্ষণ। তারপরই বনে বনে খবর দিতে উড়ে গেল তার নীলচে পাখায় রোদ ছিটিয়ে…।
ঋজুদা এই অবধি বলে চুপ করে গেল। অনেকক্ষণ হল নিভে যাওয়া পাইপটা থেকে ছাই ঝেড়ে ফেলে নতুন করে আগুন জ্বালল। রুদ্র আর ভটকাই চুপ করে বসেছিল। রোদটা এখন জোর হয়েছে। হাওয়াও ছেড়েছে একটা। নানারঙা শুকনো পাতা উড়িয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে জঙ্গলের পায়ের কাছে পাথর ও রুখ মাটির উপর সড়সড় আওয়াজ তুলে। একটা পাহাড়ী বাজ উড়ছে নীল আকাশে ঘুরে ঘুরে।
ঋজুদা পাইপটা ভরে লাইটার জ্বেলে আগুন জ্বালাল। তারপর একমুখ ধোঁয়া ছাড়ল। বলল, আঃ। ভটকাই হঠাৎই বলল, আচ্ছা ঋজুদা, তোমার এই গল্পটির মরাল কী? এ তো জাস্ট একটা গল্পই নয়। কিছু নিশ্চয়ই বলতে চেয়েছ তুমি এই গল্পের মাধ্যমে।
কিছুমাত্র বলতে না চেয়েও গল্প বলা যায়। যা শুধু গল্প করার জন্যেই গল্প; অন্যভাবে বলতে গেলে কথার কথা। গাল-গল্পও হয়তো বা। তবে এই গল্পে কিছু বলতে চেয়েছি নিশ্চয়ই। তবে আমি তো আর লেখকটেখক নই, কী করে গল্প লিখতে হয় তা তো জানা নেই, তাই পেরেছি কিনা তা তোরাই বলতে পারবি। তোরাই বল? কী বলতে চেয়েছি?
একটু ভেবে ভটকাই বলল, বাঘের সঙ্গে লড়তে গেলে এইই নতিজা নিকলোয়।
ঋজুদা বলল, হিন্দী ছবি একটু কম দ্যাখ টিভিতে ভটকাই। নতিজা নিকলোয়। এ আবার কী রকম বাংলা?
না কেন? হালুয়া সহজেই নিকলোতে পারে আর নতিজা নিকলোতেই দোষ?
রুদ্র হেসে ফেলল ভটকাই-এর কথা শুনে। ঋজুদাও। ঋজুদা বলল, নাঃ। তুই একটি ইকরিজিবল। হিন্দী-নবীশ।
তারপর বলল, তুইই বল রুদ্র এবার, কী বলতে চেয়েছি এই অলেখকের গল্পে?
প্রত্যেক মানুষের মনের মধ্যে সে মানুষ সাধারণ অর্থে যতই সুখী হন না কেন, একধরনের অতৃপ্তি থাকেই। সেই অতৃপ্তিকে জয় করাই একজন সত্যিকারের মানুষের ধর্ম।
বাঃ, বেশ বলেছিস। হয়তো এও এই গল্পের সারমর্ম হতে পারত। কিন্তু আমি অন্যকিছু বলার চেষ্টা করেছি।
কী তা?
ভটকাই বলল।
বলতে চেয়েছি যে, একজন মানুষের মতো মানুষ অথবা একটি বাঘের মতো বাঘকে মেরে ফেলা যায়, ধ্বংস করা যায়; ছিঁড়ে টুকরো টুকরোও করে দেওয়াও যায় সহজেই কিন্তু হারানো যায় না তাদের।