Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee » Page 9

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 17

কানে এল মেশোমশায়ের কথা। —— কেষ্টা,তোমার গাইড বই কি বলে? ——— ঋষিকোন্ডা শহর থেকে আট মাইল দূরে। এ পি টুরিজ্ম ঢেলে সাজিয়েছে। দারুণ সব কটেজ। পাহাড়ের ওপর কটেজ। সাঁতারের ব্যবস্থা ও আছে। পুনমী বিচ্ রিসর্ট। বত্রিশ টা রুম আছে, ,ভাড়া নয়শো পঞ্চাশ। মাসীমা বললেন—— এত ভাড়া?আমাদের টা তো অনেক সস্তা। খোলামেলা, মাত্র তিন শ টাকা। আমি অনেক দিন আগের দেখা ঋষিকোন্ডাকে মনে মনে জরীপ করছিলাম। সেই প্রাণ হীন নিরস একটা ছোট্ট বিচ্।হঠাৎই খেয়াল হল আমি একা দাঁড়িয়ে। মাসীমারা এগিয়ে গেছেন। মন্দাকিনী পিছু ফিরে আমাকে ডাকছে। ———— কৃষ্ণ দা,দাঁড়িয়ে কেন? ওর ডাকে এগুলাম। ওর দৃষ্টি আমার দিকে। বহুদিন পর আমার সেই ছাত্রীর কথা মনে হল।দু’ বিনুনী সামনে দুলছিল। সেদিনের ভয় আজ আর নেই। কারণ বেশ ক’ বছর পড়িয়ে বুঝেছিলাম আমার পড়াবার ক্ষমতা আছে।সেই যুবতী প্রেমে হাবুডুবু খাবার ভয়েই ওদের ঘর ছেড়ে ছিলাম। ঘর ছাড়তে মেশোমশায় আমায় ছাড়েন নি।ডক্টরেট করার পর মেশোমশায়ের কাছে আমার কদর টা বেড়েছিল । সেই সুবাদে সেই মেয়ের সাথে একটু আধটু দেখা। কেমন একটা টান বোধ হচ্ছে ঐ মেয়ের ওপর।ফিরে খারাপ লাগবে। সূর্যের আলো পড়ছে মন্দাকিনীর মুখে। লালের আভা ছড়িয়েছে মুখে। মাথার টুপি খানা খুলে ওর হাতে দিলাম। বললাম—– মাথায় দাও এটা। মন্দাকিনীর চোখে মুখে হাসি খেলে গেল। বলল—– দাও। টুপি মাথায় দিয়ে বলল—–এ দিকে তাকাও কৃষ্ণ দা। ওর কথায় ফিরে চাইলাম ওর দিকে। দুষ্টমীর হাসি ওর চোখে। বলল——- কেমন দেখাচ্ছে আমাকে? ওকে জব্দ করতে বললাম। ——– তুমি যেমন, তেমনই তো দেখাবে?টুপি কি হীরের, যে কালো কুৎসিতরা পড়লে ও সুন্দর দেখাবে? মন্দাকিনীর হাসি নিবে গেল। আমি বুঝলাম ঠিক ভাষা আমি ব্যবহার করিনি।ওর তো দোষ নেই। ওকে দূরে ঠেলতেই অমন ভাষা ব্যবহার করেছি।কারণ ওকে পাবার যোগ্যতা আমার এখনও হয়নি।তাই ওকে কথার বাণ মেরে দূরে ঠেলেছি।নিজেকে শক্ত রাখলেই তো হতো। এগিয়ে চলেছে সে।বুঝলাম কালো কুৎসিত কথাটা ওর মনে লেগেছে। সেটাকে মলম দিতেই পা চালালাম ওর দিকে। বললাম—— প্লিজ, রাগ করো না। দেখলাম টুপীটা হাতে রয়েছে।হাত থেকে নিয়ে আবার ওর মাথায় পড়িয়ে দিলাম। ওর চোখ আমার চোখে।আমি মুগ্ধ, তা বুঝতে ওর বাকি থাকার না। তবুও বললাম—— কেমন লাগছে জিজ্ঞেস করলে না?সেটা শুধুই তোমার হবু স্বামীর বলার অধিকার আছে। যার জন্য পুরীতে রাজবেশ দেখেছিলে। ভগবান যদি দিন দেন তবে নিশ্চয়ই তোমার প্রশ্নের জবাব দেব। এতক্ষণে মানিনীর মান ভাঙলো। চোখের হাসি ছড়িয়ে পড়ল সারা মুখে। গ্রীবা বাঁকিয়ে বলল। ———- অপেক্ষায় থাকলাম। তবে আমার হবু বর আসার আগেই উত্তর টা দিও।কালো কুৎসিত বলে হেলা করোনা যেন। ওর মুখের হাসি ধরেই আমি দিল খোলা হাসি হেসে উঠলাম। মুখে কালো কুৎসিত বললেও মন্দাকিনী ভাল করেই জানে ওকে দেখে আমার ভাল লাগার পারাটা কতোটা ওঠে।মনটা হালকা হল ওর কথায়। হাটতে হাটতে বিচ্ এ পৌঁছলাম। মেশোমশায় বললেন। ——— কি গো মায়া, এক কাপ চা খাবে নাকি? ——— মন্দ হতো না।কেষ্টা,আমাদের সঙ্গে যাবে নাকি?মন্দা যাবি না? ——– না ,মা। এখানেই ভাল লাগছে। তোমরা ঘুরে এস। দেরি করো না। মেশোমশায় ঝোলা ব্যাগ খানা তুলে নিলেন। আমি বালির ওপর বসে পড়লাম। মন্দাকিনী সাগর জলে পা ডুবিয়ে দাঁড়াল। আমি ঢেউয়ের সাদা ফেনা গুনতে লাগলাম। সত্যিই বিস্ময় জাগে!এমন সৌন্দর্য সৃষ্টি কারীকে জানতে ইচ্ছাতো হবেই!প্রকৃতির এমন রঙের খেলা যে খেলছে তাকে জানতে ইচ্ছাতো হবেই। প্রজাপতির নানা রঙের বাহার আর ফুলের বাহার একাকার হয়ে যায়। লাল কলাবতী ফুলের লাল মধু খেয়ে কি ঐ ছোট্ট লাল পাখীর লাল পালক? এখানেও সমুদ্রে নানা রঙের মেলা।যেখানে।সূর্যের আলো পড়েছে সেখানে সাগর জলে হীরের চমক ফেলছে। মেঘের ফাঁকের এক ফালি সূর্যের রশ্মি পড়ছে জলে। একফালি আলোর রশ্মি সমুদ্রে আলো আঁধারি খেলা খেলছে।ভাবতে ভাবতেই মনটা কোথায় চলে গিয়েছিল, তাই খেয়াল করিনি মন্দাকে। দেখতে পাচ্ছি না তো! চারদিকে চাইলাম। তখনই নজরে পড়ল। না সমুদ্রের কাছে নেই। মাসীমা মেশোমশায়ের সাথে ফিরছে। পরনে তার চুড়িদার। বুকের উড়নী উড়ছে হাওয়ায়। যাবার আগে আমাকে একবার বলে গেল না? মাসীমা বললেন—-কেষ্টা তুমি কি জলে নামবে? ——-‘ না মাসীমা।আপনারা যান। মেশোমশায় বললেন—-তোমার মাসীমাকে নিয়ে একটু জলে নামি।না হলে ভয় ভাঙবে না।আমি উঠলে তুমি নেমো। মেশোমশায়ের এক দিকে মাসীমা আর অন্য দিকে মন্দাকিনী।জলে নামতে গিয়ে মন্দাকিনী হঠাৎই আমার দিকে এগিয়ে এল।বুক থেকে উড়নী খুলে আমাকে এগিয়ে দিল। বলল—— এটা ধরো তো। জ্লে ভেসে যেতে পারে। মনে হল, ও যদি বিনা দ্বিধায় উড়নী বুক থেকে খুলে আমাকে দিতে পারে। আমার ই বা তা নিতে এতো দ্বিধা কেন?আমি তো জোর করে ওর আব্রু খসাইনি? উড়নী খানা হাতে নিতেই মন্দাকিনী চলে গেল। একবার ও মন্দাকিনীর চোখে একটু আগের দেখা সেই প্রেমের ঝলক দেখলাম না।তখুনি আমার মনে হল। মাসীমা আমায় আনতে রাজি হয়েছেন শুধুই তাঁর মেয়ের দেখভাল করতে।এই বিদেশে একজন জোয়ান মরদ দরকার বলে। যাতে মেয়ের কোন বিপদ না ঘটে। সে দিক দিয়ে শুধু উড়নী খানা রক্ষা করা তো ঐ মেয়ের আব্রু রক্ষা করাই হল। মাসীমা বেসামাল হলেও মন্দাকিনী বেসামাল নয়। মনে ভাবলাম হয়তো সেই পাজামার জন্য এটা হচ্ছে। শাড়ি হলে হয়ত পাল তোলা নৌকার মতো হয়ে মন্দাকিনীকে বেসামাল করে দিত। মাসীমা ও মেশোমশায়ের সঙ্গে দারুণ লাফিয়ে লাফিয়ে ঢেউ পার হচ্ছেন। মেশোমশায় জল থেকে উঠে পড়লেন। আমার কাছে এসে বললেন। ——–কেষ্টা, একটু জলে নেমে এসো। দারুণ লাগবে। প্যান্ট টা ছেড়ে যাও।আমি আছি। এক লহমায় সার্ট প্যান্ট ছেড়ে ফেললাম বালিতে। ছুটলাম জলে। জলে নেমে লজ্জা পেলাম। মেশোমশায় কি ভাবলেন আমার ব্যস্ততা দেখে। আমার ই ব্যস্ত হবার কি ছিল?হয়ত মন্দাকিনী জল থেকে উঠে আসার ভয়! আমাকে দেখে মাসীমা দারুণ খুশি হয়ে বলেন। ———— ওমা! তুমি তৈরি হয়ে এসেছিলে?ভাল করেছ।কি ঠান্ডা জল! কথাটা বলেই আমার অন্তর্বাসের দিকে তাকালেন। মাসীমা পড়েই যাচ্ছিলেন।শক্ত হাতে আমি ধরে ফেললাম। খুশির হাসি মাসীমার। হেসেই বলেন। ——– মন্দার সাহস টা দেখ। ওকে টেনে নিয়ে এস। আমি উঠছি। এগিয়ে গেলাম সেই সাহসী মেয়ের দিকে।শুধুমাত্র মাসীমার কথায় ?নাকি মনের টানে?দুটোই হবে। ছাড়পত্র না পেলে কি আমি মন্দাকিনীর দিকে জন সমক্ষে এগোতে পারতাম? পেছন থেকেই ওকে লক্ষ্য করছিলাম। ঢেউয়ের তালে তালে লাফাতে লাফাতে মন্দাকিনী আমায় দেখতে পেল। বলল——-তুমি এসে গেছ? ওর সাথে কথা বলতে বলতেই জলের মধ্যেই উপুর হয়ে শুয়ে পড়লাম। একেবারেই পাড়ের দিকে মুখ করে। যাতে কানে জল না ঢোকে। আমায় অমন করে শুতে দেখে মন্দাকিনী চেঁচিয়ে উঠল। ——- ——– এই কি করছ? বললাম———- পুরো শরীর টা ভিজিয়ে নিচ্ছি। বলতে বলতেই নীল স্বচ্ছ ঢেউ উত্তাল হয়ে আমায় ডুবিয়ে দিল। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই থাকার পর কে যেন আমার হাত ধরেছে।চোখ খুলে দেখলাম মন্দাকিনীকে। আমার ই ঢং এ আমার পাশে শুয়ে আছে।অমনি একটা ঢেউ এল। মাথা নিচু করে নিলাম। তখন ও তার হাত আমার হাতে।ছাড়িয়ে নিলাম হাত। বললাম——— ওটা কি হচ্ছিল? ——— কি আবার?তুমি যা করছিলে, তাই। ———- আমার হাত কেন ধরেছিলে? ——–‘ ভয়ে। যদি সমুদ্র টেনে নিয়ে যায়!হাত ধরা থাকলে এক সঙ্গে চলে যেতে পারব। তোমার যখন অপছন্দ তখন আর করব না। ——– মরার কথা না ভেবে বাঁচার কথা ভাব। এবার চল। জল ছেঁড়ে উঠতে ইচ্ছা করছে না।সমুদ্রের গর্জণে ঢাকা পড়ে গেল মন্দাকিনীর গলা।পাড়ে উঠে আমার লজ্জা করছে। মাসীমা আর মেশোমশায় এমন ভাবে আমার দিকে তাকান যে আমার মনে হল আমি দেহ প্রদর্শনী তে নেমেছি।মন্দাকিনীর চোখ পড়তেই পারে। কিন্তু মাসীমা আর মেশোমশায় কেন আমায় বার বার দেখছেন?তবে কি?——— ।অন্য কথা ভেবে আমার বুক ফুলে উঠল। আমার অস্বস্তি বুঝে বললেন। ———— চল,ঐ কুয়োর জলে আমরা হাত পা ধুয়ে নিই।একটা মেয়ে জল ঢেলে দিচ্ছে সকলকে। আমরাও হাত পা ধুয়ে পরিস্কার হয়ে নিই। তাই হল। আমরাও পরিস্কার হয়ে নিলাম। মেশোমশায় ও আমি পোশাক বদল করলাম। মাসীমা আর মন্দাকিনী চলেছে পোশাক বদল করতে। এতক্ষণে মাসীমার আজকের স্নানের আনন্দের কারণ টা বুঝলাম। এইজন্য ই মেশোমশায় মাসীমাকে নিয়েছিলেন। চায়ের কথা বললেও উদ্দেশ্য অন্য। মনে খুশি হলাম। শাড়ি পড়ে স্নানের আনন্দ পেতেন না।দু’পায়ের মাঝে শাড়ি ঢেউ এ পাল তোলা নৌকা হয়ে ঠেলে দিত। সেই কথা বুঝলাম। যারা রক্ষণশীল তারা সমুদ্র স্নানের আনন্দ নিতে পারে না।বেসামাল হয়ে পড়ত। চোখে পড়ল সমুদ্রে ভলিবল খেলার সুযোগ। হিল রিসর্ট এর থেকে খাঁড়া সিঁড়ি নেমে এসেছে সমুদ্র তটে। লাইফ সেভিং বোট আছে তবে যে সাংঘাতিক গভীর তাই সেভিং থেকে ডেড বডি সার্চিং এই বোট কাজে লাগে। মেশোমশায়ের ডাকে ফিরলাম। ———- চল এবার যাওয়া যাক। গাড়িতে বসা হল ঝিমুনি আসছে। গাড়ি চলল বিমুনিপত্তনম এর পথে। কারো মুখে কথা নেই।মন কথা বলছে। হবেই তো এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শুধু স্বর্গীয় মাত্রাই এনে দেয়।সাগরের জল পূর্ব ঘাট পর্বত মালার পদ চুম্বন করেছে।তাতে পড়েছে সূর্যের মিঠে আলো।মাখামাখি হয়ে গেছে সমুদ্র, পাহাড় আর ক্ষেতের শষ্য রাশি তে। হরিৎ সবুজ ই বলা যায়। একেবারে।কাঁচা সবুজের ঢাল মন কেঁড়ে নিচ্ছে। এই জায়গায় ঈশ্বরের বাস না হয়ে পারে না। বইয়ে দেখেছি ভারতের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত বিশাখাপত্তনম থেকে বিমুনিপত্তনম সৈকত। একদিকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে পূর্ব ঘাট পর্বত মালা।অন্য দিকে বঙ্গোপসাগররের ফেননীভ ,তরঙ্গমালা হাতছানি দিচ্ছে। যেন চতুর্দোলায় চড়ে চলেছি স্বর্গে।শুধুই আরাম। চোখ বুজে আসছে।সুন্দর মিষ্টি হাওয়া।মনে হল রথে চড়ে চলেছি।এটা কে!এ তো কুস্তিগীর। দু’হাত ঘোরাতে ঘোরাতে ছুটে আসছে আমার দিকে।ভয়ে আমি ওকে মাথা দিয়ে ঢিস মারার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।ছুঁতে পারছি না ওকে।নিশানা ফসকে আমি গোঁ গোঁ করছি।মনে হল আমি কেষ্টাচরণ নিতান্তই ষন্ড। একটা মানুষ হয়ে ওকে মারতে পারছি না।রাগে গোঁ গোঁ করছি।তখন মনে হল, আমি ষন্ড হয়ে যা পারছি না মানুষ হয়ে সে আমাকে ধরা শাড়ি করে ফেলল। গোঁগোঁ করে চোখ মেললাম। আমি বোঝার চেষ্টা করছি,আমি কোথায়? দেখলাম গাড়ি দাঁড়ান। ড্রাইভার আমাকে ধাক্কাচ্ছে। আমি ঠিক ই দেখেছি স্বপ্নে।তবে আমি কেষ্টাচরণ ষন্ড নই। ——— স্যার, বিমুনিপত্তনম আ গয়া। ——– ওরা কোথায়? হাত দিয়ে রেস্তোরা দেখাল।বুঝলাম, এখন ও ব্রেকফাস্ট হয়নি।ভাবতেই খিদে টা চাড় দিয়ে উঠল। এগুলাম রেস্তোরার দিকে।

বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 18

রেস্তোরার ভেতরে ঢুকে দেখলাম ওরা তখন ও বসেনি।ভাল বসার জায়গার সন্ধানে মাসীমা এদিক ওদিক চাইছিলেন। আমাকে দেখে মেশোমশায় বললেন। —— খুব ঘুমিয়ে পড়েছিলে!! বললাম——–হ্যাঁ। চান করে ঘুম এসে গেল। মেশোমশায় বললেন—— তোমার মাসীমা ও একচোট ঘুমিয়ে নিলেন। মাসীমা বললেন—– আহা!তুমি যেন ‘ডাউক’পাখির মতো বড় বড় চোখ মেলে বসেছিলে। —– আমি কখন ঘুমালাম?– বললেন মেশোমশায়। ——– বাবা,বলো না।তুমি ঘুমোতে ঘুমোতে কতবার যে মায়ের ঘাড়ে পড়েছ, তার ঠিক নেই। —-সেটা তোর মায়ের জন্য ই হয়েছে। এমন ঢুলতে শুরু করল যে আমার বুক ব্যথা হয়ে গেল। তায় মাথায় এক গোছা প্লাস্টিকের ফুল। ——– তাই তুমিও ঘুমোলে? – —– হ্যাঁ রে মা।কাঁহাতক সহ্য করা যায়?তাই ঠিক করলাম ওর গায়ে ঢুললেই ওর ঘুম বন্ধ হবে।বুঝলি কিছু? ——বুঝবো তো বটেই । কে কার গায়ে কতটা ঢুলেছে তা সব আমার ক্যামেরায় বন্দী।——-বলল মন্দাকিনী। ওর কথায় হাসি চাপতে পারলাম না।দম ফাটা হাসি আপনার থেকেই বেড়িয়ে এল।কিন্তু বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না সে হাসি।থেমে গেল মন্দাকিনীর ধমকে। ——— হাঃ হাঃ করে হাসছো কি করে?তুমিও বাদ যাও নি।তুমিতো ড্রাইভার এর কাঁধে, বুকে হামাগুড়ি দিচ্ছিলে।বেচারা,গাড়ি চালাবে না তোমাকে কাঁধ থেকে সরাবে?মাঝপথে দু দু বার গাড়ি থামিয়ে তোমাকে সরিয়েছে। মন্দাকিনীর কথা শেষ হবার আগেই আমার মনে হল সেই কুস্তিগীরের কথা।ঠিক ই দেখেছি।আমায় ঘুমাতে দেয়নি,তাই দেখলাম ও আমায় মারতে আসছে। ঘুমোতে না দেওয়া তো মারার ই সামিল। মনে মনে হাসলাম। বিশেষ করে নিজেকে ষন্ড ভেবেই হাসা! আমি মনে মনে হাসলেও মেশোমশায় দমফাটা হাসি হাসলেন। চারদিক চাইলাম। ভাবলাম, কি জানি ওরা কি মনে করে !সবার ঔৎসুক্য দেখলাম। মেশোমশায় হাত নাড়লেন ওদের উদ্দেশ্যে। বললেন—-যাক্,সবার যখন ঘুম হয়ে গেল তাহলে আর রেস্ট নেবার দরকার নেই। কি বল মা? হ্যাঁ। এবার শুধু জায়গা গুলো দেখা। মেশোমশায় বললেন—- তার মাঝেই খেয়ে নেব। খাওয়া সারা হতেই বেড়িয়ে পড়লাম বিমুনিপত্তনম এর উদ্দেশ্যে।গাড়িতে বসেই মেশোমশায় বললেন। শুরু করো কেষ্টা। আমি বললাম——-খৃঃ পূঃ দু’শো একষট্টির থেকে আছে এই বিমুনিপত্তনমের নাম ইতিহাসের পাতায়। মৌর্যের পতনের পর কলিঙ্গ এই বিমুনিপত্তনম দখল করে। বাব্বা, এত পুরোন?—-মন্দাকিনী বলল। আমি বলতে শুরু করলাম, একে একে হাত বদলের গল্প। আগে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীন, তারপর অশোকের সাম্রাজ্যের অধীন। ষোড়শ শতাব্দীতে, “কৃষ্ণ দেবরায়া” বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শাসক জয় করলেন এই শহর। তারপর গোলকোন্ডার শাসক কুতুব শাহ এই শহর কেড়ে নিল বিজয়নগরের শাসক গজপতির থেকে। মন্দাকিনী বলল——-তারপর কি ইংরেজ এল? বললাম—— না।বণিক সম্প্রদায়,ডাচ।আঠের শো একচল্লিশ এ ডাচ্,বিমুনিপত্তনম শাসন করেছে। মেশোমশায় বললেন——– এরপর ব্রিটিশ? বললাম ——– হ্যাঁ। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হয়ে শাসন ভার গ্রহণ করল বিমুনিপত্তনম বন্দরের। মন্দাকিনী বলল——-তখন বিশাখাপত্তনম ছিল না? -বললাম——-ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশাখাপত্তনম বন্দরের গুরুত্ব বেড়ে যায়।আর বিমুনিপত্তনম এর গুরুত্ব কমে গেল। মেশোমশায় বললেন——-এই সব কি বই থেকেই উদ্ধার করলে? ———-বটেই।তবে ইতিহাসের পাতা থেকে ও মিলিয়ে নিয়েছি।যেগুলো বইয়ের পাতায় নেই সে গুলো এক বৃদ্ধ ভদ্রলোকের কাছ থেকে। মেশোমশায় বললেন—–সে আবার কে ? ———- তিনি জনার্দন রাও। স্বাধীনতার আগে তিনি চিটাগাং এয়ারফোর্সে কাজ করতেন। ছেচল্লিশে আসেন নিজের দেশে,অর্থাৎ ভাইজ্যাগ এ।কাকার হার্ড ওয়ারের ব্যবসায় ঢুকে যান। সে সময়ে ভাইজ্যাগ এ কিছুই ছিল না।সবই আসত জাহাজে করে বিদেশ থেকেই। সেটা স্বাধীনতার আগের কথা। মন্দাকিনী বলল———- তাই নাকি? বললাম——হ্যাঁ।স্ক্রু পেরেক,যন্ত্র পাতি সবই আসতো নাকি বিদেশ থেকেই। এ পি টুরিজ্ম এর বইয়ে দেখেছিলাম দু’জন ইঞ্জিনিয়ার এর বুদ্ধিতে ই দু দু খানা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল ভাইজ্যাগ পোর্টের মুখে। একের ওপরে আর এক জাহাজ। মেশোমশায় বললেন——– কেন? বললাম—— ব্রিটিশ রা ভাইজ্যাগ এ পোর্ট করতে চেয়েছিল।কিন্তু বিশ্ব যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় নি।সেই আভ্যন্তরীণ পোর্ট কে উন্নত করার জন্য এইচ কার্ট রাইট রেইড সেই প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। ——– বাব্বা এত সব জানতাম না। ——– কিন্তু, কনস্ট্রাকশনের সময় দেখলেন যে বন্দরের মুখে যে ঢেউ তার উচ্চতা মাপা যাচ্ছে না। তখন ই ঠিক হল পুরোন দুটো জাহাজ কে ডুবিয়ে দিলে উঁচু ঢেউ জাহাজের দেওয়ালে বাধা পাবে।তখন উচ্চতা মাপা সহজ হবে। দেখতে দেখতেই গাড়ি পৌঁছলাম বিমুনিপত্তনম। নরসিংহ স্বামীর মন্দিরের পাশ দিয়ে ডাচ্ সিমেট্রি তে গিয়ে গাড়ি দাঁড়া করালো ড্রাইভার। ডাচ্ সিমেন্ট্রি তে মাসীমা আর মেশোমশায় গাড়ি থেকে নামলেন না।আমি ভাবলাম, আহা যারা একসময় বাস করেছিল তাদের পরিজন রা আজ কোথায়!তাদের স্বজন দের মরদেহ আজ অযত্নে, অবহেলিত ভাবে ভগ্ন কবরে পড়ে আছে! নিঃশব্দে গাড়িতে বসলাম। চার পাশের ঘর বাড়ির ডাচ্ নমুনা আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে আঠের শো একচল্লিশ অবধি ডাচ্ শাসিত বিমুনিপত্তনম কে। মেশোমশায়কে বললাম——আমাদের দেশের মধ্যে সব চেয়ে যে পুরনো যে সমস্ত মিউনিসিপ্যালিটি আছে, তার মধ্যে বিমনিপত্তনম দ্বিতীয় মিউনিসিপ্যাল টাউন। মেশোমশায় বললেন—— তাই নাকি?তা কবরে যারা রয়েছেন তাদের কথা কি বংশধর রা ভুলে গেছেন? বললাম——– তথ্য বলছে কবরে যারা আছেন তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কিছু সাহায্য বংশধর রা বিমুনি মিউনিসিপ্যাল কে করেন।তবুও যথাযথ দেখভাল করা হয় না। মেশোমশায় বললেন——- বুঝেছি, “নেপোয় মারে দই।” কথা বলত বলতে আমরা “ক্লক টাওয়ার” এ পৌঁছে গেলাম। বাজারের একেবারেই মধ্যিখানে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে এই ঘড়িঘর। বললাম—–মেশোমশায় এই ঘড়িঘর ডাচ্ দের তৈরি নয়। এটা ব্রিটিশ সরকারের তৈরি। মেশোমশায় বললেন——— যাবার আগে তাহলে ব্রিটিশ রা ভাল উপহার দিয়ে গেছে। কি বল কেষ্টা? কি আর বলব!সম্মতি জানালাম মাথা নেড়ে।উপহার তো বটেই। কারণ এই ঘড়ির যে ভেতরকার মেসিনপত্র তা পাঠিয়েছে নাম করা ব্রিটিশ ঘড়ির কারখানা।তখন মাইনে করা একজন লোক রাখা হয়েছিল শুধুই ঘড়ির ঘন্টা বাজবার জন্য।ঘড়ির স্টাইল গথিক । নজরে পড়ার মত ঘড়ি। তবে ঘড়ির বয়স বোঝা দায়।চারতলাটা সব চেয়ে ছোট। নিচ তলাটা সব থেকে বড়।চার দিকে আর্চ করা।ঘড়ির টাওয়ারের তিন তলায় ঘড়ি বসান হয়েছে। মেশোমশায় বললেন——নাও আর দেরী করোনা। তোমার মাসীমা আবার নরসিংহ স্বামীর মন্দিরে যাবেন। গাড়িতে বসলাম আমরা।সমুদ্রের দিকে গাড়ি চলল। কিছুটা যাবার পর ড্রাইভার বলল। ——–স্যার, এরামাটি ঢিব্বালু দেখেঙ্গে?চালা মাঞ্চিদি। বুঝলাম কোন মাটির ঢিবি হয়তো দেখাবে। সবাই দেখে। চালা মাঞ্চি মানে খুব ভাল। বললাম——দিখাও। বিচ রোড ধরে গাড়ি চলল।কিছুটা গিয়েই গাড়ি দাঁড়াল। গাড়ির থেকেই দেখলাম চমক প্রদ ব্যাপার। মনে হল মাটি কেটে চূড়োর মতো করে রেখেছে। বেশ কিছুটা গিয়ে ঐ রকম অনেক গুলো লালচে বালির চূড়ো রয়েছে। ঝুর ঝুর করে পড়ছে না। সমুদ্র তটে এমন লালচে বালি দেখবো, তা ভাবা যায় না । এবার আমরা নরসিংহ মন্দিরে চললাম। সমুদ্রের গায়ে নরসিংহ স্বামীর মন্দির।বেশ পবিত্র ভাব।এই অবেলায় ও ভক্তের অভাব নেই। ঐতিহাসিক দ্রষ্টব্যের সঙ্গে দেব দর্শনের ব্যবস্থা থাকলে ভালই। কারণ যার যেটায় মন টানে সে সেটায় মন দিতে পারে। মাসীমার জোরে মন্দিরে ঢুকতে হল। আসল কথা নরসিংহ স্বামীর হলুদ মাখা মুখ দেখার ইচ্ছা ছিল না।মনে মনে প্রণাম করলে যখন কাজ মিটে যায়,তখন ভেতরে ভীড় বাড়িয়ে কি লাভ?কিন্তু মাসীমার কথা না রাখলে নয়। কিন্তু নরসিংহ স্বামীর রূপ দেখার পর মন ভরে গেল। এ তো নারায়ণের রূপ। এক ভক্তের কাছে শুনলাম যে নরসিংহ তাঁর ভক্ত শিশু প্রহ্লাদের অনুরোধে নারায়ণের এই রূপ দেখিয়েছিলেন।শুধু তাঁকে নয় সমস্ত ভক্তদের । বিমুনিপত্তনম ফোর্টের ধংসাবশেষ দেখে তখন কার কথা মনে হচ্ছে।এরপর একে একে লাইট হাউজ, সেন্ট পিটারের চার্চ, অ্যাকুরিয়াম দেখিয়ে আবার বিমলি বিচ্ এ নিয়ে এল। বেশ কড়া সূর্যের তাপ। অনেকেই স্নানে রত।স্নানের নিরাপদ জায়গা মনে হল। আমি অতীতে ভাসমান। সে কালের বন্দরে একটা জাহাজ এসে ভিরল। ছবিটা আমার চোখে ভেসে উঠল। অতুলনীয় সৌন্দর্য। পাহাড়ের উপত্যকা দেখতে দেখতেই সমুদ্র কে উপলব্ধি করা। মেশোমশায়ের ডাকে চমক ভাঙলো। চলে এস কেষ্টা। গাড়ি ছুটল বৌদ্ধ হ্যারিটেজ এর দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14

2 thoughts on “বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী || Shipra Mukherjee”

  1. চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *