বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 13
সাবমেরিন এর সামনেই গাড়ি দাঁড়াল। বললাম—– বাইরের থেকেই দেখে নিন।একেবার সময় করে দেখে নেয়া যাবে। মন্দাকিনী বলল—-কৃষ্ণ দা,সাবমেরিন তো জলের নিচে থাকে। তাই না গো?তবে তো জানালা দরোজা থাকে না।তাই না গো? জাহাজের ভেতরে সব ব্যবস্থা আছে।শত্রুর আগমন বা আক্রমণ সম্বন্ধে জানার জন্য কাঁচের জানলা বসান থাকে।যাতে দূর থেকেই বোঝা যায়। মাসীমা বললেন—-জলের তলে থাকলে লোকজন উঠবে কি করে? দু তলার ওপরের অংশ জলের নিচে থাকে। বন্দর থেকে জাহাজের ওপর তলায় সিঁড়ি দিয়ে ওঠা যায়।জলের তলে এতো সুন্দর ব্যবস্থা,দেখে আশ্চর্য হয়েছিলাম। মেশোমশায় বললেন—-তুমি ডুবো জাহাজে কি চড়েছ? হ্যাঁ মেশোমশায়।ভেতরে ঢুকলে মনেই হয় না জলের তলে রয়েছি।লেফটেন্যান্ট পল, আমাদের জানাশোনা ছিলেন। তাই ভেতরে ঢুকতে পেরেছি। একটু নজর রাখলেই সমুদ্রে সাবমেরিন দেখতে পাওয়া যায়।দূর থেকে মনে হবে কালো রঙের একটা টুপী সমুদ্রে ভেসে চলেছে। তোমরা যখন এসেছিলে তখন কি এই ডুবোজাহাজ এখানে ছিল? না মেশোমশায়।আর একটা যুদ্ধ জাহাজ থাকলে নিশ্চয়ই চোখে পড়ত। ভারত পাক যুদ্ধে এই সাবমেরিন বিরাট অংশ নিয়েছিল। সাবমেরিন পার হতেই রাস্তা একটু একটু করে ডানে বাঁক নিল।তাতে সমুদ্র সৈকতের রূপ আরও স্পষ্ট। রাস্তা আসতে আসতে ঢালে নামছে। মনে পড়ছে পুরণো দিনের কথা।বাবা মায়ের সঙ্গে আমি।সাল টা বোধ হয় তিরাশি। রাত আটটায় নিঝুম সমুদ্র তট। সরু রাস্তা তখন।এখন কার রাস্তার সাথে তার তুলনা মেলা ভার। মার্চ মাসের সন্ধ্যা এত নির্জন হতে পারে ঐ বিচ তাভাবতেই পারেননি। তাই মা ফেরার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি বায়না শুরু করেছিলাম সমুদ্র স্নানের জন্য। কিন্তু শেষ অবধি বাবা মায়ের কথাই শুনেছিলাম। এবার আসার থেকেই বার বার বাবা মায়ের কথা মনে হচ্ছে।পুরনো কথা মনটাকে নাড়া দিচ্ছে।মনের অতলে সেই রেস্টুরেন্ট আঁতিপাতি করে খুঁজেছি। যার সামনে অনেক টা ফাঁকা জায়গা।সেখানেই আজকের ‘সুখ সাগর ‘রেস্টুরেন্ট দাঁড়িয়ে আছে। খুঁজে পাব কি করে মা বাবাকে?তারা তো ধরা ধাম ছেড়ে অন্যধামে জিতেন্দ্রিয় হয়েছেন। চমক ভাঙলো আমার মন্দাকিনীর ডাকে। ——-কৃষ্ণদা, দেখ। তাকালাম ওর নজর অনুসরণ করে।বললাম—– —ওটা ভারত পাক যুদ্ধের জয় স্তম্ভ।একাত্তরের নৌ সেনার জয়ের স্মারক স্তম্ভ। সাবমেরিন এর উল্টো দিকে। পথে পড়ল জেলেদের মডেল নৌকো। মেছোয়ালিরা নৌকা নিয়ে দাঁড়িয়ে। বললাম—–এরপর দেখবে মৎসকন্যার মডেল। এদের ভাস্কর্যের নমূনা দেখার মত। শহর সাজাতেই এ সবের ব্যবহার। কথা বলতে বলতেই মৎসদর্শিনীর কাছে গাড়ি দাঁড়াল। ড্রাইভার বলল——ইঁহা উৎরেঙ্গে? মাসীমা বললেন——না বাবা আর নাচানাচি করব না।চল এবার। মন্দাকিনী বলল——-কেন?বিচ এ একটুও যাব না?বাবা তুমিও যাবে না?এটা তো রামকৃষ্ণ বিচ। আমি আর তোর মা বসছি।তুই আর কেষ্টা বরং ঘুরে আয়। মাসীমা বুঝি ভয় পেলেন আমার সাথে মন্দাকিনীর যাবার কথায়।তাই বললেন। ‘ঠিক আছে চল, আমিও যাচ্ছি। মেশোমশায় জোর দিয়েই বললেন——তোমার যাবার দরকার নেই। ভয় নেই কেষ্টাতো আছে। অতএব আমাকে মন্দাকিনীর পিছু নিতে হল। রামকৃষ্ণ বিচ উপভোগ করার মত জায়গা।প্রায় সরল রেখায় সমুদ্র তট চলে গেছে।যতদূর চোখ যায় তটরেখা। ডানে নজর ফেরালে সমুদ্রের সাথে মিলে গেছে পাহাড়।বুঝলাম, ওটাই ডলফিন নোজ। যার আকৃতি ডলফিন এর মতো।ইতিহাস বলে ওটাই “ব্ল্যাক মোর’স হিল”।ওটাই লাইট হাউজ। রাতে লাইট জ্বালিয়ে জাহাজ কে পথ নির্দেশ করে। আমার দিকে না তাকিয়ে ই মন্দাকিনী ছুটছে সমুদ্র মুখী।ঐ মেয়ের ঘটে যে সরেস বুদ্ধি তা আমার জানতে বাকি নেই। ওকে জব্দ করতে আমার মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। ঐ মেয়ে ভেবেছে আমি ওকে অনুসরন করব। আমি ওর থেকে অনেক টা দূরে এগিয়ে গেলাম সমুদ্র মুখী। নজর রাখলাম ওর দিকে। সমুদ্রের জলে হাত দিয়ে ফিরে দেখল আমি পিছনে নেই।আমায় পেছনে না দেখে বিষম চটেছে বুঝলাম। রাগেই সে ছুটল গাড়ি মুখী।আমিও ফিরলাম। ঐ মেয়ের মনের কি চলছে তা আমি জানি।তাই মলম দিতে বললাম——-কি গো এত তাড়াতাড়ি চলে এলে? ঝাঁঝের সাথে বলল——সমুদ্রের জল ছুঁতে ইচ্ছা হল তাই ছুঁয়ে চলে এলাম। তাতো বুঝলাম। কিন্তু তাতে এত রাগের কারণ তো দেখিনা! আমার কথায় সেই মেয়ের দৃষ্টি ফিরল আমার দিকে। তার নজর যেন আমায় ভস্ম করে দেবে। বুঝলাম ঝড়ের সংকেত! তার পর ই বলল মনের কথা। \ সে বুদ্ধি যদি তোমার থাকত তাহলে তো ঝামেলাই থাকত না। আমার না হয় নেই। তোমার তো আছে? তোমার সেই বুদ্ধি খাটাও না কেন?তবে বুঝবে কেন তোমার পাশে দাঁড়াইনি। চমকে ফিরল প্রেয়সী আমার। এখন আর ঝাঁঝ নেই। এ দৃষ্টি মনমুগ্ধকর ।আমি দুষ্টমী করেই বললাম। তুমি বাবা মায়ের কাছে ভাল সাজবে। তাই এগিয়ে গেলে অনেক টা।তখন আমি কেন খারাপ হই তোমার পাশে দাঁড়িয়ে?তোমার মায়ের একটা ভয় আমি বুঝি তাদের মেয়েকে আত্মসাৎ করবো। মন্দাকিনীর চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। দীপ্তি ছড়িয়ে পড়ল ঢেউ এর তালে তালে একেবারে সাগরে। সে বলল——-আমি ভাল না সাজলে তুমিও সাজতে না। নিশ্চয়ই। এমন একজন সুন্দরীর পাশে যে কেউ দাঁড়াতে চাইবে। আমি তো কোন ছাড়? খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়ল চার দিকে। সমুদ্রের গর্জণ কে ছাপিয়ে উঠল মন্দাকিনীর হাস্যকলধ্বনি। আমি চমকে তাকালাম ওর দিকে। সমুদ্রের পাশে এমন হাসিই মানায়।কিন্তু পরমুহূর্তে শঙ্কিত আমি। কারণ গাড়িতে বসে মাসীমা সব দেখছেন। অমন একখানা মেয়ের পাশে কি নিডর হয়ে থাকা যায়? তাই বালি ঠেঙাতে চড়াই উৎরাই করতে লাগলাম আনন্দে। গাড়িতে উঠেই বুঝলাম এখানের হাওয়া আরো গরম। বালিতে পা না দিয়ে ও মাসীমা তেতে আছেন। মাসীমার কথার আঁচ কিন্তু আমার গায়েই পড়ল। মেয়ের দিকে ফিরে বললেন——-হাঃ হাঃ করে হাসছিলি কেন?চলা ফেরা করতে জান না?বয়স তো কম হয়নি।বিয়ে দিলে এতদিনের মধ্যে চারটে বাচ্চা হয়ে যেত। আমি নড়ে চড়ে বসলাম। সর্বনাশ!চারটে!ভয়ে কারো দিকে ফিরলাম না।কিন্তু তাতেও ছাড় পেলাম না। ঝাঁঝ টা আরও বেড়ে গেল। এবার আমার দিকে ফিরলেন। – আর তোমাকে ও বলিহারি বাবা। তুমি মাস্টার মাস্টারের মত থাক। তা না ফচকে ছোড়ার মত ওর তালে তালে চলছ। আঃ!কি হচ্ছে মায়া?কাকে কি বলছো? মাস্টার কেন বলছ?ওকি এখন মন্দাকে পড়ায়? আর কেষ্টা একজন নামী দামি লেখক।বুঝলে গিন্নি একটু সমঝে কথা বলো। জোঁকের মুখে নুন পড়ার মত মিয়িয়ে গেলেন মাসীমা।বললেন——আহা!আমি কি ওকে মন্দ কিছু বলেছি?হ্যাঁ বাবা কেষ্টা,তোমাকে খারাপ কিছু বলেছি? না মাসীমা।ঠিকই বলেছেন। তাছাড়া আর কি বলব?একদিকে মাসীমার কথা সত্য। মন্দাকিনীর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাতে অভ্যস্ত। অন্য দিকে আবার মাসীমার অসত্য কথন” ফোচকে ছোড়া ” আমি কোন দিন ও ছিলাম না।এখন ও নই। তখন ও নই।তা যদি হতাম তবে মাসীমার কথা মত মন্দাকিনীকে বিয়ে দিলে যা এতদিনে হত।তা বিয়ে না দিয়েও হয়ে যেত।আর সেটা হবার ভয়েই আমি কেটে পড়েছিলাম। সে দোষ অবশ্য মন্দাকিনীর নয়। আমার সুন্দর দেহ ও মুখশ্রী ই দায়ি হত তার জন্য। বেশ শক্ত হয়েই বসেছিলাম। সমুদ্র মুখী হয়ে।দূরের টহল দারী জাহাজ আর ছোট ছোট ডিঙিগুলো ভেসে চলেছে।সাগরের রং এখন গাঢ় নীল। ঠিক ভাঙ্গা কাঁচের সবজে নীল রং। তটরেখায় সাদা ফুলের গোরের মালার মত ঢেউ এর খেলা চলছে। গেস্ট হাউজ পৌঁছে মাসীমা বললেন–বাব্বা! এর থেকে গেস্ট হাউজ এ ব্যালকনি তে বসে সমুদ্র দেখাই ভাল। মেশোমশায় বললেন——ঠিক বলেছ। ।।এর থেকে বাড়ির টি ভি তে ভাইজ্যাগ এর সমুদ্র দেখলে হত। মাসীমা আমায় সালিশি মেনে বললেন—— দেখেছ কেষ্টা।তোমার মেশোমশায় সুযোগ পেলেই আমাকে ছোবল মারেন। মেশোমশায় বললেন——ছিঃ ছিঃ কি যে বল।আমি কি সাপ যে ছোবল মারবো?আমাদের মধ্যে ওকে টেনে কি লাভ?আমরাই মিটিয়ে নেবো। মন্দাকিনীর বলল-বাবা,কাল থেকে তুমিও মা যেওনা। কৃষ্ণ দা আর আমি——– মন্দাকিনীর কথা শেষ হতে পেল না।মাসীমা বলে উঠলেন——-তোমায় আর ধিঙ্গী পনা করতে হবে ন। মেশোমশায় হাসতে হাসতেই বললেন—– —-মন্দা, মাকে রাগাস না।মায়ের শরীর খারাপ হলে আরকু যাওয়া হবে না।তাই বলে মনে করো না তোমাকে কেষ্টার সাথে ছেড়ে দেব। আমার ঘরে ঢুকলাম।
বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 14
আমার ঘরে ঢুকলাম। পাশাপাশি দুটো ঘর। সামনে বিরাট বারান্দা । দু ঘরের একই বারান্দা।বাইরের পোশাক না ছেড়েই বারান্দায় গিয়ে বসলাম। সামনেই উন্মুক্ত সাগর। একটু আগে মাসীমার বলা কথাটা মনে হল।আমার ও মাসীমার ধারে কাছের মত। পাশের ঘরের দরজার শব্দ শুনে মনে হল ও ঘরের বাতাবরণ ঠিক নেই। পিছু ফিরতেই মাসীমাকে দেখি। তবে তাঁর মুখ দেখে মনে হল আমার ধারণাটা ভুল। মাসীমার চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ থাকলেও বিরক্তির ছাপ নেই মুখে। উঠে দাঁড়ালাম আমি। মাসীমা চেয়ার এ বসে বললেন—তুমি দাঁড়ালে কেন?বস । বলে পাশের চেয়ার টা দেখালেন। আকাশ এখন মেঘলা। সমুদ্র আর আকাশ একাকার। দূরের জাহাজ ও পাহাড় ঝাপসা লাগছে। ভাবনা চটকে গেল মেশোমশায়ের গলা শুনে। ও কেষ্টা,ওটা কি হচ্ছে? মেশোমশায়ের দৃষ্টি অনুসরন করে দেখলাম একটা জাহাজ পাইপ দিয়ে ময়লা জল ছাড়ছে সমুদ্রে। হাওয়ায় অর্ধচক্রাকারে সেই জল সমুদ্রে পড়ছে।মনে হল সমুদ্রের জল দূষিত হচ্ছে। যারা সমুদ্র স্নানে রত তাদের কথা মনে হল। এখানে স্নান একেবারেই অনুচিত। মাসীমা বললেন—–এ মা!তেল কালি শুদ্ধু জল ফেলছে। আমি বললাম——খনিজ তেলের সন্ধান চালাচ্ছে। ড্রেইজিং চালাচ্ছে। মন্দাকিনী বলল——–জায়গাটা কিন্তু দারুণ! বললাম——- হ্যাঁ। খৃঃ পূঃ ২৬০ এ এই মেছোয়ালিদের ছোট্ট গ্রাম জুড়ে গেল কলিঙ্গে। তারপর হাত বদল। পনের শতাব্দীতে বিজয়নগর সাম্রাজ্যে অন্তর্ভুক্তি হল। তারপর একটা বিশাল বন্দর নগরে রূপায়িত হল। মেশোমশায় বললেন, আমাদের দেশের সব চেয়ে বৃহত্তর জাহাজ তৈরির ক্ষেত্র তো থিপাখাপত্তনম?তাই না? মাসীমা বললেন——-বিশাখা নামটা কি সুন্দর! বললাম——-বিশাখা কিন্তু মেয়ের নাম না। বিশাখা অর্থাৎ বৈশাখ। যা আদতে সুব্রম্মন্য স্বামীর মন্দির। শৌর্য বীর্যের প্রতিক এই দেবতা।তার থেকেই এ জায়গার নাম। মন্দাকিনী বলল——মন্দির কোথায়?দেখলাম না তো? কি করে দেখবে?তাতো সমুদ্রে বিলীন। যেখানে লওসন’স বে সেখানেই বিশাখার প্যাগোডা ছিল। মেশোমশায় বললেন—-তারপর? অন্ধ্র রা তখন রাজামুন্ড্রি তে রাজত্ব করছিল। সেই বংশের কেউ ভিজাগাপট্টনম এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে প্যাগোডা তৈরি করেন। কারণ ওদের প্রিয় দেবতা ছিল বৈশাখা।সে জায়গার নাম হয়েছিল ‘তীর্থ পুরালু’।এখন ও বিশাখা উৎসবে স্নান করে পুন্যার্থীরা। এক নাগারে বলে লজ্জা পেলাম। কি জানি ওদের ভাল লাগছে কিনা! মেশোমশায় বললেন, কি হল, থামলে কেন? কলকাতায় এসব শোণার সময় কোথায়? মন্দাকিনী বলল — বিমুনিপত্তনম ও তো বন্দর,তাই না ? বললাম—— হ্যাঁ। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর কলিঙ্গ যুদ্ধে এই বিমুনিপত্তনম সম্রাট অশোকের দখলে যায় এই বন্দর নগর। বিশাখাপত্তনম বন্দরের আগে ১৯৩১ সাল অবধি বিমুনিপত্তনম ছিল ব্যস্ত বন্দর।ব্রিটিশ শিপিং আমদানি রপ্তানি করত ওখান থেকেই। মন্দা বলল——আমার মনে হয় বিশাখাপত্তনমের সৌন্দর্যের জন্য ওরা ভাইজ্যাগ কে পোর্ট হিসাবে পছন্দ করেছে। দরজায় নক হতে তাকালাম সে দিকে। মুখুজ্জ্যে মশায় ভেতরে ঢুকলেন। ভাবলাম সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় ঠিকই লিখেছেন,” বিদেশে বাঙালি মাত্র ই সজ্জন”। কলকাতায় এঁর সঙ্গে দেখা হয়তো হবে না।আর হলেও অমায়িকতার অভাব হওয়াই স্বাভাবিক। আমায় চুপ করে থাকতে দেখে মাসীমাই উত্তর দিলেন। হ্যাঁ। কিছু দেখা হল। আবার কাল হবে।আপনাদের হল? কেবল” বোদ্ধিস্ট হেরিটেজ ” বাকি। বললাম, থোটলা কোন্ডা, ব্যভি কোন্ডা, শঙ্করম, পভুরালা কোন্ডা আর শালিহুন্ডম হল বুদ্ধিস্ট হেরিটেজ। এরা শাক্য মুনি, গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি আকড়ে শান্তিতে রয়েছে।ইস এটাই দেখলেন না? মুখুজ্জ্যে মশাই বললেন, কি আর করি!বৌদ্ধ মঠ দেখার ইচ্ছা নেই গিন্নীর। অগত্যা আমার ইচ্ছার ও জলাঞ্জলি দিতে হল। কথায় কথায় বললাম-সবই। ভু ডা অফিসে গিয়েছিলাম। অনেক তথ্য পেলাম। ওখানকার পি আর ও প্রভাকর রেড্ডীকে ভাল লেগেছে। আমাকে তথ্য দিয়েছেন বলে নয়। ওর ঐ আই কার্ড খানা দেখার পর ওর ওপর ভাল লাগার পারা টা উঠেছিল অনেক। আমি কেষ্টাচরণ এম এড করার পর ডক্টরেট করে গর্ব বোধ করি।আর রেড্ডী এম এ ।এম এড, এম ফিল করেছে জার্নালিজম এ। মাস কমিউনিকেশন এ করেছেন ডক্টরেট। শিক্ষার দরোজা পেরিয়ে তবে উদার হয়েছেন। কথা বলতে বলতে নজর গেল মন্দাকিনীর দিকে। তার চোখের তারায় ঝাঁঝ। সে বলল—–কই বলিনি তো? তোমরা ঘুমাচ্ছিলে ,তাই ডাকিনি। মেশোমশায় বললেন—— কেষ্টা কাজে গেছে। তোর সেখানে কি দরকার? মন্দাকিনীর থেকে বাঁচার জন্য ঘরে ঢুকে গেলাম। কিন্তু ঢোকা হল না। কি গো মশায় , পালাচ্ছ যে বড়!এবার থেকে যেখানেই যাবে আমাকে নিয়ে যাবে। মনে ভাবলাম, তাই তো চাই। কিন্তু পাই কই?তোমার মা এখুনি দিলে তো আমি এখুনি রাজি। মন্দাকিনী বলল —- চুপচাপ কেন? বললাম, তোমার সাহস তো কম নয়। কথাটা নিচু গলায় বলি। দেখলাম মেশোমশায় ও মাসীমা ঘরে ঢুকে গেছেন। তাই মেয়ের অত বুকের পাটা।উত্তর দিতে কার্পণ্য করিনি। তোমাকে নিয়ে গিয়ে বিপদে পড়ি আরকি! যা একখানা কান্ড করলে সিমহাচলমে। মনে ভাবলাম, এবার বাগে পেয়েছি। আমার ঐ কথায় তার মুখ খানা হল নিপাট ভাল মানুষের মত। আমি কি মজা দেখাব! সেই ভাবে ই বলল, সে কি গো কৃষ্ণ দা!আমি না তুমি! একে একে বলি সব? তুমি আবার কি বলবে? এক ,আমার পা ধরে বসে রইলে।দুই, অন্য মেয়েদের দলের পিছন পিছন চললে।মা কে বলি? ও মেয়ে যে কি ধুরন্ধর তা বুঝেও আমার কিছুই করার নেই। তাতেই হেসে ফেললাম। বললাম, এরপরের বার আমায় যেন না ডাকেন তা মাসীমাকে বলে দেব। আমি জানি এতেই ঐ মেয়ে জব্দ হবে। হল ও তাই। ভাঙে তবুও মচকায় না। আহা,আমি যেন তা বলেছি?তবে তোমার ভাল না লাগে তাহলে অন্য কথা। এবারের সুর অন্য রকম। একেবারেই ধার নেই। মোম গলা সুর ঝড়ে পড়ছে।তরঙ্গ তুলছে সে সুর আমার শরীরে।সেই সুরধনী কে কি না ভাল লেগে পারে?আমি তো তুচ্ছ এক পুরুষ। স্বর্গের দেবতা ও হেলা করতে পারত না এই সুর স্রষ্টা কে। নাম সার্থক তোমার মন্দাকিনী। মনে একটা কথা চলকে উঠল-“-তুমি ছাড়া আমি হই অপূর্ণ “।সে কথা বলা যাবে না।তাই অন্য কথা বলি। কিন্তু বলা হল না।সে নেই।তবে কি আশাহত হয়ে ফিরে গেছে। ভাল লাগল না ঘরে তাই বারান্দায় দাঁড়ালাম। সমুদ্র মুখী দাঁড়ালাম। একটা স্পীড বোট আসছে সাঁ সাঁ করে। কয়েক টা পাল তোলা নৌকা ভেসে চলেছে। ডিঙী মত দেখা যাচ্ছে। দু’ খানা পাটাতন জুড়ে হয়েছে ঐ মাছ ধরার জলযান। ছ’জনের মধ্যে দু,জন দাঁড় টানছে। আর চারজন দাঁড়ানো।অসীম সাহস! নইলে উত্তাল সমুদ্রে নামতে পারে!ওটাই ওদের জীবিকা। মাছ না ধরলে চলবে কি করে ওদের? তবে ওরা বলে যে মাঝ সাগরে ঢেউ উত্তাল নয়। নৌকা সমান ভাবেই চলে। আমার দরজার বেস্টনেই দাঁড়িয়েছিলাম।পাশের ঘরের দরজায় খুট করে শব্দ হল। নীল আঁচল উড়ে এলো বাইরে।এক ঝলক দেখলাম তাকে। আর কিছুই হল না।বরং উড়ন্ত আঁচল ভেতরে টেনে নিল। আমার সভ্যতা ভব্যতার আড়ালটুকু খসতে দিলাম না। মেশোমশায় বাইরে এলেন। বললেন——-কি গো একটুও ঘুমালে না? এত হাওয়া বাইরে ,ভাল লাগছে। খুব পুরোন শহর এটা। মেশোমশায় বললেন—– নাম টা ও সুন্দর। বললাম——হ্যাঁ পড়েছিলাম, দু,হাজার বছর আগে এখানে বিশাখা নামে এক বৌদ্ধ রাজ কুমারী ছিলেন। কেউ কেউ বলেন ওর নামেই এই জায়গার নাম। একাদশ শতাব্দীতে এই শহর কে জানা যায়। তাই নাকি? হ্যাঁ।চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কোল তুঙ্গা চোলা নামে অন্ধ্র রাজ বংশের রাজা কিছু সময় এখানেই ছিলেন। তিনি একটা মন্দির তৈরি করেন। তাঁর আরাধ্য দেবতা বৈশাখার নামেই। মেশোমশায় বললেন —-ঠিক বেঠিকের দন্দ্বে যেওনা। আমাদের আম নিয়ে কারবার। গাছের খবর নিয়ে লাভ নেই। মন্দাকিনীর বলল——-ওড়িষ্যার মহানদী থেকে গোদাবরী অবধি বৌদ্ধ শাসকদের অধীন ছিল। তাই না? বললাম—— হ্যাঁ। শঙ্করমের ধংসাবশেষ দেখলে বোঝা যায় যে এত বিশাল কর্ম কান্ডের পেছনে রাজ রাজরার শক্ত হাত না থেকে যায় না। মেশোমশায় বললেন, তারপর-? সম্রাট অশোকের সঙ্গে কলিঙ্গ যুক্ত হওয়ার পর ই হয়তো এতো বাড় বাড়ন্ত হয়েছিল। মন্দাকিনী বলল—–গোলকুন্ডার কুতুব শাহী তো পনের শো আটষট্টি,তাই না? বললাম , যাক্ মনে আছে তাহলে!এরপর ? ষোলোশো বিরাশিতে ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে কোম্পানির যুদ্ধ। বিপদ বুঝে কোম্পানি ঔরঙ্গজেবের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করল। থামলে কেন? মেশোমশায়ের কথায় বুঝলাম আমি শুধুই বকবক করিনি।উপভোগ্য আলোচনা।ভালই লাগছে সবার। বললাম—– সতেরোশো তেপ্পান্ন তে ফরাসিরা অধিকার করল ‘সরকার ‘।সতেরোশো ছাপ্পান্ন তে ব্রিটিশ ফ্যাক্টরি দখল করল “বুশি “(BUS
SY) এবং স্বশরীরে এসে পৌঁছল ভিশাখাপট্টনম। সতেরো শো সাতান্ন সালের চব্বিশে জুন। ।একা নয়।সঙ্গে এক বিশাল সৈন্য দল। মন্দাকিনী বলল, মারাঠা ‘প্যানিক’ কি তখন শুরু হয়েছে? বললাম——–হ্যাঁ। ভারত সরকারের চিফ তখন আনন্দ রাজ। এই আনন্দ রাজ ই ফরাসীদের সরকার গড়তে সাহায্য করেছিলেন। মেশোমশায় বললেন, তাজ্জব কি বাত!! বললাম, হ্যাঁ। পরে বুঝতে পারেন যে ফরাসীরা তার প্রতি এতটুকু ও কৃতার্থ নয়।তখন তিনি ইংরেজ দের স্ব স্ব পদাধিকারে বহাল করেন। মেশোমশায় বললেন, আনন্দ রাজ কে ছিলেন? বললাম—– ভারতের মহা শক্তিমান প্রধান ছিলেন। তাই তো ফরাসী আধিপত্য ফিরিয়ে নিতে পেরেছেন। ইংরেজদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। যেটা ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে দুঃস্বপ্ন মনে হয়েছিল। মন্দাকিনী বলল—-আজ কি শুধুই ইতিহাস শুনব? কোথাও বেরোবে না? মাসীমা বললেন ধারে কাছের মন্দিরে গেলে হয়। বললাম——চৈতন্য দেবের মঠ ।পাশে কৃষ্ণ মন্দির। হরিনাম সংকীর্তন হয় জিলা পরিষদের কাছে। পাচ শো বছরের পুরনো মন্দির, যেটা জয় পুরের রাজার মেয়ে তার বাবার স্মৃতির উদ্দেশ্যেই জমি দান করেন। মাসীমা বললেন——আরও পুরনো মন্দির ? বললাম———দু, শো বছরের পুরনো মন্দির যা সমুদ্রে বিলীন হয়ে গেছে।লর্ড কার্তিকেয় বা বিশাখার মন্দির ছিল বিচ রোডে। মাসীমা বললেন——-কাছে কোন মন্দির? বললাম——- আর কে বিচ এ কালি মন্দির। পান্ডুরঙ্গা পুরমে “পান্ডুরঙ্গার” মন্দির। মেশোমশায় বললেন—চলো মায়া, ,অনেক মন্দির আছে। মাসীমা বললেন—— ওরা বাপ বেটি টিটকারি দিচ্ছে দিক। কেষ্টা চল তুমি আমি যাই। মন্দাকিনী বলল—– আমি কখন হাসলাম। আমিও যাব। মেশোমশায় বললেন—— সে কি মায়া?আমায় ছাড়া তুমি মন্দির এ যাবে?ঠাকুর দেবতা নিয়ে রসিকতা! কখন ও নয়। তৈরি হতে সূর্য ডুবে গেল। গেট এর কাছে যেতেই একটা অটো এসে দাঁড়াল।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!