Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

তখন সকাল বেলা। সকালসকাল স্নান করে নেবার অভ্যাস রমার। তখনই কেউ এসে ডাকল, ‘রমা আছে!’

রমা বাথরুমে। রমা স্কুটারের শব্দে টের পায় সে এসে গেছে। রমা অনেক দূর থেকে শুনতে পায়, নীল রঙের স্কুটার চড়ে সে আসছে। অনেকদূর থেকে আওয়াজটা অতীব এক ভোমরার মতো শব্দ করতে থাকে। যেন দূরান্তে আছে লোকটা, স্কুটারে চাপলেই গড় গড় শব্দ, কোনো দূরবর্তী জায়গা থেকে শব্দটা ভেসে আসে। রমা তখন স্থির থাকতে পারে না।

দোতলায় বারান্দায় বোধহয় কেউ নেই। বাবা ঠিক কাগজ পড়ছে। মানুষটা নীচে দাঁড়িয়ে রোজকার মতো বলবে, রমা আছে। আশ্চর্য অভ্যাস মানুষটার। রমা যাবে কোথায়? রমা আছে কী নেই কথাটা অবান্তর। আসলে জানান দেওয়া, এলাম। স্কুটারের শব্দে টের পায় সবাই সে এসেছে। অধিকন্তু নীচে দাঁড়িয়ে বলা, রমা আছে? রমার ভারি হাসি পায় কথাটা ভেবে।

আজ ছুটির দিন। ছুটির দিন হলেই অরুণ সকালসকাল চলে আসে। রমা অন্য দিনকার চেয়ে ছুটির দিনে আরও একটু বেশি সময় নিয়ে বাথরুমে ঢোকে। যেন ছুটির দিনে সহজে সব কিছু সাফ—সোফ হতে চায় না।

আর গরমের দিনে কোথাও বের হতে হলে স্নান না করে বের হওয়াও যায় না। ফুরফুরে বাতাসে চুল উড়বে। শরীরে মেখে নিতে ভালো লাগে সব মনোরম গন্ধ। এবং লোকটার গায়ে মিশে থাকতে তখন কী যে আরাম লাগে! যথার্থ পুরুষমানুষের গন্ধ অরুণের শরীরে! কী সুন্দর গন্ধটা! ঠিক স্কুটারের মতই মনে হয়, যত সে বাতাসে ভর করে আসছে ততই গন্ধটা ক্রমে এগিয়ে আসে। এবং এভাবে নীচে এসে না ডাকলেও টের পায়, কোথায় কত দূরে আছে মানুষটা। রমা আছে, এমন প্রশ্নে সে অরুণের মধ্যে একজন কাপুরুষেরও গন্ধ পায়।

রমা জানে, অরুণকে দরজা খুলে দেবার লোকের অভাব নেই বাড়িতে। অরুণ সোজা বারান্দা ধরে সিঁড়িতে উঠে আসছে জুতোর শব্দে তাও সে টের পায়। এবং এমনই যখন সব কিছু তখন একটু দেরি করলেও ক্ষতি নেই। সে ঠিক উঠে আসবে ধীরে ধীরে। জুতোর শব্দ সিঁড়িতে। ওর উঠে আসা, বসা এবং প্রতিটি কথাবার্তা শোনার জন্যে তখন মাথায় জল ঢালে না রমা। কেমন গোপন এক অভিসার নিজের সঙ্গে নিজের।

একটু বাদেই সে সেজেগুজে বের হবে মানুষটার সঙ্গে। কখন ফিরবে ঠিক নেই। কোনো কোনোদিন অরুণ বড় ফাজিল হয়ে যায়। ফিরতে চায় না। রাত করে ফিরলে ঠান্ডা গলায় বাবা বলবে, ‘তোমরা বড় হয়েছ। সবই বোঝ। আমার বলার কিছু নেই।’

রমা তখন বাবাকে বলতে চায়, বাবা, আমি কী বড় হয়েছি! বড় হওয়াটা কী! আজকাল সে নিজের সঙ্গে দুষ্টু দুষ্টু খেলা যখন আরম্ভ করে দেয়, মনেই হয় না পৃথিবীতে কোনো দুঃখ আছে।

অরুণের নতুন স্কুটার কেনার পর এমন হয়েছে। ছুটির দিনগুলো ভারি মজার। সকাল হলেই অরুণ নীচে এসে ডাকবে—রমা, রমা। রমা তো তৈরি। তবু অরুণকে একটুক্ষণের জন্য ওপরে উঠে যেতে হয়। দোতলায় তিনখানা ঘরের একখানা বসার ঘর। সিঁড়ি দিয়ে ঠিক ঢোকার মুখে বাথরুম, তারপর সরু করিডোর। বাঁদিকে বসার ঘরের মুখেই রান্নাঘর। করিডোর দিয়ে ঢোকবার সময় প্রায় রান্নাঘরের সবই দেখা যায়। লোকজন এলে বাড়িটার কোনো আব্রু থাকে না।

সে উপরে এলেই দেখতে পাবে বাথরুমের দরজা বন্ধ। কেউ ভেতরে আছে। তখন জল ঢালার শব্দে, মগের ঠুংঠাং আওয়াজে সে টেরও পাবে বাথরুমে কে আছে, আর টের পেলেই যা হয়, সব কিছু তার চোখের ওপর তখন ভাসতে থাকবে। ভাবতেই রমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। নিজের শরীর বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার এক আশ্চর্য বাসনা জাগে।

রমার ছোট ভাই মানু তখন রেলিঙে ঝুঁকে পড়েছে। এই মানুষটি এলে ছোটখাটো দুঃখ আর সংসারে ভেসে থাকে না। যেন সব সময়ই মানুষটার এই পরিবারের জন্য কোনো না কোনো সুখবর বয়ে আনার কথা। মানুর তো খুব প্রত্যাশা, একদিন যেমন দিদির চাকরির খবর নিয়ে এসেছিল, তেমনি তারও চাকরির খবর আনবে। বোধহয় বেলায় ঘুমোয় বলে, টেরই পায়নি, নীচে অরুণদা দাঁড়িয়ে আছে। বাইকের শব্দ থেমে গেছে। সে স্বপ্নের ভেতর বাইকের একটা শব্দ শুনতে পেয়ে যেন জেগে উঠেছিল। তারপর রেলিঙের ধারে এসে দেখেছে ঠিক অরুণদা, পাশে তার নীল রঙের স্কুটার, সুন্দর ব্যাকব্রাশ করা চুল, লম্বা বেলবটস আর রংদার বুশ—শার্ট।

বিগলিত হাসি মানুর—অরুণদা যে কী দারুণ লাগছে তোমাকে! ঘড়ি? ব্যান্ডটা দেখি—কবে কিনলে—সব ম্যাচ করা। দিদি বাথরুমে।

এই বাইকের শব্দ তো এ—বাড়ির বুকে একটা ছোট রেলগাড়ি চালিয়ে দেয়। সবাই নড়েচড়ে বসে। মা ঘোমটা টেনে বলে, ‘দ্যাখ অরুণ বুঝি এল।’

বাবার আজকাল ভীষণ ভয়, আতঙ্ক, যেন সব জায়গাতেই গণ্ডগোল লেগে আছে। কারণ শহরের দিনগুলো কোনো না কোনো জায়গায় ভয়ংকর খবরের মতো কাগজের পাতায় ভেসে থাকছে। বাবার যা স্বভাব, ঠিক বলবে, ‘অরুণ, তোমাদের ওদিকটাতে কোনো গণ্ডগোল হয়নি তো আর।’

রমা শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে এমন ভাবছিল। সবাই একটা যেন কী ভেবে ফেলেছে। অরুণ ওর অফিসে রমাকে এত ভালো মাইনের একটা কাজ জোগাড় করে দিতেই সহসা সবার সে বড় নিজের মানুষ হয়ে গেছে। এবং অরুণের জন্য সংসারের সব মানুষদের একটা কৃতজ্ঞতাবোধ জন্মে গেছে। দাদা পর্যন্ত অরুণকে আজকাল সমীহ করে কথা বলে!

অথচ অরুণ এ—সংসারে এসে স্বস্তি পায় না। এই যে রমাকে নিয়ে ছুটির দিনগুলোতে বের হয়, সম্পর্কটা যে সত্যি কী, কখনও ভেবে সে অস্থির হয়ে ওঠে, অথচ না এসেও পারে না, যে সংসারের একটা বড় কর্তাগোছের মানুষ রমা, ওর ইচ্ছেতেই এখন সব হয়। রমার ইচ্ছে না থাকলে সে কখনও এতটা এগোতে পারত না। যেন রমাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমার নিজের মানুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়াব, ভয়ের কি। আর এমন সুপুরুষ, ভালো মাইনের কাজ করা মানুষ, তোমরা যতই চেষ্টা কর, কিছুতেই আমার মতো মেয়ের জন্য আনতে পারতে না। সংসারে আমার ভার কত হালকা হয়ে গেছে, বুঝতেই পারছ তোমরা। তারপরই রমার মুখে কেমন দুঃখী দুঃখী দেখায়। আসলে ভেতরে অশুভ ছায়া তখন নড়েচড়ে বেড়ায়। সে জানে সেটা কী। সে বোঝে কতটা দূরে সে স্কুটারে উড়ে যেতে পারে।

আর তখনই বারান্দায় জুতোর শব্দ। রমা শাওয়ার বন্ধ করে জুতোর শব্দ শুনল। বসার ঘরের দিকে যাচ্ছে। ঠিক একজন বুড়ো মানুষের মতো মনে হয়। বারান্দা ধরে বসার ঘরে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন কোনো রুগণ মানুষকে ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এবং এত করেও এই ভারিক্কি রুগণ শব্দটা রমা দূর করতে পারেনি অরুণের। বাড়িতে অরুণের এতটা কাপুরুষের মতো স্বভাব রমার পছন্দ না। যেন বাড়িতে চোর ঢুকেছে। বাড়িতেই এমনটা। কিন্তু যখন স্কুটার চালিয়ে দেয়, নীল আকাশের নীচে ধাবমান স্কুটার আর সে, পাগলের মতো অরুণ কত দূরে যে যেতে চায়। সে মাঝে মাঝে ভয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘এই পড়ে যাব। মরে যাব। আস্তে।’

অরুণ তখন আরও মজা পায়।

রমা যতটা পারে কোমর ধরে বসে থাকে। যত নীল আকাশ দুরন্ত ছেলের মতো দামাল হয়ে ওঠে, চারপাশের বাড়িঘর, গাছপালা যত দ্রুত ধাবমান দৃশ্যাবলি হয়ে যায় তত সে খামচে ধরে অরুণকে। যেন সে তখন পারলে অরুণের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চায়।

আর অরুণ এক উন্মুক্ত আকাশতলে প্রায় শক্ত বাহুতে ব্যালান্সের খেলা খেলতে খেলতে কোন এক সুদূর গোপন গহন অভ্যন্তরে প্রবেশ করে—রমা সত্যি থই পায় না। এমন একটা জীবন ছেড়ে দিতেও তার ভয় লাগে। সে তখন একা হয়ে যাবে। ভারি নিঃস্ব। পৃথিবীতে এমন কোনো নবীন যুবকের আর সন্ধান পাবে না, যে তাকে অরুণের মতো সুদূরে নিয়ে যেতে ভালোবাসে।

রমা বুঝতে পারল, অরুণ বসার ঘরে ঢুকে গেছে। সে এবার শাওয়ার পুরো খুলে দিল। শরীরে বৃষ্টিপাতের মতো এক স্নিগ্ধ করুণা। সে বুঝতে পারছিল, অতলে ডুবে যাচ্ছিল সে। সব জেনেও কিছু আর তার করার নেই।

আগে দাদা বাবা মিলে কী না করেছে। এখন দাদার ধারণা অরুণ ইচ্ছে করলে মানুকেও একটা চাকরি দিতে পারে। দাদা বাবা সবাই সেজন্যে স্কুটারের শব্দ পেলে ছুটে চলে যায়। কে আগে প্রাণ করিবেক দান এমন যেন ভাব। রমা হেসে বাঁচে না। শাওয়ারের জল মাথায় মুখে সর্বাঙ্গে—কি যে ঠান্ডা! শরীরের রোমকূপে বিন্দু বিন্দু জলকণা ক্রমে গভীরতর হচ্ছে। সারা শরীরে সাবানের ফেনা, পাম—অলিভের সৌরভ আর তখন সেই দুষ্টু লোকটা বাবা দাদার সঙ্গে সরল বালকের মতো ঠিক গল্প জুড়ে দিয়েছে। কে বলবে, ওর উদ্ভট সব পরিকল্পনা যে—কোনো কুটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের চেয়ে প্রবল।

আয়নায় রমার শরীরের সবকিছু ভেসে বেড়াচ্ছে। শরীরে কী যে মোহ থাকে মানুষের, শেষ হয়ে যায় না, বার বার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখতে কেন যে এত ভালো লাগে—আচ্ছা অরুণ, তুমি বসে গল্প করছ, কিছু ভাবছ না তো। এই মিথ্যুক মারব! আমি বাথরুমে, তুমি কিছু ভাবছ না! তুমি আমাকে মনে মনে দেখতে পাচ্ছ, আমি এখন কী কী করতে পারি ঠিক তুমি জানো সব। তুমি খুবই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছ, আমি জানি। আমার হয়ে গেল বলে। বের হলেই সাবানের গন্ধটা ভুর ভুর করবে তোমার নাকে। তেলের সুগন্ধ চুলে। তুমি তো খুব ভালোবাসো এসব গন্ধ নিতে। স্নান সেরে বের হলেই জানি আমাকে দেখতে খুব ভালো লাগে তোমার। পাগলামি করবে না। আজকাল যা করছ। কিন্তু তুমি তো জানো, আমার কী কী ইচ্ছে হয়, আমার কিন্তু ভয় লাগে অরুণ। সত্যি ভয় লাগে। কোনো বড় হলঘরে ঢুকে যাবার মতো ভয়।

অরুণ তখন বলল, এই যে মানুবাবু, তোমার ক্লাব তো হেরে গেল।

মানুর রাতে ভালো ঘুম হয়নি। হাই উঠছিল। দিদি না আসা পর্যন্ত কেউ না কেউ একজন ওরা জেগে থাকে। দাদা বাজার করতে যাবে—দাদাকে সে ঢুকে বলল, তুমি যাও। অতিথির অসম্মান না হয় আবার! মানু অথবা বাবা, যে কেউ একজন হলেই চলে! মা মানদাকে দিয়ে ঘরের ঝুল পরিষ্কার করাচ্ছে। মানু খুব বিষণ্ণ গলায় বলল, এত ক্লিকবাজি থাকলে হারবে না!

অরুণ বলল, ক্লিকবাজি কারা করছে?

কারা আবার। সাপোর্টাররা ভাবছেন ছেড়ে দেবে।

ঠ্যাঙাবে বলছ?

কিছু একটা হবেই।

এসব কথা খুবই অদরকারি অরুণের কাছে। তবু কিছু কথা অদরকারি হলেও বলে যেতে হয়। কাগজটা এক ফাঁকে তুলে প্রথম পাতার খবর দেখল। জনগণের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা—অরুণ প্রথম দু—চার লাইন পড়তে পড়তে কিছুই ভালো লাগছে না—র মতো রেখে দিল কাগজটা। মানুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তা হলে কিছু একটা হবেই।’

হবে না বলছেন! পর পর হেরে যাওয়া কত আর সহ্য করা যায় বলুন।

শুনলাম ক্লাবের সেক্রেটারি বিলেত চলে যাচ্ছেন?

গুজব। কতরকম যে গুজব রটাচ্ছে শত্রু—পক্ষরা।

মানুষের এই স্বভাব। সে নিজেই কোনো না কোনো জটিল সমস্যা নিজের জন্য সৃষ্টি করে নেয়। মুখ চোখ দেখে অরুণ বুঝতে পারছিল, মানু রাতে ভালো ঘুমোতে পারেনি। সে কোনো ক্লাবের একনিষ্ঠ সমর্থক নয়। যে জেতে তার পক্ষ নিতে শুধু তার ভালো লাগে। বরং এই সকালে অদরকারি কিছু কথাবার্তা বলতে গিয়ে বুঝল, মানু ভীষণ সিরিয়াস হয়ে উঠছে। ওর হাসি পায়। সে মানুকে সামান্য উত্তপ্ত করতে পেরে বরং খুশিই। সারা সকালে ওই একটা বিষয়েই তর্ক করা যেতে পারে। খেলোয়াড়দের প্রশংসা, নিন্দা দুটোই এখন তর্কের বিষয়বস্তু হতে পারে। জার্সির রং দেখে ঘাবড়ে যায় সে বলতে পারত, যদিও কোনো কিছুই তার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না, বরং বাথরুমের দিকে চোখ—কখন খুট করে দরজা খোলার শব্দ হবে। কখন রমা বের হবে স্নান সেরে। দৃশ্যটা দেখার জন্যই সে একমাত্র উন্মুখ। পর্দায় প্রায় নগ্ন কোনো দৃশ্যের মতো তার কাছে অতীব প্রয়োজন রমার এই বের হওয়া। সে তবু বলল, মন খারাপ!

হবে না!

কেউ ডাকছে মনে হচ্ছে।

ওই তো ডেকে নিয়ে গিয়ে এখন লাগবে পেছনে।

যাবে না। তবে বল অন্তত বাড়িতেই আছ।

কিছু বলব না। আপনি একটু উঠে গিয়ে বলুন না অরুণদা, মানু নেই।

অরুণের উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। যদি রমা ঠিক তখনই বের হয়ে যায়। রমার স্নানের দৃশ্যটা সে আজকের দিনটায় দেখতে পাবে না! ওই যে কী হয়, একবার ডায়মন্ডহারবারে সাগরিকায় দুপুরবেলা খাওয়া—দাওয়া করে খাবার পর বাথরুমে হাতমুখ ধুতে গিয়ে রমা বেরই হচ্ছিল না। যখন বের হল, তখন একেবারে স্নিগ্ধ ছবি রমার। স্নানটান শেষে মেয়েদের এত কেন যে ভালো লাগে।

তার বলতে ইচ্ছে হল, মানুবাবু, তোমার এমন একটা দৃশ্য দেখার জন্য বসে থাকতে ইচ্ছে হয় না। অথচ নীচে ডাকছে, তখন গলা পাওয়া যাচ্ছে—মানু আছিস?—মানু?

অরুণ অগত্যা জানালার পর্দা সরিয়ে বলল, ও তো নেই। এলে কিছু বলব?

বলবেন এসেছিল। বললেই বুঝতে পারবে। আমার নাম নানু।

অরুণ ভাবল বেশ সময় এটা মানুষের। একটা কিছু নিয়ে থাকা। কোনো ব্যর্থতাই ব্যর্থতা নয়। ওদের সময় কত সহজে কেটে যায়। ওর সময় লম্বা, দীর্ঘ, এবং একমাত্র রমা কাছে থাকলে সময় কীভাবে কেটে যায় সে টের পায় না। সে মানুকে বলল তোমার বন্ধু নানু এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে মানুর মুখটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল।

তখনই রমা খুট করে দরজা খুলে ফেলল। প্রায় আবির্ভাবের মতো লাগছিল। এমন উঁচু লম্বা মেয়ে সে কমই দেখেছে। চুল ঘন, মিহি চুলে তোয়ালে জড়ানো। হাতে ভেজা সায়া, শাড়ি, ব্লাউজ। বাসি কাপড় ধুয়ে একেবারে পরিচ্ছন্ন রমা। ভেতরের রক্তপ্রবাহ কেমন মাতাল সমুদ্রের মতো ওকে ধাক্কা মারে। এত উষ্ণতা জীবনে থাকে কেন! তার নিজের কিছু আছে, উলটে পালটে দেখতে দেখতে বছর দু’বছর না ঘুরতেই জীর্ণ বাসের মতো হয়ে যায় কেন! প্রকৃতির কোন কুটবুদ্ধি শরীরে তার খেলে বেড়ায়। কতবার মনে হয়েছে এটা ঠিক না। গোপনে সে একটা ভারি পাপ কাজে লিপ্ত হবার জন্য উন্মুখ। অথচ এই মেয়েটা তাকে নিয়ে বেশ খেলাচ্ছে। কোথাও যখন গভীরে ডুবে যেতে ইচ্ছে হয়, রমার বালিকার মতো দুঃখী মুখ। তখন সে আর গভীরে নেমে যেতে পারে না। চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, রমা প্লিজ। রমা মরে যাব।

রমা তখন পাশ কাটিয়ে বারান্দায় শাড়ি মেলতে যাচ্ছে। পালিয়ে পালিয়ে কিছুটা দেখছিল। খুব অবহেলা ভরে। চোখে বিন্দুমাত্র লোলুপতা ছিল না। আবার মানু অজস্র কথা বলে যাচ্ছে। সে হুঁ—হা করছে। সিগারেট টানছে। রমার সঙ্গে গোপনে যে কিছু কথাবার্তা হয়ে গেল মানু হয়তো টেরই পেল না। এই বাড়ি, ঘরদোর, আসবাবপত্র সবই ওর কাছে বড় মহার্ঘ হয়ে যায় রমার জন্যে। সে কেমন দীনহীনের মতো কেবল সব কিছু তাকিয়ে দেখে।

রমা নিজের মনেই বলল তখন, এই তুমি পালিয়ে পালিয়ে এত কী দেখছ! চোর কোথাকার! কী ভেজা বেড়ালের মতো বসে আছে দ্যাখ। কিছু যেন খুঁটে খেতে জানে না বাবু। রমা বারান্দা থেকে বলল, কী অরুণদা মানুর সঙ্গে বেশ জমে গেছ। আমরা যে বাড়িতে আছি দেখে তা মনে হয় না।

আরে না না। তুমি যাবে তো?

কোথায়!

বা রে বললাম না, জীবনবাবুর ছেলের অন্নপ্রাশন।

না গেলেই নয়?

দ্যাখ ভেবে। যাও তো সঙ্গে নিতে পারি।

না গেলে ভারি খারাপ দেখাবে?

অরুণ এসেই কত সব জীবনবাবুর বিয়ে, অন্নপ্রাশন, বউভাত, পিকনিকের কথাবার্তা বলে যে সুখ পায়। আগে এটা সত্যি বিয়ে অন্নপ্রাশন ছিল। পরে কিছুদিন যেতে না যেতেই দাদার মনে সংশয়, তারপর কিছুদিন সে এ—বাড়িতে আসতই না। দাদাই খবর দিয়ে ফের আনিয়েছে। ওদের ভুবনেশ্বরে সেলস এম্পোরিয়ামে একটা পোস্ট খালি আছে। যদি অরুণ চেষ্টা চরিত্র করে মানুকে ঢুকিয়ে দিতে পারে। সংসারে অরুণই একমাত্র ভরসা।

রমা নিজের ঘরে ঢুকে গেছে তখন। গলায় ঢুকে পাউডার ঢেলে দিচ্ছে। গলা বাড়িয়ে একবার মাকে বলল, অরুণদাকে চা দাও, মা।

ও—ঘর থেকে অরুণ বলল, কিচ্ছু না।

মা বলল, তুই ফিরবি কখন?

ফিরতে রাত হবে।

মা আর কিছু আজকাল বলতে সাহস পায় না। বসার ঘরে বাবা একা। বয়স বাড়লে মানুষেরা খুব নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। বাবা একদিন বলেছিলেন, এবারে বল আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবে।

রমা কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেছিল। বলেছিল, বললে কী হবে!

বললে কী হয় তোমরা জানো না।

চাকরিটা তবে থাকবে না।

যেন বাবার মনে পড়ে যায় সত্যি, তবে চাকরি থাকবে না। মেয়েটা তার উঁচু লম্বা বলেই এমন একটা দামি চাকরি পেয়ে গেল। শ্যামলা রং। চোখ বড় চিবুক সামান্য চাপা। তবু রমার মুখে এক ধরনের কোমল ব্যক্তিত্ব আছে, সে যে—কোনো মানুষের পক্ষে লোভনীয়। রমা নিজের টাকায় একাই বাড়ির আজকাল সব প্রাচুর্য রক্ষা করতে পারে। আসলে চাকরির শর্তটা এই রকমের। আসলে যারাই আসবে সেই বিরাট অফিস বাড়িটাকে, যেখানে রমা কাচের ঘরে বসে থাকে, সবার সঙ্গে সামান্য হেসে কথা বললে লোকগুলির মনের ভেতর এক সুন্দর জগৎ তৈরি হয়ে যায়, জটিল সব লেন—দেন অফিসের দোরগোড়ায় এসেই সহজ সরল হয়ে যায়। আসলে মেয়েটা তার গৌরব। অফিসবাড়ির অনেক কূটতর্ক ওর হাসিতে জলের দামে বিকোয়।

এ—সব কারণেই তিনি দ্বিধা এবং সংশয়ে ভুগছেন। কিছু স্থির করতে পারছেন না। বরং নিবেদিত যৌবন রমার—এমনই তিনি ভাবেন। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন, তারপর কী হবে!

তারপর কী হবে কেউ জানে না।

অরুণ নিজেও জানে না তারপর কী হবে।

আর রমাও বসে থাকে না তারপর কী হবে ভেবে। সে বরং অরুণ আছে বলেই তার সঙ্গে কিছুটা তারপর কী আছে জীবনে বুঝতে পারে। আর অফিস বস যেহেতু অরুণের আপন মামা, কেউ আর রমাকে ঘাঁটাতে চায় না। বরং অরুণ হাতে ধরে নিয়ে এসেছিল বলে, অরুণের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখে ফেললে, কেউ চটে যেতে পারে না। অরুণের কোনো আত্মীয় হবে। একবার তো জীবনবাবুই দেখেছিল, স্কুটারে একটা আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলজ্বল করছে। যে—কোনো সময় দাউ দাউ করে অগ্নিকাণ্ড ঘটে যেতে পারে, কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করতে সাহস পাননি। অরুণবাবুর স্ত্রী যখন যুবতী এবং লাবণ্যময়ী, স্ত্রীর চোখেই দৃশ্যটা পড়বে একদিন। তখন যা হবার হবে। মজা দেখার মতো অন্তত জীবনবাবুর এই জীবনে একটা ঘটনা ঘটে যাবে। সেই আশাতেই তিনি লেজারে কেবল যোগ করে যাচ্ছেন। বিয়োগ করছেন না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *