জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা বেশ পরিষ্কার
জঙ্গলের মধ্যে এই জায়গাটা বেশ পরিষ্কার। প্রায় চৌকোমতন জায়গাটাতে শুধু ঘাস হয়ে আছে, অনায়াসেই একটা ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটা যায়। অনেক গভীর জঙ্গলের মধ্যেই হঠাৎ-হঠাৎ এরকম এক-একটা ফাঁকা জায়গা থাকে। কেন যে এখানে বড় গাছ জন্মায় না তা কে জানে!
সেই জায়গাটার এককোণে একটা গোল পাথরের ওপর বসে আছেন কাকাবাবু। প্রচণ্ড রোদ বলে তাঁর মাথায় একটা টুপি। তাঁর পা দুটো সামনের দিকে ছড়ানো, ডান হাতে আলগা করে ধরে আছেন রিভলভার।
সন্তু দাঁড়িয়ে আছে কাকাবাবুর পেছনদিকে। তার মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় সে খুব ভয় পেয়েছে। বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও সে বেশি ভয় পায় সাপকে। সাপটা রয়েছে ফাঁকা জায়গাটার প্রায় মাঝখানে, কালো রঙের গা, প্রায় দু হাত লম্বা, খুব আস্তে-আস্তে সেটা পাথরটার দিকেই এগোচ্ছে আর এদিক-ওদিক মাথা ঘুরিয়ে মাটিতে কী যেন খুঁজছে।
সন্তু প্রায় কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কাকাবাবু, মারো! ওটাকে মাররা!
কাকাবাবু যেন সন্তুকে ভয় পাওয়াবার জন্যই মজা করে বললেন, আর একটু কাছে আসতে দে না!
সন্তু বলল, যদি সড়াৎ করে দৌড়ে চলে আসে!
কাকাবাবু বললেন, সাপকে, কখনও দৌড়তে দেখেছিস? আমি তো দেখিনি!
সন্তু বলল, লাফিয়ে উঠতে পারে! পারে না?
কাকাবাবু বললেন, তা পারে। কিন্তু সাপটা এখন হাই জাম্প দেওয়ার মেজাজে আছে বলে তো মনে হচ্ছে না! ও বোধ হয় আমাদের দেখতেই পায়নি!
সন্তু বলল, ওই যে, ওই যে মাথা তুলছে!
কাকাবাবু বললেন, হুঁ, বিষাক্ত সাপই বটে। বেশ বড় ফণা। তবে সাপ দেখলেই যে সেটাকে মেরে ফেলতে হবে তার কোনও মানে নেই। ও বেচারারা নিরীহ প্রাণী, সাধারণত মানুষের কোনও ক্ষতি করে না।
রিভলভারটা তুললেন কাকাবাবু। সাপটার দিকে চেয়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপর বললেন, আগে সাপ দেখলেই আমার খুব ঘেন্না করত। পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে কম সাপ তো দেখিনি! যখন বয়েস কম ছিল, তখন সাপ দেখলেই মেরে ফেলতাম। এখন একটু মায়া-দয়া বেড়ে গেছে রে! এখন মনে হয়, ও যদি আমাদের ক্ষতি না করে তা হলে শুধু-শুধু মেরে কী হবে?
সন্তু বলল, আমরা ওইদিকে যাব কী করে?
কাকাবাবু বললেন,তুই একটু নাচতে পারবি?
সন্তু কোনও উত্তর দিল না বলে কাকাবাবু হেসে বললেন, সার্প তাড়াবার সবচেয়ে ভাল উপায়টা জানিস না বুঝি? যখন দেরাদুনে থাকতাম, তখন আমাদের ওখানকার বাড়ির বাগানে প্রায়ই সাপ আসত। আমার এক সহকর্মী আমার সঙ্গে থাকতেন, তাঁর নাম ফজলে রব্বি। সেই রব্বিসাহেব রোজ ভোরবেলা বাগানের ফুল গাছগুলোতে জল দিতে যেতেন পায়ে ঘুঙুর বেঁধে। হাতে জলের ঝারি নিয়ে তিনি নেচে-নেচে গান গাইতেন। সেইজন্যই…
সন্তু কাকাবাবুর কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, রিভলভারটা আমায় দাও, আমি গুলি করব।
কাকাবাবু বললেন, আগে নাচ শুরু কর না! দ্যাখ তাতে কী ফল হয়। আমি গান গাইছি, তুই নাচবি! এক দুই তিন! মম চিত্তে নিতি নিত্যে কে গো নাচে, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ, তাতা থৈ থৈ!
সন্তু বাধ্য হয়ে ধুপধাপ করে নাচ শুরু করতেই সাপটা ফণা মেলে অনেকখানি সোজা হয়ে উঠল। কাকাবাবুর থেকে তার দূরত্ব বড়জোর দশ বারো হাত। সে মুখ ঘুরিয়ে এদিকে দেখল, চিড়িক-চিড়িক করে দুবার বেরিয়ে এল তার জিভ।
সন্তুর বুকখানা ভয়ে হিম হয়ে গেছে। সে এবার পেছন ফিরে পালাবার চেষ্টা করতেই কাকাবাবু তার হাত চেপে ধরে বললেন, থামলি কেন! বেশ তো হচ্ছে। আরও জোরে নাচ, আরও জোরে!
কাকাবাবু গানটাও জোরে-জোরে গাইতে লাগলেন।
সাপটা এবার ফণাটা নামিয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে উলটোদিকে চলে যেতে লাগল সরসর করে। স্পষ্ট বোঝা গেল সেটা ভয় পেয়ে পালাচ্ছে।
কাকাবাবু উল্লাসের সঙ্গে বললেন, দেখলি, নাচ আর গান দিয়ে কীরকম সাপকে জব্দ করা যায়? রব্বিসাহেব ঘুঙুর পরে নেচে-নেচে সাপ তাড়াতেন। তাঁরকাছে আমি এটা শিখেছি।
সন্তু বলল, আমি জানি, সাপ কানে শুনতে পায় না। মাটিতে পায়ের। আওয়াজ করলে সেই ভাইব্রেশন ওরা টের পায়। কিন্তু টের পেলেই কি পালায়? অনেক সময় মানুষকে তো কামড়ে দেয়!
কাকাবাবু বললেন, সে একেবারে কাছাকাছি গিয়ে পড়লে কিংবা ওদের গায়ে পা লাগলে ওরা ভয়ের চোট কামড়ে দেয়। নিজে থেকে তেড়ে গিয়ে কামড়ায় না।
সাপটা ঘাসের মধ্যে মিশে গেলেও একটু-একটু দেখা যাচ্ছে। সেটা এঁকেবেঁকে চলে যাচ্ছে সন্তুদের ঠিক উলটোদিকে।
সন্তু অসন্তুষ্টভাবে বলল, তুমি ওটাকে মারলে না। ওটা তো আশপাশেই রয়ে যাবে। সন্ধের পর যদি ওর গায়ে পা লেগে যায়?
কাকাবাবু বললেন, ওটাকে মারলেই তো পৃথিবীর সব সাপ শেষ হয়ে যাবে। এখানেও নিশ্চয়ই আরও আছে। আমাদের একটু সাবধানে পা ফেলতে হবে সন্ধের পর।
আকাশে জ্বলজ্বল করছে সূর্য। এরই মধ্যে পশ্চিমদিক থেকে একখণ্ড মেঘ ভাসতে-ভাসতে আসছে। এখানে মেঘ অনেক নিচু দিয়ে আসে। একখানা মেঘের তলায় আর-একটা মেঘ স্পষ্ট দেখা যায়।
এই মেঘটা সূর্যকে ঢেকে দিতেই গরম অনেক কমে গেল। হাওয়া বইতে লাগল ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা। একটু আগে রীতিমতন গরম ছিল, রোদ ঝাঁ ঝাঁ করছিল, আবার একটু পরেই শীতে কাঁপুনি ধরলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
কাকাবাবু রিভলভারটা পকেটে ভরে মাথা থেকে টুপিটা খুললেন। রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে বললেন, বৃষ্টি হবে নাকি রে?
সন্তু আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, হতে পারে।
কাকাবাবু বললেন, আসুক বৃষ্টি। একটু না হয় ভেজা যাবে। ওই দ্যাখ, ওই দ্যাখ সন্তু, যেখানে সাপটা ছিল, সেখানে কতগুলো পাখি এসে বসল। প্রকৃতির এই এক মজা! একটু আগে যেখানে ছিল বিষাক্ত সাপ, এখন সেখানে কতকগুলো সুন্দর পাখি! ওগুলো কী পাখি বল তো?
সন্তু সেগুলোর দিকে একপলক তাকিয়েই বলল, চড়াই পাখি!
কাকাবাবু বললেন, তুই একদম পাখি চিনিস না। চড়াই পাখি অত ছোট হয় নাকি?
সন্তু বলল, বাচ্চা চড়াই ছোট হবে না? ওগুলো বাচ্চা!
কাকাবাবু বললেন, ওদের গায়ের রংও আলাদা। ওগুলো হচ্ছে মুনিয়া। এইসব পাহাড়ি জঙ্গলে অনেক মুনিয়া পাখির ঝাঁক দেখতে পাওয়া যায়।
তারপর একটু হেসে কাকাবাবু আবার বললেন, কিংবা, তুই কি বলতে চাস, কেউ চড়াই পাখির বাচ্চাদের গায়ে রং করে ছেড়ে দিয়েছে?
সন্তু প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারল না। এই জঙ্গলে কে আবার চড়াই পাখির বাচ্চা ধরে-ধরে রং করবে? সন্তু সেরকম কথা ভাবতে যাবেই বা কেন?
কাকাবাবু বললেন, এই নিয়ে একটা গল্প আছে। মুনিয়া অনেকরকম হয়। এক জাতের মুনিয়াকে বলে ক্যানারি। তারা সুন্দর শিস দেয়, গানের মতন শোনায়। অনেকটা দোয়েল পাখির মতন। সাহেব-মেমরা খুব ক্যানারি পাখি পোষে। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে, যখন ইউরোপ-আমেরিকার লোকেরা জাহাজেই বেশি যাতায়াত করত, প্লেনের চল হয়নি, তখন অনেক সুন্দর বন্দরে এই ক্যানারি পাখি পাওয়া যেত। বন্দরের ঘাটে জাহাজ লাগলে স্থানীয় লোকেরা নৌকো করে এসে নানারকম জিনিস বিক্রি করত, তার মধ্যে ক্যানারি পাখিও থাকত। এডেন বন্দরে খুব ক্যানারি পাখি পাওয়া যেত।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এডেন, না আডেন?
কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবারে, আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে কিছু ভুল বলবার উপায় নেই। তোরা অনেক কিছু জানিস। হ্যাঁ, আসল উচ্চারণটা আডেন ঠিকই, বাংলায় আমরা বরাবর এডেনই বলেছি। তুই ক্যানারির গল্পটা জানিস নাকি?
সন্তু বলল, না। সেটা বলো!
কাকাবাবু বললেন, সেই বন্দরে ক্যানারি পাখির খুব ডিমান্ড ছিল। সব বিক্রি হয়ে যেত। সেইজন্য ভেজালও চলত খুব। কেউ-কেউ চড়াই পাখির বাচ্চার গায়ে রং করে ক্যানারি পাখি বলে চালিয়ে দিত। একবার একজন লোক জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে খুব দরাদরি করে খাঁচাছু একটা ক্যানারি পাখি কিনল। দাম ঠিক হল এক পাউন্ড। নৌকো থেকে খাঁচাটা তুলে দেওয়া হল জাহাজে। আর সাহেবটি একটা পাউন্ডের কয়েন ছুঁড়ে দিল দোকানির হাতে। তারপর জাহাজ যখন ছেড়ে দিল, সাহেব-খদ্দেরটি দোকানিকে আর ধরতে পারবে না, তখন দোকানি চেঁচিয়ে বলল, ও মিস্টার, দ্যাট ক্যানারি উইল নেভার সিংগ। সাহেব খদ্দেরটিও চোখ টিপে বলল, অ্যান্ড দ্যাট কয়েন উইল নেভার রিং?
সন্তু হাসতে-হাসতে বলল, খাঁচাটাই লাভ হল। নকল টাকা দিয়েছে!
কাকাবাবু বললেন, জাহাজে যাওয়ার সময় এইরকম অনেক মজা হত। আমিও একবার গিয়েছিলাম।
উঠে দাঁড়িয়ে, দু হাত ছড়িয়ে আড়মোড়া ভেঙে কাকাবাবু বললেন, এখানে এসে এ পর্যন্ত বেশ কয়েক ঝাঁক টিয়া, দুরকম বুলবুলি, শালিক, কাঠঠোকরা আর ময়না দেখেছি। খুব বড় পাখি তো চোখে পড়েনি একটাও!
সন্তু বলল, যে পাখিগুলোর গায়ে অনেকরকম রং, ওগুলো কী পাখি?
কাকাবাবু বললেন, ওইগুলোই তো কাঠঠোকরা। সরু ঠোঁট। ওরা গাছের গায়ে গর্ত করে। কাঠঠোকরা আর মাছরাঙা পাখি খুব রংচঙে হয়।
সন্তু বলল, কাকও দেখতে পাইনি!
কাকাবাবু বললেন, জঙ্গলে সাধারণত কাক দেখা যায় না। কাক থাকে মানুষের কাছাকাছি। শহরে বা গ্রামে। কিন্তু হাঁস-টাঁসের মতন বড় পাখি তো দেখলাম না একটাও। তা হলে ওই পাখিগুলো আসে কোথা থেকে?
সন্তু বলল, কী জানি! কাকাবাবু ক্রাচ দুটো বগলে নিয়ে বললেন, চল, জঙ্গলের মধ্যে আর একটুখানি ঘুরে দেখি। যদি বড় পাখির সন্ধান পাওয়া যায়।
এমন সময় ফাঁকা জায়গাটার অন্য প্রান্তে একটা লোককে দেখা গেল। সেই লোকটি আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে।
সন্তু লোকটিকে দেখেই চেঁচিয়ে বলল, সাবধান! সাবধান! ওইদিকে একটা সাপ আছে!
লোকটি থমকে দাঁড়িয়ে গেল বটে, কিন্তু খুব একটা চমকে উঠল না। সন্তুদের দিকে তাকিয়ে বলল, তাই নাকি? সাপ? কোথায়?
সন্তু বলল, এই ঘাসের মধ্যে আছে। আমরা একটু আগেই দেখেছি। ওইদিকেই গেছে।
লোকটি মুখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখল। তারপর কোমর বেঁকিয়ে ঝুঁকে, সাবধানে পা ফেলে-ফেলে সাপটাকে খুঁজতে লাগল।
সন্তু বলল, বাবাঃ! লোকটার কী সাহস!
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, সাহস আছে ঠিকই। কিন্তু লোকটার পায়ের দিকে দ্যাখ, হাঁটু পর্যন্ত ভোলা গামবুট পরে আছে। সাপ সাধারণত পায়েই কামড়ায়, ওকে কিছু করতে পারবে না!
লোকটি কিছুক্ষণ সাপটাকে খুঁজল, কিন্তু পেল না। সেটা নিশ্চয়ই কোনও গর্তে ঢুকে পড়েছে।
এবার সে ফাঁকা জায়গাটা পেরিয়ে সন্তুদের কাছে এসে বলল, আপনারা সাপটাকে ভাল করে দেখেছিলেন? বিষাক্ত সাপ ছিল? আপনারা সাপ চেনেন?
কাকাবাবু বললেন, হ্যাঁ, বিষাক্ত সাপ। অনেকটা ফণা তুলেছিল।
লোকটি বলল, ইস্! খুব মিস্ হয়ে গেল। আর একটু আগে এলে..
কথা থামিয়ে সে হাত জোড় করে নমস্কার করল। তারপর কাকাবাবুকে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিশ্চয়ই রাজা রায়চৌধুরী? আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম। আপনি সার্কিট হাউসে এসে উঠেছেন শুনলাম।
কাকাবাবুও প্রতি-নমস্কার করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনাকে তো চিনতে পারলাম না?
লোকটি বলল, চিনবে কী করে? আমার সঙ্গে তো আপনাদের আগে আলাপ হয়নি। আমার নাম পীতাম্বর পাহাড়ী। হ্যাঁ, সত্যিই আমার পদবি পাহাড়ী। আমার বাড়ি মেদিনীপুর, সেখানে কোনও পাহাড় নেই অবশ্য, তবু আমরা পাহাড়ী। এই নামের জন্যই বোধহয় এখন আমাকে পাহাড়ে-পাহাড়ে কাটাতে হয়। আমি এখন এখানেই থাকি। সাপ ধরার ব্যবসা করি।
সন্তু বলল, সাপ ধরা?
লোকটি বলল, হ্যাঁ। সাপ ধরে-ধরে বিষ বের করি। সেই বিষ ভাল দামে বিক্রি হয়। ওষুধ তৈরির কাজে লাগে। কথায় আছে না, বিষে বিষক্ষয়! বিষ দিয়েও ওষুধ তৈরি হয়।
সন্তু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনি নিজে সাপ ধরেন? কী করে ধরেন? খালি হাতে?
লোকটি বলল, আমার একটা লম্বা লোহার চিমটে আছে। সেটা দিয়ে ধরা খুব সোজা। খালি হাতেও ধরতে শিখে গেছি। মাথার পেছনদিকটা খপ করে চেপে ধরলে সাপ তো আর কিছু করতে পারে না। মাগুর মাছের মতন!
কাকাবাবু বললেন, ওরে বাবা, খালি হাতে সাপ ধরা! আপনি তো সত্যিই খুব সাহসী লোক মশাই!
লোকটি বলল, প্র্যাকটিস! প্র্যাকটিস!
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আপনি আমার কাছে যাচ্ছিলেন কেন, পীতাম্বরবাবু?
এমন সময় ঝাঁ করে বৃষ্টি এসে গেল। বেশ বড় বড় ফোঁটা। সবাই মিলে সরে গিয়ে দাঁড়াল একটা বড় গাছতলায়।
লোকটি বলল, আমাকে বাবুটাবু বলবেন না। পীতাম্বর নামটাও আমার পছন্দ নয়। আমাকে শুধু অম্বর বলে ডাকবেন। আমি এখন সাপ ধরে বেড়াই বটে কিন্তু একসময় তো কলেজে-টলেজে পড়েছি। শহরেও থেকেছি। তখন আপনার নাম শুনেছি। আপনার সম্পর্কে কাগজে লেখায় পড়েছি। এই ছেলেটি নিশ্চয়ই সন্তু?
সন্তু দু হাত তুলে নমস্কার করল।
অম্বর সন্তুর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল, এই রে, তোমাকে ধরেছে!
সন্তু আঁতকে উঠে বলল, অ্যাঁ? কী ধরেছে?
অম্বর বলল, যা ধরবার তাই ধরেছে! এইরকম পোশাকে কি কেউ আসামের জঙ্গলে আসে? তাও এই বর্ষাকালে!
সন্তু ভয়ে-ভয়ে চারদিকে তাকিয়ে বলল, কেন? কী হয়েছে?
সন্তু পরে আছে একটা নীল রঙের ফুলপ্যান্ট আর একটা হালকা নীল রঙের। হাওয়াই শার্ট। পায়ে চটি। কাকাবাবু সব সময় ফুলহাতা শার্ট গায়ে দেন, পায়ে। মোজা আর শু। কাকাবাবুর একটা পায়ের পাঞ্জা ভাঙা আর বিকৃত বলে তাঁর জন্য অর্ডার দিয়ে বিশেষ ধরনের জুতো বানাতে হয়।
অম্বর বলল, পায়ে ফুলমোজা আর গামবুট পরে আসা উচিত। তুমি যে একটা পা মাঝে-মাঝে নাড়ছ, তাতেই বুঝতে পেরেছি। প্রথম প্রথম সুড়সুড়ির মতন লাগে।
অম্বর বসে পড়ে সন্তুর ডান পায়ের প্যান্ট অনেকখানি তুলে ফেলল। হাঁটুর ১৭৬
নীচে এক জায়গায় গুঁটলি মতন হয়ে আছে।
কাকাবাবু অস্ফুট গলায় বললেন, জোঁক!
অম্বর বলল, সাপের হাত থেকে বাঁচা যায়, কিন্তু এখানে জোঁক ধরবেই! পা বেয়ে তো ওঠেই, অনেক সময় গাছের ওপর থেকেও টুপ-টুপ করে খসে পড়ে!
সন্তু নিচু হয়ে জোঁকটাকে টেনে তুলতে গেল, কিন্তু সেটা ইলাস্টিকের মতন লম্বা হয়ে গেল, ছাড়ানো গেল না। অম্বর বলল, অত সহজ নয়। এখন তো দেখছ এইটুকু, তোমার রক্ত খেয়ে-দেয়ে ফুলে অ্যাও বড় হয়ে যাবে?
কাকাবাবু বললেন, একটা ছুরি দিয়ে কাটতে হবে। শিগগির ডাকবাংলোয় চলো!
অম্বর বলল, ব্যস্ত হবেন না, আমার কাছে ওষুধ আছে। সব সময় সঙ্গে রাখি।
পকেট থেকে সে একটা ছোট প্লাস্টিকের কৌটো বের করল। সেটা থেকে দু আঙুলে খানিকটা সাদা জিনিস তুলে নিয়ে বলল, এটা কী বলুন তো? স্রেফ নুন। আমরা যে নুন খাই, সেই নুন। জোঁকের মাথায় নুন বলে একটা কথা আছে জানেন তো? এবার দেখুন, তাতে কী হয়!
সে খানিকটা নুন ছিটিয়ে দিল জোঁকটার গায়ে। অমনি সেটা ছটফটিয়ে টুপ করে খসে পড়ে গেল। তারপর কিলবিল করতে লাগল মাটিতে পড়ে।
সন্তু সেটা থেঁতলে দিতে গেল চটি দিয়ে।
অম্বর বলল, ওরকমভাবে জোঁক মারা যায় না। ওদের গা রবারের মতন। একমাত্র নুনেই জব্দ। নুন ওদের চামড়ার মধ্যে ঢুকে যায়। সন্তু ঘেন্নায় মুখখানা কুঁচকে বলল, অদ্ভুত প্রাণী। মানুষের রক্ত খেয়ে বাঁচে!
অম্বর বলল, ওরা বাঘেরও রক্ত খায়। একসঙ্গে অনেকগুলো জোঁক। লাগলে বাঘও কাবু হয়ে যায়!
কাকাবাবু নিজের বুকের কাছে জামাটা ঘষতে-ঘষতে বললেন, আমার আবার এখানটায় কী হল? হঠাৎ চুলকোচ্ছে। আমারও জোঁক লাগল নাকি?
টপটপ করে জামার বোতামগুলো খুলে ফেললেন কাকাবাবু। গেঞ্জির মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা পোকা বের করে আনলেন। বাচ্চা আরশোলার সাইজের।
অম্বর সেটা দেখে বলল, এটা এমন কিছু খারাপ পোকা নয়। আর একরকম আছে। গায়ে একটু লাগলেই ঘা হয়ে যায়।
সন্তু বলল, বাবারে বাবাঃ! সাপ, জোঁক, বিষাক্ত পোকা, আরও কী কী আছে এ জঙ্গলে? বাঘ, হাতি, গণ্ডার?
অম্বর বলল, বাঘ বিশেষ দেখা যায় না, তবে লেপার্ড আছে। সেগুলো এমন কিছু ভয়ের নয়। বরং ওরাই মানুষ দেখলে ভয় পায়। মাঝে-মাঝে একরকম ভাল্লুক এসে পড়ে, সেগুলো বড্ড হিংস্র। একদিন আমি গভীর জঙ্গলের মধ্যে হঠাৎ একটা ভাল্লুকের মুখোমুখি পড়ে গিয়েছিলাম। ঝোপের সঙ্গে মিশে থাকলে হঠাৎ ওদের দেখাই যায় না।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, তারপর আপনি কী করলেন? আপনার কাছে বন্দুক ছিল?
অম্বর বলল, না। আমি বন্দুক কোথায় পাব? হাতে শুধু একটা সাপ ধরার চিমটে। তা দিয়ে তো আর ভাল্লুকটার সঙ্গে লড়া যায় না? ওরা প্রথমেই এক থাবা দিয়ে চোখ অন্ধ করে দেয়। তখন আমি কী করলাম জানো? আমি হাসতে শুরু করলাম। এটা আমার ছোটবেলা থেকে স্বভাব, ভয় পেলেই কান্নার বদলে মুখ দিয়ে হাসি বেরিয়ে আসে। যত বেশি ভয় পাই, তত বেশি জোরে হি-হি করে হাসি। কীরকম শুনবে? হি-হি-হি-হি!
অম্বর সত্যিই ভয় পাওয়ার মতন মুখখানা কুঁচকে, প্রচণ্ড জোরে, বন কাঁপিয়ে হেসে উঠল।
তাই শুনে কাকাবাবু আর সন্তুর ঠোঁটেও হাসি খেলে গেল।
অম্বর বলল, আমার সেই হাসি শুনে ভালুক বাবাজি পেছন ফিরে হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে চোঁ-চোঁ দৌড়। ভাবল, এ আবার কী অদ্ভুত জন্তু রে বাবা!
অম্বরের এই কাহিনীটা বানানো গল্প, না সত্যি, তা ঠিক বুঝতে পারল না সন্তু। তবে লোকটিকে তার বেশ পছন্দ হয়ে গেল। সব কথাই মজার সুরে বলে। মুখখানা দেখলে ভালমানুষ বলে মনে হয়।
অম্বরের লম্বা ধরনের চেহারা। বয়েস তিরিশের কাছাকাছি। মাথা ভর্তি চুল। গালে অল্প-অল্প দাড়ি। কথা বলার সময় তার চোখ দুটো কৌতুকে জ্বলজ্বল করে।
সন্তু জিজ্ঞেস করল, এই জঙ্গলে এতসব খারাপ-খারাপ জিনিস রয়েছে, তবু আপনি এখানে একা-একা ঘুরে বেড়ান?
অম্বর বলল, কী করব বলো? এটাই যে আমার কাজ। টাকাপয়সা রোজগারের জন্য মানুষকে কতরকম কষ্ট স্বীকার করতে হয়। এখানে একটু ঝুঁকি আছে বটে, তবু তো আমার স্বাধীন ব্যবসা। মাথার ওপর কোনও ওপরওয়ালা নেই। কারুর হুকুম শুনতে হয় না আমাকে।
কাকাবাবু বললেন, বাঙালির ছেলেদের এরকম কোনও কাজ করতে দেখলে আমার আনন্দ হয়। বেশিরভাগই তো সাধারণ একটা চাকরি খোঁজে। কোনওরকমে একটা চাকরি জোটালেই ধন্য মনে করে।
অম্বর জিজ্ঞেস করল, আমি না হয় নিজের কাজের জন্য এখানে পড়ে আছি। আপনারা এখানে এসেছেন কেন? বেড়াতে? রাজা রায়চৌধুরী তো কোথাও শুধু-শুধু বেড়াতে যাওয়ার লোক নন।
সন্তু কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল।
কাকাবাবু বললেন, অনেকটা বেড়াতেই এসেছি বলা যায়। এর আগে আসিনি। তা ছাড়া আর একটা উদ্দেশ্য হল পাখি দেখা।
অম্বর মুচকি হেসে বলল, পাখি মানে…জাটিংগা বার্ডস? বুঝেছি। তা হলে আজ রাত্তিরে আমিও আপনাদের সঙ্গে যাব!
যেমন হঠাৎ বৃষ্টি এসেছিল, তেমনই হঠাৎ থেমে গেল। আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। ওরা তিনজনে এগোতে লাগল ডাকবাংলোর দিকে।