কাঁটালতা
রেণুকুটে আমাদের একটা বাড়ি ছিল পৈতৃক বাড়ি। বাবা ছিলেন সরকারী ডাক্তার, কর্মজীবনে বিহার-প্রবাসী। ছোটনাগপুরের জল-হাওয়ায় থাকতে থাকতে সেখানকার জল-বাতাস তাঁর মনে ধরে গিয়েছিল; পাহাড় জঙ্গল মাঠ আর শুকনো আবহাওয়া তিনি পছন্দ করতেন। চাকরি থেকে অবসর নেবার পর রেণুকুটে তিনি বাংলো ধরনের একটা বাড়ি করেন, বেশ বড়ো বাড়ি; ফল-ফুলের বাগান করেন; আর জলের দরে অনেকটা মাঠ-জঙ্গল কিনে রাখেন। বাবার অবশিষ্ট জীবন রেণকুটেই কাটে। বাবা মারা যাবার পর মা জায়গা-নাড়া করেনি। চাকর-বাকর আর প্রতিবেশীদের ভরসায় মা বছর চারেক আরো বেঁচে ছিল, তারপর মারা যায়। আমরা দু’ভাই, এক বোন। দাদা আর আমি খানিকটা রাঁচি বাকিটা পাটনায় মানুষ, দিদি রাঁচিতে। দাদা পাটনা থেকে লেখাপড়া শেষ করে সরকারী কাজ নিয়ে নাগপুরের দিকে চলে যায়; আমি বাংলাদেশে। দিদির বিয়ে হয়েছিল কাশীতে।
মা মারা যাবার পর রেণুকুটের বাড়ি, বাগান, জঙ্গল বিক্রী করে দেবার কথা আমাদের মধ্যে উঠেছিল। বিষয়টা নিয়ে পরে কেউ ভাবিনি। তিনজনে তিন জায়গায় এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিলাম যে, চিঠিপত্রেই আমাদের যোগাযোগটা রাখতে হতো; দেখা-সাক্ষাৎ বড় হতো না। মাঝে মাঝে চিঠিতে বাড়ি-টাড়ি বেচার কথা উঠত; কিন্তু ওই—কথাটা উঠতই শুধু, আমরা তেমন গা বা গরজ করতাম না। আট-দশ বছর এইভাবে কেটে গেল, শেষে শুনলাম আমাদের রেণুকুটের বাড়ি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, বাগান জঙ্গল হয়ে গেছে, আর জঙ্গলের নানা জায়গা দখল হয়ে যাচ্ছে। দাদার কিছু বাড়তি টাকার দরকার ছিল, মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলেছে ; আমিও বাংলাদেশে একটু জমি-জায়গা কেনার কথা ভাবছিলাম; রেণুকুটের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রায় ছিলই না আর, কাজেই পৈতৃক সম্পত্তি এবার বেচে দেবার কথা স্থির করে আমরা রেণুকুটে এলাম। রেণুকুটে বাবার বন্ধু মহাদেবপ্রসাদের ছেলে জগদীশবাবু ছিলেন। তিনিই আমাদের তরফে বেচাবেচির কথাবার্তা বলেছিলেন। জগদীশবাবুর চিঠি পেয়ে আমরা রেণুকুটে হাজির হলাম। দাদা এল ছিঁদোয়াড়া থেকে, আমি কলকাতা থেকে। আর দিদি-জামাইবাবুকে কাশী থেকে আনালাম।
মা মারা যাবার পর আমরা এক-আধবার রেণুকুটে গিয়েছি, তারপর আর যাওয়া হয়নি। অনেককাল পরে যাচ্ছি বলে আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম, শীতেই যখন যাচ্ছি তখন সপরিবারে সকলে যাব, মাসখানেক থাকব, তাতে বেড়ানো, স্বাস্থ্যোদ্ধার, পারিবারিক দেখাসাক্ষাৎ এবং কাজের কাজ সবই হয়ে যাবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের পূর্বপুরুষের ভিটে শেষবারের মতন দেখে আসুক—এ-রকম একটা ইচ্ছেও আমাদের ছিল।
আমাদের পারিবারিক সদ্ভাব ছিল। দূরে দূরে থাকার দরুন পরস্পরকে আমরা দেখার আকাঙ্ক্ষা করতাম, ভালবাসতাম। দাদা এবং আমার মধ্যে বাল্যকাল থেকেই সৌহার্দ্য ছিল, আমরা বছর চারেকের ব্যবধানে জন্মেছি, মাঝখানে ছিল দিদি, দুই ভাইয়ের মধ্যে সাঁকোর মতন একটু বৈচিত্র্য বোধহয়। ছেলেবেলায় আমরা ছড়া করে দিদিকে বলতাম: ‘দু’ দিকে দুই লাট মধ্যিখানে মাঠ’; দিদি ওটা উলটে দিয়ে কলা দেখিয়ে বলত : ‘দু’ দিকে দুই মাঠ, মধ্যিখানে লাট।’ …তা দিদি আমাদের লাটই ছিল, অন্তত লাটসাহেবের মেজাজ পেয়েছিল। আদরে আদরে বোধহয়। আমরা লাটানীকে খুব ভালবাসতাম।
রেণুকুটের বাড়ি আর সম্পত্তি বেচবার সময় দিদিকে আনানোর একটা কারণ ছিল। দাদা আর আমার মধ্যে এই যে পৈতৃক সম্পত্তি সমানভাগে ভাগ-বাটরা হবে, তাতে দিদি আমাদের ধর্মত সাক্ষী থাকবে। আমরা দু’ ভাই কেউ কাউকে কিছু বলতে পারব না, বলব না; দিদি আমাদের দু’ তরফ দেখে যাকে যা করতে বা নিতে বা দিতে বলবে, আমরা তাই করব। অবশ্য আমরা চেয়েছিলাম দিদি আমাদের কাছ থেকে কিছু নিক। কিন্তু দিদি তা নেবে না। জামাইবাবুরা খুবই সচ্ছল পরিবারের লোক, দিদি আমাদের দু’ ভাইকে সর দিতে চায়, দিয়ে তৃপ্তি পেতে চায়।
রেণুকুটের পুরনো বাড়ি ঝাড়া-মোছা করে, আমরা দু’ভাই এবং বোন যখন সপরিবারে গুছিয়ে বসলাম তখন বাড়িটা গমগম করতে লাগল। পৌষ মাস, প্রচণ্ড শীত, খটখটে শুকনো মাঠঘাট জঙ্গল, গাঢ় সুন্দর তপ্ত রোদ, মিষ্টি জল, বাড়িভরা ছেলেমেয়ের দল, গিন্নীরা দু’জন, দিদি—এতগুলো লোকের একত্র হওয়ার যেরকম হই-হই হাসি হুল্লোড়, দলবেঁধে বেড়ানো, আড্ডা, গল্পগুজব চলছিল, তা দেখেশুনে মনেই হবে না, আমরা বৈষয়িক কারণে রেণুকুটে এসেছি ; বরং ধারণা হবে, শীতের ছুটি কাটাতে সমস্ত পরিবার একত্র হয়েছি। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সেইভাবে দিন কাটাচ্ছিল, গিন্নীরাও; আমরা জগদীশবাবুর সঙ্গে সম্পত্তি বিক্রির পাঁচ রকম ঝকমারি কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
দেখতে দেখতে পৌষ মাস শেষ হয়ে এল। আমাদের হাতের কাজও মিটে এসেছিল। উকিলবাড়িতে দলিল তৈরি হচ্ছিল, মাঘের প্রথম দিকেই কোর্ট-কাছারি করে বাকিটুকু শেষ হবে। হাতে আর আমাদের কাজকর্ম ছিল না, দুশ্চিন্তা উদ্বেগ ছিল না, সোলার টুপি মাথায় পরে লোক দিয়ে জঙ্গল মাপামাপির ঝঞ্ঝাটও আর পোয়াতে হচ্ছিল না। এতদিন আমরা দু’ভাই, কখনো-সখনো দিদিও, কাজকর্ম ও প্রয়োজনীয় কথাবার্তার জন্যে অন্যদের সঙ্গে তেমন ভাবে মিশতে পারছিলাম না। এবার সে অবসর হলো।
অবসর হলে দাদাই বলল, ”চল রে, একদিন আমাদের জঙ্গলে গিয়ে সারা দিন কাটিয়ে আসি। এই তো শেষ।”
ছেলেমেয়ের দল কাছে বসে তাস খেলছিল, স্ক্রু না কি যেন; গোপা একটা বই পড়ছিল; জামাইবাবু বসে বসে সিগারেট পাকাচ্ছিল; দাদার কথায় সকলেই কান দিল, দিয়ে তাকাল।
সোনা বলল, ”পিকনিক না এমনি বেড়ানো?”
দাদা হেসে জবাব দিল, ”সারাদিন কাটাতে হলে খাওয়া-দাওয়া করতে হবে না! হাঁড়িকুড়ি চাল-ডাল বেঁধেই যাব।”
গোপা বলল, ”কিসে যাব বাবা?”
”হেঁটে, দাদা বলল, ”আমাদের জঙ্গল তো সামনের ওই মাঠ থেকে শুরু, তবে যেখানে যাব সেটা একেবারে জঙ্গলের শেষ। হেঁটেই যাওয়া যাবে।”
সোনা বলল, ”জেঠামণির যেমন কথা, হেঁটে হেঁটেই যদি যাওয়া, তবে বাপু, হাঁড়িকুড়ি বয়ে নিয়ে যাওয়া কেন! বাড়ি থেকে খেয়ে বেরুলেই হয়!”
বড়ো খোকা, মানে দাদার ছেলে বলল, ”তোর খালি স্টমাকের ফিকির। তুই বাড়ি থেকে লোডেড হয়ে যাস; আমরা জঙ্গলেই উনুন জ্বালব।”
সোনা জবাবে জিব ভেঙিয়ে বলল, ”থাম, তুই, উনুন জ্বালব! উনুন কি, তুই তো চুলহা বলবি।”
বড়ো খোকা আর সোনায় বেধে গেল। সব সময়েই বাধছে। একেবারে সমবয়সী।
জ্যোতিদা, মানে জামাইবাবু বলল, ”কথাটা মন্দ বলোনি বড়দা, চলো বুড়ো বয়সে একবার চড়ুইভাতি করে আসি।…আমার বিয়ের পর একবার গিয়েছিলাম সব, মনে আছে? তুমি ফক্স আর টাইগারের মধ্যে গোলমাল করে ফেলেছিলে…” বলতে বলতে জ্যোতিদা হো-হো করে হাসল। দাদা আর আমিও হেসে উঠলাম। ভাগ্নে রবি বসে ছিল, সে এবং আমাদের ছেলেমেয়েরাও হাসতে লাগল।
জ্যোতিদা ঠাট্টা করে দাদাকে বড়দা আর আমাকে ছোড়দা বলে ডাকে; নয়তো দাদাকে নাম ধরেই ডাকে—বসন্ত। আর আমাকে প্রশান্ত বলে ডাকার অধিকার তো তার আছেই। হাসাহাসির মধ্যেই জ্যোতিদা বলল, ‘ব্যবস্থাটা তাহলে তোমাদের লাটানীকেই পাকা করতে বলি। গোপা, তোমার পিসিমাকে ডাকো।”
দিদির নাম সুনয়নী। আমরা ছেলেবেলায় তার লাটসাহেবী মেজাজের জন্যে বলতাম—লাটানী; সেই নাম তার এখনো জ্যোতিদার মুখে মাঝে মাঝে শোনা যায়।
গোপা গিয়ে দিদিকে ধরে আনল।
জ্যোতিদা জঙ্গলে চড়ুইভাতি করতে যাবার কথাটা গুছিয়ে বলল দিদিকে; তারপর হেসে বলল, ”লাটানী, এই হলো আমাদের লাস্ট পিকনিক টুগেদার। …চলো সমবেত হওয়া যাক। সমবেতা যুযুৎসবঃ—”
আমি হেসে বললাম, ”যুযুৎসবঃটা কি জ্যোতিদা?”
জ্যোতিদা পাকানো সিগারেট ঠোঁটে ঠেকিয়ে আগুন জ্বালল।
দুই
পরের দিন একটু বেলায় বেশ বড়সড় একটি দল করে আমরা বেরুলাম। দাদা বউদিরা পাঁচজন—কর্তাগিন্নী আর তিন ছেলেমেয়ে; আমরা চার—আমি আর নীহার বাদে দুই ছেলেমেয়ে; দিদিরাও চার—দিদি জ্যোতিদা আর দুই ছেলে। চাকর আর পাঁড়ে ছিল। জগদীশবাবু একটা গোরুর গাড়ির ব্যবস্থা করে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন; সেই বাড়িতে উনুন, কাঠ, চাল-ডাল, তরিতরকারি আর দু’ কলসী জল চাপিয়ে চাকর আর পাঁড়ে চলে গেল, তাদের সঙ্গে থাকল বড়ো খোকা আর পূর্ণ।
দাদা মোটামুটি একটা জায়গার কথা বলে দিয়েছিল, বলেছিল, শাল জঙ্গলের পর দেখবি পশ্চিম ঘেঁষে একটা বালিয়াড়ির মতন আছে, সেখানে বেশ ছায়াটায়া দেখে জায়গা বেছে নিবি। তোরা জিনিসপত্র নামাতে আমরা চলে আসব।
আমরা বেশ চড়া রোদেই বেরুলাম; পৌষের রোদ এত গাঢ় ও তপ্ত যে সকাল ফুরোবার আগেই মাঠঘাট থেকে হিম শিশির কুয়াশা শুকিয়ে সব খটখটে হয়ে যায়। আমাদের বেরুতে বেরুতে প্রায় দশটা বেজে গিয়েছিল, রোদ তখন মস্ত একটা ফুলঝুরির মতন যেন জ্বলছে চারপাশে, চোখে সামান্য লাগছিল। তবু পৌষের বাতাস আর শীতের দরুন রোদটা আরামদায়ক লাগছিল। খানিকটা পরে আমাদের—বুড়োদের ছাতা খুলতে হল, না হয় সোলার টুপি পরে নিতে হল। ছেলেমেয়েদের এসবে ভ্রূক্ষেপ ছিল না; তারা অনেকটা আগে আগে চলছিল এবং থেকে থেকে গাছপালার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছিল।
দাদা, জ্যোতিদা আর আমি আগে আগে, পেছনে বউদি, দিদি আর নীহার। দাদা মাথায় সোলার টুপি পরেছিল, আমি আর জ্যোতিদা ছাতার তলায় মাথা ঢেকে চলেছি। পেছনে দুটো ছাতার তলায় বউদি, দিদি আর নীহার।
যেতে যেতে দাদা ছেলেবেলার নানান গল্প বলছিল, আমার কিছু কিছু মনে পড়ছিল, কিছু বা পড়ছিল না। মাঝে মাঝে দিদির ডাক পড়ছিল। দাদা নিজের স্মৃতিশক্তির সঙ্গে দিদির স্মৃতি মিলিয়ে নিচ্ছিল। দেখলাম, আমাদের মধ্যে দাদারই স্মৃতিশক্তি বেশ প্রখর; তার ছোটখাটো তুচ্ছ অনেক ঘটনাই মনে আছে।
দাদা প্রায় একাই গল্পে গল্পে আমাদের নীরব রেখে অনেকটা পথ এগিয়ে নিয়ে এল। মাঠ বা উঁচুনীচু কাঁকর ছড়ানো প্রান্তর, কিছু সবুজ ক্ষেতখামার ছাড়িয়ে শেষে আমরা জঙ্গলে এসে পড়লাম। জঙ্গলের এদিকটায় নিম আর গরগলের ঝোপটাই বেশি, কিছু কাঁঠাল গাছ। বনের মাথায় বা চোখে লাগছিল না। আমরা ছাতা বন্ধ করে ফেললাম। মেয়েরাও।
একই সঙ্গে, দু’হাত হয়তো আগুপিছু হবে, আমরা আর মেয়েরা হাঁটছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে জ্যোতিদা বলল, ”বসন্ত, সেই কুয়াটা কোথায়?”
”কোন কুয়া?” দাদা জিজ্ঞেস করল, ”কুয়া একটা শাল জঙ্গলে আছে।”
”আরে না, সে কুয়া নয়; আর-একটা কুয়া ছিল শুনেছি—শ্বশুর-মশাই বুজিয়ে ফেলেছিলেন।”
দিদি ঠাট্টা করে বলল, ”সর্বনাশ, সে কুয়ার কথা তোমার এখনো মনে আছে।”
জ্যোতিদা হেসে জবাব দিল, ”থাকবে না; তুমি ওই কুয়ার মধ্যে ঝাঁপ খেতে গিয়েছিলে!”
দিদি বলল, ”থাক, বুড়ো বয়সে আর রঙ্গ করো না!”
বউদি হেসে বলল, ”ঠাকুরঝি ঝাঁপ খেতে যাবার আগেই তো আপনি দড়িদড়া নিয়ে গিয়ে বসেছিলেন ঠাকুরজামাই, তাই না?”
জ্যোতিদা জবাবে হেসে হেসে বলল, ”আপনি একটু ভুল শুনেছেন, আমি দড়িদড়া নিয়ে যাব কেন, নিজেই গিয়ে কুয়ার তলায় বসেছিলাম।”
নীহার খিল খিল করে হেসে উঠে মুখে আঁচল চাপা দিল। বউদি আর দিদিও হাসছিল।
জঙ্গলের মধ্যে পাখিরা যে কোথায় ডাকছে বোঝা যায় না। চিক চিক চিকির শব্দ উঠছিল, কখনো কখনো চিকন শিসের মতন কিছু ডাকছিল, মাথার ওপর পলকা ডালের পাতা নড়ছিল, আমাদের পায়ের তলায় শীতের শুকনো পাতা। ডালপালার আড়াল দিয়ে রোদ এসে চমৎকার ঝাফরি করে রেখেছিল। আমরা পরম আলস্যে গল্প করতে করতে হাঁটছিলাম।
বউদি বলল, ”বিয়ের পর আমার জঙ্গল দেখা হয়নি; এই প্রথম এই শেষ।”
নীহার বলল, ”আমারও।”
জ্যোতিদা বলল, ”শ্বশুরের ভিটেতে ছেলের বউরা তো আর থাকল না, থাকলে দেখত!”
বউদি জবাবে বলল, ”সে দোষ বউদের না ছেলেদের? তুমিই বলো ঠাকুরঝি?”
দিদি বলল, ”দোষ কারো নয়, সবই আমাদের কপাল।”
নীহার হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, তার গায়ের শালের সঙ্গে একটা কাঁটালতা জড়িয়ে গিয়েছিল। এরকম কাঁটাগাছ সচরাচর চোখে পড়ে না। শুকনো মরা হরিতকী গাছের গা বেয়ে বেয়ে গাছটা উঠেছিল। দেখলেই বোঝা যায়, কাঁটালতা জড়িয়ে জড়িয়ে মস্ত একটা কাঁটাগাছ তৈরি হয়ে গিয়েছে—বড় বড় পাতা আর বাবলা কাঁটার মতন কাঁটা। অনেকটা ঢেকে ফেলেছিল, প্রায় রাস্তা জুড়ে লতায় পাতায় ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গাছ থেকে গাছে। নীহার সামান্য অসাবধান হয়েছিল, তার শাল কাঁটালতায় আটকে গেল।
নীহার দাঁড়াল। বউদি বলল, ”দাঁড়া, নড়িস না, খুলে দিচ্ছি।” ছোট জাকে বউদি তুই বলত। এটা পুরনো অভ্যেস।
বউদি পারল না। নীহারের গায়ের শালটায় চওড়া করে কাজ ছিল, কাশ্মীরী কাজ; এমন বেয়াড়াভাবে ঝুলন্ত কাঁটালতার একটা ডগা নকশার সুতোর সঙ্গে আটকে গিয়েছিল যে, খোলবার চেষ্টা করে বউদি আরো যেন জড়িয়ে ফেলল। তারপর অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ”দূর ছাই, এ যে বিদকুটে কাঁটা বাপু, আরো গণ্ডগোল হয়ে গেল। কই ঠাকুরঝি, তুমি দেখো।”
দিদি খুব সাবধানে এবং বিচক্ষণতার সঙ্গে কাঁটা ছাড়াবার চেষ্টা করল। পারল না। নীহার প্রথমেই বোধহয় গণ্ডগোল করে ফেলেছিল।
শেষে জ্যোতিদাই কাঁটাটা ছাড়িয়ে দিল।
কাঁটা ছাড়ানো হয়ে গেলে নীহার বলল, ”বাব্বা, এরকম কাঁটাগাছ থাকলে জঙ্গলে হাঁটাই মুশকিল।”
আমরা আবার ঝোপ-জঙ্গলের বাইরে ফাঁকায় এসে পড়েছিলাম। আমলকির চারা চারপাশে, কিছু তেঁতুল ঝোপ; কালো কালো কটা পাথর; সামনে ঢালু জমি নেমে গেছে, দূরে আমাদের ছেলেমেয়েদের দেখা গেল, রোদের মধ্যে দিয়ে চলছে—ওরা অন্যপথে এসেছে।
জ্যোতিদা পথের মধ্যে দাঁড়াল হঠাৎ, কালো কালো পাথরগুলো দেখল, এদিক-ওদিক তাকাল। তারপর বলল, ”আমার মনে হচ্ছে বসন্ত, সেই কুয়াটা এখানেই ছিল।”
দাদা এদিক ওদিক তাকাল, বলল, ”হতে পারে। এই পাথরগুলো দেখে আমারও মনে হচ্ছে এদিকে কোথাও ছিল।”
বউদি ঠাট্টা করে বলল, ”ঠাকুরজামাই যে কুয়াটার কথা ভুলতে পারছেন না!”
”কি করে ভুলি বলুন,” জ্যোতিদা জবাব দিল, ”বিয়ের পর আপনার ঠাকুরঝি ওই কুয়ার জন্যে আমায় কতকাল যে ঘুমোতে দেয়নি।”
দিদি জ্যোতিদাকে ভর্ৎসনা করে বলল, ”বাজে কথা বলো না; তাড়াতাড়ি চলো, রাস্তায় দাঁড়িয়ে কুয়া খুঁজতে হবে না এখন। কত বেলা হয়েছে খেয়াল করেছ!”
জ্যোতিদা হাসল।
যেতে যেতে আমি বললাম, ”জ্যোতিদা, আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, কুয়াটা বোজাবার পর চারপাশে কাঁটা ফেলা হয়েছিল, ওই কাঁটালতার ঝোপ বোধ হয় সেই থেকে। …..এখন আর কুয়াটা দেখা যাবে না।”
দেখার কথাটা অবশ্য এখানে অবান্তর ছিল। কবে একটা জঙ্গলের কাঁচা কুয়া বোজানো হয়ে গেছে, এতদিনে তা দেখা সম্ভবও নয়, ঘাসপাতা বুনো লতায় এখন কুয়ার মুখ জঙ্গল, বোঝাও যাবে না এখানে কিছু ছিল।
নীহার বলল, ”এত জায়গা থাকতে এই জঙ্গলের মধ্যে কুয়া কেন?”
”বাবার খেয়াল”, দিদি জবাব দিল।
দাদা বলল, ”বাবার মাথায় মাঝে মাঝে উদ্ভট সব খেয়াল চাপত। লোকে দশটা সৎ পরামর্শ দিলেই যে বাবা সেই পরামর্শ মতন কাজ করতেন এমন নয়, কিন্তু কেউ যদি অসম্ভব একটা কথা বলত, বাবা অমনি সেটা সম্ভব করতে বসতেন। শুনেছি, কে নাকি বলেছিল—অতটা জঙ্গল ফেলে না রেখে খানিকটা জমি করে নিতে। তা বাবা, সামনের কয়েক বিঘে জায়গার জঙ্গল পরিষ্কার করিয়ে ক্ষেতখামার করতে বসেছিলেন। কুয়া খুঁড়িয়ে ছিলেন জলের জন্যে, একটা চালাও তুলেছিলেন। মাথায় খোলার চাল। সবই গেছে। জঙ্গলে আমি কিছু ঢেঁড়স গাছ ছাড়া আর কিছু হতে দেখিনি।”
”অনেক পেঁপে গাছ হয়েছিল”, আমি বললাম।
দাদা মাথা নাড়ল।
বউদি হেসে বলল, ”ঠাকুরজামাই কি বিয়ের পর নতুন কিছু দেখেছিলেন?”
জ্যোতিদা হাসল। সিগারেটটা নতুন করে জ্বালাতে জ্বালাতে বলল, ”নতুন আর কি দেখব, ওরা যা দেখেছে আমিও তাই, সামান্য হয়তো বেশি। কিন্তু সেকথা থাক। ….ফেরার সময় বিকেল হয়ে যাবে, খুব সাবধানে ফিরতে হবে, কাঁটায় না আমাদের জড়িয়ে ধরে।”
জ্যোতিদা যে কি ভেবে কথাটা বলল আমরা বুঝলাম না। দিদি যেন বিরক্ত হয়ে জ্যোতিদাকে একটা ধমকই দিল, ”তুমি কি বউদিকে ভূতের ভয় দেখাচ্ছ নাকি?”
জ্যোতিদা হাসল। ”আরে না, না; ভূতের ভয় দেখাব কেন! ওই কাঁটা তোমারও লাগতে পারে, আমারও পারে; বসন্তের পারে, প্রশান্তরও পারে।”
ততক্ষণে আমরা সামনে শাল জঙ্গলটা দেখতে পেয়ে গেছি।
তিন
পূর্ণরা জায়গাটা ভালই বেছে ছিল। শাল জঙ্গলের শেষে বালিয়াড়ির কাছেই। ওটা ঠিক বালিয়াড়ি নয়, খানিকটা তফাতে যে চাঁচি-পাহাড়, তারই একটা ভাঙা ঢেউ এসে এ-পর্যন্ত ছড়িয়ে গিয়েছিল। বুনো গাছে ভর্তি, আর পাথরের রাশি। ওপাশটায় বালিয়াড়ির দক্ষিণে পাহাড়ী নদীর একটা ধারা, বালি আর পাথরের চাঁই, মাঝমধ্যিখান দিয়ে জলের যেন ফিতে পড়ে আছে। জায়গাটা খুবই মনোরম।
গাছের ছায়ায় উনুন ধরিয়ে দিয়ে পূর্ণরা চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছিল। আমাদের আসতে একটু সময় লাগলেও ছেলেমেয়েদের লাগেনি। তারা নিশ্চয় সোজাসুজি এসেছে, পথ ধরে নয়, আমরা একটু ঘুর-পথে। ওরা খানাখন্দ ডিঙোতে পারে, মাঠঘাট ভাঙতে পারে, আমরা পারি না। দাদার বয়েস পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে, দিদি পঞ্চাশ ধরছে প্রায়, আর আমার আটচল্লিশ। জ্যোতিদা দাদার চেয়ে দু-চার বছরের বড়ই। স্বাস্থ্য জ্যোতিদারই সবচেয়ে ভাল, দাদারও খারাপ নয়। তবে দাদার মাথায় বিরাট টাক পড়ে গিয়ে আর দাঁত নড়ে দাদাকে বেশ বুড়ো করে দিয়েছে। জ্যোতিদা লম্বা হলেও চওড়া নয়, ছিপেছিপে। স্বাস্থ্য আমারই সবচেয়ে খারাপ, আধিব্যাধিতে নিত্যই ভুগছি। বউদির চেহারা মোটাসোটা, মাথার চুলে সাদাটে ছোঁয়া লেগেছে, চোখমুখে, আজও লক্ষ্মীশ্রী লেগে আছে; দিদির চেহারা তো এখনো চোখ চেয়ে দেখার মতন; যেমন পরিষ্কার কাটাকাটা ছাঁদ নাক-চোখ-মুখের তেমনি মাথায় লম্বা, গায়ে মাঝারি। দিদির গায়ের রঙ গুললে বোধ হয় এখনো ধবধবে জল বেরুবে। নীহার সুন্দরী নয়, কিন্তু সুশ্রী; চেহারা না হোক, গাল মুখ বেশ ফুলিয়ে ফেলে তার বয়েসকে চল্লিশের ওপরে এনে দাঁড় করিয়েছে। গলার স্বর এখনো মিষ্টি। আমার মেয়ে সোনার গলা আর নীহারের গলা চিনতে আমারই মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়।
ছায়ায় বিছোনা সতরঞ্জির ওপ বসে বসে আমাদের চা খাওয়া হলো। বেলা যথেষ্ট হয়েছে। দিদি বউদি সামান্য জিরিয়ে নিয়েই পাঁড়েকে নিয়ে রান্নায় বসল; নীহার গোপাকে নিয়ে তরিতরকারি কুটতে বসল জামতলায়।
ছেলেমেয়েরা পিসি, জেঠি, কাকিদের কাজে হাত লাগাল খানিক, খানিক অকাজ করল, বড়ো খোকা আর-একটা উনুন ধরাতে গিয়ে শুকনো পাতায় আগুন জ্বালিয়ে হাত পোড়াতে পোড়াতে বেঁচে গেল, সানু তেলের টিন উলটে ফেলে অনেকটা তেল নষ্ট করল, সোনা মাংস বাছতে বসে বেশ কিছু কাক জড়ো করে ফেলল মাথার ওপর। এইভাবে আমাদের পারিবারিক চড়ুইভাতির প্রথম পর্বটা শুরু হল। তারপর বেলা বাড়তে লাগল, শীতের হাওয়া ছুটতে লাগল বন থেকে বনে, আমাদের জঙ্গলের গায়ে গায়ে একটা দেহাতী গ্রাম, কিছু বাগাল আর কুকুরও জুটে গেল।
ভালই তো লাগছিল আমাদের, গাছতলায় রান্না চলছে, বউদি আর দিদির মাথায় কাপড় নেই, পান খাচ্ছে কথা বলছে, হাতাখুন্তি নাড়ছে; হাসছে, ডাকছে, গল্প করছে। নীহার ফরমাস খাটছে দিদি আর আমাদের। ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় করছে, দল বেঁধে নদীর দিকে চলে গেল, ফিরে এল বালি-জলে গেরুয়া হয়ে, গান গাইছে চেঁচিয়ে, পরস্পরকে রাগাচ্ছে, ভেঙাচ্ছে শুকনো ডাল তুলে নিয়ে সোনা বড় খোকার পিঠে সপাসপ লাগিয়ে দিল। বড়ো খোকা বলল, ”তুই জেনানা না মরদানা রে?” সোনা বলল, ”জেনানাবেশী মরদানা।” বলে হি-হি হাসি, হাসতে হাসতে ভাগ্নে পূর্ণকে বলল, ”ও বড়দা, বড় খোকাকে তোমার সেই মোচআলী মেমের গল্পটা বলে দাও।” দাদা ওদের দেখতে দেখতে হেসে বলল, ”দেখো জ্যোতি, সোনাটা তার পিসির মতন হয়েছে।” আমি হাসলাম।
গোপা একটু শান্তশিষ্ট। হয়তো তার বিয়ের সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে বলে এখন একটু লজ্জায় লজ্জায় আছে। ভাইবোনেরা তো তাকে অহরহ খেপায়। গোপা একপাশে বসে বসে তার কাকির সঙ্গে গল্প করছিল। আমি তাকে কাছে ডাকলাম। গোপা আসতে বললাম, ”কেমন লাগছে রে?”
”খুব সুন্দর।”
”তোর বিয়ের পর জামাইকে আর আনতে পারব না এখানে—এই যা দুঃখ।”
গোপা লজ্জা পেয়ে মুখ নীচু করে পালাল।
শীতের বেলা; দেখতে দেখতে দুপুর মরে আসছিল। খাওয়াদাওয়া শেষ করতে বেলা প্রায় নিবে আসার মতন হয়ে এল। তারপর বিশ্রাম। গাছতলায় সতরঞ্জির ওপর গড়াগড়ি দিতে লাগল মেয়েরা, ছেলেরা মাঠেঘাসে পাতায় চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। আমি একটু আড়ালে গিয়ে সিগারেট খেতে খেতে কেমন তন্দ্রার ঝোঁকে চোখ বুজে ফেলেছিলাম, নীহার এসে ডাকল।
”ওমা, ঘুমোচ্ছ?”
”না, তন্দ্রা এসে গিয়েছিল। বসো।”
নীহার পাশে বসল। বলল, ”তোমার জন্যে একটু সোডা এনেছিলাম; অবেলার খাওয়া—, খাবে নাকি?”
”না, এখানে আর সোডাটোডা কেন, এমন জল….”
”পান খাবে আরেকটা?”
”দাও।”
নীহার পান দিল। দুপুর মরে আসছিল বলে বনের মধ্যে আবার শীতের ছোঁয়া লাগছিল। রোদ পালানো শুরু হয়েছে। সোনা গান গাইছিল কোথাও, তার গলা ভেসে আসছে।
নীহার বলল, ”যাই বলো, জায়গাটা বেশ সুন্দর। এই এক মাস বেশ কাটল।”
”হ্যাঁ, বেশ আনন্দে।”
”ছেলেমেয়েরাও খুব খুশী। দেখাশোনা তো হয় না। জেঠা, জেঠি, পিসি, পিসেমশাই—এতগুলো ভাইবোন, হইচই করে বেড়িয়ে খুব আনন্দে কাটিয়েছে।”
নীহার আমার গায়ের দিকে একটু হেসে বসে থাকল খানিক। তারপর হঠাৎ বলল, ”হ্যাঁ গো, দিদি কি সত্যিই কুয়ায় ঝাঁপ খেতে গিয়েছিল?”
আমি চমকে উঠে নীহারের মুখের দিকে তাকালাম, ”কে বলল?”
”না, তখন জামাইবাবু বলছিলেন কি না, তাই জিজ্ঞেস করছি।…ঠাট্টা তা হলে?”
আমি কোনো জবাব দিলাম না, নীহারের কাঁধে হাত রেখে বসে থাকলাম।
চার
বেলা মরে আসতেই জঙ্গলে ছায়া জমতে শুরু করেছিল। শীতের হাওয়াটাও প্রখর হল। কাঠকুটো জ্বালিয়ে চা খাওয়া হল, তারপর ফেরার তোড়জোড়। পাঁড়ে আর চাকর গাড়িতে হাঁড়িকুড়ি উনুন চাপাতে লাগল। আমরা সদলবলে নদীর দিকে বেড়াতে গেলাম। নদীর চরায় বিকেলের শীত নেমে গেছে, বাতাস দিচ্ছিল, বট আর শিমুলের মাথার ওপর তখনো শেষ বেলার রোদ গড়িয়ে পড়ছে। নিষ্প্রভ রোদ। কাঠুরেদের গাড়ি নদী ভেঙে গ্রামের দিকে যাচ্ছিল, আকাশ কেমন অবসন্ন, মাঝে মাঝে ঝাঁক বেঁধে পাখি ফিরছে।
আমাদের শাল জঙ্গলের মাথায় একটু মেঘ এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
দাদা বলল, ”এবার চলো, ফেরা যাক, আলো ফুরিয়ে যাচ্ছে।”
নদীর চর থেকে আমরা ফিরতে লাগলাম। শীতের বাতাসটা ক্রমশই বাড়ছে। কনকন করছে। বউদি, দিদি, নীহার গায়ের শাল গুছিয়ে নিল। জ্যোতিদা তার গলাবন্ধ কোটের বোতাম আঁটল। গায়ের শাল দাদাও ভাল করে জড়িয়ে নিল। গোপা, সোনা, বিন্দু যে যার গরম জামা পরে নিয়েছে।
ফেরার সময় আমরা সকলেই প্রায় একই সঙ্গে ফিরছিলাম। গোরুর গাড়িটা আগেই রওনা দিয়েছে।
আমাদের কারো খেয়াল হয়নি, হঠাৎ দিদি বলল, ”কী সর্বনাশ! দেখেছ? …..আকাশটা দেখ একবার।”
তাকিয়ে দেখি, শাল জঙ্গলের মাথার ওপর মেঘটা অনেকখানি ছড়িয়ে গেছে, পেছন থেকে কখন মস্ত একটা মেঘের পুকুর এসে তার গায়ে গায়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক কালচে মেঘ নয়, কিন্তু কি এরকম যেন পাংশু। ঝড় বা বৃষ্টির স্পষ্ট কোনো লক্ষ্মণ এ মেঘে ছিল না। হয়তো মেঘলা হয়ে যাবে, বা মেঘটা সামান্য পরেই ফেটে আকাশময় ছড়িয়ে পড়বে। বাদলার গন্ধ নেই কোথাও, শীতের বাতাসটাই যা শন শন করে বইছিল।
পূর্ণ হেসে বলল, ”মেঘ দেখলেই মা’র ভয়।….এটা বর্ষাকাল নয় মা, শীতকাল।”
দিদি বলল, ”তুই কি পাঁজি লিখিস যে শীতে বৃষ্টি হবে না।…. আমি মেঘ চিনি। এ বড় পাজী মেঘ।”
গোপা হেসে বলল, ”তুমি এমন করে বলছ পিসি, যেন এই মেঘটেঘ নিয়ে তোমার ঘরসংসার।”
বড় খোকা বলল, ”বৃষ্টি এলে আমাদের কি, আমরা দৌড়াবো; ওল্ডরাই মুশকিলে পড়বে; আর যারা কাছা দেয় না তারাই।”
সোনা বলল, ”দৌড়ো না, তোকে আর এ জঙ্গলে কাছা সামলে দৌড়তে হবে না।”
দাদা বলল, ”একটু পা চালিয়ে চলো সব। জঙ্গলের রাস্তা, আমাদেরও জানাশোনা নেই তেমন নতুনই।”
পা অবশ্য কারো তেমন জোরে চলছিল না। সারাদিনের হই-হুল্লোড়, হাঁটাহাঁটি , অবহেলায় খাওয়া, আলস্য ও শীতের জড়তার জন্যে সকলেই ঢিলে মেজাজে হাঁটছিল। মাঠঘাট থেকে রোদ চলে গেছে অনেকক্ষণ, গাছের মাথায় পাতলা রোদ যেটুকু ছিল তাও মুছে গেল। উত্তরের বাতাস গাছের পাতা কাঁপিয়ে শব্দ তুলে বয়ে যাচ্ছে। টি-টি করে কেমন একটা পাখি মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল।
বউদি বলল, ”ঠাকুরঝি, আজ না পূর্ণিমা! সন্ধের আগেই চাঁদ উঠবে।….একটু বাবা রয়ে-সয়ে চলো, চাঁদ উঠলে বাড়ি ফিরব।”
ছোটো খোকা টপ করে বলল, ”জেঠমণি যে পোয়েট হয়ে যাচ্ছে, পূর্ণদা।”
পূর্ণ বলল, ”তোর দেখাদেখি।”
ছোটো খোকা আজ বনে খুব কবিতা আওড়েছে হয়তো সেই জন্যেই পূর্ণ ঠাট্টা করে কথাটা বলল।
বউদি বলল, ”বড্ড ফাজিল হয়ে যাচ্ছিস ছোটোখোকা।”
কথা বলতে বলতে আমরা শাল জঙ্গল পেরিয়ে মাঠে এসে হঠাৎ অনুভব করলাম, চারপাশ যেন কেমন বাদলার মতন অন্ধকার হয়ে গেছে। শীতের বিকেল দেখতে দেখতে ফুরোয়, প্রথমে মনে হয়েছিল, শীতের আঁধার জমে আসছে। পরে মনে হল, বিকেল মরে যাওয়ার পর আবছা অন্ধকার এত দ্রুত ঘন হয়ে আসার কথা নয়, আজ পূর্ণিমা। মেঘলা জমেছে কি? আকাশের মেঘটাও বেশ কালো ও কুটিল হয়ে উঠেছিল।
দাদা বলল, ”সারাদিন ভালোয় ভালোয় কেটে এখন ঝড়বৃষ্টি শুরু হবে নাকি? নাও, তোমরা একটু তাড়াতাড়ি পা চালাও।”
আমরা তখনো মেঘটার প্রকৃতি বা চরিত্র বুঝতে পারিনি, মনে হচ্ছিল—পৌষের শেষে বা মাঘে যে বর্ষণ নামে এই মেঘ তার বিক্ষিপ্ত কোনো টুকরো হবে। হয়তো আজ বাদলা জমবে, মেঘলা হবে, পূর্ণিমার চাঁদ আর দেখা দেবে না। তারপর কাল সকাল অথবা দুপুর থেকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টির চিন্তা আমাদের বিরক্ত করল।
দল বেঁধে আমরা আরো খানিকটা পথ চলে এলাম। বাতাসে বনের শুকনো পাতা খড়কুটো উড়ছিল, মাঝে মাঝে মেঠো ধুলো আসছিল। সূর্য অস্ত গেছে না আড়াল পড়েছে, আমরা বুঝতে পারছিলাম না। বেশ একটা ঝোড়ো ভাব, আলো মলিন। ছেলেমেয়েরা যে বনের মধ্যে এই ঝোড়ো ভাবটা খুব উপভোগ করছে তা ওদের আচরণ দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছিল। কখনো দু’ পা ছুটে যাচ্ছে, কখনো মাটিতে বসছে, কখনো বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে সাড়া ছড়িয়ে দিচ্ছে, কখনো গান গেয়ে উঠছে, একে অন্যকে ধুলো পাতা ঘূর্ণির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
মাঠ শেষ করে আবার বনে এসে পড়লাম। তারপর ঝাপসা আঁধার এবং গাছপালার শব্দের মধ্যে আমাদের পথ একটু ভুল হয়ে গেল। দাদা এমন একটা রাস্তা ধরল যে, খানিকটা এগিয়ে আমরা আর পথ দেখতে পেলাম না।
দাদা বলল, ”রাস্তাটা গোলমাল হয়ে গেল যে। কি রে প্রশান্ত, তুই কিছু বললি না তো তখন?”
”আমিও বুঝতে পারিনি। চলো পিছিয়ে যাই।”
জ্যোতিদা বলল, ”জঙ্গলের রাস্তার এই দোষ, পায়ের চিহ্ন না থাকলে চেনা যায় না।”
আবার পেছনে ফিরে এসে আমরা পথ পেলাম। ততক্ষণে ঝড় উঠে গেছে। শীতের ঝড়ে গায়ে কাঁপুনি ধরছিল।
ওই ঝড়ের মধ্যে চোখ রগড়াতে রগড়াতে আমরা বন পেরিয়ে এলাম। এবার সেই আমলকী বন। এখান থেকে আমাদের বাড়ি এমন কিছু দূর নয়। কিন্তু ততক্ষণে চারিদিক কালো হয়ে গেছে। শীতের সন্ধ্যে, আকাশের মেঘ, বনভূমি—সব মিলেমিশে হঠাৎ এই সান্ধ্যমুহূর্ত কেমন রাত্রের চেহারা নিয়েছিল। ঝোড়ো বাতাসটা থামেনি, থামার লক্ষণও ছিল না। গাছ-পাতার ফাঁকে ফাঁকে বোধহয় হিম জমতে শুরু করেছিল, কুয়াশার ভাব যেন।
গোপার শীত করছিল। কাঁপতে কাঁপতে বলল, ”কাকামণি, বড্ড শীত।”
”তুই আমার চাদরটা নে।”
”আর তুমি?”
”আমার গায়ে সোয়েটার আছে, গরম ফতুয়াটা রয়েছে….। নে, চাদরটা নে, নিয়ে কান-মাথা জড়িয়ে ফেল।” আমি গোপাকে গায়ের চাদরটা দিয়ে দিলাম।
দাদা কাশতে শুরু করেছিল। কাশতে কাশতে বলল, ”বড্ড ঠাণ্ডা রে! হুট করে বিকেলেই এত ঠাণ্ডা পড়বে ভাবিনি।”
বড় খোকা, পূর্ণ আর সোনা একসঙ্গে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে গান শুরু করে দিল, যেন শীতের জড়তা গায়ে বসতে দেবে না।
ছোটো খোকা আর সানু দাঁত বাজিয়ে বাজনা বাজাচ্ছিল। বিন্দু তাদের গায়ে গায়ে।
আমলকী বন পাশে রেখে আমরা আবার সেই জঙ্গলের মধ্যে ঢুকলাম। এটা ঠিক জঙ্গল নয়, ঘন ঝোঁপ, খানিকটা হাঁটলেই পেরিয়ে যাওয়া যায়। তারপর ফাঁকা মাঠ, মাঠের শেষে আমাদের বাড়ি।
যেতে যেতে বউদি বলল, ”চোখে যে আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না।”
দিদি বলল, ”গাড়ির রাস্তা ধরে গেলেই হতো। অনেকটা ঘুর-পথ পড়ত, তবু এ আর পা ফেলা যাচ্ছে না।”
জ্যোতিদা সবার পেছনে। পেছন থেকেই বলল, ”সাবধানে যাও। তাড়াহুড়োর কিছু নেই, বাড়ি তো পৌঁছে গেলে।”
বলতে না বলতে বড় খোকারা হঠাৎ যন্ত্রণার শব্দ করে দাঁড়িয়ে পড়ল।
”কি হল রে?”
”কি যেন ফুটলো!”
”কাঁটা!” সোনা বলল।
”আমি গিয়েছি রে বাবা,” পূর্ণ চেঁচাল, ”কাঁটায় আটকে গেছি।”
ছোটো খোকা আর সানু অতটা বোঝেনি, তারা এগিয়ে বড় খোকাদের অবস্থা দেখতে গিয়েছিল, গিয়ে কাঁটায় জড়িয়ে গেল। হাত পা মুখ কাপড় কিছু-না-কিছু আটকে যাওয়ায় ওরা যন্ত্রণার শব্দ করছিল। অসহিষ্ণুতা ও বিরক্তি প্রকাশ করছিল।
দিদি বলল, ” সেই কাঁটা…., সকালে নীহারের শালে জড়িয়েছিল।”
বউদি বলল, ”কী সর্বনাশ! তা এখন ছেলেমেয়েগুলোকে ছাড়াই কি করে?” বলে দাদার উদ্দেশে রাগ করে বলল, ‘সকালে দেখল, তবু এই রাস্তা ধরে আসার কি দরকার ছিল!”
ছেলেমেয়ের দল তখন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে যে যার কাছের মানুষের কাঁটা ছাড়াবার অক্ষম চেষ্টা শুরু করেছে। বউদি আর নীহার সাবধানে এগিয়ে গেল, গোপা আমার পাশে।
পূর্ণ চেঁচাচ্ছিল, ”এ কী কাঁটা রে বাবা, গায়ের ছাল মাংস পর্যন্ত জ্বালিয়ে দিচ্ছে। কই সকালে তো দেখিনি।”
বড়ো খোকা বলল, ”আমরা এ-রাস্তায় মোটেই যাইনি।”
সোনা কেঁদে ফেলে বলল, ”বাবা গো, আমার গালে কাঁটা ফুটে গেছে।”
বউদি আর নীহারও শেষ পর্যন্ত কাঁটার হাত থেকে বাঁচতে পারল না। পারা সম্ভব নয়। মাথার ওপর থেকে, পাশ থেকে বটের ঝুরির মতন পাতা নেমেছে। লতায় লতায় চারদিক ঢাকা, পাতা আর অজস্র কাঁটা সেই লতায়। এমনকি মাটিতেও ঝোপের গা বেয়ে বেয়ে কাঁটালতা থিক থিক করছে। একপাশে একটু ফাঁকা ছিল, যেখান দিয়ে সকালে আমরা এসেছিলাম, কিন্তু এই অন্ধকারে সেই নিষ্কন্টক ক্ষুদ্র পথটুকু খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
দাদা ভয় পেয়ে বলল, ”কি করা যায় জ্যোতি, এ যে বড় বিপদে পড়লাম।”
জ্যোতিদা বলল, ”আলো-টালো থাকলেও না হয় চেষ্টা করতাম, কিছু বুঝতে পারছি না।”
আমিও বুঝে উঠতে পারছিলাম না কি করা যায়। আলো বলতে আমাদের কাছে দেশলাই; জ্যোতিদার কাছে অবশ্য লাইটার আছে। কিন্তু এই বাতাসে দেশলাই বা লাইটারের আলো কতটুকু কাজ দেবে! এতগুলো লোকের এত কাঁটা এভাবে ছাড়ানো সম্ভব না।
দাদা রীতিমত ভয় পেয়ে গিয়েছিল; বলল, ”আমাদের মধ্যে কেউ যদি বাড়ি যেতে পারত। আলো আর চাকর-বাকর নিয়ে ফিরে আসত।”
দিদি অধৈর্য হয়ে একটা দেশলাই চাইল। বলল, ”হাঁ করে দাঁড়িয়ে মজা দেখলেই রাস্তা পাবে নাকি। ছেলেমেয়েগুলো কাঁটা ফুটে মরছে। দাও, দেশলাই দাও।”
আমি দেশলাই দিলাম। দিদি মাটিতে উবু হয়ে বসে খড়কুটো শুকনো পাতা জড়ো করতে লাগল।
জ্যোতিদা বলল, ”দাঁড়াও, আমার লাইটারটা জ্বালি।”
প্রথমে রুমালে আগুন জ্বালিয়ে তারপর সেই জ্বলন্ত রুমাল শুকনো পাতার মধ্যে দিতে দপ করে আগুন জ্বলে উঠল। অন্ধকারে এই আলোটুকু জ্বলতে আমরা অনেকটা স্পষ্ট হলাম। দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত। পূর্ণ, বড় খোকা, ছোটো খোকা, সানু, সোনা, রবি বউদি, নীহার—এমনকি বিন্দুটা পর্যন্ত কাঁটা ঝোপের সামনে চুম্বকের মতন আটকে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে এক মুঠো আলপিন চুম্বকের কাঠিতে আটকে থাকলে যেরকম দেখায় অনেকটা সেই রকম। কারো গাল ছড়েছে, কারো হাত, কেউ পা তুলে দাঁড়িয়ে। চুলে জামায় কাপড়ে কাঁটালতা জড়ানো। সকালে এতটা লক্ষ্য করিনি, এখন দেখলাম, বিশাল গুহার মতন চারপাশে বেড়ে গিয়ে যেন একটা কাঁটাকুঞ্জ হয়ে আছে ওখানটায়, আশেপাশের সব গাছ পালায় জড়িয়ে রয়েছে কাঁটালতা জড়িয়ে ছড়িয়ে ঘন একটা বাধা সৃষ্টি করেছে; মাটিতে কিছু ফণিমনসা।
দিদির জ্বালানো পাতার চুল্লি যেভাবে জ্বলছিল তাতে নিবে যেতে সময় লাগবে না। আমরা আশপাশ থেকে পাতা আর শুকনো কাঠি এনে আগুনের মধ্যে ফেলতে লাগলাম।
দিদি বউদির মাথার কাপড় আর আঁচল থেকে সাবধানে কাঁটালতার ডগা সরিয়ে বউদিকে মুক্ত করল; দাদা সানুকে কাঁটার বাঁধন থেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছিল আপ্রাণ। জ্যোতিদা বিন্দুকে অতিকষ্টে ছাড়িয়ে এনেছিল। গোপা আর আমি দু’ হাতে সমানে পাতা জড়ো করছি, শুকনো কাঠি ভেঙে ভেঙে আগুনের মধ্যে ফেলছি। বাতাসের জন্যে আগুন এলোমেলো হয়ে জ্বলছিল, দেখতে দেখতে পাতা পুড়ে যাচ্ছিল। অজস্র পাতা এখানে কোথায় পাব! অন্ধকার থেকে পাতা সংগ্রহ করে আনাও সম্ভব নয়। ঝোড়ো দমকা শীতের কনকনে হাওয়া বনের চারদিক বেড় দিয়ে যেন নাচছিল, পাতার শব্দে আমরা চমকে উঠে ভাবছিলাম, বুঝি বৃষ্টি এল! বৃষ্টি এসে পড়লে পাতার আগুনটুকু নিবে যাবে, আমরা সপরিবারে কাঁটার বনে আটকে থাকব। সারা রাত এই জঙ্গলে, শীতে, বৃষ্টিতে বন্দী হয়ে থাকার চিন্তায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।
দাদা খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিল। সানুকে ছাড়াতে গিয়ে নিজেই কখন কাঁটার জঙ্গলে জড়িয়ে গেল। জড়িয়ে গিয়ে আতঙ্কের একটা শব্দ করল। এরকম শব্দ আগে আর কেউ করেনি।
দিদি বলল, ”কি হলো?”
দাদা জবাব দিল, ”আর কি হবে, আমিও আটকে গেলাম।”
নীহার যেন কোনো মন্ত্রবলে কাঁটার হাত থেকে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে; ঝাঁপ দিয়ে সরে এল। অনেকক্ষণ থেকে সে চেষ্টা করছিল।
জ্যোতিদা সোনার কাঁটা ছাড়িয়ে ফেলছিল। এমন সময় বাদলা গন্ধ এল।
গোপা কোথাও শুকনো পাতা খুঁজে পাচ্ছিল না। বলল, ”কাকামণি, এবার—”?
পায়ে করে টেনে টেনে যা জোটাতে পারলাম জুটিয়ে আগুনের কাছে রাখলাম; বললাম, ”এবার আর কি, বসে থাকতে হবে……।”
গোপা ভয়ে আঁতকে উঠল।
ছেলেমেয়েরা এতক্ষণে বেশ বিরক্ত এবং অধৈর্য। তাদের আর সহ্য হচ্ছিল না। এই জঙ্গল, বন, কাঁটাগাছ—সমস্ত কিছুকেই তারা গালাগাল দিতে শুরু করল।
আমাদের কারো চেষ্টার অন্ত ছিল না। ছেলেমেয়েরা, বউরা—সবাই আপ্রাণ চেষ্টা করছিল এই বিশ্রী জঘন্য কাঁটার জঙ্গল থেকে মুক্তি পাবার। বউদি বিরূপ হয়ে উঠেছিল, নীহার তার মেয়ে সোনার জন্যে ছটফট করছিল, আর-একটু হলেই তার মেয়ের অমন সুন্দর চোখ যেত। দাদা চেঁচামেচি শুরু করেছিল। এক জ্যোতিদা তখনো বেশ শান্ত, সুস্থির, রসিকতাও করছে: ‘কাঁটা হেরি ক্ষান্ত কেন কমল তুলিতে? বুঝলি সোনা, এত সুখ-আনন্দ যে করলি তার জন্যে তোর ঠাকুর্দার রেণুকুটকে একটু দাম দিবি না!”
দিদি বলল, ”তোমার তামাশা রাখো, মেয়েটাকে ছাড়াও আগে।”
”ছাড়িয়ে দিয়েছি।”
”তবে ও দাঁড়িয়ে আছে কেন?”
”যাচ্ছে, ওর হাত ধরে টেনে নাও।”
বড় খোকা বেপরোয়া হয়ে জামাকাপড় ছিঁড়ে গা-মুখ কেটে পাতার আগুনের কাছে ঝাঁপ খেয়ে পড়ল।
আমি ডাকলাম, ”দিদি”?
”উঁ—!”
”এ আগুন আর তো জ্বালিয়ে রাখা যাবে না; পাতা পাই কোথায় আর?”
গাছের পাতায় আবার শব্দ উঠেছিল বৃষ্টির মতন, তারপর টুপ টুপ করে জলের ক’টা ফোঁটা যেন পড়ল।
গোপা বলল, ”বৃষ্টি—”।
আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, পাতার শব্দ না বৃষ্টি; বৃষ্টি হলে অনেক জোরে বড়ো বড়ো ফোঁটায় পড়া উচিত ছিল। নাকি গাছের আড়াল বলে আমরা বুঝতে পারছি না। ছাতাগুলোও সব গাড়িতে।
আগুন ক্রমেই নিবে আসছে। বৃষ্টি আসলেও আসতে পারে। আমাদের মধ্যে সে যে কী এক আতঙ্ক এল, বিন্দু কেঁদে ফেলল, সোনা তার মা’র হাত ধরে কাঁপতে লাগল। দাদা উন্মাদের মতন করছিল, বউদি গোপাকে নিয়ে একপাশে সরে গেল।
দিদি আর কোনো উপায় না দেখে তার গায়ের দামী শালটা খুলে আগুন ফেলে দিল। দাউ দাউ করে খানিকটা আগুন জ্বলে উঠল। ছোটো খোকা তখনো তার হাতের কাঁটা ছাড়াচ্ছে।
তারপর দেখতে দেখতে বৃষ্টি এল। বড় বড় ফোঁটা পড়ল। শীতের রাত্রের বাতাস আরো ধারালো হয়ে আমাদের সর্বাঙ্গ বিক্ষত করে অসাড় করে বয়ে যেতে লাগল। আগুন নিবে গেছে। অন্ধকারে, শীতে, বৃষ্টিতে, কুৎসিত হিংস্র এক কাঁটাবনের মধ্যে আমরা সপরিবারে আবদ্ধ হয়ে থাকলাম, মাথার ওপর দিয়ে ঝোড়ো বাতাস আর মেঘ ভেসে যেতে লাগল।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম খেয়াল করিনি, করা সম্ভব ছিল না। বৃষ্টির পশলা কেটে গেলে মেঘ সরে শীতের জলো চাঁদ-পূর্ণিমার চাঁদ দেখা দিল। সেই চাঁদের আলোয় আবার আমরা পরস্পরকে খানিকটা দেখতে পাচ্ছিলাম।
জ্যোতিদা বলল, ”অকারণ ব্যস্ত হয়ো না; এভাবে যেতে পারবে না কেউ। খানিকটা অপেক্ষা করো, বাড়ি থেকে আলোটালো নিয়ে লোক আসবে নিশ্চয়। এতটা রাত হয়ে গেল, আমরা ফিরছি না—ওরা কি আর না ভাবছে?”
আমার মনে পড়ল, বাড়িতে সন্ধ্যেবেলা জগদীশবাবুর থাকার কথা। দলিল দেখাতে আসবেন। তিনি নিশ্চয় আমাদের ফিরতে না দেখে ব্যস্ত হয়ে লোকজন আলো খুঁজতে বেরুবেন। কথাটা দাদাকে বললাম।
অপেক্ষা করা এবং আশা করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না।
অর্ধ-সিক্ত বস্ত্রে শীতে অসাড় হয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে আমরা যখন দাঁড়িয়ে আছি, তখন জ্যোতিদা কি ভেবে বলল, ”এই কাঁটাগাছ কে পুঁতেছিল আমি জানি।”
দাদা বলল, ”বাবা।”
”না”, জ্যোতিদা বলল, ”শ্বশুরমশাই কুয়াটা বুজিয়েছিলেন; তার চারপাশ ঘিরে কাঁটাগাছ পুঁতে দেননি।”
”কে দিয়েছিল তবে?”
”মা।”
”মা! মা কেন?” বউদি বলল।
জ্যোতিদা সে-কথার কোনো জবাব দিল না। পরে বলল, ”সেই কথাটা আমার মনে পড়ছে, বাইবেলের বোধ হয়; দাও হ্যাস্ট সার্ভড দি ব্যাড ওআইন ফার্স্ট অ্যাণ্ড লাস্ট অফ অল দি গুড…… তা প্রায় ধরো তিরিশ বছর ধরে আড়ালে আড়ালে এই মন্দটা—ওই কাঁটা বেড়েছে।”
দিদি জ্যোতিদাকে থামিয়ে দিল। অপ্রসন্ন, বিরক্ত; বলল, ”তোমায় এখন আর পাদ্রী সাজতে হবে না, চুপ করো।”
দিদি রাঁচি মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছে ও থেকেছে, বাইবেল ভালই জানত। আমরা অল্প-স্বল্প। তবু জ্যোতিদার কথার মর্ম বোধহয় তিনজনেই বুঝতে পারছিলাম।
জ্যোতিদা বলল, ”চুপ করার কি আছে সুনু, আমি কি মিথ্যে বলেছি।”
”সব কথা সব জায়গায় বলার নয়—” দিদি বলল। ”পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটে লাভ কি এখন?”
জ্যোতিদা হাসল যেন, ”পুরনো কাঁটা কেমন বাড়ে দেখছ না, পুরনো কাসুন্দি ভেবে সব ফেলে রাখলে কি আর বাঁচা যায়!”
দিদি অধৈর্য হয়ে বলল, ”আঃ, থামো।”
তারপর এক সময় সত্যিই আমরা কাঁটাবন থেকে উদ্ধার পেলাম। জগদীশবাবু লোকজন, পেট্রম্যাক্স বাতি, টর্চ, লাঠি নিয়ে হাজির। ওদের সাড়া পেতে আমরা সাড়া দিলাম। সাড়া পেয়ে কাছে এসে আমাদের অবস্থা দেখে জগদীশবাবু স্তম্ভিত।
কাঁটাবনের বাইরে এলে আবার আমরা একটা দল হলাম। ক্লান্ত, অবসন্ন, হাত-পায়ে কাঁটার জ্বালা, জামাকাপড় ভেজা ভেজা, ছেঁড়া ফাটা, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে অবসাদে আর শীতে দুর্বল পায়ে বাকি পথটুকু পেরোতে লাগলাম।
ছেলেমেয়েরা আর হইচই করছিল না; করার অবস্থাও ছিল না। সামান্য দূরেই আমাদের বাড়ি। জগদীশবাবু লোকজন নিয়ে এগিয়ে গেছেন, ওদের হাতে দুটো পেট্রম্যাক্স বাতি। আকাশ যখন পরিষ্কার, পূর্ণিমার চাঁদ উঠে আছে, দু-এক আঁচড় কালচে মেঘ ছড়ানো, হিম জড়িয়ে মাঠঘাট ঝাপসা, চাঁদের আলো ভেজা ভেজা লাগছিল।
আমি, জ্যোতিদা, দাদা পাশাপাশি; বউদি, নীহার, দিদি ওপাশে। একই সঙ্গে চলেছি।
যেতে যেতে জ্যোতিদা বলল, ”সুনু, তখন তুমি রাগ করলে, কিন্তু সত্যি করে বলো তো, তোমাদের সংসারে নোংরা মদটা আগে খেতে দেওয়া হয়েছিল কি না!”
দিদি এবার বিরক্ত হল না, কিন্তু অস্বস্তি বোধ করে ‘আঃ’ বলল।
জ্যোতিদা বলল, ”আমি খুব খুশি হয়েছি। কুয়ো বুজিয়ে কাঁটার বেড়া দিয়ে দিলেই কি পাপ মুছে যায়!”
দিদি বলল, ”পুরোনো কথা কেন তুলছ তুমি!”
”ক্ষতি কি তুললে, ছেলেমেয়েরা তো শুনছে না।
দিদি আর কথা বলল না।
দাদার স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর, তবু দাদা যে কেন ওই কুয়া আর কাঁটার বিষয় কিছু বলছিল না, আমি জানি না। অথচ আমি জানি, কথাটা আমাদের সকলেরই জানা আছে, মনে আছে। আমি বললাম, ”ওই কুয়াটা আমাদের কলঙ্ক, যার গর্ভে আমরা জন্মেছি তার ভেতরটা কী নোংরা আর অন্ধকার ছিল!…আর ওই কাঁটা হল পাপ; পরম পাপ।”
কথাটা আমি কেমন করে বলেছিলাম জানি না, কিন্তু বলার পর আমি নিজেই নিজের গলার স্বরে চমকে উঠলাম, মনে হল আমি অন্যদেরও চমকে দিয়েছি। সকলেই স্তব্ধ।
দাদা সামনের মস্ত একটা তেঁতুলগাছের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চাপা গলায়, যেন সব জেনেও শেষবারের মতন কিছু বাঁচাবার চেষ্টা করছে, বলল, ”বাবা রতীনদাকে সত্যিই মেরেছিল?”
”হ্যাঁ—” দিদি বলল, নিদ্রিত অবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে কথা বললে যেমন শোনায়, তার গলা সেরকম শোনালো, ”আমি জানি বাবা মেরেছিল।”
বউদি আর নীহার আঁতকে ওঠার শব্দ করল। ওরা ভয় পেয়ে গিয়েছিল।
জ্যোতিদা বলল, ”আত্মসম্মানের জন্যে?”
দাদা বাধা দিল, ”না, মা’র জন্যে, মা’র জন্যে সমস্ত। বাবা বোধহয় বোঝেনি….”
”কে বলল!” দিদি হঠাৎ যেন ঘুম ভেঙে গিয়ে রাগের গলায় বলল, ”বাবা সব বুঝেছিল; সমস্ত।”
রতীনদা রাঁচি থেকে আমাদের বাড়িতে এসেছিল। দিদির লোভে লোভে সে কয়েকবারই এসেছে। দিদিকে সে ভালবাসত, দিদি তাকে ভালবাসত। শেষবার এসে মাসখানেক ছিল। মা তাকে রেখে দিয়েছিল। মা তাকে নিজের জন্যে কাছে রাখার চেষ্টা করত, ছুতো বের করত। দিদির জন্যে মা’র হিংসে ছিল। রতীনদার জন্যে মা’র এমন একটা অস্থিরতা জন্মে গিয়েছিল যে, মা তার চাতুর্যও ধরে রাখতে পারত না, প্রকাশ হয়ে পড়ত। মা বোধ হয় শেষের দিকে রাত্রের ঘুমোতে পারত না। আমাদের বাড়িতে রেখে মা রতীনদাকে নিয়ে জঙ্গলে যেত। বাড়ি আর জঙ্গলের মধ্যে জঙ্গলই মা’র বেশি পছন্দসই জায়গা ছিল। অমাবস্যায় যেন মা’র জোয়ার উঠত।
”মা” আমি বললাম, ”আমি জানি জ্যোতিদা, মা রতীনদাকে কি রকম চোখে যেন দেখত। সেরকম চোখে বাবাকেও দেখত না। ভাঙা গির্জের মাথায় পুরনো ঘণ্টা বেজে উঠলে যেমন লাগে, রতীনদার সামনে মাকে সে রকম লাগত।”
বউদি ছি ছি করল, নীহার মাথার কাপড় টেনে নিল আরো।
দিদি বলল, ”মা’র ওই রকমই স্বভাব বরাবরের নোংরা; আমরা মা’র জন্যে কেউ বাড়িতে থাকতাম না, বাইরে বাইরে; বাড়িতে মানুষ হতে পারিনি। ওই ছুটিছাটায় একসঙ্গে হতুম।”
দাদা বলল, ”আমার বাড়ি ভাল লাগত না। মা আমাদের আদর-যত্ন করার চেষ্টা করত, হয়তো ভালবাসত কিন্তু নিজেকে মা সামলাতে পারত না।”
জ্যোতিদা বলল, ”কিন্তু ওই কাঁটার বেড়া দিয়ে উনি তো শেষ পর্যন্ত কিছু সামলাতে গিয়েছিলেন, বসন্ত?”
দাদা কোনো জবাব দিল না।
দিদি বলল, ”আমাকে সামলাতে। … ওই কুয়ার সামনে রতীনদা আর মা ছিল। সন্ধ্যেবেলায় অন্ধকারে বাবা রতীনদাকে মারে, মেরে কুয়ার মধ্যে ফেলে দেয়। পরের দিন দুপুর পর্যন্ত কোনো খোঁজ হয়নি। তারপর বাবা খোঁজার রব তোলে, থানায় খবর পাঠায়।….কিন্তু হয়নি, বাবা বলে—ওটা হয় অ্যাকসিডেন্ট, না হয় আত্মহত্যা।…ওইজঙ্গলেই তাকে পোড়ানো হয়। তারপর কুয়া বুঁজিয়ে ফেলা হয়েছিল।”
জ্যোতিদা বলল, ”তুমি ওই কুয়ায় ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলে।”
”দুঃখে, লজ্জায় বা ঘেন্নায় নয়,” দিদি যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয়ে বলল, ”আমি কেন ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলাম তোমরা জানো-না, আমি জানি। রতীনদা আমার জন্যে সত্যিই মরেনি; আমি তাকে মারিনি। তবু আমি ওই কুয়ায় ঝাঁপ দিয়ে মরতে গিয়েছিলাম মা’র জন্যে।…..না, মা’র জন্যেও ঠিক নয়, আমাদের সকলের জন্যে। ভালবাসার জনে মরা যায়, মরে নিজেকে বাঁচানো যায়—মাকে আমি শেখাতে গিয়েছিলাম। আমি মরলে মা’র নিজেকে বদলাবার সুযোগ ঘটত। ….মা….” দিদি আর বলতে পারল না।
মা’র যে সেটাও সহ্য হয়নি আমরা জানতাম; মা ভালবাসার জন্যে মরা পছন্দ করত না, বরং মারাই পছন্দ করত। ও পথটা মা বরাবরের জন্যে বন্ধ করে দিয়েছিল কাঁটা দিয়ে।
দাদা রাগে বেহুঁশ হয়ে বলল, ”কী গর্ভেই আমরা জন্মেছি! নোংরা, নোংরা। ওটা যদি বুঁজিয়ে দিতে পারতাম…..।”
নীহার ঘৃণায় মাটিতে থুথু ফেলল। বউদি বিড় বিড় করে বলল, ”জন্তু-জানোয়ারের অধম।”
আমরা অনেকক্ষণ আর কেউ কোনো কথা বললাম না।
বাড়ির কাছাকাছি এসে পড়েছিলাম এবার। শীতের জ্যোৎস্নায় নিবিড় একটা দুঃখ-বলয় সৃষ্টি হয়েছে, মাঠ অসাড়, দূরে টিমটিম বাতি জ্বলছে, কাঁঠালতলায় আগুন জ্বালিয়ে কারা যেন প্রসবিনী গাভীকে শুশ্রূষা করছে। কোথাও কেউ রামায়ণ গাইছিল সুর করে, গাইতে গাইতে চলে যাচ্ছিল।
জ্যোতিদা হঠাৎ বলল, ”সুনু তোমাদের দেখে আজ আমার একটা কথা মনে হচ্ছে।”
আমরা জ্যোতিদার দিকে তাকালাম।
জ্যোতিদা আস্তে করে দিদির কাঁধ ছুঁয়ে বলল, ”ভালবাসা পাওনি বলে তোমরা আজ ভালবাসা শিখছ। ভালবাসা শেখার জিনিস, সংসারেই শিখতে হয়। তোমার মাকে কিছু শিখতে হয়নি, শরীরের জন্যে শিখতে হয় না।”
দিদি আরো কিছুক্ষণ কথা বলল না, শেষে বলল, ”কী জানি, আজ আরো বেশি করে যেন লাগছে। কোথায় লাগছে, তোমাদের কেমন করে বোঝাব!…মনে হচ্ছে, আমরা আমাদের ছেলেমেয়ে সব নিয়ে কি এক কাঁটার জঙ্গলে আটকে গেছি।”
দিদি কথাটা এমন করে বলল, মনে হল, যেন আমাদের সমস্ত চৈতন্য আজ কোনো অব্যক্ত বেদনায় কেঁদে ওঠার জন্যে গুমরে উঠেছে। আমরা কি কাঁটার জঙ্গলে আটকে থাকব!
তারপর বাড়ির কাছে পৌঁছে গেলাম। রেণুকুটের বাড়ি, বাগান, জঙ্গল আমরা বেচে দিয়েছি, আমাদের কোনো মায়ামমতা থাকার কথা আর নয়, তবু শীতের সেই জ্যোৎস্না এবং হিমের মধ্যে, গাছ এবং বাগানের মধ্যে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে চোখে জল এল।