পণ্ডিতের কথা
সেই যে হবুচন্দ্র গবুচন্দ্র মন্ত্রী ছিল, সেই হবুচন্দ্র রাজার একটা ভারি জবর পণ্ডিতও ছিল। তার এতই বুদ্ধি ছিল যে, তার পেটে অত বুদ্ধি ধরত না। তাই তাকে দিন রাত নাকে কানে তুলোর ঢিপ্লী গুঁজে বসে থাকতে হত, নইলে বুদ্ধি বেরিয়ে যেত। তুলোর ঢিপ্লী গুঁজত বলে নাম হয়েছিল ‘ঢিপ্লী’ পণ্ডিত।
একদিন হয়েছি কি, হবুচন্দ্রের দেশের জেলেরা একটা এঁদো পুকুরে জাল ফেলতে গিয়েছে। সেই পুকুর কোত্থেকে একটা শূয়র এসে ঝাঁঝি পাটার ভিতরে গা ঢাকা দিয়েছিল। জেলেরা জাল ফেলতেই সে গিয়েছে তার মধ্যে আটকে, তারপর জাল টেনে তুলে সেই শূয়র দেখতে পেয়েই ত জেলেরা ভারি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছে। তাদের দেশে আর কেউ কখনো এমন জানোয়ার দেখে নি। তারা কিছুতেই ভেবে ঠিক করতে পারল না, এটা কি জানোয়ার। তারা জাল দিয়ে কত বড় বড় শাল, বোয়াল, কচ্ছপ ধরেছে, কিন্তু এমন জানোয়ারের কথা ত কখনো শোনে নি। যা হোক তারা ঠিক করল যে রাজা হবুচন্দের সভায় নিয়ে এটাকে দেখাতে হবে। এই বলে সেই শূয়রটাকে খুব করে জাল দিয়ে জড়িয়ে তারা রাজার সভায় নিয়ে এল। রাজা তার ছটফটি দেখে দেখে আর চ্যাঁচানি শুনে বললেন, ‘বাপ্ রে। এটা-আবার কি জন্তু?’ সভার লোকেরা কেউ সে কথার উত্তর দিতে পারল না। যে-সব পণ্ডিত সেখানে ছিল, তারা দু দল হয়ে গেল। কয়েকজন বললে, ‘গজয়’, অর্থাৎ হাতি ছোট হয়ে গিয়ে এমন হয়েছে। কেউ বললে, ‘মূষা বৃদ্ধি’, অর্থাৎ ইঁদুর বড় হয়ে এমনি হয়েছে। এখন এ কথার বিচার ঢিপাই ছাড়া আর কে করবে? কাজেই রাজা তাকে ডেকে পাঠালেন। ঢিপাই এসে অনেকক্ষণ ধরে সেই শূয়রটাকে দেখ বলল, ‘আরে তোমরা কেউ কিছু বোঝ না। এটাকে জলে ছেড়ে দাও। যদি ডুবে যায়, তবে এটা মাছ। যদি উড়ে পালায় তবে পানকৌড়ি। আর যদি সাঁতরে ডাঙ্গায় ওঠে, তা হলে কচ্ছপ, না হয় কুমির।’ তখন সভার লোকেরা ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘ভাগ্যিস ঢিপাই মশাই ছিলেন, নইলে এমন কথা আর কে বলতে পারত।’
আমরা ছেলেবেলায় এই ঢিপাইয়ের গল্প শুনতাম।এইরূপ এক-একটা পণ্ডিত বা পাড়াগেয়েঁ বুদ্ধিমানে গল্প অনেক দেশেই আছে, তার দু-একটি নমুনা শোন।
