শুভ বিবাহ – ষষ্ঠ ঋতু
শুভ বিবাহ কথাটি খুবই চলিত। আমি যে বিয়ের কথা বলতে যাচ্ছি, সেটা ঠিক আপনাদের মতে শুভবিবাহ নাও হতে পারে। মনে হতে পারে খানিকটা অভিনব। অভিনব বিয়ে।
বেশ কিছুদিন আগের কথা বলছি। একটি ছোটখাটো বেকারি ফ্যাক্টরির হিসাব রক্ষকের কাজ করতুম। আসলে, হিসাব রক্ষা, মালখানা পাহারা দেওয়া এবং সাপ্লায়ার— এই ত্রিবিধ কাজই আমাকে করতে হত। মাইনে পেতুম গোটা তিরিশ। আমার মালিকের এক শালা ছিল, কলকাতা থেকে প্রায় ষাট বাষট্টি মাইল দূরে, ছোট মফস্বল টাউনে। মনোহারী দোকান ছিল তার। আমাকে মাঝে মাঝে মাল নিয়ে, সেইখানে পৌঁছে দিয়ে আসতে হত। সেই সময়টাতে ময়দা পুরো র্যাশনিং। পারমিট ছাড়া এক চিমটি ময়দাও পাওয়া যায় না। সেই জন্য, আমার মালিক দূরে মালটা পাঠিয়ে বেশ ভাল রোজগার করছিল।
কিন্তু কাজটা বড় বিশ্রী। অবশ্য মালটা বহন করবার জন্য আমায় কুলির পয়সা দেওয়া হত। তবু, এত দূরে গিয়ে, মালটা দিয়ে আসতে হত যে, আমার ধৈর্য থাকত না এক একদিন। দায়িত্বও ছিল কম নয়। মালের দায়িত্ব, তা ছাড়া পাই পয়সাটি পর্যন্ত গুণে গুণে হিসাব দেওয়ার দায়িত্ব, সবই করতে হত। তার পর, মালিকের শালাটি পয়সার ব্যাপারে–
যাকগে ও-সব কথা। সেখানে যাওয়ার সারাদিনে তিনটি গাড়ি আছে। তার মধ্যে একটি আমাদের শহরতলীর স্টেশনে দাঁড়ায় না। সকালের গাড়িটি ফেল করলে, রাত্রি সাড়ে সাতটায় আর একটি। সেইটিতে গেলে, মালিকের শালাকে ঘুম থেকে তুলতে হয়। অবশ্য শ্যালক যদি ঘরে থাকে। তার বসতবাড়ি আবার সে শহর থেকে মাইল তিনেক দূরে। কোনও কোনও দিন সে সেখানে যায়। কোনওদিন বা সেই শহরেরই মেয়েমানুষের পাড়ায়—
যাক সে কথা। আমাকে নানান রকম ভোগান্তি পোয়াতে হয় প্রায়ই। তবে মাগনা নয়, তিরিশটি টাকার বিনিময়ে। আর খুব খিদে পেলে, রুচি থাকলে, কারখানার ছাড় অর্থাৎ খারাপ কিংবা ভাঙাচোরা রুটি বিস্কুট খেতে পাওয়া যেত। এইটি বিনা পয়সায় পাওয়া যেত। একমাত্র উপরি রোজগার।
একবার আমাকে যেতে হল সেই সাড়ে সাতটার গাড়িতে। সেদিন আকাশের অবস্থাটা ভাল নয়। শ্রাবণ মাস। জলটা ঠিক জোরে হচ্ছে না। হাওয়াও নেই। সারাটি দিন দিনের মুখ ভার হয়েছিল মেঘ অন্ধকারে। বৃষ্টি হচ্ছে ফিসফিস করে। যেমন রাস্তার অবস্থা, তেমনি গাড়িগুলির তৃতীয় শ্রেণীর অবস্থা। তার উপর ছিল সে দিন বিয়ের লগনসা–বর আর বরযাত্রীরও ভিড় ছিল। বাজার গাড়িগুলির তো কথাই নেই। হয় আঁশটে, নয় ছানার বোটকা গন্ধে ভরা। তার উপরে অন্ধকার। যেন ওই গাড়িগুলিতে বাতি জ্বলতে নেই। ভাল কামরাতেই জ্বলে না। আমার সঙ্গে ছ টিন মাল। এস, পাপা, লেড়ো, নানা রকমের দেশি বিস্কুট, রুটি, কেকভরা। আমাকে বাজার গাড়িতে উঠতে হল। থার্ডক্লাশের যাত্রীরা এত মাল নিয়ে উঠতেও দিতে চান না।
বেরুলাম, সেখানে পৌঁছুলাম প্রায় রাত্রি এগারোটার সময়। সেই একই ফিসফিসে জল, আর গুমোট। মাঝে মাঝে চোখ ঝলসে দিচ্ছে বিদ্যুৎ। সারা স্টেশনে কুলি নেই একটিও। মালটা নামালুম নিজের হাতেই। মাগনা নয়। কুলির পয়সাটা লাভ হল নিজের।
স্টেশনটা নদীর পারে। সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে হয় অনেকখানি, নামি কী করে এত মাল নিয়ে। নীচে উঁকি দিয়ে দেখলুম, রিকশাওয়ালা নেই একটিও। টিকেট কলেকটর চিনতেন আমাকে। মালগুলি রাত্রের মতো অফিসে রাখতে দিলেন। টিনগুলি অবশ্য তালাবদ্ধ ছিল।
বসে বসে কী করি। নীচে নেমে গেলুম, যদি কোনও দোকানে একটু চা পাওয়া যায়। টিকেট কলেক্টর বললেন, কি, শহরে রাতটা কাটিয়ে আসা হবে বুঝি?
বলার ভঙ্গিটি খুব স্পষ্ট। বললুম, দেখি কী হয়।
উনি হাসলেন। আমি নেমে এলুম। ইস! কী বিদ্যুৎ! যেন নির্ঘাত বাজ পড়বে মাথায়।
স্টেশনটা অনেক উঁচুতে। নীচের জমির সঙ্গে গিয়ে মিশেছে প্রায় এক মাইল দূরে। স্টেশনের লাইনের তলা ইট সিমেন্ট দিয়ে জমানো। যেন উপরে ব্রিজ আর নীচে রাস্তা। কিন্তু রাস্তা ঠিক নয়। তলা দিয়ে সরু সরু মালা ঢাকা গলির মতো হয়েছে এক একটি খিলানের তলায়। চামচিকের বাস। ইঁদুর, আরশোলা, সাপখোপ, সব কিছুরই যাতায়াত আছে এই সুড়ঙ্গগুলিতে।
নীচে নেমে দেখি, চায়ের দোকান খোলা নেই। শহরটা গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছ। এ-দিক ওদিক তাকিয়ে, খানিকটা উত্তরদিকে একটু আলোর আভাস চোখে পড়ল। এগিয়ে গেলুম।
দেখলুম আলো জ্বলছে স্টেশনের নীচের একটি সুড়ঙ্গের মধ্যে। তার মধ্যে কিছু লোক। তা বেশ কিছু প্রায় জনা চোদ্দো পনরো হবে। গোটা দুয়েক সাইকেল রিকশাও ঢোকানো রয়েছে।
আমাকে দেখে সবাই তাকাল। আলো বলতে সাইকেল রিকশার দুটি আলো। বসানো হয়েছে খিলেনের দেয়ালে ছোট ছোট খুপরির মধ্যে। একটি চামচিকে নরকে আবদ্ধ আত্মার মতো এ-পাশে ও-পাশে ছটফট করে উড়ছে। আর মানুষগুলিকে ঠিক মানুষ মনে হচ্ছিল না। যেন কতগুলি কিম্ভুতকিমাকার মূর্তি এক ভিন্ন ভয়াল অন্ধকার রাজ্যের কোণে বসে কীসের ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিল, একটি নতুন জীব দেখে চমকে উঠেছে। মুখগুলি যেন অদ্ভুত রং মাখা, বাঁকা চোরা ভাঙা, নাকমুখহীন দলা দলা। শরীরগুলিও সেই রকম। নিজেদের ছায়ার সঙ্গে মিলেমিশে আর একটি প্রাকৃতিক রূপ যেন।
এক মুহূর্ত পরেই নজর করে দেখলুম, সবাই ঘিরে বসেছে দুজনকে মাঝখানে রেখে। একজন পুরুষ, আর একজন মেয়েমানুষ। একমাত্র তাদের দুজনেরই নতুন কাপড়।
পুরুষটি কালো, রোগা। খোঁচা খোঁচা চুল, খালি গা। বয়স অনুমান করা যায় না। মেয়েমানুষটির ঘোমটা আছে, তবু মুখ দেখা যায়। সেও কালো, চুলগুলি জটপাকানো। চোখগুলি কোটরে ঢুকে গেছে, দৃষ্টি একটু রোখা রোখা। গায়ে জামা নেই। শরীরের পুষ্টতা চোখে পড়ে। তবে বয়স বলা কঠিন।
আমার মনে হল, এদের অনেককেই আমি চিনি। কিন্তু কোথায় দেখেছি, মনে করতে পারছিনে। আশ্চর্য! তা হলে কি জন্মান্তর বলে কিছু আছে নাকি? এরা কি আমার গত জন্মের চেনাশোনা, নাকি আগের মৃত্যুর পর পৃথিবীর কোনও এক অদৃশ্য লোকে এদের দেখেছিলুম।
হঠাৎ একজন বলল আমাকে, কে? কী চাই? যে বলল, সে একজন আধবুড়ো। তাকেও আমি যেন চিনি চিনি মনে হচ্ছে। বললুম, কিছু চাইনে। একটু চায়ের দোকানের খোঁজে এসেছিলুম।
একটি বুড়ির খনখনে গলা শোনা গেল, চা তো এখেনে পাবেন না গো বাবুমশাই। এখেনে একটা শুভ কাজ হচ্ছে এখন।
বলেই বুড়ি হেসে উঠল কেশো গলায়! আরে, বুড়িটা তো চেনা। ও হো! হাঁ, ঠিক মনে পড়েছে। এই বুড়িটা তো, এই স্টেশনেরই সিঁড়িতে ভিক্ষে করে।
একজন জিজ্ঞেস করল, নিবাস কোথায়? কোথায় যাওয়া হবে? যে জিজ্ঞেস করল, তাকেও এবার চিনতে পারলুম। সে এখানকার একজন রিকশাওয়ালা। অনেকবার আমার মাল বয়েছে। বললুম, যাব তো শ্রীহরির মনোহারী স্টোর্সে। কিন্তু রাত হয়ে গেছে
রিকশাওয়ালা অমনি বলে উঠল, ও হো! আপনি? সেই রুটি বিস্কুটওয়ালা বাবু তো। সাঁতরা বাবুর দোকানে তো অনেকবার আপনাকে নিয়ে গেছি। তা এত রাতে আর কোথায় যাবেন রুটিওয়ালা বাবু, বসে যান না এখানেই।
আরও কয়েকজন বলে উঠল, হাঁ, হ্যাঁ, বসে যান।
কিন্তু বসব কোথায়। ছাট অবশ্য লাগছে না, লাগবার কোনও সম্ভাবনাও নেই। যে কোনও ভাল বাড়ির থেকে এ আশ্রয়টি খারাপ নয়। আর বসতে যাবই বা কেন? জিজ্ঞেস করলুম, ব্যাপারটা কী হচ্ছে?
জবাব দিল সেই রিকশাওয়ালাটিই। বলল, আপনি অনাথকে চেনেন তো? অনাথ আর কালার বউকে?
অনাথ আর কালার বউ! কই মনে পড়ছে না তো। তার পরে বুঝলুম, অনাথ আর কালার বউ, দুজনেই ভিক্ষুক। এই শহরেই ভিক্ষে করে। স্টেশনটা তাদের কেন্দ্রস্থল। অনাথ নিতান্তই অনাথ। সে নাকি নদে জেলারই কোনও গ্রামের খাঁটি ব্যাঘ্রক্ষত্রিয়দের পূজারী বামুন ছিল। কপাল গতিকে এখানে এসে ভিক্ষুক হয়েছে। এমন কী, তার নাকি ভিটেমাটিও ছিল এককালে। বিয়ে থা আর হয়নি। কেউ ছিলও না দেবার। এখন দরিদ্র বোরাম্ভনের ছেলেকে একটি পয়সা দিন বলে ভিক্ষে করে। বয়স দেখায় প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশের মতো। কিন্তু সে বলে, একুশের বেশি নয়।
আর কালার বউ যে কোন কালার বউ, তা কেউ জানে না। বৃন্দাবনের কালা নয়, এটা সবাই জানে। গত মন্বন্তরের সময় থেকে এ শহরে আছে। কালা বলে তার এক স্বামী ছিল। সে মারা গেছে। ছেলেমেয়ে ছিল কয়েকটি। তারাও মরে গেছে।
কিছুদিন থেকে অনাথ কালার বউগের কাছে প্রেম নিবেদন করছে। এ নিয়ে, রাস্তাঘাটে কালার বউ অনাথকে গুষ্টিসুদ্ধ উদ্ধার করেছে। এখনও তার গতর আছে, ভিক্ষে করতেও পারছে। শুধু শুধু অনাথের কাছে থেকে আবার এক গাদা বিয়োবে কেন? অনাথ তাকে খাওয়াবে পরাবে কী? ছেলেপুলে হলে কী পুষবে? ন্যাড়া বেলতলায় যায় কবার! অতই যদি দুঃখ সইতে পারবে কালার বউ, তবে এই শহরে অনেক বাবুর কাছেই সে যেতে পারত। পয়সা মিলত। কিন্তু রেলপুলের তলায় বিয়োতে হত–
যাক। কিন্তু অনাথ ভিক্ষে বন্ধ করে প্রায় অনশনে মরতে বসল। কালার বউকে সে ভালবেসেছে, তাকে না পেলে নাকি মরবে।
মরুক। কালার বউ বলেছে, যদি তাকে পেতে হয়, তবে বিয়ে করতে হবে, দরকার হলে খাওয়াতে পরাতে হবে। অনাথ তাইতেই রাজি। মিছিমিছি নয়। ফাঁকি হলে তাকে কালার বউ এ শহরছাড়া করে ছাড়বে। মেরেধরে তুলো ধোনাও করতে পারে।
স্টেশনকেন্দ্রের ভিক্ষাজীবী মেয়ে পুরুষেরা গভীর অভিনিবেশ সহকারে ব্যাপারটি ভেবেছে। তার পর এক বাক্যে রায় দিয়েছে, ভিক্ষুক বলে কি তারা মানুষ নয়, না, তাদের আর বিয়ে-থা বলে কিছু নেই! সুতরাং বিয়ে সাব্যস্ত হয়েছে। সকলে তাদের রুজির পয়সাও দিয়েছে বিয়ের খরচের জন্য। এখানে একটি মন্দিরের সামনে, কপালে সিঁদুর লাগিয়ে আর গলায় রুদ্রাক্ষ দিয়ে একজন ভিক্ষে করে। সে ব্রাহ্মণ! বিয়ের মন্ত্র পড়ার পুরোহিত সে। রিকশাওয়ালা দুজন আছে, তাদের আর কোথাও যাবার জায়গা নেই রাত্রে। মালিকের ঘরে রাত্রে ফিরে না গেলেও ক্ষতি নেই। তারাও বিয়েটা দেখে যাবে। তা ছাড়া স্টেশনের লাইসেন্সবিহীন দুজন কুলি আছে এই বিয়ে বাসরে। গুটি তিনেক কুকুর। তার পরে আবার আমি এসে হাজির হলাম আর একজন বাইরের লোক।
