বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 9
কেষ্টাচরণ, বি অনেষ্ট বলেই মন্দাকিনীকে পড়াতে শুরু করেছে। ইংরাজী পড়াবাবার কথা হলেও কেষ্টার খারাপ লাগল ছাত্রীর অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞানের ঘাটতির কথা ভেবে।শুরু হয়ে গেল অন্য বিষয় নিয়ে টানাটানি। কারণ প্রথম দিকে কেষ্টা নিজের কর্ম ক্ষমতায় সন্দিহান হলেও পরে আশ্চর্য হয়েছিল নিজের করিৎ-কর্মতার উপর।আশ্চর্য হবে নাই বা কেন?যে মেয়ের পরীক্ষার ফলাফল তাক লাগিয়ে দেবার মত হয়ে যায়।কেষ্টার কাছে পড়ার পর। কদর তো বাড়বেই কেষ্টার। কিছুদিন পর ছাত্রীর বেহাল অবস্থা।কথায় কথায় “কেষ্টার কাছে জিজ্ঞাসা কর “শুনতে হয় মায়ের কাছে।আগে যদিও পড়া না বুঝতে পারলে মাস্টার মশায় গাট্টা মারেন বলা যেত। এখন সে উপায় নেই। গাট্টা তো মারতে হতো।তবে তর্জনীতে পেন এর ঢাকনা ঢুকিয়ে তা দিয়েই মন্দার মাথায় মারতো কেষ্টা।মারবে নাই বা কেন?অমন নিরেট মাথা কারো দেখেনি কেষ্টা।আগে অমনটা ছিল না মন্দা।বোঝালে বুঝে ফেলত সব বিষয়।কিন্তু ফাইনালের পর মন্দার ভাবগতিক গেল পাল্টে। কোথা থেকে রাজ্যের লজ্জা এসে জড়ো হল মন্দার শরীরে।পড়বে কি করে! কেষ্টার মুখের দিকে তাকাতে ঘেমে নেয়ে একাকার। মন্দার পড়া উঠল মাথায়। মন্দা কলেজে ভর্তি হলেও কেষ্টার বুকে দামামা বাজতে শুরু হল। আর বুঝি কবি হওয়া গেল না।এই ভয়ে কেষ্টার নাওয়া, খাওয়া মাথায় উঠল। কারণ মন্দার পরীক্ষার ফল খারাপ হলে বদনাম হবে কেষ্টার। ফলে এ বাড়ি ছাড়তে হবে। সেই বদনাম নিতে নারাজ কেষ্টাচরণ। তাই ঠিক করে ফেলল এই বাড়ি ছেড়ে দেবে। বলে ফেলল মন্দাকে। পড়াশোনা করছো না কেন?পরীক্ষার ফল খারাপ হলে আমি কিন্তু তোমাকে পড়াব না। না পড়ালে না পড়াবে। মাস্টারের কি অভাব আছে?তাছাড়া তোমার কাছে পড়তে ও আমার ভালো লাগে না।তোমাকে মাস্টারমশায় ভাবতেও ভাল লাগেনা। কেষ্টা আশ্চর্য হয়েছিল ওর কথায়। তবে ওর বলা কথার সঙ্গে গালে লালের আভায় সাবধান হবার কথাও ভেবে নিয়েছিল।উত্তরে কেষ্টা বলেছিল— ——– বাব্বা! কলেজে পড়ে তো অনেক বুদ্ধি বেড়েছে। তবে আর আমার কাছে পড়তে হবে না। আমি ঠিক করেছি আমি চলে যাব। না।কোথাও যাবে না।এখানেই থাকবে।আমি মন দিয়েই পড়ব। মন্দাকিনী মন দিয়েই পড়ব বললেও আমি তার ঝুঠো কথার দাম দিইনি।তাই কিছুটা সত্যের সাথে মিথ্যে মিশেল করে বলেছিলাম মেশোমশায়কে।যাতে মন্দার ওপরে দায়টা না পড়ে।বকুনি না শুনতে হয়। বলেই ফেললাম মেশোমশায়কে।——–মেশোমশায়, পত্র পত্রিকায় লেখা পাঠানোর জন্য মন্দাকে ভাল করে পড়াতে পারছি না। আমি চলে যাব। আপনি বরং অন্য মাস্টার দেখুন। আমার দোষেই ওর ফল খারাপ হল। -তোমার দোষ কেন হবে?ওর পড়ায় মন নেই। ———-না না ।মাস্টার বদল করলে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ও লেখায় একটু বেশি সময় দিতে হবে। মেশোমশায় কি ভাবলেন কে জানে, তারপর বলেন। – ঠিক আছে। আগে আমাদের সাথে পুরী চল।তারপর ফিরে এসে চলে যেও।আমাদের সাথে একটা জোয়ান ছেলে থাকলে তোমার মাসীমা একটু জোর পাবেন। পুরীতে গিয়েই মন বদলে গেল। ফ্রক পড়া ছাত্রীর সাথে শাড়ি পড়া মন্দাকিনীকে মেলাতে পারলাম না। তখন ই ঐ মেয়েকে আমার ‘মন’এ বসিয়েছি। সুরের আবেশে ছুটছিলাম। সুর স্রষ্টা তার আঙুলের ছোঁওয়ায় সুর বেঁধে চলেছে সেতারে। কখনও বেহাগ, কখনও আশাবরী। যতই খেলুক না কেন সুর বাঁধা আছে “পকড়” এ।সুর খেলছে আপন ঢং এ বাঁধা সপ্তক ছেড়ে নড়ছে না।রং বেরঙের এর মীড়গুলো সুর এঁকে চলেছে আকাশে বাতাসে।স্থায়ী অস্থায়ী যেখানেই যাক না কেন’ ফুসফুস’ তার পকড়।কেষ্টার ফুসফুস তার ‘মন’।মন্দাকিনী,ই সেই মেয়ে যে পারে বিশ্ব সংসার কে দোলাতে আবার শান্ত করতে। এই অনুভূতি হয়েছিল জগন্নাথ দর্শনের সময়। কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি সে কথা।এমন কি মন্দাকে ও না। পুরীর স্মৃতি টেনে নিয়ে যাচ্ছে কেষ্টাকে। মেশোমশায়ের কথা মতো ই পুরী যাওয়া হল।কথা ছিল মাসীমা আর মেশোমশায় মন্দিরে জগন্নাথ দর্শনে যাবেন। আমি সঙ্গী হলাম। মাসীমার ইচ্ছাতেই সঙ্গ নিতে হল।মাসীমা বললেন। — বাবা কেষ্টা,আমরা মন্দিরে ঢুকব। আজ জগন্নাথের রাজবেশ হয়।ভীড় হবে খুব। ঔৎসুক্য দেখাই আমি। –তাই নাকি? মাসীমা বললেন—- হ্যাঁ। স্বধবারা রাজবেশ দেখলে নাকি বৈধব্য যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় না।এ কথা শোনার পর না গিয়ে পারি?নইলে অত ভীড়ে যেতাম না। মেশোমশায় হাসতে হাসতেই বললেন- চিন্তা কর না রাজবেশ না দেখলেও তুমি আমার আগেই যাবে। — তোমার যেমন কথা। এবার আমায় বললেন-শোন বাবা,মন্দার ভার তোমার ওপর রইল। ওকে দেখো। মনে ভাবলাম এ তো কয়েক ঘন্টার জন্য, পুরোপুরি ভার দিলেও রাখার চেষ্টা করব। কেষ্টাচরণের ফুসফুস তার” মন”।সেই মেয়ে সব পারে বিশ্ব সংসার কে দোলাতে পারে আবার শান্ত করতে পারে। এই অনুভূতি হয়েছিল জগন্নাথ দর্শনের সময়। মাসীমা আর মেশোমশায় মন্দিরে ঢুকে গেলেন। আমি ভাবলাম , আমরা একটু ফাঁকা দেখে দাঁড়াই। কারণ এই ভীড়ে আমি মন্দা কে পাহারা দিতে মত্ত। যে মন্দাকে একটু ছোঁওয়ার চেষ্টা করবে তাকেই দৃষ্টির ছোবল মারতে দ্বিধা করবো না।কেন নয় আস্তিন গুটিয়ে?মন্দার কি হবে তাই ভেবে!কি আর হবে?আরে ভীড় ভাট্টায় যাবে আর কারো ধাক্কা খাবে না?তাই কি হয় কেষ্টাচরণ?মন্দা কে নিয়ে একটু নিরিবিলিতে যাও।দু দন্ড মনের কথা বল। বললাম——–এখানটা ভীড়। চল একটু ফাঁকায় দাঁড়াই।জগন্নাথের রাজবেশ দেখতে ভীড় হবেই। আমি কেষ্টাচরণ মন্দাকিনীর উত্তরে যারপর নেই বিস্মিত হলাম। এ কোন মন্দাকিনী!একে কি আমি চিনি? মন্দা বলল – মা যা বলেছে তা শুনতে হবে নাকি?ঠাকুর দেবতা বলে কথা। তাছাড়া বিয়ের পর এখানে নাও আসতে পারি। বললাম-তাতে কি হল? সে বলল – আমি এখুনি রাজবেশ দেখব। বললাম – তোমার তো বিয়েই হয় নি।বিধবা হবার ভয় নেই। আবার সে বলল- কে বলল, যে আমার জন্য অপেক্ষা করে বসে আছে?জেনেও তাকে আমার আগেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেব? আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম–সে হবার নয়।।আমি মাসীমার কথার অবাধ্য হতে পারি না। বিয়ের পর তুমি রাজবেশ দেখো। আমার কথা না শুনে সেই মেয়ে আমার হাত ধরে টানতে টানতে নিয়ে চলল। হতচকিত আমি কেষ্টাচরণ। চতুর্দিকে মঙ্গলিক শঙ্খ বেজে চলেছে। ঘূর্ণাবর্তে আমি।মন্দাকিনীর দৃষ্টি হল গভীর। ঘন নিশ্বাস আরো ঘনতর হল। ওর চোখে চোখ ফেলতে পারছি না।কি এক অমোঘ আকর্ষণে আমি আচ্ছন্ন হতে চলেছি। পৃথিবী জুড়ে শঙ্খ নাদ।আমার সারা শরীরের আসন্ন প্লাবন আমি কম্পিত এক সঙ্কিত পুরুষ। চলেছি তারই আকর্ষণের টানে।চলেছি মৃত্যু পথের দিকে এগিয়ে। নিশ্ছিদ্র গুহা পথে অগণিত শোনিত স্রোত ছুটে চলেছে জীবনের তালে তালে।নিয়ম লঙ্ঘন করার আমি কে?কি আমার সাধ্য, যে বেতাল হই? আঁধার গুহা কিঞ্চিত আলোকিত হল।চোখ মেলে দেখলাম তাম্রপাত্রে আলোক মালা সজ্জিত। চোখ ধাঁধিয়ে গেল সেই আলোক রশ্মি তে।মন্ত্রোচ্চারণের ধ্বনি কানে আসছে। পুস্প শোভিত বেদীতে সহস্র শতদলে সজ্জিত মায়ের পাদমূল। মায়ের রঙ সুবর্ণ। মায়ের চোখ থেকে আলোর বিচ্ছুরণ দেখে বললাম—– —– তুমি কে? আমি মন্দাকিনী,স্বর্গের দেবী।আমায় তুমি চেনো না?কিন্তু তুমি কে? আমি কেষ্টাচরণ। – কেষ্টা!কেষ্ট ! নারায়ণ তুমি?গোপাল নাম ই তোমায় সাজে। এস কৃষ্ণ চল কুঞ্জবনে। লীলা খেলা করি। ধর,দেবী। আমার হাত ধর। আমি যে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। –কি করে দেখবে?তুমি তো চোখে ঠুলী পড়ে আছ?আমাতে প্রাণ সঁপে দাও।সব দেখতে পাবে। – হে দেবী, তুমি আমার সব নাও।অন্তর্দৃষ্টি দাও আমাকে। কি দেখবি? যেই কালী সেই কৃষ্ণ। সেই জগন্নাথ। শুধুমাত্র রঙ রুপের বদল।দেখেই কি হবে? শুধু তাঁকে ডাক। চকমকির শব্দ। কে আলো জ্বাললো?আলো হীন গুহায় হাজার বাতিতে চোখ ধাঁধিয়ে গেল। চামচিকে ডানা ঝটপটিয়ে উড়ে গেল। হাজার বাতির আলো এমন লালচে হল কি করে?নিজেকে শুদ্ধ করতে ঐ বাতিতে হাত মেলে ধরলাম। হ্যাচকা টানে হাত সরে এল।ওটা কি?প্রদীপ না মশাল?অগ্নিশিখা ক্রমে বর্তুলাকার নিল।মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ হল।পুরোহিত তো নেই!এই তো পন্ডাবাবাজী !রুষ্ট চাউনি তার। আমার কি বলি হবে?ভয়ে কেঁপে উঠলাম। বললাম ——— মা গো কোন পাপ করিনি। কেন এই যম পুরী তে নিয়ে এলে?এতো লোকের কষ্ট দেখতে পারিনা মা। –কষ্ট কোথায়, এরা তো পুণ্য কামাচ্ছে। ধন কামাতে তো কষ্ট করে। পুণ্য কামাতে কষ্ট করবে না? -মা,তোমার ক্ষেত্রে এত হুটোপুটি কেন? –আরে, ওটা না থাকলে পুণ্য কামিয়েছি বলে মনে হতো না।আরে কেষ্ট ঠাকুর নিজেকে স্মরণ কর। কানে আসছে দৈব বাণী “যেই কালী সেই কৃষ্ণ “। আমি কৃষ্ণ। হ্যাঁ। কৃষ্ণ আর কেষ্টা আলাদা? কানে আসছে সেই মেয়ের গলা।তুমি কৃষ্ণ, কৃষ্ণ দা বলেই ডাকব। সাড় ফিরল বুঝি আমার। নইলে টের পেলাম কি করে যে তার হাতে আমার হাত!ইহ জীবনের জন্য বাঁধা পড়েছে সেই হাত। হাত ছাড়াবার আমি কে?যা করার তিনিই করবেন। আমি যন্ত্র তিনি যন্ত্রী। অসংখ্য গোলাপ পাঁপড়ি সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। সুড় সুড় করে আমার কানে বলছে।”তোমায় কৃষ্ণ দা বলব”। হাতের চেটোতে হাত রেখে বলছে “দেখো তো প্রদীপের ওপর অমন হাত রাখে?দেখো তো ঝলসে গেছে।এমন লোক নিয়ে কি করে ঘর করি বলোতো”? ভাবলাম——তুমি স্বর্গের দেবী।তোমার আবার ঘর কোথায়?তোমাকে নিয়ে ঘর!না না ত হবার নয়।চল কুঞ্জ বনে। সেখানেই তো লীলা খেলা করি। যার সাথে আমার হাত বাধা। সে আমায় নিয়ে চলল কুঞ্জ বনে।সে মানবী কি ঈশ্বরী জানিনা।তবে অমন একটা নরম শরীর যার সে মানবী ই বটে। সে তার শরীর দিয়ে দলিত মথিত করে চালিত করছে।সেই শরীর ধারীর নাম জানিনে।তার পরনে হলুদ শাড়ি। কপালে সিঁদুরের, আর যজ্ঞের টিকা। দেবী?কোন দেবী?অসুর দলনী? তারই পথে আমি চলেছি কৃষ্ণ। সেই শক্তিরুপিনীর তালে তালে চলেছি মৃত্যু পুরীর দিকে। একটা হ্যাচকা টানে মোড় ঘুরিয়ে দিল আমায়।চললাম মৃত্যুর থেকে জীবনের দিকে। জলধারায় সিঞ্চিত, সিক্ত আমি।আমার মুখের ওপরে একটি অশ্রুসিক্ত মুখ।আমাকে চোখ খুলতে দেখে সে শুধুই বলল—–কৃষ্ণ দা এদিকে তাকাও। আমি কৃষ্ণ, কেষ্টাচরণ ডুবে যেতে লাগলাম দীঘিসম তার আঁখিজলে।ডুবতে ডুবতে কতদূর ডুবেছি তা জানিনা।তবে আবার ও ‘কৃষ্ণ দা’ শুনে চোখ খুললাম। দেখলাম এটা কুঞ্জ বন না।একটা বটবৃক্ষ কে বেষ্টন করে শান বাঁধানো হয়েছে। তাতেই বসে আছি।আমাকে স্বাভাবিক দেখেই মন্দাকিনী বলল। – ঠিক আছ তো? রাগ হলো ওর কথায়। আচ্ছা মেয়ে বটে। আমি ভেতরে যাব না বলা সত্ত্বেও আমায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল ভেতরে।বুড়ি ছোঁওয়ার মতো রাজবেশ দেখে তবে ছাড়ল। ওর হবু স্বামীর আয়ু বাড়লেও আমার তো ঐ ভীড়ে প্রাণ যায় যায়।অন্য পুরুষের ছোঁওয়া বাঁচাতে আমার দেহের সাথে লেপটে ছিল সারাক্ষন। হাত ধরে এক মুহূর্তের জন্যও লাগ ছাড়া হতে দেয়নি।আরে তুমি অমন একটা যুবতী আমার অঙ্গের সাথে লেপটে রইলে আর এখন বলছো ঠিক আছি কিনা?উত্তরে বললাম—— —আমার কথা ছাড়।তোমার ঐ হবু স্বামীটি কি শুনলে খুশি হবেন যে তুমি কুমারী কালে একজন পুরুষের শরীরের সাথে তোমার শরীর লেপা পোছা করতে করতে রাজবেশ দেখেছিলে? আমার কথা শুনে ওর মুখে সব রক্ত জমাট হয়েছিল। রাগেই সরে গিয়েছিল ওখান থেকে। আমিও উঠে গেলাম। রাগ ভাঙ্গাতে বললাম। – রাগ করো না।তবে তোমার অসীম ক্ষমতা! নইলে ঐ চক্র ব্যুহ থেকে আমায় উদ্ধার করতে সমর্থ হও?তবে তোমার হবু স্বামীর আয়ুর জোরেই এ যাত্রা বাঁচলাম। আমার শেষ কথা শুনে ঐ মেয়ের মুখের ভঙ্গিটা হলো দেখার মতো।কিন্তু ওর স্বর্গীয় হাসির অর্থ উদ্ধার করতে সমর্থ হলাম না। রাগ হল নিজের উপরে ।শতধিক তোমায় কেষ্টাচরণ, এমন একটা হাসির অর্থ বুঝতে পার না?তাও অমন একটা মেয়ের মুখের হাসি?যাকে নাকি তুমি প্রাণ সঁপে বসে আছ!কেষ্টাচরণ লেখা ছেড়ে এবার একটা চাকরি জোগার করতে উঠে পড়ে লাগ।নইলে অমন দেব ভোগ্যা কে পাবে কি করে?
বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 10
কেষ্টাচরণ, এবার একটা চাকরি জোগার কর।নইলে কি ঐ মেয়ের হাসি দেখতে পাবে?পাবে না তার নাগাল।যে মেয়ে ভিড়ের তোয়াক্কা না করে তার হবু বরের আয়ু বাড়াতে জগন্নাথের রাজবেশ দেখতে যায়!বলা কি যায় ঐ আয়ুটা তোমার কপালেই নাচছে কিনা? মন্দিরে আমার মনই স্বপ্নের আবেশ সৃষ্টি করেছিল। তাই মন্দাকিনীকে দেবী বলে ভ্রম হয়েছিল। নইলে কি আমি প্রদীপের শিখায় হাত দিই।এই প্রথম জগন্নাথ দর্শন করলাম। কিন্তু আমিতো মাতৃরূপই দর্শন করেছি। মন্দা বলল কি হল, হাসছো কেন? বললাম—–হাসবো না?যা একখানা কান্ড করলে! বলি ,মাসীমাকে। সে মুরোদ তোমার এখন ও হয়নি।তা আমি ভাল করেই জানি। আমার মুরোদের কথায় আমার পুরুষত্বে ঘা লেগেছিল বলে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলিনি।বেগতিক দেখে ঘাট মানতে হয়েছিল ঐ মেয়েকে। মেশোমশায়ের কথায় আমার চিন্তা ছুটে গেল। চিন্তা করতে করতে কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গিয়েছিলাম।আমিতো কৈলাশ গিরির পথে!একটু আগে পুরী পৌঁছে গিয়েছিলাম। রাগের কারণ টা খুঁজি।মনে পড়ে মন্দাকিনীর বলা কথাটা। রাগ করে কি লাভ?তাই বললাম। না মেশোমশায়।তাছাড়া পরের বার আমাকে দরকার না ও হতে পারে। আমার কথায় যার আঁতে লাগার তার লেগেছে।তার মুখ দেখেই বুঝলাম। আমার কথায় মেশোমশায় বললেন–তোমাকে ছাড়া আমার চলবেই না।তুমি আমার ছেলের মত। অনেক সুপাত্র পাবার যোগ্যতা মন্দাকিনীর আছে।তবে আমাকে সুপাত্র প্রমাণ করার তাগিদে মন্দাকিনী আমার ত্রুটিটুকু মাফ করে বলল। জানো বাবা,কৃষ্ণ দার একখানা উপন্যাস শিঘ্রী বের হবে। আমি বললাম—–হ্যাঁ। ওরা রয়ালটি দেবে। তাই নাকি? এতো বড় সুখবর টা চেপে গেছ।তা ,টাকা পয়সার কথা কিছু হয়েছে?দেখ, বাবা আবার ঠকিয়ে না দেয় । আঁকে বাঁকে বেষ্টন করে উঠছে গাড়ি।ডানে উন্মুক্ত সাগর। স্বচ্ছ জলের নীল রং।সর পড়া ভাব। তাতে রৌদ্র কিরণ চমক ফেলছে। এই রুপ বঙ্গোপসাগররের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। তবে লোক মুখে শোনা বিশ্বের সমুদ্র সৈকতের মধ্যে বিশাখাপত্তনম এর বিচ্ মোটা দাগে লেখা আছে। আমার মন কেঁপে ওঠে ঐ সর পড়া সমুদ্রে ভেসে যাওয়া পাল তোলা ডিঙ্গি দেখে।সেই সর পড়া সমুদ্রে চমক ফেলছে রৌদ্র কিরণ।অপূর্ব এই রুপ। পালের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে বৈঠা বাইছে মাঝি।কত অবলীলায় বৈঠা বাইছে।নৌকার পাল যত বেলুনের মত ফুলে উঠছে ডিঙ্গী ততো তীর বেগে ছুটছে। কৈলাশগিরির পথে আঁকা বাঁকা পথে পাহাড়ে উঠছে গাড়ি।কি সুন্দর প্ল্যান করে রাস্তা তৈরি করেছে।প্রতি –টি বাঁকেই সুদৃশ্য ল্যান্ডিং এ বাগান করা।গার্ডেনার মনে হয় ‘ওয়েল ট্রেন্ড’।নইলে ঝাউ, দেবদারু গাছের অমন জন্তু জানোয়ারের রুপ দিতে পারে!ওঠার সময় দেখলাম ঘাস মসৃণ আকারে কেটে, তাতে ফুলের বাহারি ঢঙে লেখা -‘ ভিশাখা আরবান ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’।এরা কি পুরস্কার পায়!জানা নেই। মন্দাকিনীর উচ্ছাস কানে আসতে আমার চমক ভাঙলো। আমার ও অমনটা হয়েছিল যেবার প্রথম মা বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম। আজ তাঁরা নেই। তাঁরা আমার হৃদয় জুড়ে।সেবার আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে কবিতা লিখে ফেলেছিলাম। মাসীমার কথায় মন ফিরল।দেখলাম গাড়ি দাঁড়ানো। কৈলাশগিরিতে দাঁড়িয়ে পুরো ওয়ালটেয়র দেখছিলাম। কথা বলতে বলতেই টাইটানিক কর্ণারে পৌঁছলাম।মোটা লোহার রড দিয়ে বেড় দেওয়া রয়েছে।ঠিক যেন জাহাজের কোনে দাঁড়িয়ে নিচের সমুদ্র দেখছি।সমুদ্রের বেলাভূমির পাশেই রাস্তা গেছে এঁকে বেঁকে স্তরে রাস্তার খাঁজ দেখা যাচ্ছে।আগে যখন এসেছিলাম তখন কি এ জায়গাটা ছিল!পলাশ, শিমুল আর রকমারি রঙের বোগনভেলার গাছ। আর তাতেই ঢাকা পড়েছে এ পাশের সমুদ্রের রূপ। মন্দাকিনী তার ক্যামেরা নিয়ে তৈরি হচ্ছে দেখে মাসীমা ও মেশোমশায় কে টেনে সেই কোনে দাঁড় করালাম। আমি সরে যাওয়ার আগেই ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলে উঠল। রাগ হল ওর ওপর।আমাকে বুঝতে না দিয়েই ছবি তোলার কাজ শেষ । বলেই ফেললাম—— কি হল এটা?আমার ছবিটা নিলে কেন? মন্দাকিনীর চোখে দুষ্টমী খেলছে।আমি জানি আমায় রাগাতেই এটা করেছে।মেশোমশায় –মাসীমা কাছে তাই কিছু বললাম না।কিন্তু সে মেয়ে নাছোড়। আমাকে রাগাতেই আবার ও সাটার টিপল। এবার মেশোমশায় মাসীমা ধারে কাছে নেই।আমি হলফ্ করে বলতে পারি ঐ মেয়ে ইচ্ছা করেই করছে। কি করে ধুতি পড়ে এসেছিলাম একবার ও ভাবিনি হাওয়ায় উড়ে যাবে ধুতি।মন্দাকিনীর গলার স্বর কানে এল। রাগ করো না কৃষ্ণ দা।এস ছবি তুলি। অমন সুমধুর কন্ঠে আমার মন গলে গেল। তবুও বললাম। ছবিটা কি তোমার জন্য তুললে?আগে বললে ঠিক হয়ে দাঁড়াতাম। তাহলে কি তোমার ধুতি উড়ে গিয়ে পাল তোলা নৌকার মত যেটা হয়েছিল সেটা পেতাম? ও,এই ব্যাপার!ধুতির নিচে আমার পা খানা কেমন তা দেখাতে চাও সবাই কে? কি যা তা বলছ? এবার মন্দাকিনীর চোখে লালের ছোঁওয়া গালে ছড়িয়ে পড়ল। এবার ওর চোখে চোখ ফেলে বললাম—-ঐ ছবিটা তোমার জন্য রেখে দিও। কথাটায় কতদূর কাজ হল জানিনা তবে আমাকে ধরাশায়ী করার মত একখানা মুখভঙ্গী করে সে ছুটে পালাল। হাসলাম মনে মনে। কেমন জব্দ?আর অমন ছবি তুলবে?আমি ভাল করেই জানি যে তখন আমার ধুতি ছিল উড্ডীয়মান। দু খানা পা ছিল বিবস্ত্র। এগিয়ে গেলাম ওদের দিকে। মেশোমশায় বললেন——– রাগ করছ কেন?ছবি যেমন ই হোক স্মৃতিটাই আসল। না মেশোমশায় রাগ করিনি। কথাটা বলতে বলতেই বজ্জাতির হাসি হাসলাম ঐ মেয়ের চোখে চোখ ফেলে। সেই তখন সহজ হবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।আমি গেলাম ওর দিকে বললাম। দাও দেখি ক্যামেরা টা।আমার ঐ পোজ এ তোমার একটা ছবি তুলতে পারি কিনা? ঐকথায় ঐ মেয়ের যা হাল হল তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখার।সে ক্যামেরা ছাড়তে নারাজ। ভয় যদি সত্যিই অমন একটা ছবি তুলে ফেলি! আমাদের ক্যামেরা নিয়ে টানাটানি দেখে মেশোমশায় বললেন—–,কেষ্টাকে ছেড়ে দে।ও তুলুক।তুই এদিকে আয়। শুধু কি বাবার কথায়, নাকি আমার চোখের এমন কিছু লেখা হয়েছিল যাতে মন্দার ভয়টা চলে গেছে। সোজা চললাম রাস্তা পেরিয়ে। চওড়া চওড়া টাইলস বসিয়ে চলার পথ করেছে।মাঝে মাঝেই সিঁড়ি। সামনেই বসার চেয়ার দেখে মাসীমাকে বসতে বললাম। মেশোমশায় ও বসলেন। ঠিক তখনই মাসীমা চিৎকার করে উঠলেন। হ্যাঁগো, মন্দা কোথায়? চারদিকে নজর চালালাম। না,কোথাও নেই। মাসীমা বললেন——-‘ ও কেষ্টা ,মন্দা পড়ে যায় নি তো? আমি জোর গলায় বললাম—-না না মন্দা তো আমাদের সঙ্গেই ছিল। একটু আগেই দেখেছি ওকে। আপনারা বসুন এখানে। আমি দেখছি। এদিক থেকে ওদিক খোঁজা শুরু করলাম। কোথায় যাবে!মনে হল সত্যিই পড়ে যায় নি তো?আবার দেখি সেখানে গিয়ে।তরিঘড়ি ছুটলাম সেদিকেই। আমার চোখ সর্বত্র খুঁজতেই ব্যস্ত। না,এখানে তো কেউ নেই! ফিরলাম সেখান থেকে। মন বলছে, “কোথায় পাব তারে”। সত্যিই যদি হারিয়ে যায়।বুকের মাঝে শূন্যতার সৃষ্টি হল। হে কৈলাশ তুমি মন্দাকিনীকে এনে দাও। আমার ইষ্ট দেবকে স্মরণ করতে করতে চলেছি।কল কল করে অনেক শিশুর কথা কানে আসছে।দেখলাম শিশু হাতে মায়েরা চলেছে পার্কে।অনেক গাছের ঘেরাটোপে ঢাকা পড়েছে পার্ক। যেখানে মাসীমারা বসে আছেন তার পেছনেই এই পার্ক। বাচ্চারা সিঁড়ি ধরে উঠছে আর মসৃণ পাতের ওপরে শুয়ে। কলকল করে হাসছে।দেখতে মজা লাগলেও আমার এখন মজা করার সময় না।ঘুরে দাঁড়াতেই কানে এল বাঙলা ভাষা। কি হল কবি মশায়, কাকে খুঁজছো? গলার স্বরে থমকে দাঁড়ালাম। অপলকে চেয়ে থাকি সেই মেয়ের দিকে। পালঙ্কে হেলান দেওয়ার ভঙ্গিতে দোলনায় বসে আছে।তার হলুদ শাড়ির আঁচল উড়ছে।কিন্তু বেসামাল হচ্ছেনা। চোখে তার দুষ্টমীর হাসি ঝিলিক দিচ্ছে।ঐ হাসি দেখে বলে দিতে পারি যে এসব আমায় নাকাল করতেই করছে।দারুণ রাগ হল ওর ওপর। কিন্তু রাগ করা ছাড়া আমার আর কি করার আছে? এগিয়ে যাই ওর দিকে। রসিয়ে কি যেন খাচ্ছে। তাড়িয়ে তাড়িয়ে খেতে গিয়ে ঠোঁটে সেই রস গড়িয়ে পড়ছে।আমি চেয়ে আছি সেই ঠোঁটের দিকে।এক ফোটা রস গড়িয়ে পড়ল ওর শাড়িতে। বলে ফেললাম অন্য কথা।যা বলার তা বলা হল না। কি খাচ্ছো বল তো হ্যালার মত? যা বলার ছিল তা না বলে অন্য কথা বলায় নিজেকেই গাল দিতে ইচ্ছে করছে ধন্যি মেয়ে বটে আমাকে গলাতে পারে।নইলে কোথায় দুটো কথা শোনাব, তা না ওর খাবার খবর নিচ্ছি?ধিক্ আমাকে।যদি সত্যিই আমার ঘরে আসে তবে আমার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাবে। আমাকে বলল——- কেষ্টাদা, খাবে নাকি কাঁচা আম?ভাবতে পার আমাদের ওখানে এখন কাঁচা আম? মনে ভাবলাম, আমার ভারি বয়েই গেছে আমের কথা ভাবতে।এবার তোমাকে একটু টাইট দেওয়া দরকার। নইলে তোমার ঐ সুন্দর মুখে হেসে কতবার যে আমায় ঐ কৈলাশগিরিতে ওঠানামা করাবে তার ঠিক নেই। আবার বলল——–খাও না কৃষ্ণ দা।একটুও টক না। ভাবলাম, তোমার থেকেও মিষ্টি?জোর জুলুমে ওর কথা রাখতে হল।হাতে এক টুকরো আম। বললাম ওটা তো এঁটো। না না এই দেখ।এতোগুলো রয়েছে। বলেই শাড়ির কোঁচড় দেখাল। হলুদ শাড়িতে সাদাটে আমের অনেক ফালি। দেখে বললাম——যেটা খাবে সেটা শাড়ির আঁচলে রাখবে? কেন?ওদের পুরানো নোংরা খবরের কাগজটা তোমার পরিস্কার মনে হত?শাড়ির যেখানটা পরিস্কার সেখানেই রেখেছি। দেখলাম, কাঁধের কাছে যে পিন করে তা নেই।তার মানে যে জায়গাটা শাড়ির ভাঁজে থাকে সেখানেই আম রেখেছে।বুঝলাম ওর নিটিপিটি টা একটু বেশি। নইলে শাড়ি ভাঁজ ছাড়া পড়েনা । একে পাতলা শাড়ি তায় আবার ভাঁজ হীন।তাতে যে কোন পুরুষের দৃষ্টি আকর্ষিত হতে পারে।আমার লেখনীতে কি নারী দেহের ছবি আঁকতে হবে না? কিন্তু আমার দৃষ্টি এখন মন্দাকিনীর শরীরের কোন খাঁজে আটকে আছে তা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। সে এখন আম্র রসাস্বাদনে ব্যাস্ত।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!