এত রাত্রে আবার
বিপাশা বলল, কী ব্যাপার এত রাত্রে আবার?
প্রদোষ মুখে একটু ব্যঞ্জনাময় হাসি ফুটিয়ে বলল, ঢুকতে দেবেন না বুঝি?
হ্যাঁ, আপনি বলেই কথা বলে ওরা।
কারণ পালিশটা হারাতে হাজী নয়, রাজী নয় মুখোশটা খুলতে। কেউটে সাপ খেলাবে, তবু ভাব দেখাবে যেন রবারের সাপ নিয়ে খেলছে।
ব্যঞ্জনার হাসি বিপাশাও হাসতে জানে বৈকি। সেই হাসির সঙ্গে তীক্ষ্ণ কথার হুল বসায় সে, না-দেওয়াই তো উচিত।
তাহলে ফিরে যেতে হয়।
বিপাশা মুখ টিপে হাসে, আমিও তাই বলছি।
এক পেয়ালা কফি না-খেয়ে নড়ছি না। হঠাৎ ভীষণ ইচ্ছে জেগে উঠল—
রাত্তির এগারোটায় আর কফি খায় না।
এগারোটা নয়, পৌনে এগারোটা।
ওই একই কথা।
দরজা আগলে দাঁড়িয়ে রইলেন মনে হচ্ছে। সত্যিই ঢুকতে দেবেন না নাকি?
ভাবছি—
অপমানিত হচ্ছি কিন্তু।
হচ্ছেন বুঝি?
হাসির ছুরি ঝলসায়। তাহলে তো দরজা ছাড়তেই হয়। শেষে পরে আবার বন্ধু এলে লাগিয়ে দেবেন!
বন্ধু এলে?
প্রদোষের চোখের কোণে এক ঝিলিক আগুন জ্বলে ওঠে, পালিত ফেরেনি এখনও?
কোথায়! বারোটার আগে কবে ফেরে? পকেটের সব টাকা ফুরিয়ে গেলে তবে তো ফিরবে।
ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে বসে প্রদোষ।
সোফায় গা হেলিয়ে বলে, আচ্ছা, ও কেন তাস খেলে?
খেলতে জানে না বলে খেলে।
বাস্তবিক, আপনার বারণ করা উচিত। রোজ যখন হারে।
বিপাশা মুচকে হেসে বলে, হারাই ওর ভাগ্য। সব খেলাতেই হারছে।
তার মানে ওর পার্টনার আনাড়ি।
যা বলেন।
প্রদোষ চঞ্চল গলায় বলে, ও সত্যি বারোটার আগে ফেরে না?
বিপাশা আবারও সেই হাসি হাসে, গ্যারান্টি দিতে পারছি না। এক্ষুনিও এসে যেতে পারে।
তার মানে ভয় দেখাচ্ছেন?
কী আশ্চর্য, এর মধ্যে আবার ভয়ের প্রশ্ন কি? এখন বলুন পুনরাগমনের হেতুটা।
যদি বলি হতভাগ্য আশ্রয়হীন, আশ্রয় চাইতে এসেছে?
বিপাশা বলল, মনে করব তামাশা করছেন।
দেখছি লোকের মর্মান্তিক যন্ত্রণা আপনার কাছে তামাশার বস্তু ছাড়া আর কিছুই নয়! এই সব মেয়েকেই সাধুভাষায় বলে পাষাণী।
তা পাষাণী দেখতেই তো আপনি অভ্যস্ত। বিপাশার সব মুখটা বিদ্রুপে কুঁচকে যায়।
তা যা বলেছেন, সাধে বলি হতভাগ্য!
গিন্নির গোঁসা ভাঙেনি?
কখন আর ভাঙল? এই তো ঘণ্টা দেড়েক আগে গেছি। এর মধ্যে আর—
এক মুহূর্তে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল তছনছ হয়ে যেতে পারে।
পারে? আপনি বলছেন পারে? স্বর্গ-মর্ত্য তছনছ হয়ে যেতে পারে?
নিয়তিতে থাকলে পারে বৈকি।
প্রদোষের চোখে আবার আগুনের ঝিলিক ঝলসে ওঠে, তাহলে দায়ী হচ্ছে নিয়তি?
তা বলে সব ক্ষেত্রে নয়—বিপাশা হেসে ওঠে, আর সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ একটা ভারী কাঁচের ফুলদানি টেবিল থেকে তুলে উঁচু করে ধরে বলে ওঠে, যেমন ধরুন, এইটাকে যদি ধরে আছাড় মেরে ভাঙি, সেটার জন্যে নিয়তিকে দায়ী করব না।
প্রদোষ উঠে দাঁড়িয়েছিল, চঞ্চল পায়ে এদিক-ওদিক করছিল, আবার ঝুপ করে সোফায় বসে পড়ে একটা অদ্ভুত হাসি হেসে বলে, হাতিয়ার হাতে রাখছেন? এত ভয়?
বিপাশার কাঁধের কাপড় খসে পড়েছিল, বিপাশা ফুলদানিটা নামিয়ে রেখে ধীরে-সুস্থে চ্যুত অঞ্চল বিন্যস্ত করে অবোধের গলায় বলে, ভয়-হাতিয়ার—এসব অদ্ভুত শব্দগুলো ব্যবহার করছেন কেন বলুন তো? বিরহের জ্বালায় জ্বলে জ্বলে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে বুঝি?
প্রদোষ ওই বাঁকানো ঠোঁটের অসাধারণ কুটিল একটা ভঙ্গির সঙ্গে নিতান্ত সাধারণ ওই তামাশার কথাগুলো মেলাতে পারে না, তাই প্রদোষ আবার চঞ্চল হয়ে ওঠে দাঁড়ায়, বলে, যদি বলি তাই? যদি বলি এই বিরহ আর বরদাস্ত হচ্ছে না?
তবে যান গিয়ে পলাতকার পায়ে ধরুন গে।
তার কথা ছাড়ুন, প্রদোষ উত্তেজিত গলায় বলে, ওই এক সেন্টিমেন্টাল মহিলাকে নিয়ে জীবন বিষময় হয়ে গেল আমার। অকারণ খানিকটা সিন্ ক্রিয়েট করে—ছেলেটিও হয়েছেন মায়ের উপযুক্ত।
ওকে বাইরে কোথাও পাঠিয়ে দিন না। বিপাশা সচিবের ভূমিকা নেয়, বাইরে কোনো বোর্ডিংয়ে। তাতে ওর মন ভালো থাকবে।
আমি তা ভেবেছি, প্রদোষ সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে, কিন্তু যা একবগা, হয়তো যেতেই চাইবে না।
বিপাশা ক্রুর হাসি হাসে, তাহলে নাচার। তবে শুনছি তো গিন্নি কেস ঠুকছেন।
প্রদোষ ওই কালো-রঙা মুখের গাঢ় রক্তিম ঠোঁট দুটোর দিকে চেয়ে দেখে, যেন কোন এক অজানা দেশের ভয়ঙ্করী পাখি, ওই চড়া রঙের ঠোঁট দুটো দিয়ে ঠুকরে তুলে নিতে এসেছে প্রদোষের সারা জীবনের স্বস্তি শান্তি, সভ্যতা সম্রম, অতীত ভবিষ্যৎ।
প্রদোষের শক্তি নেই ওর কবল থেকে সেগুলি রক্ষা করবার। অতএব প্রদোষ নিয়তিকে মানবে। নিজেকে নিয়তির হাতে সমর্পণ করবে। প্রদোষ ভাববে—শুধু কি আমিই একলা? জগতের লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ এই নিয়তির দাসত্ব করছে না? প্রদোষের ঘটনার অনেক আগে লেখা হয়ে গেছে, তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ। প্রদোষ বিহুল গলায় বলে, চুলোয় যাক ও-কথা।
চুলোয় যাক?
হ্যাঁ হ্যাঁ। আমি ওসব কেয়ার করি না। ও-ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়। অনেক বলেছিলাম—অকারণ কতকটা কেলেঙ্কারী করার মানে হয় না। তা কানেই নিলেন না। আমাকে কোর্টে দাঁড় না-করিয়ে ছাড়বেন না।
পাখির ঠোঁট দুটো আগুনের মতো জ্বলে।
গিন্নির অবাধ্য হচ্ছেনই বা কেন?
হচ্ছি কেন? প্রদোষ হঠাৎ উঠে সেই চকচকে সাপের মতো নিরাভরণ আর নিরাবরণ হাত দুটোর মূল অংশটা চেপে ধরে উত্তেজিত গলায় বলে, বলব—কেন হচ্ছি?
গাঢ় রাত্রি, নির্জন ঘর, স্বামী নেই বাড়ি, তবু একবিন্দু বিচলিত হয় না বিপাশা। শুধু আস্তে কৌশলে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে অবহেলার গলায় বলে, থাক্! আপনার গৃহবিবাদের কাহিনি শুনে আমার লাভ কি?
বিবাদটা যে আপনাকে কেন্দ্র করেই।
ওমা, সেকি?
বিপাশা আকাশ থেকে পড়ে, আমি আবার হঠাৎ আপনাদের কি বলে—দাম্পত্য জীবনের মাঝখানে গিয়ে পড়লাম কোন্ অধিকারে? এত বাজে কথাও বলতে পারেন! দাঁড়ান, কফি খান একটু-না-খেয়ে নড়বেন না মনে হচ্ছে। তাড়াতাড়ি বিদায় হবেন।
বিপাশা দরজার দিকে এগোয়।
প্রদোষ তীব্র আর তীক্ষ্ণ হেসে বলে, বেহায়াদের কাছে সব হিন্টই ব্যর্থ। যদি বলি আজ আর শুধু হাতে বিদায় নেব না প্রতিজ্ঞা নিয়ে এসেছি?
সর্বনাশ! একেবারে প্রতিজ্ঞা! আরে চারু এসে গেল মনে হচ্ছে যেন। গাড়ির শব্দ হল। বলে টুক করে কেটে পড়ে বিপাশা?
নাগিনী-কন্যা তার সাপের ঝাপিটা একটুখানি খোলে আর বন্ধ করে ফেলে। দেখতে দেয় না সত্যি কি আছে। কিন্তু পালিত এসেছে বলে অবহিত করিয়ে দেবার কি ছিল? কবেই বা এসময় সজ্ঞানে বাড়ি ফেরে চারুতোষ পালিত?
আর সজ্ঞানে যখন থাকে? তখন তো বড়ো বেশি অজ্ঞান! তাই বন্ধুকে দেখে যেন হাতে চাঁদ পায়।
বলে, আপনাকে দেখে আমার ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে মনে হচ্ছে। ভীষণ টায়ার্ড ফিল করছি, অথচ গ্লোবের দুটো টিকিট কাটা রয়েছে, আর মিসেসকে কথা দেওয়া রয়েছে। অনুগ্রহ করে যদি এই ঘণ্টাতিনেক সময়টি আমার হিতার্থে ব্যয় করেন!—এই হচ্ছে চারুতোষ।
কাজেই চারুতোষ যদি রাত বারোটায় বাড়ি ফিরে দেখেও তার বাড়ির সন্ধ্যার অতিথি দ্বিতীয় আবির্ভাবে আবার মধ্যরাতের অতিথি হয়েছে, শানানো ছুরি নিয়ে অথবা জিভে ছুরি শানিয়ে তেড়ে আসবে না।
তবু ঘোষণাটা করে গেল বিপাশা। হয়তো সত্যিও নয়, হয়তো গাড়ির শব্দ পায়নি, তবু এইভাবেই খুঁটি চালে বিপাশা।
খানিকটা পরে যখন কফির পেয়ালা হাতে নিয়ে ফিরে এল বিপাশা, তখন ঘরের উষ্ণ বাতাস মিইয়ে গেছে। প্রদোষ সেই মিয়োনোর প্রতীকের মতো বসে আছে পাইপটা ঠোঁটের কোণে ঝুলিয়ে।
প্রদোষ হাত বাড়াল চট করে, শুধু সোজা হয়ে বসল, বলল, মুখে যতই সাহস দেখান, আসলে আপনি একটা ভীরু মহিলা।
ভীরু? বিপাশা একটু বাঁকা হাসি হেসে বলে, কে? আমি?
নিশ্চয়।
তা বেশ। ভীরুই। নিন, এখন এটা খান।
দিন—হাত বাড়িয়ে পেয়ালাটা ধরে প্রদোষ, তার সঙ্গে পেয়ালাধরা হাতটাও। বলে, যতটুকু লাভ। নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক।
বাকির কোনো খাতাই নেই! বিপাশা বলে গম্ভীর গলায়।
প্রদোষ হাতটা ছেড়ে দেয়। বলে, রাগ করলেন তো?
সেই তো মুশকিল, আপনারা চির-রহস্য। বোঝা যায় না কোন্টা আপনাদের সত্যি, আর কোষ্টা তামাশা। কোন্টা পছন্দ করছেন, কোন্টা পছন্দ করছেন না।
ওঃ, সব কিছুই বুঝে ফেলতে চান? খুব সাহস তো!
নাঃ, সাহস আর কোথায়? প্রদোষ হতাশ গলায় বলে, ঠিকই বলেছেন, ভীরু আমি। ভালো ভালো নভেলের নায়করা কখনও আমার মতো এমন অনুকূল অবস্থাকে অপচয় করে না।
বিপাশা হঠাৎ ভারী ঘরোয়া বৌয়ের সুর আনে গলায়। বলে, নভেলের কথা নভেলেই মানায়।
প্রদোষ কফির পোয়ালাটা হাত থেকে নামায়। প্রদোষের চোখের কোণায় আগুন জ্বলে ওঠে। কেন, শুধু নভেলেই বা মানাবে কেন? নভেলের বাইরেই বা মানাবে না কেন? মানুষকে নিয়েই তো নভেল।…
তা হোক, বিপাশা তার গলায় সেই ঘরোয়া সুরটাই বজায় রাখে, তবু একথা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না, অবস্থা অনুকূল হলেই মানুষ পশু হয়ে উঠে বন্ধুর বিশ্বস্ততা নষ্ট করে তার স্ত্রীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে, অথবা মেয়েরা সুযোগ, অথবা বলা যেতে পারে কুযোগ, জুটলেই এক মুহূর্তে সততা সভ্যতা পবিত্রতা, সব কিছু জলাঞ্জলি দিয়ে বসতে পারে! অথচ, আপনাদের ওই আধুনিক সাহিত্যের পাতা খুললেই এই সব ঘটনা।
বলে, এই রকম সুন্দর আর সৎকথা মাঝে মাঝেই বলে বিপাশা, শুধু ওর গলার সুরের সঙ্গে চোখের কটাক্ষের মিল থাকে না।
এখনও রইল না।
প্রদোষ ওর কটাক্ষের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে বলে, তার কারণ হচ্ছে আধুনিক লেখকেরা ধরে ফেলেছে আসল মানুষটা হচ্ছে ওই। সভ্যতা নামের একটা আবরণ চাপিয়ে সেই আসল মানুষটাকে চাপা দিয়ে দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছি আমরা।
তাহলে আর আসল মানুষটা বলছেন কেন? বলুন আসল জানোয়ারটা!
প্রদোষ হেসে ওঠে। তা, তাও বলতে পারেন। পোশাক-পরিচ্ছদ ঢাকা এক-একটা জানোয়ারই। মানুষ যে তার ওপর দেবত্ব আরোপ করতে চায়, সেটা হচ্ছে কবির কল্পনা। এই আমি এই মুহূর্তে জানোয়ার হয়ে উঠতে পারি।
ওরে সর্বনাশ! চোখের কোণে বিদ্যুৎ খেলিয়ে বিপাশা ভয় পাওয়ার অভিনয় করে বলে ওঠে, তাহলে তো আত্মরক্ষার্থে সরে পড়াই উচিত।
বলে, কিন্তু সরে পড়ে না। আর তার নিরুদবিগ্ন মুখচ্ছবি দেখে মনেও আসে না আত্মরক্ষার গরজ তার বিন্দুমাত্রও আছে।
এক চোখে প্রশ্রয়, আর-এক চোখ শাসন নিয়ে সে যেন এক অভিনব খেলার মজা উপভোগ করে বসে বসে। আর হয়তো মানুষ যে জানোয়ার, প্রদোষের এই কথাটার প্রমাণপত্রের অপেক্ষা করে। এবং অপেক্ষায় হতাশ হলে ভাবে…ভীরু, ভীরু! পুরুষ জাতটাই এক নম্বরের ভীরু!… চারুতোষটাকে অমানুষ ভাবি, কোন্টাই বা মানুষ? অথবা জানোয়ার?