তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় (Tarasankar Bandyopadhyay)

নাম : তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (Tarasankar Bandopadhyay)
জন্ম : ২৩ জুলাই, ১৮৯৮, পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে
অভিভাবক : হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা প্রভাবতী দেবী।
দাম্পত্য সঙ্গী : উমাশশী দেবী
পেশা : ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার
উল্লেযোগ্য উপন্যাস : গণদেবতা ’ , ‘ পঞ্চগ্রাম ‘ , হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ’ , ‘ যােগভ্রষ্ট ’ , ‘ ধাত্রী দেবতা ’ , ‘ মন্বন্তর ’ , ‘ আরােগ্য নিকেতন ’ , ‘ বিচিত্রা
পুরস্কার : রবীন্দ্র পুরস্কারসাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারজ্ঞানপীঠ পুরস্কার পদ্মভূষণ
মৃত্যু : সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় (২৩ জুলাই, ১৮৯৮- সেপ্টেম্বর ১৪, ১৯৭১) বিংশ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট বাঙালি কথাসাহিত্যিক ছিলেন। তার সামগ্রিক সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে ৬৫টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধের বই, ৪টি আত্মজীবনী, ২টি ভ্রমণ কাহিনী, ১টি কাব্যগ্রন্থ এবং ১টি প্রহসন লিখেছেন। । এই বিশিষ্ট সাহিত্যিক রবীন্দ্র পুরস্কার, সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার,পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।
জন্ম ও শিক্ষা
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা-মায়ের নাম হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রভাবতী দেবী। তাদের বাড়িতে নিয়মিত কালী ও তারা মায়ের পুজো হতো। তার বাবা মা দুজনেই ছিলেন অত্যন্ত ধর্মপরায়ণ ও আদর্শনিষ্ঠ। তারাশঙ্করের জন্মগ্রহণ করার আগে প্রভাবতী দেবী ও হরিদাসের জ্যেষ্ঠপুত্রের মৃত্যু হয়। তাই তাদের পরিবারে তারা মায়ের পুজো শুরু হওয়ার ঠিক দশমাস পরে তারাশঙ্করের জন্ম হয়৷তিনি মায়ের দয়ায় জাত হয়েছিলেন বলেই তার নাম রাখা হয় তারাশঙ্কর। তারাশঙ্কর ছোটবেলায় মাদুলি, তাবিচ, কবচ এবং বহু সংস্কারের গন্ডিতে বড় হয়ে ওঠেন। আসলে সততা, ধর্মভাব, ভক্তি ও ধর্মশাস্ত্রীয় বিশ্বাস তিনি পেয়েছিলেন মায়ের কাছ থেকে। যদিও পরবর্তী জীবনে এ সব বিশ্বাস নিয়ে অনেক দ্বিধা দ্বন্দ্ব ও জিজ্ঞাসা তার মনকে আলোড়িত করেছে। প্রগতিশীল চিন্তার শরিক হয়েছেন। তারাশঙ্করের বাল্যজীবন কাটে গ্রামের পরিবেশেই। গ্রামের স্কুল থেকেই তার প্রাথমিক পাঠ।
তারাশঙ্কর লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে ১৯১৬ সালে এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে প্রথমে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে এবং পরে সাউথ সুবার্বন কলেজে (এখনকার আশুতোষ কলেজ) ভর্তি হন। তিনি সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। স্বাস্থ্যভঙ্গ এবং রাজনৈতিক কার্যকলাপের কারণে তার পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি।
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার কারণে ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেপ্তার হলেও পরে মুক্তি পেয়ে যান। এরপর নিজেকে সাহিত্যকর্মে নিয়োজিত করেন। ১৯৩২ সালে তিনি প্রথমবার শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে দেখা করেন। একই বছরে তার প্রথম উপন্যাস “চৈতালী ঘূর্ণি” প্রকাশ পায়।
তারাশঙ্কর ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে বাগবাজারে একটি বাড়ি ভাড়া করে নিজের পরিবারকে কলকাতায় নিয়ে আসেন ও ১৯৪১-এ তিনি বরাহনগরে চলে যান। তারাশঙ্কর ১৯৪২-এর বীরভূম জেলা সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেন এবং ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পী সংগঠনের সভাপতি হন। তিনি ১৯৭০ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন
তারাশঙ্কর কংগ্রেসের কর্মী হয়ে সমাজসেবামূলক কাজ করেন এবং এর জন্য তিনি কিছুদিন জেলও খাটেন। একবার তিনি ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টও হয়েছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদের সদস্য হন।
লেখার বৈশিষ্ট্য
তার লেখায় বিশেষ ভাবে পাওয়া যায় বীরভূম-বর্ধমান অঞ্চলের সাঁওতাল, বাগদি, বোষ্টম, বাউরি, ডোম, গ্রাম্য কবিয়াল সম্প্রদায়ের কথা। ছোট বা বড় যে ধরনের মানুষই হোক না কেন, তারাশঙ্কর তার সব লেখায় মানুষের মহত্ত্ব ফুটিয়ে তুলেছেন, যা তার লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। সামাজিক পরিবর্তনের বিভিন্ন চিত্র তার অনেক গল্প ও উপন্যাসের বিষয়। সেখানে আরও আছে গ্রাম জীবনের ভাঙনের কথা, নগর জীবনের বিকাশের কথা।
চলচ্চিত্রায়ন
তারাশঙ্করের উপন্যাস, গল্প ও নাটক নিয়ে চল্লিশটিরও বেশি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সত্যজিৎ রায়ও তারাশঙ্করের জলসাঘর এবং অভিযান উপন্যাসের সফল চিত্ররূপ দিয়েছেন। তার যেসব রচনা চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয়েছে সেগুলির মধ্যে আছে:
কবিতা
১৯৩৩ সালে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ ত্রিপত্র ’ নামে একটিকবিতা সঙ্কলন প্রকাশ করলেন । কবিতার মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার আবির্ভাব ঘটেছিল । কিছুদিন পরে বুঝতে পারেন কবিতা । তার ভাবনা প্রকাশের সার্থক মাধ্যম নয় , উপন্যাসের মাধ্যমে মানুষের জীবনের নানা টানাপােড়েনকে তুলে ধরতে হবে । তখন থেকেই শুধুমাত্র গদ্য সাহিত্যের সেবা করে গেছেন । আর এর জন্যই তাকে শরৎ – রবীন্দ্রোত্তর যুগের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলা হয়েছে ।
পরাধীন মানুষের মনের জ্বালা – যন্ত্রণাকে কাছ থেকে উপলব্ধি করেছেন । তার লেখার মধ্যে বারবার ফুটে উঠেছে মনুষ্যত্বের অবমাননা এবং দেশভাগজনিত দুঃখ – জ্বালা – যন্ত্রণা । দাঙ্গা এবং নারীত্বের অবমূল্যায়নও তার লেখার উপজীব্য বিষয় হয়েছে । ইতিহাসের পরিবর্তন ও রাজনৈতিকক্রান্তিকালের মধ্যে দিয়ে বাঙালির জীবনে কী কী পরিবর্তন এসেছে তা তিনি তার লেখনীর মাধ্যমে । ফুটিয়ে তুলেছেন ।
উপন্যাস
তার লেখা বিখ্যাত উপন্যাসগুলির মধ্যে ‘ গণদেবতা ’ , ‘ পঞ্চগ্রাম ‘ , হাঁসুলিবাঁকের উপকথা ’ , ‘ যােগভ্রষ্ট ’ , ‘ ধাত্রী দেবতা ’ , ‘ মন্বন্তর ’ , ‘ আরােগ্য নিকেতন ’ , ‘ বিচিত্রা ইত্যাদি । ছােটো গল্পের এক সার্থক রূপকার হিসাবে তারাশঙ্করকে পাঠকমহল মনে । রাখবে । তার লেখা ‘ রসকলি ’ , ‘ ডাকহরকরা , প্রভৃতি ছােটোগল্পকে পাঠকমহল কখনাে ভুলতে পারবে না ।
• নিশিপদ্ম (১৯৬২)
• চৈতালি ঘূর্ণি (১৯৩২)
• পাষাণপুরী (১৯৩৩)
• নীলকণ্ঠ (১৯৩৩)
• রাইকমল (১৯৩৫)
• প্রেম ও প্রয়োজন (১৯৩৬),
• আগুন (১৯৩৮)
• ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯)
• কালিন্দী (১৯৪০)
• গণদেবতা (১৯৪৩)
• মন্বন্তর (১৯৪৪)
• পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪)
• কবি (১৯৪৪)
• সন্দীপন পাঠশালা (১৯৪৬)
• ঝড় ও ঝরাপাতা (১৯৪৬)
• অভিযান (১৯৪৬)
• সন্দীপন পাঠশালা (কিশোরপাঠ্য সংস্করণ, ১৯৪৮)
• পদচিহ্ন (১৯৫০)
• উত্তরায়ণ (১৯৫০)
• হাঁসুলীবাঁকের উপকথা (১৯৫১)
• তামস তপস্যা (১৯৫২)
• নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫২)
• আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩)
• চাঁপাডাঙার বৌ (১৯৫৪)
• পঞ্চপুত্তলি (১৯৫৬)
• বিচারক (১৯৫৭)
• সপ্তপদী (১৯৫৮)
• বিপাশা (১৯৫৯)
• রাধা (১৯৫৯)
• মানুষের মন (১৯৫৯)
• ডাকহরকরা (১৯৫৯)
• মহাশ্বেতা (১৯৬১)
• যোগভ্রষ্ট (১৯৬১)
• না (১৯৬১)
• নাগরিক (১৯৬১)
• নিশিপদ্ম (১৯৬২)
• যতিভঙ্গ (১৯৬২)
• কান্না (১৯৬২)
• কালবৈশাখী (১৯৬৩)
• একটি চড়–ইপাখি ও কালো মেয়ে (১৯৬৩)
• জঙ্গলগড় (১৯৬৪)
• মঞ্জরী অপেরা (১৯৬৪)
• সংকেত (১৯৬৪)
• ভুবনপুরের হাট (১৯৬৪)
• বসন্তরাগ (১৯৬৪)
• স্বর্গমর্ত্য (১৯৬৫)
• বিচিত্রা (১৯৬৫)
• গন্না বেগম (১৯৬৫)
• অরণ্যবহ্নি (১৯৬৬)
• হীরাপান্না (১৯৬৬)
• মহানগরী (১৯৬৬)
• গুরুদক্ষিণা (১৯৬৬)
• শুকসারী কথা (১৯৬৭)
• শক্করবাঈ (১৯৬৭)
• মণিবৌদি (১৯৬৯)
• ছায়াপথ (১৯৬৯)
• কালরাত্রি (১৯৭০)
• রূপসী বিহঙ্গিনী (১৯৭০)
• অভিনেত্রী (১৯৭০)
• ফরিয়াদ (১৯৭১)
• শতাব্দীর মৃত্যু (১৯৭১)
• কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড (কিশোর উপন্যাস,১৯৭২)
• ‘১৯৭১
• নবদিগন্ত(১৯৭৩)
• কীর্তিহাটের কর্তা(১৯৭৬)
ছোটগল্প
তারাশঙ্কর প্রায় দুশ গ্রন্থ রচনা করেন। সেগুলির মধ্যে চৈতালী ঘূর্ণি (১৯৩২), জলসাঘর (১৯৩৮), ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯), কালিন্দী (১৯৪০), গণদেবতা (১৯৪৩), পঞ্চগ্রাম (১৯৪৪), কবি (১৯৪৪), হাঁসুলি বাঁকের উপকথা (১৯৪৭), আরোগ্য নিকেতন (১৯৫৩) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তিনি অনেক গল্পও লিখেছেন। বেদে, পটুয়া, মালাকার, লাঠিয়াল, চৌকিদার, বাগদী, বোষ্টম, ডোম ইত্যাদি সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র তাঁর গল্পে দক্ষতার সঙ্গে অঙ্কিত হয়েছে। ‘রসকলি’, ‘বেদেনী’, ‘ডাকহরকরা’ প্রভৃতি তাঁর প্রসিদ্ধ ছোটগল্প। তারাশঙ্করের গল্পের সংকলন তিন খন্ডে সাহিত্য সংসদ কর্তৃক প্রকাশিত (১৯৭৭-১৯৭৯) হয়েছে।
• ছলনাময়ী (১৯৩৭)
• জলসাঘর (১৯৩৮)
• রসকলি (১৯৩৯)
• তিন শূন্য (১৯৪২)
• প্রতিধ্বনি (১৯৪৩)
• বেদেনী (১৯৪৩)
• দিল্লী কা লাড্ডু (১৯৪৩)
• যাদুকরী (১৯৪৪)
• স্থলপদ্ম (১৯৪৪)
• তেরশো পঞ্চাশ (১৯৪৪)
• প্রসাদমালা (১৯৪৫)
• হারানো সুর (১৯৪৫)
• ইমারত (১৯৪৭)
• রামধনু (১৯৪৭)
• শ্রীপঞ্চমী
• কামধেনু (১৯৪৯)
• মাটি (১৯৫০)
• শিলাস্থান (১৯৫২)
• বিস্ফোরণ (১৯৫৫)
• কালান্তর (১৯৫৬)
• বিষপাথর (১৯৫৭)
• রবিবারের আসর (১৯৫৯)
• পৌষলক্ষ্মী (১৯৬১)
• আলোকাভিসার
• চিরন্তনী (১৯৬২)
• অ্যাক্সিডেন্ট (১৯৬২)
• তমসা (১৯৬৩)
• আয়না (১৯৬৩)
• চিন্ময়ী (১৯৬৪)
• একটি প্রেমের গল্প (১৯৬৫)
• তপোভঙ্গ
• দীপার প্রেম (১৯৬৬)
• নারী রহস্যময়ী (১৯৬৭)
• পঞ্চকন্যা (১৯৬৭)
• শিবানীর অদৃষ্ট (১৯৬৭)
• গোবিন সিংয়ের ঘোড়া (১৯৬৮)
• জয়া (১৯৬৮)
• এক পশলা বৃষ্টি (১৯৬৯)
• মিছিল (১৯৬৯)
• উনিশশো একাত্তর (১৯৭১)
পুরস্কার সমুহ
সাহিত্য সাধনা করে অসংখ্য পুরস্কার এবং সম্মান লাভ করেছেন । তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । তিনি পেয়েছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শরৎস্মৃতি পুরস্কার , জগত্তারিণী পুরস্কার , পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র । পুরস্কার , সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার , জ্ঞানপীঠ সাহিত্য পুরস্কার ইত্যাদি । কেন্দ্রীয় সরকার তাকে পদ্মশ্রী এবং পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেছিল।তার অসংখ্যগল্প উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়ে হাজার হাজার মানুষের মন জয় করেছে ।
মৃত্যু
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরিণত বয়সে মহাপ্রয়াত হন । বাংলার কালজয়ী এই ঔপন্যাসিক ও ছােটো গল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ।
Source : wikipedia