Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » সন্তু ও এক টুকরো চাঁদ || Sunil Gangopadhyay » Page 5

সন্তু ও এক টুকরো চাঁদ || Sunil Gangopadhyay

আবার এসে বসা হল সেই জমকালোভাবে সাজানো ঘরটিতে।

কাকাবাবু খুব সহজভাবে বললেন, সিংজি, তখন শরবত-টরবত খাওয়ালে, কিন্তু চা খাওয়া হয়নি। এখন কি এককাপ চা পাওয়া যেতে পারে?

কাকাবাবুর গলা শুনে মনে হয় যেন কিছুই হয়নি। একটু আগে যে দুজনের মধ্যে তলোয়ার নিয়ে জীবন-মরণ যুদ্ধ হয়ে গেল, ঠাকুর সিং খুনটুনের হুমকি দিয়েছিল, তা যেন কিছুই না।

ঠাকুর সিং হাঁক দিয়ে বলল, কই হ্যায়? চায়ে লাও। আচ্ছাসে কলকাত্তাই চা বানাও!

তারপর সে কাকাবাবুর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আর বলুন?

কাকাবাবু বললেন, তুমি সাইমন বুবুম্বা নামে কারও নাম শুনেছ?

ঠাকুর সিং মাথা হেলিয়ে বলল, হ্যাঁ, শুনেছি।

কাকাবাবু বললেন, তুমি জানো, সাইমন বুবুম্বা বিদেশ থেকে এসেছেন খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজে, কিন্তু তাকে পাওয়া যাচ্ছে না।

ঠাকুর সিং বলল, হাঁ জানি।

কেউ তাকে গুম করেছে। মুক্তিপণ চেয়েছে। এই ব্যাপারের সঙ্গে তোমার কোনও সম্পর্ক আছে?

হ্যাঁ, আছে। খুব সম্পর্ক আছে। তাকে তো আমারই জিম্মায় রেখেছি। এই বাড়িতেই।

এবার কাকাবাবুর অবাক হওয়ার পালা। তাঁর ভুরু দুটো কপালে উঠে গেল। এত সহজে স্বীকার করে ফেলল লোকটা!

দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে কাকাবাবু বললেন, এ বাড়িতেই আছে? গুড! তবে তো সব ঝামেলাই চুকে গেল। ঠাকুর সিং, সাইমন বুবুম্বার কোনও ক্ষতি হলে আমাদের দেশের খুব বিপদ হয়ে যাবে। তুমি তাকে আমাদের হাতে তুলে দাও, দেশ তোমার কাছে ঋণী থাকবে।

ঠাকুর সিং বিদ্রুপের হাসি দিয়ে বলল, ওসব দেশ-ফেশ আমি বুঝি না। তোমাদের মতন শহরের লোকেরা দেশ নিয়ে মাথা ঘামায়। এক কোটি টাকা মুক্তিপণ দিয়ে যাও, মাল ডেলিভারি নিয়ে যাও। এটা আমার ব্যবসা।

কাকাবাবু বললেন, তুমি বলছ কী, ঠাকুর সিং! মানুষ চুরি তোমার ব্যবসা? সাইমন বুবুম্বা তোমার কাছে আছে আমরা জেনে গেলাম। এখন তো পুলিশ ডেকে এনে তাকে উদ্ধার করে নিতে পারি।

ঠাকুর সিং বলল, শোনো রায়চৌধুরী, তোমাকে আমি সাফ-সাফ সব কথা বলে দিচ্ছি। আমি মানুষ চুরি করি না, মুক্তিপণও আমি নিজের হাতে নিই না। সেসব কারবার অন্য লোক করে। আমি শুধু জিম্মাদার। এখন সারাদেশে যখন-তখন মানুষ গুম হয়। অসমে, বিহারে, পঞ্জাবে, অন্ধ্র প্রদেশে। সেসব অন্য-অন্য পার্টির কাজ। আমার কাছে তারা সেইসব লোকগুলোকে এনে রাখে। আমি তাদের দেখভাল করি। খাওয়াই-দাওয়াই। মুক্তিপণের একটা বখরা আমি পাই, ব্যস!

পুলিশ তোমার হদিস পায়নি?

বিহারের পুলিশের সাহস নেই আমার বাড়ির ধারেকাছে আসে।

কিন্তু সাইমন বুবুম্বাকে যে আমার চাই। তাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।

ওসব ফিকির ছাড়ো, রায়চৌধুরী। তোমাকে আর এই বাচ্চা দুটোকে আমি ছেড়ে দেব কথা দিয়েছি, ভালয়-ভালয় ফিরে যাও। দ্বিতীয়বার যদি গণ্ডগোল করো, আমার ব্যবসার ক্ষতি করতে চাও, তা হলে কিন্তু আমি আর ছাড়ব না। কুত্তা দিয়ে তোমাদের খাওয়াব!

ওরে বাবা, খুব যে ভয় দেখাচ্ছ দেখছি।

আমি মিথ্যে কথা বলি না। সাইমন বুবুম্বা একটা স্পেশাল কেস। খুব বড় ব্যাপার। এর পেছনে অনেক বড় কোনও লোক আছে। অনেক টাকার খেলা। তুমি কিছুই করতে পারবে না, রায়চৌধুরী। বাইরের পুলিশ এনেও কোনও লাভ হবে না। আমার বাড়িটা দেখছ তো? পাহাড়ের ওপর। পুলিশের গাড়ি এলে এক মাইল দূর থেকে টের পেয়ে যাব। আমার ওপর অর্ডার আছে, সাইমন বুবুম্বাকে কিছুতেই পুলিশের হাতে দেওয়া হবে না। পুলিশ যদি আমার গেটের কাছে আসে, আমি নিজের হাতে সাইমন বুবুকে কেটে টুকরো-টুকরো করে পেছনে একটা নদীতে ভাসিয়ে দেব। পুলিশ ভেতরে ঢুকলেও কিছু প্রমাণ পাবে না।

এই সময় একজন বেয়ারা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকল। চায়ের সঙ্গে দু-তিনরকম কেক।

কথার ভঙ্গি পালটে ভদ্রতার সুরে ঠাকুর সিং বলল, চা এসে গেছে, খেয়ে নিন!

সন্তুর গলা শুকিয়ে গেছে। একটা মানুষকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলার কথা শোনবার পর কি চা খাওয়া যায়!

কাকাবাবু একটা কাপ তুলে দিব্যি চুমুক দিলেন।

খানিকটা কৌতূহলের দৃষ্টিতে ঠাকুর সিংয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, তুমি এমন গড়গড় করে সব কথা বলে দিচ্ছ, তাতে আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না।

সাইমন বুবুম্বা সত্যিই তোমার এখানে আছে? না কি লম্বা-চওড়া কথা বলে আমাদের ধোঁকা দিচ্ছ!

ঠাকুর সিং হে-হে করে হেসে উঠে বলল, নিজের চোখে দেখে যাবে? তা হলে বিশ্বাস হবে? আচ্ছা, একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।

ঠাকুর সিং বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

কাকাবাবু একটা কেকের টুকরো ভেঙে মুখে দিয়ে বললেন, হুঁ, বেশ ভালই তো?

সন্তু আর জোজোর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোরা খেয়ে নে। এই জঙ্গলেও ভাল কেক বানায়।

এই সময় একটি তেরো-চোদ্দ বছরের মেয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকল, পিতাজি?

মেয়েটি ভারী সুন্দর। শালোয়ার কামিজ পরা। ফুটফুটে মুখখানি। হরিণীর মতন সরল চোখ মেলে সে ঘরের মধ্যে কাকে যেন খুঁজল।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

মেয়েটি বলল, রোশনি!

তারপরই একটা পাখির মতন ফুড়ত করে চলে গেল।

ঠাকুর সিং ফিরে এল মিনিট দশেক পরে। বলল, চলো আমার সঙ্গে!

কাকাবাবু বললেন, একটু আগে একটি বাচ্চা মেয়ে উঁকি মেরে গেল। রোশনি। সে কি তোমার মেয়ে?

ঠাকুর সিং বলল, হ্যাঁ। সে এসেছিল বুঝি?

কাকাবাবু বললেন, কী সুন্দর দেখতে তোমার মেয়েকে। আচ্ছা ঠাকুর সিং, তোমার এই মেয়েকে যদি কেউ চুরি করে নিয়ে যায়, তারপর তোমার কাছে মুক্তিপণ চায়, না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়, তা হলে তোমার কেমন লাগবে?

ঠাকুর সিং রুক্ষ স্বরে বলল, ওসব বাত ছাড়ো। ব্যবসা হচ্ছে ব্যবসা। তার মধ্যে আবার ছেলেমেয়ের কথা আসে কী করে? লোকে তো যুদ্ধ করতে গিয়েও মানুষ মারে। নিজের ছেলেও কোনও যুদ্ধে মরতে পারে ভেবে কেউ কি যুদ্ধ বন্ধ করে?

একটু থেমে সে আবার হিংস্র গলায় বলল, আমার মেয়ে রোশনি, একটা ফুলের মতন মেয়ে, তার গায়ে যদি কেউ হাত ছোঁয়ায়, আমি তার কলিজা ছিঁড়ে নেব। ভীমের মতন আমি তার রক্ত খাব!

আগের দেখা বারান্দাটা এল-শেপের মতন বেঁকে গেছে। সেখানে একটা ঘরের দরজা খুলে দেখা গেল ভেতরে আর-একটা দরজা। তারপরে লোহার গরাদ দেওয়া একটা জেলখানার মতন।

সেই ঘরটা আধো-অন্ধকার। সেখানে একটা খাটিয়ার ওপর একপাশ ফিরে শুয়ে আছে একজন মানুষ। জিন্স আর হলুদ গেঞ্জি পরা। দাড়ি-গোঁফ কামানো মুখ। লোকটি ঘুমিয়ে আছে। সোনালি ফ্রেমের চশমাটা পাশে খুলে রাখা।

সন্তু জোজোর দিকে তাকাল।

জোজো মাথা নেড়ে বলল, ইয়েস!

ঠাকুর সিং বলল, আমরা ভাল খেতে দিই। যত্ন করি। খুব ভাল হোটেলেও এরকম যত্ন পাবে না।

কাকাবাবু ডেকে উঠলেন, সাইমন, সাইমন!

ঠাকুর সিং বলল, ডেকে কোনও লাভ নেই। আফ্রিকানদের কীরকম ঘুম তুমি জানো না। ঠিক কুম্ভকর্ণের মতন। একবার ঘুমোলে সাত ঘন্টার আগে চোখ মেলবে না। এখন তুমি বোমা ফাটাও এখানে। তাও জাগবে না।

সেই বারান্দার একটা দরজা আছে বাড়ির পেছনের বাগানের দিকে। ঠাকুর। সিং কাকাবাবুদের নিয়ে এল সেখানে। এর মধ্যে টিপি-টিপি বৃষ্টি নেমেছে।

ঠাকুর সিং বলল, তা হলে তোমাদের গাড়িটা ভেতরে আনতে বলি! গেট পর্যন্ত যেতে গেলে ভিজে যাবে।

কাকাবাবু বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ! ঠাকুর সিং, একটা কথা তোমাকে জানিয়ে যাচ্ছি। সাইমন বুবুম্বাকে এখানে দেখে গেলাম। তাকে যে-কোনও উপায়ে আমি উদ্ধার করার চেষ্টা করবই। হাল ছেড়ে দেব না, বুঝতেই পারছ! হি ইজ টু-উ-উ ইমপর্টান্ট!

ঠাকুর সিং বলল, রায়চৌধুরী, তোমাকেও আমি বলে দিচ্ছি, তুমি আমার এখান থেকে ওই লোকটাকে কিছুতেই উদ্ধার করতে পারবে না। কিছুতেই না। আমি চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি তোমাকে। তবে আবার তুমি যদি এ বাড়ির মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করো, তখন কিন্তু আমি আর ছাড়ব না। তোমাকেও জানে মেরে দেব!

কাকাবাবু বললেন, অল রাইট। চ্যালেঞ্জ রইল।

মহিম গাড়িটা চালিয়ে আনল এদিকে। সবাই উঠে গেল। ঠাকুর সিং বলল, জঙ্গলে ঘোররা। জানোয়ার দেখো, এদিকে আর এসো না!

কাকাবাবু বললেন, শিগগির তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।

গাড়িটা গেট পার হওয়ার সময় দরোয়ান কী যেন একটা ছুঁড়ে দিল জানলা দিয়ে। একটা কালো বলের মতন। সবাই চমকে উঠল। জিনিসটা পড়েছে। জোজোর কোলের ওপর, সে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা রে, বোমা, বোমা, গাড়িটা উড়িয়ে দেবে।

জোজো দু হাত দিয়ে সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিল।

সন্তু নিচু হয়ে টপ করে সেটাকে তুলে বাইরে ফেলে দিতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, এ তো একটা ক্যামেরা।

মহিম ঘাড় ফিরিয়ে বলল, কামেরা? আমারটা কেড়ে নিয়েছিল। ফেরত দিয়েছে।

সন্তু সেটাকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বলল, ভাঙেটাঙেনি, ঠিকই আছে।

কাকাবাবু বললেন, ওঃ, তোরা এমন চেঁচিয়ে উঠলি, আমি ভাবলাম সত্যিই বুঝি বোমা। আর-একটু হলে গাড়ির দরজা খুলে লাফাতে যাচ্ছিলাম!

জোজো বলল, একবার কম্বােডিয়া দিয়ে যাওয়ার সময় সত্যিই আমাদের গাড়ির মধ্যে একটা জ্বলন্ত বোমা ছুড়ে দিয়েছিল ডাকাতরা। সেইজন্যই আমি ভাবলাম…

সন্তু বলল, সেবারে বোমায় তোদের গাড়িটা ধ্বংস হয়ে গেল কিন্তু তোদের গায়ে একটাও আঁচড় লাগল না, তাই তো?

জোজো বলল, মোটেই তা নয়। আমাদের গাড়িতে এক টিন নারকোল তেল ছিল। সঙ্গে-সঙ্গে সেই টিনের সবটা তেল ঢেলে দিলাম বোমার ওপর। অমনই সেটা ফুস করে নিভে গেল। নারকোল দিয়ে ভেজালে কোনও বোমা ফাটতে পারে না, জানিস না?

সন্তু তাকাল কাকাবাবুর দিকে।

কাকাবাবু থেমে বললেন, কী জানি! কোনওদিন তো বোমার ওপর নারকেল তেল ঢেলে দেখিনি। বোধ হয় আর্মির লোকেরাও এই টেকনিকটা জানে না।

সন্তু পেছন ফিরে ঠাকুর সিংয়ের বাড়িটা আর একবার দেখবার চেষ্টা করে বলল, উঃ, সত্যিই যেন সিংহের গুহা! যখন দেখলাম মহিমাকে বেঁধে উলটো করে ঝুলিয়ে দিয়েছে-

জোজো বলল, আর কাকাবাবু যখন তলোয়ার লড়তে গেলেন, তখন এত ভয় করছিল ..

কাকাবাবু বললেন, ওটা এমন কিছু ব্যাপার নয়। আমার আত্মবিশ্বাস জিনিসটা খুব স্ট্রং, বুঝলে জোজো! লোকে বলে জেদ্ কিংবা গোঁয়ার্তুমি। জিতব জেনেই তলোয়ারটা হাতে নিয়েছিলাম। সে যাকগে! সাইমন বুবুকে। আমরা সবাই স্বচক্ষে দেখলাম। ওকে উদ্ধার করার একটা উপায় বার করতেই হবে।

বাংলোয় ফিরে এসে কাকাবাবু টেলিফোন নিয়ে বসলেন। এখানে একটা টেলিফোন আছে বটে, কিন্তু লাইন পাওয়া প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। তবু কাকাবাবু চেষ্টা করে যেতে লাগলেন অনবরত।

দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার সময় কাকাবাবু সন্তুকে বললেন, তোরা এই জঙ্গলের মধ্যে কাছাকাছি ঘুরে বেড়াতে পারিস, খবদার, বেশি দূরে যাবি না। ওয়াইল্ড ডগসের ভয় আছে।

সন্তু বলল, আমরা গাড়ি করে গেলেও কি ওয়াইল্ড ডস কিছু করতে পারবে?

কাকাবাবু বললেন, তা পারবে না বটে। কিন্তু ঠাকুর সিং তোদর একজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে প্যাঁচে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। তাতে আরও মুশকিলে পড়ে যাব। গাড়িতে গেলেও কাছাকাছি থাকবি।

খাওয়া সেরেই সন্তু আর জোজো ছুটে গেল মহিমের কাছে। তার ঘরটা একটু দূরে। মহিম শুয়ে-শুয়ে একটা ট্রানজিস্টার রেডিও শুনছে। সন্তু বলল, মহিমদা, চলো না আমরা একটু বেড়িয়ে আসি।

মহিম কাতর মুখ করে বলল, সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। মাথা দপদপ করছে। আমি এখন গাড়ি চালাতে পারব না।

ওরা দুজনে মহিমের দু পাশে দাঁড়াল।

সন্তু বলল, মাথায় হাত বুলিয়ে দেব?

মহিম বলল, না, ঘুমোলে ঠিক হয়ে যাবে। ওষুধ খেয়েছি! তোমরা এখানে থেকে কী করবে!

মহিমকে ঘুমোতে দিয়ে ওরা বেরিয়ে এল। এখন আর ওদের কিছুই করার নেই। রোদ ঝাঁঝাঁ করছে। অন্য আর কোনও টুরিস্ট আসেনি, চতুর্দিক নিস্তব্ধ। একঝাঁক টিয়াপাখি ডাকতে-ডাকতে উড়ে গেল।

একটু দূরে একটা বড় শিমুলগাছের ছায়ায় গিয়ে বসল দুজনে।

সন্তু বলল, দ্যাখ জোজো, তুই যে সেদিন ভোরবেলা এসে সাইমন বুবুম্বার কথা বললি, তখন আমি ঠিক বিশ্বাস করিনি। তারপর জানা গেল, সত্যিই আফ্রিকা থেকে ওই নামে একজন এসেছে। তাকে গুম করা হল। একটু আগে তাকে আমরা দেখেও এলাম। কিন্তু আমার একটা চিন্তা হচ্ছে। ঠাকুর সিং কি ওকে পিন হেড মাশরুম কিংবা পিংক রজনীগন্ধা ফুল খাওয়াতে পারবে? সেসব কি এখানে পাওয়া যায়?

জোজো বলল, তা হলে ডিমসেদ্ধ খাবে। মধুর অভাবে গুড়ও খেতে হয় জানিস না?

সত্যি করে বল তো, সাইমন বুবুম্বা কাঁচা-কাঁচা ফুল খায়?

আফ্রিকানরা অনেক জিনিস কাঁচা খায়। সেইজন্যই ওদের স্বাস্থ্য এত ভাল। আমরাও তো ফুলকপি কাঁচা খেতে পারি। টমাটো কাঁচা খেতে পারি। পারি না?

জোজো, এখানে শুধু তুই আর আমি আছি। আমার সামনে তোর গুল ঝাড়ার দরকার নেই। যা জিজ্ঞেস করব, স্পষ্ট সত্যি বলবি। সাইমন বুবুম্বা সত্যি-সত্যি তোদের বাড়িতে এসেছিলেন?

হ্যাঁ, একদিন সন্ধেবেলা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। ছিলেন প্রায় দেড় ঘন্টা।

তুই সব জিনিসই অনেকটা বাড়িয়ে বলিস, তাই না? সন্ধেবেলা এসেছিলেন দেড় ঘন্টার জন্য। আর তুই বলেছিলি, তোদের বাড়িতে থাকছেন, সকালে ব্রেকফাস্ট খাচ্ছেন। ঠিক আছে, মেনে নিলাম। কিন্তু তোদের বাড়িতে এসেছিলেন, তোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তবু কেন তুই আজ বললি যে সাইমন বুবুম্বার গায়ের রং কুচকুচে কালো?

আসল ব্যাপারটা বলি। উনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন বটে, কিন্তু আমার সঙ্গে সামনাসামনি দেখা হয়নি। আমি বিকেলে ব্যাডমিন্টন খেলতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম, আফ্রিকার একটা দেশের প্রেসিডেন্ট বাবার কাছে হাত দেখাতে এসেছে।

প্রেসিডেন্ট নয়। প্রেসিডেন্টের ভাই।

ওই একই হল। পরে তো প্রেসিডেন্ট হবে। বাবার ঘরের দরজা বন্ধ। আর সামনের ঘরে কুচকুচে কালো একজন আফ্রিকান বসে আছে। সে সাইমন বুবুম্বার সেক্রেটারি। সুতরাং তাকে দেখে আমি ধরেই নিলাম, বুবুম্বারও রং ওইরকম কালোই হবে। সে যে মুলাটো না ফুলাটো, তা জানব কী করে?

তোর সঙ্গে তা হলে দেখাই হয়নি?

বাবার ঘরের পেছন দিকে একটা দরজা আছে। তাতে এক চুল ফাঁক। খুব বিখ্যাত কোনও লোক এলে ওই দরজার ফাঁকে আমি আড়ি পাতি। একটু-একটু দেখা যায়, একটু-একটু কথা শোনা যায়। সাইমন বুবুম্বা সেদিকে পেছন ফিরে বসে ছিল। টুকরো-টুকরো কথা শুনে বোেঝা গেল, কবে প্রেসিডেন্ট হবে তা জানতে চায়। বাবা কী সব ধারণটারন করতে বললেন, আর একটা মুন স্টোনের আংটি দিলেন।

উনি বেরোবার সময়েও তুই দেখতে পাসনি?

একটু সময়ের জন্য আমি বাথরুমে গিয়েছিলুম, তার মধ্যেই বেরিয়ে গেলেন যে। আমি বাথরুম শেষ করে আসতে-আসতে উনি গাড়িতে উঠে বসেছেন। কিন্তু ওঁর সেই সেক্রেটারি আবার নেমে এসে বলল, মিঃ বুবুম্বা চশমাটা ফেলে গেছেন। বাবা আমাকে একটা সোনালি ফ্রেমের চশমা দিয়ে বললেন, এইটা দিয়ে দে, জোজো!

তোর এই গল্পটার কতটা সত্যি?

সেটা তুই নিজে বুঝে দ্যাখ!

তুই কথায় কথায় এত বেশি বানাস কেন, জোজো? সোজাসুজি সত্যি কথা বলতে পারিস না?

আমি তোদের মতন অর্ডিনারি হতে চাই না! আমার যা মনে আসে তাই বলি। আমার মনটা বিরাট।

ওই মুন স্টোনের কথাটা শুনেই বুঝি তুই চাঁদের পাথরের আইডিয়াটা পেয়ে গিয়েছিলি?

আইডিয়াটা কেমন ছিল বল? ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে, এমনকী জি সি বি পর্যন্ত বিশ্বাস করেছিল। এরকম দুর্দান্ত প্র্যাকটিক্যাল জোক কজন করতে পারে?

হ্যাঁ, অনেক দূর পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু মিউজিয়াম থেকে পাথরটা চুরি যাওয়ায় তোর জোকটা প্র্যাংক হয়ে গেল। তাই তো নাসির সাহেবের কাছে ধমক খেয়ে তুই প্রায় কেঁদে ফেলতে যাচ্ছিলি।

কাঁদিনি রে, কাঁদিনি! ওটা অভিনয়। মাঝে-মাঝে কান্নার অভিনয়টা প্র্যাকটিস করতে হয়।

আর-একটা কথা বল তো দিল্লি থেকে নরেন্দ্র ভার্মা যখন এসে কাকাবাবুকে সাইমন বুবুম্বার উধাও হয়ে যাওয়ার কথা বলছিলেন তখন তুই। একবারও জানালি না কেন যে, উনি তোদের বাড়িতে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, বলে আবার একটা ঝামেলায় পড়ি আর কী! একে তো নাসির সাহেব চাঁদের পাথর নিয়ে অত জেরা করে গেলেন, তারপর নরেন্দ্র ভার্মা আবার জেরা শুরু করে দিতেন! জেরায় জেরায় আমি জেরবার হয়ে যেতাম। তা ছাড়া, সাইমন বুবুম্বা আমাদের বাড়িতে গিয়েছিলেন, এটা তো একটা নিছক ঘটনা। ফ্যাক্ট! শুধু ফ্যাক্ট বলায় আমার কোনও উৎসাহ নেই।

দেখতে-দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল। তারপর ঝড় উঠল। খানিকক্ষণ। বারান্দায় বসে ঝড় দেখতে দারুণ লাগে। গাছের ডালগুলো মড়মড় করবে। অসংখ্য ঝরা পাতা উড়ছে সামনের মাঠে। একসঙ্গে গোটা দুয়েক বড় কোনও জন্তু হুড়মুড় করে চলে গেল অন্ধকারের মধ্য দিয়ে।

এখানে খবরের কাগজ আসে না। বাইরের খবর জানার একমাত্র উপায় রেডিও। রেডিওতে শোনা গেল, অসমের চা বাগান থেকে আবার একজন ম্যানেজারকে কারা যেন জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। চাঁদের পাথরটার এখনও হদিস পাওয়া যায়নি। পঞ্জাবে খুব গণ্ডগোল চলছে। সাইমন বুবুকে খোঁজা হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। পুলিশ দশ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে, সাইমন বুবুষার সঠিক খবর যে দিতে পারবে, সে পাবে। প্রধানমন্ত্রী জরুরি ক্যাবিনেট মিটিং ডেকেছেন, আজ রাত্তিরে আরও ঝড় বৃষ্টি হতে পারে।

খবর শুনে জোজো বলল, ওই দশ লক্ষ টাকা তো আমাদেরই পুরস্কার পাওয়া উচিত। আমরা সাইমন বুবুম্বাকে বন্দি অবস্থায় একটা বাড়িতে দেখেছি। এটা তো সঠিক খবর।

সন্তু বলল, আমরা যে দেখেছি, তার প্রমাণ কী?

বাঃ, আমরা তিনজন দেখেছি। স্পষ্ট দেখেছি। দশ লক্ষকে তিন দিয়ে ভাগ কর। থ্রি পয়েন্ট থ্রি থ্রি থ্রি লাখ টাকা আমিও পাব কিন্তু?

দাঁড়া, দাঁড়া জোজো। তুই যে আগেই কালনেমির লঙ্কা ভাগ করতে বসে গেলি। নিজের চোখে দেখাটাই প্রমাণ নয়। আমাদের দেওয়া খবর অনুযায়ী পুলিশ যদি ওকে উদ্ধার করতে পারে, তাকেই বলে প্রমাণ। কিন্তু পুলিশকে যেতে দেখলেই ঠাকুর সিং হয় সাইমন বুবুম্বাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই কোথাও সরিয়ে ফেলবে কিংবা মেরে কেটে কুচি কুচি করে নদীতে ভাসিয়ে দেবে। কোনও প্রমাণ থাকবে না। গেটের দু পাশে দুটো গম্বুজ দেখিসনি? নিশ্চয়ই ওর ওপর উঠে রাত্তিরবেলা ওরা নজর রাখে। ওই টিলায় ওঠার আর কোনও রাস্তা নেই।

জোজো বিরক্তির সঙ্গে বলল, দূর ছাই!

কাকাবাবু বারবার শুধু সাইমন বুবুম্বার ফাইলটা পড়ে যাচ্ছেন আর। টেলিফোনে লাইন পাওয়ার চেষ্টা করছেন। ওদের সঙ্গে বিশেষ কথা বলছেন না।

রাত্তিরের খাওয়াদাওয়া চুকে গেল তাড়াতাড়ি। কাকাবাবু শুতে চলে গেলেন।

সন্তু আর জোজো এত তাড়াতাড়ি ঘুমোতে চায় না। ওরা গল্প করতে লাগল বারান্দায় বসে। ঝড় তেমন প্রবল নয়, হাওয়া বইছে শোঁ-শোঁ শব্দে। তার সঙ্গে মিশে আছে উড়ন্ত বৃষ্টি।, রাত যখন প্রায় এগারোটা, তখন একটা গাড়ি স্টার্ট নেওয়ার শব্দ পাওয়া গেল।

ওদের গাড়িটা রয়েছে একটা গাছের নীচে। এত রাত্রে সেটা চালাতে চাইছে। কে? কোনও চোর নাকি?

সন্তু আর জোজো দুজনেই ছুটে গেল।

না, চোর নয়। মহিমই বসে আছে স্টিয়ারিংয়ে।

সন্তু জিজ্ঞেস করল, এ কী মহিমা, তোমার শরীর খারাপ, এখন কোথায় যাচ্ছ?

মহিম বলল, শুয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না। একটু ঘুরে আসব।

সন্তু বলল, আমরাও যাব। এই সময় অনেক জন্তু-জানোয়ার দেখা যেতে পারে।

মহিম এবার গম্ভীরভাবে বলল, না, তোমরা যাবে না।

কেন, আমরা যাব না কেন?

আমি জঙ্গলে যাচ্ছি না। আমি যেখানে যাচ্ছি…তোমাদের বিপদে ফেলতে চাই না। আমাকে একাই যেতে হবে।

অ্যাঁ? তুমি ঠাকুর সিংয়ের বাড়ি যাচ্ছ? পাগল হয়েছ নাকি?

মোটেই পাগল হইনি। রেডিওতে শুনলাম দশলাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছে। আমি একবার প্রাণপণ চেষ্টা করে দেখব।

সকালবেলা তুমি ধরা পড়ে গেলে, তারপর ওই কাণ্ড হল। আবার তুমি একা যাচ্ছ?

এবার সাবধান হয়ে যাব। শোনো, দশ লক্ষ টাকা পেলে আমি মধ্যমগ্রামে একটা ছোট বাড়ি বানাব। চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকায় একটা রেডিওর দোকান খুলব। বাকি জীবনটা শান্তিতে কাটবে। এই দশ লক্ষ টাকার জন্য একটা বড়রকমের ঝুঁকি তো নিতেই হবে। যদি লুলুম্বা সাহেবকে উদ্ধার করতে পারি—

লুলুম্বা নয়, বুবুম্বা।

ওই যা হোক। আফ্রিকার রাজার ভাইটাকে যদি একা উদ্ধার করতে পারি, পুলিশের টাকা তো পাবই, ওই কালো সাহেবও নিশ্চয়ই আমাকে কিছু পুরস্কার দেবেন নিজে থেকে।

কিন্তু তুমি একা পারবে কী করে?

গাড়ি নিয়ে পুরোটা যাব না। টিলার নীচে রেখে দেব। চুপিচুপি পায়ে হেঁটে উঠব। পাঁচিলের এক জায়গায় খানিকটা নীচু আছে, সকালে দেবে রেখেছি, সেখান দিয়ে ঢুকব।

ভেতরে দুটো ভয়ঙ্কর কুকুর আছে।

সে ব্যবস্থাও করা হয়ে গেছে। ডিনারে যে মাংস দিয়েছিল, খাইনি, রেখে দিয়েছি। খুব কড়া ঘুমের ওষুধ আছে আমার কাছে। সেই ওষুধ মেশান মাংস ছুঁড়ে দেব আগে। কুকুর দুটো খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে। আর যে দশ বারোজন লোক বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায়?

তাদেরও ঘায়েল করার উপায় আছে। কলকাতা থেকেই বড় এক শিশি ক্লোরোফর্ম নিয়ে এসেছি। রুমালে ক্লোরোফর্ম ভিজিয়ে এক-একটা লোককে পেছন থেকে ধরে-ধরে অজ্ঞান করে দেব।

মহিমা, এসব সিনেমায় হয়। বাস্তবে হয় না। কেউ না কেউ তোমায় ধরে ফেলবে।

বাস্তবে যা হয়, সিনেমাতে তাই-ই দেখায়। সরে যাও, সন্তু, এই দশ লক্ষ টাকা আমার চাই।

সন্তু এবার হাত বাড়িয়ে স্টিয়ারিং চেপে ধরে বলল, তোমাকে একা কিছুতেই যেতে দেব না। আমরাও যাব। চল, জোজো ওঠ।

জোজো বলল, আমাকে মাফ করো, ওই সিংহের গুহায় আমি যেতে চাই না। এমনই দশ-বারোজন গুণ্ডাকেও আমি ভয় পাই না। রদ্দা মেরে ঠাণ্ডা করে দিতে পারি। কিন্তু বড় বড় কুকুর, একটু ওষুধ মেশানো মাংস খেয়েই ঘুমিয়ে পড়বে, এ আমি বিশ্বাস করি না।

সন্তু বলল, ঠিক আছে, তুই থাক। কাকাবাবুকে ম্যানেজ করিস, যেন জানতে না পারেন। আমি যাব মহিমদার সঙ্গে।

মহিম বলল, যেতে পারো এক শর্তে। যদি সাকসেসফুল হই, তুমি কিন্তু ওই দশ লাখ টাকার ভাগ চাইবে না। তুমি ছেলেমানুষ, পরে অনেক রোজগার করতে পারবে।

সন্তু বলল, না, না, আমার টাকা চাই না। জোজো বলল, আমাদের দুজনকে অন্তত একলাখ করে দিও। সন্তু বলল, মহিমা, তোমার কাছে ছুরিটুরি আছে কিছু? মহিম বলল, না। সন্তু বলল, একটা অন্তত সঙ্গে রাখা দরকার। অন্তত যদি দড়ি-টড়িও কাটতে হয়..আমার একটা ভোজালি আছে, নিয়ে আসব?

মহিম বলল, যাও, চটপট আনো। আর যদি একটা টর্চ আনতে পারো ভাল হয়। আমার কাছে টর্চও নেই।

সন্তু দৌড়ে বাংলোয় ফিরে গেল। সে আর জোজো এক ঘরে শোয়। ভোজালিল সে-ঘরেই আছে। কিন্তু টর্চটা কাকাবাবুর কাছে। একটা টর্চ লতা লাগবেই।

কাকাবাবুর ঘরের দরজাটা আস্তে করে ঠেলতেই খুলে গেল। ভেতরটা অন্ধকার। কাকাবাবুর নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাকাবাবু ঘুমিয়ে পড়েছেন।

সন্তু পা টিপে টিপে ঘরের মধ্যে এল।

টর্চটা কাকাবাবুর শিয়রের কাছে একটা ছোট টেবিলের ওপর রাখা আছে, সন্তু আগেই দেখেছে। অন্ধকারে আন্দাজে চলে এল সেখানে। টর্চটা তুলে নিল। কাকাবাবু জাগেননি।

দরজা পর্যন্ত ফিরে আসতেই কাকাবাবু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলেন, টর্চ নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস এখন?

সন্তু থমকে গেল, তার বুক কেঁপে উঠল।

অপরাধীর মতন বলল, একটু মহিমদার সঙ্গে ঘুরে আসতে যাচ্ছি। কাকাবাবু বললেন, এত রাত্রে! আমাকে না বলে? তোকে বারণ করেছিলাম না?

মহিমা যে যেতে চাইছে। একা-একা। তাই আমি–

মহিম কোথায় যেতে চাইছে?

ওইখানে?

মানে, ঠাকুর সিংয়ের বাড়িতে? ইডিয়েট! শিগগির ডেকে নিয়ে আয় মহিমকে। বলবি, নরেন্দ্র ভার্মা গাড়িটা আমার ব্যবহারের জন্য দিয়েছে। আমার হুকুম ছাড়া মহিম গাড়ি নিয়ে যাওয়ার কে? যা, তাকে ধরে নিয়ে আয়?

জোজো আর সন্তুর সঙ্গে মহিম যখন এ-ঘরে এল, তখন আলো জ্বলে গেছে, কাকাবাবু বিছানায় উঠে বসেছেন।

কাকাবাবু সাধারণত নিজের লোকদের কড়া গলায় কথা বলেন না। এখন তিনি বেশ রেগে গেছেন বোঝা গেল। মুখখানা থমথমে হয়ে আছে। প্রচণ্ড ধমকের সুরে তিনি বললেন, কোন সাহসে তুমি আমাকে না বলে গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলে?

মহিম গোমড়ামুখে বলল, ঠিক আছে, আমি গাড়ি নেব না। পায়ে হেঁটেই যাব।

কাকাবাবু আরও জোরে বললেন, দশ লক্ষ টাকা পুরস্কারের কথা শুনে বুঝি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? সকালে ধরা পড়ে কোনওক্রমে বেঁচে গেছ। এবার ধরা পড়লে ওরা একটুও দয়া মায়া দেখাত না। প্রাণেই যদি বাঁচতে না পারো, তা হলে পুরস্কারের টাকাটা ভোগ করবে কী করে? নিজের ক্ষমতা না বুঝে যারা বিপদে ঝাঁপ দেয়, তারা বেঘোরে মরে!

মহিম এবার চুপ করে গেল।

কাকাবাবু বললেন, ওইভাবে যদি লোকটাকে উদ্ধার করা যেত, তা হলে আমিই কি সে-চেষ্টা করতাম না? ঠাকুর সিং ওই লোকটাকে দেখিয়ে দিল তো ওইজন্যই। যাতে আমরা রাত্তিরে আবার ঢোকার চেষ্টা করি আর গুলি খেয়ে মরি। আমি অন্য একটা পরিকল্পনা করছি, এর মধ্যে তোমরা ওর খপ্পরে পড়ে গেলে সব নষ্ট হয়ে যাবে।

এবার সন্তুর দিকে ফিরে বললেন, তুই এত বোকা হয়ে গেলি কী করে, সন্তু! আমি ঘুমিয়ে পড়লেও আমার ঘরে ঢুকে কেউ কিছু নিয়ে চলে যাবে, অথচ আমি জাগব না, এরকম কখনও হয়েছে আগে?

জোজো বলল, আমি শেষপর্যন্ত ওদের যেতে দিতাম না, কাকাবাবু! ওরা দুজনে যখন কথা বলছিল, ততক্ষণে আমি গাড়ির চাবিটা টুক করে সরিয়ে ফেলেছিলাম!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress