Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সাংঘাতিক || Narayan Gangopadhyay

সাংঘাতিক || Narayan Gangopadhyay

সাত দিন পরেই পরীক্ষা। আর কী? সেই কালান্তক স্কুল-ফাইন্যাল।

পর পর দুবার শাদা কালিতে আমার নাম ছাপা হয়েছে, তিন বারের বার যদি তাই ঘটে–তাহলে বড়দা শাসিয়েছে আমাকে সোদপুরে রেখে আসবে।

–সোদপুরে তো গান্ধীজী থাকতেন। আমি গম্ভীর হয়ে বলেছিলাম।

–তুমিও থাকবে। বড়দা আরও গম্ভীর হয়ে বললে, তবে গান্ধীজী যেখানে থাকতেন সেখানে নয়। তিনি যাদের দুধ খেতেন–তাদের আস্তানায়।

–মানে?

–মানে পিঁজরাপোলে।

আমি ব্যাজার হয়ে বললাম, পিজরাপোলে কেন থাকতে যাব? ওখানে কি মানুষ থাকে?

মানুষ থাকে না, গোরু-ছাগল তো থাকে। সেজন্যেই তো তুই থাকবি। কচিকচি ঘাস খাবি আর ভ্যা-ভ্যা করে ডাকবি। শুনে মনটা এত খারাপ হল যে কী বলব। একদিন সন্ধেবেলা গড়ের মাঠে গিয়ে চুপি চুপি একমুঠো কাঁচা ঘাস খেয়ে দেখলাম–যাচ্ছেতাই লাগল! ছাদে গিয়ে একা-একা ব্যা ব্যা করেও ডাকলাম, কিন্তু ছাগলের মতো সেই মিঠে প্রাণান্তকর আওয়াজটা কিছুতেই বেরুল না।

তাই ভারি দুশ্চিন্তায় পড়লাম। গিয়ে বললাম লিডার টেনিদাকে।

টেনিদার অবস্থা আমার মতোই। এবার নিয়ে ওর চারবার হবে। হাবুল সেনের দ্বিতীয় বার। শুধু হতভাগা ক্যাবলাটাই লাফে লাফে ফার্স্ট হয়ে এগিয়ে আসছে–তিন ক্লাস নীচে ছিল, ঠিক ধরে ফেলেছে আমাকে। এর পরে যদি টপকে চলে যায় তাহলে সত্যিই পিঁজরাপোলে যেতে হবে!

চাটুজ্যেদের রোয়াকে বসে টেনিদা আতা খাচ্ছিল। গভীরভাবে চিন্তা করতে গিয়ে গোটাকয়েক বিচি খেয়ে ফেললে। তারপর অন্যমনস্কভাবে, খোসাটা যখন অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, তখন সেটাকে থুথু করে ফেলে দিয়ে বললে, ইউরেকা। হয়েছে।

–কী হয়েছে?

–প্ল্যানচেট।

–প্ল্যানচেট কাকে বলে?

টেনিদা বললে, তুই একটা গাধা। প্ল্যানচেট করে ভূত নামায়–জানিসনে?

এর মধ্যেই কোত্থেকে পাঁঠার ঘুগনি চাটতে চাটতে ক্যাবলা এসে পড়েছে। বললে, উঁহু, ভুল হল। ওর উচ্চারণ হবে প্লাসে।

–থাম-থাম–বেশি ওস্তাদি করিসনি! ভূতের কাছে আবার শুদ্ধ উচ্চারণ! তারা তো চন্দ্রবিন্দু ছাড়া কথাই কইতে পারে না–বলেই ছোঁ মেরে ক্যাবলার হাত থেকে ঘুগনির পাতাটা কেড়ে নিল টেনিদা।

ক্যাবলা হায় হায় করে উঠল। টেনিদা একটা বাঘাটে হুঙ্কার করে বললে, থাম, চিল্লাসনি। এ হল তোর ধৃষ্টতার শাস্তি। বলতে বলতে জিভের এক টানে ঘুগনির পাতা একদম সাফ।

ভেবেছিলাম আমাকেও একটু দেবে–কিন্তু পাতার দিকে তাকিয়ে বুকভরা আশা একেবারে ধুক করে নিবে গেল। বললাম, মরুক গে, প্ল্যানচেট আর প্লাসে কিন্তু ওসব ভুতুড়ে কাণ্ড আবার কেন? ভূত-টুত আমার একেবারেই পছন্দ হয় না।

টেনিদা হেঁ-হেঁ করে বললে, আছে রে গোমুখ–আছে। সবাই কি আর তালগাছের মতো হাত বাড়িয়ে ঘাড় মটকে দেয়? ওদের মধ্যেও দু-চারটে ভদ্র লোক আছে। তারা পরীক্ষার কোশ্চেন-টোশ্চেন বলে দেয়।

–অ্যাঁ?

–তবে আর বলছি কী! টেনিদা এবার শালপাতার উলটো দিকটা একবার চেটে দেখল। কিছু পেলে না–তালগোল পাকিয়ে ক্যাবলার মুখের ওপর পাতাটা ছুঁড়ে দিলে। বললে, আমার বিরিঞ্চি মামা কিছুতেই আর বি. এ পাশ করতে পারে না। গুনে গুনে আঠারো বার। গাঁজা খেলো। শেষকালে যখন আমার মামাতো ভাই গুবরে বি. এ ক্লাসে উঠল, তখন মামা কিছুতেই আর বি,এলার মুখের ওপর পাতা একবার চেটে বিরিঞ্চি মামার আর সইল না। প্ল্যানচেটে বসল। আর বললে পেত্যয় যাবি না প্যালাটপ টপ করে কোশ্চেন-পেপার এসে পড়তে লাগল টেবিলের ওপর।

–পরীক্ষার পরে না আগে? রোমাঞ্চিত হয়ে আমি জানতে চাইলাম।

দূর উল্লুক! পরে হবে কেন রে, একমাস আগে।

হঠাৎ ক্যাবলা একটা বেয়াড়া প্রশ্ন করে বসল।

–আচ্ছা টেনিদা সবসুদ্ধ তোমার ক’টা মামা?

–অত খবরে তোর দরকার কী রে গর্দভ? পুলিশ কমিশনার থেকে পকেটমার পর্যন্ত সারা বাংলাদেশে আমার যত মামা, তাদের লিসটি করতে গেলে একটা গুপ্ত প্রেসের পঞ্জিকা হয়ে যায়–তা জানিস?

–ছাড়ান দে–ছাড়ান দে। বললে হাবুল সেন।

আমি বললাম, আমাদের অঙ্কের কোশ্চেন যে করেছে সে কি তোমার মামা হয় নাকি?

–কে জানে, হতেও পারে! টেনিদা তাচ্ছিল্য করে জবাব দিলে।

–তা হলে তাকেই প্ল্যানচেটে ডাকো না!

–চুপ কর বেল্লিক! জ্যান্ত মানুষ কি কখনও প্লানচেটে আসে? ভূতকে ডাকতে হয়। ভূতের অসীম ক্ষমতা–যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। তেমন-তেমন ভূত যদি আসে ব্যস্–মার দিয়া কেল্লা!

–বেশ তো-আনো না তবে ভূতকে? আমি অনুনয় করলাম।

–বললেই হল? টেনিদা প্রায় ভূতের মতো দাঁত খিচোল : ভূত কি চানাচুরওয়ালা যে ডাকলেই আসবে? তার জন্যে হ্যাঁপা আছে না? অন্ধকার ঘর চাই–টেবিল চাই–চারজন লোক চাই—

ক্যাবলার চোখ দুটো মিটমিট করছিল। বললে, ঠিক আছে। আমাদের গ্যারাজের পাশে একটা অন্ধকার ঘর আছে–একটা পা-ভাঙা টেবিল আমি দেব, আর চার মূর্তি আমরা তো আছিই।

টেনিদা বললে, বাঃ, গ্র্যান্ড! শুনে এত ভালো লাগছে যে তোর পিঠে আমার তিনটে চাঁটি মারতে ইচ্ছে করছে!

ক্যাবলা একলাফে রোয়াক থেকে নেমে পড়ল। বললে, তা হলে আজ রাত্রেই?

টেনিদা বললে, হ্যাঁ–আজ রাত্রেই।

আমার কেমন যেন সুবিধে মনে হচ্ছিল না। ভূত-টুত কেমন যেন গোলমেলে ব্যাপার! কিন্তু সাতদিন পরেই যে স্কুল ফাঁইন্যাল! আর তার দেড়মাস বাদেই পিঁজরাপোল!

অগত্যা নাক-টাক চুলকে আমায় রাজি হয়ে যেতে হল।

বাড়ির পেছনে গ্যারাজ–এমনি ঘুরঘুটটি অন্ধকার সেখানে, গ্যারাজের পাশের ছোট টিনের ঘরটা যেন ভুযো কালি মাখানো। গিয়ে দেখি ক্যাবলা সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একটা পায়া-ভাঙা টেবিল। তার চারদিকে চারটে চেয়ার। একটু দূরে লম্বা দড়ির সঙ্গে ছোট একটা বস্তা ঝুলছে। টেবিলের ওপর ক্যাবলা একটা মোমবাতি জ্বেলে রেখেছিল–তার আলোতেই সব দেখতে পেলাম।

বস্তাটা দেখিয়ে হাবুল বললে, ওইটা কী ঝুল্যা আছে রে! খাওন-দাওনের কিছু আছে নাকি?

টেনিদা বললে, পেট-সর্বস্ব সব–খালি খাওয়াই চিনেছে! ওটা বকসিংয়ের বালির বস্তা।

–ভূত আইস্যা ওইটা লইয়া বকসিং কোরব নাকি? হাবুলের জিজ্ঞাসা।

ক্যাবলা হেসে বললে, ওটা ছোড়দার।

টেনিদা বললে, থাম–এখন বেশি বাজে বকিসনি। এবার কাজ শুরু করা যাক। হ্যাঁ রে ক্যাবলা–এদিকে কেউ কখনও আসবে না তো?.

–না, সে ভয় নেই।

–তবে দরজা বন্ধ করে দে।

ক্যাবলা দরজা বন্ধ করে দিলে। টেনিদা বললে, চারজনে চারটে চেয়ারে বসব আমরা। আলো নিবিয়ে দেব। তারপরে ধ্যান করতে থাকব।

–ধ্যান? কীসের ধ্যান?–আমি জানতে চাইলাম।

–ভূতের। মানে অঙ্কের কোশ্চেন বলে দিতে পারে–এমন ভূতের।

হাবুল বললে, সেইডা মন্দ কথা না। হারু পণ্ডিতের ডাকন যাউক।

হারু পণ্ডিত! শুনে আমার বুকের ভেতরে একেবারে ছাত করে উঠল। তিন বছর আগে মারা গেছেন হারু পণ্ডিত। দুর্দান্ত অঙ্ক জানতেন। তার চাইতেও জানতেন দুর্দান্তভাবে পিটতে। একটা চৌবাচ্চার নল দিয়ে জল-টল ঢোকার কী সব অঙ্ক দিতেন, আমরা হাঁ করে থাকতাম আর পটাৎ পটাৎ গাঁট্টা খেতাম। সেই হারু পণ্ডিতকে ডাকা।

আমি বললাম, বড় মারত যে!

-এখন আর মারবে না। ভূত হয়ে মোলায়েম হয়ে গেছে। তা ছাড়া কেউ তো ডাকে–আমরা ডাকলে কত খুশি হবে দেখিস। শুধু অঙ্ক কেন–চাই কি আদর করে সব কোশ্চেনই বলে দেবে! টেনিদা আমাকে উৎসাহিত করলে।

ক্যাবলা বললে, তবে ধ্যানে বসা যাক।

আমি বললাম, হ্যাঁ ভাই, একটু তাড়াতাড়ি। বেশি দেরি হয়ে গেলে বড়দা কান পেঁচিয়ে দেবে। আমি বলে এসেছি ক্যাবলার কাছে অঙ্ক কষতে যাচ্ছি।

টেনিদা বললে, আমি আলো নিবিয়ে দিচ্ছি। তার আগে শেষ কথাগুলো বলে নিই। সবাই হারু পণ্ডিতকে ধ্যান করবি। এক মনে, এক প্রাণে। সেই দাড়ি–সেই ডাঁটভাঙা চশমা, সেই টাক–সেই নস্যি নেওয়া–

ক্যাবলা বললে, সেই গাঁট্টা–

টেনিদা ধমক দিয়ে বললে, চুপ, বাজে কথা এখন বন্ধ। শুধু ধ্যান। এক মনে, এক প্রাণে। শুধু প্রার্থনা : “স্যার–দয়া করে একবার আসুন–আপনার অধম ছাত্রদের পরীক্ষার কোশ্চেনগুলো বলে দিয়ে যান।” আর কিছু না–আর কোনও কথা নয়। আচ্ছা আমি আলো নেবাচ্ছি। ওয়ান-টু-থ্রি—

টুক করে আলো নিবে গেল।

বাপস, কী অন্ধকার! দম যেন আটকে যায়। ভয়ে আমার গা শিরশির করতে লাগল। ধ্যান করব কী ছাই, এমনিতেই মনে হচ্ছিল, চারদিকে যেন সার বেঁধে ভূত দাঁড়িয়ে আছে।

তবু ধ্যানের চেষ্টা করা যাক। কিন্তু কী যাচ্ছেতাই মশা এ-ঘরে। পা দুটো একেবারে ফুটো করে দিচ্ছে। অনেকক্ষণ দাঁত-টীত খিঁচিয়ে থেকে আর পারা গেল না। চটাস করে একটা চাঁটি মারলাম।

কিন্তু একি! পায়ে চাঁটি মারলাম কিন্তু লাগল না তো? আমার পা কি একেবারে অসাড় হয়ে গেছে? আর আমার পাশ থেকে হাবুল তখুনি হাঁইমাই করে চেঁচিয়ে উঠল : অ টেনিদা, ভূতে আমার পায়ে ঠাঁই কইর‍্যা একটা চোপড় মারছে।

টেনিদা বললে, শাট আপ। ধ্যান করে যা।

–কিন্তু আমারে যে চোপড় মারল।

–ধ্যান না করলে আরও মারবে। চোখ বুজে বসে থাক।

আমি একদম চুপ। এঃ হে-হে–ভারি ভুল হয়ে গেছে। অন্ধকারে নিজের ঠ্যাং ভেবে হাবুলের পায়েই চড় মেরে দিয়েছি।

আরও কিছুক্ষণ কাটল। ধ্যান করবার চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হারু পণ্ডিতের টাক আর দাড়িটা বেশ ভাবতে পারছি, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই গাঁট্টটাও বিচ্ছিরিভাবে মনে পড়ে যাচ্ছে। তক্ষুনি ধ্যান বন্ধ করে দিচ্ছি। ওদিকে আবার দারুণ খিদে পাচ্ছে। আসবার সময় দেখেছি রান্নাঘরে মাংস চেপেছে। এতক্ষণে হয়েও গেছে বোধহয়। বাড়িতে থাকলে ঠাকুরের কাছে গিয়ে এক-আধটু চাখতে-টাখতেও পারতাম। যতই ভাবি, খিদেটা ততই যেন নাড়ির ভেতরে পাক খেতে থাকে।

হঠাৎ অন্ধকার ভেদ করে রব উঠল : ব্যা-ব্যা-ব্যা–অ্যা-অ্যা–

কী সর্বনাশ! ধ্যান করতে করতে শেষকালে পাঁঠার আত্মা ডেকে আনলাম নাকি! এতক্ষণ যে মাংসের কথাই ভাবছিলাম।

আমার পাশ থেকে হাবুল কাঁপা গলায় বললে, অ টেনিদা–পাঁঠা ভূত!

অন্ধকারে টেনিদা গর্জন করলে : যেমন তোরা পাঁঠা-পাঁঠা ভূত ছাড়া আর কী আসবে তোদের কাছে।

ক্যাবলা খিকখিক করে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গেই আবার শোনা গেল : ভ্যা–অ্যা–অ্যা–অ্যা–

টেনিদা বললে, অমন কত আসবে। ধ্যানে বসলে সবাই আসতে চায় কিনা। এখন কেবল একমনে জপ করে যা–পাঁঠা ভূত, তুমি চলে যাও, স্বর্গে গিয়ে ঘাস খাও। আমরা শুধু হারু পণ্ডিতকে চাই। সেই টাক, সেই দাড়ি–সেই নস্যির ডিবে–আমাদের সেই স্যারকেই চাই। আর কাউকে না–কাউকেই না–

পাঁঠা ভূতকে যে আমিই ডেকে ফেলেছি সেটা চেপে গেলাম। কিন্তু আমার পায়ে ওটা কী সুড়সুড়ি দিয়ে গেল? প্রায় চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছি হঠাৎ টের পেলাম–আরোশোলা।

খিদেটা ভুলে গিয়ে প্রাণপণে স্যারকে ডাকতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু বেশিক্ষণ ধ্যানের জো আছে? ঘটাং করে কে যেন আমার পায়ে ল্যাং মারল।

–টেনিদা। ভূতে ল্যাং মারছে আমাকে–আমি আর্তনাদ করলাম।

হাবুল বলে উঠল : আঃ–খামখা গাধার মতন চাঁচাস ক্যান? আমার পা-টা হঠাৎ লাইগ্যা গেছে।

টেনিদা দাঁত কিড়মিড় করে উঠল : উঃ–এই গাড়লগুলোকে নিয়ে কি ধ্যান হয়? তখন থেকে সমানে ডিসটার্ব করছে। এবার যে একটা কথা বলবে, তার কান ধরে সোজা বাইরে ফেলে দেব।

আবার ধ্যান শুরু হল।

প্রায় হারু পণ্ডিতকে ধ্যানের মধ্যে এনে ফেলেছি। এল, এল–এসেই পড়েছে বলতে গেলে। টাকটা প্রায় আমার চোখের সামনে-মনে হচ্ছে যেন দাড়ির সুড়সুড়ি আমার মুখে এসে লাগছে। একমনে বলছি : দোহাই স্যার, স্কুল ফাঁইন্যাল স্যার–অঙ্কের কোশ্চেন স্যার।–আর ঠিক তক্ষুনি–

কেমন একটা বিটকেল শব্দ হল মাথার ওপর।

চমকে তাকাতে দেখি টিনের চালের গায়ে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ঠিক যেন মোটা মোটা চশমার আড়াল থেকে হারু পণ্ডিত আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আমার পালাজ্বরের পিলেটা সঙ্গে সঙ্গে তড়াং করে লাফিয়ে উঠল।

–ওকি–ওকি টেনিদা।–আমি আবার আর্তনাদ করে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে সেই জ্বলন্ত চোখ দুটো যেন শূন্য থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ল–আর আমার মাথায় এসে লাগল এক রামচাঁটি। ভূত হয়ে সে চাঁটি মোলায়েম হওয়া তো দূরে থাক–আরও মোক্ষম হয়ে উঠেছে।

বাপ্ রে গেছি বলে আমি এক প্রচণ্ড লাফ মারলাম। সঙ্গে সঙ্গে টেবিল উলটে পড়ল।

–খাইছে–খাইছে–ভূতে খাইছে রে-হাবুল কেঁদে উঠল।

–টেবিল চাপা দিয়ে আমায় মেরে ফেলে দিলে রে–টেনিদার চিৎকার শোনা গেল।

অন্ধকারে আমি দরজার দিকে ছুটে পালাতে চাইলাম। সঙ্গে সঙ্গেই কে যেন আমার ঘাড়ে লাফ দিয়ে পড়ল। আমার গলা দিয়ে–গ্যাঁ- ঘোঁক–বলে একটা আওয়াজ বেরুলো-আর তার পরেই–সর্ষে ফুল। ঝিঁঝির ডাক। পটলডাঙার প্যালারাম একেবারে ঠায় অজ্ঞান।

চোখ মেলে দেখি, মেঝেয় পড়ে আছি। ঘরে মোমবাতি জ্বলছে, আর ক্যাবলা আমার মাথায় জল দিচ্ছে। চেয়ার টেবিলগুলো ছত্রাকার হয়ে আছে ঘরময়।

আমি বললাম, ভু–ভু–ভূত।

ক্যাবলা বললে, না–ভূত নয়। টেনিদা আর হাবুল তক্ষুনি পালিয়েছে বটে, কিন্তু তোকে চুপি চুপি সত্যি কথা বলি। ঘরটার পেছনেই একটা ছাগল বাঁধা আছে। দাদুর হাঁপানি রোগ আছে কিনা, ছাগলের দুধ খায়। সেই ছাগলটাই ডাকছিল।

–আর সেই জ্বলজলে চোখ? সেই চাঁটি?

–হুলোর।

–হুলো কে?

–আমাদের বেড়াল। এ-ঘরে প্রায়ই ইঁদুর ধরতে আসে।

–কিন্তু হুলো কি অমন চাঁটি মারতে পারে?

–চাঁটি মারবে কেন রে বোকা? তুই চ্যাঁচালি–ভয় পেয়ে হুলোও চাল থেকে লাফ দিলে। পড়বি তো পর ছোড়দার স্যান্ডব্যাগের ওপরে। আর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগ দোল খেয়ে

এসে তোর মাথায় লাগল–তুই ভাবলি হারু পণ্ডিতের গাঁট্টা।ক্যাবলা হেসে উঠল।

–আর আমার ঘাড়ে অমন করে লাফিয়ে পড়ল কে?

–হাবলা। ভয় পেয়ে বেরুতে গিয়ে তোকে বিধ্বস্ত করে চলে গেছে।ক্যাবলা হেসে উঠল আবার।

আমি আবার চোখ বুজলাম। ক্যাবলার কথাই হয়তো ঠিক। কিন্তু আমার মন বলছে–ওই হুলো আর বালির বস্তার মধ্য দিয়ে সত্যি সত্যিই হারু পণ্ডিতের মোম চাঁটি আমার মাথায় এসে লেগেছে।

কারণ, পৃথিবীতে অমন দুর্মদ চাঁটি আর কেউ হাঁকড়াতে পারে না। আর কিছুতেই না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress