বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 1
স্টেশন চত্বরে যেখানে যাত্রীদের বসার চেয়ার সাজানো,সেখানেই দাঁড়ালাম। মাল বলতে আমার কিছুই নেই। শুধুমাত্র একখানা ঝোলা সম্বল করেই চলেছি বিশাখাপত্তনমে। আজ ঘুম থেকে উঠেও বুঝিনি এত বড় একটা সুখবর আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। চারদিকে নজর চালিয়ে ও যখন তাদের দেখা মিলল না,তখন পা বাড়ালাম প্ল্যাটফর্ম এর দিকে।বহুদিন পর চলেছি তাদের সঙ্গে।এখনও নিজের সৌভাগ্যকে বিশ্বাস করতে পারছি না।ভাবতে ভাবতেই চলেছি কিন্তু আমার চোখ খুঁজে চলেছে সেই একজনকে। প্ল্যাটফর্ম এর গেট এর আগেই থমকে দাঁড়ালাম। নজর আটকে গেছে সেই মেয়ের কাজল কালো চোখে।অনেক দিন পর দেখা সেই মেয়ের সাথে যাকে পুরী তে নিজের করে পেয়েছিলাম। আমার মতের কোন দাম নাই দিয়ে পুরীর মন্দিরের জন স্রোতের মধ্যে আমার শরীরের সঙ্গে মিলে মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল সেই মেয়ে। তখন ভিড়ের ঠেলায় আমি আমার আমিত্ব হারিয়ে শুধুই শুনেছিলাম আমার শোনিত স্রোতের শব্দ। আমি কোন ছার!যে কোন পুরুষ হলে তার ও হাল হতো আমার মতো। ভাবনাটা চটকে গেল হাওড়া স্টেশনের অ্যানাউন্স কানে আসতে। তার চোখে চোখ পড়তেই দেখলাম তার আঁখি পল্লবের কম্পন। ঘনঘোর দৃষ্টি হলো নত মুখী।চোখ ফিরিয়ে নিলাম। আগের থেকে রং টা আরও খুলেছে। বাইরের রোদের তাপে ই হয়তো বা ঐ মেয়ের গালে লালের আভা। নাকি অন্য কিছু!!
মেশোমশায়ের কথায় সে দিকে ফিরলাম। ——-যাক এসে গেছ তাহলে?তোমার দেরি দেখে ভাবলুম তুমি বুঝি আর আসবে না।চল এবার, ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে। মোট ঘাট নিয়ে কুলি দাঁড়িয়েছিল ,তাই মালের বোঝা আমায় বইতে হলো না।যে বোঝা বওয়ার জন্য টিকিটের টাকা গুনে আনা হয়েছে ,তারই দায় নিয়ে তারই পাশে পাশে হাঁটতে লাগলাম। পাছে আমার কর্তব্যে গাফিলতি হয় এই ভেবেই তার পাশে হাঁটা। কিন্তু মাসীমার দৃষ্টি আমায় অনুসরন করে চলেছে।তা দেখে মনে হলো কর্তব্যে গাফিলতি হওয়াটাই মাসীমার কাম্য। তাই মন্দাকিনীর পাশ থেকে দু,কদম পিছিয়ে এলাম। বুঝলাম আমার সঙ্গে মন্দাকিনী কে এক হতে দেখলেই মাসীমার অসন্তোষের সীমা লঙ্ঘিত হচ্ছে।এমন টা হবে জানলে আসতাম না। তবে এই মেয়ের সঙ্গ পাবার লোভ কি ছাড়তে পারতাম?মনে পড়ে গেল ফোন যখন এলো সে সময়ের কথা। পি থ্রি হান্ড্রেড, ইউনিক পার্কে ফোন যখন এলো তখন আমি চিলে কোঠায়। কারণ ও বাড়ির চিলে কোঠায় আমার ঘর। নামা ওঠার অসুবিধা হলেও কবিত্ব করতে ওর থেকে খাঁসা জায়গা আর আছে কিনা তা জানা নেই। আর থাকলেও তা জোটাবার মতো এলেম আমার নেই। সকাল আটটা হবে তখন।বুলার গলা কানে এলো। ———ছোটকা, তোমার ফোন।
এ বাড়ির একটা সুবিধে। ফোন এলেই ছেলেরা আমাকে ডেকে দেয়। ডাকটা কানে যেতেই পড়ি মরি করে ছুটলাম। ভাবলাম কোন প্রকাশনী থেকে ফোন এসেছে।হয়তো কোন উপন্যাস মনোনীত হয়েছে। আমাকে দেখেই বুলা বলল—-কাকু তোমার ফোন। একটা বুড়ো বলল কেষ্টাকে ডেকে দে।
কেষ্টা –কেষ্টা বলে কি কোন প্রকাশনীর থেকে ফোন করতে পারে? না।রিসিভার কানে দিতেই মেশোমশায়ের গলা শুনলাম। আগে যতটা হতাশ হয়েছিলাম এখন ততোটাই উৎফুল্লিত হলাম। —–,—বাবা কেষ্টা আমরা আজ চারটের গাড়িতে বিশাখাপত্তনম চলেছি। তিরুচিরাপল্লী এক্সপ্রেস । তোমার টিকিট কাটা আছে। হাওড়ার নতুন বিল্ডিং থেকে ছাড়বে। দেরি করো না।ঠিক সময়েই চলে এসো কিন্তু।
বললাম—–আজ? মনে ভাবলাম, লাস্ট মোমেন্ট এ মাসীমা রাজি হয়েছেন। মেশোমশায় বললেন—হ্যাঁ। আজ মন্দার জন্য তোমাকে দরকার। তোমার মাসীমা বলেছেন তোমার মতো একজন শক্ত পোক্ত লোক দরকার মন্দার জন্য। যা চঞ্চল মেয়ে মন্দা।দেরি করো না।রাখি।
অঅ্দ”রাখি” বলে মেশোমশায় রিসিভার নামিয়ে দিলেন। কিন্তু আমার কানে তখন ও বেজে চলেছে ,”মন্দার জন্য তোমার মতো শক্ত পোক্ত লোক দরকার “। যুবতী মন্দাকে রক্ষা করতে আমার মতো একজন বলিষ্ঠ পুরুষ চাই।গর্বে আমার কেশর ফুলে উঠল। আদৌ আমি বলিষ্ঠ কিনা তা জানিনা। সেটা জানার আজও সুযোগ হয়নি।তবে আমি একজন পুরুষ তা হলপ করে বলতে পারি। তৈরি হতে ছুটলাম অমনি চাবুক খাওয়া ঘোড়ার মতো টগবগিয়ে। তারপর চানা খাওয়া ঘোড়ার মতো ছুটে এলাম স্টেশন এ। সায় ফিরলো মেশোমশায়ের কথায়। ———–এই তো এস সিক্স। আমাদের কামরা।উঠে পড়ো কেষ্টা। কামরায় উঠে পড়লাম আমরা। ভেতরের দিকের তিনটে বার্থ আর কড়িডরে একটা বার্থ। ভেতর দিকে কুলী মালপত্র গোছ করে দিল।মাসীমা খুব খুশি হয়ে বলেন—–বাহ্ নিচের দুটো বার্থ পাওয়া গেছে ইচ্ছে মত বসে থাকতে পারবো। মেশোমশায় বললেন——কেষ্টার জায়গাটা ও ভাল। বসতে,শুতে কোনটাতেই অসুবিধা নেই।
ট্রেন ছেড়ে দিতে মাসীমা,মেশোমশায় দারুণ খুশি। মনে ভাবলাম, ভালই হল।ওপাশে একটা সিট্ থাকা সত্ত্বেও আমার সিট্ খানা এ ধারে হওয়ায় মাসীমা খুশি। কারণ কেষ্টা চরণ পুততুন্ড ওদের মেয়ের নাগালের একেবারে বাইরে রইল।দেখলাম সেই মেয়ে অবাক বিস্ময়ে পৃথিবী দেখছে। চোখ ফিরিয়ে নিলাম।মনোনিবেশ করলাম প্রকৃতিতে। মনে চলেছে তোলপাড়।নিজের ভাগ্য কে অনুভব করার চেষ্টা করছি।তবে আমার বাবা মারা না গেলে,আমার ভাগ্য ও মন্দ হতো না।
মেশোমশায়ের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। বুঝতেই পারিনি যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। গাড়ির দোলায় আর মনের আনন্দে হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ———–কেষ্টা!আটটা বাজে। এবার খেয়ে শুয়ে পড়। আমি লজ্জা পেলাম। ছিঃ ছিঃ এতক্ষণ ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম!মাসীমা খাবার দিলেন। বললেন—–মন্দা খেয়ে শুয়ে পড়ল তাই আমরাও খেয়ে নিলাম।
ওপরের বার্থ এ নজর গেল। দেখলাম, সেই মেয়ে অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন। হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়লাম। ভাবলাম এত সহজে ঘুম আসবে না।কিন্ত তা হলো না।আমি আবার ও ডুবে যেতে লাগলাম ঘুমে।
হঠাৎই জেগে গেলাম একটা ঝাঁকিতে। ভাবলাম গাড়ি কি এক্সিডেন্ট হলো?এতো জোরে ঝাকি লাগল যে লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। নজর গেল বাইরে। জানালার সার্শি দিয়ে দেখলাম অজস্র আলোর মালা। তবে কি স্টেশন এসে গেল?ঘড়ি দেখলাম। চল্লিশ মিনিট বাকি এখন ও বিশাখাপত্তনম অর্থাৎ ভাইজ্যাগ পৌঁছতে। ছুটলাম দরজার দিকে। অ্যাটেন্ডেন্ট কে জিজ্ঞাসা করতে জানলাম ভাইজ্যাগ এসে গেছে। হুড়মুড় করে ছুটলাম ওদের ডাকতে। দেখলাম ওঁরা তৈরি হয়ে গেছে। সেই মেয়ের ঢুলু ঢুলু আঁখি।এ নিয়ে কবিরা অনেক কবিত্ব করেছেন। তবে আমার এখন কবিত্ব করার সময় নেই।
তাই বললাম——-মাসীমা আপনারা নিচে নেমে দাঁড়ান। আমি মাল পত্র নামাচ্ছি। মাল কুলির মাথায় চাপিয়ে আমরা স্টেশন চত্বর থেকে বেড়িয়ে পড়লাম। সেই তিরাশি সালের ওয়ালটেয়রের সাথে আজকের ভাইজ্যাগ কে মেলাতে পারলাম না আমি।সেই লাল মাটির আর উগ্র ফুলের গন্ধ ভরা ওয়ালটেয়র আর নেই।এ হলো কেতাদুরস্ত স্টেশন বিশাখাপত্তনম। অটোর সঙ্গে রফা হলো তিরিশ টাকায়। আমি সামনে বসতে গোল বাধল।ড্রাইভার এর কথায় সামনে কেউ বসলে পুলিশ ধরবে। অবশেষে ড্রাইভার বলল——-, নেনু ম্যানেজ চেস্তুন্নানু। শেষ অবধি ম্যানেজ হলো।পেছনেই বসলাম। মন্দাকিনীকে আজ বেশি ফর্সা লাগছে। পরণে কালো শাড়ি। সঙ্গে মানানসই ব্লাউজ। হঠাৎই চোখে পড়ল মন্দাকিনীর উড়ন্ত আঁচল বাইরে।ভয় হলো যদি কোন অঘটন ঘটে যায়!তাই বললাম,” আঁচল টা টেনে নাও।”
বহুদিন ওর সাথে কথা হয়নি। তাই কি সে চমকে উঠল?টেনে নিল আঁচল খানা।এবার ট্র্যাফিক মোড় নেমে দাঁড়ালাম আমি।মোড় পেরিয়ে আবার অটো তে বসলাম। আর পুলিশের মোড় পড়বে না।তাই গ্যাট হয়ে বসলাম। আবার সেই মেয়ের আঁচল খানা উড়ে এসেছে আমার কাছে। আমার কাছে উড়ে না এলে আমার কি সাধ্যি যে আমি তার আঁচল খানা দেখি!!কারণ আমিতো সামনে। তবে হ্যাঁ, কপাল গুনে ড্রাইভারের আয়নাটা আমার আর সেই মেয়ের দৃষ্টি চালাচালির পথ করে দিচ্ছে বলেই তো ওর চমকিত চোখ আমার চোখে পড়ছে। গাড়ি ব্রেক কষতেই আমার চিন্তাটা হোঁচট খেল জমজমাট শহরের রাস্তায়।সকালের মিঠে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। তাই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে আলো আঁধারের খেলা। এই বুঝি কৈলাশ গিরিরেঞ্জ। মনে হল পূর্ব ঘাট পর্বত মালার কথা। মালা ই বটে। খাঁজের পর খাঁজ তৈরি করেছে। মেশোমশায়ের কথায় সাড় ফিরল আমার। কথা বলতে বলতেই গাড়ি নিচের দিকে নামতে লাগল। দূর থেকে নজরে পড়ল দিগন্ত জোড়া সমুদ্র। গাড়ি নেমে চলেছে সমুদ্রের দিকে। মনে হল গাড়ি সমুদ্রে গড়িয়ে পড়বে। না তা হল না।সমুদ্রের পাশ দিয়েই আমরা গেস্ট হাউজে পৌঁছে গেলাম।
বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী -2
ঘর দেখে মাসীমা দারুণ খুশি। আর হবেনা ই বা কেন?ঘরের ভেতর থেকে উন্মুক্ত সমুদ্র তট রেখা, জাহাজ, ফেননীভ ঢেউ দেখতে কার না ভাল লাগে। আমি ঘরের ভেতরে না ঢুকে এগিয়ে গেলাম সাগর তীরে। সাগরের সঙ্গে এখানে পাহাড় কোলাকুলি করছে। আমি বুঝি জাগতিক স্তর থেকে মহাজাগতিক স্তরে পৌঁছে গেলাম। কতক্ষণ যে অমন ছিলাম জানিনা, পিঠে হাত পড়তেই চমকে ফিরলাম। মন্দাকিনী আর মেশোমশায়ের দৃষ্টিতে বিস্ময়। ———- তোমায় খুঁজে খুঁজে হন্নে হয়ে গেলাম। আর তুমি এখানে দাঁড়িয়ে!! বললাম—— ঐ দূরের পাহাড়টা দেখছেন ওই জায়গাটা অনেক ইতিহাস বহন করে চলেছে।ঐ পাহাড় কে এখন বলে ‘ডলফিন নোজ ‘। মেশোমশায় পাহাড় টা দেখে নিয়ে বললেন—– চল কাল সিটি ট্যুর এর জন্য একটা গাড়ির বন্দোবস্ত করে আসি। ওখানেই ব্রেক ফাস্ট সেরে নেব। আমি বললাম—-মাসীমা? মন্দাকিনী বলল—- মা স্নান না করে খায় না।দশটার মধ্যেই আমরা ফিরে আসব। তখন ই মায়ের খাবার টা নিয়ে আসব। কি বল বাবা? —– হ্যাঁ। তাই হবে। গাড়ির খবর পাওয়া গেলে ও মালিকের সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষায় বসে থাকতে হবে শুনে আমি মন্দা আর মেশোমশায়কে গেস্ট হাউজ এ ফিরে যেতে বললাম। কারণ মাসীমার খাওয়া হবে না ততক্ষণ যতক্ষণ আমরা গেস্ট হাউজ এ না পৌঁছব। দুপুরে খাওয়ার পর সবাই টেনে ঘুমিয়ে নিল। আমি ঘুমোইনি তা না। তবে সাগরের ডাকে আর ঘরে থাকতে পারছি না।তাই এক পা দু পা করে সমুদ্র মুখী এগিয়ে গেলাম। তবে বেশি দূরে যাবো বলে এগোইনি।কারণ একা যাবার অধিকার আমার নেই। আমার এখানে আসার মূল কারণ সেই মেয়ের দেখভাল করা। বেশ বড়সর একটা জাহাজ পোর্ট এর দিকে চলেছে। বড় বড় চৌকো বাক্স ভরা জাহাজ। কারগো ই হবে। পেছন থেকে মাসীমার গলা শুনলাম। ———– ঐ তো কেষ্টা!! বুঝলাম ওঁরা আমাকে খুঁজছিলেন। দেখে মনে হল তৈরি হয়েই এসেছেন। তাই বললাম—— আপনাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছি। রামকৃষ্ণ বিচ্ যাবেন তো? মাসীমা বললেন—–হ্যাঁ।চল। দেখলাম সবাই ধোপ দূরস্ত পোশাক পড়েছে। সেই মেয়ের পরনে গোলাপী চুড়িদার। গাঢ়-মিঠের ম্যাচিং এ চুড়িদার এর মোহময় রুপ খুলেছে। আমার দৃষ্টি তার দিকে হলেও সেই মেয়ের নজর কিন্ত চলমান জাহাজে।এটা কিন্ত কারগো নয়। যুদ্ধ জাহাজ। তিনটে আলাদা আলাদা জায়গা থেকে ধোঁয়া উঠে তিন টে লাইন করেছে।এ জাহাজ কিন্ত কারগো নয়। হয়তো বা যুদ্ধ জাহাজ ।দূর থেকে মনে হচ্ছে ঌটরপেডো বা কামান জাতীয় বসানো আছে ঐ জাহাজে।হয়তো বা টহল দারী জাহাজ। তাই শত্রুর সাথে মোকাবেলা করার ব্যবস্থা রেখেছে জাহাজে। তারমানে এটা নেভির জাহাজ। মেশোমশায় বললেন—মায়া হেঁটে যেতে পারবে তো? ——হ্যাঁ।একটু হাঁটা ভাল। আর..কে.বিচ. যখন আমরা পৌঁছলাম তখন কালী মন্দিরে ভক্তের ভীড়। মাসীমা এগিয়ে গেলেন মন্দিরের দিকে। আমরা এগুলাম উল্টো ফুট এ।যেখানে বাঁধানো আছে শ্বেত পাথরের বসার বেদী। দেখলাম মন্দাকিনী মাসীমাকে অনুসরন করল। আমরা মন্দিরের মুখোমুখি শ্বেত পাথরে বসে মা কালির রুপে মজে গেলাম। মেশোমশায় চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আরতী শুরু হলো।কানে আসছে শ্যামা সঙ্গীত। পবিত্র মন।একটু পরেই মাসীমা আর মন্দাকিনী মন্দির থেকে বেড়িয়ে এল।আমরা প্রসাদ পেলাম। সমুদ্র ঝলমল করছে জাহাজের আলোয়। বাইরে রাতের খাবার খেয়ে আমরা গেস্ট হাউজ এ ফিরলাম। মেশোমশায় বললেন—কেষ্টা,তাড়াতাড়ি শুয়ে পড় সকাল আটটায় গাড়ি আসবে। গাড়ি আসার কথা সকাল দশ টায়।কিন্তু এক ঘন্টা আগেই গাড়ি এসে দাঁড়াল গেস্ট হাউজ এ।শীত যায় যায় করেও যায়নি।তাই চারদিক কুয়াশার চাদরে মোরা।পাখির ডাক আর সমুদ্রের গর্জনে বিছানা থেকে উঠে পড়েছিলাম। গায়ে জামা চড়িয়ে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। বাইরে গাড়ি দেখে টোকা দিলাম পাশের ঘরে। তারপর বেড়িয়ে গেলাম রাস্তায় ।সমুদ্রকে উপভোগ করছি গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে। একটা ডুবে জাহাজ এগিয়ে আসছে। একটা কাঠের পাটাতনের উপর একটা কালো টুপি বলেই মনে হচ্ছে জাহাজ কে। গাড়ির হর্ন বাজতেই সে দিক ফিরলাম। দেখলাম মেশোমশায় এগিয়ে আসছেন গাড়ির দিকে। সবাই তৈরি ভেবেই সেদিকে এগুলাম। কারণ টুকটাক কিছু নেবার থাকলে আমার ই নিয়ে আসা উচিত। কিন্তু ততক্ষণে মাসীমা আর মন্দাকিনী নেমে এসেছে। মন্দাকিনীর হাতে একটা জলের বোতল আর একটা ঝোলা। আমি ওর ভার লাঘব করতে চাইলেও সে আমায় সেই সুযোগ দিল না। ঠিক হল আমরা প্রথমেই সিমহাচলম যাব।তারপর ঋষিকোন্ডা যাব। সেই মতই গাড়ি চলল।জগদম্বা জংশন এ গাড়ি দাঁড় করাল।—— আইদু মিনিট ম্যাডাম। বলেই গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। মন্দাকিনী বলল—-পরা লেদু বাবু। আমার টাক্ খাওয়া অবস্থা!!!এ ভাষা শিখল কি করে? মেশোমশায় বললেন—-তুই তেলেগু জানিস? আমি বললাম—-পরা লেদু টা কি? সেই মেয়ের অহংকারী মুখ। বলল—–ঐ আমরা যাকে পরোয়া নেই বলি।এই আর কি। ঘাড় ফিরিয়ে সেই মেয়ের চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া হাসি দেখলাম। আর তার বাবা যে মেয়ের গর্বে খুশি তা মেশোমশায়ের কথায় বোঝা গেল। ———এই তো বাপ কা বেটি। সেবার ওড়িশায় যাবার সময় ওড়িশার ভাষাটা রপ্ত করেছিলাম। তোমার মনে আছে কেষ্টা? ভাবলাম তা আবার মনে না থাকে!!পুরীর আনন্দ বাজারে ভোগ কিনতে গিয়ে যা নাকাল না হতে হয়েছিল!তা ভোলাবার নয়। মেশোমশায়কে কে যেন বলেছিল গোপাল সারঙ্গী বলে একটি ছেলে আনন্দ বাজারে বসে। তার কাছেই নাকি ভাল প্রসাদ কিনতে পাওয়া যায়। আনন্দ বাজারে প্রসাদের হাট বসে। বিক্রেতারা সবাই’ পন্ডা ‘।আমাদের ভাষাতে পান্ডা। মেশোমশায় আর আমি তাকে খোঁজ করলাম। অন্য বিক্রেতারা আমাদের ডাকাডাকি করলেও মেশোমশায়ের ইচ্ছা গোপালের প্রসাদ কেনার। আমি কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন—-দেখছো না সব ভাতের ভাড়ের মধ্যে আঙুলের ছাপ রয়েছে।তরকারির ভাড়ে ও পানের পিক ভরা আঙুলের ছোপ। পান্ডারা পানের পিক ভরা আঙুল মুখে ঢুকিয়ে চেখে দেখে কোনটা ভাল। ভালো দেখে তবে কেনে। —–সেকি মুখের এঁটো বিক্রি করে?ভাতে যে খয়েরী গর্ত!!ওটা কি পানের পিক? —–তাই তো গোপালের খোঁজ করা।গোপাল হাটে বসে না। কথা বলতে বলতে পান্ডা গোছের একজন কে জিজ্ঞেস করলেন—-এই যে ভাই এইঠু গোপাল সরঙ্গী অচ্ছন্তি?মানে গোপাল কি এখানে আছে? ভদ্রলোক বললেন—-এইঠু গোপাল নাহন্তি। আপন টিকে পাছর আসন্তু। সে কথা শুনে মেশোমশায় বেজায় খুশি। বললেন —–গোপাল এখন চান করছে। একটু ঘুরে ফিরে আমি বললাম—-চলুন মেশোমশায় এবার বোধহয় এসে গেছে। ভদ্রলোক কে জিজ্ঞেস করতেই রেগে গেলেন তিনি। ———আচ্ছা লোক তো আপনি। কি করে আনন্দ বাজারে বসে বলব গোপাল কি করছে? ‘———– আপনি যে বললেন গোপাল চান করছে। ————আমি বলেছিলাম গোপাল নাহন্তি। মানে নেই।আপনি ভেবেছেন নাহাচ্ছে। বাঙালিরা কোন ভাষা জানেনা। তবুও বাহাদুরি করবে। মেশোমশায়ের কথায় সাড় ফিরল। ——–কেষ্টা, কি ভাবছ? বললাম——পুরীর কথা। আবার ও বললেন—–এখন সিমহাচলম এর কথা ভাব। ভাবলাম,ঠিক ই বলেছেন মেশোমশায়।আমার এক বদ দোষ। সব সময়ই চিন্তা।আর যেই শুরু হল অমনি লাটাইয়ের সুতো ছাড়তে থাকি। যতক্ষণ না ভোকাট্টা হয়। সেই কবিতার কথা।পুরী যখন গেলাম মন্দাকিনীর তখন এগারো ক্লাস ।মন্দাকিনীর বি এ পাশ করে যাবার কথা। ওর পাকামির জন্য টিউশন ছাড়তে হল।কলকাতায় ফিরে ওদের বাড়ির টিউশন ছাড়ার পর দুটো টিউশন বদল করলাম। তবুও টাকার টান পড়ত যদি না ভারতী প্রকাশনীর থেকে মোটা টাকাটা পেতাম। তারপর পি থ্রি হান্ড্রেড ইউনিক পার্ক এর চিলে কোঠাকে আমার পাকাপাকি নিবাস বানিয়ে ফেললাম। তাতে সুবিধা হল ডক্টরেট করতে। ড্রাইভার গাড়িতে বসতে আমার চমক ফিরল। বললাম—–এন এইচ ফাইভ সে চলিয়ে। এই পথে কৈলাশ গিরিরেঞ্জ পড়বে। মনোরম দৃশ্য। আমরা চলেছি সিমহাচলম মন্দিরের পথে।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!