ঢিপাইয়ের যে ছেলে, সেও বড় হয়ে তার বাপের মতন বড় পণ্ডিত হয়েছিল। তার গ্রামের লোকেরা একটা কিছু জানতে হলেই তার কাছে আসত। এর মধ্যে একদিন রাত্রে তাদের গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা হাতি গিয়েছে। ভাবনা হল, না জানি এ-সব কিসের দাগ, আর না জানি তাতে কি হবে। তারা এর কিছুই বুঝতে না পেরে শেষে ঢিপাইয়ের ছেলেকে নিয়ে এল। সে এসে অনেক ভেবে বললে, ‘ওহ্! বুঝেছি রাত্রে চোর এসে উঘ্লি নিয়ে গেছে। সে বেটা বারবার বসেছিল, তাইতে উঘ্লির তলায় দাগ পড়েছে।’
কাশীর ওদিকে এমনি একটা পণ্ডিতের গল্প আছে, সেই পণ্ডিতের নাম ছিল ‘লাল বুঝগ্র।’
সে এমনি হাতির পায়ের দাগ দেখে বলেছিল-
‘লাল বুঝগ্গর সব সম্ঝো আউর না সমঝো কোই,
চার পয়ের মে চক্কর বাঁধকে হরণা কূদে হোই।’
অর্থাৎ লাল বুঝগ্গর সব বুঝতে পারে, আর কেউ বুঝতে পারে না; চার পায়ে জাঁতা বেধে হরিণ ছুটে গিয়েছে।
তুরস্ক দেশেও এমনি একটি বেজায় বুদ্ধিমান লোক ছিল। একবার একটা উট দেখে একজন তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মশায়, এটা কি জন্তু?’ বুদ্ধিমান বললে, ‘তাও জান না? খরগোশ হাজার বছরের বুড়ো হয়েছে, তাইতে তার এমনি চেহারা হয়ে গিয়েছে।’ কথাটা কিন্তু নিতান্ত মন্দ বলে নি, খরগোশ যদি হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারত, আর সেই হিসাবে তার নাক তুবড়ে গাল বসে মুখ লম্বা হয়ে আসত, তবে তার অনেকটা উটের মত চেহারা হত বইকি!
পাঞ্জাবে এক বুদ্ধিমান বুড়োর কথা আছে, সে বেশ মজার। গ্রামের মধ্যেই সেই লোকটি সকলের চেয়ে বুড়ো আর বুদ্ধিমান, আর সব বড্ড বোকা। একদিন রাত্রে সেই গ্রামের ভিতর দিয়ে একটা উট গিয়েছিল। সকালে উঠে তার পায়ের দাগ দেখে কেউ বুঝতে পারছে না যে, কিসের দাগ। শেষে তারা সেই বুড়োর কাছে গিয়ে বলল, ‘দেখ ত এসে বুড়ে দাদা, এ-সব কিসের দাগ?’ বুড়ো দাদা সঙ্গে সঙ্গে এসে এই উটের পায়ের দাগগুলো দেখে খানিক হাউ হাউ কাঁদল, তারপর হিহি হিহি করে হেসে ফেলল। তাতে সকলে ভারি আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘তুমি কাঁদলে কেন দাদা?’ বুড়ো বললে, ‘কাঁদব না? হায় হায়। আমি মরে গেলে তোরা কার ঠেঞে এ-সব কথা জিজ্ঞেস করবি?’ তাতে সকলে ভারি দুঃখিত হয়ে বলরে, ‘আহা, টিক বলেছ দাদা। তুমি না থাকলে আর কাকে জিজ্ঞাসা করব? তুমি আবার হাসলে কেন?’ বুড়ো বলল, ‘হাসব না? হাঃ হাঃ হা-হা-আ-আ, আরে আমিও যে বুঝতে পারলুম না, এ ছাই কিসের দাগ। হাঃ হাঃ হা-হা-আ-আ-আ।’
আর দু-ভাইয়ের কথা বলে শেষ করি। এক গ্রামে অনেক চাষা ভুষো থাকে, তাদের সকলের কিছু কিছু টাকা কড়ি আছে, কিন্তু তাদের কেউ কখনো লেখাপড়া শেখে নি। সেজন্য তারা বড়ই দুঃখিত। একদিন তারা সবাই মিলে যুক্তি করল, ‘চল আমরা দুটি ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে আনি। আমাদের গ্রামে একটাও পণ্ডিত নেই, কেমন কথা?’ এই বলে তারা তাদের গ্রামের মোড়লের দুটি ছেলেকে শহরে পাঠিয়ে দিল। তাদের বলে দিল, ‘তোরা বিদ্যে শিখে পণ্ডিত হয়ে আসবি।’
তারা দু ভাই শহরে চলেছে, পথে পাশে যা কিছু দেখছে, কোনটারই খবর নিতে ছাড়ছে না। এক জায়গায় গাছতলায় একটা হাতি বাঁধা ছিল, তাকে দেখে তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে পথের লোককে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি ভাই?’ তারা বলল, ‘এটা হাতি।’ তা শুনে দু ভাই ভারি খুশি হয়ে বলল, ‘বাঃ এরি মধ্যে ত এক বিদ্যা শিখে ফেলুলম-হাতি, হাতি হাতি।’
তারপর শহরের কাছে এসে মন্দির দেখতে পেয়ে তারা একজনকে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কি ভাই সে বলল, ‘এটা মন্দির।’ তাতে দু ভাই বলল, ‘মন্দির মন্দির, মন্দির, বাঃ, আরেক বিদ্যে শেখা হল।’
বলতে বলতে তারা বাজারের ভিতর দিয়ে চলেছে। বাজারে মাছ, তরকারি, ডাল, চাল সবই আছে, আর সবই তারা চেনে, খালি আলু আর কখনো দেখে নি। সেই জিনিসটার দিকে তারা অনেকক্ষণ হাঁ করে চেয়ে রইল, তারপর আলুওয়ালাকে জিজ্ঞাস করল, ‘এগুলো কি ভাই?’ সে তাতে রেগে বলল, ‘কোথাকার বোকা? এ যে আলু তাও জান না?’ তারা দু ভাই সে কথার কোন উত্তর না দিয়ে খালি বলতে লাগল, ‘আলু, আলু, আলু।’ তখন তাদের মনে হল ‘ইস, আমরা কত বড় পণ্ডিত হয়ে গেছি, একটা বিদ্যে শিখলেই তাকে পণ্ডিত বলে। আর আমরা দেখতে দেখতে তিনটে বিদ্যে শিখে ফেললুম। আর কি, এখন দেশে ফিরে যাই।’
কাজেই তারা গ্রামে ফিরে এল। তারপর থেকে তারা পালকি ছাড়া চলে না, গ্রামের লোক তাদের দেখলেই দণ্ডবৎ করে আর বড় বড় চোখ করে বলে ‘বাপ রে, তিন মুখো পণ্ডিত হয়ে এসেছে।’ এমনি করে কয়েক বছর চলে গেল। তারপর একদিন হয়েছে কি, সেই গ্রামে কোত্থেকে এসেছে এক হাতি। গ্রামের লোক তাকে দেখেই ত আগে ছুটে পালাল। তারপর অনেক দূর থেকে উঁকি ঝুঁকি মেরে তাকে দেখতে লাগল, কিন্তু কেউ বলতে পারল না, এটা কি। শেষে একজন বলল, ‘শিগ্গির পণ্ডিতমশাইদের ডাক।’ তখনি পালকি ছুটল পণ্ডিতদের আনতে। তারা এসে চশমা এঁটে অনেকক্ষণ ধরে হাতিটাকে দেখল, বড় ভাই বলল, ‘এটা মন্দির।’ ত শুনে ছোট ভাই বলল, ‘দাদার যে কথা! এত টাকা দিয়ে বিদ্যে শিখে এসে শেষে কিনা বলছে, এটা মন্দির। আরে না না, এ মন্দির। আরে না না, এ মন্দির নয়, এটা আলু। আলু।