এতক্ষণে আমি ভাল করে সকলের মুখের দিকে তাকালাম। চোখাচোখি হতেই অনাথ সলজ্জ হেসে মাথা নিচু করল। কালার বউ ঘোমটা টেনে দিল।
শুনলুম মন্ত্র পড়া হয়ে গেছে। এবার সাত পাক ঘোরা হবে। এমন সময়ে আমি এসেছি। দেখলুম, শাল পাতায় ঢাকা রয়েছে কী সব বোধ হয় কিছু তেলেভাজা জাতীয় খাবার আনা হয়েছে। কেন না কুকুরগুলি ওই দিকেই চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে।
এখন তর্ক হচ্ছিল বিয়ের অনেক নিয়মকানুন নাকি ঠিক হয়নি। এখানকার অনেকেই এ বিষয়ে অভিজ্ঞ এবং রীতিমতো বিবাহিত। সাতপাকের আগে, সেইটার বিহিত হোক।
বসতে পারলুম না। দাঁড়িয়েই রইলুম। জীবনে যে এমন বিয়ে দেখতে হবে, কোনওদিন ভাবিনি। এমন বিয়েও যে আবার হয়, তা জানতুম না। এখানেও যে নিয়মকানুন নিয়ে আবার বাকবিতণ্ডা হতে পারে, সেটাও কল্পনাতীত ব্যাপার।
এবার একটি আধবুড়ি বলে উঠল, আমার কাছে চালাকি চলবে না। শস্তাগণ্ডার দিনে আমার বাপ একশো, এক আধটাকা নয়, একশো টাকা খরচ করে বিয়ে দিয়েছিল। ও-সব বিয়ের আচার-বিচার আর আমাকে শিখুতে হবে না।
খনখনে গলা বুড়ি, শননুড়ি চুল দুলিয়ে দুলিয়ে বলল, সে কী তোর একলার। আমার বেতে একশোটা নোক খেয়েছিল। ঢাক ঢোল কাঁসি বাদ্যি বাজনা, সে একেবারে কী কাণ্ড।
রিকশাওয়ালাটা এবার চটে উঠে বলল, আরে দুত্তোর নিকুচি করেছে বাদ্যি বাজনার। আমি এবার আমার গাড়ির বাতি নিয়ে চলে যাব কিন্তু। বলছি তখন থেকে যে, এটা বেওয়ারিশ বিয়ে, চালিয়ে নেও যা হোক করে, তা নয়, এখন আবার আচার বিচার। একজন বলে উঠল, হ্যাঁ, সময়মতো আবার ভোরবেলা গিয়ে কাচারির কোণটাতে আমাকে বসতে হবে। নইলে গাঁয়ের বুড়ো কানাটা এসে বসে পড়বে।
একটি খোঁড়া ভিখারি বলে উঠল, ওদিকে তেলেভাজাগুলি চুপসে জল হয়ে গেল।
বসন্তের দাগ ধরা ভয়ঙ্কর মুখো লোক একটি বলে উঠল, অমনি নোলা দিয়ে জল ঝরছে। শালা ভিখিরি কোথাকার।
উপযুক্ত গালাগাল! কিন্তু খোঁড়া গেল খেপে। বলল, কী! জাত তুলে গালাগাল! জানিস, ও কথা বললে বাবুদেরও ছেড়ে দিইনে!
রিকশাওয়ালা আমার দিকে ফিরে হেসে বললে, দেখছেন তো শালাদের কাণ্ড। ভেবেছিলাম আজ এট্টু বায়স্কোপ দেখব। তাপর ভাবলাম যে, না এ ব্যাটাদের বিয়েটাই দেখে যাই। তা কী ঝগড়াটাই লাগিয়েছে তখন থেকে।
কিছু বলতে পারলুম না! হাসতেও পারলুম না। যদি কিছু মনে করে বসে। এরা সকলেই নিজেদের মধ্যে জানাশোনা। আমি অজানা। তা ছাড়া, সবটা মিলিয়ে, এদের সেই করুণ, দয়াভিক্ষা করা কাঁদা কাঁদা ভিখারি মনে হচ্ছিল না এখন। বরং রাগে বিদ্রূপে এই অদ্ভুত পরিবেশে এক অন্য জগতের মানুষ মনে হচ্ছিল। দেখাচ্ছিল আরও ভয়ঙ্কর।
ইতিমধ্যে দুই বুড়িতে তর্কাতর্কি জমে উঠেছে। পুরোহিত হাঁ করে দেখছে সব। কালার বউয়ের চোখে রাগ। অনাথের ব্যস্ত অস্থিরতা।
তার পর অনাথের আর সহ্য হল না। সে প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল, বেটা হতে দেবে, না উঠে পড়ব। এ তো আর গাঁয়ে ঘরে বিয়ে হচ্ছে না যে নিয়মকানুন সব মানতে হবে। আর যদি বাগড়া দাও তো বলো, উঠে পড়ি।
সব চুপ। কেবল একজন বলে উঠল, হ্যাঁ এবার ঘুরিয়ে দেও, ঘুরিয়ে দেও সাতপাক। রাগারাগির দরকার নেই।
হঠাৎ একটা বাতি নিভে গেল। তেল নেই আর। আরও অন্ধকার হল। একটি বাতির আলোয় আরও ভয়ঙ্কর হল মূর্তিগুলি। আমার ছায়াটা আলাদা করে খুঁজলুম, পেলুম না।
খনখনে-গলা, বুড়ি বলল, কত আলো জ্বলেছিল আমার বিয়েতে—
আধা বুড়ি বলল থেমে থেমে, আমার সময়ে আটটা হ্যারিকেন জ্বলেছিল।
এক চোখ কানা একজন মোটা গলায় বলে উঠল, আঃ, এবার থামাও ওই কথাগুলি। আমি আর সহ্য করতে পারি না!…
আচ্ছা, আচ্ছা ঘোরাও। কালার বউকে তুলতে হয় যে! কে কে তুলবে?
রিকশাওয়ালা বসেছিল রিকশার উপরেই। হঠাৎ সিটটা চাপড়াতে আরম্ভ করল। বাজনা বাজাচ্ছে।
খোঁড়া উঠল আগে। কালার বউকে তুলবে।
কিন্তু আবার গণ্ডগোল। কনে কালার বউ বলল, সাতপাক হবে না, বে হবে না। আমার মন নেই।
এক মুহূর্ত সব চুপ। অবাক গুলতানি। কেন, কী হল! সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে এখন সীতা কার বাপ!
কালার বউ নীরব। কিন্তু তার রাগ নেই, চোখা চোখা কথা নেই। খালি নীরব। ঘোমটা খসে পড়েছে, জট পাকানো চুলগুলি ছড়িয়ে পড়েছে ঘাড়ে। মুখের একদিকটা দেখা যাচ্ছে না একেবারে। আর একদিক ঝাপসা ঝাপসা। মানুষ বলে মনে হয় না।
তার পাশে অনাথের অবস্থা কহতব্য নয়। তিন ভাগ অন্ধকার, এক ভাগ আলোয়, অনাথকে ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছিল। তার সারা মুখে বোবা অস্থিরতা ও যন্ত্রণা। সে প্রায় ছেলেমানুষের মতো চিৎকার করে উঠল, ওলো কেন বল…তোর পায়ে পড়ি।
মনে মনে বললুম, ঠিকই। এ ছাড়া, বরোচিত কথা আর কী বলতে পারত অনাথ।
কালার বউ পরিষ্কার বলে দিল, আমি বে করে আর ভিক্ষে মাগতে পারব না। আর, কারওর ভিক্ষের ভাতও খেতে পারব না। তা এখন যাই বলো।
সবাই তো হাঁ। তবে কী করতে হবে?
কালার বউ বললে, সমসারে যা করে নোকে। কাজ করে, সোমসার করে। ভিক্ষেই যদি করব, তবে আবার এ সব কেন। না বাপু না, এই নেও তোমাদের নতুন শাড়ি
বলতে বলতে সে তার ছেঁড়া ধোকড়া ন্যাকড়াটা টেনে নিল পরবে বলে। এখনও পরনে তার, সকলের দেওয়া লালপাড় শাড়ি।
সবাই স্তম্ভিত। অনাথ দেখছে সকলের মুখ। আমার পাশে রিকশাওয়ালাটি গম্ভীর হয়ে উঠেছে।
কালার বউ আবার বলল, সব গেছে বলেই না আজ ভিখিরি হয়েছি। যদি থাকত! আর আবার যদি হবেই…
থেমে হঠাৎ ফোঁস ফোঁস করে উঠল,..পেথম যখন বে হয়েছিল।
রিকশাওয়ালার আরও গম্ভীর; কিন্তু চাপা খুশির চোখে সে কালার বউকে দেখছে। তার পর হঠাৎ আমার দিকে ফিরে খুব বিজ্ঞের মতো মাথা ঝাঁকতে লাগল। অর্থাৎ, দেখছেন তো।
আমার মেজাজ খারাপ হয়ে উঠছিল। তিরিশ টাকা আর ছাড় মাল খেয়ে আমি বিয়ে করিনি। ভিক্ষুকের বিয়েতে কোথায় একটু মজা দেখছিলুম, তা নয়, ভিখারি বেটির আবার মান। আসরটাকে দিলে জুড়িয়ে।
কালার বউ কাপড় খুলতে যাবে, রিকশাওয়ালা তার গাড়িতে দাঁড়িয়ে উঠে বলল, দ্যাখ অনাথ, তুই কাজ করতে পারবি?
অনাথের চোখে আলো দেখা দিল, বললে, পারব।
চুরি করবিনে?
আমি বেরাম্ভনের ছেলে—
থাক ঢের বেরাম্ভন দেখেছি। ঘর ঝাঁট দিতে পারবি?
পারব।
বাবুর সঙ্গে কলকাতা থেকে মাল বয়ে নিয়ে আসতে পারবি?
খুব খুব।
বেশ আমাদের রিকশা মালিকের গদিতে কাল তোকে নিয়ে যাব। কাজ মিলিয়ে দেব।
এবার আমারই হাঁ হওয়ার পালা। অন্যান্য লোকগুলি পাথর। তার পর হঠাৎ সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, তা হলে অনাথ আর ভিখিরি নয়?
রিকশাওয়ালা বলল, হাঁ, এখনও ভিখিরি। সাত পাকটা দেও ঘুরিয়ে।
তা হলে? কী বলিস্ কালার বউ?
কালার বউ ঘোমটা টেনে বললে, তা হলে হোক।
অনাথের আর হাসি ধরে না মুখে। খোঁড়া উঠল সকলের আগে, তার পরে এক চোখ কানা।
সাতপাক ঘোরানো হচ্ছে আর সবাই চিৎকার করছে, এবার আমরাও একটা করে বে করব মাইরি-ই-ই…। তার পর শুভদৃষ্টি। আমি ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছি। কেননা, বিয়ে বাসরটা কেমন যেন ভিজে গেছে। ভিজে ভিজে, কান্না মাখা। একটা অন্য রকমের চাউনি সকলের চোখে। ঠিক ভিক্ষুকের আসর আর নেই।
রিকশাওয়ালাটি পেছন পেছন এসে বলল, সাঁতরা বাবুর দোকানে যাবেন?
বললুম, হ্যাঁ।
ওরা তখন খাচ্ছে আর কুকুরগুলি করুণ গলায় কোঁ-কোঁ করছে।