কেন তবে কেড়ে নিলে লাজ-আবরণ? হৃদয়ের দ্বার হেনে বাহিরে আনিলে টেনে, শেষে কি পথের মাঝে করিবে বর্জন? আপন অন্তরে আমি ছিলাম আপনি, সংসারের শত কাজে ছিলাম সবার মাঝে, সকলে যেমন ছিল আমিও তেমনি। তুলিতে পূজার ফুল যেতেম যখন সেই পথ ছায়া-করা, সেই বেড়া লতা-ভরা, সেই সরসীর তীরে করবীর বন— সেই কুহরিত পিক শিরীষের ডালে, প্রভাতে সখীর মেলা, কত হাসি কত খেলা— কে জানিত কী ছিল এ প্রাণের আড়ালে। বসন্তে উঠিত ফুটে বনে বেলফুল, কেহ বা পরিত মালা, কেহ বা ভরিত ডালা, করিত দক্ষিণবায়ু অঞ্চল আকুল। বরষায় ঘনঘটা, বিজুলি খেলায়— প্রান্তরের প্রান্তদিশে মেঘে বনে যেত মিশে, জুঁইগুলি বিকশিত বিকাল বেলায়। বর্ষ আসে বর্ষ যায়, গৃহকাজ করি— সুখদুঃখ ভাগ লয়ে প্রতিদিন যায় বয়ে, গোপন স্বপন লয়ে কাটে বিভাবরী। লুকানো প্রাণের প্রেম পবিত্র সে কত! আঁধার হৃদয়তলে মানিকের মতো জ্বলে, আলোতে দেখায় কালো কলঙ্কের মতো। ভাঙিয়া দেখিলে ছিছি নারীর হৃদয়! লাজে ভয়ে থর্থর্ ভালোবাসা-সকাতর তার লুকাবার ঠাঁই কাড়িলে নিদয়! আজিও তো সেই আসে বসন্ত শরৎ। বাঁকা সেই চাঁপা-শাখে সোনা-ফুল ফুটে থাকে, সেই তারা তোলে এসে— সেই ছায়াপথ। সবাই যেমন ছিল, আছে অবিকল— সেই তারা কাঁদে হাসে, কাজ করে, ভালোবাসে, করে পূজা, জ্বালে দীপ, তুলে আনে জল। কেহ উঁকি মারে নাই তাহাদের প্রাণে— ভাঙিয়া দেখে নি কেহ হৃদয় গোপন গেহ, আপন মরম তারা আপনি না জানে। আমি আজ ছিন্ন ফুল রাজপথে পড়ি, পল্লবের সুচিকন ছায়াস্নিগ্ধ আবরণ তেয়াগি ধুলায় হায় যাই গড়াগড়ি। নিতান্ত ব্যথায় ব্যথী ভালোবাসা দিয়ে সযতনে চিরকাল রচি দিবে অন্তরাল, নগ্ন করেছিনু প্রাণ সেই আশা নিয়ে। মুখ ফিরাতেছ সখা, আজ কী বলিয়া! ভুল করে এসেছিলে? ভুলে ভালোবেসেছিলে? ভুল ভেঙে গেছে, তাই যেতেছ চলিয়া? তুমি তো ফিরিয়া যাবে আজ বই কাল— আমার যে ফিরিবার পথ রাখ নাই আর, ধূলিসাৎ করেছ যে প্রাণের আড়াল। একি নিদারুণ ভুল! নিখিলনিলয়ে এত শত প্রাণ ফেলে ভুল করে কেন এলে অভাগিনী রমণীর গোপন হৃদয়ে! ভেবে দেখো আনিয়াছ মোরে কোন্খানে— শত লক্ষ আঁখিভরা কৌতুককঠিন ধরা চেয়ে রবে অনাবৃত কলঙ্কের পানে। ভালোবাসা তাও যদি ফিরে নেবে শেষে, কেন লজ্জা কেড়ে নিলে, একাকিনী ছেড়ে দিলে বিশাল ভবের মাঝে বিবসনাবেশে !