Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনেতিক মতাদর্শ || Sankar Brahma

রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনেতিক মতাদর্শ || Sankar Brahma

রবীন্দ্রনাথ মুলতঃ কবি বলেই বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত। কবি প্রতিভাই তাঁকে সারা পৃথিবীর কাছে ‘নোবেল পুরস্কার’-য়ের সম্মানে ভূষিত করেছিল। কিস্তু তাঁর প্রতিভা শুধ কবিতার মধ্যে আবদ্ধ না থেকে, বহুমুখী শাখায় ছড়িয়ে পড়ছিল। শিল্প সাহিত্যের সব ক্ষেত্রেই তার বিচরণ ছিল অবাধ। সাহিত্যের এমন কোন শাখা নেই যেখানে তাঁর অবদান নেই। শুধু মাত্র সাহিত্যই নয়, চিত্রকলা, নাট্যকলা, সংগীত, সমাজ দর্শন, ধর্মতত্ত্, শিক্ষা তত্ত্ব সব ক্ষেত্রই তাঁর লেখনীর অনায়াস বিচরণ আমাদের বিস্মিত করে। কবি পরিচয় তাঁর প্রধান হলেও একমাত্র পরিচয় নয়। তাঁর বড় পরিচয় তিনি সচেতন দার্শনিক ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি তীব্র গতিশীল নদীর মতো প্রবাহিত হলেও সমালােচনার পাথরখণ্ড তার গতি প্রবাহে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে, কিন্তু তার দুর্বার স্রোতের মুখে সবই ধুয়ে মুছে গেছে। তাকে বারবার সমালােচনার মুখাোমুখি হতে হয়েছে। বিতর্কের ঝড় উঠেছে তাঁর লেখা নিয়ে। সর্বাধিক বেশি বিতর্ক হয়েছে স্বাধীনতার আন্দোলনে কবির ভূমিকা নিয়ে। তার রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ নিয়ে। কেউ কেউ সোজাসুজি তাঁকে আক্রমণ করেছেন স্বাদেশিকতা আন্দোলনে কবির ভূমিকা শুধু নিষ্ক্রিয়ই শুধু ছিল না, ছিল পলাতকের ভূমিকা। তিনি নাকি পলায়নবাদী (escapist) ছিলেন।
তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদ এমন একটি বিষয় যা বহু বিতর্কিত। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘যখন খবর পাই, রাষ্ট্রনীতি, সমাজনীতি, ধর্মনীতি সম্বন্ধে আমার বিশেষ মত কী তা আমার রচনা থেকে কেউ কেউ উদ্ধার করবার চেষ্টা করছেন, তখন নিশ্চিতভাবেই জানি আমার মতের সঙ্গে তার নিজের মত মিশ্রিত হবে। …আমি জানি, আমার মত ঠিক যে কী তা সংগ্রহ করা খুব সহজ নয়।

রবীন্দ্র-সাগরের অতলে প্রবেশ করে তাঁর রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদের মুক্তটিকে খুঁজে পাওয়া মােটেই সহজ কাজ নয়, বেশ কঠিন কাজ। তার উপর আমার মতো সীমিত
জ্ঞান নিয়ে তাঁর মতবাদকে বিশ্লেষণ করা দুরুহ ব্যাপার। অসম্ভবও বটে। রবীন্দ্র সাগরে ডুব দিয়ে হাবুড়বু খাওয়ার মতো।
যে কোন দার্শনিক মতবাদ একদিনে গড়ে ওঠে না। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও চিত্তার ফসল। আবার এ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি চিত্তা স্থিতিশীল (state) নয়, বরং গতিশীল (dymamic) সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ঘটনার আবর্তে তার কিছুটা পরিবর্তন হলেও, মুল তত্ত্বটির একেবারে আমূল পরিবর্তন ঘটে না। তবুও কঠিন কাজ। রবীন্দ্রণাথের বেলায়েও এর ব্যাতিক্রম ঘটেনি। তাঁর কথাতেই শুনুন , – ‘বাল্যকাল থেকে আজ পর্যস্ত দেশের নানা অবস্থা এবং আমার নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে দীর্ঘকাল আমি চিন্তা করেছি এবং কাজও করেছি। রচনাকালীন সময়ের সঙ্গে, প্রয়ােজনের সঙ্গে সেই সব লেখার যােগ বিচ্ছিন্ন করে দেখলে তার সম্পূর্ণ তাৎপর্য গ্রহণ করা সম্ভবপর হয় না।
… রাষ্ট্রনীতির বিষয়ে কোন বাঁধা মত একেবারে
সুসম্পূর্ণভাবে কোনো এক বিশেষ সময়ে আমার মন থেকে উৎপন্ন হয়নি। জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে নানা পরিবর্তনের মধ্যে তারা গড়ে উঠেছে। সেই সমস্ত পরিবর্তন পরম্পরের মধ্যে নিঃসন্দেহে একটা ঐক্যমন্ত্র আছে। সেটিকে উদ্ধার করতে হলে রচনার কোন অংশ মূখ্য, কোন অংশ গৌণ, কোনটি তৎসাময়িক, কোনটা বিশেষ সময়ের সীমাকে অতিক্রম করে প্রবাহমান, সেইটে বিচার করে দেখা চাই।’

সর্বপ্রথম, ডঃ শচীন সেন রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মতবাদের আলোেচনা করেন ১৯২৯ সালে “The political philosophy of Rabindranath” গ্রন্থে।
প্রবাসীতে (অগ্রহায়ণ, ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে) রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং তার প্রশংসা করেন। কবির মৃত্যুর পর পরিবর্দ্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে ডঃ সেন প্রকাশ করেন ‘Political thought of Tagore’ ১৯৪৬ সালে।
রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি শুধু মাত্র স্বদেশের সীমানার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না বলেই সমালােচকরা বলেছেন, আন্তর্জাতিকতা বোধের বিপুল উত্তাপে বাষ্প হয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল তাঁর জাতীয়তা বোধ। কিন্তু দার্শনিক রবীন্দ্রনাথ সব সংকীর্ণতার উর্দ্ধে উঠে বিশ্বমানবতা বোধকে আপন করে নিয়ছিলেন। ফলে দেশের সমস্যায় তিনি যেমন বিচলিত বোধ করতেন তেমনি বিদেশের সমস্যাও তঁকে ব্যথিত করত। দুর্বলের প্রতি সবলের আত্যাচার, শাসন, শোষণ, নিপীড়ন, অবিচার ও অত্যাচার তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কৃষ্ণাঙ্গ জুলু জাতির প্রতি শ্বতাঙ্গদের অত্যাচারের তিনি ফুঁসে ওঠেন, ‘ওরে তুই ওঠ আজ/আগুন লেগেছে কোথা? কার শঙ্খ উঠছে বাজি/জাগাতে জগতজনে ! কোথা হতে ধ্বনিছে ক্রন্দনে/শন্যতল ‘কোন অন্ধ কারা মাঝে/ অনাথিনী মাগিছে সহায়’।’
যারা তাঁকে পলায়নবাদী (escapist) অপবাদ দিয়েছিলেন তাঁদের বােধহয় জানা ছিল না, জীবনের বহুদিন পর্যন্ত সক্রিয়ভাবে স্বদেশী আন্দোলনে তিনি অংশ গ্রহণ করে ছিলেন।
হাতেখড়ি হয়েছিল ‘হিন্দুমেলা’-তে।

১৮৮৫ সালে কংগ্রেসের জন্ম হয়। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসর মতো সংস্থার মধ্যে সদস্যদের দলাদলি ক্ষমতা লোভ দেখে কবি মর্মাহত হয়েছিলেন। নরম ও চরম পন্থীদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তাঁকে ব্যথিত করে তুলেছিল। সুরাট কংগ্রসের ব্যর্থতার পরও তিনি প্রত্যাশা করেছিলেন হয়তো অচিরেই এই দ্বন্দ্ব মিটে যাবে। তাই তিনি এই ব্যর্থতার পরও পাবনা কংগ্রেসে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু দলাদলির ভিত এতো শক্ত ছিল যে,কবি তা’তে সমান্যতম চির ধরাতে পারলেন না। সম্ভবতঃ সক্রিয় রাজনীতিতে এই পাবনা কংগ্রেসের কনফারেন্সেই তার শেষ যোগদান। তারপর তিনি সক্রিয়া রাজনীতি থেকে সরে আসেন। তাঁর চিত্ত যেখানে অপ্রসন্ন হলো, সেখানে বিবেকও অসত্তোষে ভরে উঠলো।
কবি মনে করতেনে সঙ্ঘশক্তি ছাড়া কোন জাতি মর্যাদা বা সাফল্য লাভ করতে পারে না। সঙ্ঘশক্তি আনতে হলে গ্রামে সমবায় নীতির প্রচলন, সঙ্ঘবন্ধ কাজ, বিচিত্র কুটিরশিল্লের প্রবর্তন, পরিমিত শ্রম-যন্ত্র ব্যবহার করা প্রয়োজন। কবির পরিকল্পনা তখন অগ্রাহ্য করেছিল কংগ্রেস, পরে অবশ্য জাতীয় কংগ্রেসই এসব বিষয়ের উপর গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয়েছিলেন তা’রা। রবীন্দ্রনাথ শুধু মাত্র কল্পনাবিলাসী কবি ছিলেন না। তিনি ছিলেন সচেতন দার্শনিক। তাই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ঐক্য আনতে হবে বৈচিত্রের মধ্যে। সাম্য-সৌহার্দ্ আনতে হবে স্বাতন্ত্রের মাধ্যমে।
পাবনা কনফারেন্সের পর সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ালেও কবি একেবারে নিষ্ক্রিয় ছিলেন না স্বাধীনতা আন্দোলনে। সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে এসে তিনি হাতে তুলে নেন লেখনী। ১৮৯২ সালে সাধনা পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ঘটে। সেখানেই কবি সাহিত্য সেবার মাধ্যমে স্বদেশ সেবায় নিজেকে নিয়ােজিত করেন। সাধনা পত্রিকায় রাষ্ট্রীয় বিষয়ে প্রথম আলোচনা শুরু করেন তিনি।
রবীন্দ্রনাথ সর্বদাই মানুষ এবং মনুষ্যত্বকেই সবচেয়ে বড় করে দেখতেন। ‘সবার উপরে মানুষ সত্য’ একথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। তাই কোথাও মনুষ্যত্বের অবমাননা ঘটলে তিনি স্থির থাকতে পারতেন না। বারবার ঝাঁপিয়ে পড়েছেন রাজনীতির আবর্তে। মানবিকতার অবমাননা যেমন তাঁকে রাজনীতিতে টেনে এনেছে, রাজনীতির মারপ্যাচ তাঁর অজানা ছিল বলে তিনি বারবার মার খেয়েছেন। বিবেক দংশন তাঁকে পুনরায় সক্রিয়তা থেকে নিষ্ক্রিয় করেছে রাজনীতির ব্যাপারে। তিনি চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক সরকার, যে সরকারের ভিত্তি হবে জনগণের সার্বভৌমিকতার উপর। গণতন্ত্রের ব্যাপারে তিনি আব্রাহাম লিংকনের চেয়ে বার্নার্ড শ’র মত অধিক যুক্তিযুক্ত বলে মনে করতেন। লিংকনের মতে ‘Democracy is the governmnent of the people, by the people and for the people. কিন্তু ‘বার্নড শ’-য়ের মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন, ‘Democracy is the governmnent of the people and for the people’ হলেও কখনোই ‘by the people’- নয়, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল রাষ্ট্রে এমন কিছু বিশেষ মানুষ থাকেন যাঁদের দেশ সেবার ক্ষমতাকে মানুষ উপেক্ষা করতে পারে না। সাধারণ মানুষের পক্ষে সুষ্ঠভাবে দেশ পরিচালনা সম্ভবপর নাও হতে পারে। এই জন্যই বােধহয় Leeky বলেছেন,’ Democracy can never be true society where, greed grows uncontrolled and people are drugged with admiration for power politics. নেতাদের লোভ, লালসা, যশলাভ, শক্তিমত্তার বিষ ঢোকে তবে সাধারণ মানুষ এসব থেকে রেহাই পেতে পারে না। তাই তিনি সাধারণ মানুষের হাতে শাসন ক্ষমতা তুলে দিতে রাজি ছিলেন না। এরিস্টটলের মতো তিনি বিশ্বাস করতেন,’Some are born to rule others to he ruled’. তিনি মনে করতেন গণতন্ত্রের স্থায়ী সাফল্যের জন্য অবশ্যই গ্রামের দিকে চোখ ফেরাতে হবে। গ্রাম বাঁচলে গণতন্ত্র বাঁচবে, আমরা বাঁচবো। রাষ্ট্রতন্ত্র অপেক্ষা সমাজতন্ত্রকেই তিনি শ্রেয়ঃ মনে করতেন।
কবি তাঁর মতবাদে ভাববাদ এবং বস্তবাদকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে আলাদা করে দেখেন নি। এখানেই মার্ক্সের সঙ্গে তার অমিল এবং হেগেলের সঙ্গে তার ঐক্য। ডায়লেকটিক্স এর
তত্তানুযায়ী দুই পরস্পর বিরোধী উপাদানের ঘাত প্রতিঘাতে, নুতনের জন্ম হয়, এ হল প্রকৃতির নিয়ম। কবিও বলেছেন, প্রকৃতির প্রকাশ বিভিন্ন রূপে। রূপের মৃত্যু অরূপে, পুরাতনের মৃত্যু নুতনে। তাঁর মতে কোন কিছুরই বিলুপ্তি হয় না, হয় নবরূপায় । মার্ক্স ও হেগেলের দর্শনে যে তত্ত্ব পাই, তাই পাচ্ছি আমরা কবির দর্শনে। মার্ক্সের সঙ্গে হেগেলের অমিল ডায়লেটিক্সের- য়ের রূপ নিয়ে। হেগেলের মতে পরিবর্তনের মূলে আছে ধারণা (idea) তাই তার তত্ত্বকে বলা হয় ‘Dialectical idealism’ কিন্তু মার্ক্সের মতে ‘Materialism’. কবি এই পরিবর্তনের সূত্রে হেগেলকেই সমর্থন করেছেন। কবিরও মত, সমন্ত বিবর্তনের মূলে আছে ভাব (idea) উৎপাদনের ক্ষমতাই ইতিহাসে পরিবর্তন আনে না। এই পরিবর্তন আনে ভাব (idea) আর ভাবই তাকে সাহায্য করে বাঁচার উপায় খুঁজে বের করতে। মার্ক্সের মতে ‘শ্রেণী সংগ্রামে’র ফলেই আসে প্রলেতারিয়েনদের একনায়কত্ব। এই একনায়কত্বের পরে ধাপে ধাপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় শ্রেণীবিভক্ত সমাজ,গড়ে উঠবে শ্রেণীহীন সমাজ।
কবি একথা বিশ্বাস করতে পারেননি কারণ সুষ্ঠুভাবে সমাজকে পরিচালিত করতে ক্ষমতা (Power) অপরিহার্য। আবার এই শক্তিই হলো যত নষ্টের মূল। তাই ক্ষমতাকে (Power) বাদ দিয়ে সমাজ গড়ে না উঠলে শ্রেণীহীন সমাজের আসল উদেশ্যটাই মাটি হয়ে যাবে।
পশুশক্তিকে বাদ দিয়ে প্রেম ভালবাসা ত্যাগের মধ্যে সকলকে এক করে তুলতে না পারলে শ্রেণীহীন সমাজের সার্থকতা হারাবে। কবি সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রশংসায় বিমুখ ছিলেন না। তাঁর মতে মানুষ যন্ত্রকে চালাবে, যন্ত্র মানুষকে নয়। কবিও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ গান্ধী এবং সুভাষের মিলিত শক্তিই সম্প্রসারিত করেছিল। গান্ধী ও সুভাষ উভয়ের পথকেই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে সমর্থন করেছেন কবি। কিন্তু সমর্থন করতে পারেননি সুভাষ ও গন্ধীর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনকে।
কবি মনে করতেন, হিন্দু-মুসলমান যদি আত্মীয়ভাবে মিলিত হতে পারে তবে, স্বরাজ পাওয়ার একটা বড় ধাপ তৈরী হবে। ‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য না হলে দেশ দু’টুকরাে হবে, ক্ষতি হবে বাঙালীর। তাই হয়েছে শেষপর্যন্ত। ধর্মন্ধতা কবি অপছন্দ করতেন। তিনি বুঝতেন ধর্ম নয়, মানুষের ভাষা ভূমি ও ঐতিহ্ই ঐক্যের মূলমন্ত্র। তিনি লিখেছিলেন ‘ধর্ম মোহ’ শীর্ষক কবিতায়, –
‘ধর্মের বশে মােহ যারে এসে ধরে / অন্ধ সেজন মারে আর শুধু মরে/ নাস্তিক সেও পায় বিধাতার বর / ধার্মিকতার করে না আড়ম্বর।’
তাঁর মতে ধর্মান্ধতা থেকে নাস্তিকতা অনেক ভাল।
কবি বুঝতে পেরেছিলেন শিক্ষাই হল মুক্তিপথের প্রশস্ত সোপান। তাঁর মতে ‘শিক্ষার আদর্শ হল মানসিক বিকাশ ও সুনাগরিকের কর্তব্যজ্ঞান।’ পুঁথিগত বিদ্যায় তার বিশ্বাস ছিল না। তিনি মনে করতেন জ্ঞানের জন্যই শিক্ষা, পরীক্ষায় পাশের জন্য নয়। যে শিক্ষা মানুষকে প্রকৃত মানুষ হতে সহায়তা করে, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা। মানুষকে অন্ধকার থেকে আলাের পথ দেখায়। রাশিয়ার শিক্ষা পদ্ধতির উচ্ছুসিত প্রশংসা করে কবি লিখলেন, ‘এখানে এসে দেখলুম এরা শিক্ষাটাকে প্রাণবান করে তুলেছেন। তার কারণ এরা সংসারের সীমা থেকে ইস্কৃলের সীমাকে সরিয়ে রাখেন। এরা পাশ করবার কিম্বা পন্ডিত করবার জন্য শেখায় না সর্বতো মানুষ করবার জন্য শেখায়।’ কবির মতে, – ‘The highest education is that which does not merely give us information but also harmonises our life with all existences’. বিশ্বভারতীতে সে শিক্ষাই দিতে চেয়ছিলেন তিনি। যা, মানুষকে মানুষ হিসাবেব গড়ে উঠতে সাহায্য করবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের প্রয়োেজনীয়তা তিনি অনুভব করেছিলেন। কারণ, ভাষা হলো ভাবপ্রকাশের বাহন। যে ভাব আমরা মাতৃভাষায় প্রকাশ করতে পারি, তা অন্য কোনও ভাষায় প্রকাশ করা সহজ নয়। শুধু স্কুল কলেজ নয়, সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার ব্যবহারের সুপারিশ করেন তিনি। ফলে তাকে নানা সমালােচনার সন্মুখীন হতে হয়েছে। কেউ কেউ বিরূপ করে বলেছিলেন, ‘তিনি তো ইংরেজী জানেন না, তাই এমন বলছেন। সমস্ত ভাষাকে সমানাধিকার দিতে এবং মাতৃভাষার মাদ্যমে পঠন-পাঠনের সুপারিশ করেছিলেন কবি। তিনি বলেছিলেন, দেশের কোন ভাষা রাষ্ট্রভাষার দাবীদার হতে পারে না। ফলে অনেকেরই তিনি চক্ষুশূল হয় উঠেছিলেন। পরে হিন্দিকে রাষ্ট্র ভাষা হিসাবে গণ্য করা হয়েছিল।
গান্ধীর মতো, রাজনীতির ক্ষেত্রে, তিনিও হিংসাত্মক বিপ্লব পছন্দ করতেন না।
স্বামী বিবকানন্দ যেমন বলতেন, ‘চালাকির দ্বারা কোন মহৎ কার্য সম্পন্ন হয় না।’ তেমনই কবিও বলতেন, হিংসার দ্বারা বৃহৃৎকর্ম সাধন হয় না। রাজনীতিতে হিংসার দাম নেই, কারণ রাজনীতির আদর্শ হল সকলকে নিয়ে সকলকে সহ্য করে জতির সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের পথে চলা। তাই তিনি বিশ্বাস করত্নে ‘পশুশক্তির বলে কোন ভাল কাজ হয় না। ক্রোধ ও হিংসা মানুষকে পশুর পর্যায়ে নিয়ে যায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে কবির ভূমিকা নিয়ে যতােই প্রশ্ন থাক, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, দেশ স্বাধীন করার সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিলেন কবি।
জীবনের প্রথম দিকে সমগ্র ইংরেজ জাতিকে কবি খারাপ মনে করতেন না। বরং ইংরেজ জাতির গুণাবলী তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল। অবশ্য তীব্র নিন্দাও করেছে তাদের শাসন, শোষণের। ধিক্কার জানিয়েছেন তাদের ইম্পিরিয়ালিজমকে অজগর সাপের গিলে খাওয়া বলে ‘পত্রপুট” কাব্যে। শেষপর্যন্ত তিনি ‘স্যার’ উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। কবি একদিকে ছিলেন সত্য ও সুন্দরের পূজারী অন্যদিকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কে সাম্য, সাতন্ত্র ও সৌত্রাত্বের সম্পর্কে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মানুষকে বিশ্বাস করতেন, মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ মনে করতেনে তিনি। মানুষের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি, তাই তার কাছে মানুষ ছিল সবার উপর়ে। তাঁর চিন্তাধারা, ভাব, ভাবনা মানুষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।
তিনি ছিলেন মানবতার দিশারী, আমাদের কাছে এক আলােক বর্তিকা। আজও যদি তাঁর আদর্শকে পাথেয় করে চলা যায়, তবে বিশাল ভারতবাসীদের মধ্যেও ঐক্য বজায় রেখে সর্ববিষয়ে এগিয়ে যাবার সুযােগ রয়েছে। আমরা কি সে পথের পথিক হবো? ভাবুন,ভেবে দেখুন।

—————————————————————-
ঋণস্বীকার – কেদারনাথ মুখোপাধ্যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *