Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মজন্তালী সরকার || Upendrakishore Ray Chowdhury

মজন্তালী সরকার || Upendrakishore Ray Chowdhury

এক গ্রামে দুটো বিড়াল ছিল। তার একটা থাকত গোয়ালাদের বাড়িতে, সে খেত দই, দুধ, ছানা, মাখন আর সর। আর একটা থাকত জেলেদের বাড়িতে, সে খেত খালি ঠেঙ্গার বাড়ি আর লাথি। গোয়ালাদের বিড়ালটা খুব মোটা ছিল, আর সে বুক ফুলিয়ে চলত। জেলেদের বিড়ালটার গায় খালি চামড়া আর হাড় কখানি ছিল। সে চলতে গেলে টলত আর ভাবত, কেমন করে গোয়ালাদের বিড়ালটার মতো মোটা হব।

শেষে একদিন সে গোয়ালাদের বিড়ালকে বললে, ‘ভাই, আজ আমার বাড়িতে তোমার নিমন্ত্রণ।’

সব কিন্তু মিছে কথা। নিজেই খেতে পায় না, সে আবার নিমন্ত্রণ খাওয়াবে কোথা থেকে? সে ভেবেছে, ‘গোয়ালাদের বিড়াল আমাদের বাড়ি এলেই আমার মত ঠেঙ্গা খাবে আর মরে যাবে, তারপর আমি গোয়ালাদের বাড়িতে গিয়ে থাকব।’

যে কথা সেই কাজ। গোয়ালাদের বিড়াল জেলেদের বাড়িতে আসতেই জেলেরা বললে, ঐ রে। গোয়ালাদের সেই দই-দুধ-খেকো চোর বিড়ালটা এসেছে, আমাদের মাছ খেয়ে শেষ করবে। মার বেটাকে!’

বলে তারা তাকে এমনি ঠেঙান ঠেঙালে যে, বেচারা তো মরেই গেল। রোগা বিড়াল তো জানতই যে, এমনি হবে। সে তার আগেই গোয়ালাদের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত হয়েছে! সেখানে খুব করে ক্ষীর-সর খেয়ে, দেখতে-দেখতে সে মোটা হয়ে গেল। তখন আর সে অন্য বিড়ালদের সঙ্গে কথা কয় না, আর নাম জিজ্ঞেস করলে বলে, ‘মজন্তালী সরকার।’

একদিন মজন্তালী সরকার কাগজ কলম নিয়ে বেড়াতে বেরুল। বেড়াতে-বেড়াতে সে বনের ভিতরে গিয়ে দেখল যে, তিনটি বাঘের ছানা খেলা করছে। সে তাদের তিন তাড়া লাগিয়ে বলল, ‘এই-য়ো! খাজনা দে!’ বাঘের ছানাগুলো তার কাগজ কলম দেখে আর ধমক খেয়ে বড্ড ভয় পেল। তাই তারা তাড়াতাড়ি তাদের মায়ের কাছে গিয়ে বললে, ‘ও মা, শিগগির এস! দেখ এটা কি এসেছে, আর কি বলছে!’

বাঘিনী তাদের কথা শুনে এসে বললে, ‘তুমি কে বাছা? কোত্থেকে এলে? কি চাও?’

মজন্তালী বললে, ‘আমি রাজার বাড়ির সরকার, আমার নাম মজন্তালী। তোরা যে আমাদের রাজার জায়গায় থাকিস, তার খাজনা কই? খাজনা দে!’

বাঘিনী বললে, ‘খাজনা কাকে বলে তা তো জানিনে! আমরা খালি বনে থাকি, আর কেউ এলে তাকে ধরে খাই। তুমি না হয় একটু বস, বাঘ আসুক।’

তখনই মজন্তালী একটা উঁচু গাছের তলায় বসে, চারদিকে উঁকি মেরে দেখতে লাগল। খানিক বাদেই সে দেখল-ঐ বাঘ আসছে। তখন সে তাড়াতাড়ি কাগজ কলম রেখে, একেবারে গাছের আগায় গিয়ে উঠল।

বাঘ আসতেই তো বাঘিনী তার কাছে সব কথা বলে দিয়েছে, আর বাঘের যে কি রাগ হয়েছে কি বলব! সে ভয়ানক গর্জন করে বললে, ‘কোথায় সে হতভাগা? এখুনি তার ঘাড় ভাঙছি!’

মজন্তালী গাছের আগা থেকে বললে, ‘কি রে বাঘা, খাজনা দিবি না? আয়, আয়!’

শুনেই তো বাঘ দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললে, ‘হাল্লুম!’ বলে দুই লাফে সেই গাছে গিয়ে উঠেছে। কিন্ত খালি উঠলে কি হয়? মজন্তালীকে ধরতে পারলে তো! সে একটুখানি হালকা জন্তু, সেই কোন সরু ডালে উঠে বসেছে, অত বড় ভারি বাঘ সেখানে যেতে পারছে না। না পেরে রেগে-মেগে বেটা দিয়েছে এক লাফ, অমনি পা হড়কে গিয়েছে পড়ে! পড়তে গিয়ে দুই ডালের মাঝখানে মাথা আটকে, তার ভেঙে প্রান বেরিয়ে গিয়েছে।

তা দেখে মজন্তালী ছুটে এসে তার নাকে তিন চারটে আঁচড় দিয়ে, বাঘিনীকে ডেকে বললে, এই দেখ, কি করেছি। আমার সামনে বেয়াদবি!’

এ সব দেখে শুনে তো ভয়ে বাঘিনী বেচারীর প্রাণ উড়ে গেল! সে হাত জোড় করে বললে, ‘দোহাই মজন্তালী মশাই, আমাদের প্রাণে মারবেন না! আমরা আপনার চাকর হয়ে থাকব!’

তাতে মজন্তালী বললে, ‘আচ্ছা তবে থাক্‌, দোহাই ভালো করে কাজকর্ম করিস, আর আমাকে খুব ভালো খেতে দিস।’

সেই থেকে মজন্তালী বাঘিনীদের বাড়িতেই থাকে। খুব করে খায় আর বাঘিনীর ছানাগুলির ঘাড়ে চড়ে বেড়ায়। সে বেচারারা তার ভয়ে একেবারে জড়-সড় হয়ে থাকে, আর তাকে মনে করে, না জানি কত বড় লোক!

একদিন বাঘিনী তাকে হাতজোড় করে বললে, মজন্তালী মশাই, এ বনে খালি ছোট-ছোট জানোয়ার, এতে কিছু আপনার পেট ভরে না। নদীর ওপারে খুব ভারি বন আছে, তাতে খুব বড় বড় জানোয়ার থাকে। চলুন সেখানে যাই।’

শুনে মজন্তালী বললে, ‘ঠিক কথা! চল ওপারে যাই।’ তখন বাঘিনী তার ছানাদের নিয়ে, দেখতে-দেখতে নদীর ওপারে চলে গেল। কিন্ত মজন্তালী কই? বাঘিনী আর তার ছানারা অনেক খুঁজে দেখল- ঐ মজন্তালী সরকার নদীর মাঝখানে পড়ে হাবু-ডুবু খাচ্ছে! স্রোতে তাকে ভাসিয়ে সেই কোথায় নিয়ে গিয়েছে, আর ঢেউয়ের তাড়ায় তার প্রাণ যায়-যায় হয়েছে!

মজন্তালী তো ঠিক বুঝতে পেরেছে যে, আর দুটো ঢেউ এলেই সে মারা যাবে। এমন সময় ভাগ্যিস বাঘিনীর একটা ছানা তাকে তাড়াতাড়ি ডাঙ্গায় তুলে এনে বাচাল, নইলে সে মরেই যেত, তাতে আর ভুল কি?

কিন্ত মজন্তালী সরকার তাদের সে কথা জানতেই দিল না। সে ডাঙায় উঠে ভয়ানক চোখ রাঙিয়ে বাঘের ছানাকে চড় মারতে গেল, আর গাল যে কত দিল, তার তো লেখাজোখাই নেই। শেষে বললে, ‘হতভাগা মূর্খ, দেখ্‌ দেখি কি করলি! আমি অমন চমৎকার হিসাবটা করছিলুম, সেটা শেষ না হতেই তুই আমাকে টেনে তুলে আনলি-আর আমার সব হিসাব গুলিয়ে গেল! আমি সব গুণছিলুম, নদীর কটা ঢেউ, কতকগুলো মাছ আর কতখানি জল আছে। মূর্খ বেটা, তুই এর মধ্যে গিয়ে সব গোলমাল করে দিলি! এখন যদি আমি রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে এর হিসাব দিতে না পারি, তবে মজাটা টের পাবি!’

এসব কথা শুনে বাঘিনী তাড়াতাড়ি এসে হাত জোড় করে বললে, ‘মজন্তালী মশাই, ঘাট হয়েছে, এবারে মাপ করুন। ওটা মূর্খ, লেখাপড়া জানে না, তাই কি করতে কি করে ফেলেছে!’

মজন্তালী বললে, ‘আচ্ছা এবারে মাপ করলুম! খবরদার! আর যেন কখনো এমন হয় না!’ এই বলে মজন্তালী তার ভিজে গা শুকোবার জন্য রোঁদ খুঁজতে লাগল।

গভীর বনের ভিতরে সহজে রোদ ঢুকতে পায় না। সেখানে রোদ খুঁজতে গেলে উঁচু গাছের আগায় গিয়ে উঠতে হয়। মজন্তালী একটা গাছের আগায় উঠে দেখলে যে, খুব বড় একটা মরা মহিষ মাঠের মাঝখানে পড়ে আছে। তখন সে তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই মহিষটার গায়ে কয়েকটা আঁচর কামড় দিয়ে এসে বাঘিনীকে বললে, ‘শিগগির যা আমি একটা মোষ মেরে রেখে এসেছি।’ বাঘিনী আর তার ছানাগুলো ছুটে গিয়ে দেখল, সত্যি মস্ত এক মোষ পড়ে আছে। তারা চারজনে মিলে অনেক কষ্টে সেটাকে টেনে আনলে, আর ভাবলে, ‘ঈস! মজন্তালী মশায়ের গায়ে কি ভয়ানক জোর!’

আর একদিন তারা মজন্তালীকে বললে, ‘মজন্তালী মশাই, এ বনে বড়বড় হাতি আর গণ্ডার আছে। চলুন একদিন সেইগুলো মারতে যাই।’

একথা শুনে মজন্তালী বললে, ‘তাই তো, হাতি গণ্ডার মারব না তো মারব কি? চল আজই যাই।’

বলে সে তখুনি সকলকে নিয়ে হাতি আর গণ্ডার মারতে চলল। যেতে-যেতে বাঘিনী তাকে জিগগেস করলে, ‘মজন্তালী মশাই, আপনি খাপে থাকবেন, না ঝাঁপে থাকবেন? খাপে থাকবার মানে কি? না-জন্তু এলে তাকে ধরে মারবার জন্য চুপ করে গুঁড়ি মেরে বসে থাকা। আর ঝাঁপে থাকার মানে হচ্ছে, বনের ভিতরে গিয়ে ঝাঁপাঝাঁপি করে জন্তু তাড়িয়ে আনা।’

মজন্তালী ভাবলে, ‘আমার তাড়ায় আর কোন জন্তু ভয় পাবে!’ তাই সে বললে, ‘আমি ঝাঁপিয়ে যে সব জন্তু পাঠাব, তা কি তোরা মারতে পারবি? তোরা ঝাঁপে যা, আমি খাপে থাকি।’

বাঘিনী বললে, ‘তাই তো, সে সব ভয়ানক জন্তু কি আমরা মারতে পারব? চল বাছারা, আমরা ঝাঁপে যাই।’

এই বলে বাঘিনী তার ছানাগুলোকে নিয়ে বনের অন্য ধারে গিয়ে ভয়ানক ‘হাল্লুম-হাল্লুম’ করে জানোয়ারদের তাড়াতে লাগল। মজন্তালী জানোয়ারদের ডাক শুনে, একটা গাছের তলায় বসে ভয়ে কাঁপতে লাগল।

খানিক বাদে একটা সজারু সড়-সড় করে সেই দিক পানে ছুটে এসেছে, আর মজন্তালী তাকে দেখে ‘মাগো’ বলে সেই গাছের একটা শিকড়ের তলায় গিয়ে লুকিয়েছে, এমন সময় একটা হাতি সেইখান দিয়ে চলে গেল। সেই হাতির একটা পায়ের এক পাশ সেই শিকড়ের উপরে পড়েছিল, তাতেই বেচারা মজন্তালীর পেট ফেটে গিয়ে, বেচারার প্রাণ যায় আর কি!

অনেকক্ষন ঝাঁপাঝঁপি করে বাঘেরা ভাবল, ‘মজন্তালী মশাই না জানি এতক্ষনে কত জন্তু মেরেছেন, চল একবার দেখে আসি।’ তারা এসে মজন্তালীর দশা দেখে বললে, ‘হায়-হায়! মজন্তালী মশায়ের এ কি হল?’

মজন্তালী বললে, ‘আর কি হবে? তোরা যে সব ছোট-ছোট জানোয়ার পাঠিয়েছিলি, দেখে হাসতে-হাসতে আমার পেটই ফেটে গিয়েছে!’

এই বলে মজন্তালী মরে গেল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress