Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » শান্তিনিকেতনে অশান্তি || Sujan Dasgupta » Page 5

শান্তিনিকেতনে অশান্তি || Sujan Dasgupta

৷৷ ২১ ৷৷

আমি আগে ভাবতাম শুধু আমাদের দেশেই ডানহাত জানে না বাঁ-হাত কী করছে। দেখলাম আমেরিকাতেও তাই। পুলিশ যার খোঁজ করছে ক্রিমিন্যাল বলে, সে দিব্যি ইমিগ্রেশনের বেড়াজাল ডিঙিয়ে এদেশে ওদেশ করছে। ইমিগ্রেশনের লোকরা যাদের পাকড়াও করছে, পুলিশ আবার তাদের খবর রাখে না। আমি হয়তো একটু সরলীকরণই করছি। কিন্তু মাত্র ক’দিন আগে যে লোকটা জেলের কয়েদি ছিল, সেই আব্দুল এদেশ ছেড়েছে চলে গেছে না আছে সেই সহজ প্রশ্নটার উত্তর না মেলার আর কোনো কারণ থাকতে পারে না।

পুলিশ টম ক্যাসিডিরও কোনো খোঁজ পায়নি। ব্রুকলিনে যেখানে থাকত, সেখানে নেই। কোথায় গেছে বাড়িওয়ালা জানে না। একেনবাবুর কথায় মনে হল পুলিশ অ্যাকটিভলি ওকে খুঁজছে না। সম্ভবতঃ ব্ল্যাকমেইল অ্যাঙ্গেল থেকেই পুলিশ এই হত্যাকান্ড দুটোকে দেখছে।

প্রমথ রাত্রে ডিনার খেতে খেতে একেনবাবুকে চেপে ধরল, “আপনার কী মনে হয় মশাই, মার্ডারটা ব্ল্যাকমেইল সংক্রান্ত?”

“হু নোজ স্যার।”

“হু নোজ মানে! আপনি ডাকসাইটে ডিটেকটিভ, আমাদের গর্ব। আপনি দ্যুম করে ‘হু নোজ’ বললে তো চলবে না।”

“শুনছেন স্যার প্রমথবাবুর কথা,” আমার দিকে তাকিয়ে একেনবাবু বললেন।

“শুনবে না কেন, প্রমথ বলল। “ও-তো কালা নয়। কিন্তু আপনি মশাই আমার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না কেন?”

“পুলিশ তো মনে হয় ব্ল্যাকমেইল থিওরির দিকেই এগোচ্ছে।”

“আর আপনি?”

“আমি আর অন্য কী ভাবব বলুন স্যার। ঢাল নেই তলোয়ার নেই, আমি তো নিধিরাম সর্দার।”

একেনবাবুর ক্ষোভের কারণটা আমি জানি। দু’দিন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ছুটিতে আছেন। ওঁর ডেপুটি রবার্ট, যাঁর পদবীটা ঠিক মনে করতে পারছি না –একেনবাবুকে একেবারেই পছন্দ করেন না। সেখান থেকেই নিশ্চয় কোনো থাবা-টাবা খেয়েছেন।

তবে প্রমথ ছাড়ল না। বলল, “ঢাল-তলোয়ার নেই কেন? বাপির মতো অ্যাসিস্টেন্ট আপনার। আমি আছি। চাইলে ফ্রান্সিস্কাকেও দলে নিতে পারেন।”

“এটা ভালো বলেছেন স্যার। আপনারা সত্যি সত্যি দলে থাকলে, অন্যকে ঘোড়াই কেয়ার করি।”

“গুড। এবার বলুন, পুলিশ কেন ব্ল্যাকমেইল থিওরির দিকে এগোচ্ছে।”

“সঠিক বলতে পারব না স্যার। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তো নেই। তবে যেটুকু শুনলাম, তা হল দিলীপ পারেখের ‘বস’ বল্লভ শাহ বলে একটি লোকের উপর পুলিশের সন্দেহ পড়েছে। তাঁকে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।”

এই বল্লভ শাহর কথাই বোধহয় রোহিত রয় সেদিন বলেছিলেন। “উনি কি নানান ধরণের বিজনেস করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ স্যার।”

“তাঁকে সন্দেহ করার কারণ?”

“একটা কারণ, বাজারে ওঁর খুব একটা সুনাম নেই।”

“মানে ঠগ-জোচ্চুরি করেন, তা ঝেড়ে কাশুন না,” প্রমথ বলল। “কীসের ব্যাবসা ওঁর?”

“অনেক কিছুর স্যার, ভিডিও স্টোর থেকে শুরু করে, হোটেল, ডায়মন্ড, অ্যান্টিক, ট্রাভেল এজেন্সি।”

“এর মধ্যে ঠগ-জোচ্চুরি কোথায়?”

“ঠগ-জোচ্চুরি উনি কতটা করেন সেটা পরিষ্কার নয়। তবে যাদের সঙ্গে উনি কারবার করেন, তাদের অনেকেই শেডি ক্যারেক্টার। কয়েকজনের ক্রিমিন্যাল রেকর্ডও আছে। আর ওঁর হোটেলটারও দুর্নাম আছে।”

নিশ্চয় নারীঘটিত ব্যাপার মিন করছেন। এই ধরণের প্রসঙ্গ এলে একেনবাবুকে ইশারায় বুঝে নিতে হয়।

“তাই যদি হয়, তাহলে পুলিশ এতদিন ওকে ধরেনি কেন?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“ধরত স্যার। ধীরে ধীরে তদন্তের জাল গুটিয়ে আনছিল।”

“কিন্তু এর সঙ্গে খুনের সম্পর্ক কি?” এবার আমার প্রশ্ন।

“সেটাই বলছি স্যার। রোহিত রয় যেদিন খুন হন, তার আগের রাতে বল্লভ শাহ রোহিতের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলেন। বল্লভ শাহর বক্তব্য শ্রেফ গল্প করতে। কিন্তু যেটা সবচেয়ে সন্দেহজনক, সেটা হল রোহিত রয় খুন হবার দিন সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বল্লভ শাহ রোহিত রয়ের বিল্ডিং-এ এসেছিলেন। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী মৃত্যু ঘটেছিল আটটা থেকে ন’টার মধ্যে। তার মানে মৃত্যুর সময়ে বল্লভ শাহ ঐ বিল্ডিং-এ ছিলেন।”

“মাই গড!” আমি বললাম। “কিন্তু পুলিশ এতদিন সেটা জানতে পারেনি কেন?”

“কারণ বিল্ডিং সিকিউরিটির কাছে কোনো রেকর্ড ছিল না। পুলিশ জানতেও পারত না, বল্লভ শাহকে প্রশ্ন না করলে।”

“কেন গিয়েছিলেন তার কোনো জবাবদিহি আছে?” প্রমথ জানতে চাইল।

“বল্লভ শাহ বলছেন, সকালে বাড়ি থেকে বেরোবার সময়ে উনি খেয়াল করেন যে ওঁর গাড়ির চাবি মিসিং। গাড়ির চাবিটা একটা ছোট রিং-এ লাগানো থাকে। সেই রিংটা আবার আটকানো থাকে ওঁর বড় চাবির রিং-এ। এর আগেও এরকম হয়েছে যে গাড়ির চাবির রিংটা বড় রিং থেকে খুলে পড়ে গেছে। তাই এবার গাড়ির চাবির রিং না পেয়ে বল্লভ শাহর মনে হয়েছিল, ওটা নিশ্চয় রাতে রোহিতের ফ্ল্যাট থেকে আসার সময়ে লিফটে ঢোকার মুখে পড়ে গেছে।”

“লিফটে ঢোকার মুখে কেন?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“কারণ স্যার, উনি সেই সময়ে ঝন্ন করে একটা আওয়াজ পান। কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক ওঁর মাথায় আসেনি ওটা চাবির আওয়াজ।”

“পকেট থেকে চাবি কী করে পড়ে যায়! পকেট ফুটো থাকলে অবশ্য অন্য কথা। এটা খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য এক্সপ্লানেশন নয়।” আমি মন্তব্য করলাম।

“পুলিশেরও একই প্রশ্ন ছিল। ওঁর উত্তর, উনি সবসময়ে চাবির ডগা দিয়ে লিফটের বোতাম টেপেন। বোতাম টেপার পরে পকেটে চাবি রাখার সময়ে নিশ্চয় রিংটা খুলে পড়ে যায়।”

আপাতভাবে এটা অস্বাভাবিক আচরণ মনে হলেও, এটা কিন্তু শীতকালে অনেকেই করে। আমিও মাঝেমাঝে করি। শীতকালে কার্পেটের উপর হেঁটে এসে লিফটের বোতাম কিংবা দরজার মেটাল হ্যাঁন্ডেলে হাত দিলে প্রায়ই শক খেতে হয় স্ট্যাটিক ইলেক্ট্রিসিটির জন্যে। চাবির ডগা ঠেকালে সেখানেই স্পার্কটা হয়, গায়ে শক লাগে না।

আমি বললাম, “ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট তো নেই, আপনি এত খবর জোগাড় করলেন কী করে?”

“বল্লভ শাহই আমাকে বললেন স্যার। পুলিশের হাতে হেনস্তা হবার পর আমাকে ফোন করেছিলেন। কার কাছে জেনেছেন, আমি নাকি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের দোস্ত। তাই বোধ হয় ভেবেছেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ওঁর সাইডটা আমি বুঝিয়ে বলব।”

“আপনার কি মনে হয় উনি সত্যি কথা বলছেন?”

“গোলমাল নিশ্চয় কিছু আছে। ঠিক বুঝছি না, খামোখা কেন উনি বলতে গেলেন সকালে মিস্টার রয়ের বিল্ডিং-এ যাওয়ার কথা!”

“কারণ সিকিউরিটির লোকেরা ওঁকে দেখেছিল বলে।” প্রমথ মন্তব্য করল।

“সিকিউরিটির লোকেরা দেখে থাকলে স্যার অনেক আগেই পুলিশ ওঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করত।”

হঠাৎ আমার একটা প্রশ্ন জাগল, “আচ্ছা একেনবাবু, রোহিত রয়ের বিল্ডিং- লবিতে কোনো সিকিউরিটি ক্যামেরা নেই?”

“আছে স্যার। তবে রোহিত রয়ের মার্ডারের তিনদিন আগে থেকে তার রেকর্ডার খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নতুন রেকর্ডার কেনা হয়েছে, কিন্তু ইনস্টল করা হয়নি।”

“কিন্তু সেই তথ্যটা তো বল্লভ শাহর জানার কথা নয়।”

“তা নয়। কিন্তু তিনি খুন করে থাকলেও পুলিশকে তা প্রমাণ করতে হবে। মার্ডারের সময়ে উনি উপস্থিত ছিলেন বলে শুধু শুধু পুলিশকে সাহায্য করবেন কেন?”

“দিলীপ যখন খুন হয়, তখন বল্লভ শাহ কোথায় ছিলেন?” প্রমথ প্রশ্ন করলো।

“উনি বলছেন বাড়িতে ছিলেন। সন্ধ্যা ছ’টায় দিলীপ পারেখকে দোকানে রেখে উনি বাড়ি ফেরেন। তারপর আর বাড়ি থেকে বেরোননি। ন’টা নাগাদ বাইরে থেকে খাবার আনিয়েছিলেন। ক্লান্ত লাগছিলো বলে খেয়েদেয়ে দশটার মধ্যে শুয়ে পড়েন।”

“এটা তো ওঁর গল্প, প্রমথ বলল।

“রাইট স্যার। তার ওপর উনি অবিবাহিত, অ্যাপার্টমেন্টে একা থাকেন। যে অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন, সেখানে আবার কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। সুতরাং তিনি যে ঘরেই ছিলেন তার কোনো প্রমাণ নেই। হি হ্যাঁস নো অ্যালিবাই।”

এরপর একেনবাবু যা বললেন সেটা হল ওঁর স্পেকুলেশান। পুলিশ নিশ্চয় অনুমান করছে রোহিত রয় আর দিলীপের সঙ্গে বল্লভ শাহও ব্ল্যাকমেইল রিং-এ ছিলেন। হয়তো বখরা নিয়েই এঁদের মধ্যে ঝগড়া লেগেছিল। পাপকাজের বন্ধুরা যখন শত্রু হয়, তখন হয় সেই শত্রুর নাশ, নয় নিজের বিনাশ।

“আমার মনে হচ্ছে, আপনি পুলিশের সঙ্গে ঠিক একমত হতে পারছেন না।”

“তা নয় স্যার। তবে কিনা খোঁজ নিয়ে জানলাম মারা যাবার আগে পর্যন্ত দিলীপ পারেখের আচরণ খুব স্বাভাবিক ছিল। আই অ্যাম লিটল কনফিউজড স্যার।”

এর মধ্যে কী এমন কনফিউশনের আছে বুঝলাম না। তবে একেনবাবুর কথাবার্তা অনেক সময়েই হঠাৎ ক্রিপ্টিক হয়ে যায়!

৷৷ ২২ ৷৷

পর পর দুটো মার্ডারের পর শিশিরবাবুর ব্যাপারটা আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। রাত্রে প্রভাসের একটা ই-মেইল পেলাম। লিখেছে ওখানকার ওসি রাখালবাবু নাকি একেনবাবুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। জিজ্ঞেস করেছে আমরা কিছু শুনেছি নাকি একেনবাবুর কাছ থেকে?

সকালে ব্রেকফাস্ট খাবার সময়ে আমি একেনবাবুকে শিশিরবাবুর কথা জিজ্ঞেস করলাম।

“হ্যাঁ স্যার, আপনাদের বলতে ভুলে গেছি, যা ঝামেলা যাচ্ছিল ক’দিন!”

তারপর যা বললেন, তা হল–

পুলিশ দুজন রিকশাওয়ালা আর শিশিরবাবুর বাড়িতে মতিলাল নামে যে কাজ করত, তার ভাইকে ধরেছে। রিক্সাচালকদের বয়ান অনুসারে এক আধ-চেনা ভদ্রলোক ওদের বলেন যে শিশিরবাবুর বাড়িতে একটা ছোটো কাঠের বাক্স আছে, সেটা চুরি করে আনতে পারলে দু-হাজার টাকা দেবেন। ওরা ওদের বন্ধু মতিলালের ভাইকে ধরে। সে শিশিরবাবুর বাড়িতে অনেকবারই গিয়েছে। সে বলে দেয় কোথায় পুরোনো কাঠের বাক্সটা আছে। মতিলালের অজান্তে বাড়ির চাবিও বন্ধুদের দেয়। পরদিন শিশিরবাবু বাইরে যেতেই একজন বাড়িতে ঢোকে, অন্যজন বাইরে থেকে তালা বন্ধ করে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। তালা লাগানো দেখলে কারো কোনো সন্দেহ হবে না ভেতরে কেউ আছে বলে। একটু বাদেই ভেতর থেকে সিগন্যাল পেয়ে বাইরের লোকটি দরজা খুলতে যায়। এমন সময়ে শিশিরবাবু হঠাৎ বাড়ি ফিরে আসেন। শিশিরবাবু বুঝতেও পারেননি কী হচ্ছে! উনি লোকটিকে জিজ্ঞেসা করেন, কী চাও?’ সে ভয় পেয়ে হঠাৎ ছুট লাগায়। যাবার সময় হাত থেকে চাবিটা পড়ে যায়। শিশিরবাবু নিশ্চয় অবাক হয়েছিলেন। কিন্তু দরজায় তালা আছে। সুতরাং লোকটির বদ-উদ্দেশ্য থাকলেও ক্ষতি করতে পারেনি। এই ভেবে নিশ্চয় তালা খুলে ভেতরে ঢোকেন। তখনই ভেতরের লোকটি এঁকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এসে দরজাটা ভেজিয়ে অদৃশ্য হয়। তার বক্তব্য, শিশিরবাবু যে ঐটুকু ধাক্কাতেই মারা যাবেন কল্পনাও করেনি। ও চোর, কিন্তু খুনি নয়। বুড়ো মানুষ মারা যাওয়াতে ও খুবই অনুতপ্ত, ইত্যাদি। যাইহোক, ওরা যখন বাক্সটা সেই ভদ্রলোককে দেয়। তিনি বলেন ওটা ভুল বাক্স। এই নিয়ে ওদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ভদ্রলোক শেষে রাগ করে পাঁচশো টাকা দিয়ে বাক্সটা নিয়ে যান। রাখালবাবু প্রভাসকে জিজ্ঞেস করে জেনেছেন যে পুরোনো একটা কাঠের বাক্স কাঁচের আলমারিতে ছিল। শিশিরবাবু প্রাণে ধরে কিছুই ফেলেন না। তবে এই বাক্সের জন্য কেউ দু-হাজার টাকা দেবে ভাবা যায় না। ভদ্রলোক নিশ্চয় গয়নার বা অ্যান্টিক কোনো বাক্সের কথা বলেছিলেন, যেটা প্রভাস কখনও দেখেনি। রাখালবাবু দল নিয়ে শিশিরবাবুর বাড়িতে আবার গিয়েছিলেন, যদি অন্য কোনও বাক্স চোখে পড়ে। গিয়ে দেখেন দরজার তালা ভাঙা। এমনি কি গোদরেজের আলমারিও কেউ শাবল বা কিছু দিয়ে ভেঙেছে। দুয়েকটা পুরোনো জামাকাপড় ছাড়া মূল্যবান কিছুই সেখানে অবশিষ্ট নেই। অর্থাৎ, মহামূল্য সেই অলীক বাক্স শুধু নয়, কাপডিশ ইত্যাদিও সেই সঙ্গে অদৃশ্য হয়েছে। বাক্সের খোঁজ যাঁরা করছিলেন তাঁরা তো এসেছিলেনই, সেইসঙ্গে ছিঁচকে চোরও ভাঙা দরজার সুযোগ নিয়েছে বলে মনে হয়। পুলিশ এখন চেষ্টা করছে সেই বাবুটিকে ধরার। ভদ্রলোকের চেহারার একটা বিবরণ পুলিশ পেয়েছে। বেঁটে, দেহটা একটু মোটার দিকে, অল্প ভুড়ি আছে, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, মাথায় অল্প টাক, নাকে এক চিলতে গোঁপ। এরকম অজস্র লোক রাস্তায় চোখে পড়বে।

একেনবাবুর দীর্ঘ কাহিনি শেষ হবার পর আমি বললাম, “আপনার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে, শান্তিনিকেতনের পুলিশ ডেড-এন্ডে গিয়ে পৌঁছেছে।”

একেনবাবু তার উত্তর না দিয়ে বললেন, “স্যার, কাল সকালে কি আপনার ক্লাস আছে?”

“না, কিন্তু কেন?”

“আপনার সঙ্গে নিউ জার্সি যেতাম।”

“নিউ জার্সিতে? কোথায়?”

“জার্সি সিটিতে।”

“সেখানে কে থাকেন?”

“একজন থাকেন স্যার।”

“নিশ্চয় একজন থাকেন,” প্রমথ বলল। “কিন্তু সেই একজনটি কে? আপনার কি একজন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে নাকি?”

“ছি ছি, কী যে বলেন স্যার।”

“কেন মশাই, বউদিকে এদ্দিন ছেড়ে আছেন, একটু যদি মন উড়ু উড় হয় –তাতে তো অবাক হবার কিছু নেই।”

“সত্যি স্যার, আপনার মুখে কিছু আটকায় না!”

“তাহলে লোকটি কে?”

“লোক নয় স্যার, একজন মহিলা।”

“পথে আসুন, কত বয়স মহিলাটির?”

“ধারণাই নেই স্যার, আশি-টাশি হবে।”

“ওরে বাবা, তা এই বুড়ির সঙ্গে আপনার কী দরকার?”

“উনি টম ক্যাসিডির পিসি। হয়তো টম ক্যাসিডির খোঁজ জানতে পারেন।”

“তা এই পিসিটির সন্ধান জোগাড় হল কী করে?”

“সে এক কাহিনি স্যার।”

এমন সময়ে ফোন। একেনবাবুই ধরলেন। দুয়েকটা কথা বলে ছেড়ে দিয়ে বললেন, “কাল স্যার ছুটি। এইমাত্র খবর পেলাম টম ক্যাসিডির খোঁজ পাওয়া গেছে। মাস দুই আগে সেলসম্যানের চাকরি নিয়ে অ্যারিজোনা গেছেন।”

৷৷ ২৩ ৷৷

সকালে কোনো ক্লাস ছিল না। বিকেলেও আজ না গেলে চলে। যে কাজ আছে বাড়িতে বসেই করতে পারি। প্রমথ ল্যাব-এ চলে গেছে। একেনবাবু সোফায় বসে বসে পা নাচাচ্ছিলেন। হঠাৎ উঠে গায়ে অলওয়েদার কোটটা চাপিয়ে বললেন, “একটু ঘুরে আসছি স্যার।”

এটা একেনবাবুর একটা বৈশিষ্ট্য। কিছুতেই বলবেন না ঠিক কোথায় যাচ্ছেন। এই নিয়ে প্রমথর সঙ্গে ওঁর প্রায়ই লাগে। প্রমথ বলে, “আপনি ভীষণ সিক্রেটিভ।”

“কেন স্যার?”

“বলে যেতে পারেন না, কোথায় যাচ্ছেন?”

“কী করে বলব স্যার, আমি নিজেই জানি না ঠিক কোথায় যাব।”

“কী যা তা বকছেন, আপনি জানেন না এখন কোথায় যাচ্ছেন?”

“তা জানি স্যার। কিন্তু সেখান থেকে কোথায় যাব –সেটা তো ঠিক করিনি।”

“তা এখন যেখানে যাচ্ছেন সেটা তো বলতে পারেন!”

“তাহলে তো স্যার ইনফরমেশানটা কমপ্লিট হল না।”

“আপনি কি বউদিকেও না জানিয়ে এরকম অদৃশ্য হতেন?”

“খেপেছেন স্যার, আমার ফ্যামিলির চোখ এড়িয়ে কিছু করা শিবের অসাধ্যি!”

“দাঁড়ান আজকেই বউদিকে লিখছি যে এখানে এসে আপনার পাখা গজিয়েছে!” প্রমথ থ্রেট করল।

তবে একটা কথা ঠিক একেনবাবু যখন ফিরে আসবেন বলেন, ঠিক সেই সময়েই ফিরে আসেন। যদি কোথাও আটকা পড়ে যান, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমাদের জানিয়ে দেন। এ নিয়ে কমপ্লিমেন্ট দিলে বলেন, “ কি যে বলেন স্যার, আপনারা ছাড়া এদেশে আমার কে আছেন বলুন।”

“তারমানে ওদেশে আমরা আপনার কেউ নই।” প্রমথ টিপ্পনি কাটে।

“প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”

ওরা বেড়িয়ে যাবার পর আমি আমার ই-মেইল চেক করতে বসলাম। বেশিরভাগই কাজ সংক্রান্ত। শুধু একটা নয়, সেটা বন্দনার। বন্দনা লিখেছে, ওদের বিয়ের কথা। ওরা দুজনে শান্তিনিকেতনে চলে এসেছে। নতুন সংসার সাজাতে ব্যস্ত। প্রভাসের কাজের চাপ হঠাৎ বেড়েছে। একজন অধ্যাপক অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর ক্লাসও প্রভাসকে নিতে হচ্ছে। বন্দনা। ভাবছে ও-ও কিছু একটা করবে। কিন্তু কী করবে এখনও ঠিক করতে পারছে না। শেষে লিখেছে যার বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়,

তোমার কথা প্রায়ই ও বলে। আমার তো সব সময়েই মনে হয়। আর কতদিন ওদেশে পড়ে থাকবে? তাড়াতাড়ি ফিরে এসো। আমার এক বন্ধু অছে, খুব মিষ্টি আর দারুণ সুন্দরী। তোমার সঙ্গে চমৎকার মানাবে। রাগ করলে না তো? এখানে কোনো কম্পিউটার নেই। অনেক পথ হেঁটে একটা সাইবার কাফে থেকে তোমায় লিখছি।

ভালোবাসা নিও।

তোমার বন্দনা

চিঠিটা পড়ে কেন জানি না একটা বিষণ্ণতা আমায় পেয়ে বসল। তোমার বন্দনা কথাটা পড়লাম কয়েকবার। সেন্স অফ গিল্ট? বন্দনার চোখ আমি কোনো দিনই ফাঁকি দিতে পারিনি, তাই নিশ্চয় ওর খারাপও লাগছে। আমি যে ওকে সম্পূর্ণ হারাইনি, সেটাই আমাকে মনে করিয়ে দেবার চেষ্টা করছে তোমার বন্দনা কথা দুটোর মধ্যে দিয়ে। আমার একাকিত্ব দূর করার জন্যও ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। চোখের সামনে ফোটোগ্রাফিক ফ্রেমের মতো একের পর এক বন্দনার নানান ছবি চোখের সামনে ভেসে ভেসে উঠতে লাগল। কম-বয়সি বন্দনা, কিশোরী বন্দনা, যৌবনে পরিপূর্ণা বন্দনা। হঠাৎ তীব্রভাবে অনুভব করলাম বন্দনাকে কী ভীষণভাবে আমি চেয়েছিলাম! আমার বহু নিদ্রাহীন রাত্রি কেটেছে বন্দনার কথা ভেবে। কল্পনায় ওকে আমার পাশে পাশে রেখেছি, যা সামনা-সামনি বলতে পারিনি, তা অনায়াসে কল্পনায় ওকে বলেছি, যা শুনতে চেয়েছি তা শুনেছি। কিন্তু বাস্তবে কখনোই সাহস করে বলতে পারিনি যে ওকে চিরজীবনের জন্য কাছে পেতে চাই। হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়ে একবার প্রেমের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু পরে নিজেই লজ্জিত হয়েছি সেই হাস্যকর প্রচেষ্টায়। আসলে আমার ভয় ছিল ও আমায় প্রত্যাখ্যান করবে। কিন্তু প্রত্যাখ্যানেরও তো একটা মূল্য আছে। বহু অনাবশ্যক কল্পনা, স্বপ্নের জাল বোনা চিরতরে সেটা স্তব্ধ করে দিতে পারে। লাঠির বড় একটা বাড়ি মেরে রূঢ় বাস্তবের সঙ্গে পরিচয় ঘটিয়ে দেয়, শরীর ও মনকে আশা-নিরাশার দ্বন্দে কুরে কুরে নষ্ট হতে দেয় না। আমার এই ভীরুতার ফল সারা জীবনই ভোগ করতে হবে। বন্দনার চিঠি আরও পাব, কারণ সিলেক্টেড হইনি ঠিকই, কিন্তু রিজেক্টেডও হইনি। আর সেই চিঠি আমায় যেমন দেবে আনন্দ, তেমনি বয়ে আনবে না পাওয়ার পুরোনো বেদনা।

আমি বন্দনাকে একটা উত্তর লিখতে বসলাম। লিখলাম “এক সুন্দরীকে চেয়ে পাইনি, কী করে তুমি ভাবছ আরেক সুন্দরীকে না চেয়েই পাব।” হঠাৎ মনে হল, একি পাগলের মতো লিখছি! কম্পিউটার বন্ধ করে টিভি খুলে বসলাম। মনকে বন্দনা-মুক্ত করা দরকার।

কখন ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়ালও নেই। ঘুম যখন ভাঙল, তখন দেখি একেনবাবু কিচেনে কফি বানাবার চেষ্টা করছেন। আমি উঠেছি দেখে বললেন, “প্রমথবাবুও ফিরেছেন। একটু বাইরে গেছেন কি একটা পার্সেল করতে।”

আমি জানি সেটা কি। ফ্রান্সিস্কার এক বন্ধুর বিয়ে হচ্ছে বাল্টিমোরে-এ। ওরা যাবার প্ল্যান করেছিল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে কাজের জন্য আটকা পড়েছে। বন্ধুকে দেবে বলে সুইস আপ্লসের একটা সুন্দর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি কিনেছিল ফ্রান্সিস্কা। সেটাই নিশ্চয় প্রমথ পার্সেল করতে গিয়েছে।

প্রমথ বাড়ি ফিরতে জিজ্ঞেস করলাম, “কিরে, পার্সেল করা হল?”

প্রমথ বলল, “বলিস না, জোর গচ্চা গেছে স্টুপিড পার্সেলটা করতে!”

“কত নিলো?”

“পঞ্চান্ন ডলার, বিশ্বাস করবি? ছবিটা তিরিশ ডলার হবে কিনা সন্দেহ!”

একেনবাবু পয়সাকড়ির ব্যাপারে খুব সেন্সেটিভ। “বলেন কি স্যার, এত হাইওয়ে রবারি! যাই বলুন স্যার, আমেরিকা হল আজব দেশ। বিচির থেকে খোলের দাম বেশি।”

প্রমথ তর্ক করতে ভালোবাসে। বলল, “এ একটা বাজে কথা বললেন। লোকে বিচি ফেলে বাইরের অংশ খায় –আম বলুন, লিচু বলুন, আঙুর বলুন।”

একেনবাবু বললেন, “আপনি উলটোগুলো দেখছেন না কেন স্যার। খোলসের মধ্যেই থাকে চিনেবাদাম, শুক্তির মধ্যে থাকে মুক্তো।”

আমি ভাবছিলাম, উঃ, মাঝে মাঝে এত বাজে বকবক করতে পারে ওরা! প্রসঙ্গটা চাপা দেবার জন্য বললাম, “দুদিকেই অজস্র উদাহরণ আছে। আর সবই রিলেটিভ। যারা ছবিটা পাচ্ছে, তাদের কাছে ছবিটাই আসল। বাইরের বাক্স বা বাবল র‍্যাপিং-এর দাম কত, সে নিয়ে ভাববে না। অন্যদিকে প্রমথ গাঁটের পয়সা খরচা করে প্যাকিং করিয়েছে, এয়ারে শিপ করছে –তাই ওগুলোই ওর কাছে আসল।”

“এটা ভালো বলেছেন স্যার।” বলে একেনবাবু চুপ মেরে গেলেন।

প্রমথ বলল, “অবাক করলেন মশাই, শুধু একটা বাক্যবাণে মৌনীবাবা হয়ে গেলেন যে বড়ো?”

“কেন স্যার, আমি কি বেশি বকবক করি?”

“আলবাৎ করেন। যদি না আপনার মাথায় অন্য কোনো চিন্তা ঘুরপাক না খেতে শুরু করে!”

“আপনাকে বলিহারি স্যার, একেবারে বাঘের চোখ। ধরেছেন ঠিক।”

“কী ভাবছিলেন?”

“বাপিবাবুর কথায় হঠাৎ আরেকটা জিনিস মনে এল।”

“কী সেটা?”

“এই স্যার, শিশিরবাবুর কথা। উনি ওঁর মহামূল্য প্রেমপত্রগুলো বাক্সবন্দি করে রাখলেন। ওঁর কাছে প্রেমপত্রগুলোই বড়ো, বাক্সটা নিমিত্ত মাত্র। অথচ আরেকটা লোক সেই মহামূল্য চিঠিগুলোকে মাটিতে ফেলে দিয়ে বাক্সটা নিয়ে অদৃশ্য হল। ভ্যালু ব্যাপারটাই একেবারে রিলেটিভ স্যার।”

“শিশিরবাবুর প্রেমিকা যদি কোনো সেলিব্রেটি হতেন –ধরুন, নার্গিস বা সুচিত্রা সেন, অথবা তার থেকেও উর্ধে চলে যান, ক্লিওপেট্রা –তাহলে হয়তো চিঠিগুলোই চুরি হতো। কি মশাই, হত না?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“তা হতো স্যার। চড়া দামেই বিক্রি হত চিঠিগুলো।”

“এখন প্রশ্ন হল বাক্সটার অ্যান্টিক ভ্যালু কত। আপনার কোনো ধারণা আছে?”

“তেমন নেই স্যার। মিস্টার লংফেলোর সঙ্গে এই নিয়েই দু’দিন আগে কথা বলছিলাম।”

“লংফেলো মানে, যে লোকটি রোহিত রয়ের সঙ্গে সেদিন দেখা করতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ স্যার। ভদ্রলোক অ্যান্টিক সম্পর্কে অনেক জানেন।”

“আপনি কি সেই জন্যেই ওঁর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলেন?”

“কী করব স্যার, মাথায় কিছুতেই ঢুকছিল না একটা পুরোনো বাক্স কেউ চুরি করতে যাবে কেন!”

“মিস্টার লংফেলো কি বললেন?” এবার আমিই প্রশ্নটা করলাম।

“বাক্সটা না দেখে দাম বলা শক্ত। তবে চিঠিপত্র ছিল শুনে বললেন বড় সাইজের একটা জুয়েলরি বক্স হওয়া সম্ভব। তবে বাক্সটা যদি বেশি বড়ো হয়, তাহলে সম্ভবত ওটা ছিল রাইটিং ডেস্ক।”

রাইটিং ডেস্ক-এর কথা আমি বইয়ে পড়েছি। আগেকার যুগে বাক্সের ডালা বন্ধ করে তার উপরে খাতা রেখে হিসেবটিসের চিঠিপত্র –এইসব লোকে লিখত। বাক্সের ভেতরে থাকত লেখার যাবতীয় সরঞ্জাম কাগজপত্র, খাতা-কলম ইত্যাদি।

“কি রকম দাম ওগুলোর?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

“আমিও স্যার প্রশ্নটা করেছিলাম। বললেন, জিনিসটা না দেখে বলা যায় না।”

“একটা রেঞ্জ তো আছে?”

“তা আছে স্যার, পাঁচ ডলারও হতে পারে, আবার পাঁচ হাজার ডলারও হতে পারে। জর্জ ওয়াশিংটনের রাইটিং ডেস্ক হলে মিলিয়ন ডলার হওয়াও বিচিত্র নয়।”

“দু-চারশো টাকার রাইটিং ডেস্ক কখনোই ওটা ছিল না,” আমি বললাম। “সেক্ষেত্রে চুরি করার জন্য অত টাকা কেউ দিত না।”

“আরেকটা সম্ভবনার কথাও উনি বললেন, সেটা হল টি-ক্যাডি। টি ক্যাডি অবশ্য সব সময়ে কাঠের হত না, তবে এককালে টার্ন ব্রিজের কাঠের টি-ক্যাডির বেশ চল ছিল। তবে টি-ক্যাডি হলে ভেতরে খোপ খোপ থাকত। সেগুলো কেটে উড়িয়ে না দিলে সেখানে চিঠিপত্র রাখা যেত না। তাই মনে হয় ওটা টি-ক্যাডি নয়।”

“সেই টি-ক্যাডিগুলোর দাম বেশি না কম?”

“সেটা জিজ্ঞেস করিনি স্যার। তবে মনে হয় ঐ একই রেঞ্জ।”

“তাহলে আর কি এসে গেল?”

“আমি শুধু পসিবিলিটির কথাগুলো বললাম স্যার।”

“আরেকটা পসিবিলিটিও তো হয়, প্রমথ বলল। “শ্রীনিকেতনের কোনো কাঠের মিস্তিরির তৈরি। হয় না?”

“তা হয় স্যার।”

“তাহলে সেটা ধরছেন না কেন?”

“ইউ হ্যাভ এ পয়েন্ট স্যার। তবে কিনা তার জন্য কেউ পয়সা দিয়ে ওটা চুরি করাবে না।”

“আপনি মশাই, আপনার অ্যান্টিক নিয়ে মাথা ঘামান,” বলে প্রমথ আমাকে বলল, “এই বাপি, একটা সিডি কিনে আনলাম ইন্ডিয়া মিউজিক শপ থেকে। শ্যামলের। শুনবি?”

শ্যামল মিত্রের গান যদিও আমার মায়ের আমলের, কিন্তু ওই সময়কার গান শুনতেই আমার ভালো লাগে।

“তোর তো দেখছি ইদানিং বেশ গানে উৎসাহ হয়েছে? চমৎকার, লাগা।”

‘কার মঞ্জীর বাজে’ গান দিয়ে সিডির শুরু। আমার ফেভারিট।

একেনবাবু যিনি একেবারেই গান-বাজনা ভালোবাসেন না, তিনিও দেখলাম চোখ বুজে পা নাড়িয়ে নাড়িয়ে শুনছেন।

দেখেছি তোমাকে মুখর মেলায়
পথের বাঁকে আর রঙেরই খেলায়
জেনেছি তুমি মোর অনুরাগিনী।

হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইনফ্যাক্ট দারুণ বলেছেন স্যার।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কিসের কথা বলেছেন?”

“ঐ যে স্যার, ছবি আর ছবির বক্স আর র‍্যাপিং-এর কথা।”

এটা কি এমন দারুণ সেটা অবশ্য আর ব্যাখ্যা করলেন না। উলটে একটা প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা স্যার, মাসিমা কি ফ্রেঞ্চ জানেন?”

সুভদ্রামাসি একটু আধটু ফ্রেঞ্চ জানেন আমি জানতাম। ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে মাঝে মাঝে ফ্রেঞ্চে কথা বলতে শুনেছি। বললাম, “বোধহয়, কেন বলুন তো?”

“আসছি স্যার,” বলে বোঁ করে ঘুরে নিজের ঘরে চলে গেলেন।

একেনবাবুর সঙ্গে থেকে থেকে আমাদের এত অভ্যাস হয়ে গেছে যে এগুলো নিয়ে আর মাথা ঘামাই না। আমরা আয়েস করে বসে শ্যামলের গান শুনতে লাগলাম।

একটু বাদেই দেখি উনি ওঁর অল-ওয়েদার গায়ে চাপিয়ে এসেছেন।

“স্যার আমি একটু বেরোচ্ছি, খানিক বাদেই ফিরব।” তারপর প্রমথকে বললেন, “আমি স্যার আজ পিৎজা নিয়ে আসছি। রান্নাবান্না করবেন না।”

“হঠাৎ এই সুমতি?”

“না স্যার, আপনারাই তো খালি খাওয়ান, একদিন আমি খাওয়াতে পারি না?”

“একদিন কেন, চাইলে প্রতিদিন পারেন। এত আনন্দের কথা,” প্রমথ বলল।

“স্যার, আপনার দিদিমার ছবিটা একটু নিয়ে যাচ্ছি –আপনার অ্যালবাম থেকে।”

আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন, কি ব্যাপার?”

“বিরাট কোনো ব্যাপার নয় স্যার। হারাব না, ভয় নেই।” বলে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।

একেনবাবুর অনেক কাজই খাপছাড়া, তাই খুব একটা অবাক হই না।

প্রমথ বলল, “জানি কেন নিয়ে যাচ্ছেন। তুই সেদিন কথায় কথায় বললি না কপি করা বলে ছবিটা খারাপ হয়েছে, সেটাই উনি ঠিক করে দেবেন। আজকে বেশ বদান্য-মুডে আছেন!”

।। ২৪ ।।

একেনবাবু পিজ্জা নিয়ে ফিরলেন একটু দেরি করেই। আসতেই প্রমথ ওঁকে ঝাড়লো, “কি মশাই, খাওয়াবেন বলে মাথা কিনে নিয়েছেন নাকি! আটটার সময় ডিনার টাইম আর আপনি ন’টার সময়ে হেলতে দুলতে আসছেন?”

আমি বললাম, “চুপ কর, ওঁর নিশ্চয় একটা এক্সকিউজ আছে।”

“তা আছে স্যার।” পিৎজার বাক্সটা খুলতে খুলতে বললেন, “আপনার জন্য পেপারোনি আর অনিয়ান, আর প্রমথবাবুর জন্য সসজে আর মাশরুম।”,

“আর আপনি?”

“আমি স্যার আপনাদের দু’জনের কাছ থেকেই একটু শেয়ার করব।”

“ও, আপনি ভ্যারাইটি খাবেন, আর আমাদের জন্য সিঙ্গল আইটেম। বলিহারি হোস্ট আপনি।”

“কী মুশকিল স্যার, আপনি সসেজ মাশরুম ভালোবাসেন বলেই তো স্পেশালি আনলাম।

“তা হোক, আমিও আপনার মতো ভ্যারাইটি খাব।”

“নিশ্চয় খাবেন স্যার।”

আমি বললাম, “আপনার এক্সকিউজটা কি, সেটা তো বললেন না?”

“ও হ্যাঁ স্যার। তার আগে আপনার ছবিটা রেখে আসি।” বলে একেনবাবু ছবির খামটা আমার ঘরে রাখতে গেলেন।

এটাও একেনবাবুর বৈশিষ্ট্য, গল্পের আগে একটা সাসপেন্স ক্রিয়েট করতে ভালোবাসেন। চট করে কিছু না বলে সময় নেওয়া। তবে আমরা ওঁর অপেক্ষায় না থেকে পিৎজার একটা স্লাইস তুলে তার সদ্বব্যবহার শুরু করলাম। অতি সুস্বাদু পিৎজা। খুঁতখুঁতে প্রমথ মানল।

“নাঃ, ভালো মালই এনেছেন। তারপর পিজা-বক্সের ডালা উলটে নাম দেখে বলল, টমি’জ। আগে খেয়েছিস?”

একেনবাবু ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন। বললেন, “কেমন লাগছে স্যার?”

“দারুণ, কোত্থেকে খবর পেলেন দোকানটার?”

“বল্লভ শাহ-র কাছ থেকে।”

“বল্লভ শাহ! লোকটা তো সাসপেক্টেড মার্ডারার! তাঁর সঙ্গে আপনার এত দহরম মহরম শুরু হল কবে থেকে?” প্রমথ প্রশ্ন করল।

“দহরম-মহরম নয় স্যার, হঠাৎ দেখা টাইমস স্কোয়ারে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় ভালো পিজ্জা পাওয়া যায়। উনি বললেন টমি’জ। লোকে চেনে ডমিনোজ, পিজ্জা হাট –এইসব। কিন্তু অথেন্টিক পিজার স্বাদ চাইলে টমি’জ-এর জুরি নেই।”

“অথেন্টিক মানে কি? পিজা তো এক এক জায়গায় এক এক ধরণের সিসিলিয়ান স্টাইল, নেওপলিটান, পিৎজা রোমানা –কিসের কথা বলছেন?”

“তা তো বলতে পারব না স্যার। উনি বললেন অথেন্টিক, আমিও সেটাই রিপিট করলাম।”

“অথেন্টিক হোক বা না হোক, অতি উত্তম পিঞ্জা,” আমি বললাম। “তা বল্লভ শাহর খবর কি? পুলিশ যে এখনও ওঁকে ধরেনি, কী ব্যাপার?”

“বেশ দুশ্চিন্তাতে আছেন স্যার। ওঁর ধারণা কেউ ওঁকে চক্রান্ত করে ফাঁসাচ্ছে।”

“সেই কেউ-টা কে?”

“সেটা উনি জানেন না স্যার। তবে কয়েকটা ইন্টারেস্টিং কথা বললেন।”

“যেমন?”

“রোহিত রয়ের বান্ধবী মিস আইলিন সম্পর্কে বেশ কিছু খবর জানলাম।”

“কী জানলেন?”

“দাঁড়ান, আগে একটা পিৎজা নিই।”

একেনবাবু প্লেটে পিঞ্জার একটা স্লাইস চাপিয়ে তার উপর ক্রাশড রেড-পেপার ছিটিয়ে লালে লাল করে কামড় বাসালেন।

তারপর চিবোতে চিবোতে বললেন, “মিস আইলিন স্যার, সত্যিই একটা ক্যারেক্টার।”

আমরা দুজনেই সপ্রশ্নে ওঁর দিকে তাকালাম।

“তিনি স্যার প্যারালাল প্রেম চালাচ্ছিলেন।”

“কার সঙ্গে?”

“নামটা বললেন না, তবে লোকটা ওয়ালস্ট্রিটের এক ব্যাঙ্কার।”

“মাই গড! রোহিত রয় জানতেন?”

“জানতেন কিনা বল্লভ শাহ শিওর নন। বোধহয় সন্দেহ করছিলেন।”

“সেটা ভাবার কারণ?”

“কারণ বল্লভ শাহকে মিস্টার রয় কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে মাঝে মাঝেই মিস আইলিন অদৃশ্য হয়ে যান। বল্লভ শাহর মতে, একটু বিরক্ত হয়েই।”

“বল্লভ শাহ কী করে জানলেন যে মিস আইলিন আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করছেন?”

“সেটা বললেন না, তবে লোকটা সত্যিই রিসোর্সফুল স্যার।”

“আপনার কি মনে হয় মিস আইলিন এখন সেই ব্যাঙ্কারের কাছেই আছেন?”

“পসিবল স্যার।”

“বল্লভ শাহ কি পুলিশকে সেটা বলেছেন?”

“মনে হয় না স্যার। তবে ভালো করে সব কিছু জানতে পারব কালকে। আমার কাছে আসছেন কোনো একটা ব্যাপারে পরামর্শ নিতে।”

“আমার তো মনে হয় আপনার চেয়ে একজন উকিলের পরামর্শ নেওয়াটাই ওঁর পক্ষে আশু প্রয়োজন,” প্রমথ বলল।

“তাও নিশ্চয় নিচ্ছেন স্যার।”

তারপর মিস আইলিন আর বল্লভ শাহর প্রসঙ্গ থেকে হঠাৎ এক-শো আশি ডিগ্রী ঘুরে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা স্যার, মিস সুজাতা কতদিন মাসিমার বাড়িতে আছেন?”

“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”

“এমনি মনে হল স্যার। মাসিমা ওঁকে খুবই পছন্দ করেন। নিশ্চয় অনেক দিন ধরে আছেন।”

“ইউ মে বি রাইট,” আমি বললাম। “ফ্র্যাঙ্কলি এ নিয়ে কোনোদিন সুপ্রভামাসির সঙ্গে কথা হয়নি। আমার জিজ্ঞাসা করার কোনো কারণও ঘটেনি।”

“তা তো বটেই স্যার।”

“আপনি ফোন করে জিজ্ঞেস করুন না। প্রশ্নটা যখন মাথায় জেগেছে, ওটা না জানা পর্যন্ত তো ছটফট করবেন!”

“আরে না স্যার। হঠাৎ মনে হল কথাটা, এদেশে তো এরকম সচারাচর দেখা যায় না।”

হঠাৎ হঠাৎ একেনবাবুর কিছু মনে হয় না, কিন্তু এ নিয়ে আর প্রশ্ন করা হল না।

প্রমথ বলল, “ঐ যাঃ, আপনাকে বলতে গেছি স্টুয়ার্ট সাহেবের অফিস থেকে একটা মেসেজ আপনাকে দিতে বলেছে।”

“কী স্যার?”

“কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে যে চিঠিটার খোঁজ আপনি করতে বলেছিলেন, তার খবর ওরা নিয়েছে। উত্তর হল, হ্যাঁ, কিছুদিন আগে ইন্ডিয়া থেকে একটা চিঠি এসেছিল প্রফেসার রিচার্ড সাহেবের কাছে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।”

“এর অর্থটা কি? আমি তো মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলাম না।”

“সেটা উনিই জানেন,” প্রমথ বলল। “নিশ্চয় পরে একদিন জানতে পারব, যদি দয়া করেন।”

“আপনারা সত্যি স্যার, এত লেগপুল করেন।” কিন্তু মনে হল একেনবাবু খবরটা পেয়ে বেশ খুশি হয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “ব্যাপারটা কি?”

“বলব স্যার, বলব।”

৷৷ ২৫ ৷৷

পরদিন সকালে যে ভদ্রলোক একেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন, তাঁকে আমি শান্তিনিকেতনে যাবার পথে দেখেছি। গলায় এখনও সেই BS লকেট লাগানো নেকলেস। বল্লভ শাহও আমাকে দেখে অবাক হলেন। “আপনাকে আগে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”

“শান্তিনিকেতনে যাবার পথে।”

“ও ইয়েস, আপনার মেমারি তো ভীষণ শার্প!”

“না, আমার মেমারি খুবই বাজে। কিন্তু আপনার গলার নেকলেসটা যে দেখেছে, তার পক্ষে ওটা ভুলে থাকা কঠিন।”

“এটা ঠিকই বলেছেন। এই বুলশিট নেকলেসের জন্য আমাকে অনেকেই খ্যাপান। কিন্তু কি করব বলুন, পিতৃপুরুষের দেওয়া নামটাকে তো অস্বীকার করতে পারি না। বাই

দ্য ওয়ে, আমি বল্লভ শাহ।”

আমিও নিজের নাম বললাম।

ইতিমধ্যে একেনবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। “আরে আরে, আসুন স্যার আসুন। আমি ভেবেছিলাম আপনি একটু দেরি করে আসবেন।”

“আরেকটু দেরিতেই আসার কথা ছিল, কিন্তু সকালের কাজটা চট করে মিটে গেল। তাই ভাবলাম সময় নষ্ট করে আপনার কাছেই চলে আসি।”

“ভালো করেছেন, এসেছেন। একটু কফি বানাই?”

“সিওর, জাস্ট ব্ল্যাক।”

আমি একেনবাবুকে বললাম, “আপনারা বসুন, আমি বানাচ্ছি।”

“আরে না না স্যার, এটা একটা কথা হল।” একেনবাবু ব্যস্ত সমস্ত হয়ে কফির জল চড়ালেন।

ইনস্ট্যান্ট কফি। জলটা গরম করতে যে সময়টুকু। কফি নিয়ে আমরা সবাই বসলাম। একেনবাবু বল্লভ শাহকে বললেন, “আপনি স্বচ্ছন্দে বাপিবাবুর সামনে যা বলার বলতে পারেন। আমরা এক সঙ্গে কাজ করি।”

একেনবাবু সব সময়েই এই সম্মানটা আমাকে আর প্রমথকে দেন, যদিও রহস্য সন্ধানে আমার বা প্রমথের কন্ট্রিবিউশন তিল পরিমাণও নয়। একেনবাবুকে এ নিয়ে বললে বলেন, “স্যার, উইদাউট ইউ টু, আই ডোন্ট এক্সিস্ট।” আর এমন নাটকীয় ভাবে কথাটা বলেন যে তার উপর কিছু বলতে পারি না। প্রমথর অবশ্য বলতে আটকায় না। “জানি, জানি, আমাদের কন্ট্রিবিউশন হল আমার রান্না আর বাপির গাড়ি।”

“কী যে বলেন স্যার, গাড়ি তো ভাড়া করলেই পাওয়া যায়, আর খাবারও রেষ্টুরেন্টে মেলে।”

“কিন্তু তার জন্য গাঁটের পয়সা লাগে, সেখানেই তো আপনার মুশকিল!”।

“না না স্যার, আপনাদের সঙ্গে আলোচনায় কত যে কু পাই, তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না।”

এগুলো কিন্তু বেশ জেনুইনলিই উনি বলেন মনে হয়। সে কথা থাক।

বল্লভ শাহ একটু বোধহয় অস্বস্তি বোধ করছিলেন। বললেন, “এটা একটু ডেলিকেট ব্যাপার।”

একেনবাবু বললেন, “সেটা আমাকে বলাও যা, বাপিবাবুকে বলাও তাই। আপনি না চাইলে, কাকপক্ষীও জানতে পারবে না।”

একেনবাবু অবশ্য কাক-পক্ষী বলেননি। কাকের ইংরেজি শব্দটা বোধহয় মনে পড়েনি, তাই শুধু পাখি বলেই ম্যানেজ করলেন।

“অলরাইট,” বলে বল্লভ শাহ শুরু করলেন। “দেখুন আমি কতগুলো ব্যাপার জানি, যার সঙ্গে রোহিত রয়ের মৃত্যুর যোগ থাকতে পারে। কিন্তু পুলিশকে বলিনি। আই অ্যাম অলরেডি ইন ডিপ ট্রাবল উইথ দেম। আমি যাই বলি, উলটো ভাবে দেখবে।

আপনাকে বলছি, কারণ আমি জানি আমার অবস্থাটা বিবেচনা করে পুলিশের উপর আপনার যা ইনফ্লুয়েন্স সেটা অন্ততঃ আমার জন্য ব্যবহার করবেন।”

“আপনি নির্ভয়ে বলুন স্যার। আমি যতটুকু করতে পারি নিশ্চয় করব।”

“সেই জন্যেই আপনার কাছে এলাম,” বলে বল্লভ শাহ, তাঁর কাহিনি শুরু করলেন

“ডিসেম্বররের মাঝামাঝি আমার স্পেশালিটি স্টোরে একজন লোক আসে। মাথায় টুপি, চোখে কালো চশমা, মুখ-ভর্তি গোঁপ-দাড়ি। আমি অবশ্য তাকে দেখিনি। আমার সেলসম্যান দিলীপ-এর কাছে যে বর্ণনা শুনেছিলাম, সেটাই বললাম। লোকটা দিলীপকে বলে, তাকে একটা বাক্স এনে দিতে হবে। বাক্সটা ওয়েস্ট বেঙ্গলের একটা জায়গায় আছে।”

কথাটা শুনেই আমি একেনবাবুর দিকে তাকালাম। একেনবাবুর মুখ ভাবলেশহীন। বল্লভ শাহ তখন কফিতে চুমুক দিতে ব্যস্ত, তাই আমার এই তাকানোটা খেয়াল করলেন না।

তিনি বলে চললেন, “লোকটার রিকোয়েস্ট শুনে দিলীপ অবাক। দিলীপ লোকটাকে বলে এভাবে কোনো জিনিস আমাদের কোম্পানি আনায় না। আমাদের বিক্রির জিনিস সবই আসে আমাদের নিজস্ব সাপ্লায়ারদের কাছ থেকে। কিন্তু লোকটা নাছোরবান্দা। বলে, এর জন্য সে দু’হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে রাজি আছে। দিলীপ তখন আমাকে ফোন করে। প্রথমে রাজি হইনি, মনে হচ্ছিল এর মধ্যে নিশ্চয় কোনও ঝুট-ঝামেলা আছে। ফোনে লোকটার সঙ্গে কথা বলি। লোকটা বলে যে এটা কাঠের বাক্স, এর মধ্যে কিছুই নেই। আমার লোক বাক্স খুলে দেখে নিতে পারে। এটা ওদের ফ্যামিলির পুরোনো স্মৃতিজড়িত একটা বাক্স, চাপে পড়ে বহু বছর আগে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল। এখন ফ্যামিলির সবাই সেটা ফিরে পেতে চায়।

“ভেবে দেখলাম, একটা ছোটো বাক্স এনে যদি দু’হাজার ডলার পাওয়া যায়, তাহলে মন্দ কি। আর যে লোকটা এভাবে দু’হাজার ডলার খরচা করতে চাইছে, সে নিশ্চয় মালদার লোক। আমি তখন দিলীপকে ফোনটা দিতে বলি। দিলীপ ফোন ধরতে ওকে বলি, পাঁচশো ডলার অ্যাডভান্স নিতে, আর চেষ্টা করতে লোকটাকে যদি আর কিছু বিক্রি করতে পারে। তবে দিলীপকে তা বলার দরকার ছিল না, ও ইতিমধ্যেই লোকটার হাতে পিতলের একটা বুদ্ধমূর্তি ধরিয়েছে। দিলীপ তিন হাজার চেয়েছিল ওটার জন্যে। লোকটা অনেক নেড়েচেড়ে হাজার ডলার দিতে রাজি হয়েছে। তবে এই চুক্তিতে যখন বাক্সটা হাতে আসবে, তখনই মূর্তিটা কিনবে। পিতলের ঐ মূর্তিটা আমি তিনশো ডলার পেলেও বেচতাম। তাই দিলীপকে বললাম হাজার পেলে ওর কমিশন দুশো ডলার আর অর্ডার বইয়ে লোকটার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখে রাখতে। পরে জানতে পারলাম, লোকটার নাম ঠিকানা দেয়নি; তবে ক্যাশ অ্যাডভান্স করে ব্ল্যাঙ্ক রসিদ নিয়ে চলে গেছে। আমার তখনই খটকা লাগল। দিলীপকে বললামও কাজটা ঠিক ভালো বলে মনে হচ্ছে না। যাই হোক, মানি ইজ মানি। দিলীপ বলল, লোকটাকে দিলীপ কোথাও দেখেছে, বিশেষ করে গলার স্বর যেন চেনা চেনা। কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছে না। দিলীপের কাছে বাক্সটার মোটামুটি একটা সাইজ আর কোথায় সেটা পাওয়া যাবে, লোকটা লিখে দিয়ে গেছে; শিশিরবাবু বলে শান্তিনিকেতনের একজন লোকের বাড়ি থেকে।” বল্লভ শাহ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি শিশিরবাবুকে চেনেন?”

একেনবাবুর মুখে কোনও বৈকল্য নেই। আমি একটু থতমত খেয়ে উত্তর দিলাম, “না।”

মনে হল, বল্লভ শাহ হয়তো শিশিরবাবুর মৃত্যুর কথা জানেন না, নইলে এভাবে এত সহজে আমাদের কাছে কথাগুলো বলতেন না। অথবা উনি অদ্ভুত ভালো অ্যাক্টিং করছেন অন্য কোনো উদ্দেশ্যে।

বল্লভ শাহ বলে চললেন, “যাই হোক, আমি রতনলাল বলে একজন লোককে চিনতাম। সে শান্তিনিকেতনের কাছে থাকে। তাকে ফোন করে বললাম, শান্তিনিকেতনে শিশিরবাবু বলে এক ভদ্রলোক থাকেন, তাঁর বাড়িতে একটা পুরোনো কাঠের বাক্স আছে। সেটা যেন ও জোগাড় করে আমার জন্য রাখে। তারজন্য পাঁচ হাজার টাকা পাবে। আমার দেশে অন্য কাজ ছিল। সেগুলো শেষ করে আমি শান্তিনিকেতনে যাই। তখনই…” আমাকে দেখিয়ে বললেন, “এঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়। বাক্সটা সেদিনই পাওয়া গেল। খুবই পুরোনো, অযত্নে রাখা একটা বাক্স। যদিও সাইজটা মোটামুটি মিলে যাচ্ছে, কিন্তু এই বাক্সের জন্য কেউ দু’হাজার ডলার খরচা করতে পারে বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। রতনলালকে বললাম, “এটা সেই বাক্স নয়। রতনলাল আমতা আমতা করল। কিন্তু তখন নতুন করে বাক্স খোঁজার সময় নেই। ইন্ডিয়া থেকে আমি যে প্লেনে ফিরছি, রোহিতও সেই প্লেনে ছিল। রোহিত আমার অনেক দিনের বন্ধু। কিন্তু তখন রোহিতকে এ বিষয়ে কিছু বলিনি।

“কয়েকদিন বাদে রোহিত আমার দোকানে এল। কথায় কথায় ওকে এই গল্পটা করে বাক্সটা দেখালাম। রোহিত একটা অদ্ভুত কথা বলল। বলল, এই বাক্সটার কথা ও জানে, এটা কাউকে না দিতে। আমি পড়লাম বিপদে। আমি অ্যাডভান্স টাকা নিয়েছি। কী ভাবে সেই খদ্দেরকে ফেরাই! রোহিত আমার সমস্যাটা বুঝতে পেরে বলল, “ওকে বলে দাও তুমি ওটা পাওনি।” আমি বললাম, “তা কি করে হয়, লোকটা দিলীপকে গতকাল ফোন করেছে। দিলীপ তাকে বলেছে যে মাল এসে গেছে।” রোহিত বলল, “ঠিক আছে, আই উইল ডিল উইথ হিম। তুমি শুধু ওকে ওর টাকাটা ফেরত দিয়ে দাও। আর বলে দাও যে বাক্সটার জন্য আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে।”

“রোহিত আমাকে একটা ঝামেলার মধ্যেই ফেলল। এই জিনিসটা জোগাড় করতে আমার অল্পই খরচ হয়েছে। সেটা নষ্ট হওয়া বড়ো কথা নয়। কিন্তু দোকানের সুনাম বলেও তো একটা ব্যাপার আছে। এদিকে রোহিত আমার বহুদিনের বন্ধু এবং ভালো খদ্দেরও। আমি ইতঃস্তত করছি দেখে রোহিত বলল, “আরে বল্লভ, যেটা যার প্রাপ্য নয়, সে সেটা পাবে কেন? তুমি ওর কাছ থেকে দু’হাজার পেতে, আমিও না হয় তাই দেব। তবে এক্ষুণি দিতে পারব না, দিন কয়েক সময় লাগবে। আমি বললাম, ঠিক আছে। দিলীপকে ডেকে বললাম, লোকটা এলে ওর অ্যাডভান্সডটা ফেরত দিয়ে দিতে। ঝামেলা করলে রোহিতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। লোকটা কয়েকদিন বাদেই এল। এসে যখন শুনল ওর বাক্সটা আর কাউকে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন সে চটে আগুন! দিলীপ অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল, কে কার কথা শোনে। বলল, তোমার মালিককে ডাকো। দিলীপ বলল যে মালিকের কাছে জিনিসটা নেই, চাইলে রোহিত রয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। লোকটা তখন অশ্রাব্য কুশ্রাব্য গালাগাল করে চলে গেল। সেই রাতে আমি আমার আরেক বন্ধু বাবুর কাছে গিয়েছিলাম। ও টাকা পয়সা নিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়ে আমার কাছে কিছু ধার চেয়েছিল সেটা দিতে।”

আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “আচ্ছা, এই বাবু কি বাবু পিন্টো?”

“হ্যাঁ, আপনি চেনেন?”

“চিনি মানে একবার দেখা হয়েছে।”

একেনবাবু বললেন, “আমার তো ধারণা ছিল ওঁর বিজনেস খুব ভালো চলছে!”

“তা চলছে। কিন্তু শেয়ার মার্কেটে মার্জিন-ট্রেডিং করতে গিয়ে প্রচুর লোকসান করেছে। যাই হোক, রোহিতও সেই বিল্ডিং-এ থাকে। আমি ফেরার পথে রোহিতের অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে রোহিতকে বললাম, সেই লোকটা এসে অনেক গালিগালাজ করে গেছে। রোহিত আমলই দিল না। এরপর বেশ কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি বাড়ি চলে আসি। আর তার পরদিনই রোহিত মারা যায়। আমি অবশ্য সেটা জানতাম না। সেদিন সকালেই দু’দিনের জন্য আমি ফিলাডেলফিয়াতে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দিলীপের কাছে সব ঘটনা শুনলাম। এর ক’দিন বাদে, আমি দোকানে যাই। দিলীপ সেখানে ছিল না। আমার আরেকটি কর্মচারী আছে, তার নাম শরৎ। সে দিলীপ যখন থাকে না, তখন দোকানটায় বসে। শরৎ বলল, দিলীপ নাকি ধরতে পেরেছে যে কোন লোকটা সেদিন বাক্সের খোঁজ করছিল। শরৎকে আমি চাকরি দিয়েছি বটে, কিন্তু ও অনেক সময়েই ভুলভাল বোঝে –উলটোপালটা করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কে সেই লোক? সেটা শরৎ বলতে পারল না। তবে বলল, দিলীপ নাকি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। সে অস্বীকার করেছে, কিন্তু দিলীপ বলেছে ও ভুল করেনি। কিন্তু, তারপর আমিও কতগুলো ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, দিলীপের সঙ্গে কথা এ নিয়ে আর কথা হয়নি। এরপর হঠাৎ দিলীপও খুন হল।” বলে বল্লভ শাহ চুপ করলেন।

“আপনার মনে হয় স্যার, এই দুটো মৃত্যুর সঙ্গেই সেই মিস্ট্রিম্যান জড়িত?”

“সেটা আমি বলতে পারব না। আমি শুধু যা জানি বললাম।”

একেনবাবু বললেন, “আপনি কি জানেন স্যার যে শিশিরবাবু মারা গেছেন?”

“ও মাই গড, না তো!” বল্লভ শাহর মুখে মনে হল অকৃত্রিম বিস্ময়!

“ওঁর বাড়িতে যারা চুরি করতে ঢুকেছিল, তারাই ওঁর মৃত্যুর জন্য দায়ী।”

“চুরি করতে ঢুকেছিল!”

“হ্যাঁ, আপনার বাক্সটা।”

“কী বলছেন, আমি তো রতনলালকে ওটা কিনে রাখতে বলেছিলাম!”

“আপনার রতনলাল চুরিটাই শস্তা এবং সহজ পথ ভেবেছিলেন।”

বল্লভ শাহর মুখটা একেবারে সাদা হয়ে গেল! আবার “ও মাই গড,” বলে মাথা নাড়তে নাড়তে বললেন, “আই অ্যাম ইন ডীপ শিট।”

আমরা চুপ।

বল্লভ শাহ হঠাৎ উঠে একেনবাবুর হাতদুটো ধরে বললেন, “আমাকে আপনার বাঁচাতে হবে মিস্টার সেন, একটা কথাও আমি মিথ্যে বলছি না, বিশ্বাস করুন।”

রাতে প্রভাসের কাছ থেকে একটা ইমেইল পেলাম। লিখেছে পুলিশ রতনলাল বলে একজন লোককে গ্রেফতার করেছে। রতনলাল স্বীকার করেছে দুজন রিকশাওয়ালাকে সে শিশিরবাবুর বাড়িতে একটা বাক্স চুরি করতে পাঠিয়েছিল। সেইসময়েই ধাক্কাধাক্কিতে শিশিরবাবু মৃত্যু হয়। তবে রতনলালের বক্তব্য, তার নিজের জন্য নয়, আরেকজন তাকে বাক্সটা জোগাড় করে দিতে বলেছিল। বাক্সটা কেন এত বহুমূল্য সেটা পুলিশ বুঝতে পারছে না, তবে সেই আরেকজন কে পুলিশ জানে। ইন্টারপোলে খবর পাঠানো হয়েছে শুনে প্রভাসের ধারণা এর সঙ্গে কোনো বিদেশি চক্রের যোগ আছে। লিখেছে, শান্তিনিকেতন আর শান্তিনিকেতন নেই, চুরি-নিকেতনে দাঁড়াচ্ছে!

Pages: 1 2 3 4 5 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *