Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ষষ্ঠদশ অভিযান : জঙ্গল অভিযান || Sasthipada Chattopadhyay

ষষ্ঠদশ অভিযান : জঙ্গল অভিযান || Sasthipada Chattopadhyay

শীতের সকাল।

ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এসে দুটো টোস্ট খেয়ে সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে বাবলু, এমন সময় ওদের বাড়ির সামনে একটি অস্টিন গাড়ি এসে থামল। গাড়ির ভেতর থেকে নেমে এলেন এক দীর্ঘ দেহী সুদর্শন প্রৌঢ়। বয়স প্রায় ষাটের কাছাকাছি। টকটকে ফরসা গায়ের রং মাথায় টাক। চোখে মোটা ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। সরু পাড় ধুতি আর কাতানের পাঞ্জাবির ওপর কোট পরে আছেন।

বাবলু ভদ্রলোককে অভ্যর্থনা করবার জন্য এগিয়ে গেল।

ভদ্রলোক হাসি মুখে গাড়ি থেকে নেমেই বললেন, “তুমি নিশ্চয়ই বাবলু? মানে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের লিডার?”

“হ্যাঁ।”

“আমি বিশেষ প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছি বাবা। আগে চল ঘরে গিয়ে বসি, পরে বলব সব।”

বাবলু ভদ্রলোককে ঘরে নিয়ে এল। তারপর বসবার জন্য চেয়ার এগিয়ে দিতেই ভদ্রলোক বাবলুর কাঁধে হাত রেখে ধপ করে বসে পড়লেন। মুখে ঘাম ছিল না তবু পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখটা একবার মুছে নিয়ে বললেন, “আমার নাম রুদ্রনারায়ণ রায়। আমি অনেক খোঁজ খবর নিয়ে তোমার ঠিকানা জোগাড় করেছি। তুমি এখানে এতই পপুলার যে তোমার ঠিকানা খুঁজতে আমার একটুও কষ্ট হয়নি। সব চেয়ে আনন্দের কথা, এখানে এসে তোমার দেখাটাও পেয়ে গেলাম। না হলে অনেক দূর থেকে এসেছি বাবা। শূন্য হৃদয়ে ফিরে যেতে হলে আশাহত হতাম।”

“কোথা থেকে আসছেন আপনি?”

“সুদুর মোসাবনী থেকে।”

“মোসাবনী মানে ঘাটশিলার কাছে?”

“হ্যাঁ।”

“এ আর কী দুর? আমরা ঘাটশিলা ঘুরে এসেছি। ওখানে গিয়ে খুবই বিপদে পড়ে গিয়েছিলাম।”

“জানি জানি, সব জানি। ওখানে তো তোমাদের জয়-জয়কার। তা বাবা, খুব একটা বিপদে পড়ে আমি তোমার কাছে ছুটে এসেছি।”

“বিপদে পড়ে?”

“হ্যাঁ। আমার এই বিপদে একমাত্র তুমিই ভরসা।”

বাবলু বলল, “আপনি একটু বসুন। আমি আপনার জন্য চা বলি।”

“চা? বল। শীতের সকালে একটু গরম চা হলে মন্দ হয় না।”

বাবলু রুদ্রনারায়ণবাবুকে বসিয়ে রেখে ভেতরে চলে গেল। তারপর কিছু সময়ের মধ্যেই একটা ট্রে-তে করে গোটা চারেক বিস্কুট, দুটো কেক ও দু’ কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকল।

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “আবার এত সব কেন? শুধু চা আনলেই তো হত।”

বাবলু হেসে বলল, “শুধু চা কি মানুষকে দেওয়া যায়? আপনার বাড়িতে গেলে আপনি পারতেন শুধু চা দিতে?” বলে ট্রে-টা টেবিলের ওপর রেখে বলল, “নিন। এগুলো আগে খেয়ে নিন। তারপর বলুন কী বলতে চান?”

রুদ্রনারায়ণবাবু নীরবে চা আর বিস্কুট খেলেন। তারপর বললেন, “বাবলু, আমার একমাত্র নাতি প্রতাপকে আজ কিছুদিন হল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

“সে কী! কত বয়স?”

“তা বছর দশেক তো হবেই।”

“তারপর?”

“থানা-পুলিশ অনেক কিছুই করলাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। কেউ কোনও খোঁজ খবরই দিতে পারল না। অথচ ওই নাতিটি ছাড়া আমার আর কেউ নেই।”

“আপনার স্ত্রী!”

“নেই।”

“ছেলেটির মা? মানে আপনার পুত্রপধু?”

“কেউ না। বেশ কয়েক বছর আগে আমি যখন মধ্যপ্রদেশে থাকতাম তখন ডাকাতরা একবার আমার বাড়ি চড়াও হয়ে আমার পরিবারের সবাইকে হত্যা করে। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন আমি নাতিটিকে নিয়ে আমার এক পরিচিতর বিয়ে উপলক্ষে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে স্থানান্তরে গিয়েছিলাম, না হলে আমাদেরও শেষ করে দিত।” এই পর্যন্ত বলার পর রুদ্রনারায়ণবাবুর কণ্ঠরোধ হয়ে এল। চোখদুটিও জলে ভরে উঠল যেন।

বাবলু বলল, “খুব নৃশংস ব্যাপার তো!”

“হ্যাঁ। খবর পেয়ে যখন আমি ফিরে এলাম তখন দেখি সব শেষ। আমার পরিবারের চোদ্দোজন মানুষের মৃতদেহ ঘিরে গ্রামবাসীরা বিলাপ করছে।”

“হত্যাকারীরা ধরা পড়েছিল?”

“না। ওরা চিরকাল ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকে। যাই হোক। তারপর আমি ওখান থেকে সোজা চলে এলাম ঘাটশিলায়। ঘাটশিলার অদূরে মোসাবনীতে মনের মতো একটি বাড়ি তৈরি করে নাতিটিকে নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলাম। এমন সময় হঠাৎ এক অঘটন। একদিন বাইরে থেকে ঘুরে এসে দেখি আমার নাতি নেই। প্রথম ভাবলাম কোথাও না কোথাও গেছে হয়তো। কিন্তু দিন শেষে সন্ধ্যাতেও যখন সে ফিরল না তখন ভয় পেলাম। থানায় খবর দিলাম। কিন্তু না। কিছুতেই কিছু হল না।”

বাবলু, “আপনার ওই হারিয়ে যাওয়া নাতিকে আমাদের খুঁজে বার করতে হবে, এই তো?”

“ঠিক তাও নয়। আবার অনেকটা ওইরকমই।”

“তার মানে?”

“পরশু বিকেলে একটা চিঠি পেয়েছি। চিঠিটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি আমি। এই দেখ।” বলে বাবলুর হাতে চিঠিটা দিলেন রুদ্রনারায়ণবাবু।

বাবলু চিঠিটা পড়ল। পড়তে পড়তে কপাল কুঁচকে উঠল। চিঠিতে যা লেখা ছিল তা হল এই—

রুদ্রনারায়ণবাবু, আপনি অযথা থানা-পুলিশ করবেন না। আপনার নাতি আমাদের হেফাজতে আছে। সেবার আপনার বাড়িতে ডাকাতি করে বিশেষ কিছু পাইনি। যা পেয়েছিলাম তা খরচ হয়ে গেছে। আমাদের এখন খুবই টাকার দরকার। আপাতত তিন লাখ হলেই হবে। আপনি হচ্ছেন টাকার খনি। এত টাকা আপনি ছাড়া কেউ দিতে পারবে না। টাকা পেলেই আপনার নাতিকে অক্ষত শরীরে পৌছে দিয়ে আসব আমি। তবে সাবধান! এ চিঠি যেন পুলিশের হাতে না পড়ে। টাকা কীভাবে নেব তা পরবর্তী চিঠিতে জানাচ্ছি। ইতি—আপনার প্রিয় মঙ্গল সিং।

বাবলু চিঠিটা পড়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “এ চিঠি আপনি পুলিশকে দেখিয়েছেন?”

“না।”

“খুব ভাল কাজ করেছেন। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতি তাতে এই ব্যাপারে আমরা আপনার কী কাজে লাগতে পারি বলুন? আপনার নাতি এখন এমন এক জায়গায় আছে যা আমাদের সকলেরই নাগালের বাইরে।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “ধরে টাকা যেদিন ওরা নিতে আসবে সেদিন টাকাটা যদি আমি তোমাদের হাত দিয়ে পাঠাই তা হলে তোমরা কী পারবে না তোমাদের কুকুরের সাহায্যে ওদের গোপন ঘাঁটিটা চিনে আসতে?”

“পারব। কিন্তু ওদের কোনও লোক এসে যদি আপনার বাড়ি থেকে টাকাটা সংগ্রহ করে নিয়ে যায়?”

“তা হলে তো আরও ভাল হয়। তোমাদের বদলে তোমাদের ওই কুকুরই গিয়ে ওঁদের ঘাঁটি চিনে আসবে। তারপর একদিন ওর সাহায্যে তোমার দলবল নিয়ে ওদের ঘাঁটিটা চিনে এসে আমাকে বলবে। তার মধ্যে ওদের কথামতো আমার নাতি যদি উদ্ধার হয় তো ওকে আমি তোমাদের এখানে রেখে গিয়ে একাই ওদের মোকাবিলা করব।”

“পারবেন?”

“না পারবার কী আছে? নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে অনেক সহজ কাজও অনেক সময় করা যায় না। কিন্তু নিজেকে মৃত্যুর পায়ে উৎসর্গ করতে পারলে অনেক কঠিন কাজও করে ফেলা যায়।”

বাবলু বলল, “বেশ। তা না হয় করবেন। কিন্তু ওরা যে টাকা চাইছে সে টাকা আপনি দিতে পারবেন?”

“পারব।”

বাবলু অবাক হয়ে রুদ্রনারায়ণবাবুর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “আপনি কত টাকার মালিক তা আমি জানি না। তবে মধ্যপ্রদেশ থেকে ফেরার পর আপনি কলকাতার মতো জায়গায় না থেকে মোসাবনীতে থাকতে গেলেন কেন?”

রুদ্রনারায়ণবাবু মাথার টাকে একবার হাত বুলিয়ে বললেন, “আসলে আমি একজন প্রকৃতি-প্রেমিক লোক। পাহাড়-পর্বত বন-জঙ্গল আমি অত্যন্ত ভালবাসি। তাই ওখানে প্রকৃতির কোলে পাহাড়ের বুকেই আশ্রয় নিয়েছি আমি।”

“কিন্তু এত টাকা আপনি সঞ্চয় করলেন কী করে? কী করেন আপনি?”

“তোমার এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয় বাবা। আমি অনুরোধ করছি তোমার অধিকারের বাইরে কোনও প্রশ্ন তুমি আমাকে কোরো না।”

“তা হলে আমিও করজোড়ে এবং সসম্মানে আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে অনুরোধ জানাচ্ছি।”

“সে কী !”

“হ্যাঁ। তার কারণ আপনার সব ব্যাপার যদি আপনি পরিষ্কার করে আমার কাছে খুলে না বলেন তা হলে আপনার এই ব্যাপারে মাথা গলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আপনি নিজেই একজন অসাধু ব্যক্তি কি না না জেনে কী করে আমি আপনার কাজে হাত দেব? আমরা কোনও বাজে লোকের হয়ে কাজ করি না।”

রুদ্রনারায়ণবাবু একবার বাবলুর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, “আমি জঙ্গল ইজারা নিয়ে কাঠের ব্যবসা করি। আমি একজন টিম্বার মার্চেন্ট।”

বাবলু হেসে বলল, “এই তা হলে আপনার প্রকৃতি-প্রেমের নমুনা? আপনি নিজেই তো একজন হত্যাকারী। বন-জঙ্গল কেটে অরণ্যের নিধন করছেন। আপনার কুঠারাঘাতে প্রকৃতি তার সম্পদ হারাচ্ছে। জীব-জন্তুরা আশ্রয়হীন হচ্ছে। আমরা সৌন্দর্যে বঞ্চিত হচ্ছি। আপনি প্রকৃতি-প্রেমিক নন। ঘাতক। একজন ঝানু ব্যবসাদার।”

“তুমি ঠিকই বলেছ বাবা।”

বাবলু বলল, “কিছু মনে করবেন না। সংসারে আপনারা তো মাত্র দুটি প্রাণী। আপনি এবং আপনার নাতি। তার পর প্রচুর টাকারও মালিক। বিশেষ করে মঙ্গল সিং-এর মতো ডাকাত যখন আপনার শক্ৰ তখন আপনি অর্থ-লোভে কেন এ সব করছেন? আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আপনার অর্থলালসাই আজ আপনার বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে?”

“হ্যাঁ, পেরেছি। জীবনে অনেক টাকা রোজগার করেছি আমি এখনও যা আছে তাতে আমার তিন পুরুষ পায়ের ওপর পা তুলে বসে খেতে পারবে। তাই ঠিক করেছি, আর নয়, এবার আমি সব কিছু ছেড়ে দেব! শুধু তোমরা আমাকে একটু সাহায্য করো। ওদের এলাকাটাও আমি দূর থেকে দেখিয়ে দেব তোমাদের তোমরা শুধু ওই এলাকায় কোনখানে ওদের ঘাঁটি সেইটাই খুঁজে বার করবে।”

বাবলু বলল, “বেশ, কথা দিলাম।”

বাবলুর মা এতক্ষণ ঘরের বাইরে দরজার আড়াল তোকে সব কথা শুনছিলেন। বাবলুর কথা শেষ হতেই ঘরে ঢুকলেন তিনি। তারপর দুহাতে বাবলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “না না, ওই দুর্ধর্ষ ডাকাতদের মোকাবিলা করবার জন্য তোকে আমি কিছুতেই যেতে দেব না বাবলু।”

বাবলু বলল, “আঃ কী হচ্ছে মা! কেন তুমি ভয় পাচ্ছ?”

“কেন ভয় পাচ্ছি সে তুই কী বুঝবি? ওখানে আমি কিছুতেই যেতে দেব না।”

তারপর রুদ্রনারায়ণবাবুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনি চলে যান। থানা-পুলিশ যা ইচ্ছে করুন। আমার ছেলেকে আপনি মুক্তি দিন। এইটুকু একটা ছেলেকে এত বড় একটা কাজে লাগাতে আপনার দ্বিধা হচ্ছে না? যদি আমার বাবলুর কোনও ক্ষতি হয় তা হলে পারবেন কি আমার সন্তানকে আমার বুকে ফিরিয়ে দিতে?”

রুদ্রনারায়ণবাবু মাথা নত করলেন। তারপর বললেন, “না, তা পারব না। তবে আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না মা। আমি এসেছিলাম আমার প্রতাপের মুখ চেয়ে। কেন না এ কাজ আপনার ছেলে ছাড়া আর কেউ করতে পারবে না। আর আপনার ছেলে তো সাধারণ ছেলে নয়। এই ধরনের কাজ একাধিক করেছে শুনেই খোঁজখবর নিয়ে এখানে এসেছি। তা ঠিক আছে। থাক। আপনি যখন বাধা দিচ্ছেন—।”

বাবলু বলল, “আপনি বসুন। আমরা না গেলে আপনার নাতিকে উদ্ধার করা যাবে না। থানা-পুলিশ করতে গেলেই মেরে ফেলবে ওরা ছেলেটাকে।”

মা বললেন, “বাবলু!”

“মা! তুমি ভেতরে যাও দেখি। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। কেন অযথা ভয় পাচ্ছ তুমি?”

“না না না। তোমার কোনও কথা আমি শুনব না। তোমার বাবা দুর্গাপুর থেকে আসুন। তারপর তোমাকেও আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ওঁর সঙ্গে। এখানে থাকলেই তুমি যা ইচ্ছে তাই করে বেড়াবে।”

বাবলু বলল, “মাগো, তুমি তো জান না, তোমার বাবলু অজেয়। তুমি আশীর্বাদ করো যেন রুদ্রনারায়ণবাবুর পরিবারের লোকদের যারা নৃশংসভাবে খুন করেছে আমরা তাদের সবাইকে ফাঁসির মঞ্চে তুলে দিতে পারি। আমরা পাণ্ডব গোয়েন্দা। আমাদের তো পিছু হটলে চলবে না মা।

“আমার যে বড় ভয় করছে বাবা।”

“তুমি ভেতরে যাও।”

অগত্যা বাবলুর মা ভেতরে গেলেন।

বাবলু রুদ্রনারায়ণবাবুকে বলল, “ঠিক আছে। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমরা দু-একদিনের ভেতরেই মোসাবনীতে যাচ্ছি। তবে একটা কথা। আমরা কিন্তু আপনার ওখানে থাকব না। আপনি যে আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন এটা যেন ডাকাতরা কোনওরকমেই টের না পায়। তা হলে সব চাল ভেস্তে যাবে।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “হ্যাঁ, আমিও তাই চাইছি। তোমরা পিকনিক পার্টি হিসেবে যাবে এবং ওখানে গিয়ে নিজেরাই খুঁজেপেতে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করে নেবে।” এই বলে কোটের পকেট থেকে এক গোছা নোট বার করে বললেন, “এগুলো তা হলে তোমাদের কাছে রাখ। আশা করি প্রাথমিক খরচটা এতেই তোমাদের হয়ে যাবে!”

বাবলু হাত পেতে টাকাগুলো নিল।

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “এতে পাঁচ হাজার টাকা আছে।”

বাবলু অবাক হয়ে বলল, “এত!”

“তোমাদের জন্যে এর দশগুণ টাকা আমি তুলে রেখেছি বাবা এখন এই নাও। ওখানে পৌছুলে আরও পাঁচ হাজার পাবে। আজ তা হলে আসি?”

“আসুন।”

বাবলুদের বাড়ির সামনে থেকে রুদ্রনারায়ণবাবুর অস্টিন গাড়িটা উধাও হয়ে গেলে টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে ডায়াল ঘোরাল বাবলু,“হ্যালো, পুলিশ স্টেশন… হ্যালো… হ্যালো…।”

বাচ্চু-বিচ্ছুদের বাড়ির সামনে ছোট্ট একটুখানি জায়গা পড়ে আছে। তার চারদিকে গাঁদা ফুলের গাছ। হলুদ আর চিনা গাদায় গাছগুলি ভরে আছে। ওইখানে বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু আর বিচ্ছু ব্যাটমিন্টন খেলছিল। এমন সময় দেখা গেল বাবলুকে সেখানে আসতে।

দূর থেকে বাবলুকে দেখতে পেয়েই চেঁচিয়ে উঠল বিচ্ছু, “ওই দেখ দিদি, বাবলুদা আসছে।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই বাচ্চু, বিলু ও ভোম্বল ঘুরে তাকাল। বাবলু কাছে আসতেই বিলু বলল, “এনি নিউজ?”

“ও, ইয়েস।”

ভোম্বল বলল, “নিউজটা বেশ আনন্দদায়ক তো?”

“অবকোর্স।”

বাচ্চু বলল, “তবু কীরকম শুনি?”

বাবলু বলল, “উহু। এত সহজে নয়। তার আগে গরম হালুয়া আর চা চাই।”

বিচ্ছু বলল, “এক মিনিট। আমি এখনই মাকে বলে আসছি। বলেই এক দৌড়ে ঘরে ঢুকল বিচ্ছু। বাচ্চু বলল, “তা হলে চল। সকলে বরং ছাদে গিয়ে বসি। ইন্টারেস্টিং খবর যখন, তখন রোদে বসে বেশ জুত করে শোনা যাবে।”

এমন সময় বাচ্চু-বিচ্ছুর মা হাসতে হাসতে বিচ্ছুকে নিয়ে উপস্থিত হলেন সেখানে বললেন, “কী খবর বাবলু? বিচ্ছুর মুখে শুনলাম তুমি নাকি কী একটা দারুণ খবর নিয়ে এসেছ?”

বাবলু বলল, “সত্যিই দারুণ খবর। কিন্তু আমি যা খেতে চাইলাম তা কই?”

“হচ্ছে হচ্ছে। শীতের সকালে শুধু হালুয়া কেন বাবা? তার সঙ্গে দুটো লুচি আলুভাজা আর নলেন গুড়ের সন্দেশেরও ব্যবস্থা করছি।”

বাচ্চু বলল, “তা হলে চা কেন? চায়ের বদলে কফি করেই পাঠিয়ে দাও না মা। আমরা ছাদে যাচ্ছি।”

“তা দেব। কিন্তু তোদের পঞ্চু ছাড়া বাবলু হয়?”

বাবলু বলল, “সত্যিই তো। নিজের খেয়ালে চলে এসেছি। পঞ্চুটাকে তো আনা হয়নি।”

এমন সময় হঠাৎ গেটের পাশ থেকে, “গোঁ—ও—ও—ঔ।”

সবাই হকচকিয়ে বলল, “আরে পঞ্চু!”

পঞ্চু তখন প্রশান্ত বদনে দিব্যি ভেতরে এসে বাবলুর পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে লেজ নেড়ে আনুগত্য স্বীকার করতে লাগল।

বাবলু বলল, “দেখছেন, পঞ্চুটা কী দুষ্টু। আমি ভুলে গেছি বলে সাড়া না দিয়ে দিব্যি আমার পিছু পিছু চলে এসেছে।”

বাচ্চু-বিচ্ছুদের মা বললেন, “ধন্যি কুকুর বটে তোমাদের। যাও, তোমরা ছাদে যাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

বাবলুরা সিঁড়ি ভেঙে ছাদে উঠল! তারপর চিলেকোঠার ঘর থেকে শতরঞ্জি বার করে ছাদের মাঝখানে গোল হয়ে বসল সকলে। শীতের সোনা ঝরা রোদ গায়ে মেখে দেহ-মন যেন সতেজ হয়ে উঠল।

বিলু বলল, “এবার বল দেখি কী ব্যাপার?”

বাবলু বলল, “ব্যাপার কিছু নয়, আর একবার ঘাটশিলায় যেতে হবে। সেখান থেকে মোসাবনী—।”

ভোম্বল বলল, “তার মানে?”

বিলু বলল, “তার মানে গোরুতেও বোঝে। অর্থাৎ আবার অ্যাডভেঞ্চার। তাই না বাবলু?”

“ঠিক তাই।”

বাচ্চু বলল, “কিন্তু আবার ঘাটশিলা গেলে তো টাকা চাই। এবারে টাকা কোথায় পাব?”

বিলু বলল, “ঠিক। এবারের টাকা আসবে কোত্থেকে?”

বাবলু বলল, “অপ্রত্যাশিতভাবে হাজার পাঁচেক টাকা পেয়ে গেছি।”

এই কথা শুনে সকলেরই চোখ কপালে উঠে গেল প্রায়। সবাই সমস্বরে বলল, “বলিস কী রে?”

এমন সময় বাচ্চু-বিচ্ছুর মা লুচি, আলুভাজা, হালুয়া আর সন্দেশ নিয়ে ওপরে এলেন। বিচ্ছু আনন্দে বলে উঠল, “জানো মা, আমরা আবার ঘাটশিলায় যাচ্ছি।”

বাবলু বলল, “আসলে সেবারে গিয়ে এমন সব ঝামেলায় জড়িয়ে পড়লাম যে ভাল করে ঘোরাই হল না। এবার ভাবছি দু’ চোখ ভরে সব কিছু দেখব আর দিনরাত ঘুরব।”

“তার মানে আবার একটা নতুন ঝামেলায় তোমরা জড়িয়ে পড়ছ।”

“কেন, একথা বলছেন কেন?”

“তোমাদের বিশ্বাস কী বলো? তোমরা যা ছেলেমেয়ে তাতে যেখানে তোমরা সেইখানে ঝামেলা।”

বাবলু বলল, “না না। এবার আর সে সবের ভয় নেই।”

“কিছুই বলা যায় না বাবা।”

বাচ্চু বলল, “কই মা, আমাদের খাবার তো এল। কফি কই?”

“আগে এগুলোই খা। তারপর কফি আনছি। নয়তো তুই আয় নীচে। আমি তো দশভুজা নই যে দশ হাতে সব কিছু ধরে আনব।”

বাচ্চু মায়ের সঙ্গে নীচে গেল। এবং একটু পরেই কেটলি আর কাপ হাতে নিয়ে ওপরে উঠল। বাবলু খেতে খেতেই সব কথা খুলে বলল। তারপর বলল, “তোদের এখানে আসবার আগে আমি থানাতেও যোগাযোগ করেছি। ও সি-র সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বলছেন একটা বায়নোকুলার সঙ্গে রাখতে। ওটা আশাকরি বিলুই ওর বাবার কাছ থেকে নিতে পারবে। কিছু নাইলনের দড়ি, একটা লোহার আংটা এবং মালপত্তর বইবার জন্য একটা ছোট চার চাকার গাড়িও আমাদের দরকার।”

বিলু বলল, “এ তো দেখছি এলাহি ব্যাপার।”

“হ্যাঁ। তা তো হবেই। কেন না আমাদের এবারের অভিযান দুর্গম পাহাড়ে জঙ্গলে এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমরা কিন্তু এবারে ভদ্র চোরেদের মোকাবিলা করতে যাচ্ছি না। চম্বলের ভয়ংকর দস্যুদেরই একজনের সঙ্গে আমাদের মোকাবিলা।”

ভোম্বল বলল, “ডাকাতটার কী যেন নাম বললি?”

“মঙ্গল সিং।”

বিলু বলল, “বাবা রে! নাম শুনেই তো বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে।”

বাবলু বলল, “ওর সম্বন্ধে যেটুকু শুনেছি তাতেই বুঝেছি অতি সাংঘাতিক দস্য ও ভয়ানক নৃশংস। কাজেই খুব সতর্কতার সঙ্গে এবং সাবধানে করতে হবে আমাদের কাজ। এবং সেজন্যে আমাদের নিজেদের ভেতর একটা জোর আলোচনা দরকার। তোরা যে যার মনস্থির করে নে তোরা কে কে যাবি বা যাবি না। তবে এবারের অভিযানে ভাবছি বাচ্চু-বিচ্ছুকে সঙ্গে নেব না।”

বাচ্চু-বিচ্ছুর মুখটা শুকিয়ে গেল। বলল, “কেন বাবলুদা?”

“এবারের অভিযানে বিপদের সম্ভাবনা খুব। হয়তো প্রাণহানিও ঘটতে পারে। কেন না এবারের ঝুঁকিটা তো সখের গোয়েন্দাগিরির নয়। জেনে শুনে গোখরো সাপের গর্তে হাত দিতে যাওয়া। কাজেই তোদের না যাওয়াই ভাল।”

বাচ্চু বলল, “বুঝলাম। কিন্তু আমরা যদি না যাই তা হলে সেটা কি পাণ্ডব গোয়েন্দার অভিযান হবে, না বাবলুদার অভিযান হবে?”

“এটা তো ঠিক সে ধরনের অভিযান নয়।”

বিলু বলল, “তাই যদি হয়, তা হলে এই কেসটা তুই হাতে না নিলেই পারতিস বাবলু। আমার কিন্তু এ ব্যাপারে মন খুব একটা সায় দিচ্ছে না।”

ভোম্বল বলল, “আমারও।”

বাবলু বলল, “আমার মনেও সায় দেয়নি। তবে কী জানিস, এবারের কেসটা অত্যন্ত মর্যাদার। একবার ভেবে দেখ তো, আমরা কতখানি জনপ্রিয় হয়েছি বা আমাদের কৃতকর্ম কতদূর সাকসেসফুল, যার জন্য সেই পাহাড় ঘেরা মোসাবনী থেকেও ভদ্রলোক ছুটে এসেছেন আমাদের কাছে। তার ওপরে এই রকম লোভনীয় প্রস্তাব। এ সুযোগ ছাড়ে কখনও?”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “কখনওই না। তবে বাবলুদা, তুমি জেনে রাখ এবারেও আমরা তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের রেখে তুমিও কোথাও যেতে পারবে না।”

“কোনও কিন্তু নয়। তবে একটা কথা, বাড়িতে যেন ঘুণাক্ষরেও এসব কথা জানতে না পারে।”

বাবলু বলল, “আমার মা সব জানে।”

“সে কী!”

“মাকে অবশ্য আমি বুঝিয়ে শুঝিয়ে ম্যানেজ করে নিয়েছি। যাক, আর দেরি করে লাভ নেই। বিলু, তুই বায়নোকুলারটা জোগাড় কর। ভোম্বল, তোর ওপর ভার রইল ওই চার চাকার গাড়ির। একটা আপেলের বাক্সর নীচে চারটে চাকা শুধু ফিট করে নিতে হবে। ও কাজটা তুই নিজেই পারবি।”

ভোম্বল ঘাড় নাড়ল। তারপর সকলে নেমে এল ছাদ থেকে।

দুপুরবেলা বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং পঞ্চু মিত্তিরদের বাগানে সেই ভাঙা বাড়ির মধ্যে বসে বাবলুর প্রতীক্ষা করছিল। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করার পরও যখন বাবলু এসে পৌছল না তখন সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ল। বাবলু যে কেন এত দেরি করছে আসতে তা কে জানে? এমন তো ও করে না। ব
াবলুই বরং সবার আগে এসে ওদের জন্য অপেক্ষা করে।

বাবলু না আসায় পঞ্চুও হান-টান করছে খুব। মাঝে মাঝে একবার করে বাগানের বাইরে থেকে চক্কর দিয়ে আসছে।

বিলু বলল, “কী ব্যাপার বল তো? বাবলু তো এরকম কখনও করে না।”

ভোম্বল বলল, “কিছু বুঝতে পারছি না।”

বাচ্চু বলল, “দুপুর যে গড়িয়ে গেল।”

বিচ্ছু বলল, “একটু এগিয়ে দেখব?”

ওরা যখন এই সব বলাবলি করছে তেমন সময় বেশ একটু হতদন্তভাবেই বাবলুকে আসতে দেখা গেল।

বাবলু কাছে আসতেই বিলু বলল, “কী রে, এত দেরি যে?”

“হ্যাঁ, একটু দেরি হয়ে গেল। বেশ কিছু কাজ চটপট সেরে ফেললাম কি না। তা যাক। যাকে যা ভার দিয়েছিলাম সব রেডি তো?”

ভোম্বল বলল, “বস। আগে একটু ঠান্ডা হ তুই। তার পরে সব খোঁজখবর নিবি।”

বাবলু বলল, “আর ঠান্ডা হবার দরকার নেই! যা শীত পড়েছে তাতে এমনিতেই ঠান্ডা হয়ে গেছি।”

বাবলু বলল, “নীচে নয়। চল দেখি সব ছাদে গিয়ে বসি। রোদ্দুরে পিঠ রেখে বসে আলোচনা করা যাবে।”

বাবলুর কথামতো ওরা সেই পোড়ো বাড়ির অব্যবহৃত ভাঙা চোরা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠল। ছাদে উঠে ছাদের মাঝ-মধ্যিখানে গোল হয়ে বসল ওরা।

বাবলু বলল, “সব তো হল। এখন এবারের যাত্রায় আমাদের সামনে একটা বিরাট বাধা এসে উপস্থিত হয়েছে।”

বিলু বলল, “কী রকম?”

“আমি এই মাত্র থানা থেকে আসছি ও সি কিন্তু আমাদের এই যাওয়ার ব্যাপারে একদম রাজি হচ্ছেন না।”

“কী বলছেন?”

“বলছেন রুদ্রনায়ারণবাবুর টাকা ফেরত দিয়ে দিতে। এবং আমাদের এই অভিযান বাতিল করতে।”

ভোম্বল বলল, “সে কী?”

“হ্যাঁ।”

“তার কারণ মঙ্গল সিং দুর্ধর্ষ দস্যু। সকালে আমার মুখে শোনার পর বিহার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও সি জেনেছেন দিনের পর দিন চেষ্টা করেও পুলিশ নাকি তার ধারে কাছে পৌছতে পারছে না। অতি মারাত্মক ওই দস্যু। ওর দীর্ঘ ডাকাতির জীবনে খুন ছাড়া নাকি কিছুই ও জানে না। সবচেয়ে বড় কথা এক জায়গায় ও স্থির থাকে না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জায়গায় ও ঘাঁটি তৈরি করে। এবং এমন এমন জায়গায় ও ঘাঁটি গাড়ে তা যে কোনও মানুষের পক্ষেই দুর্ভেদ্য হয়ে ওঠে।”

বাচ্চু বলল, “তা হলে কী করা যাবে?”

বাবলু বলল, “অভিযান বাতিল হবে না। মুশকিল হচ্ছে এই যে পিস্তলের জন্য কিছু গুলির তো দরকার।”

ভোম্বল বলল, “পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া যাবে না?”

“যেত। এখন ওঁরাই যখন বাধা দিচ্ছেন তখন আর তো আশা করা যায় না।”

বাবলু বলল, “তবে একটা উপায় আছে। গোটা-তিনেক বুলেট আমার কাছেই রয়েছে। বাকি কিছু রুদ্রনারায়ণবাবুকেই জোগাড় করে দিতে বলব।”

সবাই বলল, “দি আইডিয়া।”

বাবলু বলল, “ভোম্বল, তোর চার চাকার গাড়ি রেডি?”

“রেডি।”

“একটা টেলিস্কোপ পেয়ে গেছি। এই দেখ…” বলে কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে টেলিস্কোপটা বার করে বাবলুকে দিল বিলু।

বাবলু সেটা সযত্নে হাতে নিয়ে তাইতে চোখ রেখে চারদিক দেখতে লাগল। কী চমৎকার জিনিস ওটা! বহু দূরের সব কিছুও কত কাছে দেখাচ্ছে। বাবলু খুশির সঙ্গে বলল, “ওঃ, তুই যে কী জিনিস জোগাড় করেছিস বিলুতা কী বলব? তোর জবাব নেই, সাব্বাস।” বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গেল বাবলু। ওর টেলিস্কোপে ধরা পড়ল বহু দুরের একটি বাড়ির ছাদের এক দৃশ্য। এক অসামান্যা সুন্দরী তরুণী একটি অ্যালুমিনিয়াম চেয়ারে আরাম করে বসে গভীর মনোযোগ কী একটা বই পড়ছে। বাবলু আরও একটু লক্ষ করে দেখল বইটার নাম ভাঙা দেউলের ইতিকথা। বাবলু অবাক হয়ে কতকটা যেন নিজের মনেই বলল, “আরে! পায়েলদি!”

টেলিস্কোপ নামিয়ে উল্লসিত হয়ে বলল, “এই, পায়েলদি এসেছে রে।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “সত্যি!”

এরপর সবাই আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বলল, “কই, দেখি দেখি।” বলে সকলেই একবার করে টেলিস্কোপে পায়েলদিকে দেখে নিল। পায়েলদিকে দেখে ওদের যেন আনন্দের আর অবধি রইল না।

বাবলু বলল, “তা হলে শোন, কাল সকালের গাড়িতেই আমরা যাচ্ছি। এবং এটাই ফাইনাল।”

বিলু বলল, “পঞ্চু?”

“পঞ্চুও যাবে আমাদের সঙ্গে। তবে এবারে কিন্তু ওকে আমরা বৈধ ভাবেই নিয়ে যাবার চেষ্টা করব। এখন একবার পায়েলদির সঙ্গে দেখা করে আসি চল। পায়েলদি নিশ্চয়ই আজকালের মধ্যেই পাটনা থেকে এসেছে। আমাদের দেখলে আশা করি খুশিই হবে খুব। সত্যি! কতদিন পরে দেখা।”

বিলু বলল, “হ্যাঁ, সেই ভাল। সর্বাগ্রে আমরা একবার পায়েলদির সঙ্গে দেখা করে আসি চল। না হলে আমরা যখন অভিযান শেষ করে ফিরে আসব তখন হয়তো পায়েলদি আবার পাটনায় চলে যাবে। একবার পাটনায় চলে গেলে আবার যে কত বছর বাদে ফিরবে তা কে জানে?”

বাচ্চু বলল, “সেই ভাল। চলো সব দল বেঁধে পায়েলদির কাছে গিয়ে পায়েলদিকে চমকে দিই।”

ওরা সবাই দলবদ্ধ হয়ে পায়েলদির সঙ্গে দেখা করতে চলল। বাবলু বাগানের বাইরে এসে পিঠ চাপড়ে পঞ্চুকে ঘরে যাবার নির্দেশ দিল। পণ্ডিত পঞ্চুও এ সময় ওদের সঙ্গে যাওয়াটা অপ্রয়োজনীয় ভেবেই আপত্তি না জানিয়ে ফিরে গেল!

ওরাও এ-পথ সে-পথ করে এক সময় হাজির হল পায়েলদির বাড়িতে। বাড়ি তো নয়, একটা ছোটখাটো রাজপ্রাসাদ। দেখলে দুদণ্ড তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

পায়েলদিরা খুব বড়লোক। পায়েলদির বাবা পাটনার একজন নামকরা ডাক্তার। একটি নার্সিংহোম এবং একটি ঔষধ ফ্যাক্টরির মালিক। পায়েলদির দাদা পশ্চিম জার্মানিতে থাকেন। পায়েলদিও ভারতীয় নৃত্যকলার একজন প্রথম শ্রেণীর শিল্পী। কত্থক, মণিপুরী ও ভরতনাট্যমে পায়েলদির জুড়ি আর কেউ নেই। ভারত সংস্কৃতির এই অমূল্য সম্পদের বিকাশ ঘটাতে দেশ-দেশান্তরেও ছুটে যায় পায়েলদি।

মধ্য হাওড়ায় পায়েলদিদের পৈতৃক বাড়ি থাকলেও পায়েলদিরা এখন পাকাপাকিভাবে বিহার প্রবাসী। পায়েলদিদের হাওড়ার এই বাড়ি দেখাশোনা করবার জন্য একজন বিশ্বাসী লোক আছে। তা ছাড়া আশপাশের প্রতিবেশীদেরও সহযোগিতা আছে খুব। তবুও প্রবাসী হলেও পায়েলদির বাবা দু-এক মাস ছাড়া ছাড়াই এখানে আসেন। পায়েলদিও আসে। তবে খুব কম। কারণ পায়েলদি তো সংস্কৃতির জগৎ নিয়ে ব্যস্ত থাকে খুব।

বাবলুরা পায়েলদির বাড়ির সামনে এসে দরজা বন্ধ দেখে কলিংবেল টিপল। কলিংবেলের শব্দ শুনে পায়েলদি ছাদের আলসের কাছে এসে মাথাটা ঝুঁকিয়ে ওদের দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠল, “ওমা! তোমরা!” বলেই দ্রুত নীচে এসে দরজা খুলে দিল পায়েলদি।

দরজাটা শুধু খোলার অপেক্ষা। সকলে মিলে হইহই করে ঢুকেই আবেগে জড়িয়ে ধরল পায়েলদিকে। পায়েলদিও বিচ্ছুকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, “সত্যি, কত বড় হয়ে গেছ তোমরা সব। সেই কত ছোট্টটি দেখেছিলাম তোমাদের। এখন তো তোমাদের নাম-ডাক খুব। পাটনাতে বসেও তোমাদের খবর পাই। আর তোমাদের সেই কুকুর, পঞ্চু। পঞ্চু কই?”

বাবলু বলল, “ওকে আনিনি।”

পায়েলদি বলল, “ওঃ কী ডানপিটে হয়েছ তোমরা। আমাদের দেশে তো ক্ষুদে গোয়েন্দা ছিল না। কিন্তু তোমরা যা হয়েছ তাতে বিলেতের ছেলেমেয়েদেরও হার মানাও। আর তোমাদের পঞ্চুর তো কথাই নেই। আমাদের পাটনাতেও এখন কয়েকটি বাঙালি পরিবারে কুকুরের নাম পঞ্চু রেখেছে তোমাদের কুকুরের নামে।

“বলেন কী?”

“তা হলে বুঝছ তো এখন তোমরা কত জনপ্রিয়?”

“এর জন্যে আমরা অবশ্য ষষ্ঠীবাবুর কাছে ঋণী। উনি এত যত্ন করে আমাদের কথা না লিখলে তো কেউ চিনত না আমাদের।”

পায়েলদি বলল, “তা ঠিক। এক কথায় বলা যেতে পারে তোমরাই ষষ্ঠীবাবুর ছেলেমেয়ে।”

বাচ্চু তখন পায়েলদির বুকে মুখ রেখে বলল, “তবে পায়েলদি, আমরা যেমন আগের মতো নেই, বড় হয়েছি, তেমনই আপনারও কিন্তু অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের হাওড়ায় কিন্তু আপনি এত ফরসা ছিলেন না। একেবারে গোলাপের মতো গায়ের রং হয়েছে আপনার।”

বিচ্ছু বলল, “ঠিক বলেছিস দিদি। পায়েলদিকে ঠিক মেম-মেম দেখতে লাগছে।”

বাচ্চু বলল, “দেখতে লাগবে কেন। খাটি মেম তো।”

পায়েলদি বলল, “খুব ফরসা হয়েছি না? আসলে একটানা দেড় বছর সানফ্রানসিসকোতে ছিলাম কি না।”

“তাই নাকি? কবে এলেন?”

“এসেছি মাসখানেক হল।”

বাবলু বলল, “আপনি এখানে কবে এসেছেন পায়েলদি?”

“আজই এসেছি। সকালে।”

ভোম্বল বলল, “পাঞ্জাব মেলে নিশ্চয়ই?”

পায়েলদি সে কথার উত্তর না দিয়ে ওদের প্রত্যেকের দিকে স্নেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “এসো সব। ভেতরে এসে বসো বসে বসেই কথা বলা যাবে।” এই বলে ওদের সকলকে আদর করে একটা ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে চমৎকার রকমের কভার দেওয়া সোফাতে বসাল পায়েলদি। তারপর ডাকল, “রঘুদা!”

বৃদ্ধ রঘুপতি গামছায় হাত মুছতে মুছতে এসে বলল, “ডাকছেন দিদিমণি?”

“হ্যাঁ, এদের জন্য পুডিং করো তো? আর সকলের জন্যে চা বসাও।”

বাবলুরা সোফায় আরাম করে বসে ঘরের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বুঝল এটা আসলে ঘরের চেহারায় ছোটখাটো স্টুডিয়ো একটা। বাবলু সে সব দেখে পায়েলদির মুখের দিকে হাসি মুখে তাকাল। তারপর বলল, “আজ সকালে আপনি কোন গাড়িতে এসেছেন পায়েলদি?”

“কেন বলো তো?”

“তাই জিজ্ঞেস করছি। পাঞ্জাব মেলে নিশ্চয়ই? আমার না পাঞ্জাব মেলে চাপতে খুব ইচ্ছে করে।”

পায়েলদি বলল, “ইচ্ছে যখন করে তখন একবার চেপে পড়লেই হয়।”

“হ্যাঁ। একবার চাপতেই হবে।”

“এবার তো তোমরা বড় হয়েছ। একবার চলো না সবাই দল বেঁধে আমাদের ওখানে?”

ভোম্বল বলল, “আমারও পাঞ্জাব মেলে চাপবার শখ খুব।”

বিচ্ছু বলল, “বাবার মুখে শুনেছি পাঞ্জাব মেল নাকি ডিজেল ইঞ্জিনে যায়। আমার কাকিমারা একবার বেনারস গিয়েছিল ওই গাড়িতে চেপে।”

বাচ্চু বলল, “আমরাও যাব।”

বিলু বলল, “এবং ফাস্ট ক্লাসে চেপে।”

বাবলু বলল, “ফাস্ট ক্লাসে? ভাড়া জানিস?”

“জানবার দরকার নেই তো। যে গাড়িতে চাপবার এত শখ সে গাড়িতে যখন চাপব তখন ফাস্ট ক্লাসেই যাব। জীবনে একবার। বার বার তো নয়।”

পায়েলদি বলল, “কেন নয়? তোমরা যখন বড় হবে, বড়দরের মানুষ হবে তখন নিশ্চয়ই চাপবে ফাস্ট ক্লাসে। একবার, দু’বার নয়। বার বার চাপবে।”

বিচ্ছু বলল, “পায়েলদি, আপনি নিশ্চয়ই ফাস্ট ক্লাস ছাড়া চাপেন না?”

“চাপি না-ই তো। তবে এবারে আমি ফাস্ট ক্লাসেও চাপিনি। পাঞ্জাব মেলেও আসিনি।”

“তবে?”

“আমি এসেছি মোটরে।”

বাবলু বলল, “সে কী ! অতখানি পথ মোটরে?”

“তাতে কী হয়েছে? পাটনা থেকে মোটরে দিল্লিও আমি যাই। একটা নতুন প্রিমিয়ার কিনেছি। তাতে চেপেই যাই।”

বিলু বলল, “আপনার মা-বাবা আসেননি?”

“না। আমি একাই এসেছি। আজ সন্ধ্যায় রবীন্দ্রসদনে আমার একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই এসেছি। রবিশংকর, আল্লারাখাও আসছেন। যাবে তোমরা?”

ততক্ষণে পুডিং এসে গেছে। পায়েলদি প্রত্যেককে পুডিং ভাগ করে দিল।

বাবলু প্লেটটা কোলের কাছে টেনে নিয়ে বলল, “যাবার খুব ইচ্ছে। কিন্তু যেতে পারব না পায়েলদি।”

“কেন?”

“আমরা একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছি। না হলে এমন চান্স কেউ মিস করে? আবার কবে কতদিন বাদে এই রকম অনুষ্ঠান হবে তা কে জানে? তবু সব জেনেও যাওয়া হবে না আমাদের। আমরা কাল সকালের গাড়িতে সবাই চলে যাচ্ছি ঘাটশিলা বেড়াতে! সকাল ছটা দশে গাড়ি। সব ঠিকঠাক। কাজেই আজ আর ইচ্ছে থাকলেও যাওয়া যাবে না।”

“সে তো বটেই। কিন্তু ঘাটশিলায় হঠাৎ?”

“এমনই বেড়াতে।”

“উহু। একটু আগেইনা তুমি বললে একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছ তোমরা। তার মানে, নিশ্চয়ই কোনও রহস্যের জালে জড়িয়েছে?”

“না না। সে রকম কিছু নয়।”

পায়েলদি বলল, “শোনো, আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে। ওখানকার কপার মাইনসটা আমার দেখবার ইচ্ছে আছে খুব।”

বাবলু বলল, “বেশ তো চলুন। কোনও অসুবিধে হবে না। আমরা এর আগেও তো গেছি ঘাটশিলায়। ওখানে গিয়ে শুধু কপার মাইনস দেখবেন কেন, আরও অনেক কিছুই আছে দেখবার।”

“কী রকম?”

“যেমন ধারাগিরি, মৌভাণ্ডার, রাতমোহনা, হরিণ ধুবড়ি, তামুক পালের বন, কী না আছে সেখানে? কাছেই রাকা মাইনস, রংকিনী। যদুগোড়াটা অবশ্য একটু দূরে। আর আছে ফুলডুংরি পাহাড়—আরও কত কী? তবে আমাদের যাত্রাপথ এবারে কিন্তু ঠিক ঘাটশিলায় নয়, একটু দূরে সুরড হয়ে মোসাবনীতে।”

“সে তো শুনেছি আরও ভাল জায়গা। সুরডায় শুনেছি কাশাইডি, সিমাইডি আর কোন্দাডি নামে তিনটে পাহাড় আছে।”

“এই অঞ্চলটাই পাহাড়ে পাহাড়। আর তেমনিই জঙ্গল। আমরা যাব ওইখানেই মোসাবনীতে। সেখানেও পাহাড়। আপনি যদি আমাদের সঙ্গে যান তা হলে খুবই ভাল হয়। আপনি সঙ্গে থাকলে বেড়ানোটা যে কী ভাল হবে না! একেবারে প্রাণ মাতানো ব্যাপার যাকে বলে তাই হবে।”

পায়েলদি খুশি হয়ে বলল, “তবে ভাই, একটা কথা। আমি কিন্তু ট্রেনে যাব না। তোমরাও যাবে না।”

“তা হলে?”

সকলে ‘হু-র-র-রে’ বলে লাফিয়ে উঠল!

বাবলু বলল, “তা হলে যে আমাদের কী ভাল হয় পায়েলদি তা কী বলব। আপনি তো জানেন, আমরা যেখানে যাই আমাদের পঞ্চুও আমাদের সঙ্গে সেখানেই যায়। কাজেই বাইরে কোথাও গেলে ট্রেনে ওঠানোর সময় ওকে নিয়ে বড় ঝামেলা পড়তে হয়। এখন আপনার গাড়িতে যদি আমরা যাই তা হলে ওকে নিয়ে আর ঝামেলায় পোহাতে হবে না।”

পায়েলদি বলল, “আমি আজ রাত্তিরেই গাড়িটাকে ঠিক-ঠাক করে রাখছি। যাতে কাল সকালে যেতে কোনও অসুবিধে না হয়।”

বাবলু বলল, “বেশ। এই কথা রইল তা হলে। আমরা কাল খুব ভোরে এখানে চলে আসব।”

পায়েলদি বলল, “তা কেন? তোমরা বরং তৈরি হয়ে আজই এখানে চলে এসো। তা হলে কাল খুব ভোরে অন্ধকার থাকতেই আমরা রওনা দিতে পারব।”

“হ্যাঁ, সেই ভাল। আপনি আপনার অনুষ্ঠান শেষ করে আসুন। আমরাও ততক্ষণে সব কিছু গুছিয়ে-গাছিয়ে আসি।”

ততক্ষণে চা এসে গেছে। পুডিং-এর পর চা মন্দ না। চা খেয়ে উচ্ছসিত বাবলুরা যে যার বাড়ির দিকে চলে গেল।

সে রাতে বাবলুরা বাড়িতে বলে কয়ে পায়েলদির বাড়িতেই চলে এসেছিল। পায়েলদি রাত দশটার মধ্যেই ফিরে এসেছিলেন। তারপর একসঙ্গে শুয়ে অনেক রাত পর্যন্ত পায়েলদির সঙ্গে গল্প করে, ঘুমিয়ে, ভোর না হতেই যাত্রা শুরু।

যাবার সময় হঠাৎ এক বিঘ্ন উপস্থিত হল।

পায়েলদির ড্রাইভার প্রভুদয়াল গত রাতে ফুটপাতে পিয়াজি খেয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। এই অবস্থায় যাওয়া বুঝি আর হয় না। কিন্তু পায়েলদিও তো যা তা মেয়ে নয়, বলল, “ঠিক আছে। ঘাবড়াবার কোনও কারণ নেই। আমিই চালিয়ে নিয়ে যাব।”

বাবলু বলল, “আপনি পারবেন তো? অনেক দূরের পথ কিন্তু।”

পায়েলদি হেসে বলল, “ভয় নেই গো, ভয় নেই। না পারলে বলি? আমার সব কিছুরই অভ্যাস আছে।”

ওরা সকলে হৃষ্ট মনে পায়েলদির মোটরে চেপে বসল। প্রিমিয়ার তো খুব একটা বড় সড় গাড়ি নয়। তাই একটু চাপাচাপি করে বসল সব।

পায়েলদি বসল সামনের দিকে। ড্রাইভারের আসেন। কিন্তু মালপত্তরের সঙ্গে পায়েলদির হাতে যেটা দেখা গেল সেটা দেখে অবাক হয়ে গেল সকলেই।

বাবলু তো দারুণ খুশি হয়ে বলল, “পায়েলদি! এই সবও আপনি রাখেন সঙ্গে?”

পায়েলদি হেসে গাড়িতে স্টার্ট দিতে দিতে বলল, “এটা আমাদের অনেকদিনকার সম্পত্তি। এখন দিনকাল খারাপ তো। তাই সঙ্গে রাখি। কেউ বাড়াবাড়ি করতে এলেই ট্রিগারটি টিপে দেব। আর সঙ্গে সঙ্গে আগুনের হলকা ছুটিয়ে শব্দ হবে, ছ-র-র-র।”

প্রশস্ত রাজপথের ওপর দিয়ে পাণ্ডব গোয়েন্দাদের নিয়ে পায়েলদির প্রিমিয়ার ঝড়ের গতিতে ছুটে চলল। বাবলু আর ভোম্বল বসেছিল পায়েলদির পাশে। বিলু, বাচ্চু আর বিচ্ছু বসেছিল পিছনের সিটে। পঞ্চু ছিল ওদের কোলে। মাঝেমধ্যে দৃষ্টি উদাস করে প্রকৃতির দৃশ্য দেখছিল সে।

গাড়িটা এত ম্পিডে চলছিল যে বাচ্চু-বিচ্ছুর ভয় করছিল খুব। তাই ভয়ে ভয়ে বলল, “একটু আস্তে চালান পায়েলদি। বড় ভয় করছে।”

পায়েলদি বলল, “ভয় কী? এখন তো রাস্তাঘাট একদম ফাঁকা। এই সময়ই তো জোরে চালাতে হয়।”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ, আরও জোরে—দ্বিগুণ জোরে চালিয়ে যান পায়েলদি। আমি ভয় পাচ্ছি না।”

বিলু আর ভোম্বল বলল, “বাচ্চু-বিচ্ছু ছেলেমানুষ। না হলে আমরা হচ্ছি পাণ্ডব গোয়েন্দা। আমরা কোনও ব্যাপারেই ভয় পাই না।”

ভোম্বল বলল, “আসলে কী ব্যাপার জানেন তো পায়েলদি, ভগবান আমাদের সহায়। না হলে আমাদের যা মনের জোর তা আমাদের অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবদের নেই।”

পায়েলদি বলল, “মনোবলটাই তো আসল। তা তোমরা যে এইভাবে ঘুরে বেড়াও এত চোর-ডাকাতের পাল্লায় পড় তোমাদের ভয় করে না?”

বাবলু বলল, “না।”

“তোমরা তো শুনি যেখানেই যাও সেখানেই ঝামেলায় পড়।”

“হ্যাঁ, যত ঝামেলা সব যেন আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই যায়। তবে পায়েলদি, যত বিপদেই পড়ি না কেন আমরা, কেটে বেরিয়ে আসার উপায় মাথা থেকে ঠিক একটা না একটা বার করে ফেলি। আজ পর্যন্ত কোনও ব্যাপারেই আমরা হার মানিনি।”

পায়েলদি বলল, “তোমাদের বুদ্ধির দৌড়টা একবার দেখতে হচ্ছে তো। ভগবান করুক মোসাবনীতে গিয়ে তোমরা একটা বিশেষ কোনও ঝামেলায় জড়িয়ে পড়। আমি দেখব কী করে তোমরা কেটে বেরোও।”

বাবলু বলল, “দেখবেন।”

পায়েলদি বলল, “তোমাদের ব্যাপার-স্যাপার জানি বলেই আমি বন্দুকটা সঙ্গে নিয়েছি। যদিও পাখি মারা বন্দুক এটা তবুও বিপদে কাজ দেবে।”

বাবলু বলল, “ওটা সঙ্গে নিয়ে ভালই করেছেন। আমরা সত্যিই একটা বিপজ্জনক কাজে যাচ্ছি। বিপদকালে ওটা আমাদের প্রয়োজনও হতে পারে।”

পায়েলদি বলল, “হুঁ। এবারে দেখব সত্যিকারের বিপদ সামনে এসে দাঁড়ালে তোমরা কীভাবে কী করো।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা এখন চলুন তো। আগে মোসাবনী পৌছুই তারপর পরের কথা পরে।”

প্রিমিয়ার তখন পূর্ণ গতিতে বম্বে রোডের ওপর দিয়ে যেন হাওয়ায় উড়ে চলেছে। পায়েলদির ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হল এটা যেন মোটর নয়। একটা ছেড়া কাগজ। দমকা হাওয়ায় শুধু উড়েই চলেছে—উড়েই চলেছে।

কোলাঘাট, মেচেদা, খড়গপুর পেরিয়ে কলাইকুণ্ডার ওপর দিয়ে রকেটের মতো ছুটে চলেছে এই ক্ষুদ্র মোটরযান।

হঠাৎ এক জায়গায় এসে শঙ্কিত হয়ে পায়েলদি প্রায় চিৎকার করে উঠল, “এই রে! সর্বনাশ হয়েছে।”

সবাই ভয় পেয়ে বলল, “কী হল পায়েলদি?”

“ব্রেকটাকে আমি কিছুতেই কনট্রোলে আনতে পারছি না। মনে হচ্ছে ব্রেক ফেল হয়ে গেছে।”

বাচ্চু-বিচ্ছু চেঁচিয়ে উঠল, “সে কী!”

“হ্যাঁ। কিছুতেই বাগে আনতে পারছি না এটাকে।”

বাবলু বলল, “তা হলে উপায়?”

“কোনও উপায় নেই। যতক্ষণ তেল আছে এর ভেতরে ততক্ষণ নন স্টপ এগিয়ে যেতে হবে। তার ভেতরে যদি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয় তা হলে সব শেষ।”

ভোম্বল বলল, “তেল কতটা আছে?”

“অনেক। এখন ফুরাবে না।”

তখন রীতিমতো সকাল হয়ে গিয়েছিল। বাবলুরা তাই গাড়িতে বসেই হাত পা নেড়ে ‘ব্রেক ফেল—ব্রেক ফেল’ বলে চিৎকার করতে লাগল।

কিন্তু এখানে কে শুনছে ওই চিৎকার?

পায়েলদি কিন্তু শক্ত হাতেই স্টিয়ারিং ধরে আছে। শুধু তাই নয় ওই প্রচণ্ড গতিতেই দু-একটা মোটর ও লরিকে অদ্ভুত কায়দায় ওভারটেক করল পায়েলদি।

এমন সময় দেখা গেল একটা হেলিকপ্টার রানওয়ে থেকে উড়ে ওদের মাথার ওপর দিয়ে চক্কর খেয়ে চলতে লাগল।

বাবলুদের চিৎকারে যে দু-একজন পথচারী পথে ছিল তারাও ওই মরণদুতকে সামনে দেখে দৌড়ে।

ভোম্বল বলল, “আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে পায়েলদি।”

“কীরকম!”

“ভাবছি সামনের কাঁচটা ভেঙে ইঞ্জিনের ডালাটাকে তুলে মোরটাকে বিকল করে দেব?”

পায়েলদি যেন শিউরে উঠল, “ওরে বাবা! না না। আমার শখের গাড়ি, নতুন কিনেছি। কাঁচ ভাঙবে কী? তা ছাড়া এত স্পিডের মাথায় তুমি সামনে যাবে কী করে? ছিটকে পড়ে যাবে যে।”

বাবলু বলল, “ও পাগলার কথা ছেড়ে দিন। আপনি বরং গাড়িটাকে মাঠে নামিয়ে ভিড়িয়ে দিন কোনও গাছের গায়ে।”

পায়েলদি বলল, “দিতাম। কিন্তু যে রকম স্পিডে গাড়িটা চলছে তাতে ও কীর্তি করলে একেবারে গুড়িয়ে যাবে গাড়িটা। সকলকেই মরতে হবে।”

বাবলু বলল, “মরতে আমরা ভয় পাই না পায়েলদি। ভেবে দেখুন, এতে শুধু আমরাই মরব। কিন্তু এইভাবে গাড়ি চললে কত নিরীহ পথচারীর প্রাণ নষ্ট হবে বলুন তো? তা ছাড়া এতে যে সবাই মরব তার কোনও মানে নেই। কিন্তু যদি একটা বেপরোয়া লরির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়, তখন কী হবে?”

হেলিকপ্টারটা তখনও মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছে। ঘুরপাক খেতে খেতে হঠাৎ একসময় সামনের দিকে এগিয়ে বহু দূরে মিলিয়ে গেল।

পথচারীরাও যারা আপন মনে পথ চলছিল তারাও একটানা মোটরের হর্ন, বাবলুদের চিৎকার ও গাড়ির গতি দেখে পালাতে লাগল।

বাবলু বলল, “পায়েলদি, প্লিজ। এখনও সময় আছে। আবার বলছি আমার কথা শুনুন। গাড়িটা আপনি মাঠে নামিয়ে দিন। তারপর যা হয় করুন। হয় কোনও গাছে, না হয় ঝোপে ঝাড়ে ঢুকিয়ে দিন। এমন চান্স আর পাবেন না কিন্তু। রাস্তা আর মাঠ এক লেভেলে আছে এখানে।”

বাবলু বলল।

পায়েলদি শুনল।

কিন্তু কী যে মনে আছে পায়েলদির তা কে জানে? গাড়িটাকে থামাবার কোনও চেষ্টাই তো করছেন না। শুধু একটার পর একটা গাড়িকে পাশ কাটিয়ে হুস হাস শব্দে বেরিয়ে যাচ্ছেন।

পায়েলদির অনাগ্রহ দেখে বাবলুই এবার সক্রিয় হয়ে উঠল। পায়েলদি ধরে থাকা সত্ত্বেও বাবলু হঠাৎ স্টিয়ারিংটা ধরে নিজেই ঘুরিয়ে দিল গায়ের জোরে। ।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু সভয়ে চিৎকার করে উঠল।

মৃত্যু! অবধারিত মৃত্যু দুয়ারে উপস্থিত। আর তাকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না।

পায়েলদি ‘এ কী! এ কী! এ কী করছ?’ বলে চেচিয়ে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে মোটরটা প্রায় লাফিয়েই পাশের মাঠে নেমে পড়েছে।

এখানে আশেপাশে দু-একটি পরিত্যক্ত দরমার ঘর ছিল। এবং মাঠে কিছু ক্ষেতমজুর, কাঠুরে ও নানান শ্রেণীর লোক ছিল। তারা হইহই করে উঠল। গেল গেল রব উঠল চারদিকে। লোকেরা এটিকে একটি দুর্ঘটনা ঘটতে চলছে বলে মনে করল।

প্রচণ্ড গতিতে গাড়িটা তখন একটি খড়ের ছাউনি দেওয়া দরমার ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। বহু দিনের অব্যবহৃত পচা বাঁশের দরমা। সেটা মড়মড়িয়ে ভেঙে মোটরের সঙ্গে আটকে গেল। সে কী দারুণ কিন্তুতকিমাকার ব্যাপার। মোটর পূর্ণ গতিতে যত ছুটছে চালাঘরটাও গাড়ির সঙ্গে আটকানো অবস্থায় ততই ছুটছে। দূর থেকে সে দৃশ্য যারা দেখল তারা সেটাকে একটা ভুতুড়ে ব্যাপার বলে মনে করল। তারা ভাবল কোনও গুণিনের ক্রিয়াকলাপের প্রভাবেই বোধ হয় এই ঘরখানি রাস্তা দিয়ে ছুটছে। ঘরের ভেতরে যে মোটর ভূত আটকে আছে তা কেউ বুঝতেও পারল না।

সে এক যেমনই হাস্যকর ব্যাপার, তেমনই ভয়ংকর দৃশ্য। বোকা লোকেরা ভয়ে চেঁচামেচি করে পালাতে লাগল। আর গোরু মোষ কুকুর ছাগল দৌড়তে লাগল লেজ তুলে।

বাবলু বলল, “আচ্ছা কেলেংকারি হল তো। এটা আটকে গিয়ে তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

পায়েলদি তখন মাঠময় দু-একবার মোটরটাকে চক্কর খাইয়ে আবার রাস্তায় তুলেছে।

বাবলু বলল, “এ কী করছেন? বেশ তো ছিল। এটাকে তো মাঠময় চক্কর খাওয়াতে পারতেন সারাদিন।”

পায়েলদি বলল, “আমি তুলিনি। গাড়িটা আপনিই রাস্তায় উঠে গেছে।”

“কী করে? ওকে কি ভূতে ধরেছে?”

ততক্ষণে হেলিকপ্টারকে আবার মাথার ওপর ঘুরপাক খেতে দেখা গেল। একটু পরেই দেখা গেল পিছন থেকে একটি দমকল ও পুলিশের গাড়িকে ছুটে আসতে। চালাঘরটা আটকে গিয়ে বাইরের দৃশ্য ভালভাবে দেখা যাচ্ছে না। তবুও যেটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে বোঝা যায় রাস্তার দু’পাশে বহু লোক দাঁড়িয়ে। এমনকী মোটর ও লরিও আপ ডাউন দু’পাশে দাঁড় করানো।

বিলু বলল, “নিশ্চয়ই কোনও না কোনও ভাবে আগে ভাগে ওরা খবর পেয়ে গেছে।”

বাবলু বলল, “আমার মনে হয় এই হেলিকপ্টারের যিনি পাইলট তিনিই সব কিছু দেখে শুনে খবরটা দিয়ে দিয়েছেন।”

এমন সময় হঠাৎ পথের ধারে একটি ঝোপ-ঝাড় বিশিষ্ট ভাঙা মাটির বাড়ির ধ্বংসস্তুপ ওরা দেখতে পেল।

বাবলু বলল, “পায়েলদি, এই একটা বেটার চান্স। তুমি এইখানেই ভিড়িয়ে দাও গাড়িটাকে।”

পায়েলদি বলল, “কী করে ভেড়াব? আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।”

বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবলু নিজেই স্টিয়ারিংটাকে ঘুরিয়ে দিল। যেই না দেওয়া, গাড়ি অমনি ঢুকে পড়ল সেই ধ্বংসস্তুপের ভেতরে। তবে সবটা নয়। সামান্য অংশ। ক্যাক ক্যাক শব্দে এতক্ষণে থেমে গেল গাড়িটা।

বাবলু বলল, “এ কী! এ তো ব্রেক কষার শব্দ।”

পায়েলদি বলল, “নাঃ, তোমরা সত্যিই সাহসী ছেলে।”

বিলু বলল, “তার মানে?”

“তার মানে গাড়ির ব্রেক ঠিকই আছে। কিছু হয়নি গাড়ির। এতক্ষণ আমি তোমাদের সঙ্গে খেলা করছিলাম।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “এ তো সর্বনাশা খেলা পায়েলদি।”

“তা বলতে পারো। তবে একে ফাঁকা জায়গা, তায় স্টিয়ারিং আমার হাতে। দুর্ঘটনা ঘটতে দিতাম না। আমি শুধু তোমাদের পরীক্ষা করে দেখছিলাম সত্যিকারের বিপদের মুখোমুখি হলে তোমরা কতখানি নিজেদের ঠিক রাখতে পার। সে পরীক্ষায় তোমরা উত্তীর্ণ হয়েছ। তোমরা প্রমাণ করেছ মরতেও তোমরা ভয় পাও না। আসলে এই দৃঢ় মানসিকতার জন্যই তোমরা জিতে যাও সর্বত্র।”

এদিকে চারদিক থেকে হইহই করে লোকজনের ছুটে আসার শব্দ শোনা গেল তখন। পুলিশ এবং দমকল বাহিনীর লোকেরাও এল। সবাই এসে মোটরটাকে চালাঘর হতে মুক্ত করে উদ্ধার করল এদের সকলকে। পায়েলদির ইঙ্গিতে এবার বাবলুদের একটু অভিনয় করে দেখাতে হল। না হলে মান থাকে না। এবং পায়েলদিকেও বকুনি শুনতে হয়। কাজেই ওরা এমন ভান দেখাল যেন এই আকস্মিক বিপদে খুবই নার্ভাস হয়ে পড়েছে ওরা।

সবাই ওদের ধরাধরি করে কাছেই একটি দোকানের বেঞ্চিতে বসাল।

পায়েলদির হাতে সামান্য একটু চোট লেগেছিল এই ঝাঁকানিতে। সেখানে একটু ফাস্ট এইড দেওয়া হল।

পঞ্চু এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এবার একটু গা ঝাড়া দিয়ে ডেকে উঠল, “ভোঁ—উ—উ—উ।”

যে হেলিকপ্টারটা মাথার ওপর ঘুরপাক খাচ্ছিল সেটিও তখন মাঠে নেমে পড়েছে। একজন চাপদাড়ি সুদর্শন পাইলট এগিয়ে এসে বললেন, “আমিই প্রথম কলাইকুণ্ডার রানওয়ে থেকে তোমাদের দেখতে পাই। গাড়ির গতি দেখেই সন্দেহ হয়েছিল আমার। নিশ্চয়ই কিছু না কিছু একটা অসুবিধে হয়েছে। যে কারণে গাড়িটাকে কনট্রোলে আনা যাচ্ছে না। তাই ওপর থেকে একটু ফলো করেই বেগতিক দেখে ধলভূমগড়ে খবর দিই। পরবর্তী কাজগুলো ওরাই করেছেন সব। যাক ভাগ্য ভাল যে বড় ধরনের কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।”

বাবলুরা ধন্যবাদ জানাল পাইলটকে।

পুলিশ অফিসার বললেন, “কোথায় যাচ্ছিলেন আপনারা?”

পায়েলদি বলল, “ঘাটশিলা।”

“তা কী অসুবিধে হয়েছিল আপনার?”

“আসলে ব্রেকটা কাজ করছিল না।”

“হুঁ। যদি কিছু মনে না করেন তো আপনার গাড়ি চালানোর লাইসেন্সটা একবার দেখব।”

এইবার একটু বেকায়দায় পড়ে গেল পায়েলদি। আসলে লাইসেন্স ছিল। কিন্তু দুৰ্ভাগ্যক্রমে সেটা গাড়িতে ছিল না। ছিল বাড়িতে। পায়েলদি বিনীতভাবে বলল, “আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি স্যার—।”

“লাইসেন্সটা বাড়িতে ফেলে এসেছেন? এই তো! এসব ক্ষেত্রে সবাই তাই বলে।”

“না মানে আমার ড্রাইভার খড়গপুরের কাছে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিই এবং নিজে স্টিয়ারিং ধরি। কাজেই—।”

“ঠিক আছে। যদিও ছাড়া উচিত নয় তবুও আপনার গাড়ির নম্বরটা আমরা নিয়ে রাখছি। আপনি যাবার সময় বাড়ি থেকে লাইসেন্স আনিয়ে দেখিয়ে যাবেন। অথবা আপনার ড্রাইভারকে বলবেন গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে। আপনি স্টিয়ারিং ধরবেন না। যান। সাবধানে যাবেন।”

এমন সময় একজন দমকল কর্মী এসে বললেন, “আপনার গাড়িটা চেক করে দেখলাম। গাড়ির কোনও ক্ষতি হয়নি। খুব ভাল কন্ডিসন গাড়িটার। আসলে দরমার ঘরটাই বাইরের আঘাত থেকে বাঁচিয়েছে গাড়িটাকে। আমরা খবর দিয়েছি আমাদের মেকানিককে। তারা এসে একবার চেক করে দিলেই যেতে পারবেন আপনারা।”

পায়েলদি বলল, “কোনও দরকার নেই। ব্রেকটা প্রথমে কীসে যেন আটকাচ্ছিল। এখন ঠিক হয়ে গেছে।”

দমকলের ড্রাইভার ভদ্রলোক নিজেও একজন মেকানিক গাড়িটাকে একটু নাড়া-চাড়া করে বললেন, “কই, কী হয়েছে ব্রেকের? ব্রেক তো ভালই কাজ করছে দেখছি।”

পায়েলদি বলল, “ধন্যবাদ। শুধু শুধু আপনাদের কষ্ট দিলাম।”

ওরা সবাই এখানে বসে একটু চা জলযোগ সেরে নিল। তারপর নাটকের শেষ। বিদায়।

পায়েলদি এসে স্টিয়ারিং ধরল।

বাবলুরাও চুপচাপ এসে বসে পড়ল গাড়িতে।

পুলিশ অফিসার, দমকলের লোকেরা এবং সেই পাঞ্জাবি পাইলট ভদ্রলোক অভিবাদন জানালেন ওদের।

ওরা সকলে হাত নেড়ে টাটা করল। পঞ্চু ভৌ—ভৌ করল।

হর্ন বাজিয়ে প্রিমিয়ার ছুটে চলল ঘাটশিলার দিকে।

ঘাটশিলা।

এখানে এসে প্রথমেই ওরা একটা দোকানে ঢুকে বেশটি করে রসমালাই খেয়ে নিল পেট পুরে। ঘাটশিলার রসমালাই বিখ্যাত কিনা, তাই, তবে রসমালাই এখন সর্বত্র হচ্ছে। এবং ঘাটশিলার থেকেও অনেক ভাল হচ্ছে। কিন্তু ওই যে নাম হয়ে গেছে একবার।

যাই হোক, রসমালাই খেয়ে আবার সবাই মোটরে চেপে এগিয়ে চলল মোসাবনির দিকে। মউ ভাণ্ডার পেরিয়ে সুবর্ণরেখার সেতু পার হয়ে সোজা এগিয়ে চলল। ডানদিকের পথটা বেঁকে গেল রাকা মাইনস হয়ে যদুগোড়া ও টাটানগরের দিকে। ওরা বাঁদিকের পথ ধরল।

মোসাবনীর বাজারে পৌছে ওরা একটি মনের মতো আশ্রয়ের সন্ধান করতে লাগল। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং নিরাপদ আস্তানা। কিন্তু এই ছোট্ট জায়গায় সবচেয়ে মুশকিল যেটা, সেটা হল ঘর পাওয়া। কেন না মোসাবনী স্বাস্থ্যকর স্থান হলেও মাইনস এলাকা। এখানে প্রচুর শ্রমজীবী মানুষ কর্ম উপলক্ষে বসবাস করেন। কাজেই থাকার জন্য তাদেরই স্থান সংকুলান হয় না। এই যেখানে অবস্থা সেখানে বহিরাগতদের স্থান কোথায়? অতএব বাইরে থেকে যারা মোসাবনী বেড়াতে যায়, তারা সবাই ঘাটশিলাতেই থাকে এবং দু’চার ঘণ্টা ঘোরাফেরা করে আবার ঘাটশিলাতেই ফিরে আসে।

যাই হোক, ওরা যখন খুব চেষ্টা করছে ঘর পাবার জন্য তেমন সময় জিপসিদের মতো দেখতে একজন স্ত্রীলোক, ফরসা রং, চোখে সুরমা, পরনে ঘাগরা, এসে বলল, “তোমরা কি ঘর মাঙছো?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ।”

“মিল যায়েগি। লেকিন হামকো দশ রুপিয়া দেনে পড়েগা।”

“বেশ তাই দেব।”

“তো অা যাও মেরা সাথ৷ ”

পায়েলদি বলল,“কত দূরে?”

“কাছেই আছে। আইয়ে না?”

ওরা তার সঙ্গে একটু যেতেই এক জায়গায় একটি দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়িটা খুব ছোট। তবে নতুন। নীচে দুখানি ঘর। ওপরে একখানি। তার পাশে এক ফালি ছাদ। বাইরে দিয়ে টানা সিঁড়ি। ইচ্ছেমতো সব কিছু করা যাবে।

নীচের দুখানি ঘরের মধ্যে একটি ধোবিখানা। অপরটিতে বাড়ির মালিক থাকে। এক বিশাল বপু মিশকালো লোক নীচের ধোবিখানায় কাপড় ইন্ত্রি করছিল। কী বিচ্ছিরি চেহারা লোকটার। সারা দেহে কাটা ক্ষতের চিহ্ন। গালের একপাশ কাটা। মাথায় বাকড়া বাবড়ি চুল। ডাকাতের মতো। দেখলেই মনে হয় ক্রিমিন্যাল একটা।

ওরা যেতেই ওদের দিকে রক্তচক্ষুতে একবার তাকিয়ে দেখল লোকটা। তারপর স্ত্রীলোকটি তার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে কী সব বলতেই লোকটি একটি চাবি এগিয়ে দিল।

স্ত্রীলোকটি চাবি নিয়ে সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠল। বাবলুরাও উঠল সাথে সাথে। ওপরে উঠে ঘর খুলে স্ত্রীলোকটি বলল, “ইয়ে মকান দেখো। একদম নয়া। এক মাহিনী কা কিরায়া ষাট রুপিয়া লাগেগা। পসন্দ হো তো লে লো।”

পায়েলদি বলল, “এই ঘরের ভাড়া ষাট টাকা?”

“জায়দা নেহি দিদি। ঘর তো এখানে পাওয়াই যায় না।”

পায়েলদি বলল, “তা ছাড়া আমরা তো এক মাস থাকছি না। খুব জোর দু’চার দিন থাকব।”

“তব ভি ষাট রুপিয়া লাগে গা। ঔর হামারা বকশিশ দশ রুপাইয়া।”

পায়েলদি বলল, “এ বাড়ি কার?”

“আমার আছে। ঔর উয়ো আদমি মেরা পতি।”

“তবে? বাড়ি যখন তোমার, আর আমরা যখন তোমার সঙ্গেই এসেছি তখন বকশিশ কেন দেব?”

“বকশিশ হামকো দেনেই পড়েগা দিদিমণি। মকানকা কিরায়া তো মেরা পতি লে লেঙ্গে। লেকিন বকশিশ কা রুপিয়া হমে মিলনা চাইয়ে।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা আচ্ছা, হবে।” বলে দশটা টাকা বার করে তার হাতে দিল।

পায়েলদি বলল, “এই ঘরই নেবে তা হলে?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ। এ ছাড়া উপায় নেই পায়েলদি। দেখলেন তো এখানে ঘরের অবস্থা? তা ছাড়া একেবারে পাহাড়ের কোলে বাড়িটা। এমন পরিবেশ পাব কোথায়?”

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু ততক্ষণে মালপত্তর ওঠাতে শুরু করেছে। আর পঞ্চু? সে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে দুরের প্রকৃতির দিকে। ঘরে মালপত্তর রেখে বাড়ির পিছন দিকের কুয়োয় স্নান সেরে বাবলুরা হোটেলে খেয়ে এল। তারপর দুপুরবেলা দরজা বন্ধ করে ঘুম দিল সকলে।

ঘুম যখন ভাঙল তখন বেলা গড়িয়ে গেছে।

ওরা বেড়াতে যাবার জন্য তৈরি হয়ে ঘরে চাবি দিয়ে নীচে এল। খুব ছোট্ট জায়গা মোসাবনী। পাহাড়ের ওপর সাজানো শহর। একদিকে কপার মাইনস, দোকান পসার, মানুষের বসতি এবং অপরদিকে দুর বিস্তৃত পাহাড়ের পাঁচিল।

ওরা বাজারে ঘুরতে ঘুরতেই সন্ধে হয়ে এল। এমন সময় হঠাৎ বাবলুর নজর পড়ল একজনের ওপর। শান্ত সৌম্য এক প্রবীণ ভদ্রলোক একদৃষ্টে চেয়ে আছেন ওদের দিকে। বাবলু ভদ্রলোকের কাছে এগিয়ে গিয়ে বলল, “আপনি কি বাঙালি?”

ভদ্রলোক হেসে বললেন, “হ্যাঁ।”

“আমরা এই নতুন জায়গায় বেড়াতে এসেছি। এখানে কোথায় কী দেখার আছে বলুন তো?”

ভদ্রলোক বললেন, “এখানে দেখার মতো কিছুই তো নেই বাবা। যা আছে তা হল ওই কপার মাইনস। তাও ভেতরে ঢুকতে গেলে আগে থেকে অনুমতি নিতে হয়। এ ছাড়া দেখার মতো যা আছে তা হল এখানকার অপূর্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু তোমরা উঠেছ কোথায়?”

“কাছেই। ওই পাহাড়ের গায়ে যে ধোবিখানাটা আছে, তার ওপরে।”

“বাঃ বাঃ, বেশ। ক’দিন থাকবে?”

“এই ধরুন হস্তাখানেক।”

“খুব ভাল কথা। ক’জন আছ তোমরা?”

“আমরা পাঁচজন, এই কুকুর এবং আমাদের ওই দিদি।”

ভদ্রলোক পায়েলদির কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, “তা মা-মণি তোমরা যখন মোসাবনীতে বেড়াতেই এসেছ তখন এই বুড়ো ছেলের বাড়িতে গিয়ে একটু চা-টা খেয়ে এলেই তো পার। অবশ্য যদি তোমাদের কোনও আপত্তি না থাকে।”

পায়েলদি বলল, “না না আপত্তির কী আছে? আজ আমরা বড্ড টায়ার্ড। কাল সকালে বরং যাব।”

“আবার সকালে কেন? এখনই এসো না। তা ছাড়া শীতটাও বেশ জাকিয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় বাইরে ঘুরলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।”

বাবলু বলল, “তবে চলো পায়েলদি, উনি যখন বলছেন এত করে তখন ওনার বাড়িতেই যাওয়া যাক।”

পায়েলদি বলল, “তুমি যেতে চাইলে আমার কোনও আপত্তি নেই।”

ভদ্রলোক বললেন, “এসো তবে।”

ওরা ভদ্রলোকের সঙ্গে বাজারের পিছন দিকে একটি সুসজ্জিত বাংলোর মধ্যে ঢুকল। কী চমৎকার বাড়িটা! দেখলে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়।

ভদ্রলোক ওদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বড় একটা ঘরের মধ্যে বসালেন। তারপর ডাকলেন, “বেচারাম! এই বেচারাম!”

একটি অল্পবয়সি চাকর ঘরে ঢুকল। ভদ্রলোক বললেন, “তুই এক কাজ কর বেচা এখনই কিছু কেক আর কফির ব্যবস্থা কর। তারপর বড় মুরগি দুটো কাট। গরম ভাত আর মুরগির মাংস বানা। এরা আজ আমাদের অতিথি। এখানে খাবে। যা তাড়াতাড়ি কর।”

পায়েলদি বলল, “না না। ও কী করছেন? শুধু একটু কফি খাওয়ান। আবার মাংস-ভাত কেন?”

ভদ্রলোক বললেন, “আমার মেয়ে নেই মা। একা থাকি। শুধু মেয়ে কেন, কেউ নেই আমার আছে শুধু বেচারাম। কাজেই আজ আমার বাড়িতে তোমাদের দুটি মাংস-ভাত খাইয়ে আমি যদি সুখী হই তাতে তুমি কেন আপত্তি করছ?”

“বেশ। আজ রাতের খাওয়াটা এখানেই হোক আমাদের। তবে শুধু বেচারাম নয়, আমরাও হাত লাগাব।”

ভদ্রলোক বললেন, “সে তো খুব ভাল কথা।”

বাবলু বলল, “খাটাখাটনির ব্যাপারে আমি কিন্তু বাদ। অত্যন্ত টায়ার্ড আমি। আমি বরং বসে বসে গল্প করি।”

ভদ্রলোক বললেন, “তবে চলো, আমরা দুজনে ওপরে যাই। বেচারাম, তুই ওপরের ঘরে গিয়ে আমাদের কফি আর কেক দিয়ে আসবি।”

পায়েলদি বলল, “সেই ভাল। আপনারা ওপরে যান।”

ভদ্রলোক বাবলুকে নিয়ে ওপরে গেলেন। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে ভদ্রলোক বললেন, “তোমার অভিনয় অপূর্ব হয়েছে বাবলু। তুমি যে এত সাবধানী তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার মন বলছে তোমার দ্বারাই কাজ হবে।”

বাবলু বলল, “আমার দলের ছেলেমেয়েরাও ব্যাপারটা এখনও বুঝতে পারেনি। আমরা কী জন্যে এখানে এসেছি তা ওরা জানে। শুধু পায়েলদি ছাড়া। তবে আপনিই যে রুদ্রনারায়ণবাবু তা ওরা বুঝতে পারেনি। অবশ্য আজ রাতেই সবাইকে আমি জানিয়ে দেব। এবং কাল সকাল থেকেই আমাদের এক্সপিডিশন শুরু হবে।”

ওপরে উঠে ঘরে ঢুকে মুখোমুখি দুটো চেয়ারে বসল দু’জনে।

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “একটু পরেই কফি এলে খেতে খেতে কথা হবে, কেমন?”

বাবলু বলল, “আচ্ছা। বলে ঘরের ভেতর ঘুরে-ফিরে এটা-সেটা দেখতে লাগল। দেওয়ালের ছবি দেখল। সব দেখে মনে হল যেন কোনও শিল্পীর ঘর এটা।”

এমন সময় কফি এল। কেক এল। বেচারাম এসে দিয়ে গেল সেগুলো।

কফি খেতে খেতে রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “তোমরা যেখানে উঠেছ তার পাশেই একটা পাহাড় আছে দেখেছ?”

“হ্যাঁ।”

“ওই পাহাড়টার নাম জিলিং ডুংরি। কেউ কেউ বলে ধাবনি। পাহাড়টি একদিকে যেমন এখানকার পাঁচিলের কাজ করছে, অপরদিকে ওপারের জগতের সঙ্গে এটিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। ওই পাহাড়টা ডিঙোলেই দেখবে চারদিকে শুধু বন-জঙ্গল আর পাহাড়ের পর পাহাড়। ওই জঙ্গলেই কোনও এক গুপ্তস্থানে মঙ্গল সিং-এর ঘাঁটি। যেখানে আমার একমাত্র নাতিকে ওরা বন্দি করে রেখেছে। এবং যেখানে পদব্রজে ছাড়া কোনও যানবাহন নিয়ে কেউ যেতে পারে না।”

“কারণ?”

“রাস্তা নেই। তা ছাড়া ডাকাতের ভয়ে এমনিও কেউ যায় না। কাজেই বুঝতে পারছ তো? তবে তোমরা ছেলেমানুষ। তোমরা গেলে কেউ সন্দেহ করবে না। কিন্তু খুব সাবধান। তোমাদের ওই দিদিটিকে নিয়ে যেন ভুলেও ওখানে যেয়ো না। মেয়েদের পক্ষে ও জায়গা নিরাপদ নয়।”

বাবলু বলল, “কাল সকালেই আমি দলবল নিয়ে ঢুকে পড়ছি ওর ভেতর। ইতিমধ্যে মঙ্গল সিং-এর আর কোনও নির্দেশ পেয়েছেন। আপনি?”

“না।”

রুদ্রনারায়ণবাবুর বড় দেওয়াল ঘড়িতে তখন ঢং-ঢং করে আটটা বাজল।

সে রাতে দমভর খাওয়া-দাওয়া হল রুদ্রনারায়ণবাবুর বাড়িতে। তারপর রাত বারোটার সময় সেই কনকনে শীতে বাবলুরা ফিরে এল নিজেদের ডেরায়।

ভোরবেলা ঘুম যখন ভাঙল, চারদিক তখন ঘন কুয়াশায় ঢাকা। বাবলুরা ঘুম থেকে উঠে মুখ-হাত ধুয়ে গরম জামা-প্যান্ট পরে বেরোবার জন্যে তৈরি হল।

শীতটা আজও বেশ জাকিয়ে পড়েছে।

পায়েলদি বলল, “এত সকালে কোথায় যাবে?”

বাবলু বলল, “এই একটু মর্নিং ওয়াক করতে।”

“এই ঠান্ডায়?”

“মর্নিং ওয়াক তো ঠান্ডাতেই করতে হয়।”

“তোমরা যাও। আমি বেরোচ্ছি না।”

বিলু বলল, “না না। আপনি বরং আর একটু গড়িয়ে নিন। রোদ উঠলেই আমরা ফিরে আসব। তারপর চা-টা খেয়ে একসঙ্গে ঘুরব সবাই।”

এবারের অভিযানে এখনও পর্যন্ত পঞ্চুর কোনও বিশেষ ভূমিকা ছিল না। ও বেচারা একেবারে চুপচাপ আছে তাই। এবারে ও যেন একটু অন্য খেয়ালেই আছে। কেন না, বাবলুদের তৈরি হতে দেখেও ও যাবার জন্যে ব্যস্ততা দেখাল না। শুধু লেজ গুটিয়ে শুয়ে শুয়ে পিটপিট করে তাকাতে লাগল।

বাবলু বলল, “কী রে পঞ্চু যাবি নাকি আমাদের সঙ্গে?”

বাবলুর কথায় পঞ্চু উঠে দাঁড়িয়ে একবার গা ঝাড়া দিয়ে পায়েলদির কোলের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়ল। তারপর একটু একটু করে কম্বলের ভেতর ঢুকিয়ে নিল নিজেকে।

বাবলু বলল, “আসলে পায়েলদিকে ওর খুব ভাল লেগে গেছে। তাই ছেড়ে যেতে চাইছে না।”

বিলু বলল, “অথবা এমনও হতে পারে, আমরা সবাই চলে যাচ্ছি দেখে পায়েলদিকে পাহারা দেবার জন্য রয়ে গেল ও?”

বাবলু বলল, “ঠিক। ঠিক বলেছিস তুই।”

যাই হোক, বাবলুরা প্রত্যেকে বুট জুতো ফুল প্যান্ট আর কালো ওভারকোট পরে বেরোল। তার ওপর মাথায় পরল কম্যান্ডারের মতন হ্যাট। এই পোশাকে বাচ্চু-বিচ্ছুকেও আর মেয়ে বলে মনে হল না।

ওরা বাইরে বেরিয়ে সোজা চলল জিলিং ডুংরির দিকে। চারদিকের কুয়াশা ভেদ করে ওরা যখন গাছপালার ডাল ধরে খাড়াই পাহাড়ের ওপরে উঠতে লাগল তখন খুবই আনন্দ হল ওদের।

এই মনোরম পরিবেশে এমন একটা অভিযান করতে পেরে ওরা ধন্য মনে করল নিজেদের। মিনিট দশেকের মধ্যেই পাহাড়ের ওপরে উঠে পড়ল ওরা। কিন্তু এই ভোরে এত কষ্ট করে ওঠাটাই সার হল। ওপারের দৃশ্য যা দেখল, তা ধুধু কুয়াশার সমুদ্র ছাড়া আর কিছুই নয়।

বাবলু বলল, “চল, ফেরা যাক। এভাবে সময় নষ্ট করে লাভ হবে না। বরং রোদ উঠলে কুয়াশা কাটলে বেলায় এসে দেখা যাবে।”

বিলু বলল, “তা না হয় যাবে। কিন্তু একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না। কাল যে ভদ্রলোক আমাদের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেলেন, অত করে খাওয়ালেন, তিনি কে?”

এমন সময় সেই ঘন কুয়াশার ভেতর থেকে ভরাট গলায় কে যেন বলে উঠল, “উনি রুদ্রনারায়ণ রায়।”

বাবলুরা এই অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল সকলে। বাবলু বলল, “কে আপনি?”

কুয়াশার ভেতর থেকে আবার উত্তর এল, “কে আমি? এই আমি কে’র উত্তর আজ পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি বাবা।”

বিলু বলল, “আপনি যেভাবে বাংলায় কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনি বাঙালি। কুয়াশার জন্য আমরা আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না। আপনি আমাদের সামনে আসুন।”

“কুয়াশা কেটে গেলেই তোমরা আমাকে দেখতে পাবে। তবে সাবধান। পাহাড় ডিঙিয়ে ওপারে যাবার চেষ্টা কোরো না। ওপারে বিপদ তোমাদের জন্য ওঁত পেতে আছে।”

বাবলু বলল, “তা হলে জেনে রাখুন, আমরা পাণ্ডব গোয়েন্দা। বিপদ যেখানে ওঁত পেতে থাকে, আমরাও সেখানে বিপদের মোকাবিলা করবার জন্য ঘাপটি মেরে থাকি। আপনার সাহস থাকে, আপনি আমাদের সামনে আসুন।”

এবার একটু দূর থেকে কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল, “তোমরা নিতান্তই দুগ্ধপোষ্য বালক।”

বাবলু বলল, “এর দ্বারা এই প্রমাণ হল যে আপনিই ভয়ে পিছু হটলেন।” বলে পাহাড় থেকে নেমে এল সকলে।

নেমে এসে ওরা দেখল, এক জায়গায় কতকগুলো লোক গোল হয়ে বসে আগুন পোয়াচ্ছে। তারই একপাশে চা তৈরি হচ্ছে এবং অপর পাশে গরম জিলিপি।

যেই না দেখা, ভোম্বলের তো নোলা অমনি ছোঁক-ছোঁকিয়ে উঠল। জিভ দিয়ে একটা শব্দ করে বাবলুর দিকে তাকাতেই বাবলু বলল, “বুঝেছি। লোভ আমাদেরও হচ্ছে তা রসনার নিবৃত্তির জন্য ওগুলোর সদগতি নিশ্চয়ই করা হবে।”

যে লোকগুলো আগুন পোহাচ্ছিল তারা অবাক চোখে চেয়ে রইল বাবলুদের দিকে। বাবলু বলল, “কী ব্যাপার, তোমরা অমন করে তাকিয়ে আছ কেন?”

লোকগুলো বিহারি এবং দেহাতি। অন্তত তাদের চেহারা দেখে তাই মনে হল। বাংলা কথা কেউ বুঝল, কেউ বুঝল না।

একজন শুধু বলল, “তুম সব উধার কাহা গিয়া থা?”

বাবলু বলল, “আমরা পাহাড়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কিন্তু কুয়াশার জন্য কিছু দেখতে পেলাম না।”

“উধার মাৎ যাও খোকাবাবু।”

“কেন?”

“ও খুব খারাপ জায়গা আছে”

আর একজন বলল, “কাহা সে আয়া হ্যায় তুম সব?”

“হাওড়া থেকে এসেছি। ঘাটশিলা হয়ে মোসাবনীতে। কপার মাইনস দেখব বলে।”

“তো ঠিক হ্যায়। যাহা মর্জি হুয়া যাও। সব কুছ দেখো। লেকিন উধার মাৎ যাও।”

বিলু বলল, “কেন, ওদিকে যাব না কেন?”

“উধার ডাকুকা রাজ হ্যায়।”

“ডাকুক রাজ?”

“ডাকু মঙ্গল সিং কা।”

ভোম্বল বলল, “ডাকু মঙ্গল সিং-এর রাজত্ব তো কী হয়েছে? আমরা তো ছোট ছেলে ও ডাকু কি আমাদের সঙ্গে লড়াই করে ওর বীরত্ব দেখাবে?”

“নেহি খোকাবাবু ও ডাকু যে আছে উয়ো বহুৎ বদমাশ। ওর প্রাণে কোনও মায়া-মমতা নেই।”

বাবলু বলল, “না থাকুক। তাতে আমাদের কী? আমরা ও সবে ভয় করি না।”

এমন সময় ঘন কুয়াশা ভেদ করে পূর্বকাশে সূর্য উঠতে দেখা গেল। বাবলুরা চা আর জিলিপি খেয়ে পায়েলদির জন্যও কিছু জিলিপি কিনে ঘরের দিকে চলল। পায়েলদি নিশ্চয়ই খুশি হবেন গরম জিলিপি দেখে। এই কনকনে শীতে এর চেয়ে লোভনীয় আর কী আছে?

ওদের আসার অপেক্ষায় পঞ্চু পথ পানে চেয়ে উদ্‌গ্ৰীব হয়ে বসেছিল। এখন ওদের দেখতে পেয়েই ডেকে উঠল ভৌ ভৌ করে।

বাবলুরা ফিরে এসে দেখল পায়েলদি বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পোশাক পালটে বসে আছে। আর দরজার কাছে বসে আছে সেই জিপসিদের মতো দেখতে স্ত্রীলোকটি। অর্থাৎ বাড়িওয়ালি।

ওরা যেতে পায়েলদি বলল, “এই, তোমরা সব কোথায় গিয়েছিলে? হিমি বলছে তোমরা নাকি ওই পাহাড়ে উঠেছিলে?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ, উঠেছিলাম। তাতে কী হয়েছে?”

হিমি বলল, “উধার যানা মানা হ্যায় খোকাবাবু। উধার মাৎ যানা।”

বাবলু বলল, “কেন, ওধারে কি বাঘ না ভালুক আছে?”

“উধার ডাকু হ্যায়। একদম মার ডালে গা।”

“কেন তোমাদের এখানে পুলিশ নেই? ধরতে পারে না ওই ডাকাতটাকে।”

“পুলিশ ক্যা করে গা? বহুৎ তালাশ লাগায়া উসকো। লেকিন আভি তক পাকড়নে নেহি সকা।”

“কেন?”

“হুয়া পর জিপ-ট্রাক যানে কো কোঈ রাস্তা নেহি হ্যায়। ইসি লিয়ে পয়দাল যায়েগা তো জঙ্গল কা অন্দর সে ডাকু লোক অচানক গোলি চালায়গা। চম্বলকা এক ডাকু হুয়া পর আয়া। উস জঙ্গল মে। ডাকু মঙ্গল সিং।”

“ডাকু মঙ্গল সিং-এর সঙ্গে পুলিশের বিবাদ থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে কী? আমরা দুদিনের জন্যে এসেছি। ঘুরে বেড়িয়ে আনন্দ করে চলে যাব। তুমি যাও। আমরা আবার বেরব।”

হিমি বলল, “নেহি খোকাবাবু। মেরা বাত শুনো। মাৎ যাও উধার। কুছ দিন পহলে হিয়াক এক লেড়কা কো ভাগাকে লে গিয়া ও ডাকু লোক।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার কথা মনে থাকবে আমাদের।”

হিমি চলে গেল। পায়েলদি বলল, “কী দরকার ভাই ওদিকে যাবার? তার চেয়ে চলো আজ বরং আমার মোটরটা নিয়ে ঘাটশিলা থেকে ঘুরে আসি।”

বাবলু বলল, “না। আমরা এখনই ওই পাহাড় ডিঙিয়ে ডাকু মঙ্গল সিং-এর ঘাটির দিকে যাব।”

“সে কী!”

“হ্যাঁ। ওদিকে একটা জঙ্গল আছে। গভীর জঙ্গল। সেই জঙ্গলে আমরা পাখি শিকার করে আজ দুপুরে পিকনিক করব। আমরা যে চার চাকার গাড়িটা এনেছি, তাইতে পিকনিকের সরঞ্জাম চাপিয়ে চলুন এখনই রওনা হয়ে পড়ি।”

পায়েলদি বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল বাবলুর দিকে।

বাবলু চাপা গলায় বলল, “দেখছেন কী? আপনার বন্দুকটাও সঙ্গে নেবেন।”

“অত বিপদ জেনেও যাবে?”

“আপনার কোনও ভয় নেই পায়েলদি। চলুন তো! মরি মরব। আপনার হাতে বন্দুক আছে, আমাদের সঙ্গে পঞ্চু আছে। এর পরেও ভয় কী?”

পায়েলদি একটুক্ষণ কী যেন ভেবে হঠাৎ আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে বলল, “ঠিক বলেছ ভয় কী? চলো তো দেখি কত বড় ডাকাত সে।”

ওরা সঙ্গে সঙ্গে সেই কাঠের গাড়িতে মাল বোঝাই করে ঘরে চাবি দিয়ে নীচে নেমে এল। তারপর আবার চলতে লাগল পাহাড়ের দিকে।

যাবার সময় কিছু কলা আর পাউরুটি কিনে নিল ওরা। তারপর পাহাড়ের দিকে এগিয়ে প্রথমেই পাহাড়ের ঢালের গায়ে বস্তিগুলো ঘুরে নিল। পরে পাহাড়ের গা বেয়ে ওপরে উঠে প্রশস্ত চাতালের ওপর হাত পা ছড়িয়ে বসল। কাঠের গাড়িটাকে টেনে টেনে পাহাড়ের মাথায় ওঠাতে অবশ্য খুবই কষ্ট হয়েছিল ওদের।

পাহাড়ের মাথায় উঠে বাবলু পঞ্চুর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “তা হলে পঞ্চু, তোর ভরসাতেই আমরা কিন্তু যাচ্ছি ওখনে। বিপদ যদি সামনে এসে দাঁড়ায় তুইও তা হলে রুখে দাঁড়াবি তো?”

বাবলুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চ জোরে একটা লাফ দিয়ে ডেকে উঠল, “ভৌ-ভৌ-ভৌ— উ-উ-উ ।”

বাবলু বলল, “সাব্বাশ।”

ভোম্বলের আনা টেলিস্কোপটা সঙ্গেই ছিল। পাহাড়ের ওপর থেকে বাবলু সেটায় চোখ লাগিয়ে চারদিক দেখল। না। শুধু জঙ্গল, টিলা ও পাহাড় ছাড়া আর কিছুই নজরে পড়ল না ওর।

ওরা যখন পাহাড়ের ওপর থেকে ওপারের জঙ্গলে নামল তখন দেখল একটি বড় গাছের নীচে ঝোপড়ি বানিয়ে এক সাধুবাবা ধুনি জ্বালিয়ে বসে আছেন।

বাবলুরা সাধুর কাছেই গেল প্রথমে। পায়েলদি সাধুকে প্রণাম করতে যেতেই সাধুবাবা হা হা করে উঠলেন, “আমি কারও প্রণাম নিই না মা।”

বাবলু বলল, “আপনি কি এখানে একলা থাকেন?”

সাধুবাবা হেসে বললেন, “আমি সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী। আমার একা থাকা ছাড়া উপায় কী?”

বিলু বলল, “আপনি এখানে কতদিন আছেন?”

“দিন দুই হল এসেছি।”

পায়েলদি বলল, “ডাকাত মঙ্গল সিং-কে দেখেছেন আপনি?”

সাধুবাবা হাসলেন। বললেন, “না। তবে শুনেছি সে নাকি খুব খারাপ লোক। কিন্তু তোমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছ?”

বাবলু বলল, “আমরা পিকনিকে যাচ্ছি। পাখি শিকার করে পিকনিক করব।”

সাধুবাবা বললেন, “ভোরবেলা কোনও অলৌকিক কণ্ঠস্বর তোমাদের ওখানে যেতে মানা করেনি।”

বাবলু বলল, “করেছিল। তার কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আপনার গলার হুবহু মিল আছে। আপনিই কি—?”

“হয়তো আমিই। আমি আবার বারণ করছি ওখানে না যেতে। গেলে বিপদ হবে।” বলে সাধুবাবা তার ঝোপড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন।

বাবলুরা এগিয়ে চলল। পায়েলদি, বাবলু, বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছু এবং পঞ্চু। সঙ্গে পিকনিকের সরঞ্জাম ভর্তি সেই চার-চাকার গাড়িটা। যেতে যেতে এক সময় ওরা এক গভীর বনের ভেতর প্রবেশ করল।

এখানে চারদিকে শুধু পাহাড় আর জঙ্গল। এক জায়গায় বনের ভেতর একটু ফাকা ও প্রশস্ত স্থান দেখে ওরা পিকনিক স্পট তৈরি করল। একটা শতরঞ্জি বিছিয়ে তাইতে বসে ওরা শুরু করল ওদের ব্রেক ফাস্ট।

খেতে খেতে পায়েলদি বলল, “ভোরবেলা ওই সাধুর সঙ্গে তোমাদের দেখা হয়েছিল?”

বাবলু বলল, “হ্যাঁ। ঘন কুয়াশায় সাধুকে তখন দেখতে পাইনি। তবে কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেয়েছিলাম।”

বিলু বলল, “সাধুটা খুব রহস্যময়।”

ভোম্বল বলল, “ওই সাধু মঙ্গল সিং-এর চর নয় তো?”

বাচ্চু বলল, “হতে পারে। আমার দৃঢ় ধারণা তাই।”

বিচ্ছু বলল, “হয়তো ওই সাধু নিজেই মঙ্গল সিং।”

বাবলু বলল, “সে যাই হোক। আমারও মনে হচ্ছে ওই সাধু আসল সাধু নয়। মঙ্গল সিং-এর সঙ্গে নিশ্চয়ই এর কোনও যোগাযোগ আছে।”

বিলু বলল, “তা থাকতে পারে। যদি থাকে তাতেও আমাদের কোনও লোকসান নেই। কেন না আমরা যে কী উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছি, সে কথা তো বলেই দিয়েছি সাধুকে। কাজেই আমরা যে এখানে মঙ্গল সিং-এর খোঁজে আসিনি তা…।”

এমন সময় বাবলু হিসস করে চুপ করাল বিলুকে।

সবাই বলল, “কী হল?”

“কিছু না। ওই সব আলোচনা বোকার মতো এখানে করে কেউ? তার চেয়ে আমরা আমাদের কাজে লেগে পড়ি আয়। এখন রান্না খাওয়ার ব্যবস্থা হোক আগে।”

পায়েলদি বলল, “সেই ভাল। তোমরা সকলে কাঠ-কুটো জোগাড় করো। পাথর জড়ো করে উনুন সাজাও। বাবলু আর আমি ঘুরে দেখি কোনও পাখি-টাখি মারতে পারি কিনা?” এই বলে ওরা দু’জনে পঞ্চুকে নিয়ে পাখি শিকারের জন্য আরও গভীর জঙ্গলের দিকে এগিয়ে চলল।

এক জায়গায় গিয়ে ওরা দেখল, পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট্ট একটি ঝরনা নেমে এসেছে সেখানে। পায়েলদি বলল, “এই ঝরনার জলেই আমাদের রান্না-বান্না হয়ে যাবে।”

তারপর ওরা দেখল, সেই ঝরনার জল এক জায়গায় অনেক নীচে পাথরের খাজে খাজে জমা হচ্ছে। সেখানে কত বক, মাছরাঙা, আর ডাকপাখি, ছোট মাছ ও পোকা-মাকড়ের লোভে ঘুরছে। পায়েলদি সেই বক লক্ষ করে গুলি করতেই একটা সাদা বক মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। যেই না পড়া, পঞ্চু অমনি ছুটে গিয়ে মুখে করে নিয়ে এল সেটাকে। পক্ষী সমাজেও তখন এক মহা সোরগোল পড়ে গেল। তাদের আর্ত কলরবে ভরে উঠল আকাশ বাতাস। তারা উড়ে পড়ে ওইখানেই ঝাঁকে ঝাঁকে চক্রাকারে ঘুরপাক খেতে লাগল।

ততক্ষণে পায়েলদির বন্দুক আরও তিনবার গর্জে উঠেছে। ওরা আনন্দে সেই জলার ধারে গিয়ে তিনটি বক ও একটি ডাকপাখিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় পেয়ে গেল। বাবলু বলল, “এতেই হবে। আর দরকার নেই।”

পায়েলদি বলল, “তা হলে এক কাজ করো, আমি এইখানে ঝরনার ধারে একটু বসি। আর তুমি ওগুলো ওদের কাছে পৌছে দিয়ে হাড়ি আর ডেকচিটা নিয়ে এসো। একেবারে রান্নার জন্য জল ভরে নিয়ে যাব।”

বাবলু বক তিনটি হাতে নিতেই পঞ্চু ডাকপাখিটা মুখে নিয়ে বাবলুর আগে আগে বিলুদের কাছে ছুটে চলল।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু-বিচ্ছু তো শিকার পেয়ে খুব খুশি।

বাবলু বলল, “ভোম্বল, তুই এগুলো ছাড়াতে লেগে যা। আমি হাঁড়ি আর ডেকচি ভর্তি করে জল আনি।”

বিলু বলল, “সত্যিই তো। রান্না চাপাতে যাচ্ছি অথচ জলের কথা ভাবিনি।”

বাবলু বলল, “জলের ব্যবস্থা হয়ে গেছে! সুন্দর একটা ঝরনা রয়েছে এখানে। খুব সরু। তবে পরিষ্কার জল। সেই জলেই রান্না খাওয়া হবে।”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “আমরা তোমার সঙ্গে যাব বাবলুদা। ঝরনা দেখতে খুব ভাল লাগে আমাদের।”

বাবলু বলল, “বেশ তো, আয়।”

পঞ্চুর আনন্দ দেখে কে। সে লাফিয়ে নেচে ডিগবাজি খেয়ে সবার আগে আগে চলল। কিন্তু ঝরনার কাছে আসতেই বুকের ভেতরটা ঢিপ করে উঠল ওদের। ওরা সেখানে গিয়ে যা দেখল তা যেমনই অপ্রত্যাশিত তেমনই রোমহর্ষক। পায়েলদির বন্দুকটা ভেঙে দু টুকরো হয়ে পড়ে আছে সেখানে। কিন্তু পায়েলদির কোনও অস্তিত্বই নেই।

বাবলু বুঝল মারাত্মক অঘটন ঘটে গেছে। পায়েলদির না থাকাটা ভয়ের ব্যাপার বলে মনে হত না, যদি না বন্দুকটা ভাঙা অবস্থায় পড়ে থাকত। না হলে ভাবা যেত পায়েলদি কাছে-পিঠেই কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু ওই ভাঙা বন্দুকটাই জানিয়ে দিচ্ছে সে ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। নিশ্চয়ই কেউ জোর করে অপহরণ করেছে পায়েলদিকে। এবং সে কাজটা যে আর কেউ নয় ডাকাত মঙ্গল সিংই করেছে তাতে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

বাবলু তবুও চেঁচিয়ে ডাকল, “পা-য়ে-ল-দি…।”

পঞ্চুও ভাঙা বন্দুকটার কাছে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “ভৌ-ভৌ-ভৌ–উ-উ-উ।”

কিন্তু কে দেবে সাড়া? কেউ কোথাও নেই। বাবলুর ডাক, পঞ্চুর ডাক পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরল। পায়েলদির সাড়া শব্দও পাওয়া গেল না।

বাচ্চু-বিচ্ছুও বলল, “কী হবে বাবলুদা?”

বাবলু দু হাতে মাথার চুলগুলো মুঠো করে বলল, “কী আর হবে? চরম সর্বনাশ যা হবার তা তো হয়েই গেল। উঃ, কী বোকামিই না করেছি। কেন যে পায়েলদিকে এখানে একা রেখে গেলাম। পায়েলদির এই দুঃসংবাদটা তার বাবা মায়ের কাছে আমরা কী করে পৌছে দেব?”

বাচ্চু-বিচ্ছু বলল, “পায়েলদিকে উদ্ধার না করে আমরা কিছুতেই ফিরব না।”

বাবলু বলল, “তার আগে তোদের নিয়ে জঙ্গল থেকে বেরোতে পারলে বাঁচি।”

বাবলু, বাচ্চু আর বিচ্ছু পায়েলদির সেই ভাঙা বন্দুকটা কুড়িয়ে নিয়ে একবার হাতে করে দেখল। ততক্ষণে বিলু, ভোম্বলও ছুটে এসেছে, “কী হয়েছে রে বাবলু? পায়েলদি কই? তুই চিৎকার করে পায়েলদিকে ডাকলি কেন? পঞ্চু কেন চেঁচাল। তোদের ডাক শুনেই ছুটে এলাম আমরা। কী হয়েছে পায়েলদির?”

“পায়েলদি নেই।”

“তার মানে?”

“ডাকাতরা তুলে নিয়ে গেছে পায়েলদিকে।”

ভোম্বল বলল, “বাবলু, গতিক সুবিধের নয়। পালিয়ে চল।”

বিলু বলল, “এখুনি? একটু অপেক্ষা করলে হত না? যদি আমাদের ধারণা ভুলই হয়?”

বাবলু বলল, “আমাদের ধারণা ভুল নয় বিলু। ওই দেখ।”

ওরা দেখল জঙ্গলের ভেতর থেকে পঞ্চু পায়েলদির এক পাটি জুতো মুখে নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছে। ওরা সেই জুতোটা দেখেই নিঃসন্দেহ হল যে পায়েলদি সত্যই অপহৃত হয়েছে।

পঞ্চু জুতোটা বাবলুর হাতে দিয়ে আবার ছুটে গেল বনের ভেতর। তারপর ক্রমাগত চিৎকার করতে লাগল।

ওরা পঞ্চুর চিৎকার অনুসরণ করে সেখানে যেতেই দেখতে পেল গুলিবিদ্ধ অবস্থায় একটা ভয়ংকর চেহারার ডাকাত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে মাটিতে। নিম্প্রাণ দেহ। একটু আগেই কেউ যেন গুলি করে মেরেছে তাকে। কিন্তু এই জঙ্গলে কে ওকে মারল? আর গুলির শব্দই বা ওরা শুনতে পেল না কেন? যাই হোক ওরা আর দাঁড়াল না সেখানে।

তাড়াতাড়ি স্পটে এসে সব কিছু গুছিয়ে-গাছিয়ে নিয়ে আবার জিলিং ডুংরির দিকে ফিরে চলল ওরা।

বিলু বলল, “কী সর্বনাশ হল বল তো? আর কি আমরা পায়েলদিকে ফিরে পাব?”

বাবলু বলল, “আমার মাথা খারাপ হয়ে আসছে। কোনওরকমে আগে বাচ্চু-বিচ্ছুকে এখান থেকে পাচার করতে পারলে বাঁচি।”

ওরা হনহনিয়ে এগিয়ে চলল। বিপদসীমা পার হয়ে সাধুর আস্তানার কাছে ফিরে এসে ওরা দেখল কোথায় সাধু, কোথায় কে? সব ভোঁ ভোঁ। ঝোপড়িটাও ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।

বাবলু বলল, “উঃ। শয়তানটাকে চিনেও আমরা চিনতে পারলাম না।” ওরা পাহাড় টপকে মোসাবনীতে এল।

বাবলুরা ফিরে আসতেই হিমি ছুটে এল। তারপর ওদের মুখের অবস্থা দেখে কিছু একটা অনুমান করেই বুঝি জিজ্ঞেস করল ‘কী খোকাবাবু? দিদিমণি কাহা হ্যায়?”

বাবলু ছলছল চোখে বলল, “মুশকিল হয়ে গেছে হিমি বহিন। দিদিমণিকে ডাকুতে নিয়ে গেছে।”

“হেই রাম।” বলে শিউড়ে গালে গাত দিল হিমি,“তাঁহাসে?”

বাবলু নতমুখে বলল, “পাহাড়ের ওপারে ওই জঙ্গল থেকে।”

“হায় হায় রে। হাম বহুৎ দফে মানা কিয়া না? তব ভি তুম সব হুয়া গয়ে থে?”

বাবলু আর কথাই বলল না। হিমির চেঁচামেচিতে বহু লোক জড়ো হয়ে গেছে সেখানে। বাবলুরা ঘরের ভেতর মালপত্তর রেখে দরজায় শিকল দিয়ে নেমে এল। তারপর সবাই মিলে দল বেঁধে চলল রুদ্রনারায়ণবাবুর বাড়ির দিকে।

বাবলুর মুখে সব শুনে রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “আমি তোমাকে বার বার বারণ করেছিলাম দিদিকে নিয়ে ওই জঙ্গলে না ঢুকতে? কেন গেলে? কী সর্বনাশ ঘটালে বলো দেখি?”

বাবলু বলল, “আমি এখন প্রকৃতিস্থ নই রুদ্রনারায়ণবাবু! আপনি বেচাকে বলুন আমাদের জন্যে যা হোক দুটি রেঁধে দিতে। আজ রাত্রেই আমরা জঙ্গল তোলপাড় করব।”

“না বাবলু। আজ রাত্রে তোমরা বিশ্রাম নাও। কাল সকাল হলে কলকাতায় ফিরে যাও। নিজের গোঁয়ে কাজ করতে গিয়ে সব ভণ্ডুল করে দিলে তুমি। এ কাজ আর তোমাদের দ্বারা সম্ভব নয়।”

বাবলুর মুখ লাল হয়ে উঠল। বলল, “আপনি আমাদের চেনেন না বলেই এই কথা বললেন। ফিরে যাবার জন্যে আমরা আসিনি।”

“কিন্তু রাত্রিবেলা তোমরা ওই জঙ্গলে যাবে কী করে? সাপখোপের ভয় আছে। বুনো জন্তুর ভয় আছে।”

“সে আমরা বুঝব।”

“তা ছাড়া মঙ্গল সিংও এখন জেনে গেছে তোমরা কি উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে এসেছ।”

“মঙ্গল সিং কিছুই জানতে পারবে না।”

“ফুঃ। তোমরা একেবারেই ছেলেমানুষ। তোমাদের দিদির মুখ থেকেই মঙ্গল সিং সব কথা আদায় করে নেবে।”

“তা হলে জেনে রাখুন, আমরা কী উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি, দিদিও তার কিছুই জানেন না। অত কাঁচা আমরা নই।”

“সত্যি ! সত্যি বলছ?”

“হ্যাঁ।”

“তা হলে বলো এখন কী করে কী করতে চাও?”

“আজ রাত্রেই আমরা জঙ্গলে যেতে চাই। ওদের ঘাঁটি আবিষ্কার করতে গেলে রাত্রিবেলাই উপযুক্ত সময়। কেন না, ওই বনের ভেতর যেখানেই থাকুক না কেন ওরা, অন্ধকারে নিশ্চয়ই থাকবে না। আলো ওদের জ্বালতেই হবে। আর সেই আলোর সূত্র ধরেই ওদের আমরা খুঁজে বার করব। ততক্ষণে আমি এখানকার পুলিশকে একবার জানিয়ে আসি ঘটনাটা।”

“না। এখনই থানা পুলিশ করতে যেয়ো না। পুলিশের ভেতরেও যদি ওদের কোনও স্পাই থাকে তা হলে সব চাল ভেস্তে যাবে। আজ রাত্রে ঘুরে এসে কাল সকালে বরং যা হয় করো।”

বাবলু বলল, “তাই হবে। তবে এখানকার পুলিশকে না জানিয়ে আমি বরং আমাদের ওখানকার পুলিশের সঙ্গেই ফোনে যোগাযোগ করে একটু পরামর্শ চেয়ে নিই।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “যা ভাল হয় করো।”

বাবলু অন্যান্যদের বলল, “বিলু ভোম্বল, তোরা বাচ্চু-বিচ্ছুকে নিয়ে এখানেই থাক। ঘর থেকে একদম বেরোবি না। আমরা যে এখানে আছি, কেউ যেন তা জানতে না পারে। আমি এখনই আসছি।” এই বলে বাবলু পঞ্চুকে নিয়ে সকলের নজর এড়িয়ে রাস্তায় নেমে এল।

পথে নেমে বাজারের কাছাকাছি যখন এসেছে তখন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল একজনের সঙ্গে ।

“আরে তুম হিঁয়া?”

বাবলু বলল, “নমস্কার সিংজি। আমরা তো এখানে বেড়াতে এসেছি। আপনি এখানে?”

“আমি তো টাটানগরে থাকি। এ মেরা দেশ হ্যায়। হরবখত হেলিকপ্টার লেকে আনা যানা হোতা হ্যায় হামারা। লেকিন তুমহারা আউর সব দোস্ত কাহা? দিদি কেমন আছে?”

“আমাদের খুব বিপদ হয়ে গেছে সিংজি।”

“ক্যা হুয়া?”

“তার আগে বলুন আপনি আমাদের উপকার করবেন?”

“ক্যা করনে হোগা বতাও?”

বাবলু চোখদুটাে ছলছলিয়ে বলল, “আমাদের সেই দিদিকে ডাকু মঙ্গল সিং তুলে নিয়ে গেছে। যেমন করেই হোক তাকে উদ্ধার করতে হবে। না হলে ঘরেই ফিরব না আমরা। বিষ খেয়ে মরব।”

“আরে না না। অ্যায়সা মাৎ করো। হামকো ক্যা করনে হোগা বোলো?”

“আমি ডাকু মঙ্গল সিং-এর এলাকাটা একটু দেখতে চাই।”

বাবলুর কথায় সিংজি একটু যেন চমকে উঠল। পরে বলল “আরে ও তো বহুৎ খতরনক ডাকু। উনকো ধান্দা মাৎ লাগাও। ও সবকা দুশমন হ্যায়।”

“তো ঠিক আছে। আপনি আমাকে একবার আপনার হেলিকপ্টারে চাপিয়ে ওই জঙ্গলের ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন।

“উসমে ফায়দা ক্যা? জঙ্গলমে ও কাহ পর হ্যায়, তুমহারা নজর মে ভি নেহি আয়েগা।”

“আমার কাছে টেলিস্কোপ আছে। আমি তাই দিয়ে দেখব।”

“দেখনে সে ভি কুছ নেহি হোগা। ও দিদিকে ডাকু কভি নেহি আনে দে গা।”

“আমি পুলিশে খবর দেব।”

বাবলুর কথায় সিংজি হেসে উঠল হো হো করে। বলল, “পুলিশ ও জঙ্গলমে পুলিশ ভি জানে নেহি সকে গা। যো যায়গা ও মরে গা। উসকো বাল-বাচ্ছা ভি মরে যা।”

“তবু আপনি দয়া করে একবার আমাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসুন সিংজি। আপনার দুটি পায়ে পড়ি।”

সিংজি কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল। তারপর বলল, “ঠিক হ্যায়, চলো। লেকিন কিসিকো মাৎ বোলনা। নেহি তো মেরা ভি মুশকিল হো জায়গা। ও ডাকু জরুর খতম করেগা হামকো।”

বাবলু বলল, “এক মিনিট দাঁড়ান সিংজি। আমি এখনই ঘর থেকে টেলিস্কোপটা নিয়ে আসছি।”

এই বলে বাবলু উধৰ্বশ্বাসে ছুটল ঘরের দিকে। সঙ্গে পঞ্চুও গেল। তারপর চাবিটা খুলে ঘরের ভেতর থেকে টেলিস্কোপটা নিয়ে কিছু সাদা কাগজ, লাল ডট পেন এবং পিস্তলটা যথাস্থানে নিয়ে বেরিয়ে এল। ভগবান সহায়, তাই সিংজির সঙ্গে ওর এই অপ্রত্যাশিতভাবে দেখাটা হয়ে গেল। না হলে কী যে হত। কত কাজের সুবিধে হল এতে।

সিংজি বাজারের একটি দোকানে চা খাচ্ছিল তখন। বাবলু যেতে ওকেও চা-বিস্কুট খাওয়াল। তারপর বাজারের পিছন দিকে যে ফাঁকা মাঠের ওপর হেলিকপ্টারটা ছিল, তাইতে চেপে বসল দু’জনে। পঞ্চুও উঠল। জীবনে এই প্রথম ওর শূন্যে ওড়া।

হেলিকপ্টারটা ভট ভট শব্দ তুলে অনেকটা ওপরে উঠে গেল প্রথমে। তারপর বাজপাখির মতো ধেয়ে চলল জিলিংডুংরির দিকে। জিলিংডুংরি পেরোতেই সেই পাহাড় আর জঙ্গল। হেলিকপ্টারটা বাবলুকে নিয়ে গভীর বনপ্রদেশের মাঝখানে গিয়ে অনবরত ঘুরপাক খেতে লাগল। বাবলু টেলিস্কোপে চোখ রেখে খুব ভাল করে লক্ষ করতে লাগল চারদিক। তারপর এক সময় হঠাৎ—হঠাৎই দেখতে পেল ও…

পাহাড়ের একটি ঢাল বেয়ে দুজন ভয়ংকর চেহারার দস্যু ঘোড়ার পিঠে চেপে মন্থরগতিতে কোথায় যেন চলেছে। তাদের দু’জনেরই কাঁধে স্টেনগান বাঁধা। হেলিকপ্টারের শব্দে সচকিত হয়ে দু’জনেই থমকে দাঁড়াল। তারপর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে চিৎকার করে কী যেন বলল তারা। বলেই স্টেনগান উঁচিয়ে ধরল।

হেলিকপ্টার তখন অনেক নিচুতে ছিল। ওরা স্টেনগান চালালেই মরবে ওরা। তাই সিংজি ওদের হাত নেড়ে স্টেনগান চালাতে বারণ করে হেলিকপ্টারটা মাটিতে নামল। ঘোড়ায় চাপা দস্যুরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এল ওদের কাছে। তারপর সেই অবস্থাতেই স্টেনগানের নলটা সিংজির বুকে ঠেকিয়ে বলল, “ক্যা মতলব লে কে আয়া হিয়া পর?”

“মতলব কুছ নেহি। লেড়কা কো স্রেফ পাহাড়-জঙ্গল দেখানে কে লিয়ে আয়া।”

দস্যুরা একবার পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। তারপর একজন বলল, “তুম পাঞ্জাব কা আদমি হো, ঔর ইয়ে বাঙ্গালি বাচ্চা। তো ক্যায়সে ও তুমহারা লেড়কা হো গিয়া ভাই? ঠিক হ্যায় দেখো। আখি ভর কর দেখো। পাহাড় দেখো, জঙ্গল দেখো, ঔর ক্যা দেখো গে? বোল নারে মুনিয়া?”

অপর দস্যু বলল, “দামাদ কা ঘর দেখো গে।” বলার সঙ্গে সঙ্গেই ধুপ করে একটা শব্দ। রক্তাক্ত কলেবরে সিংজি অল্প একটু আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল।

বাবলু অবাক বিস্ময়ে সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখল।

দস্যুদের একজন বাবলুকে বলল, “দেখো তো ক্যায়সা হাল কর দিয়া সিংজি কো। যাঃ, ভাগ হিঁয়াসে। নেহি তো তেরা ভি অ্যায়সা হাল হোগা।”

বাবলু স্তব্ধ। পঞ্চুও নির্বাক। কীই বা করতে পারে সে? দস্যুদের সামনে সভয়ে মাথা নত করল বাবলু। দস্যুরা স্টেনগান কাঁধে নিয়ে পরম নিশ্চিন্তে যেমন যাচ্ছিল তেমনই চলতে লাগল আবার। এই সুযোগ। যেই না ওরা পিছু ফিরেছে, বাবলু অমনি হেলিকপ্টারের ভেতর থেকে লাফিয়ে মাটিতে নেমেই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদে পিস্তল চালাল—ডিসুম-ডিসুম।

পিস্তলের দুটি মাত্র বুলেট খরচ হল। শব্দও হল মাত্র দুবার। ঘোড়া দুটাে চিঁ-হিঁ-হিঁ করে লাফিয়ে উঠল একবার। দস্যু দু’জন ঘাড় ফেরাবার সময় পেল না। রক্তাক্ত কলেবরে ঘোড়ার পিঠ থেকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল মাটিতে।

ঘোড়া দুটো প্রাণভয়ে যে পথে এসেছিল, সেই পথেই ছুটল। আর বাবলু? তাড়াতাড়ি ওর পকেট থেকে সাদা কাগজটা বার করে লাল ডট পেনে লিখে ফেলল—

ডাকু মঙ্গল সিং! আমাদের একটি প্রাণের বদলে মাত্র দুটি প্রাণ নিয়েছি। এর পরে কিন্তু আরও অনেক নেব। তোমার নিজের অমঙ্গল যদি ঘটাতে না চাও তা হলে রুদ্রনারায়ণবাবুর নাতিকে এবং আমাদের পায়েলদিকে আজ রাত দশটার মধ্যে ফেরত দেবে। না হলে এদের মতো অবস্থার জন্য তুমিও তৈরি থেক –পাণ্ডব গোয়েন্দা।

চিঠিটা লিখে সেই মৃত দস্যুদের জামার বোতামে আটকে তার ওপর একটা পাথর চাপা দিল বাবলু। তারপর ওদের স্টেনগান দুটো কেড়ে নিয়ে পঞ্চুকে ইশারা করে দৌড়—দৌড়—দৌড়।

এখানটা একটু ফাঁকা। তাই একটানা খানিকটা ছুটে বনের ভেতর দিয়ে গাছপালার আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে চলতে লাগল। পথ অত্যন্ত খারাপ আর আঁকাবাঁকা বলে চলতে খুবই কষ্ট হল। তবুও জিলিংডুংরির দিকে নজর রেখেই আসতে হল ওকে। পথ যেন আর শেষ আর হয় না। অবশেষে অনেক কষ্টে জিলিংডুংরির কাছাকাছি এল ও। এখন মুশকিল হল স্টেনগান দুটাে নিয়ে। এ দুটো নিয়ে তো পাহাড় টপকানো যাবে না! ওপারের লোকেদের চোখে পড়ে যাবে এবং ওর মতো বয়সের ছেলের কাছে দু দুটো স্টেনগান দেখলে কী কাণ্ডটা যে হবে সে তো জানাই আছে। তাই ওইখানেই একটি গাছের ডালে কারও নজরে পড়বে না, এমন একটি জায়গায় স্টেনগান দুটি লুকিয়ে রেখে এপারে চলে এল।

বাবলু যখন ফিরে এল তখন বেলা হয়ে গেছে। রুদ্রনারায়ণবাবু বাবলুর দেরি দেখে একবার ঘর, একবার বাইরে—এই করছেন। হাজার হলেও ছেলেমানুষ। চিন্তা তো একটা হয়।

বিলু, ভোম্বল, বাচ্চু, বিচ্ছুও চিন্তিত হয়ে পড়েছিল খুব। বাবলু আসতেই সকলে প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার রে, এত দেরি? কোথায় গিয়েছিলি তুই?”

বাবলু বলল, “সব বলব। তবে জেনে রাখ আজ রাত্রে একটা জোর লড়াই হবে।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

বাবলু বলল, “আমাদের একটি প্রাণের বিনিময়ে ডাকাতদের দুটি প্রাণ নিয়ে এসেছি আজ। মঙ্গল সিংকে জানিয়ে এসেছি, আজ রাত দশটার মধ্যে আপনার নাতি এবং পায়েলদিকে ফিরিয়ে না দিলে ওর সিং আমি উপড়ে নেব।”

রুদ্রনারায়ণবাবু লাফিয়ে উঠলেন, “বলো কী! একি সত্যি? ওই সাংঘাতিক দস্যুদের দু দুটাে প্রাণ তুমি কী করে নিলে বাবলু?”

“ভগবানের দয়ায়।” বলে সব কথা খুলে বলল বাবলু।

রুদ্রনারায়ণবাবুর চোখদুটি দিয়ে যেন আগুনের হলকা বেরোতে লাগল এবার। বললেন, “তোমাকে ধন্যবাদ জানাবার মতো কোনও ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু ওরা কি সত্যিই ওদেরকে ফেরত দেবে?”

“না। তবে আজ রাত দশটা পর্যন্ত খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের। আমরা আজ কেউই আমাদের ভাড়া বাড়িতে ফিরে যাব না। কারণ আমি ডাকাতদুটোকে মেরে তাদের স্টেনগান নিয়ে পালিয়ে এসেছি। সেগুলো অবশ্য ঘরে আনিনি। লুকিয়ে রেখে এসেছি অন্য জায়গায়। ওরা সেগুলোর খোঁজে আসবে। এবং যথারীতি আমাদের ঘর ভেঙে তল্লাশ করবে। কাজেই আমরা আজ ওখানে থাকলে আমাদের অবস্থাটা কী হবে বুঝতে পারছেন তো?”

“সে তো বটেই। তোমরা তা হলে এখানেই থেকে যাও এখন থেকে।”

“হ্যাঁ, থাকব। তবে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। আর একটা কথা—।”

“কী কথা বলো?”

“আপনি বেচারামকে একবার ঘাটশিলায় পাঠিয়ে কিছু জিনিস আনিয়ে দিতে পারবেন?”

“কী জিনিস বলো ?”

বাবলু চট করে একটা ফর্দ তৈরি করে দিল।

সেটা দেখে রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “এর জন্য ঘাটশিলা যেতে হবে কেন? এ তো এখানেই পাওয়া যাবে। যাও, তুমি খাওয়া-দাওয়া করে নাও। আমি এখনই সব আনিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু ওগুলো তোমাদের কী কাজে লাগবে?”

“যথাসময়েই দেখতে পাবেন। তবে এখন থেকেই কিন্তু আমাদের তৈরি হয়ে থাকতে হবে। কেন না, পায়েলদি বা আপনার নাতি কাউকেই ওরা ফেরত দেবে না। তবে আমাদের হত্যা করবার জন্যে এবং আপনার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্যে ওদের লোক অবশ্যই আসবে। পঞ্চু ততক্ষণ বাড়িটা পাহারা দিক। আপনি ছাদে উঠে আলসের ফাঁক দিয়ে দূরের দিকে লক্ষ রাখুন। সন্ধের পর বাচ্চু-বিচ্ছুকে আপনি এই বাড়িরই কোনও গোপন কক্ষে লুকিয়ে রাখবেন। আমি বিলু ভোম্বলকে নিয়ে একটু বেরব।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “যা ভাল বোঝ করো। তবে এও জেনে রেখো, সন্ধের আগে ওরা কেউ আসছে না।”

বাবলু দেওয়ালের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “সন্ধের আর দেরি কত? শীতের বেলা। এখনি তো চারটে বাজে। যান, আপনি ছাদে উঠে পাহারা দিন। আপনার কাছে বন্দুক বা পিস্তল নিশ্চয়ই কিছু না কিছু আছে। সেটাও সঙ্গে রাখুন।”

রুদ্রনারায়ণবাবু তাঁর টোটা ভর্তি দোনলা বন্দুকটা বার করে আনলেন। তারপর সেটা নিয়ে সিঁড়ি বেড়ে উঠে গেলেন ছাদে।

বাবলুও চটপট খেয়ে নিল দুটো।

ততক্ষণে বেচারাম এসে গেছে।

বাবলু বেচারামের মালপত্তরগুলো হাতে করে বিলু আর ভোম্বলকে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকল।

বাচ্চু-বিচ্ছু দালানে বসে রইল চুপচাপ।

পঞ্চু বাড়ি পাহারা দিতে লাগল।

এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। সন্ধে উত্তীর্ণ হয়েছে। এমন সময় হঠাৎ আলো নিভে গেল।

আলো নিভে যাওয়ার পরমহুর্তেই দেখা গেল, এক ছায়ামূর্তি আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল বাচ্চু-বিচ্ছুর ওপর।

বাচ্চু-বিচ্ছু চিৎকার করে কেঁদে উঠল।

সঙ্গে সঙ্গে ওপর থেকে রুদ্রনারায়ণবাবুও চেঁচিয়ে উঠলেন, “হুঁশিয়ার।”

চেচিয়ে উঠল পঞ্চুও, “ভৌ ভৌ—ভৌ-ভৌ–উ-উ-উ।”

আর সেই সময় এক প্রচণ্ড শব্দে কেঁপে উঠল গোটা বাড়িটা। ভয়ংকর এক বিস্ফোরণ।

বাবলু, বিলু, ভোম্বল সেই ঘন অন্ধকারে ঘর থেকে বেরিয়েই ধাঁধিয়ে গেল। চারদিক তখন ধোঁয়ায় ধোয়াচ্ছন্ন।

পাঁচিলের ওপারে তখন দ্রুত ধাবমান অশ্বক্ষুরধ্বনি শোনা গেল।

রুদ্রনারায়ণবাবু ক্ষিপ্রগতিতে নেমে এলেন ওপর থেকে।

বাবলুরা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দালানে।

রুদ্রনারায়ণবাবু হাতড়ে হাতড়ে মেন সুইচের কাছে গিয়েই বুঝলেন, সুইচটা কৌশলে অফ করা হয়েছিল। সেটা অন করতেই আবার জ্বলে উঠল আলো।

ধোঁয়ার রেশ অনেকটা কেটে গেছে তখন।

রুদ্রনারায়ণবাবু বাবলুদের কাছে এসে দাঁড়ালেন। তারপর কপাল চাপড়ে বললেন, “এত সাবধান হয়েও ভুল করে ফেললাম শেষকালে। কখন কোন ফাঁকে যে শয়তানরা এসে ঘাপটি মেরে বসেছিল এখানে তা কে জানত? মেন সুইচ অফ করে দুটোকে নিয়ে পালাল।”

বাবলু নির্বাক।

এমন সময় বিলুই হঠাৎ কী দেখে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। গিয়ে দেখল বেচারাম মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সেখানে। তার চোখদুটো অসম্ভব রকমের ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ঠোঁটের কোণে কণ্ঠ বেয়ে রক্ত পড়ছে। অর্থাৎ শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে তাকে। পাশেই একটি চিঠিও পড়ে আছে। তাইতে লেখা আছে—

রুদ্রনারায়ণবাবু! আজ রাত দশটার সময় জিলিং ডুংরির ওপারে মহুয়া গাছের নীচে আপনি টাকা নিয়ে উপস্থিত থাকবেন। সবাইকে ফেরত দেব। পাণ্ডব গোয়েন্দারা নেহাতই ছেলেমানুষ। তবুও ওদের সাহসের প্রশংসা করি!”— মঙ্গল সিং।

চিঠি পড়ে বেচারামের মরদেহটা একপাশে চাপা দিয়ে রাখল ওরা। তারপর বাবলু বলল, “আপনি তা হলে তৈরি হয়ে নিন রুদ্রনারায়ণবাবু! আপনার টাকা রেডি?”

“হ্যাঁ”

“একটা অ্যাটাচিতে কিছু বাজে কাগজ ভরে নিন তা হলে। আর আসল টাকাটা এমনভাবে লুকিয়ে রাখুন, যাতে আমরা চলে যাওয়ার পর ওদের কোনও লোক এসে সেগুলো হাতিয়ে না নিতে পারে।”

“তা ওরা পারবে না। তা হলে তো কবেই আমাকে মেরে ওরা সেগুলো নিয়ে যেত। সে টাকা যে কোথায় কীভাবে আছে তা কেউ জানে না।”

বাবলু বলল, “আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমরাও ততক্ষণে তৈরি হয়ে নিই।”

এমন সময় ভোম্বল হঠাৎ বলল, “কিন্তু পঞ্চুর গলা পাচ্ছি না কেন? পঞ্চু কই? ডাকাতরা ওকেও মেরে রেখে যায়নি তো?”

সত্যিই তো! পঞ্চু কই? ওর কথা তো এতক্ষণে মনে আসেনি কারও। দেখ দেখ।

ওরা গোটা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজল। কিন্তু না, পঞ্চু কোথাও নেই।

বাবলু বলল, “যাক। নিশ্চিন্ত হলাম। ডাকাতের ঘাঁটিটা খুঁজে বার করতে আমাদের খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। পঞ্চু নিশ্চয়ই ওদের পিছু নিয়েছে।”

বিলু বলল, “ঠিক বলেছিস। এখন চটপট তৈরি হয়ে নিই চল।”

প্রায় আধঘন্টার মধ্যেই ওরা তৈরি হয়ে নিল। মেকাপ নিয়ে ওরা যখন ঘর থেকে বেরুল তখন রুদ্রনারায়ণবাবু অ্যাটাচি হাতে অপেক্ষা করছিলেন। ওদের দেখেই চমকে উঠলেন, “এ কী! এ কী সেজেছ তোমরা?”

বাবলু, বিলু আর ভোম্বল সারা গায়ে ভুষো মেখে আঠা দিয়ে তুলো লাগিয়ে তিনটি লেজবিশিষ্ট হনুমানের মেকাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবলুর হাতে শুধু টর্চ ও পিস্তল। বিলু ভোম্বলের হাতে একটি করে স্প্রিং দেওয়া ছোরা। প্রত্যেকের কোমরে জড়ানো আছে নাইলনের মোটা দড়ি।

বাবলু বলল, “রুদ্রনারায়ণবাবু, আলো নিভিয়ে আপনি সদর দরজায় তালা লাগিয়ে বেরিয়ে যান। আমরা পিছন দিক দিয়ে পাঁচিল ডিঙিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে যাব। এখন সাতটা বাজে। আপনি ঠিক দশটার সময় জিলিং ডুংরির ওখানে থাকবেন কিন্তু।”

“আমি কি বন্দুকটা সঙ্গে নেব?”

“না। তবে লুকিয়ে একটা পিস্তল কিংবা রিভলবার নিতে পারেন।”

“নিয়েছি।”

“তবে যান।”

রুদ্রনারায়ণবাবু আলো নেভাতেই বাবলুরা পিছন দিকের পাঁচিল টপকে হাওয়া। তারপর ওরা তিনজনে গা ঢাকা দিয়ে অন্য পথে জিলিং ডুংরিতে উঠল। এবং খুব সন্তর্পণে অপ্রচলিত পথ বেয়ে পাহাড় অতিক্রম করল। ওপারে গিয়ে সেই ঘন অন্ধকারে বিশেষ একটি গাছের কাছে গেল ওরা। বিলু আর ভোম্বলকে নীচে রেখে গাছের ওপরে উঠল বাবলু। তারপর অন্ধকারে হাতড়াতেই পেয়ে গেল স্টেনগানটা। কিন্তু এ কী! স্টেনগান তো বাবলু দুটো রেখেছিল। একটা কেন? আর একটা কোথায়? বাবলুর মুখ শুকিয়ে গেল। যাই হোক, একটা একটাই সই। সেটা নিয়েই নেমে এল বাবলু। তারপর রুদ্রনারায়ণবাবুর যেখানে থাকবার কথা, তার ঠিক বিপরীত দিকের একটি গাছের ঘন ডালপালার আড়ালে বিলু আর ভোম্বলকে নিয়ে লুকিয়ে রইল।

সময় আর কাটে না।

অনেক পরে এক সময় রুদ্রনারায়ণবাবুকে আসতে দেখা গেল। তারও পরে দেখা গেল তিনজন অশ্বারোহীকে মশাল জ্বেলে অন্ধকার বনপথ বেয়ে আসতে।

তারা যখন কাছে এসে দাঁড়াল তখন মশালের আলোয় তাদের ভয়ংকর মূর্তি দেখে সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠল বাবলুদের। তবুও পাগড়ির কাপড়ে মুখের অর্ধেকটা ঢাকা ছিল তাদের।

একজন মুখের কাপড় অল্প একটু সরিয়ে ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা অবস্থাতেই বলল, “রুপিয়া লেকে আয়া?”

“ফিক দে! ইধার।”

“নেহি। প্রতাপ কাঁহা হ্যায়?”

“হ্যায় মেরা সাথ।”

“ঔর উয়ো লেড়কি?”

“লেড়কি নেহি মিলেগা।”

“তো ঠিক হ্যায়। প্রতাপকো ভেজ দো পহলে।”

একজন অশ্বরোহী একটি ফুটফুটে বালককে নিয়ে একটু পিছন দিকে অন্ধকারে ছিল। সে এবার সামনের দিকে এগিয়ে এসে বালকটিকে নামিয়ে দিতেই বালকটি ছুটে গিয়ে দাদুভাই, দাদুভাই, আমাকে বাঁচাও” বলে রুদ্রনারায়ণবাবুর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।

রুদ্রনারায়ণবাবুও তাকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে অস্থির করে তুললেন।

দস্যুরা সকলেই তখন স্টেনগান উচিয়ে আছে ওদের দিকে।

একজন বলল, “উসকো হাত মে রুপিয়া ভেজ দো। ঔর তুম হাত উঠাকে চুপচাপ খাড়া রহো।”

দস্যুর কথামতো রুদ্রনারায়ণবাবুর নাতি প্রতাপ অ্যাটাচিটা তুলে যেই না এগোতে যাবে, অমনি ধমকে উঠল একজন, “রাখ দো।”

প্রতাপ থমকে দাঁড়াল ভয়ে।

দস্যু বলল, “ক্যা হ্যায় উসমে?”

“কিতনা রুপিয়া?”

“তিন লাখ।”

দস্যু হেসে বলল, “রুদ্রনারায়ণবাবু, হামলোক অ্যায়সা বুরবাক নেহি। হামারা সাথ টক্কর দেনে মাংতা তুম? উসমে তিন লাখ রুপিয়া রহনে সে ও লেড়কা উঠানে সকেগা? ক্যা হ্যায় উসকা অন্দর মে?”

“রুপিয়া!”

“ঝুট বাত। আউর এক ঘণ্টা টাইম মিলেগা। উস টাইম কে অন্দর রুপেয়া মিলে তো আচ্ছা। নেহি তো দোনোকো খতম করেগা এক সাথ। যাও, পোতা কো ছোড়কর রুপিয়া লেকে আও। জলদি যাও।”

রুদ্রনারায়ণবাবু বললেন, “না। আগে আমি ওকে ঘরে রেখে আসব, তারপর নিয়ে আসব টাকা।”

দস্যুগুলো পরস্পর পরস্পরের চোখের দিকে তাকাল একবার। তারপর বলল, “আভি সমঝ গিয়া। তো তুম হামারা সাথ জরুর টক্কর মারোগে? ঠিক হ্যায়। নেহি চাইয়ে রুপিয়া। আভি তুম ভগবানকা নাম লে লো।” বলেই স্টেনগান তাক করল দস্যুরা।

সেই ঘন অন্ধকারে বনভূমি কাঁপিয়ে তিন বার শুধু শব্দ হল—ডিসুম—ডিসুম—ডিসুম।

শব্দের সঙ্গে সঙ্গে গাছের ডাল থেকে প্রায় ছিটকে পড়ল বাবলু। ওর হাত পাথর থর করে কাঁপছে।

বিলু-ভোম্বলও লাফিয়ে নামল।

ওদের বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পিটছে। উঃ, কী দারুণ শব্দ। কানে যেন তালা ধরে যাবার জোগাড়।

যাই হোক, ওরা নেমেই ছুটল রুদ্রনারায়ণবাবুর দিকে। তিনজন দস্যুই তখন রক্তাক্ত কলেবরে লুটিয়ে পড়েছে মাটিতে। ঘোড়াগুলোও ভয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটল যে যেদিকে পারল।

রুদ্রনারায়ণবাবু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন বাবলুকে। বললেন, “সত্যি বাবলু, তোমার জবাব নেই। তুমি যে এইভাবে চোখের লহমায় তিন তিনটেকে শুইয়ে দেবে তা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।”

বাবলু বলল, “সবই ভগবানের দয়ায়। ওদেরই স্টেনগানে ওদেরকে শুইয়েছি। ভাগ্যিস বুদ্ধি করে সকালবেলা ওটা নিয়ে এসে লুকিয়ে রেখেছিলাম। এইরকম স্টেনগান আরও একটা ছিল। কিন্তু সেটা যে কোথায় গেল?”

স্টেনগান যাক। তবে আশ্চর্য এই, যার জন্য এত কাণ্ড, রুদ্রনারায়ণবাবুর সেই ফুটফুটে নাতিটি কই? এরই মধ্যে কোথায় গেল সে? সে যেন চোখের পলকে লোপাট হয়ে গেছে।

বাবলু বলল, “রুদ্রনারায়ণবাবু, আপনি বাসায় ফিরে যান। আমরা যা করবার করছি। আপনার নাতিকে উদ্ধার আমরা করবই।”

“এখনও আপনার অবিশ্বাস আছে আমাদের ওপর?”

“না নেই।”

“তা হলে, যা বলি তাই করুন।”

রুদ্রনারায়ণবাবু চলে গেলেন।

আর বাবলুরা সেই ঘন অন্ধকারে একটু একটু করে এগোতে লাগল। হঠাৎ এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ওরা। দেখল, বহু দূরে পাহাড়ের একটি ঢাল বেয়ে পঞ্চু ছুটতে ছুটতে আসছে।

পঞ্চু কাছাকাছি আসতেই বাবলু মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র আওয়াজ করল।

এই আওয়াজের অর্থ পঞ্চু বোঝে। তাই কুইকুই করে ছুটে এল বাবলুর কাছে। তারপর হঠাৎই কেমন যেন ভয় পেয়ে একটু পিছিয়ে গিয়ে লেজ নাড়তে লাগল।

বাবলু বলল, “কী রে পঞ্চু ! ভয় পেলি?”

পঞ্চু কুই কুই করতে লাগল।

“আমরা ইচ্ছে করেই এরকম হনুমান সেজেছি!”

পঞ্চু অস্পষ্টভাবে ডাকল, “গরর—ভৌ—।”

“বাচ্চু-বিচ্ছু কোথায়, পঞ্চু?”

পঞ্চু এবার ভয়ে ভয়ে বাবলুর কাছে এসে ওর পাদুটো শুকল। বিলু ভোম্বলকেও ভয়ে ভয়ে দেখল।

বাবলু তখন আদর করে পঞ্চুর গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই পঞ্চু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেল। দু-একবার আনন্দে নেচে আকারে ইঙ্গিতে পঞ্চু যে পথে এসেছিল সেই পথেই বাবলুদের যেতে বলল।

অন্ধকারে ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছিল না এতক্ষণ। এবার একটু একটু করে জ্যোৎস্না ফুটছে। তাই বুঝতে অসুবিধে হল না যে বাবলু সকালে যে পথে এসেছিল, সেই পথেই এসে পৌঁছেছে। এই তো সেই হেলিকপ্টারটা।

ওরা ধীরে ধীরে পঞ্চুর সঙ্গে চলতে লাগল।

খানিক চলার পর এক জায়গায় এসে থমকে দাঁড়াল ওরা, দেখল দুই পাহাড়ের মাঝে লম্বা একটি প্যাসেজ।

বাবলু ইঙ্গিতে প্যাসেজটা দেখে আসতে বলল পঞ্চুকে।

পঞ্চু দৌড়ে প্যাসেজটা দেখে আবার ফিরে এসে বাবলুদের কুই কুই করে ডাকল। অর্থাৎ কিনা চলে এসো। ভয়ের কিছু নেই।

বাবলুরা সেই প্যাসেজটা পার হয়েই দেখল পাহাড়ের একটা অংশ আবার খাড়াই হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে। আর তার উপরিভাগে মূর্তিমান যমের মতো কয়েকজন প্রহরী দস্যু ঘুরে বেড়াচ্ছে স্টেনগান হাতে।

পঞ্চু একবার সেদিকে তাকিয়ে যেন রাস্তার কুকুর এমনভাবে ল্যাং ল্যাং করে মাটি শুকে শুকে ঝোপ-ঝাড়ের পাশ কাটিয়ে ওপরে উঠতে লাগল।

বাবলুরাও অনুসরণ করল ওকে।

চুপি চুপি এমনভাবে উঠতে লাগল যে কারও নজরেই পড়ল না ওদের চেহারা।

হঠাৎ এক জায়গায় ঝোপটা একটু দুলে উঠতেই স্টেনগান হাতে ছুটে এল একজন, অ্যাই! কৌন হ্যায় রে?”

সমূহ বিপদ বুঝে বাবলু ‘উপ’ করে একটা শব্দ তুলে হাতে পায়ে ভর করে লেজ উচিয়ে লাফ দিয়ে এ পাশের ঝোপ থেকে ওপাশের ঝোপে ঢুকল।

দস্যুটা তাই দেখে ফিরে গেল।

অপরজন বলল, “ক্যা হুয়া?”

“কুছ নেহি! বান্দর।”

দস্যুদুটো একটু তফাতে চলে যেতেই বাবলুরা আরও ওপরে উঠে বড় একটি পাথরের আড়ালে লুকাল। এখান থেকে অপর দিকের নীচের অংশটা দেখা যাচ্ছে। এক জায়গায় বেশ কতকগুলো ঘোড়া বাধা আছে দেখতে পেল। চারজন দস্যু স্টেনগান হাতে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিচ্ছে সেই জায়গাটা। কোথাও যেন যাওয়ার প্রস্তুতি করছে। কিন্তু বাচ্চু-বিচ্ছু পায়েলদি এরা সব কোথায়? তাদের তো নাম গন্ধও নেই।

ওরা ওখানে বসে বসে যখন নীচের দৃশ্য দেখছে তখন হঠাৎ এক সময় মসমস শব্দ শুনতে পেল ওরা। দেখল টহল দিতে দিতে একজন দস্যু এদিকে এগিয়ে আসছে।

ভয়ে বুক শুকিয়ে গেল ওদের।

দস্যুটা এসে পাথরটার কাছে একবার থমকে দাঁড়াল। তারপর কী মনে করে যেন চলে গেল আবার।

বাবলু এবার একটু বেশি রকম ঝুঁকি নিয়ে সাহস করে বেরিয়ে এসে দেখল, অন্তত আট দশজন দস্যু টহল দিচ্ছে সেখানে।

ওরা এমনই বলবান যে কোনওরকমেই কবজ করা যাবে না ওদের।

তবে দস্যুরা টহলদারি করলেও খুব অন্যমনস্ক। এবং যে পথে বাবলুরা এসেছে সেই পথের দিকে ওদের দৃষ্টি নিবদ্ধ। কারও যেন প্রতীক্ষা করছে ওরা।

বাবলু মনে মনে বলল, যাদের প্রতীক্ষা করছ তোমরা তাদের আমরা অনেক আগেই যমের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে এসেছি। তারা আর কোনওদিনই রুদ্রনারায়ণবাবুর টাকার থলি হাতে নিয়ে ফিরে আসবে না।

এমন সময় নীচের চাতাল থেকে হঠাৎ একটা বাজখাই গলার আওয়াজে বুক কেঁপে উঠল ওদের। এ কণ্ঠস্বর কি মানুষের? না। এ এক অমানবিক কণ্ঠস্বর। কী ভয়ংকর। কণ্ঠস্বরের থেকেও আরও অনেক বেশি ভয়াল ভয়ংকরের আবির্ভাব হয়েছে তখন রঙ্গমঞ্চে। অন্তত সাতফুট লম্বা বলিষ্ঠ চেহারার এক তেজি ষাঁড়ের শারীরিক গঠন নিয়ে যেন এই অমানুষটাকে তৈরি করা হয়েছে। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। কপালে তেল সিঁদুরের লম্বা তিলক। অত্যন্ত রূপবান এবং অতি নিষ্ঠুর। চোখের চাউনিও বুলেটের মতো। এক জায়গায় স্থির হয়ে কিছুতেই দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। অনবরত অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। পায়চারি করতে করতে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “লাখন সিং!”

একজন এগিয়ে এল, “জি হুজুর!”

“ও লোক কাহে কো নেহি আয়া?”

“ক্যা মালুম সর্দার!”

সঙ্গে সঙ্গে একটা বোমা ফাটার মতো শব্দ বার হল সেই অমানুষটার মুখ দিয়ে, “কিতনা আদমি গিয়া থা?”

“তিন আদমি।”

“রাত বারা বাজ গিয়া লেকিন ও লোক আভিতক নেহি আয়া। ঔর তুম সব খাড়া হোকর সুরথ দেখাতে হো? যাও। আভি যাও। দেখো, ক্যায়সা হাল হো গিয়া ও লোগনকা।”

“আভি যা রহ হু সর্দার।”

“জলদি যাও। মঙ্গল সিং-কা রুপিয়া চাহিয়ে ঔর রুদ্রনারায়ণবাবুকা খুন চাহিয়ে। রুপিয়া নেহি মিলে তো উনকো শির লেকে আও। ঔর আগ লাগা দো কোঠি মে। যাও, চলা যাও।”

সঙ্গে সঙ্গে নীচের দস্যুগুলো ঘোড়ায় চেপে ঝড়ের বেগে উধাও হয়ে গেল।

আবার গর্জন শোনা গেল, “উপর মে কিতনা আদমি হ্যায়?”

প্রহরীরা বলল, “দশ আদমি।”

“এক আদমি উপরমে রহো। বাকি সব নীচে উতারো। হিঁয়াকা খেল খতম হো যায়েগা আজ।”

তাই হল। একজনই শুধু রইল ওপরে। বাকিরা নীচে নামল। কিন্তু নীচে নেমে যে কোথায় গেল তারা, কোনও হদিসই পেল না বাবলুরা।

এখন নীচে নামতে গেলে এই লোকটির নজর এড়াতে হবে। কেন না, লোকটি যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠিক পাশ দিয়েই নীচে নামার রাস্তা। অথচ লোকটি সেই প্রধান পথের মাঝখানে পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

বিলু বলল, “লোকটাকে প্রাণে না মেরে কোনও রকমেই ওখান দিয়ে যাওয়া যাবে না।”

বাবলু বলল, “তবে একটা বুদ্ধি আমার মাথায় এসেছে।”

ভোম্বল বলল, “কী রকম?”

“এইখানে একটা বড় পাথরে নাইলনের দড়িটা বেঁধে আমি পিছন দিকে ঝুলে নামি তোরা শক্ত করে দড়িটা ধরে থাক।”

“তাতে তুই না হয় নামলি। কিন্তু আমরা?”

বাবলু বলল, “তাও তো ঠিক। আর এ আবার এমন জায়গা যে সব সময় আমরা পাশাপাশি না থাকলে একের মন অন্যের দিকে পড়ে থাকবে!”

বিলু বলল, “তা হলে কী করা যায়?”

ভোম্বল বলল, “তোর পিস্তলটা এইবার কাজে লাগ না বাবলু?”

বাবলু বলল, “মাথা খারাপ? এখানে গুলির শব্দ হলে আর রক্ষে আছে? হইহই করে ছুটে আসবে সব। তবে একটা কাজ করা যায়।”

“কী কাজ?”

“ও ব্যাটাকে কৌশলে ঘায়েল করতে হবে।”

“কী রকম?”

“একটু রিস্কের ব্যাপার আছে যদিও, তবুও এ ছাড়া উপায় নেই।” বলেই বুদ্ধির প্যাঁচটা শোনাল ওদের।

বিলু বলল, “তা হলে দড়ি বাঁধ।”

বাবলুর কোমরে নাইলনের মোটা দড়িটা পাক দিয়ে জড়ানো ছিল। সেটা একটা পাথরে বেঁধে দড়ির অপর প্রান্তটা ঝুলিয়ে দিল ওপাশে।

ভোম্বল একবার উঁকি মেরে দেখল ও পাশটা ফাঁকা। দুটি মাত্র ঘোড়া বাধা আছে এক জায়গায়। আর কেউ নেই। দড়িটা ঝুলিয়ে দিয়েই পাথরের খাজে লুকিয়ে পড়ল ওরা। তারপর ইচ্ছে করেই খুক খুক করে একটু কাশল। কাশির শব্দ শুনেই ছুটে এল প্রহরটা।

পাথরের ওপর দিয়ে নাইলনের দড়িটাকে ওপাশে ঝুলতে দেখেই চোখদুটো বড় বড় হয়ে উঠল তার। এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল সেদিকে। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের ওপরে উঠে যেই না দেখতে যাবে নীচে, এরা তিনজনেই তখন একজোট হয়ে গায়ের জোরে পিছন থেকে মারল প্রচণ্ড এক ধাক্কা। এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল ব্যাপারটা যে ঘুরে তাকাবারও সময় পেল না বাছাধন। একেবারে ডিগবাজি খেয়ে পঞ্চাশ ফুট নীচের সেই প্রশস্ত চাতালের ওপর ধড়াস করে পড়ল। কোনও সাড়া শব্দ করল না। আর্তনাদ করবার সময় পেল না। একবার শুধু কেঁপে উঠল দেহটা। তারপর স্থির হয়ে গেল।

বাবলুরা দেখল এই সুযোগ। ওরা তাড়াতাড়ি ছুটে চলল প্রধান পথের দিকে।

সবার আগে চলল পঞ্চু।

এক জায়গায় গিয়ে দেখল একটা সিঁড়ি নেমে গেছে নীচের চাতালের দিকে।

সেই সিঁড়ি বেয়ে ওরা নীচে নামল।

নেমে দেখল গহ্বরের মতো একটা সুড়ঙ্গ-পথ চাতালের পাশ দিয়ে অনেকটা ভেতর দিকে চলে গেছে। সেই পথেই দূর থেকে আলোর রেখা ভেসে আসছে একটু। আলো লক্ষ্য করে ওরা এগিয়ে চলল।

এগিয়ে গিয়ে আর একটি ছাদবিশিষ্ট প্রকাণ্ড গহ্বরের মধ্যে ঢুকল ওরা। সেটি আয়তনে এত বিশাল যে দু-একশো লোক অনায়াসে তার ভেতরে থাকতে পারে। আর তার প্রবেশ পথটি এতই সংকীর্ণ যে সেখানে বড় বড় পাথর দু-একটা ফেলে রাখলে এর ভেতরে যে এমন একটি জায়গা আছে তা কেউ টেরও পাবে না। এক আশ্চর্য প্রাকৃতিক নিয়মে এখানকার পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই জন্যেই পুলিশ চেষ্টা করেও হদিস পায়নি এদের। এরা ঘোড়াগুলোকে পর্যন্ত লুকিয়ে রাখে এর ভেতর। যাই হোক। মশালের আলোয় ঘরের ভেতরটা ঈষৎ আলোকিত। জন পনেরো দস্য সেখানে ত্রিপলের বস্তার ভেতর মূল্যবান কিছু জিনিসপত্তর গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত।

বাবলুরা সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল প্রথমে। তারপর দেখল দস্যুরা যারা মালপত্তর গোছাতে ব্যস্ত তাদের স্টেনগান ও রাইফেলগুলো এক পাশে দেওয়ালের গায়ে দাঁড় করানো আছে।

ওরা চুপিসাড়ে একে একে সেগুলো নিয়ে হাতাহাতি পাচার করতে লাগল। সবগুলো জড়ো হলে ওরা করল কী সেগুলোকে নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে এসে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ওপরে উঠে এল। তারপর এক জায়গায় পাথরের খাঁজে সেগুলো ঢুকিয়ে রেখে আবার নীচে নামল।

ওরা যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছে তখন আর একটি বড় পাথরের আড়াল থেকে সকালের সেই সাধুকে উঁকি মারতে দেখা গেল।

বাবলুরা তাকে দেখতেও পেল না। এদিকে ওরা যখন গুহামুখে ফিরে এল তখন দেখল ত্রিপলের বস্তা বোঝাই মালপত্তরগুলো নিয়ে দস্যুরা এক এক করে বেরিয়ে আসছে।

হঠাৎ তাদের ভেতর থেকে একজন ছুটে বাইরে এসে বলল, “এ কালু! বহুৎ গড়বড় হো গিয়া রে!”

“ক্যা হুয়া?”

“হামারা স্টেনগান, রাইফেল সব কুছ হাপিস হো গিয়া।”

“আরে হোনে দো ভাই।”

বলেই লাফিয়ে উঠল, “ক্যা বোলা তুমনে? সব কুছ হাপিস হো গিয়া? এ ক্যায়সে হো সেকতা?”

“ক্যায়সে হো সকতা ও বাত পিছে সমঝো। লেকিন হো গিয়া।”

“হেই ভগবান। সর্দার কো মাৎ বোলনা ভাই।”

“আভি সামান রাখো। পহলে যন্তর কা ধান্দা লাগাও। নেহি তো কুছ গড়বর হো যায়েগা তো লড়েঙ্গা ক্যায়সে?”

দস্যুরা তাই করল। মালপত্তর এক পাশে সরিয়ে রেখে খোঁজাখুঁজি শুরু করল চারদিকে। সেই ফাঁকে বাবলুরাও ঢুকে পড়ল ভেতরে। একদম দেওয়াল ঘেঁষে সামনে এগোতে লাগল ওরা। এক জায়গায় এসে ওরা ঘণ্টার শব্দ শুনে থমকে দাড়াল। সেই সঙ্গে শুনতে পেল নুপুরের নিক্কণ।

কিন্তু যেখান থেকে শব্দটা আসছে সেখানে যাওয়ার কোনও পথই দেখতে পেল না ওরা। এমন সময় পঞ্চু হঠাৎ এক জায়গায় গিয়ে দেওয়াল আঁচড়াতে লাগল। খর খর করে একটা শব্দ। পাথরে তো এমন শব্দ হবে না। বাবলুর সন্দেহ হল তাই। তাড়াতাড়ি গিয়ে সেখানটায় হাত বুলিয়ে দেখল দেওয়ালটা পাথরের নয়। কালো পাথরের রঙে রং মেলানো কাঠের একটা পার্টিশন মাত্র। অতএব বোঝাই যায় এখানে তা হলে নিশ্চয়ই কোনও প্যাসেজ আছে। এই ভেবে বাবলু এদিক-সেদিক হাতড়াতেই একটা হাতল দেখতে পেল। সেটা শক্ত করে ধরে ঠেলা দিতেই খুলে গেল দরজাটা।

এখান থেকে খুব ভাল ভাবে সেই ঘণ্টাধ্বনি এবং নৃত্যগীতের শব্দ বেশ স্পষ্টভাবে শোনা যেতে লাগল। এক অপূর্ব সুরলহরীতে যেন ভরে উঠল চারদিক।

ওরা ভালভাবে লক্ষ করে দেখল কয়েক ধাপ সিঁড়ি এখান দিয়ে নেমে গেছে নীচের দিকে। বাবলুরা সেই সিঁড়ির ধাপগুলো নামতেই আর একটি প্রশস্ত গুহাঘরে এসে পৌছুল। ঘরের শেষ প্রান্তে এক প্রকাণ্ড মহিষমৰ্দিনী মূর্তি রয়েছে। আর সেই মূর্তির সামনে সেতার ও হারমোনিয়াম নিয়ে কয়েকজন মহিলা বন্দনা গাইছে। কয়েকটি ছোট মেয়ে ঝোলানো ঘণ্টার দড়ি ধরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে।

একজন বাঙালি ব্রাহ্মণ দেবীর আরতি করছেন। দেবীর সম্মুখে অপূর্ব সাজ-সজ্জায় সজ্জিতা হয়ে অনেকটা দেবদাসীর মতো নৃত্য করে চলেছে পায়েলদি। কী সুন্দর পরিবেশ। মনের ভেতরটা যেন ভক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। কিন্তু তারা কোথায়? বাচ্চু-বিচ্ছু? তারা এখানে নেই কেন? ঘরের মধ্যস্থলে দু’হাত জোড় করে অনেকটা প্রণামের ভঙ্গিতে আরতি দেখছে মঙ্গল সিং। বাবলুরা এক কোণে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে রইল।

আরতি শেষ হলে প্রণাম করে চলে গেল সকলে।

পায়েলদি বলল, “এবার তা হলে আমাকে পৌঁছে দিয়ে আসুন।”

বজ্ৰগম্ভীর স্বরে মঙ্গল সিং বলল, “নেহি।”

“আপনি কিন্তু আপনার কথার খেলাপ করছেন সর্দার। যা আপনার কাছে আশা করিনি।”

মঙ্গল সিং হেসে বলল, “পহলে তুমহারা পিতাজিকো লিখ দো এক লাখ রুপাইয়া দেনেকে লিয়ে। উসকে বাদ ছোড় দুঙ্গা।”

পায়েলদির দু’চোখে আগুন জ্বলে উঠল এবার। বলল, “না, ও চিঠি আমি কোনওদিনই লিখব না।”

“জরুর লিখনে পড়েগা।”

“আমার বাবা মেহনত করে টাকা রোজগার করবেন, আর একটা শয়তান তার মেয়েকে আটকে রেখে তাকে ব্ল্যাকমেল করে টাকা আদায় করবে, ওটি হচ্ছে না।”

“তব মৌতকে লিয়ে তৈয়ার হো যাও।”

“বেশ। আমাকে মারলে যদি তোমার শান্তি হয় তো মারো। তবে মঙ্গল সিং! এটুকু জেনে রেখো, নর্দমার ঘোলা জলের যা দাম আছে তোমার কথার সে দামও নেই। তুমি বলেছিলে মা’র মন্দিরে পূজারতির সময় নৃত্যগীতে অংশগ্রহণ করলে তুমি আমাকে ছেড়ে দেবে, কিন্তু এখন তুমি উলটো কথা বলছ।”

“আরে ও বাত পুরানা হো গিয়া। তুম বহুৎ বঢ়িয়া ড্যান্সার হো। ইসি লিয়ে তুমকো ড্যান্স দেখানে বোলা।”

পায়েলদি রেগে বলল, “তবে রে কুকুর।” বলেই মঙ্গল সিং-এর মুখের ওপর এক ধ্যাবড়া থুথু দিয়ে দিল। মঙ্গল সিং সেই থুতু মুছে ঘর ফাটিয়ে হো হো করে হেসে বলল, “হাম সব হিয়াকা ধান্দা ছোড় কর দুসরা আড্ডা মে যা রহি হ্যায় পায়েলজি। তুমকো ভি হামারা সাথ চলনা পড়েগা। ঔর জিন্দগি ভর দেবীকা সেবা, পূজা কা কাম করনে পড়েগি।”

এমন সময় একজন দস্যু ঘরে ঢুকেই চেঁচিয়ে বলল, “বহুৎ গোলমাল শুরু হো গিয়া সর্দার।”

“ক্যা হুয়া?”

“রুদ্রনারায়ণবাবুকা রুপিয়া লেনে গিয়া যো লোক, ও সব খতম হো চুকা! হমারা আদমি গিয়া থা উসকো কোঠিমে আগ লাগানে কে লিয়ে। লেকিন পুলিশ নে সবকে গ্রেপ্তার কর লিয়া।”

“তুম ক্যায়সে আপস আয়া?”

“মেরা নসিব বচায়া মুঝে।”

“তো ঠিক হ্যায় যানেকা বন্দোবস্ত করো।”

“কীধার যায়েঙ্গে সর্দার। পুলিশ নে সারি এলাকা কর্ডন কর দিয়া।”

“ইয়ে বাত হ্যায়? লড়াই শুরু কর দো।”

দস্যুটি চলে যাচ্ছিল। মঙ্গল সিং ডাকল, “শুনো।”

“জি সর্দার।”

“ও হেলিকপ্টার ঠিক হ্যায় না?”

“বিলকুল ঠিক হ্যায়।”

“যাও, আভি তুম পুলিশকো রোখো।”

দস্যুটি চলে যেতেই মঙ্গল সিং পায়েলদিকে বলল, “আও মেরা সাথ।”

পায়েলদি বলল, “না। বরং যদি প্রাণে বাঁচতে চাও তো নিজেই পালাও এখান থেকে। শুনলে তো চারিদিক কীরকম পুলিশে ঘিরে ফেলেছে? মনে হচ্ছে আমাদের ছেলেরাই নিয়ে এসেছে পুলিশকে।”

“আরে ছোড় দো পুলিশ কা বাত। পুলিশ হামারা ক্যা কিয়েগা জলদি আ যাও।”

পায়েলদি বলল, “পুলিশ যখন তোমার কিছুই করতে পারবে না, তখন এত জলদি যাওয়ার দরকারটা কী?”

“আরে আ যাও না।”

“উহু। আমি যাব না। যদি যাই পুলিশের সঙ্গে দেখা করে তাদের সামনে দিয়ে টা-টা করে তারপর যাব।”

“নেহি যাওগি? তব ভগবানক নাম লে লো।” বলেই স্টেনগান তুলল মঙ্গল সিং।

মুহুর্তের মধ্যে বিলু আর ভোম্বল ভল্ট খেয়ে মঙ্গল সিং-এর দু’পায়ের হাটুর পিছনের খাজে জোড়া পায়ে মারল মোক্ষম লাথি।

মঙ্গল সিং পা মচকে মুখ থুবড়ে কলাগাছের মতন পড়ল পায়েলদির চরণতলে।

হাতের স্টেনগানটা দূরে ছিটকে পড়ল।

পায়েলদি চকিতে কুড়িয়ে নিল সেটা।

মঙ্গল সিং পড়ে গেলেও চোখের পলকে উঠে দাঁড়াল। ওর ঠোটের পাশটা কেটে গিয়ে রক্ত ঝরছে দর দর করে। আচমকা ঘোর কেটে উঠে দাঁড়াতেই এদের তিনজনকে দেখে বলল, “আরে বাপ। ইতনা বঢ়িয়া বান্দর কাহাসে আয়া?

বাবলু বলল, “আমরা বান্দর নই মঙ্গল সিং, পাণ্ডব গোয়েন্দা।”

মঙ্গল সিং রাগে ফুলে উঠে বলল, “ও। আভি সমঝ গিয়া। ম্যায় তো দিনভর তুমহারাই ইন্তেজার করতে থে।”

ভোম্বল বলল, “যা বলছ বাংলায় বলো না বাবা, যাতে সব কথা বুঝতে পারি। এত হিন্দি যে মাথায় ঢোকে না।”

মঙ্গল সিং আস্তে আস্তে উঠে দাড়াল, “তুম বহুৎ খতরনক হো।”

বিলু বলল, ‘ও তো সবাই জানে।”

“তুমনে পুলিশবালেকো খবর দিয়া?”

“দিয়েছিই তো।”

“তো ঠিক হ্যায়। ম্যায় তুম সবকে জিন্দা নেহি ছোডুঙ্গা।”

বাবলু বলল, “তার আগে আমার একটু ঝাড় খাও।” বলেই বাবলু করল কী ঘন্টার দড়িটা ধরে ছুটে গিয়ে দোলন খেয়ে মঙ্গল সিং-এর মুখের ওপর জোড়া পায়ে মারল সজোরে লাথি।

আবার মুখ থুবড়ে ছিটকে পড়ল মঙ্গল সিং।

পায়েলদি তখনও শক্ত হাতে স্টেনগান ধরে আছে!

মঙ্গল সিং-এর কপাল কেটে রক্ত পড়ছে তখন। আবার যেই না সে উঠতে যাবে, ওদিক থেকে আর একটি ঘণ্টার দড়িতে দুলে ভোম্বল মারল আর এক লাথি।

মঙ্গল সিং আবার ছিটকে পড়ল।

বিলু বলল, “বাঃ! লাথি মারার এমন চমৎকার চান্সটা পেয়ে আমিই বা ছেড়ে দিই কেন? আমারও একটা হয়ে যাক।” বলে ওই একই কায়দায় বিলুও মারল আর এক লাথি।

অসহায় মঙ্গল সিংকে কায়দা করে লাথির পর লাথি মেরেই চলল সকলে।

কিন্তু পালাক্রমে এতগুলো লাথি খেয়েও মঙ্গল সিং-এর কিছু মাত্র হয়েছে বলে মনে হল না।

ওরই মধ্যে হঠাৎ একটু গড়িয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পায়েলদির ওপর। তারপর গায়ের জোরে ছিনিয়ে নিল স্টেনগানটা।

পায়েলদি চিৎকার করে উঠল, “বাবলু সাবধান!”

ততক্ষণে বাবলুর পিস্তল গর্জে উঠেছে, “ডিসু্ম।”

বিশাল শরীর নিয়ে মঙ্গল সিং লুটিয়ে পড়ল মেঝেতে। হাত থেকে স্টেনগান খসে পড়ল।

বাবলুরা নিশ্চিন্ত হয়ে এগিয়ে এল তার কাছে।

কিন্তু মঙ্গল সিং ওদের চেয়েও অনেক বেশি ধুরন্ধর। আসলে গুলিটা লেগেছিল তার ডান কাঁধে। পাছে

বাবলু ফের গুলি চালায় সেই ভয়ে মরে যাওয়ার ভান করল সে। তারপর বাবলুদের নিশ্চিন্ত হতে দেখেই হঠাৎ সে ঘূর্ণির মতো পাক খেয়ে সবাইকে এক ঝটকায় কাত করে লাফ দিয়ে সিঁড়ির কাছে গেল।

এইবার শুরু হল পঞ্চুর খেলা।

মঙ্গল সিং যত না ভয়ংকর, পঞ্চু তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর।

সেও তখন বিকট চিৎকার করে এক উন্মত্ত আক্রোশে লাফিয়ে পড়ল মঙ্গল সিং-এর কাঁধের ওপর। তারপর এক একটি কামড়ে ওর বৃষস্কন্ধ হতে এক এক খাবলা করে মাংস তুলে ফেলতে লাগল।

মঙ্গল সিংও কম যায় না। রক্তস্নাত অবস্থায় পঞ্চুকে এক হাতে শক্ত করে টিপে ধরে ছুড়ে ফেলে দিল এক পাশে।

পড়ে গিয়েও পঞ্চু আবার তাড়া করল নতুন উদ্যমে।

মঙ্গল সিং ম্যাজিকের মতো উধাও হয়ে গেল সেই ফাঁকে।

হতভম্ব বাবলু বলল, “চল—চল সব। শয়তানটাকে কোনওমতেই পালাতে দেওয়া যাবে না। পায়েলদি শিগগির আসুন। ব্যাটাকে ধরতেই হবে! না হলে হেলিকপ্টারে করে উড়ে পালাবে ও।”

বলেই আর কালবিলম্ব না করে ছুটল সকলে। ওরা বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল, জঙ্গলের দিকে ছুটছে মঙ্গল সিং। “ওই—ওই তো ছুটছে!” বাবলুরাও ছুটল। চারদিকে তখন থিক থিক করছে পুলিশ। কিন্তু মঙ্গল সিং-এর সেদিকে নজর নেই। সে সকাল থেকে পড়ে থাকা সেই হেলিকপ্টারটার ওপর লাফ দিয়ে উঠল। পঞ্চু ছুটে এসে আবার আক্রমণ করল তাকে। মঙ্গল সিং সেই অবস্থাতেই হেলিকপ্টারটা উড়িয়ে দিল। চিৎকার করে উঠল বাবলুরা।

কিন্তু এ কী! হেলিকপ্টার একটু উড়েই কীসের টানে যেন ধুপ করে পড়ে গেল মাটিতে। দেখা গেল হেলিকপ্টারটা একটা গাছের সঙ্গে মোটা কাছি দিয়ে কে যেন বেঁধে রেখেছে। কার কীর্তি-এ! কে করেছে এই কাজ? বাবলুরা তো নয়।

সেটা পড়ে যেতেই গাছের আড়াল থেকে প্রশান্ত বদনে সেই সাধুকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। সাধুর হাতে চক চক করছে একটা রিভলভার।

সাধুবাবা বললেন, “ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট ডাকু মঙ্গল সিং।”

কয়েকজন পুলিশ এসে মঙ্গল সিং-এর হাতে হাতকড়া পরাল। পাহাড়ের ঢালে সারি সারি ডাকাত তখন বন্দি অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বাবলুরা সাধুকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলল, “এ কী! আপনি? আপনি তা হলে সত্যিকারের সাধু নন?”

সাধুবাবা বললেন, “তোমরাও তো সত্যিকারের হনুমান নও।” বলেই সাধুবাবা তার নকল জটা দাড়ি সব খুলে ফেললেন।

ওদিকে বাবলুদের বহু পরিচিত দারোগাবাবু এবং বিহার পুলিশের ইনস্পেক্টররা সবাই এগিয়ে এলেন। দারোগাবাবু বললেন, “তোমাদের কারও কোনও আঘাত লাগেনি তো?”

বাবলু বলল, “না। তবে আমাদের বাচ্চু-বিচ্ছুর কোনও খোজ পাচ্ছি না আমরা।”

“ওদের জন্য চিন্তা কোরও না। ওরা মোসাবনীতে পুলিশের হেফাজতে আছে।”

বাবলু বলল, “কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না আপনারা খবর পেলেন কী করে?”

দারোগাবাবু বললেন, “দেখো বাবলু, মঙ্গল সিংকে ধরবার চেষ্টা ভেতরে ভেতরে পুলিশও অনেকদিন ধরে করছিল। কাজেই আমি যখনই বুঝলাম তোমরা এখানে আসবেই, তখন তোমাদের আসবার আগেই আমি ব্যাপারটা বিহার পুলিশের নজরে আনি এবং তোমাদের বডি গার্ড হিসেবে দুদে সি আই ডি মি. শাসমলকে এখানে পাঠাই।”

বিলু বলল, “বাচ্চু-বিচ্ছুকে আপনারা কীভাবে পেলেন?”

সেদিন বাচ্চু-বিচ্ছুকে নিয়ে দস্যুরা যখন পালাচ্ছিল তখন আমরাই তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করে লক-আপে দিই। এবং বাচ্চু-বিচ্ছুকে উদ্ধার করি। অপরজন পালায়। রুদ্রনারায়ণবাবুর নাতিকেও তোমাদের সামনে থেকে আমরাই নিঃশব্দে সরিয়ে নিই। তা ছাড়া তোমরা যে বাড়িতে উঠেছ তার বাড়িওয়ালি ওই হিমিও মিস পায়েলের অপহরণের সংবাদ আমাদের দেয়। কাজেই—।”

বাবলু বলল, “আচ্ছা, দস্যুদের দুটো স্টেনগান তো আমি গাছের ডালে লুকিয়ে রেখেছিলাম। তার একটা পেয়েছি। আর একটা কি— ?”

মি. শাসমল বললেন, “আর একটা আমার হেফাজতে আছে। সাসপেন্স ক্রিয়েট করবার জন্যই ওটা আমি সরিয়ে নিয়েছিলাম। তা ছাড়া তোমাদের নিরাপত্তার জন্যও । আনাড়ি হাতে তো ওসব চালানো যায় না। তুমি যদিও পারো অন্যেরা পারত না। উপরন্তু ওইসব ব্যবহার করতে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা বাঁধিয়ে বসত।”

কথা বলতে বলতেই সকলে পাহাড়ের সেই ঢালের ওপর উঠে এল। রাত বোধহয় শেষ হয়ে এসেছে। দারোগাবাবু বললেন, “এই রাতে আর নয়। ভোর হলে সবাই একসঙ্গে যাব, কেমন?”

ভোম্বল বলল, “কখন যে ভোর হবে! আমার কিন্তু দারুণ খিদে লেগে গেছে।”

মি. শাসমল বললেন, “সকালটা একবার হোক না। তারপর দেখব কত কী খেতে পার। ওদিকে রুদ্রনারায়ণবাবু আমাদের জন্য এক বিরাট ভূরিভোজের আয়োজন করে বসে আছেন।”

ভোম্বলের জিভে জল এল বুঝি। খাবার লোভে ওর চোখদুটো চকচকিয়ে উঠল।

যথাসময়ে ভোর হল।

সেই বিরাট পুলিশ বাহিনী নিয়ে মঙ্গল সিংকে দলবল সমেত গ্রেপ্তার করে ওরা যখন মোসাবনীতে ফিরে এল, তখন হাজার হাজার মানুষ ওদের দেখবার জন্য অপেক্ষা করছে।

রুদ্রনারায়ণবাবুর হাতে একটি ফুলের মালা। সে মালাটি তিনি নিজে হাতে পরিয়ে দিলেন বাবলুর গলায়।

বাচ্চু-বিচ্ছু এবং রুদ্রনারায়ণবাবুর নাতি প্রতাপ ছুটে এসে বাবলুকে জড়িয়ে ধরল। বাবলু নিজের গলা থেকে মালাটি খুলে পরিয়ে দিল পঞ্চুর গলায়।

পঞ্চু আনন্দে ডেকে উঠল—“ভৌ। ভৌ-ভৌ।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *