Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » পঞ্চদশ অভিযান : নৃসিংহ রহস্য || Sasthipada Chattopadhyay

পঞ্চদশ অভিযান : নৃসিংহ রহস্য || Sasthipada Chattopadhyay

সেদিন সকালে খবরের কাগজ দেখতে বসে বাবলু হঠাৎ আনন্দে উল্লসিত হয়ে উঠল। বার বার দেখেও নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না। টেবিলের ড্রয়ার টেনে কী একটা বার করে মিলিয়ে দেখল। তারপর কাগজটা হাতে নিয়ে ছুটে গেল পাশের ঘরে। বাবলুর মা বাবা তখন চা-পর্ব সবে শেষ করেছেন। বাবলু কাগজটা এবং সেই জিনিসটা বাবা-মা’র সামনে মেলে ধরল। তারা তো দেখেই অবাক। বাবলুর মা আনন্দে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন বাবলুকে। আবেগের আতিশয্যে বাবলুর বাবারও মুখে কোনও কথা সরল না। আর বাবলু? সে তখন মায়ের বুক থেকে ছাড়া পেয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে ‘হুর-র-রে বলেই একেবারে রাস্তায়। তারপর এক হাতে কাগজটা পাকিয়ে ধরে ছুটে চলল বিলুদের বাড়ির দিকে।

বিলু সবে পড়তে বসছে এমন সময় আনন্দের প্রতিমূর্তি হয়ে বাবলু হাজির। এমন অসময়ে বাবলুকে দেখেই তো অবাক বিলু। তাই বিস্মিত হয়ে বলল, “কী ব্যাপার রে? বেজায় খুশি মনে হচ্ছে!”

বাবলু গানের সুরে ছন্দ মিলিয়ে গেয়ে উঠল, “খুশি খুশি খুশি৷ তুমি একটি ভুষি।”

বিলু বলল, “সে আবার কী হল? তুমি একটি ভুষি মানে? এর তো কোনও মানেই হয় না।”

বাবলু বলল, “সব কথার কি মানে হয়? না সব কবিতার ছন্দ হয়? মনে করতে পারিস এটা হচ্ছে একটা অর্থহীন গান। চল ভোম্বলদের বাড়ি চল!”

“এখনই?”

“এখনই। একটা দারুণ সুসংবাদ আছে।”

“সুসংবাদটা কীরকম জানতে পারি কি?”

“না। তাড়াতাড়ি আয়।”

বিলু তো চেনে বাবলুকে। তাই এক লাফে লম্বা। তাড়াতাড়ি গেঞ্জির ওপর শার্টটা পরে আয়নার সামনে

খটখট খটখট করে দরজায় কড়া নাড়তেই ভোম্বলের মা এসে খুলে দিলেন দরজাটা।

বাবলু বলল,“ভোম্বল কী করছে মাসিমা?”

“আর বলো না বাবা। এখনও পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।”

“এখনও ঘুমোচ্ছে? এখন তো পৌনে নটা বাজে।”

“পৌনে নটা? হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে না তুললে বেলা বারোটাতেও ঘুম ভাঙবে না ওর।

বাবলু বিলু দুজনেই ঘরে ঢুকল। ঘরে ঢুকে দেখল ভোম্বলের তখনও নাক ডাকছে। বিলু বাইরের বালতি থেকে একটু জল নিয়ে এসে ওর গায়ে ঝাপটা দিতেই এই কেরে! বলে লাফিয়ে উঠল ভোম্বল।

বিলু বলল, “এখনও ঘুমোচ্ছিস, তুই? ওঠ।”

ভোম্বল চোখ রগড়াতে রগড়াতে উঠে বসে বলল, “ব্যাপার কী রে?”

বাবলু বলল, “ব্যাপার জন্ডিস।”

“তার মানে?”

বিলু বলল, “ভনিতা না করে বলেই ফ্যাল না বাবলু? আমারও প্রাণটা আকুপাকু করছে।”

বাবলু বলল, “আজকের কাগজে ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট লটারির রেজাল্ট মিলিয়ে দেখলাম আমি একটা ছোটখাটো অঙ্কের প্রাইজ পেয়েছি।”

ভোম্বল অবাক হয়ে বলল, “সত্যি!”

বিলু বলল, “সে কী রে!”

ভোম্বলের বাবা মা দু’জনেই ছুটে এলেন, “কী বললে, লটারিতে টাকা পেয়েছ।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ।”

তারপর ভোম্বলকে বলল, “তুই বাচ্চু-বিচ্ছুকে খবর দে। শিগগির যা।”

বাচ্চু-বিচ্ছু ভোম্বলদের বাড়ির কাছেই থাকে। ভোম্বল কোনওরকমে চোখে-মুখে একটু জল দিয়েই ডাকতে গেল ওদের।

ভোম্বলের বাবা বললেন, “কত টাকা পেয়েছ বাবলু?”

“এক হাজার টাকা।”

“বাঃ। এক টাকায় এক হাজার। মন্দ কী?”

ভোম্বলের মা বললেন, “তুমি বেশ কাজের ছেলে তো। ভেতরে ভেতরে লটারির টিকিটও কাটো?”

বাবলু বলল, “না মাসিমা। লটারির টিকিট আমি কাটি না। তবে সেদিন কালীবাবুর বাজারে গিয়েছিলাম, তা একটি ছেলে এসে জোর করে টিকিটটা গছালে আমায়।”

এমন সময় ভোম্বলের সঙ্গে বাচ্চু-বিচ্ছু এসে হাজির হল। বিচ্ছু খুশিতে উপচে পড়ে বলল, “বাবলুদা তুমি লটারিতে টাকা পেয়েছ ?”

“হ্যাঁ রে! এবং সেই জন্যেই এই সাত সকালে ছুটে এসেছি খবরটা জানাতে। তারপর ভোম্বলের বাবাকে বলল, “জানেন মেসোমশাই, টিকিটের টাকাটা সরকারের ঘর থেকে তুলতে তো সময় লাগবে, তাই ভাবছি টিকিটটা আমি বাবাকে দিয়ে দেব। বাবা লটারির টাকাটা সময় মতো তুলে নেবেন। আর আমি বাবার কাছ থেকে এক হাজার টাকা চেয়ে নেব। বাবা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট থেকে সেই টাকাটা আমাকে এনে দিলেই আমি কী করব জানেন?”

“কী করবে?”

“ওই এক হাজার টাকার মধ্যে পাঁচশো টাকা আমার নামে সেভিংসে রেখে বাকি পাঁচশো টাকা নিয়ে আমরা পাঁচজনে ঘাটশিলা বেড়াতে যাব।”

বাচ্চু-বিচ্ছু আনন্দে লাফিয়ে উঠল, “উঃ কী মজা। কী মজা। সত্যি, তুমি যে কী ভাল না বাবলুদা, তা কী বলব!”

বিলু বলল, “ঘাটশিলায় ফুলডুংরি পাহাড় আছে। সুবর্ণরেখা নদী আছে।”

ভোম্বল বলল, “ওখানে রাজভোগ লেডিকেনি আছে। ভাল রসমালাই পাওয়া যায়। আমি তো সকালে বিকেলে রসমালাই খাব।” ।

ভোম্বলের মা বললেন, “খাবি। পেট ভরেই খাবি। আমি কিছু টাকা দেবখন তোদের। ওই টাকায় তোরা পেট পুরে রসমালাই খাবি। কেমন? পেটুক ছেলে কোথাকার।”

ভোম্বলের বাবা বললেন, “ঘাটশিলায় গেলে তোমরা কিন্তু রাতের গাড়িতে বা বোম্বাই এক্সপ্রেসে যেতে যেয়ো না যেন!”

“তা হলে কোন গাড়িতে যাব বলে দিন?”

“তোমরা ইস্পাত এক্সপ্রেসে যাবে। সকালে ছটা দশ-কুড়ি নাগাদ ছাড়ে, নটা দশ পনেরোয় পৌছয়। খুব ভাল গাড়ি। ঘাটশিলা বা টাটানগর যাওয়ার পক্ষে বেস্ট ট্রেন।”

ভোম্বলের মা বললেন, “তোমরা একটু বসো বাবা। একটু জলখাবার তৈরি করি তোমাদের। এমন একটা সুসংবাদ যখন নিয়ে এলে তখন আজ আর কাউকে আমি শুধু মুখে যেতে দিচ্ছি না।”

ভোম্বল একটু আড়ামোড়া ভেঙে জোরে একটা হাই তুলে আনন্দে নিজের মনেই চেঁচিয়ে উঠল, “ইয়া— হা।”

বাবলুর বাবা বাবলুর আবেদন মঞ্জুর করলেন। অর্থাৎ টিকিটটি সরকারের ঘরে জমা দিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে এক হাজার টাকা দিয়ে দিলেন বাবলুকে। বাবলু সেই টাকা থেকে পাঁচশো টাকা নিজের সেভিংসে জমা করে বাকি পাঁচশো টাকা ঘাটশিলা ভ্রমণের জন্য রাখল।

টাকা হাতে পেয়েই শুরু হল যাওয়ার তোড়জোর।

ঘাটশিলা যাওয়ার আনন্দে ওরা যেন অধীর হয়ে উঠল। সত্যি! কী যে মজা। কিন্তু এবারেও সেই একই সমস্যা পঞ্চু। পঞ্চুর জন্যই তো যত রাজ্যের চিন্তা। অথচ ওকে ফেলে কোথাও যাওয়ার কথা মনেও আনা যায় না। বিশেষ করে এবারে আর রাতের গাড়ি নয়। দিনের গাড়ি। এ গাড়ি ম্যানেজ করা সত্যিই কঠিন। তাই ভাবনা হল কী ভাবে নেওয়া যায় পঞ্চুকে।

বাবলু বলল, “তাই তো! কী করা যায় বল দেখি?”

বিলু বলল, “আমি তো কোনও উপায়ই বার করতে পারছি না।”

ভোম্বল বলল, “উপায় তোরা কী বার করবি? উপায় বার করব তো আমি।”

বিলু বলল, “থাক।”

“থাক মানে? আগে যাওয়াটা কবে হচ্ছে সেটা ঠিক কর। তারপর দেখ পঞ্চুর ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।”

বিলু বলল, “শেষকালে ফাঁসাবি না তো?”

“মোটেই না। এর আগের বারেই কি ফেঁসেছিলি?”

বাচ্চু-বিচ্ছুর মুখে হাসি ফুটল এবার, বলল, “পঞ্চুর ব্যাপারে আমরা তা হলে নিশ্চিন্ত। কি বলো ভোম্বলদা?”

“নিশ্চয়ই। নাকে রেপসিড দিয়ে ঘুমো। পঞ্চুর দায়িত্ব আমার।”

পঞ্চু বাবলুর পাশটিতে বসেছিল এতক্ষণ। এবার ধীরে ধীরে ভোম্বলের কাছে এসে শুয়ে পড়ে ওর কোলে মুখ গুজে দিল।

নির্দিষ্ট দিনে ওরা যথাসময়েই হাওড়া স্টেশনে এসে পৌছুল। সকাল ছ’টা কুড়িতে ট্রেন। ওরা ঠিক ছ’টার সময় এসে হাজির হল। ভোম্বলের পরিকল্পনা মতো পঞ্চুকে এবার আর কোনওরকম লুকোছাপা করে আনা হল না। কেন না পঞ্চু এখন আগের চেয়েও অনেক বেশি চালাক হয়ে গেছে। তাই ও ছাড়া অবস্থাতেই ওদের সঙ্গে এল।

এল। কিন্তু একটু তফাতে দাঁড়িয়ে রইল।

বাবলুরা এক এক করে প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই ও-ও এক ফাঁকে টিকিট কালেক্টরের পাশ কাটিয়ে সুট করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। কালেক্টার ভদ্রলোক একবার লাফিয়ে উঠলেন, “এই মরেছে। ব্যাটার সাহস দ্যাখ।” বলে কিছুক্ষণ পঞ্চুর দিকে তাকিয়ে একটা বেওয়ারিশ কুকুর মনে করে আবার নিজের কাজে মন দিলেন।

বাবলুরা ট্রেনে উঠে বসতেই পঞ্চুও এক চোখে এদিক সেদিক তাকিয়ে এক ফাঁকে দরজার কাছে একটি সিটের নীচে আশ্রয় নিল। দু-একজন যাত্রী ছাড়া কেউ আর ছিল না। ভাগ্যক্রমে পঞ্চুর ট্রেনে ওঠা নজরে পড়েনি তাদের।

যথাসময়ে ট্রেন পরিপূর্ণ হল। অবশ্য খুব যে একটা ভিড় হল তা নয়। কেন না বে-বার তো। যাই হোক। ট্রেন ছাড়ল। টিকিয়াপাড়া, দাসনগর, রামরাজাতলা, সাঁতরাগাছির পর ঝড়ের বেগে ছুটে চলল ট্রেন।

ট্রেনের ভেতর বাবলু, বিলু, ভোম্বল বসেছিল পাশাপাশি। ওদের পাশেই বসেছিলেন মাথায় অল্প টাক ও চোখে চশমা-পরা এক মধ্যবয়সি ভদ্রলোক। ভদ্রলোক বসে বসে কাগজ পড়ছিলেন। অপর দিকে বসেছিল বাচ্চু-বিচ্ছু এবং অসম্ভব রকমের পেট মোটা এক লালাজি—

আর এধারে জানলার পাশে মুখোমুখি দুটি সিটে বলেছিল মিষ্টি মুখের এক সুশ্রী তরুণী এবং পরদিকে রোগা লম্বা খেঁফুরে চেহারার একজন লোক।

তার ঠিক সিটের নীচেই গুটিশুটি মেরে শুয়েছিল পঞ্চু।

তরুণী মাঝেমাঝে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিল এবং কখনও-সখনও তাকাচ্ছিল বাবলুদের দিকে। আর তার সামনের সিটের লোকটি চুপচাপ বসে বসে বিড়ি খাচ্ছিল। তরুণী কিন্তু লোকটির এই বিড়ি খাওয়া এবং ঘন ঘন ধোঁয়া ছাড়াটা একদম সহ্য করতে পারছিল না। অন্তত তার মুখের ভাব দেখে তাই মনে হচ্ছিল।

বাবলুও বাইরের প্রকৃতির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে একসময় বলল, “আমার অনেক দিনের সাধ আজ পূর্ণ হল।”

বিলু বলল, “তোর ছোট মাসির মুখে শুনেছি ঘাটশিলা নাকি ফ্যানটাস্টিক জায়গা।”

বাবলুদের সামনে যে লালাজি বসেছিল ভোম্বল একদৃষ্টে তার ভুড়িটির দিকে তাকিয়েছিল। লালাজির পরনে ধুতি, পাঞ্জাবি। জওহর কোট, মাথায় পাগড়ি, পায়ে বুট জুতো। আর কপালে টিপ্পা। লালজি একটু আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলে বলল, “কী খোকাবাবু! কিধার জানা হ্যায়?”

