ব্রহ্মাণ্ডের রত্নভান্ডার
“যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখ তাই, পাইলেও পাইতে পার অমূল্য রতন “
সত্যিই, আপাতদৃষ্টিতে একেবারেই গুরুত্বহীন কিছু মনে হলে ও, তার মাঝেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রাপ্তি ঘটতে পারে।
মানুষের স্বভাবই তাই। সারাজীবন ধরে অর্থের পিছনে ছুটে ছুটে তারা ক্লান্ত অবসন্ন। তবুও সন্ধানে বিরতি পড়েনি। কেবলমাত্র পৃথিবীর আনাচে কানাচে কেন? তারা এখন মহাকাশের ইতিউতি খোঁজ চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন হয়তো এভাবেই একদিন পৃথিবীর মানুষের সমস্ত অভাব মিটবে।
সংসারের ব্যাপ্তি শুধু এই দুনিয়ায়? নাকি গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে? যুগ যুগ ধরে উত্তর খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানীরা। এই খোঁজের মধ্যেই মহাশূন্যে সন্ধান মিলেছে বহু আশ্চর্য জগতের। এরই একটি ১৬-সাইকি। প্ল্যাটিনাম, সোনা, লোহা, তামা-সহ একাধিক বহুমূল্য ধাতুতে ঠাসা এই গ্রহাণু। আর এই নিয়ে আশায় বুক বেঁধেছে পৃথিবীর মানুষ
এ বার পৃথিবীর বুকে সেই সম্পদের ভাণ্ডারকে নামিয়ে আনার তোড়জোড় শুরু করে দিলেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের দাবি, ওই গ্রহাণুর এক একটি টুকরোয় বিশ্বের সবাই কোটিপতি হয়ে যেতে পারেন! বিজ্ঞানীদের অনুমান, আমেরিকার বর্তমান বাজার অনুযায়ী, ১৬ সাইকির আনুমানিক মূল্য প্রায় ১০ হাজার কোয়াড্রিলিয়ন ডলার। যেখানে বিশ্বের অর্থনীতি ১০৫ ট্রিলিয়ন ডলারের।
১৬ সাইকি গ্রহাণুটির মোট মূল্য নাকি পৃথিবীর সমস্ত মুদ্রার ১ লক্ষ ৩৫ হাজার গুণ বেশি।
নাসা মনে করছে, ১৬ সাইকিতে যে লোহা এবং নিকেল রয়েছে, তার ঘনত্বও নাকি স্বাভাবিক নয়
বেশ কয়েক জন বিজ্ঞানী ১৬ সাইকির পৃষ্ঠে সিলিকেট খনিজ পদার্থের উপস্থিতির কথাও জানিয়েছেন। ২০১৬ সালের অক্টোবরে সেই গ্রহাণুতে হাইড্রক্সিল আয়ন থাকার প্রমাণও পেয়েছে নাসা।
আজ থেকে প্রায় ১৭০ বছর আগে, ১৮৫২ সালে এই গ্রহাণুর অস্তিত্ব ঠাহর করা গিয়েছিল। ইটালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী আনিবেল দি গাসপারিস প্রথন সেটি আবিষ্কার করেন। তবে গ্রহাণুটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করতে প্রায় ১৭০ বছরের বেশি সময় লেগেছে। শুরুতে আর পাঁচটা মৃতপ্রায় গ্রহাণুর সঙ্গে সেটিকে গুলিয়ে ফেলেছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সময় যত এগিয়েছে, ততই মোহময়ী রূপে ধরা দিয়েছে প্রাণহীন সেই গ্রহাণু। সেই ১৬-সাইকির গায়ে আঁচড় কাটতে চলেছে বর্তমান আমেরিকার মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা।
গ্রিক দেবী ‘সাইকি’র নামে গ্রহাণুটির নামকরণ করা হয়েছে। মহাবিশ্বে এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবথেকে বড় গ্রহাণুগুলির মধ্যে ১৬ সাইকি অন্যতম। গ্রহাণুটির গড় ব্যাস প্রায় ২২০ কিলোমিটার।
Asteroid বা গ্রহাণু শব্দটা শুনলেই যেন অনেকের ভ্রুকুঞ্চিত হয়। অনেকেই ভাবতে থাকেন, মহাকাশ থেকে আসা এমন এক বিরাট পাথরের চাঁই যা পৃথিবীতে পড়লে বড়সড় কিছু ঘটতে পারে। এমন ইতিহাস যে নেই তা তো নয়। পৃথিবীতে একদিন তো গ্রহাণু নেমে আসার ফলেই ডাইনোসররা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। গ্রহাণু সম্পর্কে মানুষের ধারণাটাই এমন যে, কেউ ভাবতে পারেন না এই স্পেস রক মানবজাতির ভালোও করতে পারে। তবে কিছু এমন গ্রহাণুও রয়েছে, যেগুলি এই পৃথিবীতে এলে আমরা রাতারাতি বড়লোক হয়ে যেতে পারি। তবে সেই কাল্পনিক ক্ষেত্রে সমস্যাও আছে অনেক। গ্রহাণুটি সংগ্রহ করে আমরা যদি নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিই, তাহলে আমরা প্রত্যেকেই বড়লোক হয়ে যেতে পারি, এই ধরনের ধারণা মনের মধ্যে আসতেই পারে। তবে মানবজাতির মধ্যে অপরকে ল্যাং মারার যে প্রতিবর্ত ক্রিয়া পূর্ব থেকেই রয়েছে, তা না আর একটা যুদ্ধের কারণ হয়! মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে একটি এস্টোরয়েড বেল্টে তেমনই একটি বিরাট ধাতব গ্রহাণু ১৬-সাইকি। আলুর মতো দেখতে এই গ্রহাণুর থেকে এমন বিশেষ কিছু প্রত্যাশা রাখা যেতেই পারে।
প্রাথমিক ভাবে মনে করা হয়েছিল ব্রহ্মাণ্ডের কোনও নক্ষত্র ধ্বংস হয়ে গ্রহাণুটির জন্ম হয়েছে। তবে এ নিয়ে আরও মতামত রয়েছে।
নাসা জানিয়েছে, গ্রহ হিসেবে একটু একটু করে গড়ে ওঠার পথে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময় কক্ষপথ থেকে বিচ্যূত হয়ে অন্যদের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সেটি মৃত অবস্থায় ভাসছে মহাশূন্যে। প্যাসাডিনার ক্যালটেক গবেষণা সংস্থা জানিয়েছে, ৫০ মেগাপিক্সেল রেজোলিউশনের যে ছবি তাদের হাতে এসেছে, তাতে দেখা গিয়েছে গ্রহাণুপৃষ্ঠটি ধাতুতে মোড়া। তবে ধাতুগুলো মৌলিক অবস্থায় রয়েছে,সে আশা করা বোকামি।
চলতি বছরের ২৩এ অক্টোবর নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে সাইকি মহাকাশযানটি উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। একটি ভারী রকেটে মূল মহাকাশযান এবং দু’টি ছোট মহাকাশযান ১৬ সাইকির দিকে উড়ে গিয়েছে। ২০২৯ সালের অগস্ট মাসে সেটি গ্রহাণুর কাছে পৌঁছানোর কথা। এটি একটি অরবিটার। কাজেই আমাদের এখনো প্রায় ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে ১৬-সাইকির সম্পর্কে সম্যক ধারণা করতে।
তবে প্ল্যানেটারি সায়েন্স জার্নালে ইতিমধ্যেই ১৬-সাইকি সম্পর্কিত বিশদ তথ্য প্রকাশিত হয়েছে। এখনও পর্যন্ত যা যা তথ্য সামনে এসেছে, তা জড়ো করে একটি ভিডিয়োও প্রকাশ করেছে নাসা। যেটি বেশ আশ্চর্যের। চিলির বিজ্ঞানীদের দাবি, গ্রহাণুটির ভূপৃষ্ঠের কমপক্ষে ৩০ শতাংশ নিশ্চিত ভাবে বহুমূল্য ধাতুর মোটা চাদরে ঢাকা। তার বুকে জমা হওয়া পাথরের মতো চাঁইগুলিও ধাতুতে ঠাসা। সে এক অনন্য পরিমন্ডল। নাসার মহাকাশযান পৌঁছলেই এ ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে আশাবাদী তাঁরা।
তবে এত দিন মহাকাশ অভিযান যেখানে অক্সিজেন কিংবা প্রাণের সন্ধানে এবং জীবনধারণের উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে বার করার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, সেখানে এই সম্পদ অভিযান নিয়ে আপত্তিও উঠতে শুরু করেছে। আর সত্যিই তো, পার্থিব সম্পদ আহরণের এই নেশা না বিজ্ঞান গবেষণাকে প্রভাবিত করে?
এই অভিযানের সঙ্গে যুক্ত নাসার অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানী তথা অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব আর্থ অ্যান্ড স্পেস এক্সপ্লোরেশনের অধ্যাপক লিন্ডি এলকিন্স ট্যান্টন নিজেই মহাকাশ থেকে এই সম্পদের ভাণ্ডারকে পৃথিবীতে আনার বিপক্ষে। তিনি বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এক্ষেত্রে বিপথগামী হচ্ছে।
লিন্ডির মতে, এখনও পর্যন্ত ১৬-সাইকি গ্রহাণুর মতো অত্যাশ্চর্যজনক দ্বিতীয় কিছু মেলেনি। কাজেই এ এক অনন্য খোঁজ। এই প্রথম ১৬-সাইকির অন্তঃস্থলে পৌঁছনোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। কাছাকাছি পৌঁছতে পারলেই গ্রহাণুটি সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে। তবে সেখান থেকে বহুমূল্য ধাতু নিয়ে আসা শুরু হলে বিশ্ব অর্থনীতিতে ধস নামবে।
ওই গ্রহাণু থেকে আহরিত সমস্ত ধাতুর মধ্যে শুধু লোহার মূল্যই হয়ত ১০ লক্ষ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। এতে পৃথিবীতে যে লোহা রয়েছে, তার আর কোনও মূল্য থাকবে না। সোনা, প্ল্যাটিনাম, তামাও মূল্যহীন হয়ে যাবে। যার অর্থ মূল্যবান ধাতু বলে আর কিছু থাকবে না। তবে এটা ঠিক সমস্ত মহাজগতের কথা বিবেচনায় আনলে হীরা, সোনা মূল্যহীনই বটে। তুলনামূলকভাবে উদ্ভিদ বা কাঠ মহাজগতের মধ্যে সবথেকে দামী বস্তু হিসেবে বিবেচিত হতেই পারে। কারণ নীলগ্রহ ছাড়া এরা আর কোথাও নেই। অথচ আমরা যেন এর ধ্বংসের জন্য বলিপ্রদত্ত।
তবে ক্যালটেকের গ্রহবিজ্ঞান এবং জোতির্বিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ক্যাথরিন দি ক্লিরের মতে, এমনও হতে পারে যে ধাতুগুলি সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ অবস্থায় নেই। গ্রহাণুর গোটা কলেবরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে মিশে রয়েছে। সে ক্ষেত্রে গ্রহের অন্তঃস্থল পরীক্ষার ক্ষেত্রেও নাসার সাইকি অভিযান যুগান্তকারী হয়ে দাঁড়াতে পারে।
মানুষের এখনই খুব বেশি আহ্লাদিত হবার প্রয়োজন নেই। কারণ একটা ২০০কিমি প্রশস্ত গ্রহাণুকে বাগে আনতে পারা সহজ নয় মোটেই।।