কৃষ্ণকান্তের উইল (Krishnakanter Will) – ১ম খণ্ড – ০১-০৫
প্রথম পরিচ্ছেদ
হরিদ্রাগ্রামে এক ঘর বড় জমীদার ছিলেন। জমীদার বাবুর নাম কৃষ্ণকান্ত রায়। কৃষ্ণকান্ত রায় বড় ধনী; তাঁহার জমীদারীর মুনাফা প্রায় দুই লক্ষ টাকা। এই বিষয়টা তাঁহার ও তাঁহার ভ্রাতা রামকান্ত রায়ের উপার্জিত। উভয় ভ্রাতা একত্রিত হইয়া ধনোপার্জন করেন। উভয় ভ্রাতার পরম সম্প্রীতি ছিল, একের মনে এমত সন্দেহ কস্মিন্ কালে জন্মে নাই যে, তিনি অপর কর্তৃক প্রবঞ্চিত হইবেন। জমীদারী সকলই জ্যেষ্ঠ কৃষ্ণকান্তের নামে ক্রীত হইয়াছিল। উভয়ে একান্নভুক্ত ছিলেন। রামকান্ত রায়ের একটি পুত্র জন্মিয়াছিল— তাহার নাম গোবিন্দলাল। পুত্রটি জন্মাবধি, রামকান্ত রায়ের মনে মনে সংকল্প হইল যে, উভয়ের উপার্জিত বিষয় একের নামে আছে, অতএব পুত্রের মঙ্গলার্থ তাহার বিহিত লেখাপড়া করাইয়া লওয়া কর্তব্য। কেন না, যদিও তাঁহার মনে নিশ্চিত ছিল যে, কৃষ্ণকান্ত কখনও প্রবঞ্চনা অথবা তাঁহার প্রতি অন্যায় আচরণ করার সম্ভাবনা নাই, তথাপি কৃষ্ণকান্তের পরলোকের পর তাঁহার পুত্রেরা কি করে, তাহার নিশ্চয়তা কি? কিন্তু লেখাপড়ার কথা সহজে বলিতে পারেন না আজি বলিব, কালি বলিব, করিতে লাগিলেন। একদা প্রয়োজনবশত তালুকে গেলে সেইখানে অকস্মাৎ তাঁহার মৃত্যু হইল।
যদি কৃষ্ণকান্ত এমত অভিলাষ করিতেন যে, ভ্রাতুষ্পুত্রকে বঞ্চিত করিয়া সকল সম্পত্তি একা ভোগ করিবেন, তাহা হইলে তৎসাধন পক্ষে এখন আর কোন বিঘ্ন ছিল না। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের এরূপ অসদভিসন্ধি ছিল না। তিনি গোবিন্দলালকে আপন সংসারে আপন পুত্রদিগের সহিত সমান ভাবে প্রতিপালন করিতে লাগিলেন, এবং উইল করিয়া আপনাদিগের উপার্জিত সম্পত্তির যে অর্ধাংশ ন্যায়মত রামকান্ত রায়ের প্রাপ্য, তাহা গোবিন্দলালকে দিয়া যাইবার ইচ্ছা করিলেন।
হ। আমি বাল্যকালে গুরু মহাশয়ের গোঁপ পুড়াইয়া দিয়াছিলাম, এক্ষণে এই উইলও সেইরূপ পুড়াইব।
কৃষ্ণকান্ত রায় আর দ্বিরুক্তি করিলেন না। স্বহস্তে উইলখানি ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। তৎপরিবর্তে নূতন একখানি উইল লিখাইলেন। তাহাতে গোবিন্দলাল আট আনা, বিনোদলাল পাঁচ আনা, কর্ত্রী এক আনা, শৈলবতী এক আনা, আর হরলাল এক আনা মাত্র পাইলেন।
রাগ করিয়া হরলাল পিতৃগৃহ ত্যাগ করিয়া কলিকাতায় গেলেন, তথা হইতে পিতাকে এক পত্র লিখিলেন। তাহার মর্মার্থ এই;–
“কলিকাতায় পণ্ডিতেরা মত করিয়াছেন যে, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত। আমি মানস করিয়াছি যে, একটি বিধবাবিবাহ করিব। আপনি যদ্যপি উইল পরিবর্তন করিয়া আমাকে || আনা লিখিয়া দেন, আর সেই উইল শীঘ্র রেজিষ্টরি করেন, তবেই এই অভিলাষ ত্যাগ করিব, নচেৎ শীঘ্র একটি বিধবাবিবাহ করিব |”
হরলাল মনে করিয়াছিলেন যে, কৃষ্ণকান্ত ভয়ে ভীত হইয়া, উইল পরিবর্তন করিয়া, হরলালকে অধিক বিষয় লিখিয়া দিবেন। কিন্তু কৃষ্ণকান্তের যে উত্তর পাইলেন, তাহাতে সে ভরসা রহিল না। কৃষ্ণকান্ত লিখিলেন,
“তুমি আমার ত্যাজ্য পুত্র। তোমার যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে বিবাহ করিতে পার। আমার যাহাকে ইচ্ছা তাহাকে বিষয় দিব। তুমি এই বিবাহ করিলে আমি উইল বদলাইব বটে, কিন্তু তাহাতে তোমার অনিষ্ট ব্যতীত ইষ্ট হইবে না |”
ইহার কিছু পরেই হরলাল সংবাদ পাঠাইলেন যে, তিনি বিধবাবিবাহ করিয়াছেন। কৃষ্ণকান্ত রায় আবার উইলখানি ছিঁড়িয়া ফেলিলেন। নতুন উইল করিবেন।
পাড়ায় ব্রহ্মানন্দ ঘোষ নামে একজন নিরীহ ভালমানুষ লোক বাস করিতেন। কৃষ্ণকান্তকে জ্যেঠা মহাশয় বলিতেন। এবং তৎ কর্তৃক অনুগৃহীত এবং প্রতিপালিতও হইতেন।
ব্রহ্মানন্দের হস্তাক্ষর উত্তম। এ সকল লেখাপড়া তাহার দ্বারাই হইত। কৃষ্ণকান্ত সেই দিন ব্রহ্মানন্দকে ডাকিয়া বলিলেন যে, “আহারাদির পর এখানে আসিও। নূতন উইল লিখিয়া দিতে হইবে |”
বিনোদলাল তথায় উপস্থিত ছিলেন। তিনি কহিলেন, “আবার উইল বদলান হইবে কি অভিপ্রায়ে?”
কৃষ্ণকান্ত কহিলেন, “এবার তোমার জ্যেষ্ঠের ভাগে শূন্য পড়িবে |”
বি। ইহা ভাল হয় না। তিনিই যেন অপরাধী। কিন্তু তাঁহার একটি পুত্র আছে–সে শিশু, নিরপরাধী। তাহার উপায় কি হইবে?
কৃ। তাহাকে এক পাই লিখিয়া দিব।
বি। এক পাই বখরায় কি হইবে?
কৃ। আমার আয় দুই লক্ষ টাকা। তাহার এক পাই বখরায় তিন হাজার টাকার উপর হয়। তাহাতে একজন গৃহস্থের গ্রাসাচ্ছাদান অনায়াসে চলিতে পারে। ইহার অধিক দিব না।
বিনোদলাল অনেক বুঝাইলেন, কিন্তু কর্তা কোন মতে মতান্তর করিলেন না।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
ব্রহ্মানন্দ স্নানাহার করিয়া নিদ্রার উদ্যোগে ছিলেন, এমত সময়ে বিস্ময়াপন্ন হইয়া দেখিলেন যে, হরলাল রায়। হরলাল আসিয়া তাহার শিওরে বসিলেন।
ব্র। সে কি, বড় বাবু যে? কখন বাড়ী এলে?
হ। বাড়ী এখনও যাই নাই।
ব্র। একেবারে এইখানেই? কলিকাতা হইতে কতক্ষণ আসিতেছ?
হ। কলিকাতা হইতে দুই দিবস হইল আসিয়াছি। এই দুই দিন কোন স্থানে লুকাইয়া ছিলাম। আবার নাকি নূতন উইল হইবে?
ব্র। এই রকম ত শুনিতেছি।
হ। আমার ভাগে এবার শূন্য?
ব্র। কর্তা এখন রাগ করে তাই বলছেন, কিন্তু সেটা থাকবে না।
হ। আজি বিকালে লেখাপড়া হবে? তুমি লিখিবে?
ব্র। তা কি করবো ভাই! কর্তা বলিলে ত “না” বলিতে পারি না।
হ। ভাল তাতে তোমার দোষ কি? এখন কিছু রোজগার করিবে?
ব্র। কিলটে চড়টা? তা ভাই, মার না কেন?
হ। তা নয়; হাজার টাকা।
ব্র। বিধবা বিয়ে কর্যে নাকি?
হর। তাই।
ব্র। বয়স গেছে।
হ। তবে আর একটি কাজ বলি। এখনই আরম্ভ কর। আগামী কিছু গ্রহণ কর।
এই বলিয়া ব্রহ্মানন্দের হাতে হরলাল পাঁচশত টাকার নোট দিলেন।
ব্রহ্মানন্দ নোট পাইয়া উলটিয়া পালটিয়া দেখিল। বলিল, “ইহা লইয়া আমি কি করিব?”
হ। পূঁজি করিও। দশ টাকা মতি গোয়ালিনীকে দিও।
ব্র। গোওয়ালা-ফোওয়ালার কোন এলাকা রাখি না। কিন্তু আমায় করিতে হইবে কি?
হ। দুইটি কলম কাট। দুইটি যেন ঠিক সমান হয়।
ব্র। আচ্ছা ভাই–যা বল, তাই শুনি।
এই বলিয়া ঘোষজ মহাশয়ের দুইটি নূতন কলম লিয়া ঠিক সমান করিয়া কাটিলেন। এবং লিখিয়া দেখিলেন যে, দুইটিরই লেখা একপ্রকার দেখিতে হয়।
তখন হরলাল বলিলেন, “ইহার একটি কলম বাক্সতে তুলিয়া রাখ। যখন উইল লিখিতে যাইবে, এই কলম লইয়া গিয়া ইহাতে উইল লিখিবে। দ্বিতীয় কলমটি লইয়া এখন একখানা লেখাপড়া করিতে হইবে। তোমার কাছে ভাল কালি আছে?”
ব্রহ্মানন্দ মসীপাত্র বাহির করিয়া লিখিয়া দেখাইলেন। হরলাল বলিতে লাগিল, “ভাল, এই কালি উইল লিখিতে যাইও |”
ব্র। তোমাদিগের বাড়ীতে কি দোওয়াত- কলম নাই যে, আমি ঘাড়ে করিয়া নিয়া যাব?
হ। আমার কোন উদ্দেশ্য আছে–নচেৎ তোমাকে এত টাকা দিলাম কেন?
ব্র। আমিও তাই ভাবিতেছি বটে–ভাল বলেছ ভাই রে!
হর। তুমি দোওয়াত-কলম লইয়া গেলে কেহ ভাবিলেও ভাবিতে পারে, আজি এটা কেন? তুমি সরকারী কালি-কলমকে গালি পাড়িও; তাহা হইলেই শোধরাইবে।
ব্র। তা সরকারী কালি-কলমকে শুধু কেন? সরকারকে শুদ্ধ গালি পাড়িতে পারিব।
হর। তত আবশ্যক নাই। এক্ষণে আসল কর্ম আরম্ভ কর।
তখন হরলাল দুইখানি জেনারেল লেটর কাগজ ব্রহ্মানন্দের হাতে দিলেন। ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, “এ যে সরকারী কাগজ দেখিতে পাই |”
“সরকারী নহে–কিন্তু উকীলের বাড়ীর লেখাপড়া এই কাগজে হইয়া থাকে। কর্তাও এই কাগজে উইল লেখাইয়া থাকেন, জানি। এজন্যে এই কাগজ আমি সংগ্রহ করিয়াছি। যাহা বলি, তাহা এই কালি কলমে লেখ |”
ব্রহ্মানন্দ লিখিতে আরম্ভ করিল। হরলাল একখানি উইল লেখাইয়া দিলেন। তাহার মর্মার্থ এই। কৃষ্ণকান্ত রায় উইল করিতেছেন। তাঁহার নামে যত সম্পত্তি আছে, তাহার বিভাগ কৃষ্ণকান্তের পরলোকান্তে এইরূপ হইবে। যথা, বিনোদলাল তিন আনা, গোবিন্দলাল এক পাই, গৃহিণী এক পাই, শৈলবতী এক পাই, হরলালের পুত্র এক পাই, হরলাল জ্যেষ্ঠ পুত্র বলিয়া অবশিষ্ট বারো আনা।
লেখা হইলে ব্রহ্মানন্দ কহিলেন, “এখন এই উইল লেখা হইল–দস্তখত করে কে?”
“আমি |” বলিয়া হরলাল ঐ উইলে কৃষ্ণকান্ত রায়ের এবং চারি জন সাক্ষীর দস্তখত করিয়া দিলেন।
ব্রহ্মানন্দ কহিলেন, “ভাল, এ ত জাল হইল |”
হর। এই সাঁচ্চা উইল হল, বৈকালে যাহা লিখিবে, সেই জাল।
ব্র। কিসে?
হ। তুমি যখন উইল লিখিতে যাইবে, তখন এই উইলখানি আপনার পিরানের পকেটে লুকাইয়া লইয়া যাইবে। সেখানে গিয়া এই কালি-কলমে তাঁহাদের ইচ্ছামত উইল লিখিবে। কাগজ, কলম, কালি, লেখক একই; সুতরাং দুইখান উইলই দেখিতে একপ্রকার হইবে। পরে উইল পড়িয়া শুনান ও দস্তখত হইয়া গেলে শেষে তুমি স্বাক্ষর করিবার জন্য লইবে। সকলের দিকে পশ্চাৎ ফিরিয়া দস্তখত করিবে। সেই অবকাশে উইলখানি বদলাইয়া লইবে। এইখানি কর্তাকে দিয়া, কর্তার উইলখানি আমাকে আনিয়া দিবে।
ব্রহ্মানন্দ ঘোষ ভাবিতে লাগিল। বলিল, “বলিলে কি হয়–বুদ্ধির খেলটা খেলোছ ভাল |”
হ। ভাবিতেছ কি?
ব্র। ইচ্ছা করে বটে, কিন্তু ভয় করে। তোমার টাকা ফিরাইয়া লও। আমি কিন্তু জালের মধ্যে থাকিব না।
“টাকা দাও |” বলিয়া হরলাল হাত পাতিল। ব্রহ্মানন্দ ঘোষ নোট ফিরাইয়া দিল। নোট লইয়া হরলাল উঠিয়া চলিয়া যাইতেছিল। ব্রহ্মানন্দ তখন আবার তাহাকে ডাকিয়া বলিল, “বলি, ভায়া কি গেলে?”
“না” বলিয়া হরলাল ফিরিল।
ব্র। তুমি এখন পাঁচ শত টাকা দিলে। আর কি দিবে?
হ। তুমি সেই উইলখানা আনিয়া দিলে আর পাঁচ শত দিব।
ব্র। অনেকটা–টাকা–লোভ ছাড়া যায় না।
হ। তবে তুমি রাজি হইলে?
ব্র। রাজি না হইয়াই বা কি করি? কিন্তু বদল করি কি প্রকারে? দেখিতে পাইবে যে।
কৃষ্ণকান্ত রায়ের দুই পুত্র, আর এক কন্যা। জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম হরলাল, কনিষ্ঠের নাম বিনোদলাল, কন্যার নাম শৈলবতী। কৃষ্ণকান্ত এইরূপ উইল করিলেন যে, তাঁহার পরলোকান্তে, গোবিন্দলাল আট আনা, হরলাল ও বিনোদলাল প্রত্যেকে তিন আনা, গৃহিণী এক আনা, আর শৈলবতী এক আনা সম্পত্তিতে অধিকারিণী হইবেন।
হরলাল বড় দুর্দ্দান্ত। পিতার অবাধ্য এবং দুর্মুখ। বাঙ্গালির উইল প্রায় গোপনে থাকে না। উইলের কথা হরলাল জানিতে পারিল। হরলাল, দেখিয়া শুনিয়া ক্রোধে চক্ষু রক্তবর্ণ করিয়া পিতাকে কহিল, “এটা কি হইল? গোবিন্দলাল অর্ধেক ভাগ পাইল, আর আমার তিন আনা ”
কৃষ্ণকান্ত কহিলেন, “ইহা ন্যায্য হইয়াছে। গোবিন্দলালের পিতার প্রাপ্য অর্ধাংশ তাহাকে দিয়াছি |”
হ। গোবিন্দলালের পিতার প্রাপ্যটা কি? আমাদিগের পৈতৃক সম্পত্তি সে লইবার কে? আর মা বহিনকে আমরা প্রতিপালন করিব— তাহাদিগের বা এক এক আনা কেন? বরং তাহাদিগকে কেবল গ্রাসাচ্ছাদনের অধিকারিণী বলিয়া লিখিয়া যান।
কৃষ্ণকান্ত কিছু রুষ্ট হইয়া বলিলেন, “বাপু হরলাল! বিষয় আমার, তোমার নহে। আমার যাহাকে ইচ্ছা, তাহাকে দিয়া যাইব |”
হ। আপনার বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পাইয়াছে –আপনাকে যাহা ইচ্ছা, তাহা করিতে দিব না। কৃষ্ণকান্ত ক্রোধে চক্ষু আরক্ত করিয়া কহিলেন, “হরলাল, তুমি যদি বালক হইতে, তবে আজি তোমাকে গুরু মহাশয় ডাকাইয়া বেত দিতাম |”
হ। কেন দেখিতে পাইবে? আমি তোমার সম্মুখে উইল বদল করিয়া লইতেছি, তুমি দেখ দেখি, টের পাও কি না।
হরলালের অন্য বিদ্যা থাকুক না থাকুক, হস্তকৌশল বিদ্যায় যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষাপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তখন উইলখানি পকেটে রাখিলেন, আর একখানি কাগজ হাতে লইয়া তাহাতে লিখিবার উপক্রম করিলেন। ইত্যবসরে হাতের কাগজ পকেটে, পকেটের কাগজ হাতে কি প্রকারে আসিল, ব্রহ্মানন্দ তাহা কিছুই লক্ষিত করিতে পারিলেন না। ব্রহ্মানন্দ হরলালের হস্তকৌশলের প্রশংসা করিতে লাগিলেন। হরলাল বলিলেন, “এই কৌশলটি তোমায় শিখাইয়া দিব |” এই বলিয়া হরলাল সেই অভ্যস্ত কৌশল ব্রহ্মানন্দকে অভ্যাস করাইতে লাগিলেন।
দুই তিন দণ্ডে ব্রহ্মানন্দের সেই কৌশলটি অভ্যস্ত হইল। তখন হরলাল কহিল যে, “আমি এক্ষণে চলিলাম। সন্ধ্যার পর বাকি টাকা লইয়া আসিব |” বলিয়া সে বিদায় লইল।
হরলাল চলিয়া গেলে ব্রহ্মানন্দের বিষম ভয় সঞ্চার হইল। তিনি দেখিলেন যে, তিনি কার্যে স্বীকৃত হইয়াছেন, তাহা রাজদ্বারে মহা দণ্ডার্হ অপরাধ–কি জানি, ভবিষ্যতে পাছে তাঁহাকে যাবজ্জীবন কারারুদ্ধ হইতে হয়। আবার বদলের সময় যদি কেহ ধরিয়া ফেলে? তবে তিনি এ কার্য কেন করেন? না করিলে হস্তগত সহস্র মুদ্রা ত্যাগ করিতে হয়। তাহাও হয় না। প্রাণ থাকিতে নয়।
হায়! ফলাহার! কত দরিদ্র ব্রাহ্মণকে তুমি মর্মান্তিক পীড়া দিয়াছ! এ দিকে সংক্রামক জ্বর, প্লীহায় উদর পরিপূর্ণ, তাহার উপর ফলাহার উপস্থিত! তখন কাংস্যপাত্র বা কদলীপত্রে সুশোভিত লুচি, সন্দেশ, মিহিদানা, সীতাভোগ প্রভৃতির অমলধবল শোভা সন্দর্শন করিয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণ কি করিবে? ত্যাগ করিবে, না আহার করিবে? আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি যে, ব্রাহ্মণ ঠাকুর যদি সহস্র বৎসর সেই সজ্জিত পাত্রের নিকট বসিয়া তর্কবিতর্ক করেন, তথাপি তিনি এ কূট প্রশ্নের মীমাংসা করিতে পারিবেন না–এবং মীমাংসা করিতে না পারিয়া–অন্যমনে পরদ্রব্যগুলি উদরসাৎ করিবেন।
ব্রহ্মানন্দ ঘোষ মহাশয়ের ঠিক তাই হইল। হরলালের টাকা হজম করা ভার–জেলখানার ভয় আছে; কিন্তু ত্যাগ করাও যায় না। লোভ বড়, কিন্তু বদহজমের ভয়ও বড়। ব্রহ্মানন্দ মীমাংসা করিতে পারিল না। মীমাংসা করিতে না পারিয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণের মত উদরসাৎ করিবার দিকেই মন রাখিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
সন্ধ্যার পর ব্রহ্মানন্দের উইল লিখিয়া ফিরিয়া আসিলেন। দেখিলেন যে, হরলাল আসিয়া বসিয়া আছেন। হরলাল জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি হইল?”
ব্রহ্মানন্দ একটু কবিতাপ্রিয়। তিনি কষ্টে হাসিয়া বলিলেন,
“মনে করি চাঁদা ধরি হাতে দিই পেড়ে।
বাবলা গাছে হাত লেগে আঙ্গুল গেল ছিঁড়ে |”
হ। পার নাই নাকি?
ব্র। ভাই, কেমন বাধ বাধ ঠেকিতে লাগিল।
হ। পার নাই?
ব্র। না ভাই–এই ভাই, তোমার জাল উইল নাও। এই তোমার টাকা নাও।
এই বলিয়া ব্রহ্মানন্দ কৃত্রিম উইল ও বাক্স হইতে পাঁচ শত টাকার নোট বাহির করিয়া দিলেন। ক্রোধে এবং বিরক্তিতে হরলালের চক্ষু আরক্ত এবং অধর কম্পিত হইল। বলিলেন, “মূর্খ, অকর্মা! স্ত্রীলোকের কাজটাও তোমা হইতে হইল না? আমি চলিলাম। কিন্তু দেখিও, যদি তোমা হইতে এই কথার বাষ্প মাত্র প্রকাশ পায়, তবে তোমার জীবন সংশয় |”
ব্রহ্মানন্দ বলিলেন, “সে ভাবনা করিও না; কথা আমার নিকট হইতে প্রকাশ পাইবে না |”
সেখান হইতে উঠিয়া হরলাল ব্রহ্মানন্দের পাকশালায় গেলেন। হরলাল ঘরের ছেলে, সর্বত্র গমনাগমন করিতে পারেন। পাকশালায় ব্রহ্মানন্দের ভ্রাতৃকন্যা রোহিণী রাঁধিতেছিল।
এই রোহিণীতে আমার বিশেষ কিছু প্রয়োজন আছে। অতএব রূপ গুণ কিছু বলিতে হয়, কিন্তু আজি কালি রূপ বর্ণনার বাজার নরম–আর গুণ বর্ণনার–হাল আইনে আপনার ভিন্ন পরের করিতে নাই। তবে ইহা বলিলে হয় যে, রোহিণীর যৌবন পরিপূর্ণ–রূপ উছলিয়া পড়িতেছিল–শরতের চন্দ্র ষোল কলায় পরিপূর্ণ। সে অল্প বয়সে বিধবা হইয়াছিল, কিন্তু বৈধব্যের অনুপযোগী অনেকগুলি দোষ তাহার ছিল। দোষ, সে কালা পেড়ে ধুতি পরিত, হাতে চুড়ি পরিত, পানও বুঝি খাইত। এ দিকে রন্ধনে সে দ্রৌপদীবিশেষ বলিলে হয়; ঝোল, অম্ল, চড়চড়ি, সড়সড়ি, ঘণ্ট, দালনা ইত্যাদিতে সিদ্ধহস্ত; আবার আলেপনা, খয়েরের গহনা, ফুলের খেলনা, সূচের কাজে তুলনারহিত। চুল বাঁধিতে, কন্যা সাজাইতে পাড়ার একমাত্র অবলম্বন। তাহার আর কেহ সহায় ছিল না বলিয়া ব্রহ্মানন্দের বাটীতে থাকিত।
রোহিণী রূপসী ঠন্ ঠন্ করিয়া দালের হাঁড়িতে কাটি দিতেছিল, দূরে একটা বিড়াল থাবা পাতিয়া বসিয়া ছিল; পশুজাতি রমণীদিগের বিদ্যুদ্দাম কটাক্ষে শিহরে কি না, দেখিবার জন্য রোহিণী তাহার উপরে মধ্যে মধ্যে বিষপূর্ণ মধুর কটাক্ষ করিতেছিল; বিড়াল সে মধুর কটাক্ষকে ভর্জিত মৎস্যাহারের নিমন্ত্রণ মনে করিয়া অল্পে অল্পে অগ্রসর হইতেছিল, এমত সময়ে হরলাল বাবু জুতা সমেত মস্ মস্ করিয়া ঘরের ভিতর প্রবেশ করিলেন। বিড়াল, ভীত হইয়া, ভর্জ্জিত মৎস্যের লোভ পরিত্যাগপূর্বক পলায়নে তৎপর হইল; রোহিণী দালের কাটি ফেলিয়া দিয়া, হাত ধুইয়া, মাথায় কাপড় উঠিয়া দাঁড়াইল। নখে নখ খুঁটিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বড় কাকা, কবে এলেন?”
হরলাল বলিল, “কাল এসেছি। তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে |”
রোহিণী শিহরিল; বলিল, “আজি এখানে খাবেন? সরু চালের ভাত চড়াব কি?”
হ। চড়াও চড়াও। কিন্তু সে কথা নয়। তোমার এক দিনের কথা মনে পড়ে কি?
রোহিণী চুপ করিয়া মাটি পানে চাহিয়া রহিল। হরলাল বলিল, “সেই দিন যে দিন তুমি গঙ্গাস্নান করিয়া আসিতে, যাত্রীদিগের দলছাড়া হইয়া পিছাইয়া পড়িয়াছিলে? মনে পড়ে?”
রো। (বাঁ হাতের চারিটি আঙ্গুল দাইন হাতে ধরিয়া অধোবদনে) মনে পড়ে।
হ। যে দিন তুমি পথ হারাইয়া মাঠে পড়িয়াছিলে, মনে পড়ে?
রো। পড়ে।
হ। যে দিন মাঠে তোমার রাত্রি হইল, তুমি একা; জনকত বদমাস তোমার সঙ্গ নিল– মনে পড়ে?
রো। পড়ে।
হ। সে দিন কে তোমায় রক্ষা করিয়াছিল?
রো। তুমি। তুমি ঘোড়ার উপরে সেই মাঠ দিয়া কোথায় যাইতেছিলে–
হ। শালীর বাড়ী।
রো। তুমি দেখিতে পাইয়া আমায় রক্ষা করিলে–আমায় পাল্কী বেহারা করিয়া বাড়ী পাঠাইয়া দিলে। মনে পড়ে বই কি। সে ঋণ আমি কখনও পরিশোধ করিতে পারিব না।
হ। আজ সে ঋণ পরিশোধ করিতে পার–তার উপর আমায় জন্মের মত কিনিয়া রাখিতে পার, করিবে?
রো। কি বলুন–আমি প্রাণ দিয়াও আপনার উপকার করিব।
হ। কর না কর, এ কথা কাহারও সাক্ষাতে প্রকাশ করিও না।
রো। প্রাণ থাকিতে নয়।
হ। দিব্য কর।
রোহিণী দিব্য করিল।
তখন হরলাল কৃষ্ণকান্তের উইল ও জাল উইলের কথা বুঝাইয়া বলিল। শেষে বলিল, “সেই আসল উইল চুরি করিয়া, জাল উইল তাহার বদলে রাখিয়া আসিতে হইবে। আমাদের বাড়ীতে তোমার যাতায়াত আছে। তুমি বুদ্ধিমতী, তুমি অনায়াসে পার। আমার জন্য ইহা করিবে?”
রোহিণী শিহরিল। বলিল, “চুরি! আমাকে কাটিয়া ফেলিলেও আমি পারিব না |”
হ। স্ত্রীলোক এমন অসারই বটে–কথার রাশি মাত্র। এই বুঝি এ জন্মে তুমি আমার ঋণ পরিশোধ করিতে পারিবে না!
রো। আর যা বলুন, সব পারিব। মরিতে বলেন, মরিব। কিন্তু এ বিশ্বাসঘাতকের কাজ পারিব না।
হরলাল কিছুতেই রোহিণীকে সম্মত করিতে না পারিয়া, সেই হাজার টাকার নোট রোহিণীর হাতে দিতে গেল। বলিল, “এই হাজার টাকা পুরস্কার আগাম নাও। এ কাজ তোমার করিতে হইবে|”
রোহিণী নোট লইল না। বলিল, “টাকার প্রত্যাশা করি না। কর্তার সমস্ত বিষয় দিলেও পারিব না। করিবার হইত ত আপনার কথাতেই করিতাম | ”
হরলাল দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল, বলিল, “মনে করিয়াছিলাম, রোহিণী, তুমি আমার হিতৈষী। পর কখনও আপন হয়? দেখ, আজ যদি আমার স্ত্রী থাকিত, আমি তোমার খোশামোদ করিতাম না। সেই আমার এ কাজ করিত |”
এবার রোহিণী একটু হাসিল। হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “হাসিলে যে?”
রো। আপনার স্ত্রীর নামে সেই বিধবাবিবাহের কথা মনে পড়িল। আপনি না কি বিধবাবিবাহ করিবেন?
হ। ইচ্ছা ত আছে–কিন্তু মনের মত বিধবা পাই কই?
রো। তা বিধবাই হৌক, সধবাই হৌক–বলি বিধবাই হৌক, কুমারীই হৌক–একটা বিবাহ করিয়া সংসারী হইলেই ভাল হয়। আমরা আত্মীয়স্বজন সকলেরই তাহলে আহ্লাদ হয়।
হ। দেখ, রোহিণী, বিধবাবিবাহ শাস্ত্রসম্মত।
রো। তা ত এখন লোকে বলিতেছে।
হ। দেখ, তুমিও একটি বিবাহ করিতে পার— কেন করিবে না?
রোহিণী মাথার কাপড় একটু টানিয়া মুখ ফিরাইল। হরলাল বলিতে লাগিল,–“দেখ তোমাদের সঙ্গে আমাদের গ্রাম সুবাদ মাত্র–সম্পর্কে বাধে না |”
এবার রোহিণী লম্বা করিয়া মাথার কাপড় টানিয়া দিয়া, উনুন গোড়ায় বসিয়া যান, দালে কাটি দিতে আরম্ভ করিল। দেখিযা বিষণ্ণ হইয়া হরলাল ফিরিয়া চলিল।
হরলাল দ্বার পর্যন্ত গেলে, রোহিণী বলিল, “কাগজখানা না হয় রাখিয়া যান, দেখি, কি করিতে পারি |”
হরলাল আহ্লাদিত হইয়া জাল উইল ও নোট রোহিণীর নিকটে রাখিল। দেখিয়া রোহিণী বলিল, “নোট না। শুধু উইলখানা রাখুন |”
হরলাল তখন জাল উইল রাখিয়া নোট লইয়া গেল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঐ দিবস রাত্রি আটটার সময়ে কৃষ্ণকান্ত রায় আপন শয়নমন্দিরে পর্যঙ্কে বসিয়া উপাধানে পৃষ্ঠ রক্ষা করিয়া, সটকায় তামাক টানিতেছিলেন এবং সংসারে একমাত্র ঔষধ–মাদকমধ্যে শ্রেষ্ঠ–অহিফেন ওরফে আফিমের নেশায় মিঠে রকম ঝিমাইতেছিলেন। যেন হরলাল তিন টাকা তের আনা দু কড়া দু ক্রান্তি মূল্যে তাঁহার সমুদয় সম্পত্তি কিনিয়া লইয়াছে। আবার যেন কে বলিয়া দিল যে, না, এ দানপত্র নহে, এ তমসুক। তখনই যেন দেখলেন যে, ব্রহ্মার বেটা বিষ্ণু আসিয়া বৃষভারূঢ় মহাদেবের কাছে এক কৌটা আফিম কর্জ লইয়া, এই দলিল লিখিয়া দিয়া, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বন্ধক রাখিয়াছেন–মহাদেব গাঁজার ঝোঁকে ফোরক্লোজ করিতে ভুলিয়া গিয়াছেন। এমত সময়ে, রোহিণী ধীরে ধীরে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা কি ঘুমাইয়াছ?”
কৃষ্ণকান্ত ঝিমাইতে ঝিমাইতে কহিলেন, “কে নন্দী? ঠাকুরকে এই বেলা ফোরক্লোজ করিতে বল |”
রোহিণী বুঝিল যে, কৃষ্ণকান্তের আফিমের আমল হইয়াছে। হাসিয়া বলিল, “ঠাকুরদাদা, নন্দী কে?”
কৃষ্ণকান্ত ঘাড় না তুলিয়া বলিলেন, “হুম্ ঠিক বলেছ। বৃন্দাবনে গোয়ালাবাড়ী মাখন খেয়েছে–আজও তার কড়ি দেয় নাই|”
রোহিণী খিল্ খিল্ করিয়া হাসিয়া উঠিল। তখন কৃষ্ণকান্তের চমক হইল, মাথা তুলিয়া দেখিয়া বলিলেন, “কে ও, অশ্বিনী ভরণী কৃত্তিকা রোহিণী?”
রোহিণী উত্তর করিল, “মৃগশিরা আর্দ্রা পুনর্বসু পুষ্যা |”
কৃষ্ণ। অশ্লেষা মঘা পূর্বফাল্গুনী।
রো। ঠাকুরদাদা, আমি কি তোমার কাছে জ্যোতিষ শিখতে এয়েছি!
কৃষ্ণ। তাই ত! তবে কি মনে করিয়া? আফিঙ্গ চাই না ত?
রো। যে সামগ্রী প্রাণ ধর্যে দিতে পারবে না, তার জন্যে কি আমি এসেছি! আমাকে কাকা পাঠিয়ে দিয়েছেন, তাই এসেছি।
কৃ। এই এই। তবে আফিঙ্গের জন্য!
রো। না, ঠাকুরদাদা না। তোমার দিব্য, আফিঙ্গ চাই না। কাকা বললেন যে, যে উইল আজ লেখাপড়া আছে, তাতে তোমার দস্তখত হয় নাই।
কৃ। সে কি! আমার বেশ মনে পড়িতেছে যে, আমি দস্তখত করিয়াছি।
রো। না, কাকা কহিলেন যে, তাঁহার যেন স্মরণ হচ্ছে, তুমি তাতে দস্তখত কর নাই; ভাল সন্দেহ রাখায় দরকার কি? তুমি কেন সেখানা খুলে একবার দেখ না।
কৃ। বটে–তবে আলোটা ধর দেখি।
বলিয়া কৃষ্ণকান্ত উঠিয়া উপাধানের নিম্ন হইতে চাবি লইলেন। রোহিণী নিকটস্থ দীপ হস্তে লইল। কৃষ্ণকান্ত প্রথমে একটি ক্ষুদ্র হাতবাক্স খুলিয়া একটি বিচিত্র চাবি লইয়া, পরে একটা
চেষ্টড্রয়ারের একটি দেরাজ খুলিলেন এবং অনুসন্ধান করিয়া ঐ উইল বাহির করিলেন।পরে বাক্স হইতে চশমা বাহির করিয়া নাসিকার উপর সংস্হাপনের উদ্যোগ দেখিতে লাগিলেন। কিন্তু চশমা লাগাইতে লাগাইতে দুই চারি বার আফিঙ্গের ঝিমকিনি আসিল–সুতরাং তাহাতে কিছুকাল বিলম্ব হইল। পরিশেষে চশমা সুস্থির হইলে কৃষ্ণকান্ত উইলে নেত্রপাত করিয়া দেখিয়া হাস্য করিয়া বলিলেন, “রোহিণিী আমি কি বুড় হইয়া বিহ্বল হইয়াছি? এই দেখ, আমার দস্তখত |
রোহিণী বলিল, “বালাই, বুড়ো হবে কেন? আমাদের কেবল জোর করিয়া নাতিনী বল বই ত না। তা ভাল, আমি এখন যাই, কাকাকে বলি গিয়া |”
রোহিণী তখন কৃষ্ণকান্তের শয়নমন্দির হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।
গভীর নিশাতে কৃষ্ণকান্ত নিদ্রা যাইতেছিলেন, অকস্মাৎ নিদ্রাভঙ্গ হইল। নিদ্রাভঙ্গ হইলে দেখিলেন যে, তাঁহার শয়নগৃহে দীপ জ্বলিতেছে না। সচরাচর সমস্ত রাত্রি দীপ জ্বলিত, কিন্তু সে রাত্রে দীপ নির্বণ হইয়াছে দেখিলেন, নিদ্রাভঙ্গকালে এমতও শব্দ তাঁহার কর্ণে প্রবেশ করিল যে, যেন কে একটা চাবি কলে ফিরাইল। এমত বোধ হইল, যেন ঘরে কে মানুষ বেড়াইতেছে। মানুষ তাঁর পর্যঙ্কের শিরোদেশ পর্যন্ত আসিল–তাঁহার বালিশে হাত দিল। কৃষ্ণকান্ত আফিঙ্গের নেশায় বিভোর; না নিদ্রিত, না জাগরিত, বড় কিছু হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিলেন না। ঘরে যে আলো নাই–তাহাও ঠিক বুঝেন নাই, কখন অর্ধনিদ্রিত–কখন অর্ধসচেতন–সচেতনও চক্ষু খুলে না। একবার দৈবাৎ চক্ষু খুলিবায় কতকটা অন্ধকার বোধ হইল বটে, কিন্তু কৃষ্ণকান্ত তখন মনে করিতেছিলেন যে, তিনি হরি ঘোষের মোকদ্দামায় জাল দলিল দাখিল করায়, জেলখানায় গিয়াছেন।জেলখানা ঘোরান্ধকার। কিছু পরে হঠাৎ যেন চাবি খোলার শব্দ অল্প কানে গেল–এ কি জেলের চাবি পড়িল? হঠাৎ একটু চমক হইল। কৃষ্ণকান্ত সটকা হাতড়াইলেন, পাইলেন না–অভ্যাসবশতঃ ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত অন্তঃপুরে শয়ন করিতেন না–বহির্বাটীতেও শয়ন করিতেন না। উভয়ের মধ্যে একটি ঘর ছিল। সেই ঘরে শয়ন করিতেন। সেখানে হরি নামক একজন খানসামা তাঁহার প্রহরী স্বরূপ শয়ন করিত। আর কেহ না। কৃষ্ণকান্ত তাহাকেই ডাকিলেন, “হরি!”
কৃষ্ণকান্ত বারেক মাত্র হরিকে ডাকিয়া, আবার আফিমে ভোর হইয়া ঝিমাইতে লাগিলেন। আসল উইল, তাঁহার গৃহ হইতে সেই অবসরে অন্তর্হিত হইল। জাল উইল তৎপরিবর্তে স্থাপিত হইল।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
পরদিন প্রাতে রোহিণী আবার রাঁধিতে বসিয়াছে, আবার সেখানে হরলাল উঁকি মারিতেছে। ভাগ্যশঃ ব্রহ্মানন্দ বাড়ী ছিল না–নহিলে কি একটা মনে করিতে পারিত।
হরলাল ধীরে ধীরে রোহিণীর কাছে গেল–রোহিণী বড় চাহিয়া দেখে না। হরলাল বলিল, “চাহিয়া দেখ, হাঁড়ি ফাটিবে না |”
রোহিণী চাহিয়া দেখিয়া হাসিল। হরলাল বলিল, “কি করিয়াছ?”
রোহিণী অপহৃত উইল আনিয়া হরলালকে দেখিতে দিল। হরলাল পড়িয়া দেখিল–আসল উইল বটে। তখন সে দুষ্টের মুখে হাসি ধরে না। উইল হাতে করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কি প্রকারে আনিলে?”
রোহিণী সে গল্প আরম্ভ করিল। প্রকৃত কিছুই বলিল না। একটি মিথ্যা উপন্যাস বলিতে লাগিল–বলিতে বলিতে সে হরলালের হাত হইতে উইলখানি লইয়া দেখাইল, কি প্রকারে কাগজখানা একটা কলমদানের ভিতর পড়িয়া ছিল। উইল চুরির কথা শেষ হইলে রোহিণী হঠাৎ উইলখানা হাতে করিয়া উঠিয়া গেল। যখন সে ফিরিয়া আসিল, তখন তাহার হাতে উইল নাই দেখিয়া হরলাল জিজ্ঞাসা করিল, “উইল কোথায় রাখিয়া আসিলে?”
রো। তুলিয়া রাখিয়া আসিয়াছি।
হ। আর তুলিয়া রাখিয়া কি হইবে? আমি এখনই যাইব।
রো। এখনই যাবে? এত তাড়াতাড়ি কেন?
হ। আমার থাকিবার যো নাই।
রো। তা যাও।
হ। উইল?
রো। আমার কাছে থাক।
হ। সে কি? উইল আমায় দিবে না?
রো। তোমার কাছে থাকাও যে, আমার কাছে থাকাও সে।
হ। যদি আমাকে উইল দিবে না, তবে ইহা চুরি করিলে কেন?
রো। আপনারই জন্য। আপনারই জন্য ইহা রহিল। যখন আপনি বিধবাবিবাহ করিবেন, আপনার স্ত্রীকে এ উইল দিব। আপনি লইয়া ছিঁড়িয়া ফেলিবেন।
হরলাল বুঝিল, বলিল, “তা হবে না–রোহিণী! টাকা যাহা চাও, দিব |”
রো। লক্ষ টাকা দিলেও নয়। যাহা দিবে বলিয়াছিলে, তাই চাই।
হ। তা হয় না। আমি জাল করি, চুরি করি, আপনারই হকের জন্য। তুমি চুরি করিয়াছ, কার হকের জন্য?
রোহিণীর মুখ শুকাইল। রোহিণী অধোবদনে রহিল। হরলাল বলিতে লাগিল, “আমি যাই হই–কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র। যে চুরি করিয়াছে, তাহাকে কখনও গৃহিণী করিতে পারিব না |”
রোহিণী সহসা দাঁড়াইয়া উঠিয়া, মাথার কাপড় উঁচু করিয়া তুলিয়া, হরলালের মুখপানে চাহিল; বলিল, “আমি চোর! তুমি সাধু! কে আমাকে চুরি করিতে বলিয়াছিল? কে আমাকে বড় লোভ দেখাইল? সরলা স্ত্রীলোক দেখিয়া কে প্রবঞ্চনা করিল? যে শঠতার চেয়ে আর শঠতা নাই, যে মিথ্যার চেয়ে আর মিথ্যা নাই, যা ইতরে বর্বরে মুখেও আনিতে পারে না, তুমি কৃষ্ণকান্ত রায়ের পুত্র হইয়া তাই করিলে? হায়! হায়! আমি তোমার অযোগ্য? তোমার মত নীচ শঠকে গ্রহণ করে, এমন হতভাগী কেহ নাই। তুমি যদি মেয়ে মানুষ হইতে, তোমাকে আজ, যা দিয়া ঘর ঝাঁট দিই, তাই দেখাইতাম। তুমি পুরুষ মানুষ, মানে মানে দূর হও |”
হরলাল বুঝিল, উপযুক্ত হইয়াছে। মানে মানে বিদায় হইল–যাইবার সময় একটু টিপি টিপি হাসিয়া গেল। রোহিণীও বুঝিল যে, উপযুক্ত হইয়াছে–উভয় পক্ষে। সেও খোঁপাটা একটু আঁটিয়া নিয়া রাঁধিতে বসিল। রাগে খোঁপাটা খুলিয়া গিয়াছিল। তার চোখে জল আসিতেছিল।