বাবলু বলল, “আমরা ঘাটশিলা যাচ্ছি।”

“আরে বাঃ।”

“আপনি কোথায় যাবেন ?”

“ম্যায় ভি ঘাটশিলা যাউঙ্গা।”

ওদিকে সেই রোগা খেঁকুরে লোকটি একটি বিড়ি শেষ করে আবার একটি বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তেই তরুণী উঃ করে মুখ ঘুরিয়ে নিল। লোকটি সেদিকে একবার তাকাল। কিন্তু একটুও সাবধান না হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে লাগল পূর্ববৎ।

তরুণী নিজের মনেই গজগজ করতে লাগল।

বিলু হঠাৎ বলল, “আচ্ছা লালজি, ঘাটশিলায় কী কী দেখার আছে বলুন তো?”

লালাজি বলল, “পহলে বতাও তুম সব অকেলে না ঔর কোঈ হায়?”

বাবলু বলল, “না। আর কেউ নেই। আমরা এই পাঁচজনেই।”

লালজি বললেন, “ব্যস! তো ঠিক হ্যায়। তুম যাও হুয়া। উসকে বাদ নদী দেখো, পাহাড় দেখো, মৌভাণ্ডার, ধারাগিরি দেখো, রংকিনী মাতাকি মন্দির দেখো। লেকিন জঙ্গলমে মাৎ জানা।”

ভোম্বল বলল, “কেন বাঘ আছে বুঝি?”

“নেহি শের কা মতলব নেহি।”

“তবে?”

“জঙ্গলমে ডাকু হ্যায়।”

বাবলুরা লালাজির মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

লালজি বলল, “তুম সব এক কাম করো। হুয়া যাকে পহলে বঙ্গালকা কিতাব লিখনেবালা ভূতিবাবুক মকান দেখো।”

বাবলু বলল, “বাঃ! আপনি নন-বেঙ্গলি হয়ে বিভূতিবাবুর নাম জানলেন কী করে?”

“হাম সব কুছু জানে। উয়ো বহৎ বঢ়িয়া রাইটার থা। হাম রবীন্দরনাথ, শরৎচন্দ্র সবকা নাম জানে। কিতাব লিখকে বহুৎ রুপিয়া কামায়া থা ও লোক।”

ভোম্বল ঝট করে মুখ ফসকে বলে ফেলল, “যাঃ বাবা, এর মধ্যেও আবার রুপিয়ার গন্ধ?”

লালজি শুনেই বলল, “জরুর ও লোক যায়সা রুপাইয়া কামায়া থা অ্যায়সা রুপাইয়া হাম কভি কামানে নেহি সকেগা।”

ভোম্বল লালাজির কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল।

লালজি বলল, “তুম হাস রহে হো। কিতনা উমর তুমহারা? ইয়াদ রাখো দুনিয়ামে সবসে বঢ়া রুপাইয়া হ্যায়। উসসে বঢ়া কুছ নেহি।”

বিলু আর থাকতে না পেরে বলল, “লালাজি আপনি কিন্তু ভুল করছেন। সাহিত্যিকরা রুপিয়া কামাবার জন্য সাহিত্য করেন না। সাহিত্য অন্তরের তাগিদে আপনিই ফুটে ওঠে লেখকের কলমে।”

লালজি এবার রেগে বলল, “হামকো মাৎ সমঝাও বাবা। হাম রুপিয়া ভি সমঝে, সাহিত্য ভি মসঝে। ইয়ে বঙ্গলি লোক্কা বহৎ বঢ়িয়া বিজনেস হ্যায়।”

ভোম্বলও রেগে গেল খুব। বলল, “হ্যাঁ। আপনি একজন মস্ত সমঝদার লোক। তবে আপনি দুটো জিনিসই বোঝেন। রুপিয়া আর বিজনেস। সাহিত্য নয়।”

লালজি আরও রেগে বলল, “চোপ রহো তুম। ক্যা ফর ফরর করতা হ্যায়? সাহিত্য হাম নেহি সমঝেগা তো কৌন সমঝেগা রে?”

ওদের পাশে বসে যে ভদ্রলোক খবরের কাগজ পড়ছিলেন তিনি এবার কাগজের পাতা মুড়ে রেখে বললে, “ভাল জ্বালারে বাবা। এই ছেলেগুলো! কী লাগিয়েছ কী তোমরা সক্কালবেলা? সাহিত্যচর্চা করবার লোক পেলে না? চুপ করো সব।”

লালজি তখনও রাগে গরজাচ্ছে, “এ লোক তো অ্যায়সাই হ্যায়। এ লোক সব কুছ সমঝে গা। হাম লোক কুছ নেহি সমঝে। সাহিত্য দিখাতা হ্যায় হামকে। হামারা বুধরাম আগরওয়ালাকা কিতাব পড়নে সে এ লোক ক্যা বোলেগা।”

বাবলু এবার বিনীত গলায় বলল, “আপনি আমাদের ভুল বুঝছেন লালাজি। হতে পারেন আপনাদের আগরওয়ালজি বড় একজন সাহিত্যিক। আমরা তো ছোট-বড়র তর্ক করছি না। আপনি শুধু সাহিত্যের সঙ্গে রুপিয়াকে টেনে আনছেন তাই…।”

লালাজি হাত মুখ নেড়ে বলল, “আরে বাবা ও বাত হো চুকা। তুম হামারা সাথ বাত মাৎ বোলো। একদম চুপচাপ রহো তুম।”

অগত্যা বাধ্য হয়েই চুপ করল বাবলু। এবং ইশারায় অন্যদেরকেও চুপ করতে বলল।

এদিকে সেই বিড়ির ধোঁয়া ছাড়ার ব্যাপারে নিয়ে তরুণী এবার ঘোর আপত্তি জানাল,“কী আশ্চর্য! বিড়ি খেয়ে ধোঁয়াটি কি বাইরে ছাড়া যায় না?”

খেঁকুরে লোকটিও এবার চোটপাট জবাব দিল,“অত যদি ইয়ে তো লেডিজ কম্পার্টমেন্টে যাননি কেন? সেই থেকে খালি টিকটিক করছেন।”

তরুণী আরও রেগে বলল,‘কী! ভদ্রভাবে কথা বলতে শেখেননি? কোথায় গেলেন চেকারবাবু? রেলের আইনে কামরায় বসে বিড়ি খাওয়ার নিয়ম আছে কিনা জানতে চাই। অসভ্য কোথাকার।”

বেগতিক দেখে ওধার থেকে একজন চেকার ছুটে এলেন।“কী হয়েছে দিদি? কী ব্যাপার!”

“এই লোকের বিড়ি খাওয়া আপনি বন্ধ করবেন কিনা? বলছি বলে আমাকে আবার উপদেশ দিচ্ছেন লেডিজ কম্পার্টমেন্টে যেতে।”

চেকার বললেন,“উপদেশ দেয়াচ্ছি।” বলেই লোকটিকে বললেন,“দেখি, টিকিট দেখি আপনার?”

লোকটি টিকিট দেখাল।

“মুখ থেকে ওটা ফেলুন। শিগগির ফেলুন। না হলে জরিমানা হয়ে যাবে।”

লোকটি আধ খাওয়া বিড়িটা বাইরে ফেলে দিল।

চেকার বললেন,“ট্রেনের কামরায় ধুমপান একদম নিষেধ। বুঝলেন? স্মোকিং ইস স্ট্রিকলি প্রহিবিটেড।”

চেকার এবার বাবলুর কাছে এসে বললেন,“দেখি টিকিট?”

বাবলু প্রত্যেকের টিকিট দেখাল।

চেকার চেক করলেন।

মধ্যবয়সি ভদ্রলোক বললেন,“পাস।”

চেকার সেদিক থেকে মুখ সরিয়ে এনে লালাজিকে বললেন,“আপকা টিকিট?”

“সেহি হ্যায়। বানানে পাড়েগা।”

“দশ রুপিয়া ফাইন হো যায়গা।”

“আরে বিশ রুপিয়া ফাইন করো না বাবা। উসমে ক্যা হ্যায়? যো লাগে গা ও তো দেনেই পড়েগা।”

“তো ঠিক হ্যায়। দে দিজিয়ে। কাঁহা যায়েঙ্গে।”

“ঘাটশিল্লা।”

“রুপিয়া নিকালো।”

“ক্যা রুপিয়া রুপিয়া করতা হ্যায় আপ। দেখিয়ে দোসরা আদমিকা টিকিট। উসকে বাদ আইয়ে। হাম দে দুঙ্গা।”

চেকার এবার একটু বিরক্তিপূর্ল গলায় বললেন,“আমি কারও বাবার চাকর নই যে দশবার ধরে আসব যাব। রুপিয়া নিকালিয়ে।”

লালাজি এবার খাড়া উঠে দাঁড়িয়ে বলল,“চলিয়ে বাথরুম কা উধার।”

চেকার বেশ কড়া-মেজাজের লোক। রাগত চোখে লালাজির দিকে তাকিয়ে বললেন,“বাথরুমের ওদিকে কি যাব?”

“চলিয়ে না বাবা?”

“ওসব দু’নম্বরি কারবার আমার সঙ্গে চলবে না। হয় টাকা, নয়তো খড়্গপুর এলে পুলিশে হ্যান্ডওভার করে দেবো।”

পুলিশের নাম শুনতেই লালাজির বুক ধড়াস করে উঠল। আর কোন কথা না বলে ধপ করে বসে পড়ল আবার। তারপর কোটের পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বার করে চেকারের হাতে দিল।

চেকার বাবলুর পাশে সামান্য একটু জায়গা নিয়ে বসে টিকিট তৈরী করতে লাগলেন।

ওদিকে তরুণীর সামনের জানালার ধারে বসে থাকা খেঁকুরে লোকটি হঠাৎ খিক খিক করে হেসে উঠল।

তরুণী ক্রুদ্ধ চোখে একবার সেদিকে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,“ইডিয়ট।”

লোকটি ভ্রক্ষেপও করল না সে কথায়। আবার হঠাৎ কী মনে করে কুল কুল করে হেসে উঠল। তারপর হেঁট হয়ে ঝুঁকে পড়ে সিটের নীচেটা একবার দেখে নিয়েই লাফিয়ে উঠল,“তাই তো বলি সেই থেকে আমার পায়ে এমন সুড়সুড়ি দিচ্ছে কে!”

তরুণীও এবার ভ্র কুচকে বিস্মিত হয়ে পঞ্চুর দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে! এটা তো কুকুর। কুকুর ঢুকল কোথা থেকে?”

“কোথা থেকে ঢুকল তা কী করে বলব? আপনি কী ভেবেছেন এতক্ষণ আমি এমনি এমনি হাসছি? আমি কি পাগল? সেই থেকে ব্যাটা আমার পায়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে।” বলে লোকটি সিটের ওপর পা তুলে উবু হয়ে বসল।

বাবলুর পাশে বসা সেই চশমা চোখে ভদ্রলোক বললেন—“দেখে তো কারও পোষা কুকুর বলে মনে হচ্ছে।”

বাবলুরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।

তরুণীও এবার চাপা গলায় বাবলুকে জিজ্ঞেস করল, “কামড়ে দেবে না তো?”

বাবলু ঘাড় নেড়ে বলল, “না।”

চেকার লালাজিকে টিকিট দিয়ে চলে গেলেন।

চেকার চলে যাওয়া মাত্রই খেঁকুরে লোকটি ‘আমি বাবা সরে বসি’ বলে ওদিকের সিট থেকে প্রায় লাফিয়ে এদিকের সিটে লালাজির পাশে এসে বসল।

পঞ্চুও বুঝি সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। যা সে কখনও করেনি দুষ্টুমি করে এবার তাই করল। অর্থাৎ লোকটি উঠে যেতেই সে করল কী সিটের তলা থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে সেই সিটেরই ওপর উঠে পড়ল। তারপর দিব্যি ভব্যিযুক্ত হয়ে জানলা দিয়ে দৃশ্য দেখতে লাগল বাইরের।

চেকার এতক্ষণ খেয়াল করেননি। এবার পঞ্চুকে দেখেই ছুটে এলেন, “এই-এই—এ কী ! এ ব্যাটা কোত্থেকে এল?”

পঞ্চু চেকারের দিকে তাকিয়ে গর গর করে বলল, “ভৌ।”

চেকার আর না এগিয়ে বললেন, “চোপ। চোপ রও ব্যাটা। হ্যাট হ্যাট।”

চেকারের বলার ধরণ দেখে মনে হল তিনি কুকুর সম্পর্কে যথেষ্ট সাবধান। এবং কুকুরকে বেশ ভয় পান।

তরুণীটি তাই দেখে বলল, “থাক থাক। ওকে একদম ঘটাবেন না। কারও তো কিছু করছে না ও। বরং তাড়াতুড়ি দিলে ভয় পেয়ে কাউকে কামড়ে দিতে পারে।” বলে পাশে রাখা ব্যাগ থেকে বিস্কুট বার করে খেতে দিল পঞ্চুকে।

চেকার এবার আর একটু কাছে এগিয়ে এসে বললেন, “বাঃ। বেশ সভ্যভব্য কুকুর দেখছি। চলো বাবা খড়গপুর পর্যন্ত। তারপর দিচ্ছি তোমায় আসল জায়গায় পাঠিয়ে।”

তরুণী আবদার করে বলল, “না না। কিছু বলবেন না ওকে, প্লিজ। আমার খুব ভাল লাগছে। নিশ্চয়ই

কারও পোষা কুকুর।”

চেকার বললেন, “অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট। না হলে রেলের মাথায় টুপি পরিয়ে বিনা টিকিটে এমন দেশ ভ্রমণে বেরোয়?”

বাবলুরা কেউ কিছুটি না বলে চুপচাপ বসে রইল।

অন্যান্য যাত্রীরাও তখন পঞ্চুর কীর্তি দেখে বেশ মজা পেয়ে গেল এবং যে যা পারল খেতে দিল।

পঞ্চুও মনের আনন্দে যে ডাকল তার কাছেই গেল। এবং যে যা দিল তাই খেতে লাগল।

দেখতে দেখতে খড়গপুর এসে গেল।

দু’মিনিট মাত্র স্টপেজ।

তারপর আবার ছুটতে লাগল ট্রেন।

মাঝে ঝাড়গ্রামে একবার থামল। তারপরই ঘাটশিলায়।

বাবলুরা ট্রেন থেকে নামতেই পঞ্চুও নামল এবং যথারীতি স্টেশনের বাইরেও এল।

মোট কথা নির্বিঘ্নেই ঘাটশিলায় পৌছে গেল ওরা।

ঘাটশিলা।

যেন স্বপ্নের মতো একটা দেশ।

চারদিকে পাহাড়ের পাঁচিল। তারই একধারে শহরের গা বেয়ে বয়ে চলেছে সোনার নদী সুবর্ণরেখা। একধারে সুবর্ণরেখা এবং অপর পারে যে ঘন বন ও পাহাড়ের আড়াল সেখান থেকে নেমে এসেছে এক ছোট্ট চঞ্চলা গিরিধারা। নাম ধারাগিরি।

এই ঘাটশিলার কত গল্পই না শুনেছে বাবলু।

ওর ছোট মাসিরা তো প্রায়ই আসেন ঘাটশিলা বেড়াতে।

আজ বাবলুরাও এল।

বিস্তৃত শালবন, গভীর অরণ্যানী। শ্যামল উপত্যকা, ফুলডুংরি পাহাড়, হরিণ ধুবড়ি (হরিণ ধুকুড়ি) আর তামুকপালের নির্জন গিরিনদীর কিনারে বনের মধ্যে ছোট্ট মন্দিরটির কথা শুনে বাবলুর মনের মধ্যে ঘাটশিলার একটা কাল্পনিক ছবি আঁকা হয়েছিল।

সেই স্বপ্ন সার্থক হল আজ।

স্টেশনের কাছেই পায়ে হেঁটে মাত্র দুমিনিটের পথ, মাড়োয়ারিদের ধর্মশালা। খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ওর মামা এসে একবার সাত দিন ছিল সেখানে মামার মুখেও ঘাটশিলার গল্প শুনেছে বাবলু। বাবলুর কাছে ঘাটশিলা তাই এক রূপকথার দেশ।

মৌভাণ্ডার, মোসাবনী, ফুলডুংরির কোল ঘেঁষে দিগন্তে মেশা গালুডির পথের বর্ণনা ওর মনকে পাগল করে তুলত। মৌভাণ্ডারের বিরাট কারখানার অভ্যন্তরে আধুনিক শিল্পের ক্রমবিকাশ দেখার ইচ্ছা কি ওর কম ছিল ? সুবর্ণরেখার তীরে সূর্যাস্তের সমারোহ দেখার সাধ ওর কত দিনের। সেই যে পাহাড়ের পর পাহাড়ের মালা চলে গেছে, নীচে তার শ্যামল শালবন, চওড়া বালি চিকচিকিয়ে সোনার নদী পাথরে পাথরে প্রতিহত হয়ে ঝরঝর শব্দে নেচে চলেছে। বুকে তার বাধ বেঁধে মোসাবনী রোড চলে গেছে বনের ভেতর দিয়ে কত দূরে—

সত্যি! কী দারুণ ফ্যানটাস্টিক।

স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে বাবলুরা দুটো রিকশা নিয়ে ফুলডুংরি পাহাড়ের কাছে একটা বাগানবাড়িতে এসে উঠল। বাবলুর ছোট মাসিমারা যখন ঘাটশিলায় আসেন তখন এখানেই ওঠান। ভারী সুন্দর আর নির্জন এই জায়গাটা।

বাড়িটা দোতলা। ওরা দোতলার ঘরেই উঠল। নীচে কেউ থাকে না। ওটা তালা বন্ধই থাকে সব সময়। অনেক দিনের পুরনো বাড়ি। জানালা আছে, তার দু-একটির পাল্লা নেই। দরজা আছে, তবে ভেতরের খিল বা ছিটকিনি নেই। তা নাই থাক। তবু ঘর ভাল। বেশ বড় সড় ঘর। হাত পা ছড়িয়ে শোওয়া বসা যায়। বাড়ির আশপাশের চৌহদ্দিটা পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। সেখানটা বাগান। একপাশে মালির ঘর। এখন বাগানেরও ছিরি নেই। মালিও নেই। আছে দারোয়ান। বেশ মোটা সোটা নাদুসনুদুস বোকা সোকা চেহারা। গোঁফটি পাকানো। ভুড়িটা ট্রেনে দেখা সেই লালাজিকেও হার মানিয়ে দেয়। তবে লোকটির ব্যবহার ভাল। সে-ই রিকশা থেকে মালপত্তরগুলো কাঁধে করে ওপরে ওঠালো। বাবলুদের ঘর খুলে দিল। বাবলুরা তো দারুণ খুশি।

ঘরে মালপত্তর রেখে বাগানের কুয়ো থেকে জল তুলে বাবলুরা মুখ-হাত-পা ধুয়ে নিল প্রথমে। তারপর ঘরে তালা দিয়ে হইহই করে বেরিয়ে পড়ল সব।

এখন তো শুধু খাওয়া আর ঘোরা।

প্রথমেই ওরা একটা দোকানে ঢুকে বেশটি করে জলযোগ সেরে নিল। তারপর চা খেয়ে পায়ে পায়েই হেঁটে চলল ফুলডুংরি পাহাড়ের দিকে।

ফুলডুংরিকে অবশ্য পাহাড় না বলে টিলা বলাই ভাল। বেশিক্ষণ সময়ও লাগে না উঠতে। আর ওপরে উঠলে ঘাটশিলার চারদিকের বন পাহাড় ও শহর সভ্যতার প্রায় সব কিছুই দেখতে পাওয়া যায়।

বাবলুরা তো ফুলডুংরির সৌন্দর্যে এমনই মোহিত হয়ে গেল যে মনের আনন্দে ছুটোছুটি লাগিয়ে দিল সেখানে। সেই সঙ্গে পঞ্চুর সে কী ধেই ধেই নাচুনি। মোট কথা ওরা ওদের সমস্ত রকমের আবেগের উচ্ছাসে সমস্ত জায়গাটা মুখর করে তুলল।

ফুলডুংরি থেকে নেমে ওরা চলল বিভূতিবাবুর বাড়ির দিকে। সেটা দেখে দুটো রিকশা নিয়ে সোজা মৌভাণ্ডার।

সুবর্ণরেখা নদীর তীরে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ অঞ্চল। পাশেই সেতু। ওরা অনেকক্ষণ ধরে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নদী দেখল।

বাবলু ছোট মাসির মুখে শুনেছিল যারা ঘাটশিলা যায় অথচ রাতমোহনা যায় না তাদের নাকি ঘাটশিলা ভ্রমণই সার্থক হয় না। রাতমোহনা প্রকৃতির এক আশ্চর্য সুন্দর স্থান। পূর্ণিমার রাতে রাতমোহনার দৃশ্য কী দারুণ মোহময় তা যে না দেখেছে তাকে বলে বোঝানো যাবে না। লোকে দূর দুরান্তের কত কী দেখতে যায়। পূর্ণিমার রাতে মানুষের তৈরি আগ্রার তাজমহল কিংবা ফতেপুর সিক্রির সৌন্দর্যে পাগল হয় লোকে। অথচ বিশ্ব প্রকৃতির নিজের সৃষ্টি এই রাতমোহনার অনিন্দনীয় সৌন্দর্যরাশি দেখতে খুব কম লোকই নাকি উৎসাহ নিয়ে আসে।

বাবলু বলল, “আমার ছোট মাসির মুখে রাতমোহনার কথা শুনেছিলাম। তোদেরও বলেছি। মনে আছে নিশ্চয়ই?”

সবাই বলল, “হ্যাঁ। হ্যাঁ।”

“শুনেছি রাতমোহনা নাকি এই মৌভাণ্ডারেরই কাছাকাছি কোথাও।”

“কিন্তু কে বলতে পারে?”

এক বিহারি ভদ্রলোক সেতুর ফুটপাত ধরে এদিকে আসছিলেন।

বাবলু তাকেই জিজ্ঞেস করল, “শুনছেন?”

ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন।

“বলতে পারেন রাতমোহনা কোনদিকে?”

কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করলেন ভদ্রলোক। তারপর বললেন, “রাতমোহনা? ও নাম তো শুনা নেই কভি।”

এইভাবে একের পর এক লোককে জিজ্ঞেস করতে লাগল বাবলু। সবাই সেই একই কথা বলল।

এমন সময় একটি আদিবাসী মেয়ে যাচ্ছিল পথ দিয়ে। বাচ্চু তাকে জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি হেসে বলল,“রাতমোহনা? উ দেখ রাতমোহনা।”

বিচ্ছু অবাক হয়ে বলল, “ওইটা?”

“হ্যাঁ”

বাবলুরা দেখল সেতুর ডানদিকে যে বিস্তীর্ণ উপলভূমির উপর দিয়ে নাচের ছন্দে বয়ে আসছে সুবর্ণরেখা সেদিকটা কত সুন্দর।

মেয়েটি বলল, “যা। উখানকে যা। বড় ভাল জায়গা বটেক।”

বাচ্চু বলল, “আমরা নতুন এসেছি। তুমি আমাদের সঙ্গে যাবে?”

মেয়েটি কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “চার আনা পয়সা দিবি?”

বাবলু বলল, “না। চার আনা পয়সা দেব না।”

“কত দিবি তবে?”

“যদি এক টাকা নিস তা হলে দিতে পারি।”

মেয়েটি তো আনন্দে লাফিয়ে উঠল উর র র রে’। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস করতে পারল না। ও চাইল চার আনা। আর এরা দিতে চায় কিনা এক টাকা! এ যে ভাবাই যায় না।

বাবলু বলল, “বিশ্বাস হল না তো? এই নে।” বলে সত্যি সত্যিই একটা টাকা মেয়েটির হাতে দিল।

মেয়েটি খুশি হয়ে চলল ওদের সঙ্গে।

ওরা দলবদ্ধ হয়ে মেয়েটির সঙ্গে মিনিট পাঁচেক হেঁটেই রাতমোহনায় পৌছুল।

সে কী অপূর্ব সুন্দর জায়গা। সাগরের যেমন কুল-কিনারা নেই, দিগন্তেরও এখানে শেষ নেই। চার দিকে শুধু উপলখণ্ড ও সোনা রুপা তামা অভ্রের রেণু মাখানো পাথরের খাজ। যতদূর চোখ যায় শুধু নদী বালি আর পাথর। কালো পাথর নয়। মার্বেল পাথরের মতো সাদা লাল সোনালি। এক সময় হরিণ ভালুক হায়না ও চিতারা এখানে রাত্রিবেলা জল খেতে আসত। এখন বন্যজন্তুর সংখ্যা কমে গেছে। সুবর্ণরেখার তীরে তীরে ঘন বসতি হয়ে গেছে। তাই তারা আরও দূরে চলে গেছে। অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে।

ফেরার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটি সাঁওতাল পল্লীর ভেতর দিয়ে ফিরল ওরা। এখানকার সাঁওতালরা খুব স্মার্ট। এরা অন্যান্যদের মতো নয়। তার কারণ এখানকার আদিবাসীদের প্রায় সব মেয়ে-পুরুষই কপার মাইনসে কাজ করে। হাতে ওদের ভাল টাকা খায় দায় নাচ গান করে। হিন্দি সিনেমা দেখে। ডাঁটে থাকে।

বাবলু বলল, “রাত-ভিত এখানে আসা কিন্তু খুবই বিপজ্জনক।”

বিলু বলল, “ওই জন্যেই মনে হয় কেউ আসে না।”

বাবলু বলল, “আমার ছোট মাসিমারা এসেছিলেন কুড়ি জনের দল নিয়ে পূর্ণিমার রাতে।”

এমন সময় হঠাৎ পঞ্চুকে দেখে কয়েকটা কুকুর বাঘের মতো তেড়ে এল। সাঁওতালদের কুকুর সব।

এই প্রথম ভয়ে আর্তনাদ করে উঠল পঞ্চু।

বাবলুরাও ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

ওদের অবস্থা দেখে অন্যান্য সাঁওতালরা ছুটে না এলে খুবই বিপদে পড়ত ওরা।

যাই হোক, আবার মৌভাণ্ডারে এসে একটা ভাল হোটেলে পেট ভরে মাংস ভাত খেয়ে নিল ওরা। তারপর দুপুরের মধ্যেই বাসায় ফিরে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে দিয়ে বেজায় ঘুম।

বিকেলবেলা ওরা সবাই চলল রংকিনী মন্দিরে। নরখাদিনী রংকিনীর এখানে রবরবা খুব। যাবার সময় একটা খাবার দোকানে ঢুকে ওরা পাঁচজনে পেট ভরে লেডিকেনি ল্যাংচা রসগোল্লা, রসমালাই খেল। রসমালাই খেয়ে পঞ্চু যে কী খুশি তা বলে বোঝাবার নয়।

প্রথমে ওরা হেঁটে হেঁটে স্টেশনের কাছে এল। তারপর বাঁদিক দিয়ে সোজা চলে গেল হরিণধুবড়ি। হরিণধুবড়িতে পাথরের খাঁজে খাঁজে ছোট নদীটির লুকোচুরি দেখে, ভাঙা রাজবাড়ি দেখে আবার স্টেশনের দিকেই মুখ করে ফিরল। স্টেশনের কাছাকাছি থানার গায়েই মা রংকিনীর মন্দির। তার পাশে মেইন রোডের সংলগ্ন ছোট্ট একটি হাট। বুধবার আর শনিবার এই হাট বসে। আদিবাসীদের হাট। দলে দলে আদিবাসীরা এই হাটে এসে বিকিকিনি করে।

হাট দেখে ওরা মন্দিরে ঢুকল। অঞ্চলের লোকেরা সবাই মান্যগণ্য করে এই দেবীকে। মা যে ভয়ংকরী। মন্দিরের চাতালে দেখা গেল ট্রেনের সেই লালজিকে। পুজো দিতে এসেছিলেন বোধ হয়। লালজি বলল, “কী খোকাবাবু, ঘুমনে ফিরনে মে কুছ তকলিফ হোতা নেহি তো?”

বাবলু বলল, “না।” বলে মন্দিরে ঢুকল।

মন্দিরে ঢুকে রংকিনী দর্শন করে সেবাইতকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা রংকিনী নামে কোনও দেবীর কথা তো আমরা কখনও শুনিনি। এই দেবী সম্বন্ধে কিছু কি আমাদের বলতে পারেন?”

সেবাইত বললেন, “নিশ্চয়ই। যদি শুনতে চাও তো বলি। মন দিয়ে শোন। যে কাহিনী তোমাদের শোনাব তা যেমনই রোমহর্ষক তেমনই অবিশ্বাস্য।”

বাবলু বলল, “তাই নাকি? বলুন তবে।”

সেবাইত বললেন, “মা রংকিনী আগে থাকতেন গালুডির বনে। একবার কয়েকজন ডাকাত মা রংকিনীকে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় পুলিশের তাড়া খেয়ে এইখানেই তারা মাকে নামিয়ে রেখে পালায়। আবার কেউ বা বলেন—”

“গালুডি এই তো কাছেই। ঘাটশিলা থেকে টাটানগর যাবার পথে পড়ে।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা তারপরে বলুন।”

“হ্যাঁ। তারপর যা বলছিলাম। অনেকে বলেন গালুডি থেকে সাতগুডুম নদী পেরিয়ে গভীর বনের ভেতর এক পাহাড়ের গুহায় আগে মা রংকিনীর অধিষ্ঠান ছিল। আমি নিজেও গিয়ে দেখে এসেছি সেই স্থান। ভারী মনোরম। অনেক—অনেকদিন আগে যখন রংকিনীকে কেউ জানত না তখন একদিন দেবী ওইখানকার গ্রামের প্রধানকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন।

স্বপ্ন দেখে ভোরবেলা প্রধান করলেন কী লোকজন নিয়ে বনের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে একটি পাহাড়ের কাছে এসে দেখলেন একটি পাথরে খোদাই করা অপূর্ব কালীমূর্তির সামনে এক ভয়ংকর চেহারার কাপালিক বসে আছে।

প্রধান তখুনি গ্রামের লোকজনের সাহায্যে মন্দির তৈরি করার ব্যবস্থা করতে লেগে গেলেন। পাহাড়ের পাথর কেটে সেই ঘন অরণ্যে মা রংকিনীর মন্দির তৈরি হল। মন্দিরের পূজারি হল কাপালিক। পরে আরও অনেক কাপালিক এসে জুটল সেখানে। কাপালিকদের একটা আখড়া গড়ে উঠল।

এদিকে দেবী যখন প্রধানকে স্বপ্ন দিয়েছিলেন তখন এও বলে দিয়েছিলেন যে মন্দির তৈরি হবার পর মায়ের সামনে প্রতিদিন একটি করে নরশিশু বলি দিতে হবে।

প্রধান সেই স্বপ্নাদেশ শুনে বলেছিলেন—তা কী করে সম্ভব মা! তোমার পূজার বলির জন্য অত নরশিশু আমি কোথায় পাব?

দেবী স্বপ্নে বলেছিলেন—আমার সেবায়েতরাই বলির নরশিশু সংগ্রহ করে আনবে। কাজেই স্বপ্নাদেশ মতোই কাজ হতে লাগল। প্রতিদিন গভীর রাত্রে মা রংকিনীর সামনে একটি করে নরশিশু বলি হত। সে এক পৈশাচিক কাণ্ড। মন্দিরে পাশেই একটি প্রকাণ্ড গুহার ভেতরে বিভিন্ন স্থান থেকে শিশুদের ধরে এনে বন্দি করে রাখা হত। সেই গুহা এখনও আছে।

গুহার ভেতরে পাথর কেটে বড় একটি ঘরের মতো তৈরি করা হয়েছিল। ঘরটিও আছে। পাহাড়ের ঝরনার জল একধারে বড় একটি চৌবাচ্চার মতো জায়গায় জমছে। তারই এক পাশ দিয়ে গেছে আর একটি সুড়ঙ্গ-পথ। যেটি জঙ্গলের অন্য প্রান্তে গিয়ে মিশেছে।

সুড়ঙ্গ-মুখ পাথরের পাঁচিল দিয়ে ঘেরা।

গুহা-মুখও বড় বড় পাথরের চাই দিয়ে বন্ধ করা যাতে ছেলেরা কোনওরকমেই টপকে পালাতে না পারে।

একবার হল কী এক কাপালিক মেদিনীপুরের একটি রাখাল ছেলেকে এই জঙ্গলের ফুল শুকিয়ে অজ্ঞান করে এখানে বলির জন্য নিয়ে আসে। এই জঙ্গলে এক রকম ফুল হয় যা শুকলেই মানুষ অজ্ঞান হয়ে যায়। সেই ফুল শুকিয়েই নিয়ে আসা হয় ছেলেটিকে। এবং এখানকার অন্যান্য বন্দি শিশুদের সঙ্গে রাখা হয় তাকে।

ছেলেটি বেশ বলবান এবং অন্যান্য শিশুদের চেয়ে একটু হৃষ্টপুষ্ট ও বুদ্ধিমান ছিল। কী করে যেন সে ওই পাথরের আড়াল করা চাইগুলোর মধ্যে একটু ফাঁক দেখতে পায় এবং সেই ফাঁক দিয়ে আরও চারটি ছেলেকে নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালায়।

পরদিন সকালে কাপালিকরা তো ছেলেগুলোকে দেখতে না পেয়ে অবাক। সারাদিন ধরে আশপাশের জঙ্গলে অনেক খোঁজাখুঁজি করল তারা। কিন্তু কোথায় কে? অবশেষে হাল ছেড়ে দিল।

দিন দুই বাদে হঠাৎ দেখা গেল শত শত পুলিশ এসে সেই মন্দির এবং গুহাটাকে ঘিরে ফেলেছে। তাদেরসঙ্গে রয়েছে একজন লালমুখো সাহেব এবং সেই রাখাল ছেলেটি। ছেলেটি সাহেবকে বধ্যভূমি এবং গুপ্তস্থান দেখিয়ে দিল।

পুলিশের লোকেরা সঙ্গে সঙ্গে সেই পাথরের অবরোধ সরিয়ে অন্যান্য ধৃত শিশুদের উদ্ধার করল। এবং একধার থেকে সবকটা কাপালিককে গ্রেপ্তার করল।

সাহেব কাপালিকদের জিজ্ঞেস করলেন—তোমরা এইভাবে নরবলি দিচ্ছ কেন এখানে?

কাপালিকরা বলল—দেবীর আদেশ।

—কোন দেবীর ?

—মা রংকিনীর।

—এই দেবী কথা বলতে পারে?

—পারে। তবে মেচ্ছদের সঙ্গে বলে না।

—ঠিক আছে। আমি দেবীকেও গ্রেপ্তার করছি। বলেই সঙ্গের লোকজনদের বললেন—এই তোরা এই পাষাণী মূর্তিটাকেও বন্দি কর।

পুলিশের লোকেরা তাই করল।

আর যায় কোথা? দেবীর গায়ে হাত! আশপাশের গ্রাম থেকে লোকজনরা দলে দলে এসে তির, কাঁড় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল সাহেবের ওপর।

সে এক তুলকালাম কাণ্ড।

রীতিমতো খণ্ডযুদ্ধ বেধে গেল তখন।

সাহেবও বেপরোয়া গুলির নির্দেশ দিলেন। বন্দুকের গুলির কাছে সামান্য তির, কাড় নিয়ে সাধারণ জনতা কতক্ষণ যুঝতে পারে? তাই ধড়াদ্ধড় করে দু-চারটে লাশ যেই না পড়ল অমনি সব ফাঁকা।

সাহেব গালুডির বন থেকে মা রংকিনীকে পর্যন্ত নিয়ে এলেন ঘাটশিলা থানায়। অবশ্য সাহেব দেবীকে স্পর্শ করে অপবিত্র করলেন না। কাপালিকদের দিয়েই বইয়ে আনলেন। এবং থানার এক প্রান্তে দেবীকে রেখে সাতদিনের মধ্যে মন্দির তৈরি করিয়ে দেবীকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন।

স্থানীয় জনসাধারণের রাগ কিন্তু তাতেও কমল না। চারদিকে দারুণ বিশৃঙ্খলা। সাহেব কেন মা রংকিনীকে তার আসল জায়গা থেকে উঠিয়ে এনেছেন তার কৈফিয়ত চাইল সকলে।

সাহেব বললেন—এই এতগুলি শিশুহত্যা কার আদেশে হয়েছে?

কাপালিকরা বলল—মা রংকিনীর।

—তা হলে এই শিশুহত্যার জন্য মা রংকিনীই দায়ী?

—হ্যাঁ।

—আমিও তা হলে খুনের দায়ে এই নরখাদিনী দেবীকে বন্দি করে এনে ঠিক-ই করেছি। এর বিচার হবে।

সবাই চুপ।

সাহেব কাপালিকদের বললেন—এই এতগুলি শিশুহত্যার জন্যে যে মা রংকিনীই দায়ী এমন কোনও প্রমাণ দিতে পারবে তোমরা? না হলে নরহত্যার দায়ে ফাঁসি হবে তোমাদের।

কাপালিকরা বলল—আমরা মায়ের সন্তান। নিশ্চয়ই পারব।

সাহেব পড়লেন মহা সমস্যায়। একদিকে কাপালিকদের অন্ধ সংস্কারের বিরুদ্ধে তার অভিযান, অপরদিকে জনতার রোষ। তবুও তিনি বললেন—আমি প্রমাণ চাই। দেখাও তোমাদের দেবী কীরকম নরখাদিনী।

কাপালিকরা বলল—বেশ। মায়ের চরণে উৎসর্গ করার জন্য নরশিশু সংগ্রহ করা হোক।

সাহেব তখন জনতার কাছে প্রার্থনা করলেন—আপনারা যখন দেবীর ওপর এতই প্রসন্ন তখন আপনাদেরই ভেতর থেকে যে কেউ একটি শিশুকে দান করুন।

কিন্তু কে দেবে তার ছেলেকে? কেউই দিল না।

অতএব ট্যাড়া পড়ল।

একটি শিশুর জন্য তখনকার দিনে এক লক্ষ টাকা ঘোষণা করা হল।

তাতেও কেউ এগিয়ে এল না।

অবশেষে এক সৎমা এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তার সৎ ছেলেটিকে তুলে দিল কাপালিকদের হাতে।

রাত্রি দ্বিপ্রহরে শিশুটিকে স্নান করিয়ে নতুন ধুতি পরিয়ে কপালে সিঁদুরের ফোঁটা দিয়ে কাপালিকরা মায়ের মন্দিরে ঢুকিয়ে দিল। এবং দরজায় তালা দিল।

বাইরে সহস্রাধিক জনতা। অজস্র পুলিশের কড়া পাহারা। সাহেবও রাত জেগে মন্দিরের দ্বারে বসে রইলেন। আর কাপালিকরা সমানে চিৎকার করতে লাগল—মা মাগো! তোর বলি তুই নিজেই গ্রহণ কর মা। তোর অপূর্ব মহিমা তুই দেখিয়ে দে।

যথাসময়ে সকাল হল।

মন্দিরের দ্বার খুলে দেখা গেল কোথায় কে? ছেলেটি যেন কোন জাদুমন্ত্র বলে ঘরের ভেতর থেকে উধাও হয়ে গেছে।

হাজার হাজার জনতা তখন জয়ধ্বনি করতে লাগল-জয় মা রংকিনীর জয়। .

সাহেব বুঝলেন এ সবই কাপালিকদের কারসাজি। তারা নির্ঘাত কোনও গুপ্তবিদ্যায় ছেলেটিকে অন্তৰ্হিত করেছে। তাই আর কোনওরকম বাদানুবাদের ভেতরে না গিয়ে পুলিশের সাহায্যে জনতাকে ছত্রভঙ্গ করালেন এবং সব কটা কাপালিককে একধার থেকে চালান করলেন আন্দামানে।

মা রংকিনীও সেই থেকে রয়ে গেলেন থানার পাশে এই মন্দিরে। এই সেই রংকিনী।”

রংকিনীর কাহিনী শুনে বাবলুরা হতবাক হয়ে গেল।

সন্ধে পেরিয়ে রাত্রি হয়েছে তখন। ওরা আর দেরি না করে ফিরে এল বাসায়।

পরদিন সকালে বাবলুরা আবার চলল ফুলডুংরি বেড়াতে। ফুলডুংরি ছোট্ট টিলা হোক। তবু মনটা যেন ভরিয়ে দেয়। পাহাড়ের ওপর উঠতেই ওরা দেখল গতকাল ট্রেনের কম্পার্টমেন্টে ওদের দিদির বয়সি যে তরুণীকে দেখা গিয়েছিল সেই তরুণীটি এই অপূর্ব স্বপ্নরাজ্যে ভাবে বিভোর হয়ে গুণ গুণ গান গেয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যের ছবি আঁকছে।

বাবলু পা টিপে টিপে তরুণীর কাছে গেল। গিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে থেকে এক সময় বলল, “বাঃ। বেশ চমৎকার এঁকেছেন তো।”

তরুণী তন্ময় হয়ে ছবি আঁকছিল। তাই বাবলুর গলার স্বর শুনে চমকে বলল, “কে!” তারপর বাবলুকে দেখে বলল, “ওমা তুমি।”

বাবলু মিষ্টি করে হাসল।

“ছবিটা ভাল লেগেছে তোমার?”

“হ্যাঁ।”

.ততক্ষণে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং পঞ্চুও এগিয়ে এসেছে।

তরুণী রং-তুলি রেখে বলল, “তোমরা তো কাল এসেছ। এখানে উঠেছে কোথায়?”

ফুলডুংরি থেকে বাবলুদের ঘরটা দেখা যায়। বাবলু অঙ্গুলি সংকেতে দেখিয়ে দিল, “ওই যে। ওই বাড়িটায়।”

“খুব ভাল। তোমরা কি পাঁচজনেই না আর কেউ আছেন তোমাদের সঙ্গে।”

“কেউ না। আমরা পাঁচজন আর আমাদের সঙ্গী এই কুকুর। আমরা যখন যেখানে যাই এই ক’জনেই যাই। আর কেউ থাকে না আমাদের সঙ্গে।”

তরুণী হেসে বলল, “তোমাদের দেখে আমার গল্পের বইতে পড়া সেই পাণ্ডব গোয়েন্দা আর পঞ্চুর কথা মনে হচ্ছে।”

বাবলু বলল, “আমরা তো তারাই।”

“সত্যি ! সত্যি বলছ!”

“সত্যি না তো কি মিথ্যে? এই আমরা মূর্তিমান হয়ে আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”

“আরে! আমি তো ভাবতাম ও সব বানানো গল্প।”

“মোটেই না। আমরা সত্য এবং জীবন্ত।”

তরুণী সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছুকে বুকে জড়িয়ে ধরল। পঞ্চুকে আদর করল। তারপর বলল, “এসো তোমরা, আমার মা-বাবা-সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দিই। কী খুশি যে হবেন তারা তোমাদের দেখলে। এসো।”

এই টিলার পাশেই একটি চমৎকার ডাকবাংলো রয়েছে। সেখানে এক ভদ্রলোক এবং ভদ্রমহিলা বসে বসে কফি খাচ্ছিলেন।

তরুণী বাবলুর হাত ধরে তাদের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, “বাপি এই দেখ কাদের এনেছি।”

“কে মা !”

“এরাই সেই বিখ্যাত পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

ভদ্রলোক বললেন, “তাই নাকি! মিঠুমা তো তোমাদের নিয়ে লেখা গল্প দেখলেই পড়ে। পাণ্ডব গোয়েন্দা বইও তো একটার পর একটা খণ্ড বেরোচ্ছে আর কিনে এনে পড়ছে। আমিও পড়েছি। যাক। কী খাবে বলো দেখি? আগে বসো সব। তোমাদের কিছু জলযোগ করাই।”

বাবলু বলল, “আমরা এই মাত্র খেয়ে আসছি।”

“তা হোক। কিছু কেক আর সন্দেশ খেলে খুব একটা খারাপ হবে না।”

ভদ্রলোকের স্ত্রী অর্থাৎ মিঠুদির মা উঠে গিয়ে একটা বড় প্লেটে কিছু কেক-বিস্কুট চানাচুর ও সন্দেশ নিয়ে এসে বললেন, “নাও, যার যা ভাল লাগে খাও। চা খাবে?”

বাবলু বলল, “না। একদম নয়।”

এমন সময় একটা ট্রাক এসে হর্ন দিল বাংলোর কাছে।

মিঠুদির বাবা বললেন, “ওই তো এসে গেছে।”

“তা হলে আর দেরি কোরো না বাপি। চলো।”

“আমার আর যাবার দরকার কী? আমি বহুবার গেছি। তুই বরং এদের নিয়েই যা। এদেরও দেখা হোক। তোর মাকে নিয়ে আমি রংকিনী মন্দিরে পুজো দিয়ে আসি।”

মিঠুদি উৎসাহিত হয়ে বলল, “ও-ও নাইস! ঠিক বলেছ বাপি। আমি এদের নিয়েই যাই।” বলেই বলল, “এই চলো সব। খুব ভাল একটা জায়গা থেকে আমরা ঘুরে আসি।”

বাবলুরা উৎসাহিত হয়ে বলল, “কোথায় মিঠুদি?”

“নির্জন অরণ্যে। ধারাগিরিতে।”

“কখন ফিরব?”

“সেই বিকেলবেলায়।”

এরা সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল।

মিঠুদি বলল, “কী হল?”

বাবলু, “অত দেরি হলে আমাদের খিদে পেয়ে যাবে যে?”

“ও মাই গড! তোমরা এই সব ভাবছ? আরে আমরা ওখানে গিয়ে একটা গ্র্যান্ড ফিস্ট লাগিয়ে দেব। সব ব্যবস্থা করা আছে। স্টোভ, হাড়ি, ডেকচি সব রয়েছে।”

অতি উত্তম প্রস্তাব। বাবলুরা আনন্দে নেচে উঠল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল মিঠুদি। তারপর কুলি-কামিন বোঝাই সেই ট্রাকের ওপর উঠে পড়ল সকলে।

ট্রাকটা ওদের নিয়ে পাহাড়ের পিছনে ঘন শালবনে হারিয়ে গেল। বহুদূর বিস্তৃত এই বনানী। চ্যাংজোড়া পেরিয়ে চলে গেছে দূরের পাহাড়ের কোল পর্যন্ত। বনে বনে বসন্তের আমেজ লেগেছে। গাছে গাছে কচি রাঙা পাতা আর মঞ্জরী ধরেছে। হরিতকী, বয়ড়া আর কেঁদফল দুলছে। পাহাড়ে কুলের বন রাঙা রাঙা পাকা কুলে ভরা। বন পেরোতেই চোখে পড়ল বুরুডি গ্রাম। এখানে পাথরের বাসন তৈরি হয়। পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের ধারে ছোট ছোট ফসলের ক্ষেত দেখা গেল। এখানে বড় বড় গাছের ওপর মাচার ঘর করে লোকেরা পাহাড়িরা ক্ষেতের ফসল পাহারা দেয়। বাঘের ভয়ে নীচে থাকে না। আবার বুনো হাতির দল যখন খেতের ফসল নষ্ট করতে আসে তখন সেই গাছের ওপর মাচার ঘর থেকে ক্যানেস্তারা পিটোতে থাকে সব। বুরুডির পর বুরুডিপাশ। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে ট্রাক এগিয়ে চলল। এই পাহাড়ে একরকম গাছ রয়েছে যার কোনও পাতা নেই। শুধু বেগুনি রঙের ফুলে ভরে আছে। কত যে বুনো ফল দুলছে কত গাছে দুগ্ধ-ধবল শিববৃক্ষ, বনশিউলির ঝাড়, চীহড়, কেঁদগাছ আর বন্য লতা ও বিচিত্র ফুলে ভরা বনভূমি। বুরুডিপাশ পার হয়ে নীচের উপত্যকায় বাসাড়েরা গ্রাম। তার চারধারে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। জঙ্গল আর জঙ্গল। পাহাড়ের ওপর থেকে বন্য তটিনীকে নীচের খাদে নেচে নেচে বইতে দেখা গেল। তারই পাশে একজায়গায় দেখা গেল পাথরের গায়ে খোদাই করা কতকগুলো অদ্ভুত হরফের মতো চিহ্ন। কে কারা কবে কোন যুগে যে খোদাই করেছে তা কে জানে?

এখানেই এক জায়গায় ট্রাক থামল। ড্রাইভার বলল, “আপনার নামুন। আমরা আরও দূরে যাব। বিকেলে ঠিক এইখানেই থাকবেন। ট্রাক আপনাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ”

মিঠুদির সঙ্গে পাণ্ডব গোয়েন্দারা হইহই করে নেমে পড়ল ট্রাক থেকে। কী চমৎকার জায়গা। চারদিকে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল।

মিঠুদি এখানকার একটি ছেলেকে ডেকে বলল, “এই, তুমি আমাদের ধারাগিরি নিয়ে যাবে?”

ছেলেটি বলল, “হ্যাঁ নিয়ে যাব। তোমাদের সব কাজ করে দেব। আমাকে পেট ভরে খেতে দেবে বলো?”

ওরা ছেলেটির মাথায় কিছু মালপত্তর চাপিয়ে এবং কিছু নিজেরা নিয়ে দারুণ উৎসাহে এগিয়ে চলল ধারাগিরির দিকে।

একেবারে অরণ্যময় প্রাস্তর। এখানেও মাঝেমধ্যে বুনো হাতি এসে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে বলে গাছের ওপর ঘর রয়েছে। এখানেও রাত্রিবেলা ছোটখাটো বাঘ বের হয়।

ছেলেটির সঙ্গে কিছু পথ যাবার পরই ওরা একটি ঝরনার কাছে এসে পড়ল। ছেলেটি বলল, “ওই ধারাগিরি।”

ওরা কিছুক্ষণ অপলকে চেয়ে রইল সেই ঝরনার দিকে। তারপর সেইখানেই এক জায়গায় শতরঞ্জি পেতে বসে পড়ল সকলে।

মিঠুদি বড় একটা টিফিন ক্যারিয়ারে লুচি আলুরদম আর ছানার গজা নিয়ে এসেছিল। ওরা সকলে তাই দিয়েই জলযোগ সারল। সঙ্গে ওয়াটার বটল ছিল। খেয়েদেয়ে সেই জলই পান করল সকলে। ভোম্বল তো ছুটে যাচ্ছিল ঝরনার জল খেতে। ওদের সঙ্গের ছেলেটি ঝরনার জলই খেল। মিঠুদি মানা করল ভোম্বলকে। বাবলুও নিষেধ করল, “না ফুটিয়ে নদী বা ঝরনার জল কখনও খেতে নেই। কত কী রোগ-জীবাণু থাকে তার ঠিক কী ?’

যাই হোক জলযোগান্তে শুরু হল পিকনিক। ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে আদিবাসীদের বস্তিতে গিয়ে বিলু আর ভোম্বল মুরগি কিনে আনল। রান্না হল মাংস-ভাত। ধারাগিরির জলে স্নান করে গরম গরম মাংস-ভাত খেয়ে ওরা যখন গোছগাছ করছে তখন হঠাৎ মিঠুদি বলল, “আরে! তোমাদের পঞ্চু কই?”

মিঠুদি বলতে খেয়াল হল সত্যই তো পঞ্চ নেই। গেল কোথায় পঞ্চু? এই তো একটু আগে খাচ্ছিল। বাবলু জোর গলায় ডাকল, “পঞ্চু—উ—উ—উ।” কোনও সাড়া এল না।

বাবলু বলল, “কোনও কিছুর গন্ধ না পেলে তো এভাবে উধাও হয় নাও।”

ভোম্বল বলল, “আর গন্ধ পেয়ে কাজ নেই বাবা। এখন ভালয় ভালয় পালাই চল।”

বিলু বলল, “পঞ্চুকে না নিয়েই?”

“তা কেন?”

এমন সময় মিঠুদিই বলল, “ওই তো। ওই তো পঞ্চু কী যেন একটা মুখে করে টেনে আনছে দেখো।”

ওরা দেখল একটা ভারী প্যাকেট মুখে করে টানতে টানতে নিয়ে আসছে পঞ্চু। বাবলু এগিয়ে গিয়ে সেটা হাতে নিয়ে দেখল। সিল করা প্যাকেট।

ওপরে একটা করোটি ও জোড়া হাতের ডেঞ্জার সিম্বল অাঁকা। মিঠুদি বলল, “ফেলে দাও। কাদের কী না কী।”

বাবলু বলল, “উহু। মনে হচ্ছে চোরাই মাল। এর মধ্যে কোনও মূল্যবান জিনিস নিশ্চয়ই কিছু আছে।”

মিঠুদি বলল, “তা হলে ঘরে গিয়ে দেখবে। এখন চলো।”

ওরা তাই করল। ঠিক জায়গাতে এসে দেখল ওরা আসার অনেক আগেই ট্রাকটা ফিরে এসেছে।

রাত্রিবেলা বাগানবাড়ির দোতলার ঘরে পাণ্ডব গোয়েন্দারা ঝুঁকে পড়ে সেই ভারী প্যাকেটটা খুলতে লাগল। প্যাকেটটা খুলতেই ওদের চোখে পড়ল সোনার একটি নৃসিংহ মূর্তি। অতি যত্নে প্যাকিং করা হয়েছে। মূর্তিটা অনেকক্ষণ ধরে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল ওরা। তারপর সেটার মূল্য সম্বন্ধে নানা রকম আলোচনা করে ঘরের কোলঙ্গায় মূর্তিটা রেখে শুয়ে পড়ল। শোবার আগে দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখল ঘরে কোনও খিল বা ছিটকিনি কিছুই নেই। তাই বাধ্য হয়ে দরজা খুলে রেখেই শুতে হল। তা ছাড়া পঞ্চু যখন আছে তখন ভাবনা কী?

ভোরের দিকে সবাই যখন তন্দ্রাচ্ছন্ন তখন হঠাৎ কার পায়ের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ওদের। ওরা বিস্মিত হয়ে দেখল একটা প্রমাণ সাইজের সুদীর্ঘ নৃসিংহ ঘরের ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মূর্তিটা চলে যেতেই বাবলু লাফিয়ে উঠে আলোটা জ্বেলে দিল। কুলুঙ্গির দিকে তাকিয়ে দেখল মূর্তি নেই।

বিলু হতভম্ব হয়ে বলল, “এ কী ম্যাজিক নাকি রে ভাই? সোনার মূর্তি জীবন্ত হয়ে চলে গেল!”

ভোম্বল বলল, “একেবারে অলৌকিক ব্যাপার।”

বাবলু বলল, “অবিশ্বাস্য ঘটনা।”

বাচ্চু বলল, “কিন্তু পঞ্চু কই? সে কেন চেঁচাল না?”

বিচ্ছু ডাকল, “পঞ্চু!” –

সাড়া নেই। শব্দ নেই।

বাবলু ফের ডাকল, “পঞ্চু!”

এবারও সাড়া নেই।

ওরা সবাই তখন টর্চ জ্বেলে নীচে এসে দেখল অচৈতন্য পঞ্চু শুয়ে আছে সিঁড়ির ধারে। বাবলু ওর গায়ে হাত দিয়ে দেখল পঞ্চু বেঁচে আছে তবে কোনও ওষুধের প্রভাবে সংজ্ঞাহীন। সিঁড়ির পাশেই দারোয়ানের ঘর। সেখান থেকে গম ভাঙা মেশিনের মতো একটা শব্দ কানে আসছে। ওরা এগিয়ে গিয়ে টর্চের আলোয় দেখল শব্দটা অন্য কিছুর নয়। বিশাল বপু দারোয়ানের নাক ডাকার শব্দ।

সকাল হতেই ওরা ফুলডুংরির ডাকবাংলোয় গেল। বাংলোর লনে মিঠুদি তখন চমৎকার একটা ছবি আঁকছিল। মিঠুদির বাবা-মা বসে চা খাচ্ছিলেন।

বাবলুরা যেতেই মিঠুদির বাবা বললেন, “গুড মর্নিং?”

বাবলু বলল, “উহু, ব্যাড মর্নিং।”

“সে কী! কোনও খারাপ কিছু?”

মিঠুদি ছবি আঁকা স্থগিত রেখে ঘুরে তাকাল। বাবলু বলল, “কাল রাত্রে একটা সিরিয়াস ব্যাপার হয়ে গেছে মিঠুদি।”

“কী রকম?”

“ধারাগিরিতে সেই যে প্যাকিংটা কুড়িয়ে পেয়েছিলাম, তাইতে একটা সোনার নৃসিংহ মূর্তি ছিল। মূর্তিটা ঘরের কোলঙ্গায় রেখেছিলাম। শেষ রাতে সেটা ম্যাজিকের মতো জীবন্ত হয়ে চলে গেল ঘর থেকে।”

“যাঃ! তাই আবার হয় নাকি? নিশ্চয়ই কোনও স্বপ্ন দেখেছ তোমরা।”

“পাঁচজনে কি সবাই এক সঙ্গে একই স্বপ্ন দেখব? আর স্বপ্নই যদি হবে তা হলে মূর্তিটা উধাও হবে কেন?”

“তা হলে?”

“তা হলেই বুঝুন। ব্যাপারটা খুবই রহস্যময়।”

মিঠুদির বাবা বললেন, “তোমরা যেখানে আছ সেখানে থাকতে যদি ভয় করে তা হলে আমার এখানে চলে এসো।”

বাবলু বলল, “ভয়! আপনার কি ধারণা আমরা ভয় পেয়েছি? এর রহস্য উদঘাটন না করে আমরা ঘাটশিলা থেকেই যাব না।”

মিঠুদির বাবা একবার তাকিয়ে দেখলেন বাবলুর দিকে। তারপর কী ভেবে যেন নিজের মনে পায়চারি করতে লাগলেন।

বাবলু বলল, “আমরা এখন আসি। বিকেলে দেখা করব।”

মিঠুদি, মিঠুদির বাবা, মা সবাই নীরব রইলেন। বাবলুরা বিদায় নিল।

সোনার মূর্তির অন্তর্ধান রহস্য বাবলুদের ভাবিয়ে তুলল খুব। অনেক ভেবে-চিন্তে বাবলুরা আর একবার ধারাগিরি যাবার মন করল। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর স্টেশনের কাছ থেকে একটা জিপ ভাড়া নিয়ে ওরা রওনা হল ধারাগিরির পথে।

ধারাগিরিতে গিয়ে পঞ্চু সমেত পাণ্ডব গোয়েন্দারা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে লাগল চারদিকে। আর কোথাও কোনও কিছু পাওয়া কি না। কিন্তু না। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও কিছুই না পেয়ে হতাশ হয়ে ফিরে এল ওরা। ফেরার সময় ঘাটশিলার কাছাকাছি এসে ঘন শালবনের মধ্যে হঠাৎ জিপটা গেল খারাপ হয়ে।

তখন সন্ধে হয়ে এসেছে।

ড্রাইভার বলল, “সর্বনাশ হয়েছে। আর যাওয়া যাবে না।”

বাবলু চোখ কপালে উঠিয়ে বলল, “সে কী! তা হলে উপায়?”

“কোনও উপায় নেই। পায়ে হেঁটেই যেতে হবে।”

বিলু বলল, “এই ভর সন্ধেবেলা অন্ধকারে পাহাড়ে-জঙ্গলে যাব কী করে?”

ড্রাইভার বলল, “মাইল দেড়েক আছে আর এই বাঁকটা পেরোলেই ফুলডুংরি দেখা যাবে। না হলে আমার জিপ সারাতে অন্তত চার-পাঁচ ঘণ্টা সময় তো লাগবেই। কাজেই অতক্ষণ বসে না থেকে এখনও যেটুকু আলো আছে তাতে অনেক পথ এগিয়ে যেতে পারবে তোমরা।”

অতএব কোনও উপায়স্তর না দেখে ওরা হেঁটে যাবারই ঠিক করল। বনের পথ হলেও পথ তো আছে। পঞ্চু আগেভাগে চলল। বাবলুরা চলল তার পিছে। শালবনের ভেতর দিয়ে পায়ে হেঁটে যেতে মন্দ লাগল না। এও তো একটা নতুন অভিযান।

হঠাৎ এক জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে হাউ হাউ করে চেঁচিয়ে উঠল পঞ্চু। বাবলুরা চলা বন্ধ রেখে পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। ওরা দেখল শালবনের মধ্যে বড় একটি গাছের দিকে তাকিয়ে পঞ্চু একবার এগোচ্ছে আর ফিরে আসছে। সেদিকে লক্ষ পড়তেই ওরা দেখল কে বা কারা যেন লুকিয়ে আছে শালগাছগুলোর আড়ালে।

বিলু বাবলুকে বলল, “কী ব্যাপার বল তো?”

বাবলু বলল, “বোঝা যাচ্ছে না।”

“এগিয়ে দেখবি?”

“না। অযথা সাহস দেখাতে যাওয়া ঠিক নয়। তাতে বিপদ হতে পারে। চলে আয়।”

ওরা এগিয়ে চলল। কিছু পথ এসেই ঘাটশিলায় পৌছে গেল ওরা। বাসায় ফিরে ঘরে ঢুকতে গিয়েই অবাক! এ কী! দরজার তালা ভাঙা কেন? তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই আরও অবাক হল! দেখল সারা ঘর যেন তোলপাড় করে গেছে কেউ। কী যেন খুঁজেছে। পেয়েছে কি না কে জানে। ঘরের মেঝেয় একটা খামে ভরা চিঠি রেখে গেছে। বাবলু খামটা কুড়িয়ে নিতেই একটা ‘ডেঞ্জার স্ট্যাম্প’ দেখতে পেল। খাম ছিড়ে চিঠি বার করে পড়ে দেখল তাতে লেখা আছে “তোমরা ছেলেমানুষ। বনে-জঙ্গলে ঘুরো না। এই বনে নৃসিংহদেব আছেন। তিনি সোনার মূর্তি হয়ে ধরা দেন–আবার শরীর ধারণ করে উধাও হন। জঙ্গলে অপ্রয়োজনে এবং অনধিকার প্রবেশ যারা করে তাদের তিনি ক্ষমা করেন না।’

চিঠি পড়া শেষ করে বাবলু বলল, “তা হলে জেনে রাখুন হে নৃসিংহদেব, আমাদের পিছনেও যিনি নজর রাখেন আমরাও তাকে ক্ষমা করি না।”

ভোম্বল বলল, “সব জায়গায় গা জোয়ারি চলে না বাবলু।”

“চলে কি না চলে দেখাচ্ছি। আগে খুঁজে পেতে দেখি আমাদের কী কী জিনিস খোওয়া গেল।”

সবাই তখন সব কিছু খুঁজে দেখে বলল, “কোনও কিছুই খোওয়া যায়নি।”

বাবলু হেসে বলল, “গেছে।”

“কী জিনিস?”

“নৃসিংহ মূর্তি যে প্যাকিংয়ে ছিল তার মোড়কটা।”

বাচ্চু বলল, “সত্যিই তো! কিন্তু ওটা নিয়ে কী করবে ওরা?”

বাবলু বলল, “আমার মনে হচ্ছে আসলে এরা স্মাগলার। দেশ-বিদেশে স্বর্ণমূর্তি পাচার করে। যে কোনও ভাবেই হোক না কেন প্যাকিং মিসিং হয়ে যায়। ওটা আমাদের কাছে রয়েছে জানতে পেরে নৃসিংহদেবের ছদ্মবেশ ধারণ করে চুরি করে নিয়ে যায়। পাছে পঞ্চু বাধা দেয় তাই কোনও ওষুধের প্রভাবে সেন্সলেস করায় ওকে।”

বিলু বলল, “কিন্তু এত কাণ্ডর দরকার কী ছিল? সরাসরি এসে আমাদের ভয় দেখিয়ে কেড়ে তো নিয়ে যেতে পারত?”

“তাতে নিশ্চয়ই ওদের দিক থেকে অসুবিধা ছিল কিছু।”

ভোম্বল বলল, “ধারাগিরিতে যখন আমরা মালটা পেয়েছিলাম তখনই তো নিতে পারত।”

বাচ্চু বলল, “হয়তো মিঠুদি ছিল বলে নেয়নি।”

বিচ্ছু বলল, “এটা কি একটা কথার মতো কথা নাকি? ওদের শক্তির কাছে মিঠুদির শক্তি কতখানি?”

বাবলু বলল, “আমার মনে হয় যে ট্রাকে আমরা এসেছিলাম তাইতে কুলিকামিনদের ভেতরেই হয়তো ওদের দলের কোনও লোক ছিল। সেই গিয়ে ইনফর্ম করে।”

বিলু বলল, “তাই হবে। কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ করেছিস কি? দারোয়ানটা সব সময় বাড়ি আগলে বসে থাকে অথচ এমন একটা তালা ভাঙাভাঙি হল বা আমরা ফিরে এলাম তবু তার কোনও পাত্তা নেই।”

বাবলু বলল, “ঠিকই তো। চল তো দেখি?”

ওরা সকলে নীচে নেমে এল। শুধু পঞ্চুই যা বসে রইল ফাঁকা ঘরে। কিন্তু নীচে নেমে দারোয়ানের ঘরে ঢুকতে গিয়ে একটা গোঁ গোঁ শব্দ শুনতে পেল ওরা।

বাবলু বলল, “যা ভেবেছি তাই। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।”

ঘর খোলা। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই ওরা দেখতে পেল বিশাল বপু দারোয়ানজি খাটিয়েতে বাধা পড়ে আছে। পাছে চেঁচায় তাই মুখও বেঁধে রেখে গেছে ওরা।

বাবলুরা দারোয়ানকে মুক্তি দিল। মুক্তি পেতেই দারোয়ানজি উঠে বসে হাঁপাতে লাগল, “পানি, থোড়া পানি পিয়াও খোকাবাবু। মর গয়ে। বাপরে বাপ। যমকা মাফিক তিন চার আদমি আকে অ্যায়সা হাল কর দিয়া হামারা।”

বাবলুরা জল দিল। তারপর অনেক প্রশ্ন করল দারোয়ানজিকে। কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই সদুত্তর দিতে পারল না সে। উলটে বিরক্ত হয়ে যা বলল তার মানে এই যে তোমরা এখানে আসার পর থেকেই যত ঝামেলা হচ্ছে। তার চেয়ে তোমরা এখান থেকে মানে মানে কেটে পড়ো।

বাবলুরা দারোয়ানের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ওপরের ঘরে গেল। তারপর ঘর গোছগাছ করে সবাই চলল রাতের খাওয়া খেয়ে আসতে।

আজ রাত্রে ওরা কেউ ঘুমল না। সবাই জেগে রইল রাতের অন্ধকারে কোনও রহস্যময় কিছু ঘটে কি না দেখার জন্য।

রাত তখন বারোটা। ঘাটশিলায় যেন মৃত্যুর নীরবতা। দূরের মৌভাণ্ডারে কপার মাইনসের আলো নক্ষত্রের মতো জ্বলছে। হঠাৎ ফুলডুংরির শালবনে মোটর অথবা লরির দুটো হেডলাইট চোখে পড়ল। সেই সঙ্গে অন্য দু-একটা আলোও।

বিলু বলল, “আশ্চর্য! এই অন্ধকার শালবনে এমন সময় কীসের আলো?”

বাবলু বলল, “বুঝতে পারছিস না? এখানেই কোথাও ঘাটি ওদের।”

“গিয়ে দেখবি, কী ব্যাপার?”

“না। আলোটা অন্তত মাইল খানেক দূরে জ্বলছে। এত রাতে যাওয়াটা ঠিক নয়। কোনও হিংস্র জন্তু বা সাপখোপও থাকতে পারে। যা করবার কাল সকালে করব।”

ভোম্বল বলল, “সেই ভাল। এখন শুয়ে পড়া যাক। ঘুম পাচ্ছে খুব।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ। কাল সকালে অভিযান করতে গেলে আজ রাত্রে সুনিদ্রার একান্ত দরকার। তবে একটা ব্যাপার লক্ষ করেছিস কি, দারোয়ানজি ঘুমোলে দিনের বেলাতেই কীরকম নাক ডাকে, অথচ এখন মধ্যরাত্রি, কিন্তু ওদিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ নেই।”

বাচ্চু বলল, “সত্যিই তো।”

বিচ্ছু বলল, “একবার নীচে গিয়ে দেখলে হয় না?”

“চলো না সবাই গিয়ে একবার উকি মেরে দেখি।”

ওরা তখনই নীচে নেমে এল। তারপর জানলা দিয়ে ঘরের ভেতর টর্চের আলো ফেলে দেখলে কেউ কোথাও নেই। অথচ ঘরের দরজা ভেতর থেকেই বন্ধ। বাইরেও কোনও তালা নেই।

ভোম্বল বলল, “ভূতুড়ে ব্যাপার নাকি রে ভাই? সোনার মূর্তি দানো পেয়ে বেরিয়ে গেল। ভেতর থেকে ঘর বন্ধ অথচ গেরস্থ নেই। পালিয়ে চল বাবলু। আর দরকার নেই ঘাটশিলায়। আমার মনে হচ্ছে আমরা নিশ্চয়ই কোনও ভুতুড়ে বাড়িতে উঠেছি।”

বাবলু বলল, “সেই যে একটা ছড়া আছে না, কহেন কবি কালিদাস হেঁয়ালির ছন্দ, জানলা দিয়ে ঘর পালাল গেরস্থ রইল বন্ধ।” এও দেখছি ওই ধরনেরই এক হেঁয়ালি।”

বিলু বলল, “হেঁয়ালিই হোক, যাই হোক। এর শেষ আমরা দেখব।”

এই বলে যেই না ওরা সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে যাবে অমনি পঞ্চু হঠাৎ ‘ভৌ-ভৌ’ করে ছুটে গেল পাঁচিলের দিকে। ওরা চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখল সুটি বুট টাই ও হ্যাট পরা লম্বা চেহারার একজন লোক অদ্ভুত কায়দায় লাফিয়ে উঠে পাঁচিল টপকে হাওয়া। পঞ্চু ছুটে গিয়েও লোকটাকে ধরতে পারল না। শুধু লাফাতে গিয়ে আগন্তুকের হ্যাটটা পড়ে গিয়েছিল। পঞ্চু সেটাকেই মুখে করে এনে বার বার শুকতে আর চেচাতে লাগল, “ভৌ-ভৌ—ভৌ—উ—উ—উ।”

পরদিন সোনাঝরা সকালে মিঠুদির ডাকে ওদের ঘুম ভাঙল। ওরা দেখল বেলবটস প্যান্ট ও টাওয়েল গেঞ্জি পরা মিঠুদি বব করা চুল নিয়ে পুরুষালি ভঙ্গিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা অবাক হয়ে বলল, “আরে মিঠুদি!”

“সকাল ছ’ টা বাজে। তোমরা এখনও ঘুমোচ্ছ যে? বেড়াতে যাবে না?”

বাবলু বলল, “এক মিনিট। আমরা এখনই তৈরি হয়ে নিচ্ছি।”

বাবলুরা চটপট তৈরি হয়ে নিল।

ইতিমধ্যে গত রাত্রে পাওয়া হ্যাটটা দেখেই চমকে উঠল মিঠুদি। “এটা কোথা থেকে পেলে?”

“সে এক ব্যাপার মিঠুদি। সব বলছি আপনাকে।”

মিঠুদি তখন সন্দিগ্ধভাবে হ্যাটটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে লাগল।

বাবলু বলল, “ওটা কি আপনার পরিচিত কারও?”

মিঠুদি এক মিনিট কী ভেবে বলল, “না।” তারপর বলল, “কাল বিকেলে তোমরা আসব বলে এলে না। আমি সারাক্ষণ অপেক্ষা করলাম তোমাদের জন্য। কাল কোথাও যাওয়াই হল না আমার।

“কাল আমরা অভিযানে গিয়েছিলাম মিঠুদি। আজ এখনই সবাই যাব।”

“অভিযানে! কোথায়?”

বাবলু তখন কালকের ঘটনা সব বলল মিঠুদিকে।

সব শুনে মিঠুদি বলল, “আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। চল তো।”

ওরা ঘর বন্ধ করে নীচে নামতেই দারোয়ানজি বলল, “কী খোকাবাবু কাল রাতো মে কুছ ঝামেলা নেহি হুয়া তো?”

“নেহি! লেকিন তুমহারা নাসিকা গর্জন শুনকর হামারা নিদ নেহি হুয়া।”

“ক্যা বাত বাবু! কাল তো রাত ভর হাম দরোয়াজা বন্ধ করকে দরোয়াজা বগলমে ডাকুকা ডরসে চুপচাপ বৈঠা থা। জানলা সে ঘরকা অন্দরমে টর্চ মারা কোই লোক। কুত্তা ভি বহুৎ চিল্লায়া থা।”

বাবলুরা এবার হেসে উঠল সকলে।

বিলু বলল,“যাক, এবার তা হলে বন্ধ ঘর থেকে গেরস্থ উধাওয়ের ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল।”

ওরা বাইরে এসে একটা দোকানে চা-শিঙারা ইত্যাদি খেয়ে শালবনে প্রবেশ করল। মিঠুদিও চলল সঙ্গে। সত্যি, মিঠুদি কী ভাল। কী দারুণ উৎসাহ মিঠুদির।

মিঠুদি বলল, “এই শালবনেই যে ওদের ঘাটি তাতে কোনও সন্দেহ নেই।”

বাবলু বলল, “সেই জন্যই তো আসা।”

বিলু বলল, “ভোম্বল, মালপত্তর সব রেডি?”

ভোম্বল বলল, “না। আসবার সময় ওগুলো নিতে একদম ভুলে গেছি। তবে পুরিয়াগুলো পকেটেই আছে।”

বাচ্চু বলল, “ওতেই যথেষ্ট।”

বিচ্ছু বলল, “তা ছাড়া এখন তো আমরা পুরোপুরি অভিযান করছি না। একটু অনুসন্ধান করতে যাচ্ছি।”

মিঠুদি বলল, “কীসের মালপত্তর, কীসের পুরিয়া আমি কিন্তু কিছুই বুঝছি না।”

বাবলু বলল, “আমরা যখন কোথাও যাই তখন শুধু হাতে তো যাই না। সেই কথাই বলছি।”

“ও, বুঝেছি।”

ওরা শালবনে ঢুকে প্রথমেই লরির টায়ারের দাগ বেপথে কোথাও বাঁক নিয়েছে কিনা দেখবার চেষ্টা করল। এ সব ব্যাপারে পঞ্চু খুবই চৌকশ। ওই সর্বাগ্রে মাটি শুকে হঠাৎ এক জায়গায় বাধা পথ ছেড়ে নেমে পড়ল। তারপর গভীর জঙ্গলের বুকে ঘাস ও মাটির বুকে আঁকা টায়ারের দাগটা প্রত্যক্ষ করিয়ে দিল সকলকে! বাবলুরা সেই দাগ ধরে খানিকটা এগিয়েই একটি ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ টিলার কাছে চলে এল। সেটি এমনই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ও আগাছায় ঢাকা যে তাতে ওঠার কোনও পথ খুঁজে পেল না ওরা।

হঠাৎ এখানেই এক জায়গায় ঘন লতাগুল্মের ভেতর দিয়ে গলে পঞ্চু কোথায় যেন চলে গেল। তারপর বেরিয়ে এসে প্যান্ট ধরে টানতে লাগল বাবলুর।

মিঠুদি বলল, “মনে হচ্ছে এখানে কোনও গুহা বা সুড়ঙ্গ আছে।”

বাবলু বলল, “চলুন তো দেখি।”

মিঠুদি বলল, “রিক্স নেবে? যদি কোনও সাপটপ থাকে।”

ভোম্বলটা এমনিতে একটু ভিতু প্রকৃতির। কিন্তু হঠাৎ কী হল “ধুৎ তেরি’ বলে পঞ্চুকে অনুসরণ করল সে। বাবলুরাও একে একে লতাগুল্ম সরিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

সবাই অবাক হয়ে দেখল বাইরেটা অমন দুর্ভেদ্য হলেও ভেতরে প্রশস্ত সুড়ঙ্গ-মুখ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। আঁকাবাঁকা সরু পথ। পাশাপাশি একজনের বেশি দুজন যেতে পারে না। আগে পঞ্চু তার পিছনে ওরা নিঃশব্দে পথ চলতে লাগল। দু-একবার বাক নেবার পরই আলোর রেখা চোখে পড়ল ওদের। এখানটা একটু ফোঁপরা। খাদের মতো। ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে। দেওয়ালে মশাল জ্বলছে। একজন বন্দুকধারি প্রহরী টুলে বসে খৈনি টিপছে নিজের মনে। ওরা তবুও সাহস করে তার নজর এড়িয়ে দেওয়ালের গা ঘেঁষে পা টিপে টিপে এগিয়ে বাবার চেষ্টা করল। এমন সময় হঠাৎ ফ্যাচ করে হেঁচে উঠল বিলু।

যেই না হাঁচা প্রহরীটা অমনি বাজখাই গলায় বলে উঠল, “কোন হ্যায় রে?” বলে চংমং করে চারদিকে তাকাতে লাগল।

পঞ্চু অমনি চালাকি করে একবার প্রহরীটাকে দেখা দিয়ে এপাশ থেকে ওপাশে সরে গেল। প্রহরীটা পঞ্চুকে দেখে নিজের মনেই বলল, “আরে! কুত্তা কাহাসে আয়া?” তারপর হঠাৎ বাবলুদের দেখেই খাড়া হয়ে উঠে দাড়াল, “অ্যাঁই, তুমলোক অন্দরমে ঘুসা কিধারসে? নিকালো আভি।”

ভোম্বল ততক্ষণে পুরিয়া খুলে লঙ্কার গুড়োগুলো হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। সে আর কালবিলম্ব না করে প্রহরীটার চোখে ছুড়ে দিল লঙ্কার গুড়োগুলো। প্রহরীটা তখন জ্বলুনির চোটে বাবারে মারে’, ‘জুল গয়ি, মর গয়ি’ করে বসে পড়ল দু হাতে চোখ ঢেকে।

এক পাশে কতকগুলো বড় বড় বস্তা ডাই করা ছিল। যেই না বসা বাবলু হঠাৎ চোখের পলকে একটি বস্তা ফাঁক করে ঢাকা দিয়ে দিল প্রহরীটাকে। মিঠুদিও হাত লাগাল। লোকটাকে সম্পূর্ণ বস্তাবন্দি করে ওরা আবার এগিয়ে চলল সামনের দিকে। যত এগোয় সুড়ঙ্গের আর শেষ নেই। আসলে খনি অঞ্চল বলে ঘাটশিলার কিছু কিছু জায়গা ফোপরা। এর শেষ যে কোথায় তা কে জানে। এদিক-সেদিক করতে করতে যেন এক গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেল ওরা।

আরও কিছু পথ যাওয়ার পর ওরা যখন এগোবে কি এগোবে না ভাবছে তেমন সময় হঠাৎ এক ঝলক তীব্র আলো এসে পড়ল ওদের মুখে।

পঞ্চু ভৌ ভোঁ করে চেঁচিয়ে উঠল। ওদিক থেকে উত্তর এল, “খবরদার। কেউ পালাবার চেষ্টা করবে না। আলোর দিকে এগিয়ে এসো।”

মিঠুদি বলল, “যদি না যাই?”

“তা হলে বিপদ হবে।”

বাবলু বলল, “কে আপনি?”

“কাছে এলেই জানতে পারবে।”

ওরা এগোতে লাগল। যত এগোয় আলো ততই পিছোয়। এক সময় একটা বিশাল গহ্বরের মধ্যে এসে পৌছুল ওরা। দেওয়ালে মশাল জ্বলছে। কয়েকজন লোক কাজ করছে। যে লোকটা ওদের আলো দেখিয়ে নিয়ে এল তার চারটে হাত। সিংহের মুখ এবং মানুষের দেহ। তবে দুটো হাত এবং সিংহমুখ যে নকল তা বেশ বোঝাই যাচ্ছে। ইনিই তা হলে নৃসিংহদেব। তিনি আদেশ দিলেন, “এই বেঁধে ফেল এদের।”

কয়েকজন লোক এসে ওদের প্রত্যেককে থামের সঙ্গে বেঁধে ফেলল।

পঞ্চু এখন নীরব দর্শক। কেন না সে লক্ষ করেছে নৃসিংহদেবের হাতে একটা দোনলা পিস্তল রয়েছে।

“কুকুরটাকে বাইরে বার করে দিয়ে আয়।”

আদেশ মাত্রই একজন একটা লাথি মারল পঞ্চুকে। যেই না মারা পঞ্চু অমনি ঘ্যাক করে কামড়ে দিল লোকটার পায়ে। লোকটা চিৎকার করে উঠল। তারপর যেই না পঞ্চুকে অন্য একজন লাঠি দিয়ে মারতে যাবে পঞ্চু অমনি এক ছুটে হাওয়া।

যেসব লোকরা কাজ করছিল তাদের ভেতর থেকে কয়েকজন ছুটে এসে পঞ্চুর কামড়ে আহত লোকটিকে ধরাধরি করে সরিয়ে নিয়ে গেল।

নৃসিংহদেব বললেন, “দেখ তো তোমাদের কুকুরের কাণ্ডকারখানা? কী করল বলো দেখি?”

মিঠুদি বলল, “সে দোষ কি ওর?”

বাবলু বলল, “ঠিক করেছে।”

“স্যাটাপ।”

এমন সময় হঠাৎ একটি পরিচিত গলা শুনে অবাক হয়ে গেল ওরা। দেখল ইস্পাত এক্সপ্রেসের সেই লালাজি খৈনি টিপতে টিপতে এগিয়ে আসছে, “ক্যা ভাই সব। ঘাটশিল্লা ক্যায়সা লাগতা।”

বাবলু বলল, “বহুৎ আচ্ছা লাগত। তা আপনিও এই দলের?”

“ক্যা কিয়েগা ভাই? স্রেফ বেওসাকে লিয়ে আয়া। ঠিক হ্যায়। আভি রহো ইসকো অন্দরমে। ফিন মুলাকাত হোগা।”

নৃসিংহদেব বললেন, “আমি ভেবে পাচ্ছি না জগ্গুর নজর এড়িয়ে এর ভেতরে ঢুকে এল কী করে?” বলে কাকে যেন ডাকলেন, “ভূপাল সিং?”

একজন এল, “জি হুজুর।”

“জগ্গু কিধার?”

ভূপাল সিং বাবলুদের দেখিয়ে বলল, “ইয়ে লেড়কী লোক অচানক উসকো আখমে মিরচা কি গুড়িয়া ডাল কর বস্তামে ঘুসা দিয়া।”

“বোলাও জগ্গু কো।”

একটু পরেই জগ্গু অর্থাৎ সেই প্রহরীটা এল। দুহাতে চোখ ঢেকে।

নৃসিংহদেব বললেন, “বাঃ জগ্গু। অ্যায়সা হাল হোগিয়া তুমহারা?”

“কা কিজিয়ে সর্দার।”

“মাফ কিজিয়ে সর্দার।”

“আরে মাফ কিয়েগা কাহে? তুমকো তো ইনাম মিলনা চাহিয়ে। চাহিয়ে না?”

নৃসিংহদেবের পিস্তল হঠাৎ গর্জে উঠল। জগ্গু লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। নৃসিংহদেব ক্রোধের উল্লাসে পৈশাচিক হাসি হাসতে লাগলেন। সেই হাসির গমকে চারদিক যেন কেঁপে উঠল।

বেলা বারোটা বেজে যাওয়ার পরও যখন মিঠুদি ফিরল না তখন মিঠুদির বাবা খুবই চিন্তায় পড়ে গেলেন। বাংলর লনে উদভ্ৰান্তর মতো পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পেলেন অনেক দুর থেকে ছুটতে ছুটতে পঞ্চু তার দিকে আসছে।

পঞ্চু এসেই তার প্যান্ট কামড়ে ধরল। তারপর কেউ কেউ করে শুরু করল টানাটানি। মিঠুদির বাবা সন্দিগ্ধ চোখে তাকালেন পঞ্চুর দিকে। স্ত্রীকে বললেন, “আমি বেরোচ্ছি। আমার আসতে দেরি হবে। তুমি খেয়ে নিয়ো।”

“কিন্তু মিঠু এখনও এল না কেন?”

“বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।” এই বলে বেশ ভালভাবে তৈরি হয়ে পঞ্চুকে নিয়ে সর্বাগ্রে থানায় এলেন মিঠুদির বাবা।

মিঠুদির বাবাকে দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এস আই ইনস্পেক্টররা।

“এনি নিউজ স্যার?”

“আমার মেয়ের কোনও বিপদ হয়েছে মনে হচ্ছে। ছেলেগুলোও জড়িয়ে পড়েছে সম্ভবত। আপনারা তৈরি হয়ে নিন। এই কুকুরটাই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।”

“জিপের প্রয়োজন হবে?”

“দরকার নেই। মনে হয় কাছাকাছিই আছে। শালবনের ভেতরে একটা জায়গাকে আমি সন্দেহ করছি। হয়তো সেখানেই। আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তা হলে আজই ওদের গ্যাঙটাকে ধরে ফেলতে পারব।”

এমন সময় দু’জন সাদা পোশাকের পুলিশ ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “স্যার, আপনার মেয়ে আর ওই ছেলেগুলোকে আমরা একটা গুহামুখে অনেকক্ষণ আগে ঢুকতে দেখেছি। কিন্তু এখনও বেরোচ্ছে না তারা।”

দারোগাবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “ওদের ঢুকতে দিলেন কেন?”

“কী করব, স্যার যে বারণ করেছিলেন ওদের কোনও কাজে বাধা না দিতে। শুধু ওদের গতিবিধির ওপর নজর রাখতে বলেছিলেন।”

“ঠিক আছে। চলো তো কোনদিকে দেখেছ ওদের।”

সশস্ত্র পুলিশদের নিয়ে মিঠুদির বাবা শালবনে প্রবেশ করলেন। সবার আগে চলল পঞ্চু। সে একবার করে ছুটে এগিয়ে যায়, একবার করে মিঠুদির বাবার কাছে চলে আসে। পঞ্চুর যেন তর সইছে না। এইভাবে এক সময় ওরা যখন গুহা-মুখের কাছে পৌঁছুলেন তখন দেখতে পেলেন কে বা কারা যেন সেই মুখ ডিনামাইট দিয়ে ধসিয়ে একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছে।

মিঠুদি সমেত বন্দি পাণ্ডব গোয়েন্দারা অসহায় ভাবে ছটফট করছে। কয়েকজন লোক সমানে তাদের প্যাকিং-এর কাজ করে যাচ্ছে। আর ভয়ংকর চেহারার দু’জন লোক পাহারা দিচ্ছে ওদের।

বাবলু বলল, “এই শয়তানগুলো, এখনও বলছি ছেড়ে দে। না হলে একবার যদি ছাড়া পাই তোদের সব কটাকে খেয়ে ফেলব।”

বাবলুর কথা শুনে লোক দুটো বিশ্রীভাবে হাসতে লাগল।

এমন সময় নৃসিংহদেব এসে হাজির হলেন। বললেন, “সবাইকেই ছেড়ে দেব। তবে একটি মাত্র শর্তে, আগে বলে ওই সোনার মূর্তি তোমরা কী করে পেয়েছিলে?”

বাবলু বলল, “আমরা ধারাগিরিতে পিকনিক করতে গিয়ে পেয়েছিলাম।”

“মিথ্যে কথা। এখানকার ও জিনিস ধারাগিরিতে যেতেই পারে না।”

মিঠুদি বলল, “না পারার কী আছে? আপনাদের দলের কোনও লোক হয় তো চুরি করে লুকিয়ে রেখেছিল সময় মতো সরাবে বলে। তার আগে আমরাই ওটা পেয়ে যাই।”

“ঠিক বলছ?”

“মিথ্যে বলে লাভ? কিন্তু আমরা ভেবে পাচ্ছি না আপনি টের পেলেন কী করে?”

“আমাদের লোক সর্বত্র ঘোরাফেরা করছে। তাদেরই একজন খবর দিল তোমাদের হাতে ওই প্যাকিং সে দেখেছে। তাই সেদিন রাত্রে আমি নিজেই গিয়েছিলাম ওটা উদ্ধার করতে। ”

বাবলু বলল, “তা বলে এই রকম ছদ্মবেশে?”

“ছদ্মবেশে যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিল যাতে তোমরা কেউ দেখে ফেললে এটাকে চুরি মনে না করে ভৌতিক ব্যাপার বলে মনে করো।”

“সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তোমার বাবা তো এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চের একজন দুদে অফিসার বলে জানি। কিন্তু তুমিও কি তোমার বাবাকে হেল্প করবার জন্য এদের দলে ভিড়েছ?”

বাবলুরা অবাক হয়ে তাকাল মিঠুদির দিকে।

মিঠুদি বলল, “আমরা নিছক কৌতুহলবশেই এখানে এসেছিলাম।”

“বেশ। এবার কৌতুহল মিটল তো? তোমার বাবা যেভাবে আমাদের পিছনে লেগেছেন তাতে দু-একদিনের ভেতরেই আমাদের ঘাটি অন্যত্র সরিয়ে ফেলতে হচ্ছে। সব সরে গেলে তোমাদের ছেড়ে দেব।”

এমন সময় হঠাৎ একজন ছুটতে ছুটতে এসে বলল, “সর্দার, পুলিশ।”

মুখোশের আড়ালে নৃসিংহদেব চমকালেন কিনা কে জানে, “কোথায়?”

“মেন গেটের কাছে।”

“ওখানে ডিনামাইট চার্জ করা হয়নি?”

“হ্যাঁ সর্দার ও রাস্তা বন্ধ।”

“আশ্চর্য। ও পথের সন্ধান পেল কী করে? যাক, কপার মাইনসের দিকটা ধসিয়ে দাও।”

সুড়ঙ্গের ভেতরেই এক পাশে কয়েকটা বন্দুক, ডিনামাইট ও কিছু মারাত্মক রকমের বোমা সাজানো ছিল। তার গায়েই দেওয়ালে লেখা বারুদঘর। লোকটা সেখান থেকে কিছু ডিনামাইট নিয়ে চলে গেল।

এমন সময় হঠাৎ মারাত্মক রকমের আর্তনাদ করে উঠল বিলু, “ওরে বাবলু রে, আমাকে সাপে কামড়েছে। উঃ জ্বলে গেল। আমি আর বাঁচব নারে।”

সবাই চমকে উঠল।

শিউরে উঠল মিঠুদি, “সে কী!”

বিলু তখন ভয়ানক ছটফট ও আর্তনাদ করছে।

মিঠুদি বলল, “দয়া করে বাঁধন খুলে দিন আমাদের। তাড়াতাড়ি করুন।”

বিলুর অবস্থা দেখে নৃসিংহদেবেরও মায়া হল বুঝি। ভয়ংকর লোকদুটোকে বললেন, “ওদের দড়ি খুলে দাও।”

বাঁধন মুক্ত হতেই বিলু মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে লাগল। যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছে যেন। সে দৃশ্য দেখা যায় না।

মিঠুদি বলল, “কী যে করি। তাড়াতাড়ি একটু জল আনুন। কোন পায়ে কামড়েছে বিলু?”

বিলু তখন বেঁকে গিয়ে ছিটকে পড়ল বারুদঘরের কাছে। তারপর লাফিয়ে উঠে দু হাতে দুটো বোমা নিয়ে আনন্দে নাচতে লাগল, “কিছু হয়নি। শুধুই নকশা। বাবলু রেডি?”

“ইয়েস।” বলে বাবলুও হঠাৎ দু’পা পিছিয়ে গিয়ে রুখে দাঁড়াল। ওর হাতে তখন পিস্তলট ঝকঝক করছে।

মিঠুদি প্রথমটা কেমন যেন হকচকিয়ে গেল। তারপর দেখা গেল মিঠুদির হাতেও একটা দু’ নলা পিস্তল ম্যাজিকের মতো চলে এসেছে। মিঠুদিও তা হলে সঙ্গে রাখে?

এদিকে এদের ব্যাপার-স্যাপার দেখে নৃসিংহদেব, সেই ভয়ংকর লোকদুটো এবং কর্মরত লোকরা সবাই চমকে উঠেছে। নৃসিংহদেব একটানে নিজের মুখোশ খুলে ফেললেন। বাবলুরা চমকে উঠল, আরে এ কী! এ যে আদর্শ হিন্দু হোটেলের মালিক। এরই হোটেলে ওরা খাওয়া-দাওয়া করে।

মিঠুদি বলল, “এক পাও এগোবার চেষ্টা করবেন না।”

নৃসিংহদেব চিৎকার করে উঠলেন, “এই, কে আছিস? ধর ব্যাটাদের।”

কিন্তু ধরবে কে? ভয়ংকর লোকদুটো এগোবামাত্রই বাবলুর পিস্তলের গুলি ওদের পা দুটো থামিয়ে দিল। তবুও একজন ভল্ট খেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেই মিঠুদির গুলি অন্যজনকে শুইয়ে দিল। ততক্ষণে বাবলুর পিস্তল অপর দল কেড়ে নিয়ে ছুড়ে দিয়েছে নৃসিংহদেবের দিকে। ওদিকে অন্যান্য লোকরা বারুদঘরের দিকে যেতে গিয়ে বাধা পেল বিলুর কাছে।

বিলু বলছে, “কেউ এগোবে না! এগোলেই চার্জ করব।”

বাবলুর পিস্তলটা হাতে নিয়ে নৃসিংহদেব তাগ করলেন। মিঠুদিও তখন ঘুরে দাঁড়াল। যে লোকটার পায়ে বাবলু গুলি করেছিল সে তখন এক পায়ে ঠেলে দিয়েছে মিঠুদিকে। আর সেই ঠেলায় টাল সামলাতে না পেরে মিঠুদি হুমড়ি খেয়ে পড়ল নৃসিংহদেবের ঘাড়ে। আচমকা পতনে নৃসিংহদেবও উলটে পড়লেন। যেই না পড়া ভোম্বল অমনি উঠে নৃসিংহদেবের বুকে চেপে বসল। বাবলুর পিস্তলটা নৃসিংহদেবের হাত থেকে তখন কেড়ে নিতে খুব একটা কষ্ট হল না ভোম্বলের।

ওদিকে বাবলুও তখন নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে বারুদঘরের গা থেকে একটা বন্দুক তুলে নিয়েছে। বিলুও বোমা রেখে বন্দুক ধরল। মিঠুদির তখন রণং দেহি মূর্তি। বাচ্চু আর বিচ্ছু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে। বাবলু ছাড়া বিলু বা ভোম্বল কেউই পিস্তল বা বন্দুক চালনা করতে শেখেনি। বাবলু নিজেও বন্দুক ধরেনি কখনও। তবুও যেন কতই না জানে এমনভাবে ভয় দেখাতে লাগল।

মিঠুদি বলল, “এবার ভালয় ভালয় বাইরে বেরোবার রাস্তাটা দেখিয়ে দাও তো বাছাধন। তারপর বাবাকে ডেকে এনে তোমাদের হাতে হাতকড়া লাগাই।”

বাবলু বলল, “যদি বেঘোরে মরতে না চাও, তা হলে যা বলছি তাই করো।”

নৃসিংহদেব বললেন, “ঠিক আছে। আর কোনও ঝামেলার দরকার নেই। চলো তোমাদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছি।”

মিঠুদি বলল, “সবাই দু’হাত ওপরে তুলে আমাদের আগে আগে চলো।”

মিঠুদির কথায় সবাই হাত উঁচু করল। এমন সময় দেখা গেল কাছাকোঁচা খোলা অবস্থায় সেই লালাজি ছুটতে ছুটতে ওদের দিকে আসছে। আর তার পিছনে হাউ হাউ করে তেড়ে আসছে পঞ্চু। লালাজি চেঁচাচ্ছে, “কুত্তাসে বাঁচাও। পুলিশ কী কুত্তা…।” অনভ্যস্ত ছুটুনির জন্য বাবলুদের কাছাকাছি এসেই পায়ে কাপড় জড়িয়ে মুখ থুবড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল লালাজি। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চুর পিছু পিছু রইরই করে ছুটে এল একদল পুলিশ এবং মিঠুদির বাবা।

মিঠুদির বাবা মিঠুদিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “তোদের কোনও ক্ষতি হয়নি তো মা?”

“না বাবা। কিন্তু তুমি কী করে এখানে এলে?”

“পঞ্চুই তো নিয়ে এসেছে আমাদের। একটা মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। আর একটা মুখ দিয়ে এই লালাজি যেই না বেরোতে যাবে পঞ্চু অমনি তাড়া করল ব্যাটাকে। ওর পিছু নিয়েই আমরা এখানে এলাম। যাক, তোরা সবাই ঠিক আছিস তো?”

“হ্যাঁ বাবা।”

মিঠুদির বাবা অন্যান্য পুলিশদের বললেন, “এবার তা হলে আপনারা কাজ করুন। আমি এদের বাংলোয় পৌঁছে দিয়ে আসি। পরে সব রিপোর্ট আমি লিখে দেব।”

মিঠুদি বলল, “না বাবা। আমরা নিজেরাই যেতে পারব। তুমি বরং এখানেই থাকো এখন।”

“তোদের কোনও অসুবিধে হবে না?”

“না।”

মিঠুদির বাবা পাণ্ডব গোয়েন্দাদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। বললেন, “আমি উপলক্ষ মাত্র। এ জয় তোমাদেরই জয়। কেন না তোমরা স্বর্ণমূর্তি না পেলে বা ঘটনায় জড়িয়ে না পড়লে দলটাকে এত সহজে আমি ধরতে পারতাম না। এ জয় তোমাদের পঞ্চুর। ওকে আমি সরকারের তরফ থেকে কিছু পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব।”

মিঠুদি বলল, “আমরা তা হলে আসি বাবা।”

“হ্যাঁ এসো। তোমার মা খুব চিন্তা করছেন তোমার জন্য। তাড়াতাড়ি যাও।”

বাবলু-বিলু পঞ্চুকে জড়িয়ে ধরে চুমো খেল। তারপর ওর পিছু পিছু সুড়ঙ্গের বাইরে এল ওরা। মিঠুদি বলল, “আমাদের বাংলোতেই আজ কিন্তু তোমাদের খাওয়া-দাওয়া, সেটা জানো তো?”

বাবলু বলল, “উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু মিঠুদি, আপনার বাবা যে একজন দুঁদে পুলিশ অফিসার সেটা আপনি একবারও আমাদের বলেননি তো?”

“বাবার নিষেধ ছিল। তবে কাল রাত্রে যে হ্যাটটা তোমরা কুড়িয়ে পেয়েছিলে ওটা কিন্তু বাবার। তোমাদের কোনও বিপদ ঘটছে কিনা দেখতে গিয়ে বাবা ওটা ফেলে এসেছিলেন।”

বাবলু বলল, “ও, সেইজন্যে আপনি ওই হ্যাটটা দেখে অত অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিলেন?”

মিঠুদি হাসল।

বাবলু বলল, “আমাদের এবারের অভিযানে আপনার কিন্তু যথেষ্ট অবদান আছে।”

বিলু বলল,“এবং সেই অবদানের জন্যই আমরা আপনাকে অভিনন্দন জানাই। থ্রি চিয়ার্স ফর …মিঠুদি…।”

সবাই বলল, “হিপ হিপ হুরর রে…!”

পঞ্চু একবার লাফিয়ে উঠে কোরাস দিল, “ভৌ। ভৌ ভৌ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress