Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ট্রেকার্স || Bani Basu

ট্রেকার্স || Bani Basu

কাগজের প্রথম পাতার প্রথম খবরটা দেখে ধ্রুবজ্যোতি মজুমদার চমকালেন। ধৈর্য ধরে পড়লেন খবরটা। সাধারণত এতটা মন তিনি আজকাল কোনও খবরে দিচ্ছেন না। কথাটা ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছিল, আবারও হল। নাটক হচ্ছে চারদিকে মঞ্চে-মঞ্চান্তরে এবং রাস্তায়-রাস্তায়, বাড়িতে-বাড়িতে, জীবনে-জীবনে। মঞ্চের নাটকগুলো আমরা ধরতে পারি, কেননা সেখানে স্থান কাল পাত্র সবই সংক্ষিপ্ত হয়ে এসেছে। নাট্যকার ইচ্ছে হলে তাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনা দিচ্ছেন, জিনিসটা ভাবাচ্ছে। আয়োনেস্কো, ব্রেখ্ট, এদিকে হ্যারল্ড পিন্টার, দারিয়ো ফো, মাইকেল মধুসূদন, দীনবন্ধু মিত্র থেকে এখনকার বাদল সরকার, মোহিত চট্টোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র…

কথাটা হচ্ছে, প্রতিদিনকার জীবনে ছোট-ছোট যে-নকশাগুলো ঘটে, সংসারে যেসব প্রহসন এবং জীবনে সত্যিকার নাটক ঘটে, সেগুলোকে আমরা নাট্য বলে দেখি না। সবই কিন্তু মেলোড্রামা নয়। নিচুস্বরের ঘন গাঢ় নাটকগুলো একেবারেই ধরা পড়ে না বোধে। কিন্তু কখনও-কখনও এমন জিনিসও ঘটে, যেন মনে হয় পুরোটা কেউ স্ক্রিপ্ট লিখে তৈরি করেছে। কোথায় কেমন দৃশ্যপট হবে, কীভাবে আলো পড়বে, কে-কে থাকবে কেন্দ্রে, কারা আশপাশে, জীবনভর্তি এক্সট্রার দল, সমস্ত কেউ সাজিয়ে রেখেছিল। পাখিপড়া করে পড়িয়েছে প্রত্যেককে। মডুলেশন, ঢোঁক গেলা, কায়িক অভিনয়, হাতের ভঙ্গি, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, আলোর দিকে অর্ধেক ফেরা, প্রবেশ-প্রস্থান একেবারে ইঞ্চি মেপে। মঞ্চের নাটকের সঙ্গে তফাত? এ তো কুড়ি-ফুটি স্টেজ নয়, এর হিসেব হবে মাইলেজে। কালকেও গুটিয়ে ছোট করে আনা যাবে না, আর মূল নাটকের মূল কুশীলবের চলাফেরার ধন্দে উৎক্ষিপ্ত মানুষজনকে না ধরলে, এ নাটকের চরিত্রলিপি সম্পূর্ণ হয় না। শুধু ক্রাউড বা ১ নং ভদ্রলোক, ২ নং ভদ্রলোক বলে শেষ করা যাবে না এ তালিকা। আলোকসম্পাতে তিনি দেখতে পাচ্ছেন মেঘ-রোদের খেলা, প্রবল বর্ষণ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, প্যাচপেচে গরম, আদুরে রোদ। ঝমঝম, রিমিঝিমি বাজতে থাকবে আবহসংগীতে। আসল পাখিদের ডাকাডাকি চলবে নিরন্তর ক্কঃ ক্কঃ, কুবকুবকুব, আগুমবাগুম, রেডিয়োর টুকরো স্বর, কোনও জানলাপথে উপচে পড়া টিভির উচ্চারণ, ঘষঘষ গাড়ির আওয়াজ, ঢং ঢং ট্রামের, কুকুরের কেঁউকেঁউ, ঘেউঘেউ কী নেই! সব আছে এবং যথাযথ প্রয়োগে আছে। সংগীত পরিচালক যেখানে প্রকৃতি, সেখানে নৈঃশব্দ ও হট্টগোল, পক্ষবিধূননের সুদূর শব্দ, পিছলে পড়ার সড়াৎ, কোনও কিছুর জন্যই আলাদা ভাবাভাবির প্রয়োজন হয় না। আর আসল যে অভিনেতা-অভিনেত্রী? তারা আসল, তাই তাদের চলন-বলন স্বতঃস্ফূর্ত, উচ্চারণের দোষ থেকে, ভুলভাল কথা, আকস্মিক নীরবতা সবই সেখানে মানিয়ে যায়। কোনও ভিন্ন মানুষের খোলসে ঢুকতে হচ্ছে না তো! কোনও পরিচালকের নির্দেশও পালন করতে হচ্ছে না। যা কিছু মোটিভেশন সবই নিজস্ব বোধবুদ্ধি, উপলব্ধি, উদ্দেশ্য থেকে উঠে আসছে।

কে পরিচালক এই নাট্যের? অ-দৃষ্ট, যাকে এখনও দেখতে পাচ্ছি না? কোনও ব্যক্তি সে নয়। এক অমোঘ কার্যকারণের শৃঙ্খল, গেঁথে যাচ্ছে আপন মনে পুঁতির মালা। আহা, যদি ইনটুইশনের ভাষাতেও স্ক্রিপ্টটা পড়া যেত!

সংযুক্তা কফির ট্রে হাতে এসে গেলেন, “কী ব্যাপার? কাগজ হাতে এমন বোমভোলা হয়ে বসে আছ কেন?”

উত্তরে ধ্রুব কাগজটা এগিয়ে দিলেন।

সংযুক্তা একটু পড়েই বললেন, “ঠিক যেন নাটক না? ইশ্‌শ্।”

ধ্রুব হাসলেন, “কখনও-কখনও নাটক দেখেও আমরা বলি ঠিক যেন জীবন, না?”

অবসরে এখনও অভ্যস্ত হতে পারেনি মগজ। তাই-ই হয়তো দুপুরবেলা পাশের বাড়ির এফএম থেকে ভেসে আসা গান আর হাতের বই ‘গ্রে হাউন্ডস ইন ব্রাসেল্‌স’ নিয়ে যেটুকু ঢুল এসেছিল, তার মধ্যেই ধ্রুব দেখলেন পায়রার বুকের মতো ছেয়ে রঙের এতদিনের জীবনটাকে দলা পাকিয়ে পকেটে পুরে লম্বা জিন্‌স এক তরুণ লাফ দিল শেয়ালদা স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে। মাছি না গলা ভিড়টাকে কায়দা করতে তার তেমন কোনও অসুবিধে হল না। কেননা, সে ছ’ফুট দুই। ছাতি ৪২ ইঞ্চি। কাঁধ দুটো নৌকার পাটাতনের মতো। কাঁধে ব্যাকপ্যাক। হাতের সুটকেসটাকে খেলনার মতো অনায়াসে দুলিয়ে সে দুলকি চালে ঢুকে পড়ল। কাঁধ দিয়ে একটু চাপ দিতেই ভিড়ের চোখ ভয়ে, রাগে, ওপর দিকে চায়। সে গ্রাহ্যও করে না। “আহা দাদা, আপনারা এখনও অনেক পিছিয়ে। বয়সে এগিয়ে তো? স্যরি, আপনারা আফিস কাছারি যাবেন তো? তা আমারও একটা যাবার জায়গা আছে। একাধিক।” অস্ফুটে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কে?”

ছেলেটির ঠোঁটের কোণ হাসিতে বেঁকে গেল। বলল, “আমি যুবক, মানে ইয়ংম্যান।”

“কী বললে, কী ম্যান?”

“ওই দিকে দেখুন,” ছোকরাটি আঙুল দেখাল।

একটি বেশ সম্পন্ন-দর্শন ঘরের ভেতর টেবিলে বই খোলা, গালে-হাত একটি উদাস মুখকে দেখতে পেলেন ধ্রুব। গদিআঁটা কাঠের চেয়ারে বসে আছে। আপাতদৃষ্টিতে পড়াশোনা করছে, কিন্তু দৃষ্টি যেন কোথায় ভেসে চলে গিয়েছে। পরনে একটা ঝ্যালঝেলে শর্টস আর ততোধিক ঝ্যালঝেলে টপ। তার সমস্ত শরীরটা এই ঝোল্লার ভিতরে অদৃশ্য। ফুটে আছে খালি পা দু’টি আর মুখ। বেশ পা। লম্বা, নির্লোম, তবে খুব একটা অ্যাথলেটিক নয়। মুখটি বেশ ফুটফুটে। অল্প বয়সিদের সবাইকেই ধ্রুব আজকাল ফুটফুটে দেখেন অবশ্য। সংযুক্তা এখনও চাকরিতে আছেন, কিন্তু তাঁরও ওই দশা। অল্প বয়সের মেয়ে দেখলেই বলেন, “বাঃ, কী চমৎকার!”

কাজেই সত্যটা ঘষে যাচিয়ে নেওয়ার জন্য কোনও কষ্টিপাথর ধ্রুবর ধারে কাছে নেই। “তা এমন মেয়ে, এমন ঘরটি তোমার, চোখ দুটি অমন বিষাদ-কাজল কেন মা?”

“সমস্ত সম্পন্ন-সুখের হৃদয়ে থাকে এক কাঙাল। যে অনেক কিছু পেলেও, একটা জরুরি কিছু, সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে চাওয়া কিছু একটা পায়নি।” মেয়েটি বলে উঠল আস্তে আস্তে, “একলা রাতের অন্ধকারে সে হাহাকার করে ঘোরে। আমি আজকাল তার কান্না শুনতে পাচ্ছি। আগে জানতুম না, সুখের গর্ভে কোথাও এমন তলতলে কান্না আছে। সেটা দুঃখের তরল রূপ। ‘সফ্ট কোর’ সেই চকোলেটগুলোর মতো। মামা সুইজারল্যান্ড থেকে এনে দিয়েছিল। গোল-গোল বল, ওপরটা শক্ত। ভাঙতেই মুখটা তরল মাদক স্বাদে ভরে যায়। মামা বলেছিল, ‘বেশি খাসনি, নেশা হয়ে যাবে।’ এই সুখের গর্ভে, দুঃখের কান্নারও বোধহয় একটা নেশা আছে, জানেন। জীবনটা যদি একটা নিরেট চকোলেটই হত আদ্যন্ত? প্রিয়ম বলে, দুর্দান্ত হত তা হলে। প্রিয়ম জানে না, মাঝখানের ওই তরলটুকু না থাকলে নেশা জানা হত না, ঘোর জানা হত না, হাহাকার জানা হত না এবং তা হলে কিছুই জানা হত না।”

“কার লেখা থেকে পড়ছ বাবা?”

অবাক চোখে তাকিয়ে মেয়েটি বলল, “কারও লেখা তো নয়। আমি মানে দিয়া, আমি তো ভাবছিলুম।”

“ওইটুকু মেয়ে, তোমার এত কীসের দুঃখ? কিছু মনে কোরো না, প্রেম-ট্রেম?”

মেয়েটি হাসল, “আপনি খুব খু-উব পুরনো, না? প্রেম হলে তো হয়েই গেল।”

প্রেম হলে তো হয়েই গেল, মানে কী কথাটার? আর অমন হাসি? হাসির ভিতর দিয়ে যেন হাজার কথা বলে গেল। অথচ কিছুই বোঝা গেল না। তিনি কি সত্যিই খুব বুড়ো হয়ে গেলেন? মেয়েটি অবশ্য খুব ভদ্রতা করে বলল। পুরনো প্রেমের কথা বললে, পুরনো হতে হবে কেন রে বাবা? প্রেম তো চিরনতুন বলেই তার ধারণা।

এই সমস্ত সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই তাঁর চটকাটা ভেঙে গেল। পাশের টেবিলে আজকের কাগজটা ভাঁজ করা। চোখে-মুখে জল দিয়ে তিনি আয়নার দিকে তাকালেন। বডি ফিট একেবারে। কেউ বলতে পারবে না তিনি কুঁড়েমিকে প্রশ্রয় দিয়েছেন। কিন্তু মুখে তো তাঁর অভিজ্ঞতার চিহ্ন থাকবেই। সংযুক্তা আজকাল মাথার চুলে লালচে রং দিচ্ছে। তিনি কিছু দেন না, তাঁর মাথা কাঁচা-পাকা। তেমন কোনও রেখা পড়েনি, কপালে দুই ভুরুর মাধখানে একটি লম্বা তিলকের মতো রেখা ছাড়া। কিন্তু তিনি যে পুরনো, সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। ওই দিয়া, উজ্জ্বল, এরা আশ্চর্যভাবে মানুষের প্রাচীনতাকে শনাক্ত করতে পারে।

হঠাৎ তাঁর খেয়াল হল এই দুটো নাম দিয়া, উজ্জ্বল তিনি কোথা থেকে পেলেন? কাগজ, খবরের কাগজের লিড নিউজেই নাম দুটো পেয়েছিলেন। আশ্চর্য তো! কাগজটা তিনি আবার খুললেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লেন। রূপরাজ, আরিয়ান। বাব্বাঃ এসব হাই-ফাই নাম এরা কোত্থেকে পায়? শুকতারা, বাবাই। এই ছ’টা নামই তা হলে প্রধান কুশীলব।

কোত্থেকে আসছিল ইয়ংম্যান উজ্জ্বল? শেয়ালদা স্টেশনে নামল। আচ্ছা, ও তো বগুলা থেকে এল। বাসস্ট্যান্ডে মাছি থিকথিকে ভিড়। হ্যান্ডেলটা ও দূর থেকেই ধরে ফেলেছে। ব্যাকপ্যাক, গুটিকতক মুড়ো ছেঁচড়ে আপনিই জায়গা করে নেয়, তাকেও জায়গা করে দেয়। সুটকেস হাতে নিয়ে সে এক হ্যাঁচকায় শূন্যে উঠে যায়। তলায় পিলপিল করছে মুখ। হঠাৎ একটা মুখ চেনা-চেনা লাগে। পেছনের লম্বা সিটটার ওপর সে বডি ফেলে দেয়। সুটকেসটা রেখে জায়গাটা রিজার্ভ করে, তারপর চেনা মুখের তল্লাশে যায়। অন্ধের মতো হাত চালিয়ে দেয় মুখের, কাঁধের, চাঙড়ে। হাতে এসে যায় একটা কাঁধ। তার পিছনে পিঠ, দুই কাঁধের তলায় শক্ত লোহার মতো হাতটা দিয়ে সে চাগিয়ে তোলে, “যা চট করে লেডিজ সিটে জায়গা নে।”

“ভাগ্যিস তুই ছিলি!”

“বলছিস?”

“তা না তো কী! আমার সাধ্য ছিল এই ভিড় ভেদ করে বাসে ওঠা? তিনটে ছেড়েছি অলরেডি।”

“কোথায় চললি?”

“কোথায় আবার, কলেজে। তুই?”

“দু’বার ছেঁচড়ে এবার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েছে। যাচ্ছি শিবপুর।”

“কংগ্রাচুলেশন্স।”

সোমবারের রোদ একেবারে ঝক্‌কাস। যেন এরিনায় দাঁড়িয়ে বক্সার। চকচকে মাস্‌ল থেকে যেন তেল গড়িয়ে পড়ছে। হলুদ রঙের ট্রাঙ্কটা বাঘছালের মতো এঁটে আছে। হাতে লাল রঙের গ্লাভ্স। স্পিরিটটা ধাঁ করে ভেতরে ঢুকে যায়। তার জায়গা একেবারে পেছনের লম্বা সিটে, ব্যাকপ্যাকটা কোলে, সুটকেস নীচে, দু-পায়ের ফাঁকে। পিছলে যাচ্ছে পিলপিলে রাস্তা। বাসের পিছন-চাকার গজরানি ঠিক তার নীচে। পিছন ফুঁড়ে শালা শিরদাঁড়া বেয়ে সোজা ব্রহ্মতালুতে পৌঁছে যাবে। চাপের নাম বাবাজীবন। তোরা দিবি না, আমিও না নিয়ে ছাড়ব না। ঠিক মেরে দিয়েছি, “ম্যঁয় নওজওয়ান হুঁ। সমঝ লে তুরন্ত। যো চাহুঙ্গা ওহি কবজেমে লাউঙ্গা।”

ঠিক সামনে এক ঘাড়-নড়নড়ে বুড়ো দাঁড়িয়ে। কেষ্টনগরের পুতুলের শোকেসে মানাত ভাল। মেলা-ফেলায় ঢেলে বিক্‌কিরি হয়। পাশের ছেলেটি উঠে দাঁড়াল, “বসুন সার।”

“না, না, ঠিকাছি ঠিকাছি।”

“আমি জিষ্ণু সার, জিষ্ণু মণ্ডল। চিনতে পারছেন না?”

“ও ছাত্র! একেবারে আত্মনেপদী। তবে তো রাইট আছে।” নড়বড়ে বসে পড়ল।

“জিষ্ণু মণ্ডল, কোন্ ইয়ার?”

ছেলেটা ঝুঁকে পড়ে বলল, “মিলেনিয়াম ব্যাচ বলতেন তো আমাদের, ভুলে গেলেন?”

“বর্ষে বর্ষে দলে দলে, বুঝলে না? দুঃখ পেয়ো না, মুখখানা প্লেস করতে পারছি। মাধ্যমিকের ছেলে, চার বছরে দাড়ি গোঁফ গজিয়ে এমন হয়ে যায় না। তা বাবা, আমি যদি তোমার মাস্টারমশাই না হতুম, কী করতে?”

“তা হলেও উঠে দাঁড়াতুম সার! একথা আবার জিজ্ঞেস করছেন?”

“না দেখো, বাসে লেডিজ সিট আছে ঠিক আছে। গুঁতোগুঁতির মধ্যে লেডিজদের না দাঁড়ানোই ভাল। প্রতিবন্ধীদের সিট আছে, বাচ্চাদের সিটও দেখি, আহা পিঠে এক একটা পাপের বোঝা নিয়ে টলছে বাচ্চাগুলো। একটু ব্যবস্থা না করলে হয়? কিন্তু এই অ্যামনেস্টির ডেমোক্র্যাসিতে বুড়োদের কথা কেউ ভাবেনি কেন বলো তো?”

“ঠিক বলেছেন সার। কেন করে না, কে জানে?”

“আমি জানি জিষ্ণু। এই জন্যে করে না যে, এ ব্যাটার খোল থেকে ওয়ার্কিং ইয়ার যতটা পাওয়ার, নিংড়ে পাওয়া হয়ে গিয়েছে। এখন এ ব্যাটা ভুষি মাল। হয়তো বা পেনশনও খাচ্ছে। দে ব্যাটার লাইফ ডিফিকাল্ট করে। বসতে দিসনি, খেতে দিসনি, ওষুধ-বিষুধ আক্ৰা করে রাখ, যত তাড়াতাড়ি ট্যাঁসে,” বলতে-বলতে হাসলেন ভদ্রলোক।

“আপনি সেই এক রকমই রয়ে গেলেন সার,” জিষ্ণু বলল। “ইয়ংম্যানদের উপর আস্থা রাখছে সরকার। এটুকু তারাই করবে। গুড সেন্স।”

“গুড সেন্স ইয়ংম্যানদের? তুমি হাসালে জিষ্ণু। আমরা বাসে উঠলে লাস্টে উঠি। ততক্ষণে সিট সব অকুপায়েড। সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ইয়ংম্যানরা ভীষণ ব্যস্ত হয়ে কানে একটা গয়না পরে ফেলে, মোবাইল। এত টক-টাইম কোত্থেকে পায় বলো তো আজকের ব্রেকনেক কমপিটিশনের যুগে? আর এক টাইপ আছে, হঠাৎ বড় প্রকৃতি প্রেমিক হয়ে ওঠে। পাশ দিয়ে জীবন বয়ে চলেছে কিনা!”

তাকেই টার্গেট করছে নাকি কেষ্টনগর? সে নড়েচড়ে বসে। টাইট হয়ে গিয়েছে জায়গাটা। কিন্তু উঠে দাঁড়ালেও তার ব্যাকপ্যাক আর সুটকেশ তো উঠে দাঁড়াবে না। তা ছাড়া, মাথাখানাও ছাদে ঠেকবে। স্পন্ডিলোসিস বাধাবার ইচ্ছে তার নেই। এই দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, তালতাল বাইসেপস, ট্রাইসেপস, অ্যাব্স, শক্তি, সাহস এসব এ যাত্রায় স্যাক্রিফাইসের জন্য নয় দাদু। আমি ‘গৌতম বুদ্ধু’ কিংবা ‘মোহনদাস বকরম চাঁদ’ কিংবা আপামর বাঙালির ‘বোকাজি’ নই। এগুলো যুদ্ধজয়ের জন্য, ক্লিন ভিকট্রি একটা। কোথায়? কখন? জানি না। যখনই হোক, যেখানেই হোক, ইন দ্য মিনটাইম ক্ষুদিরাম স্ট্যাচুতে থাকুন।

সামনে গাদাগাদি ভিড়। বাবাইটা বসতে পেল কি না কে জানে! তখন তো ফাঁকা লেডিজ সিটের দিকেই ওকে ড্রপ করেছিল। সুযোগটা যদি না নিতে পেরে থাকে, তো নাচার। আরে, ওই তো বাবাই যাচ্ছে। নেমে গিয়েছে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে। এখন দোপাট্টা বাগিয়ে হাঁটছে দেখো, খুশি খুশি লাগে। স্যাক্রিফাইস নয়, কিন্তু টুক করে কাউকে হেল্‌প করে দিতে পারলে হেভি লাগে।

কিছুদিন আগে পর্যন্তও সে ছিল অ্যাংরি ইয়ংম্যান। অ্যাংরি এবং হাংরি। শালা লিস্টটা প্রত্যেকবার তিন মানুষ উপরে উঠে থ্যাপাং গেড়ে বসে যায়, কেন রে বাবা? পিতৃদেব বলেছিলেন, যেমন বিএসসি-টা করে যাচ্ছিস করে যা। ঠিক একটা কিছু হয়ে যাবে। ‘হওয়াচ্ছি,’ সে বলেছিল মনে মনে। দিন-রাত হাতড়ে অবশেষে থ্যাঙ্কস টু অদ্রি, পাকড়াও হল হিতেন সার। অনেক-অনেক দূর, মাল্লু নেবেও বিস্তর, কিন্তু টুইশান দেবে এ ওয়ান। দশটার মধ্যে ছ’টা চোখ বুজে এসে যাবে। উপকার করতে হলে অদ্রির করব। কেননা, সে উপকার করেছে। করব বাবাইয়েরও, কেননা সে পাশের রানাঘাটের মেয়ে। আমারই মতো, তার উপর মেয়ে। এর মধ্যে ঘাড় নড়নড়ে বুড়োফুড়ো আসে না।

চিৎপুরে নেমে গেল, বাঁচা গেল। পাশে যেন আস্ত একখানা শজারুর কাঁটা বসে ছিল। সেই জিষ্ণু না বিষ্ণু, বসে গেল তক্ষুনি। সে থাই দুটো চেপে বসে অগত্যা। সোমবারের রোদ্দুর জানলা গলিয়ে উঠে এসেছে হাতে কোলে কাঠবেড়ালির মতো। ভালবাসার চোখে সে চেয়ে থাকে হাত-ভর্তি রোদ্দুরের দিকে। মনে-মনে বলে, তুই উজ্জ্বল আমার মতো, নওজোয়ান আমার মতো। তফাতের মধ্যে, তুই আজকের মধ্যেই আস্তে আস্তে বুড়ো হয়ে, ফিকে হয়ে মরে যাবি। আমি কিন্তু বেঁচে থাকব। জোশ নিয়ে বিন্দাস বাঁচব। যেদিন মরবার, মরব ঠিকই। মানুষ নশ্বর জীব। কিন্তু অমন ঘাড় নড়নড়ে বুড়ো হওয়ার আগে শালা আমি টাটা সেন্টারের ছাদ থেকে গোটা পৃথিবীটাকে বগলদাবা করে ঝাঁপ দেব।

ব্রিজে উঠছে বাসটা একটা ঝাঁকি দিয়ে। এপারে গঙ্গা, ওপারে গঙ্গা। মেজাজটা কাটা ঘুড়ির মতো সাঁ-সাঁ করে উড়ে গেল। আহ! পাশ থেকে জিষ্ণু বলল, “এই হাওয়াটার জন্যেই লম্বা জার্নি, গাদাগাদি ভিড় সব মাইনাস হয়ে যায়।”

“কবি-টবি নাকি?”

“কবি ছাড়া আর কারও গঙ্গার হাওয়া নিয়ে কথা বলার রাইট নেই বলছেন?”

হাঃ হাঃ, সে এবার গলা ছেড়ে হাসে। বলে, “ও মস্তানরা তো সেই রকমই ক্লেম করে। হাওয়া, ফুল, পাখি, প্রেম, বিদ্রোহ সব ওদের একার।”

“আমি জিষ্ণু। মেকানিক্যাল, সেকেন্ড ইয়ার।”

“আরে একই দিকে যাচ্ছি, আমি উজ্জ্বল। সবে ঢুকছি। এখনও হস্টেলের দেওয়ালের রং জানি না,” হাত বাড়িয়ে দিল জিষ্ণু। ঝাঁকানি দিল সে আচ্ছাসে। অবাক হয়ে তাকাল ছেলেটা, “ব্যায়াম করো?”

“তবে?”

তার উজ্জ্বল দাঁতের সারিতে জুলাইয়ের রোদ পিছলে গেল। বাস এসে দাঁড়াল। ফল গিজগিজ, পেচ্ছাপের গন্ধ’অলা, মাথায় গামছা, কাঁধে গামছা টার্মিনাসে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25
Pages ( 1 of 25 ): 1 23 ... 25পরবর্তী »

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress