আরাকু ভ্যালি
আরাকু ভ্যালিতে সাধারণত সবাই ট্রেনে চেপেই যায়। দু পাশের দৃশ্য অতি সুন্দর। কিন্তু কাকাবাবু একটা জিপগাড়ি ভাড়া নিলেন। ওখানকার পাহাড়ি রাস্তায় তিনি বেশি হাঁটাচলা করতে পারবেন না ক্রাচ নিয়ে। গাড়ি লাগবেই।
ড্রাইভারটির নাম সুলেমান খান। এখানকার অধিকাংশ লোক হিন্দি জানে, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজি জানে। যারা ইংরেজিও শেখেনি, তাদের সঙ্গে কথা বলা খুব মুশকিলের ব্যাপার। সুলেমান কিছু কিছু হিন্দিও বলতে পারে। সুলেমানের বাড়ি অনন্তগিরিতে, সেইজন্য সে এদিককার রাস্তাঘাট ভাল চেনে।
প্রথমদিকে বেশ কিছুটা সমতলের রাস্তা, তারপর পাহাড়ে উঠতে হয়। সুলেমানের সঙ্গে খানিকক্ষণ গল্প করে কাকাবাবু বই খুলে পড়তে লাগলেন।
পৌঁছতে-পৌঁছতে বিকেল হয়ে গেল। দুপুরে এক জায়গায় থেমে রুটি-মাংস খেয়ে নিয়েছেন দুজনে। জিপটাও মাঝখানে একবার গণ্ডগোল করেছিল।
আগে থেকেই খবর নিয়েছিলেন যে, এখানে একটা টুরিস্ট গেস্ট হাউস আছে। সেটার নাম ময়ূরী। নামের বাহার থাকলেও সেটার বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। একটা ঘর পাওয়া গেল অবশ্য, দেওয়াল নোনা। ধরা, জানলার পরদা ঘেঁড়া, বিছানার চাদর নোংরা। কাকাবাবু ওসব গ্রাহ্য করলেন না। যখন যেমন পাওয়া যায়, তেমন জায়গাতেই থাকতে তিনি অভ্যস্ত।
আজ আর কোথাও বেরোবেন না বলে সুলেমানকে তিনি ছুটি দিলেন।
তারপর স্নানটা সেরে গেস্ট হাউসের বাইরে একটা গোল, বাঁধানো চাতালে এসে বসলেন।
সন্ধে হতে একটু বাকি আছে। আকাশ শেষ-সূর্যের আলোয় লাল।
কাকাবাবু ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন চারদিকটা। সবদিকেই পাহাড়। গোল। করে পাহাড় দিয়ে ঘেরা, মাঝখানে এই উপত্যকা। এরকম জায়গা খুব কমই দেখা যায়। বেশ একটা শান্ত সৌন্দর্য আছে। এখনও হোটেল-টোটেল তেমন হয়নি বলে বেশি লোক এখানে আসে না।
দিনের বেলায় যথেষ্ট গরম ছিল, এখন বাতাসে শীত শীত ভাব। ঘর থেকে একটা চাদর নিয়ে এলে ভাল হয়। কিন্তু কাকাবাবু উঠলেন না। একটু-একটু করে আলো কমে আসছে, দিগন্তের পাহাড়গুলো মিলিয়ে যাচ্ছে, এই দৃশ্যটা তাঁর দেখতে ভাল লাগছে।
হঠাৎ তিন-চারজন লোক সেখানে এসে জোরে জোরে গল্প শুরু করে দিল।
টুরিস্ট হাউসে সাইকেলে চেপে লোক আসছে। এত লোক এখানে নিশ্চয়ই আসে না। ওরা বোধ হয় এখানে খেতে আসে। কিন্তু মাত্র সাড়ে ছটা বাজে, এখনও তো খাওয়ার সময় হয়নি।
এটা বোধ হয় স্থানীয় লোকদের একটা আড্ডাখানা।
অনেক লোকই কাকাবাবুর দিকে ফিরে ফিরে তাকাচ্ছে। এখানে নিশ্চয়ই তাঁকে কেউ চিনতে পারবে না। তবু তাঁর মতন একজন লম্বা-চওড়া লোক, ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন, এতেই লোকে কৌতূহলী হয়।
কাকাবাবু এখানে এসে ম্যানেজারের সঙ্গে দু-একটা কথা বলা ছাড়া আর কারও সঙ্গেই কথা বলেননি।
এক-একদিন তাঁর লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছেই করে না।
বকবক-করা লোকগুলো থেকে খানিকটা সরে গিয়ে কাকাবাবু আর একটা নির্জন জায়গায় বসে রইলেন অনেকক্ষণ। আকাশে তারা ফুটছে একটা-একটা করে। চাঁদও উঁকি মারছে দিগন্তে। এইরকম সময়ে চুপচাপ বসে থাকতেই ভাল লাগে।
রাত দশটা বাজতেই কাকাবাবু সামান্য কিছু খেয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলেন নিজের ঘরের। শীত বেশ বেড়েছে, এখন আর বাইরে বসা যাবে না।
ঘরের আলোটা টিমটিম করছে, এই আলোতে বই পড়া যাবে না, এখন ঘুমিয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু করার নেই।
দরজাটা একবার পরীক্ষা করে নিলেন কাকাবাবু। মোটেই মজবুত নয়। ছিটকিনিটা ঠিকমতো লাগে না। একটিমাত্র জানলারও তারের জাল ছেঁড়া। এখানে আশা করা যায়, কেউ উপদ্রব করতে আসবে না, তবু সাবধানের মার নেই, কাকাবাবু রিভলভারটা রেখে দিলেন বালিশের তলায়।
মাঝরাতেই একবার তাঁর ঘুম ভেঙে গেল।
কারা যেন হইহল্লা করছে পাশের ঘরে। তিনি জোর করে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সারারাতই তাঁর ভাল করে ঘুম হল না।
সকালবেলা সুলেমানকে নটার মধ্যে গাড়ি নিয়ে চলে আসতে বলেছিলেন, সে আর আসে না। সাড়ে নটা, দশটা বেজে গেল, কাকাবাবু অস্থির বোধ করতে লাগলেন। তিনি তৈরি হয়ে বসে আছেন।
এখানকার লোকগুলোর সময়জ্ঞান নেই একেবারে? সুলেমান শেষপর্যন্ত এল সওয়া এগারোটায়।
তাকে বকুনি দেওয়ার আগেই সে কাঁচুমাচুভাবে জানাল যে, জিপটা কিছুতেই স্টার্ট নিচ্ছিল না। এখানে একটাই মোটে গাড়ি সারাবার জায়গা আছে। সেটা খোলে দশটায়। সেখান থেকে গাড়ি সারিয়ে আনতে দেরি হল।
কাকাবাবু বললেন, এখন ঠিকঠাক চলবে তো?
সুলেমান বলল, হ্যাঁ সার, আর কোনও গোলমাল নেই।
গাড়িতে উঠে কাকাবাবু বললেন, বোরা কেস-এ যাব। রাস্তা চেনো তো?
সুলেমান বলল, বোরাগুহালু? হ্যাঁ, চিনি। আগে অনেক লোককে নিয়ে গেছি।
গাড়িটা বড় রাস্তায় পড়ে ডান দিকে কিছুটা এগোতেই আর-একটা জিপগাড়ি খুব জোরে ওভারটেক করে সামনে গিয়ে থেমে পড়ল। সেটা পুলিশের গাড়ি।
সেই গাড়ি থেকে একজন লম্বা লোক নেমে এসে বলল,
গুড মর্নিং সার। আমি আরাকু থানার ও. সি.। আপনার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।
কাকাবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, আমার সঙ্গে? কেন বলুন তো!
লোকটি একগাল হেসে বলল, বাঃ, আপনি বিখ্যাত লোক। আমাদের এলাকায় এসেছেন, আলাপ করব? কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
তারপর বললেন, আমার কথা কে বলেছে আপনাকে? আপনি আমাকে চিনলেন কী করে?
লোকটি কাকাবাবুর ক্রাচ দুটির ওপর নজর বুলিয়ে বলল, আপনাকে দেখলেই চেনা যায়। আপনি টুরিস্ট গেস্ট হাউসে উঠেছেন, সে-খবর পেয়েছি।
ভাইজাগ থেকে ডি. আই. জি. সাহেব রাজমহেন্দ্ৰী ফোন করে আপনার কথা জানালেন।
এবার বোঝা গেল। রাজমহেন্দ্ৰী নিশ্চয়ই ভার্গবকে ফোন করেছিলেন। ওঁর কাছ থেকেই কাকাবাবুর এখানে আসার কথা জেনেছেন।
ও. সি. বলল, সার, আমার নাম বিসমিল্লা খান। আপনার এখানে দেখাশুনোর সব ভার আমার ওপর ছেড়ে দিন। যা দরকার হয় আমাকে হুকুম করবেন।
কাকাবাবু এবার সামান্য হেসে বললেন, আমি বেড়াতে এসেছি। দেখাশুনো করার তো কিছু দরকার নেই। ঠিক আছে, আপনার সঙ্গে আলাপ হয়ে ভাল লাগল। নমস্কার।
বিসমিল্লা খান বলল, আমার কোয়ার্টার কাছেই। একবার আসুন সার, একটু চা খেয়ে যাবেন।
কাকাবাবু বললেন, অনেক বেলা হয়ে গেছে, এখন আর চা খাব না। আমি বোরা কেভস দেখতে যাচ্ছি।
বিসমিল্লা বলল, সে তো অনেকক্ষণ খোলা থাকবে। একটু পরে যাবেন। চা না খান, শরবত খাবেন চলুন সার।
রাজমহেন্দ্ৰী সাহেব বলে দিয়েছেন, আপনার যত্নের যেন কোনও ত্রুটি না হয়। আপনি সি. বি. আই.-এর বড় অফিসার।
কাকাবাবু বললেন, না, না, আমি সি. বি. আই.-এর কেউ না। শুনুন বিসমিল্লা সাহেব, বেশি যত্ন করার দরকার নেই। আমি এখন শরবতও খাব না। বোরা কেভস ঘুরে আসি। ওবেলা আপনার সঙ্গে দেখা করব।
বিসমিল্লা খান আরও কিছুক্ষণ ঝুলোঝুলি করল, সময় নষ্ট হল অনেকটা।
গাড়ি আবার স্টার্ট দেওয়ার পর কাকাবাবু সুলেমানকে জিজ্ঞেস করলেন, এই বিসমিল্লা কি সানাই বাজাতে পারে?
সুলেমান বুঝতে না পেরে বলল, না তো! একথা জিজ্ঞেস করলেন কেন সার?
কাকাবাবু বললেন, বিসমিল্লা খান নামে ভারতবিখ্যাত একজন সানাইবাদক আছেন, শোনোনি বুঝি?
সুলেমান বলল, না সার, শুনিনি। তবে এই ও. সি. সাহেব আপনার সঙ্গে অত হেসে কথা বললেন, কিন্তু এমনিতে খুব কড়া। সবাই ওঁকে ভয় পায়।
কাকাবাবু মনে-মনে বললেন, ওর ওপরওয়ালা রাজমহেন্দ্ৰী ভাইজাগ থেকে ফোন করেছে বলেই এত খাতির করছে। না হলে আমাকে পাত্তাই দিত না।
খানিকটা পরে সুলেমান আবার বলল, সার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব? আপনি বোরাগুহালু যাচ্ছেন কেন? সেখানে তো আপনি গুহার মধ্যে নামতে পারবেন না।
কাকাবাবু বললেন, পারব না?
সুলেমান বলল, আপনি খোঁড়া মানুষ। সে-গুহা তো অনেক গভীর, একেবারে পাতালে নেমে গেছে প্রায়। সেখানে নামা আপনার পক্ষে অসম্ভব!
কাকাবাবু আস্তে-আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, হু, পা-টা খোঁড়া হয়ে গিয়ে ওই তো মুশকিলে পড়েছি। এখন অনেক কিছুই পারি না। তবু চলো, গুহার মুখটা অন্তত দেখে আসি। বেড়াতে এসেছি, আমার তো অন্য কোনও কাজ নেই।
বোরা কেস বা বোরাগুহালু বেশ বিখ্যাত জায়গা। অনেক টুরিস্ট আসে। মূল রাস্তা ছেড়ে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ দিয়ে বেশ কিছুটা ভেতরে যেতে হয়।
সেখানে মস্ত বড় একটা গুহামুখ আছে। প্রকৃতির খেয়ালে ভেতরের চুনাপাথরে বৃষ্টির জল ছুঁইয়ে-টুইয়ে অনেক ভাস্কর্য তৈরি হয়েছে। মনে হয় শিবলিঙ্গ বা নানা ঠাকুর দেবতার মূর্তি। ঠিক যেন মানুষের তৈরি। লোকের ধারণা, রাম, লক্ষ্মণ, সীতাও একসময় থেকে গেছেন এই গুহায়।
দশ টাকার টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতে হয়। লম্বা লাইন পড়েছে। গাড়িটা ছেড়ে দিতে হয়েছে খানিকটা আগে, কাকাবাবু ক্রাচ বগলে নিয়ে হেঁটে-হেঁটে গেটের দিকে এগোতেই কয়েকজন তাঁর দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।
কাকাবাবু মনে-মনে বললেন,
পঙ্গুও গিরি লঙ্ঘন করতে পারে, তা অনেকে জানে না। ক্রাচ বগলে নিয়ে মাউন্ট এভারেস্টেও ওঠা যায়।
তিনি গেটের কাছে দাঁড়াতেই টিকিট কাউন্টারের পাশ থেকে একটা লোক এগিয়ে এসে বলল, সার, আপনাকে তো যেতে দেওয়া হবে। না।
কাকাবাবু বললেন, কেন?
লোকটি বলল, আপনি, মানে, আপনি কী করে যাবেন?
কাকাবাবু বললেন, আমি খোঁড়া বলে ভাবছ তো? আমি যদি নিজে ঝুঁকি নিয়ে যেতে চাই, তাতে তোমার কী আপত্তি? পারব কি না সে আমি নিজেই বুঝব।
লোকটি বলল, তবু আপনার কোনও অ্যাসিডেন্ট হলে আমরাই দায়ী হব। তাও ভেতরে আলো থাকলে আপনি গাইড নিয়ে যেতে পারতেন। কাল থেকে ইলেকট্রিক লাইন খারাপ হয়ে গেছে, আলো জ্বলছে না।
কাকাবাবু বললেন, তার মানে আমি টিকিট কাটতে চাইলেও আপনারা টিকিট দেবেন না?
লোকটি বলল, না, সার। দুঃখিত সার। কাকাবাবু আর তর্ক করলেন না। তিনি এই গুহা দেখতেও আসেননি।
তবু তিনি নিরাশ হওয়ার ভান করে বললেন, ইস, এতদূর থেকে এসেছি, তবু দেখা হবে না? শুধু-শুধু এত পয়সা খরচ হয়ে গেল।
ঠুক-টুক করে তিনি ফিরে গেলেন গাড়ির কাছে।
সুলেমানকে বললেন, তুমি ঠিকই বলেছ। আমাকে টিকিট কাটতেই দিল।
সুলেমান বলল, এটা খুব ফেমাস জায়গা সার। অনেক সাহেব-মেম দেখতে আসে। ওয়ার্ল্ডে এত বড় ন্যাচারাল গুহা আর নেই।
কাকাবাবু মনে-মনে হাসলেন। এরকম গুহা, এর চেয়ে অনেক বড় আর গভীর প্রাকৃতিক গুহা এ-দেশেও আছে, পৃথিবীতে অনেক জায়গায় আছে। আমেরিকায় লুরে ক্যাভার্ন মাটির নীচে এক-দেড় মাইল নেমে গেছে, সেখানেও জল চুইয়ে বিস্ময়কর সব জিনিস তৈরি হয়েছে, কাকাবাবু সেসব দেখে এসেছেন। এ-দেশের লোকেরা সবকিছু বড্ড বাড়িয়ে বলে।
জিপে উঠে বললেন, এদিকে এসেছিই যখন, আশপাশটা একটু ঘুরে দেখে যাই। সামনের ওই পাহাড়টা কচ্ছপের মতন, ওইদিকে চলো তো।
এই অঞ্চলে ঢেউয়ের মতো অসংখ্য পাহাড় ছড়িয়ে আছে। কোনওটা গাছপালা ঢাকা, কোনওটা একেবারে ন্যাড়া। মাঝখান দিয়ে একটাই পথ, কখনও খুব খাড়াই, কখনও দারুণ ঢালু। সুলেমান খুব ভাল ড্রাইভার, ঠিকমতো চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কাকাবাবু পেছনের সিটে বসেছেন। ব্যাগ থেকে একটা ম্যাপ বার করে কোলের ওপর রেখেছেন, সুলেমান সেটা দেখতে পাচ্ছে না। কাকাবাবু ম্যাপের সঙ্গে মিলিয়ে নিচ্ছেন কোনটা কোন পাহাড়।
এক জায়গায় তিন-চারটে গাছভর্তি গাঢ় হলদে রঙের ফুল ফুটে আছে, কাকাবাবু সেখানে গাড়িটা থামাতে বললেন। নেমে পড়ে তিনি ছিঁড়ে নিলেন একগুচ্ছ ফুল। গন্ধ শুকলেন। একটু দূরে ক্যাকটাসের ঝোপ। সেখান থেকেও ভেঙে নিলেন একটু ক্যাকটাস।
যেন তিনি এইসব দেখার জন্যই এসেছেন। তাঁর অন্য কোনও কাজ নেই।
আবার গাড়িটা খানিকটা চলার পর এক জায়গায় দেখা গেল রাস্তার ওপর বড়বড় পাথর পড়ে আছে। মনে হয় পাহাড় থেকে ধস নেমেছিল। গাড়ি
আর ওদিকে যাবে না।
এদিকে গাড়ি-টাড়ি বিশেষ চলেও না। এ-পর্যন্ত আর একটাও গাড়ি দেখা যায়নি। চারদিকেই শুধু পাহাড় নিস্তব্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।
সুলেমান জিজ্ঞেস করল, গাড়ি ঘুরিয়ে নেব, সার?
কাকাবাবু ম্যাপটা গুটিয়ে ফেলে বললেন, জায়গাটা ভারী সুন্দর। এক্ষুনি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। তুমি এখানে অপেক্ষা করো, আমি একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে আসি।
সুলেমান বলল, আপনার হাঁটতে কষ্ট হবে সার। আমি সঙ্গে আসব?
কাকাবাবু বললেন, না, তার দরকার নেই। আমার অভ্যেস আছে।
কাকাবাবু পাথরগুলোর পাশ দিয়ে এগিয়ে খানিকটা পরে একটা বাঁক ঘুরে গেলেন। সুলেমানকে আর দেখা গেল না।
কাকাবাবু পকেট থেকে ম্যাপটা বের করে আবার খুললেন।
ম্যাপে এখানকার রাস্তার বাঁকগুলোর এক দুই করে নম্বর দেওয়া আছে। সাত নম্বর বাঁকে একটা তারকা-চিহ্ন।
কাকাবাবু গুনে-গুনে সাত নম্বর বাঁকে এসে থামলেন। এখানে পাহাড়ের পাশ দিয়ে একটা সরু পথ। সেটা ধরে একটুখানি যেতেই চোখে পড়ল, একটা মস্ত বড় বটগাছ, তার পাশেই দৈত্যের মুখের হাঁয়ের মতো একটা গুহা। ওপর থেকে ঠিক যেন দুটো দাঁত বেরিয়ে আছে।
এতটা রাস্তা হেঁটে আসতে কাকাবাবু হাঁফিয়ে পড়েছিলেন, এবার বুক ভরে শ্বাস নিলেন।
এটাই প্রোফেসর ভার্গবের আবিষ্কার করা গুহা। এই গুহার কথা এখনও বিশেষ কেউ জানে না। এই গুহার ভেতরে পাথরের গায়ে খোদাই করা আছে অনেক মূর্তি। প্রকৃতির সৃষ্টি নয়, মানুষের তৈরি। হাজার বছর আগে হিন্দু আর বৌদ্ধদের খুব লড়াই হয়েছিল। অনেক বৌদ্ধ পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল এইরকম সব নির্জন গুহায়। সেখানে সময় কাটাবার জন্য ছবি এঁকেছে, মূর্তি গড়েছে।
প্রোফেসর ভার্গব এটা আবিষ্কার করেছেন সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে। ইংরেজিতে দুটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন এই গুহাটা সংরক্ষণের জন্য। এর মধ্যে অমূল্য শিল্পসম্পদ রয়েছে। কিন্তু সরকারের এখনও টনক নড়েনি।
কাকাবাবু গুহামুখের দিকে এগিয়ে গেলেন। বটগাছের ডালে সামনের অনেকটা অংশ ঢাকা। গুহামুখে একটা লোহার গেট, তাতে কাঁটাতার জড়ানো। টিনের বোর্ডে একটা নোটিশ ঝুলছে। তাতে লেখা আছে, প্রবেশ নিষেধ। গুহার মধ্যে ধস নেমেছে। সম্পূর্ণ গুহাটিই বিপজ্জনক।
এবারে কাকাবাবু সত্যি-সত্যিই নিরাশ হলেন। এখান থেকেও ফিরে যেতে হবে?
ভার্গব এখানে কয়েক মাস আসেননি, গুহাটার এই অবস্থা তিনি জানেন না। সরকার এটা দেখাশুনোর ভার নেয়নি, তা হলে লোহার গেট বসিয়ে নোটিশই বা দিল কে? হয়তো এখানকার ম্যাজিস্ট্রেট এই ব্যবস্থা নিয়েছেন।
কাকাবাবু কাঁটাতার সরিয়ে লোহার গেটে মুখ চেপে ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন। একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। গুহাটা কতদূর চলে গেছে তা বোঝাই যাচ্ছে না। কাকাবাবুর ধারণা ছিল, এই গুহাটা তেমন বড় হবে না, প্রোফেসর ভার্গব অন্তত আট-দশবার এর ভেতরে গেছেন। তবে উনি রোগা-পাতলা ছোট্টখাট্টো মানুষ, ওঁর পক্ষে ওঠানামা করা সহজ।
লোহার গেটে একটা তালা লাগানো আছে। কাকাবাবু হাত দিয়ে দেখলেন, সেটা ভেঙে ফেলা এমন কিছু শক্ত নয়। তাঁর খুব ইচ্ছে হল, ভেতরে ঢুকে খানিকটা অন্তত গিয়ে দেখে আসার। কিন্তু টর্চ আনেননি। আর একজন কেউ সঙ্গে থাকলে ভাল হত।
কাকাবাবুর মনে পড়ে গেল সন্তুর কথা। সন্তু এখন কাছে থাকলে অনেক
সুবিধে হত। সন্তু তালা না ভেঙেও গেটটা টপকে গিয়ে ভেতরটা ঘুরে আসতে পারত।
কাকাবাবু ভেবে দেখলেন, তাঁর হাতে অনেক সময় আছে। কাল আবার ফিরে আসা যেতে পারে। বড় একটা টর্চ, খাবারদাবার সঙ্গে রাখতে হবে, আর থানার ও. সি.-র কাছে চাইতে হবে একজন বিশ্বাসী শক্ত-সমর্থ লোক।
আজ দুপুর আড়াইটে বেজে গেছে, খিদেও পেয়েছে, আজ ফিরে যাওয়াই ভাল।
কাকাবাবু আবার ফেরার পথ ধরলেন।
গাড়ির কাছে এসে দেখলেন, সুলেমান এঞ্জিনের ডালা খুলে ফেলে কীসব খুটখাট করছে।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী হল সুলেমান?
সুলেমান বলল, গাড়িটার মুখ ঘুরিয়ে রাখতে গিয়েছিলাম, হঠাৎ স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। এক্ষুনি ঠিক হয়ে যাবে।
কাকাবাবু বললেন, তাড়াতাড়ি করো। বেলা হয়ে গেছে অনেক। তোমার খিদে পায়নি?
সুলেমান খুটখাট, ঘটাংঘট করেই চলল। এক-একবার স্টার্ট দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রথম প্রথম ঝ্যানঝান শব্দ হচ্ছিল, তারপর আর কোনও শব্দই হয় না।
কাকাবাবু বসে রইলেন একটা ছাতিম গাছের ছায়ায়। বেশ বিরক্ত লাগছে তাঁর। কাল থেকেই গাড়িটা গড়বড় করছে। ভাড়ার গাড়ি এরকম খারাপ অবস্থায় থাকবে কেন? পাহাড়ের দেশে ঘোরাঘুরি করতে হবে, তিনি তো বলেই রেখেছেন আগে। পয়সা নেবে অনেক।
বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর কাকাবাবু বললেন, আমি ঠেলে দিলে কিছু লাভ হবে?
অপরাধীর মতো মুখ করে সুলেমান বলল, যদি সার দয়া করে একবার ঠেলে দেন। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি।
সুলেমান স্টিয়ারিংয়ে বসল, কাকাবাবু ঠেলতে লাগলেন। খোঁড়া পা নিয়ে গাড়ি ঠেলা কি সহজ কথা! তবু তিনি ঠেলতে লাগলেন, গাড়ি গড়াতে লাগল, তিন-চারবার এদিক-ওদিক করেও এঞ্জিনে কোনও শব্দই হল না। সারা মুখ ঘামে ভরে গেল কাকাবাবুর।
নেমে পড়ে সুলেমান বলল, নাঃ, এতে হবে না। টাই রড কেটে গেছে, এ.সি. পাম্প কাজ করছে না, একটা প্লাগ খারাপ হয়ে গেছে…। এইসব পার্টস কিনে একজন মেকানিক ডেকে আনতে হবে।
কাকাবাবু বললেন, তাতে কতক্ষণ লাগবে? তুমি যাবে কী করে?
সুলেমান বলল, আমি দৌড়ে চলে যাব। বোরাগুহালুর কাছে কয়েকটা গাড়ি আছে। ওর কোনও একটা গাড়িতে লিফট নিয়ে মেইন রোেড চলে যাব, তারপর যেখানে মেকানিক পাই।
কাকাবাবু বললেন, এদিকে যে প্রায় বিকেল হয়ে গেল! সুলেমান বলল, আর তো কোনও উপায় নেই সার। এই পাহাড়ি রাস্তায় তো গাড়ি ঠেলেও নিয়ে যাওয়া যাবে না বেশিদূর। খাড়াই পথে উঠবে না। এর পর বোরাগুহালুও বন্ধ হয়ে যাবে। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আসব সার, আপনি এখানে অপেক্ষা করুন।
সুলেমান এক দৌড় লাগাল।
কাকাবাবু বিরক্তি চেপে রাখলেন। গাড়ি ঠিক না হলে তো তাঁর ফেরার উপায় নেই। যে রাস্তা দিয়ে বাস যায়, সেই বড় রাস্তা থেকে প্রায় কুড়ি-একুশ কিলোমিটার ভেতরে চলে এসেছেন। পুরোটাই পাহাড়ি চড়াই-উতরাই। কাচ বগলে নিয়ে এতখানি রাস্তা কি হাঁটা যায়?
আর একটাও গাড়ি এ পর্যন্ত আসেনি, কোনও সাহায্য পাওয়ারও আশা নেই।
সুলেমান কতক্ষণে ফিরতে পারবে কে জানে? এখানে সে গাড়ির পার্টস বা মেকানিক কোথায় পাবে? সন্ধে হয়ে গেলে এখানে ফিরে আসবেই বা কী করে?
পাহাড়ে সন্ধে হয় বেশ তাড়াতাড়ি। বিকেল শেষ হতে না হতেই সূর্য চলে গেছে পশ্চিমের একটা পাহাড়ের আড়ালে। কিছু পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ শোনা যায় না। দুপুরে কিছুই খাওয়া হয়নি। পাউরুটি, জ্যাম, জেলি আর বিস্কুট সঙ্গে রাখা উচিত ছিল।
যদি পেটে খিদে না থাকত আর সঙ্গে আর দু-একজন থাকত, তা হলে এখানকার এই দৃশ্যটা এই সময় বেশ উপভোগ করা যেত। ঠিক যেন ছায়ার ডানা মেলে নেমে আসছে রাত্রি।
আজ আকাশে পাতলা-পাতলা মেঘ, তারা ফোটেনি, তবে একটু-একটু জ্যোৎস্না আছে। একেবারে মিশমিশে অন্ধকার নয়। এইরকম আবছায়ার মধ্যে সবকিছুরই চেহারা বদলে যায়। একটা পাথরের স্থূপকে মনে হচ্ছে একটা হাতি। বুনো ঝোপের দিকে তাকালে মনে হয় একদল মানুষ উবু হয়ে বসে আছে।
এই পাহাড়ি জঙ্গলে হিংস্র জানোয়ার কিছু আছে কি না কে জানে! ভালুক থাকতে পারে। প্রোফেসর ভার্গব একবার একটা ভালুক দেখার কথা বলেছিলেন। বড় বড় সাপ তো আছেই। কাকাবাবুর অবশ্য জন্তু-জানোয়ারের ভয় নেই। একবার তাঁর পায়ের ওপর দিয়ে একটা সাপ চলে গিয়েছিল, তিনি নিঃসাড় হয়ে বসে ছিলেন, সাপটা কামড়ায়নি।
সন্ধের পরেই এখানে বেশ শীত লাগে। কাকাবাবু আজ কোট পরে এসেছেন। অস্থিরভাবে কিছুক্ষণ পায়চারি করলেন, তারপর দাঁড়ালেন গাড়িতে হেলান দিয়ে।
ক্রমশ সাতটা বাজল, আটটা বাজল। কাকাবাবুর দৃঢ় ধারণা হল, আজ রাতের মধ্যে সুলেমান আর ফিরতে পারবে না। কাকাবাবুকে এখানেই রাতটা কাটাতে হবে।
সুলেমান কি ইচ্ছে করে তাঁকে এখানে রেখে পালাল? তাতে তার লাভ কী? সে কিছু টাকা নিয়েছে, কিছু টাকা এখনও বাকি আছে। গাড়িটাও রয়েছে এখানে। কাকাবাবু যখন গুহাটা দেখতে গিয়েছিলেন, তখনই তো সে পালাতে পারত। না, সেরকম কোনও মতলব ওর নেই। গাড়িটাই বাজে।
কাকাবাবু যখন বুঝতে পারলেন যে, সুলেমানের আর ফেরার আশা নেই, রাত্তিরে কোনও খাবারও জুটবে না, তখন তিনি ঠিক করলেন যে গাড়িতেই শুয়ে থাকা ভাল।
পেছনের সিটে পা দুটো ছড়িয়ে দিয়ে তিনি সবেমাত্র আরাম করছেন, এমন সময় দূরে একটা গাড়ির আওয়াজ পাওয়া গেল।
কাকাবাবুর মনটা আনন্দে ভরে গেল। সুলেমান তা হলে ফিরেছে। আর একটা গাড়ি জোগাড় করে এনেছে। ওর চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। তা হলে ও-গাড়িতেই ফেরা যাবে।
তবু কাকাবাবুর সন্দেহপ্রবণ মন। তিনি তাড়াতাড়ি জিপ থেকে নেমে বেশ খানিকটা দূরে গিয়ে একটা ঝোপের আড়ালে বসে রইলেন। হাতে রিভলভার।
পাহাড় দিয়ে এঁকেবেঁকে আসছে একটা গাড়ি, দেখা যাচ্ছে হেড লাইটের আলো। কাছে আসতে বোঝা গেল, সেটা একটা জোংগা জিপ। থামতেই তার থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ল ছ-সাতজন লোক। ছুটে গেল জিপটার দিকে। ভেতরে ঢুকে, চারপাশ ঘুরে, এমনকী তলাতেও উঁকি মেরে দেখল। তারপর জোরে-জোরে কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে। ভাষাটা ইংরেজি নয় বলে কাকাবাবু একটা শব্দও বুঝতে পারলেন না।
তবে, এটুকু বুঝলেন যে, এদের মধ্যে সুলেমান নেই, এরা খালি জিপটা দেখে অবাক হয়েছে। এরা কারা? সকলেই প্যান্ট-শার্ট পরা, কারও মুখই দেখা যাচ্ছে ভাল করে।
এবার সবাই সামনের দিকে ছুটল। কাকাবাবু আড়ালে থেকে তাদের অনুসরণ করতে লাগলেন। ওরা গুহাটার দিকেই যাচ্ছে। একজন চাবি দিয়ে খুলে ফেলল লোহার গেটের তালা। জ্বলে উঠল চার-পাঁচটা টর্চ, ওরা ধুপধাপ করে ঢুকে পড়ল গুহার মধ্যে।
খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে কাকাবাবু ভাবলেন, ওদের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ওরা এই গুহার মধ্যে আগেও অনেকবার গেছে। ভেতরটা চেনা। গেটের চাবিও আছে ওদের কাছে। গুহার মধ্যে এত অন্ধকার যে রাত আর দিন সমান। তবু রাত্তিরবেলা ওরা গুহার মধ্যে যায় কেন?
জিপটা খারাপ না হলে কাকাবাবু এখন এখানে থাকতেন না, ওদের দেখতেও পেতেন না।
তিনি বটগাছটার আড়ালে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। জিপটার কাছে ফিরে যাওয়া চলে না। লোকগুলো যে-কোনও সময় বেরিয়ে এসে আবার হয়তো জিপটা তল্লাশ করবে। লুকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।
ঘণ্টাখানেক পরে গুহার মধ্যে গুম গুম করে দুবার শব্দ হল। অনেকটা ভেতরে। গুলির শব্দ নয়, মনে হয় যেন বিস্ফোরণ। ডিনামাইট ফাটানো হচ্ছে?
কাকাবাবু ভুরু কোঁচকালেন। ডিনামাইট ফাটাচ্ছে কেন? এরা মূর্তি চোর? মূর্তি চুরি খুব লাভজনক ব্যাপার। বিদেশে পাচার করলে অনেক টাকাপয়সা পাওয়া যায়। কিন্তু প্রোফেসর ভার্গব বলেছেন, এখানকার মূর্তিগুলো ভুবনেশ্বর-কোনারকের মন্দিরের মতন আলগা-আলগা নয়। পাথরের দেওয়ালে খোদাই করা। খুলে নিতে গেলে ভেঙে নষ্ট হয়ে যাবে। তবু এরা ভাঙছে কেন?
আর একবার বিস্ফোরণের শব্দ হতেই কাকাবাবু আর কৌতূহল সামলাতে পারলেন না। সব লোক ভেতরে চলে গেছে, বাইরে কেউ নেই। গুহার মুখটায় গিয়ে একবার ভেতরে উঁকি মেরে দেখার দারুণ ইচ্ছে হল তাঁর।
লোহার গেটটা খোলা। কাকাবাবু মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতেই পেছন থেকে কেউ এসে খুব ভারী কোনও জিনিস দিয়ে জোরে মারল তাঁর মাথায়। তিনি মুখ ঘোরাবারও সময় পেলেন না। আঁক করে একটা শব্দ করে তিনি মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন মাটিতে।
কালো প্যান্ট-শার্ট পরা একজন লোক কাকাবাবুর পা ধরে ছ্যাচড়াতে-ছ্যাচড়াতে টেনে নিয়ে গেল গুহার মধ্যে।
কতক্ষণ পরে কাকাবাবুর জ্ঞান ফিরে এল, তিনি জানেন না। মাথার পেছনে দারুণ ব্যথা। আবছা-আবছাভাবে টের পেলেন যে তিনি শুয়ে আছেন একটা চলন্ত গাড়িতে।
তিনি ভাবলেন, সুলেমানের জিপ ঠিক হয়ে গেছে, তিনি সেই জিপে ফিরে যাচ্ছেন গেস্ট হাউসে।
তারপরেই মনে পড়ল, মূর্তি-গুহার সামনে কেউ তাঁকে মেরে অজ্ঞান করে দিয়েছে।
তিনি ধড়মড় করে উঠে বসলেন। সত্যিই তিনি শুয়ে ছিলেন একটা জিপের পেছন দিকে। সেটা চলছেও বটে, তবে সেটা সুলেমানের জিপ নয়। তাঁর সামনেই লোহার ডান্ডা হাতে নিয়ে বসে আছে একজন লোক।
কাকাবাবু একবার মাথায় হাত বুলিয়ে নিয়ে সামনের লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আমায় কে মেরেছে, তুমি?
লোকটি কাকাবাবুর প্রশ্ন গ্রাহ্য না করে সামনের ড্রাইভারদের উদ্দেশে বলল, মঞ্চাম্মা, এ লোকটা জেগে উঠেছে। আর বেশিদূর নিয়ে গিয়ে কী হবে, এখানেই শেষ করে দিই? এখান থেকে কেউ লাশ খুঁজে পাবে না।
কাকাবাবু আবার জিজ্ঞেস করলেন, বলো না, আমার মাথায় কে মেরেছে, তুমি?
লোকটি এবার বিকট মুখভঙ্গি করে বলল, হ্যাঁ, মেরেছি। আবার মারব।
কাকাবাবু এত তাড়াতাড়ি আর এত জোরে একটা ঘুসি চালালেন যে, সে বাধা দেওয়ার সময়ই পেল না। পড়ে গেল হাত-পা ছড়িয়ে।
কাকাবাবু বললেন, অন্যকে মারো। নিজে মার খেতে কেমন লাগে, এবার দেখো।
লোকটা আবার আস্তে-আস্তে উঠে বসল। লোহার ডান্ডাটা তুলে নিল। কাকাবাবু সেটা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন না।
লোকটির চোখের দিকে কটমট করে তাকিয়ে থেকে বললেন, লোহার ডাস্তা দিয়ে মারবে? মারো। আমার এই হাত দুটোও লোহার তৈরি।
লোকটি ডান্ডা চালাতেই কাকাবাবু খপ করে সেটাকে এক হাতে ধর ফেললেন। অন্য হাতে লোকটির থুতনিতে আবার এমন ঘুসি চালালেন যে, সে নিজেকে সামলাতে পারল না, তার মাথাটা ঝুঁকে গেল জিপের বাইরে। কাকাবাবু তাকে ধরবার চেষ্টা করলেন, তার আগেই সে পড়ে গেল রাস্তায়।
গাড়িটা ঘচাং করে ব্রেক কষল।
কাকাবাবু আগেই এক নজর দেখে নিয়েছিলেন যে, গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি ড্রাইভারের দিকে ফিরতেই সেও মুখ ফিরিয়ে একটা রিভলভার উঁচিয়ে বলল, মাথার ওপর হাত তোলো, একটু নড়লেই গুলি চালাব।
কাকাবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, স্ত্রীলোক?
ড্রাইভারটি প্যান্ট-শার্ট ও মাথায় একটা টুপি পরা। কিন্তু গলার আওয়াজ শুনলেই বোঝা যায়।
কাকাবাবু বললেন, আমি কোনও স্ত্রীলোকের গায়ে হাত তুলি না। তোমরা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিলে?
মহিলাটি ধমক দিয়ে বলল, দু হাত উঁচু করো। গাড়ি থেকে নামো। আমি ঠিক পাঁচ গুনব, তার মধ্যে না নামলে তোমার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব।
কাকাবাবু বললেন, মাথার খুলি উড়ে গেলে খুব বিচ্ছিরি ব্যাপার হবে। গাড়ির মধ্যে রক্ত, ঘিটু-টিলু ছড়িয়ে পড়বে। ঠিক আছে, আমি নামছি।
কাকাবাবু ক্রাচ দুটো খুঁজে পেলেন না। এমনিই নামলেন। মহিলাটি এরই মধ্যে দৌড়ে গাড়ির পেছনদিকে চলে এসেছে। রিভলভারটা স্থির রেখে হুকুম করল, রাস্তার একেবারে ধারে চলে যাও। আগে তোমাকে খতম করিনি, লাশটা সেখানে ফেলতে চাইনি। এখানে তোমাকে মেরে ফেলে দিলে সাতদিনের মধ্যেও তোমার লাশ কেউ খুঁজে পাবে না। তার আগেই শকুনে খেয়ে ফেলবে।
কাকাবাবু শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ইস ছি ছি, শকুনে খাবে? ভাবতেই কেমন লাগে। তুমি সত্যি-সত্যি গুলি করবে নাকি? ও রিভলভারটা কার? আমারই মনে হচ্ছে। আমাকে ফেরত দেওয়া উচিত।
মহিলাটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল, খাদের ধারে যাও, এক…দুই…
কাকাবাবু বললেন, আমাকে মারবে কেন, আমি কী দোষ করেছি, সেটাও জানতে পারব না?
অন্য লোকটি একটু দূরে রাস্তার ওপর পড়ে আছে। সে একটা গোঙানির শব্দ করে উঠল।
মহিলাটি সেদিকে মুখ ঘুরিয়ে তীব্র গলায় ডাকল, এই ইগলু, উঠে আয়, অপদার্থ কোথাকার!
লোকটি জড়ানো গলায় বলল, মঞ্চাম্মা, হাঁটুতে খুব চোট লেগেছে।
মহিলাটি বিরক্তভাবে বলল, তোকে আমি ঘাড়ে করে গাড়িতে তুলব নাকি?
তারপর সে রিভলভার নাচিয়ে কাকাবাবুকে বলল, ওকে তুলে নিয়ে এসো। গাড়িতে রাখো।
কাকাবাবু হেসে বললেন, মারবার আগে আমাকে দিয়ে খাটিয়ে নিতে চাও।
খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে গিয়ে তিনি লোকটিকে পাঁজাকোলা করে তুললেন। সে ফুঃ ফুঃ করল, আর তার মুখ থেকে রক্ত আর ভাঙা দাঁত বেরিয়ে এল কয়েকটা। ওকে নিয়ে ফিরে আসার পর কাকাবাবু গাড়িটার কাছে দাঁড়িয়ে রইলেন। মহিলাটি হুকুমের সুরে বলল, ওকে গাড়িতে বসিয়ে দাও! কাকাবাবু সে হুকুম না শুনে লোকটিকে উঁচু করে তুললেন নিজের বুকের কাছে।
তারপর বললেন, মেয়ে হয়ে তুমি খুনি-গুন্ডাদের দলে ভিড়েছ। শুধু ভিড়লেই কী হয়, আগে সব শিখতে হয়। হাতে রিভলভার থাকলেই কি গুলি চালানো যায়? এখন তুমি কোথায় গুলি করবে? আগে এই লোকটাকে মারতে হবে। পারবে?
কাকাবাবু লোকটাকে ঢালের মতন ধরে রেখে এক-পা এক-পা করে এগোতে লাগলেন।
মহিলাটির মুখোনা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। তবু সে চেঁচিয়ে বলল, মাথায় গুলি করব, পায়ে গুলি করব।
কাকাবাবু এবার গর্জন করে উঠলেন, চালাও গুলি, চালাও! দেখি কেমন পারো।
মহিলাটিও একটু-একটু পিছিয়ে যাচ্ছে। একবার তাকিয়ে দেখল, পেছনে খাদ। সে আর যেতে পারবে না। সে থামতেই কাকাবাবু এই নাও বলে লোকটিকে ছুড়ে মারলেন মহিলাটির গায়ের ওপর।
দুজনেই হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেল মাটিতে।
কাকাবাবু ক্ষিপ্রভাবে গিয়ে মহিলাটির হাত থেকে রিভলভারটি কেড়ে নিলেন। সেটার ডগায় ফুঁ দিতে-দিতে বললেন,, যা ভেবেছিলাম, এটা আমারই। কতবার কত লোক কেড়ে নিয়েছে, আবার আমার হাতে ফিরে এসেছে। এবার উঠে দাঁড়াও।
মহিলাটি আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে তার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেছে একেবারে।
কাকাবাবু বললেন, এবারে বলো তো, আমার ওপর তোমাদের এত রাগ কেন? আমি তোমাদের চিনি না, কোনও ক্ষতিও করিনি!
মেয়েটি কোনও উত্তর দিল না।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের মতলব কী? গুহার মধ্যে ঢুকে মূর্তিগুলো নষ্ট করছিলে কেন?
মেয়েটি এবারেও চুপ।
কাকাবাবু বললেন, আমি মেয়েদের গায়ে হাত দিই না। তোমাকে ধরে টানাটানি করতে পারব না। গাড়িতে ওঠো, থানায় গিয়ে যা বলবার বলবে।
অন্য লোকটি গড়িয়ে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে গেছে। খাদটি অবশ্য খাড়াই নয়, ঢালু। সে আটকে আছে এক জায়গায়। কাকাবাবু উঁকি দিয়ে একবার তাকে দেখে নিয়ে বললেন, ও থাক। ওকে তুলতে পারব না। তুমি ওঠো গাড়িতে।
মহিলাটি তবু নড়ল না একটুও।
কাকাবাবু বললেন, তোমাকে আমি প্রাণে মারব না। কিন্তু পায়ে গুলি চালিয়ে আমার মতন খোঁড়া করে দিতে পারি। দেখবে? মানুষের বুকে গুলি চালানো যায়, কিন্তু পায়ে মারা খুব শক্ত। পুলিশদের বলা থাকে, চোর-ডাকাতদের বা মিছিলের লোকদের শুধু পায়ে গুলি চালাতে। কিন্তু তারা ফসকে বুকে গুলি করে কত মানুষ মেরে ফেলে! আমার টিপ দেখো।
কাকাবাবু ট্রিগার টিপলেন। মহিলাটির ডান পায়ের ঠিক আধ ইঞ্চি পাশ। দিয়ে একটা ঝোপ উড়িয়ে দিয়ে গুলিটা বেরিয়ে গেল। প্রচণ্ড শব্দ হল পাহাড়ে-পাহাড়ে।
মহিলাটি লাফিয়ে উঠল, মুখ দিয়ে একটা ভয়ের আর্তনাদ বের হল। পাশের খাদ থেকে লোকটি চেঁচিয়ে বলল, মঞ্চাম্মা, জাম্প, জাম্প, জাম্প, ধরা দিয়ো না!
মহিলাটি ঝাঁপ দিল খাদে। দুজনেই গড়িয়ে-গড়িয়ে নামতে লাগল নীচে। কাকাবাবু ইচ্ছে করলেই ওদের গুলি করতে পারেন, কিন্তু গুলি করে মানুষ মারার প্রবৃত্তি তাঁর কখনও হয়নি।
কাঁধ ঝাঁকিয়ে আপনমনে বললেন, পালাল? কী আর করা যাবে!
গাড়িটার হেডলাইট জ্বলছে। ধকধক করছে এঞ্জিন। কাকাবাবু গাড়ি চালাতে ভালই জানতেন একসময়, অনেকদিন চালাননি। খোঁড়া পা-টা দিয়ে ক্লাচ চাপতে খানিকটা অসুবিধে হয়।
কিন্তু এখানে থাকার তো মানে হয় না। ওরা দুজনে গড়িয়ে নেমে গেল, কাছাকাছি যদি ওদের কোনও আস্তানা থাকে, তা হলে দলবল নিয়ে আবার ফিরে আসতে পারে।
কাকাবাবু ড্রাইভারের সিটে বসলেন।
চাঁদ পাতলা মেঘে ঢেকে গেছে, জ্যোৎস্না এখন খুব অস্পষ্ট। এ-জায়গাটা কোথায় কাকাবাবু জানেন না, সামনের দিকে না পেছনের দিকে গেলে আরাকু ভ্যালি পৌঁছবেন, সে সম্পর্কেও কোনও ধারণা নেই। পাহাড়ের রাস্তায় ঘন-ঘন বাঁক। আগে থেকে না জানলে বা একটু অসাবধান হলে গাড়ি পড়ে যায় খাদে। রাস্তাও ভাল দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু উপায় তো নেই, এই জায়গাটা ছেড়ে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া দরকার।
কাকাবাবু ফার্স্ট গিয়ারে আস্তে-আস্তে চালাতে লাগলেন গাড়ি। তাঁর সামনে অচেনা, অন্ধকার পথ।