Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিশল্যকরণী (২০১০) || Samaresh Majumdar » Page 2

বিশল্যকরণী (২০১০) || Samaresh Majumdar

সিঁড়ির কয়েক ধাপ নেমে মেজর চারপাশে তাকালেন। এরকম কালো অন্ধকার তিনি এর আগেও অনেক দেখেছেন। এখন ঝিঁঝির ডাক ছাড়া কোনও আওয়াজ নেই। হাওয়া জঙ্গলের শরীরে অদ্ভুত বাজনা বাজাচ্ছে। কিছুক্ষণ কান পেতে থাকলে মনে অস্বস্তি জমে। নীচে টর্চের আলো ফেললেন মেজর। সাবধানে নীচে নেমে বাংলোর পিছন দিকে এগোলেন।

দূর থেকে একটা ঘরে আলো জ্বলতে দেখে মেজর বুঝলেন, ওখানে লছমন থাকে। অপদার্থ কেয়ারটেকার! বাংলোয় গেস্ট এলে ওর কর্তব্য তাদের যাতে অসুবিধে না হয় তা দেখা। অথচ লোকটা দরজা খুলেই গা-ঢাকা দিল। নিশ্চয়ই অন্য কোনও ধান্দা আছে ওর। অসুস্থতার ব্যাপারটা হয়তো ভান। বাংলোয় থাকার অনুমতি পাওয়ায় ওর নিশ্চয়ই কোনও অসুবিধে হবে।

মেজর ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভিতরে উঁকি দিলেন। একটা হারিকেন জ্বলছে। ঘরে আসবাব বলতে একটা খাঁটিয়া আর কেরাসিন কাঠের ছোট আলমারি ছাড়া কিছু নেই। অসুস্থ লোকটির তো এখানে শুয়ে থাকার কথা।

মেজর দরজা থেকে ফিরতেই চমকে উঠলেন। কোনওরকমে তাঁর মুখ থেকে শব্দ বের হল, হু হু?

আমি লছমন?

সঙ্গে সঙ্গে সংবিৎ ফিরে এল মেজরের। গলা চড়ল, তুমি এই অন্ধকারে কী করছ?

কুছ নেহি।

কুছ নেহি? তো ভূতের মতন কোত্থেকে এলে?

সঙ্গে সঙ্গে জিভে একটা শব্দ তুলল লছমন, ওই নামটা একদম মুখে আনবেন না সাহেব। ওঁরা হয়তো পছন্দ করবেন না।

ওরা মানে? কাদের কথা বলছ?

হঠাৎ চুপ করে গেল। মেজর দেখলেন, লছমন সোজা ঘরে ঢুকে খাঁটিয়ার উপর পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

লোকটি রহস্যময়। মাথা নাড়লেন মেজর। এই সময় বেশ জোরে হাওয়া বইতেই জঙ্গলের ভিতরে প্রবল শব্দ শুরু হল। মেজর দ্রুত ফিরে এলেন উপরে। বসার ঘরে ঢুকতেই শুনলেন, অমল সোম বললেন, না ভাই, আমি ভূত দেখিনি। যা দেখিনি তা আছে কি না কী করে বলব? তবে মানুষ মরে গিয়ে যদি ভূত হয়, তা হলে বাঘ, সিংহ, হাতি থেকে গোরু, ছাগল, পিঁপড়েরা মরে যাওয়ার পরে ভূত হবে না কেন?

স্টেফি হেসে ফেললেন, আমি বাঘের ভূতের গল্প পড়েছি। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, খ্রিস্টানরা নভেম্বর মাসের দু’তারিখ সন্ধেবেলায় বাড়ির সামনে লাউ ঝুলিয়ে ‘অল সোল্স ডে’ পালন করে।

মেজর ঘরের ভিতরে এসে চেয়ারে বসে বললেন, যা দ্যাখেননি তাই যদি অবিশ্বাসে থাকে, তা হলে তো আপনি ভগবানেও বিশ্বাস করেন না?

মাথা নাড়লেন অমল সোম, এ নিয়ে আমি তর্ক করব না।

মেজর বললেন, এই বাংলোটায় আমাদের সতর্ক হয়ে থাকতে হবে।

স্টেফি তাকালেন মেজরের দিকে। উনি যাতে বোঝেন, তাই মেজর কথাগুলো ইংরেজিতে বলেছিলেন। অমল সোম বললেন, সতর্ক হয়ে থাকা সবসময় ভাল।

আপনি আমার কথা বুঝতে পারছেন না। ওই যে লছমন, লোকটিকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। বলল, অসুস্থ। ভানুপ্রসাদকে সাহায্য করা ওর কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তা না করে অন্ধকারে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আমার কাছে ধরা পড়ে গিয়ে যেভাবে তাকাল, যে-কেউ ভয় পেয়ে যাবে। আমি ধমকে বলেছিলাম, ভূতের মতো কোত্থেকে এলে?’ তাতে কী বলল জানেন? বলল, ওই নামটা একদম মুখে আনবেন না সাহেব, ওঁরা পছন্দ করবেন না। বলে শুয়ে পড়ল।

পুরো সংলাপ ইংরেজিতে বলায় স্টেফি উত্তেজিত হলেন, ফ্যান্টাস্টিক। ওর কথা সত্যি হলে এই বাংলোয় ভূত আছে। ওঃ, আজ রাত্রে আমি জীবনে প্রথমবার ভূত দেখব!

.

রাত ন’টার মধ্যে মাংস-ভাত আর স্যালাড দিয়ে ডিনার শেষ হয়ে গেল ওঁদের। খাবার টেবিলে দিয়ে ভানুপ্রসাদ খেতে যাচ্ছিল, সিঁড়িতে শব্দ হল। ভালুপ্রসাদ বারান্দায় যেতেই লছমন একটা থালা এগিয়ে দিল নিঃশব্দে।

সেটা নিয়ে ভিতরে ঢুকে সে অর্জুনকে বলল, চৌকিদার খাবার চাইছে।

দিয়ে দাও। অর্জুন বলল।

খেতে শুরু করে মেজর বললেন, আমি হলে দিতাম না। নো ওয়ার্ক, নো ফুড। লোকটি ভয়ংকর রহস্যজনক।

খাওয়া শেষ হলে ভালুপ্রসাদ এসে টেবিল পরিষ্কার করে চলে গেলে স্টেফি বললেন, আচ্ছা, আমরা এখন অনেকক্ষণ ধরে জেগে গল্প করতে পারি না?

মেজর বললেন, নো ওয়ে। আমি খুব টায়ার্ড, শুলেই ঘুমিয়ে পড়ব।

স্টেফি বিরক্ত হলেন, প্লেন যতক্ষণ উড়ছিল ততক্ষণ আপনি ঘুমিয়েছেন। আমি যে বই পড়ে জেগে থাকব তারও উপায় নেই। এত কম আলো!

অমল সোম বললেন, তুমি যে জন্যে জাগতে চাইছ সেটা যদি সত্যি হয়, তা হলে জাগার দরকার নেই। এমনিই ঘুম ভেঙে যাবে।

চারজন তিনটে ঘরে চলে গেলেন। ভানুপ্রসাদও মাঝের ঘরে শুয়ে পড়ল। অমল সোম তাঁর খাটে শুয়ে পড়ে বললেন, হাওয়া না বইলে জঙ্গল কি ভয়ানক চুপচাপ হয়ে যায়, লক্ষ করেছ?

হ্যাঁ।

গুড নাইট। তিনি দেওয়ালের দিকে পাশ ফিরলেন।

অর্জুনের এত তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছিল না। সে প্রায় নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতেই জঙ্গলের ওপাশের আকাশে এক মায়াময় আলো দেখতে পেল। বড় বড় গাছের ভিতরে গভীর কালো অন্ধকার। কিন্তু তাদের মাথা ডিঙিয়ে সেই আলো উঠছে আকাশে। বারান্দাটা এখন অন্ধকারে মোড়া। সবক’টা দরজা বন্ধ। অর্জুন নিঃশব্দে শেষ প্রান্তে চলে আসতেই মনে হল, ওই আলো গাছের মাথাগুলো ডিঙিয়ে ছড়িয়ে পড়ল এদিকে। কুমড়োর ফালির মতো চাঁদ দেখা গেল দূর-আকাশে। আলো পড়তেই বাংলোর বাগান, গেট, এমনকী বারান্দার কিছু অংশ দৃশ্যমান হল। এই আলো নেহাতই নেতানো, কোনও তেজ নেই। আর তখনই মৃদু বাতাস বইতে শুরু করল। অর্জুনের খুব ভাল লাগছিল। বারান্দার শেষ প্রান্তে রাখা টুলটা টেনে নিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসল।

ওপাশ থেকে বাতাস বইতেই অদ্ভুত মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল। নিশ্চয়ই জঙ্গলে ফোঁটা কোনও ফুল। অবশ্যই একরাশ ফুল। দিকটা দেখে রাখল অর্জুন। কাল সকালে গিয়ে দেখতে হবে ফুলগুলোকে। জ্যোৎস্না ফুটতেই ঝিঁঝিরা ডেকে উঠেছিল। এখন যেন ওরা পরস্পরের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। যেন কে কত জোরে ডাকতে পারে তার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। অর্জুনের মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের সেই গানটার লাইন, মায়ালোক হতে ছায়া তরণী! এই সময় তার সামনের ভুবনকে মায়ালোক ছাড়া আর কী বলা যায়?

দেখতে দেখতে একটা সময় চোখ বুজে এসেছিল, হঠাৎ চাপা গলার ধমক শুনে চোখ খুলে সোজা হয়ে বসল অর্জুন। গেট খোলা। কেউ একজন কাতর গলায় কিছু বলছে। তারপরেই তিনটে লোককে দেখতে পেল সে। পিছন থেকে দেখল বলে মুখ অদেখা রইল। তিনজন বেরিয়ে গিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল। এবার লছমনকে দেখল সে। ধীরে ধীরে এসে গেট বন্ধ করল। তারপর চোরের মতো বাংলোর দোতলার দিকে তাকাল। রেলিং-এর আড়ালে বসে থাকার জন্যে অর্জুনকে লক্ষ করল না। ফিরে গেল লছমন।

ব্যাপারটা বোধগম্য হল না অর্জুনের। এই লোক তিনটে কারা? কেন এত রাত্রে জঙ্গল ফুড়ে এখানে এসেছিল? লছমনকে ধমকাচ্ছিল কেন? ওদের সামনে লছমন ক্ষমা-চাওয়া গলায় কথা বলছিল কেন? লছমন যে ওদের কাছে দুর্বল তা স্পষ্ট, কিন্তু কেন? ওরা আসবে বলেই কি লছমন ভূতের ভয়। দেখাতে চেয়েছিল? বিকেলে যখন অর্জুন এখানে থাকার কথা বলেছিল, তখন খুশি হয়নি ও। বারবার চলে যাওয়ার কথা বলছিল। অর্জুন অনুমান করল, লছমনের এই কীর্তিকলাপের কথা ওর মালিক সুধাংশুশেখর দত্ত জানেন না।

আরও আধঘণ্টা বসে থেকে অর্জুন উঠে দাঁড়াল। এখন চাঁদের আলো একটু-একটু করে কমছে। জঙ্গলের ওপার থেকে কালচে মেঘের টুকরো ভেসে আসছে চাঁদের নীচে। আসামাত্র আলো প্রায় নিভে যাচ্ছে। কিন্তু সেই মেঘ সরে দ্বিতীয়টি আসার মধ্যে যে সময়, তাতে আবার আলো উজ্জ্বল হচ্ছে। অর্জুন নীচে নেমে এল। ঘাসের উপর পা রাখতেই একটা রাতের পাখি কর্কশ স্বরে এমন চিৎকার করল যে, হকচকিয়ে গেল সে। পাখিগুলো নিশ্চয়ই মানুষ চেনে। লছমন অথবা তিনটে লোককে দেখে ওই পাখি একবারও মুখ খোলেনি।

লছমনের ঘরে হ্যারিকেনের আলো একদম কমানো। যেন নিভে না যায় তেমনভাবে জ্বালানো। ঘরে লছমন নেই। কোথায় গেল লোকটি? অর্জুন চারপাশে তাকাল। ঘষা কাঁচের মতো জ্যোৎস্নায় গাছগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন জাতীয়সংগীত শুনছে। সে ধীরে ধীরে নদীর দিকে এগোতেই কানে শব্দটা এল। কেউ কাঁদছে। হয় কোনও বালক অথবা নারী। কান্নাটা কয়েক সেকেন্ড পরেই থেমে যাচ্ছে। আবার হচ্ছে। অর্জুনের মনে হল, এই কান্না কোনও মানুষের নয়। এই গভীর নির্জন জঙ্গলে মাঝরাতে কোনও মানুষ কেন এখানে এসে কাঁদবে? আসবেই বা কী করে? বিশেষ করে সে যদি নারী বা বালক হয়! প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে ঘরে ফিরে এল সে। অমল সোম তখন গভীর ঘুমে।

.

অর্জুনের ঘুম ভেঙেছিল একটু দেরিতে। জানলা দিয়ে হালকা রোদ ঢুকছিল ঘরে। বাড়িতে থাকলে বিছানায় বেশিক্ষণ সে থাকতে পারে না ঘুম ভেঙে গেলে। এখানে মনে হল, আর-একটু আরাম করা যাক। সে পাশের খাটের দিকে তাকাল। ওটা শুধু খালি নয়, বেডকভার টানটান ছড়ানো। ওই দৃশ্য দেখার পর আর আরাম করা হল না। বাথরুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিল সে। তারপর বারমুডা আর টিশার্ট পরে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই দেখল, ভানুপ্ৰসাদ নীচের লনে গাড়ি মুছছে। তাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, চা খাবেন সাহেব?

হয়ে গিয়েছে?

হ্যাঁ। একটু আগে মেমসাহেব আর সোমসাহেব চা খেয়ে বেড়াতে গিয়েছেন।

ও। মাথা নাড়ল অর্জুন, দাও।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছিল সে। এখন জঙ্গলের চেহারাই আলাদা। সোনা সোনা রোদে ঝলমল করছে গাছের পাতা। বেড়াবার পক্ষে চমৎকার সময়। চা শেষ করে মেজরের ঘরের সামনে গেল অর্জুন। দরজা বন্ধ। ভিতর থেকে করুণ ধ্বনি ভেসে আসছে। সারারাত ডেকে ডেকে আর বোধ হয় মেজরের নাক তার শক্তি হারিয়েছে।

অর্জুন বাংলো থেকে নেমে নদীর দিকে যেতে যেতে দেখল, লছমন লনের ঘাস কাটছে। চোখাচোখি হল। কিন্তু অর্জুন মুখ ঘুরিয়ে নিল। লোকটির সঙ্গে পরে কথা বলা যাবে। বাংলোর পিছন থেকে নদীতে যাওয়ার কোনও বাঁধানো পথ নেই, কিন্তু যাওয়া-আসা থাকায় ঘাসের উপর দাগ পড়ে গিয়েছে। কয়েক সেকেন্ড হাঁটতেই ওপাশে পাহাড় আর এদিকে নদী দেখতে পেল সে। নদী না বলে ঝরনা বলাই ভাল। দ্রুত বয়ে যাচ্ছে নুড়িপাথর সরিয়ে। জল হাঁটুর উপরে নয়। অর্জুন জলের গায়ে এসে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে একটা বড় সাইজের ব্যাং ডাঙা থেকে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। জল ছিটকে উঠল একটু। অর্জুন একটা চ্যাপটা পাথর তুলে আড়াআড়ি ছুঁড়তেই সেটা জল চিরে চিরে পৌঁছে গেল ওপারে। তারপরেই একটা চাপা আর্তনাদ কানে এল অর্জুনের। পাথরটা ঢুকে গিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে। ওটা কি কারও গায়ে আঘাত করেছে? কৌতূহল হল। অর্জুন ঝরনা ডিঙিয়ে জঙ্গলের ওই অংশ দেখবে বলে পা বাড়াতেই পিছন থেকে গলা ভেসে এল, যাবেন না বাবু!

ঘাড় ঘুরিয়ে অর্জুন দেখল, লছমন দাঁড়িয়ে আছে পিছনে। সে বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল, কেন? নদীর ওপারে যেতে নিষেধ করছ কেন?

কোনও জানেনায়ার আপনার ছোঁড়া পাথরে চোট পেয়েছে। চোট পাওয়া জানোয়ারকে বিশ্বাস করা যায় না। খুব ভয়ংকর হয়। নির্বিকার মুখে বলল লছমন।

অর্জুন ওপারের জঙ্গলের দিকে তাকাল। কোনও শব্দ নেই। গাছ বা পাতারা এখন একটুও দুলছে না। অত ছোট পাথর যা জল ছুঁয়ে গিয়েছিল, তার আঘাতে এমন কোনও জোর থাকতেই পারে না যে, একটা জানোয়ার আহত হতে পারে!

ঠিক আছে, তুমি যখন বলছ তখন যাব না। অর্জুন উপরে উঠে এসে লছমনের পাশে দাঁড়াল, তুমি কতদিন আছ এখানে?

চোখ বন্ধ করল লছমন। তারপর বলল, বাইশ বছর।

অনেকদিন। এই রকম একা-একা থাকতে ভাল লাগে?

পেটের উপর বাঁ হাত রাখল লছমন, পেটের দায় বড় দায় বাবু!

হুঁ। তা তোমার এই বাংলোয় হিংস্র জানোয়াররা ঢুকে পড়ে?

বেড়া আছে বলে কেউ টপকায় না। তবে হাতিরা কয়েকবার বেড়া ভেঙে ঢুকেছিল।

তোমার কাছে বন্দুক নেই?

না।

কাল বিকেলে এতটা জঙ্গল ভেঙে আসতে আমাদের ভয় করছিল। রাত্রে কেউ নিশ্চয়ই এখানে আসবে না। আমি মানুষের কথা বলছি।

দরকার ছাড়া কেউ দিনেরবেলাতেই জঙ্গলে ঢোকে না। রাত্রে আসবে, প্রাণের ভয় নেই? বেশ জোরে প্রশ্নটা করেই গলা নামাল লছমন, বাবু, বাঘ, বাইসন, গন্ডার, হাতির সঙ্গে বুদ্ধি খরচ করে লড়াই করা যায়। হাজার হোক, ওরা জানোয়ার। মানুষের বুদ্ধির সঙ্গে পারবে কেন? কিন্তু ওই দু’জনের কাছে বুদ্ধির কোনও মূল্য নেই। ওদের ভয়ে তো কাঁটা হয়ে থাকি। তবু, আমাকে তো বাইশ বছর ধরে দেখছেন ওঁরা। একসঙ্গে থাকি বলে হয়তো আমাকে দয়া করেন। কিন্তু আপনারা নতুন নোক, সেটাই তো আমার ভয়। তাই কাল বলেছিলাম, এখান থেকে চলে যেতে। আচ্ছা…! চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়াল সে।

অর্জুন ডাকল, দাঁড়াও। তুমি যে দু’জনের ভয় পাচ্ছ তারা কারা?

লছমন মাথা নাড়ল, আমি জানতাম আপনি এই প্রশ্নটা করবেন। কিন্তু মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল। সে মাথা উঁচু করে চারপাশে তাকাল। এখনও সূর্য গাছের আড়ালে। নদীর মাঝখানে রোদ পড়লেও এ পাশটা গাছের ছায়ায় ঢাকা। দমকা বাতাস বয়ে গেল। লছমন বলল, এখন দিনেরবেলা। রাত হলে বলতাম না। মা মনসার আশীর্বাদ যাদের উপরে তারা মারতে চাইলে লৌহবাসরে ঢুকে লখীন্দরকেও মেরে আসে। জলে স্থলে গাছে ওরা স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়। এই যে আপনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার দশ হাত উপরে যে শাল গাছের ডালটা ঝুলছে, তা থেকে লাফিয়ে নেমে আপনার চাঁদিতে ছোবল মেরে যেতে পারে। টের পাওয়ার আগেই আপনি মরে যাবেন।

তুমি সাপ শব্দটা উচ্চারণ করছ না কেন?

মুখে নামটা আনতে নেই, তাই রাত্রে যখন হাঁটতে হয় তখন মনে মনে ‘অস্তি অস্তি’ বলি। অস্তি নাম যে উচ্চারণ করে তাকে ওরা কামড়ায় না।

বুঝলাম। দ্বিতীয়জন কে?

আপনারা শহরের মানুষ, বিশ্বাস করবেন না।

আমি বিশ্বাস যদি না-ও করি, তবু তোমার বিশ্বাসকে অসম্মান করব না।

এই জঙ্গলে তেনারা আছেন। আমি দু’জনকে জানি। নিশুতি রাত্রে ওই বাংলোর ছাদে পা ঝুলিয়ে বসেন। তবে আমার পরে তেনারা এসেছেন বলে, আমাকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষ পড়লে তেনারা ভয়ংকর হয়ে ওঠেন। ওই পনেরোদিন আমি বিকেল শেষ হলেই ঘরের দরজা বন্ধ করে হরি নাম জপ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ি। ভুলেও ঘরের বাইরে যাই না। কথা শেষ করে লোকটি উদাস পায়ে চলে গেল।

অর্জুন হাসল। আবার ভয় দেখাল লছমন। সে ওকে জিজ্ঞেস করতে পারত, কাল রাত্রে কারা এসে ওর উপর রাগারাগি করছিল? কী করে ওরা রাত্রে এই জঙ্গলে ঢুকল?

প্রশ্নগুলো করাই যেত। কিন্তু লোকটিকে এত তাড়াতাড়ি কোণঠাসা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এই সময় স্টেফির গলার হাসি শুনতে পেল অর্জুন। সে এগিয়ে গিয়ে দেখল, বাড়ির সামনের গেটে স্টেফি আর অমল সোম দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। স্টেফির হাতে একগোছ পাতাসুদ্ধ লতা। সে গলা তুলে জিজ্ঞেস করল, পেয়েছ?

পেয়েছি। কিন্তু সোম বলছেন উনি সন্তুষ্ট নন।

কাছে গিয়ে বিশল্যকরণী পাতাগুলোকে দেখল অর্জুন। পাতার রং তেমন গাঢ় নয়। সে জিজ্ঞেস করল, কোথায় পেলেন?

অমল সোম হাত তুলে জঙ্গলের একটা অংশ দেখালেন, হাঁটতে গিয়ে চোখে পড়ল। দশ-বারোটা লতা রয়ে গিয়েছে ওখানে। কিন্তু এগুলো আসল বিশল্যকরণী নয়। শরীরের কোথাও ছড়ে গেলে এর রসে কাজ হয় বটে, কিন্তু আসল বিশল্যকরণী মিরাল করে।

অর্জুন বলল, এদের যখন পাওয়া গিয়েছে তখন তাদেরও পাওয়া যাবে। স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ওখানে তো অনেক বুনো গাছের ভিড়। তার মধ্যে এই ক’টা কী করে জন্মাবে?

অমল সোম বললেন, প্রকৃতির খেয়াল। কিন্তু অর্জুন, স্টেফি বেশ মার খেয়েছে।

মার খেয়েছে? কার কাছে?

স্টেফির মুখে কপট রাগ ফুটল, এত দুষ্টু বাঁদর আমি কখনও দেখিনি। যখন এই পাতাগুলো ছিঁড়ছিলাম, তখন ওরা গাছের ডালে বসে ফল ছুঁড়ে আমাকে মারছিল।

ওঁরা কথা বলতে-বলতে বাংলোর সামনে চলে এসেছিলেন। হঠাৎ উপর থেকে গলা ভেসে এল, ওই চৌকিদারের কাছে ছাতা আছে কি না জিজ্ঞেস করুন না!

ওঁরা উপরে তাকাতেই মেজর বারান্দার রেলিং-এ চলে এলেন। অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, বৃষ্টির তো সম্ভাবনা নেই। ছাতি নিয়ে কী করবেন?

স্টেফির জন্যে ছাতা দরকার। ও যখন আবার জঙ্গলে ঢুকবে, তখন ছাতি খুলে রাখলে বাঁদরগুলো বোকা বনে যাবে। মেজর হাসলেন।

স্টেফি ধমক দিলেন, বোকা বোকা কথা বলবেন না। তারপর অমল সোমের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, আমরা কখন ঠিক-পাতা খুঁজতে বের হব?

ব্রেকফাস্ট না করে আমি কোথাও বেরোচ্ছি না। মেজর ঘোষণা করলেন দোতলায় দাঁড়িয়ে।

অমল সোম হেসে ফেললেন, বেশ। তাই হোক।

.

ব্রেকফাস্ট করতে করতে আলোচনা হচ্ছিল, ভানুপ্রসাদ যদি ড্রাইভারি না করে রান্নার কাজ করত, তা হলে অনেক বেশি নাম করত। দুপুরের মেনু কী হবে জিজ্ঞেস করতে ভানুপ্রসাদ সলজ্জ হাসি হেসে বলল, দেখি, ধরতে পারি কি না!

কী ধরবে তুমি? অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন।

এসব নদীতে অনেক মাছ থাকে। কোনও একটা কায়দা করে ধরতে পারলে আপনাদের দুপুরবেলায় মাছ-ভাত খাওয়াব। ভানুপ্রসাদ চলে গেল।

মেজর বললেন, ইন্টারেস্টিং। ঢাল-তলোয়ার নেই তবু যুদ্ধ করতে চাইছে। না, আপনারা পাতা খুঁজতে যান, আমি ভানুপ্রসাদের সঙ্গে মাছ ধরব। সেই ছেলেবেলায় একবার ছিপ ফেলে পুঁটিমাছ ধরেছিলাম। বাই দ্য ওয়ে, এই নদীতে কী কী মাছ আছে?

অমল সোম বললেন, বেশিরভাগ মাছের এখনও নামকরণ হয়নি। ধরার পর আপনি নাম রাখতে পারেন। মৎস্য দফতরকে জানিয়ে দিলে ওরা রেকর্ড করে রাখবে।

.

স্টেফি তৈরি হয়ে এলেন। জিনস, টিশার্ট, স্পোর্টস শু, মাথায় ক্যাপ। অমল সোমের পরনে সাদামাটা প্যান্ট-শার্ট। অর্জুন ইচ্ছে করেই হাফপ্যান্ট আর টিশার্ট পরেছে, পায়ে কে। ওঁরা যখন গেটের দিকে এগোচ্ছিলেন তখন লছমন সামনে এসে দাঁড়াল, কোথাও যাচ্ছেন আপনারা?

অর্জুন বলল, হ্যাঁ।

বেশি দূরে যাবেন না। ওপাশের রাস্তায় চিতার টাটকা পায়ের ছাপ দেখে এলাম।

এই জঙ্গলে চিতা আছে? অমল সোম ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ সাহেব। বড় বাঘ নেই, কিন্তু চিতা আছে।

অর্জুন হাসল, তা হলে তো দারুণ জায়গা! চিতা, সাপ, হাতি, বাইসন, গন্ডার থেকে শুরু করে সেই তেনারা এখানে বসবাস করেন।

অমল সোমের কপালে ভাঁজ পড়ল, তেনারা মানে?

যাঁরা রাতদুপুরে বাংলোর ছাদে পা ঝুলিয়ে বসে থাকেন।

রাবিশ! অমল সোম হাঁটতে লাগলেন। ওঁরা সঙ্গী হলেন।

স্টেফি আগে জঙ্গলে ঢুকলেন। ডুয়ার্সের এই জঙ্গল সুন্দরবনের মতো অগম্য নয়। বৃষ্টি না হলে গাছের নীচের মাটি শুকনো থাকে। সমস্যা হয় বুনো ঝোঁপগুলো কাঁটাভরতি ডালগুলো বুক বরাবর ছড়িয়ে রাখে। সেগুলো সরাতে ওঁরা গাছের ডাল ভেঙে লাঠি করে নিয়েছিলেন। তাই দিয়ে ডাল সরিয়ে হেঁটে নজর রাখছিলেন নীচে, বিশল্যকরণী পাতার খোঁজে। মাথার উপর বাঁদরগুলো সমানে চেঁচামেচি চালিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎ কানে অদ্ভুত শব্দ ধাক্কা মারতেই অর্জুন হাত নেড়ে দু’জনকে থামতে বলল। অমল সোম শুনলেন। তারপর বললেন, গাছ কাটা হচ্ছে। বেশি দুরে নয়।

স্টেফি জিজ্ঞেস করলেন, গাছ কাটছে কেন?

অর্জুন বলল, বুড়ো গাছ ঝড়ে পড়ে গেলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট তা কেটে নিয়ে যায়। কিন্তু তারা যখন গাছ কাটে তখন দূর থেকেই তাদের হইচই শোনা যায়। শুধু একটা যান্ত্রিক আওয়াজ ছাড়া কোনও মানুষের গলা পাচ্ছি না। চোরা কাঠশিকারি নয় তো?

অমল সোম বললেন, চলো, নিঃশব্দে একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি?

ওঁরা যত এগোচ্ছিলেন তত আওয়াজটা বাড়ছিল। একটানা, ঘষঘষ আওয়াজ। আরও এগিয়ে যেতে ওদের দেখতে পাওয়া গেল। একটা মোটা মেহগনি গাছের প্রায় গোড়ায় যে করাত চালানো হচ্ছে, সেটা হাতে ব্যবহার করা হচ্ছে না। একটা ছোট জেনারেটারের সাহায্যে ওই বিদ্যুৎচালিত করাত চালানো হচ্ছে। সাধারণত চালু করলে জেনারেটার যে আওয়াজ তোলে, ওটা তা করছে না। সম্ভবত সাইলেন্সার ব্যবহার করা হয়েছে। পাঁচজন লোককে দেখা গেল। একজন তদারকি করছে, বাকি চারজন কাজে ব্যস্ত। এরা যে সরকারি কর্মচারী নয় তা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। কিন্তু অর্জুন বুঝতে পারছিল না এই গভীর জঙ্গলের ভিতরে গাছ কেটে ওরা বাইরে নিয়ে যাবে কী করে? আশপাশে কোনও ট্রাক বা লরি চোখে পড়ল না। অর্জুন নিচু গলায় অমল সোমকে জিজ্ঞেস করল, কী করবেন?

ওদের কাছে অস্ত্র থাকবেই। মুখোমুখি হয়ে কোনও লাভ হবে না।

হঠাৎ স্টেফি চিৎকার করে উঠলেন, ওই যে, ওখানে। ওই গাছের নীচে।

অর্জুন চকিতে দেখতে পেল, স্টেফি আঙুল তুলে কাছের একটা ঝোঁপ দেখাচ্ছেন, যেখানে বিশল্যকরণী জঙ্গল পেঁচিয়ে আছে। কিন্তু ওঁর গলার আওয়াজ পেয়ে গিয়েছে গাছকাটা লোকগুলো। সঙ্গে সঙ্গে জেনারেটার থামিয়ে দিল একজন। বন্দুক বের করল দু’জন। সতর্ক ভঙ্গিতে আওয়াজটা কোন দিক থেকে এসেছে তা বোঝার চেষ্টা করছিল ওরা। ঠিক তখনই অমল সোম পকেট থেকে একটা হুইসল বের করে ঘনঘন বাজাতে লাগালেন। লোকগুলো পরস্পরের দিকে হকচকিয়ে তাকিয়েই ছোট্ট জেনারেটার তুলে নিয়ে দৌড়োতে লাগল উলটো দিকে। তারপরেই গাড়ির শব্দ শোনা গেল। শব্দটা চলে গেল দূরে।

অর্জুন হেসে ফেলল, হুইসলটা কী ভেবে নিয়ে বেরিয়েছিলেন?

অমল সোম হাসলেন, এটা বাজিয়ে বাঁদর তাড়াব বলে ভেবেছিলাম। চলো, দেখা যাক!

ওঁরা প্রায় কেটে ফেলা গাছটার কাছে গিয়ে ইলেকট্রিক করাতটাকে দেখতে পেলেন। তাড়াহুড়োয় ওরা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি। অমল সোম বললেন, এই ঘটনার কথা ডি এফ ও-কে জানাতে হয়। পকেট থেকে সেলফোন বের করে বোম টিপে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন, লাইন পাওয়া যাবে। অমল সোম ডি এফ ও-কে ফোন করে চোরা কাঠশিকারিদের কথা জানালেন। তাঁর বাঁশিকে পুলিশের বাঁশি ভেবে ওরা পালিয়েছে বটে, কিন্তু ফিরে আসতে দেরি করবে না। গাছটা ঠিক কোথায় তার বর্ণনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

সেলফোন রেখে অমল সোম জিজ্ঞেস করলেন, এই গাছটার দাম আন্দাজ করতে পারো?

না।

অন্তত লাখ পাঁচেক হবে। এই যে জঙ্গলের গভীরে ঢুকে ওরা গাছটা কাটতে চাইছিল, তা কখনওই সম্ভব হত না, যদি লোকাল সরকারি কর্মচারীদের মৌন সম্মতি না থাকত। ডি এফ ও বললেন, আধঘণ্টার মধ্যে লোকজন এখানে চলে আসবে। স্টেফি কোথায়?

স্টেফিকে আশপাশে দেখা যাচ্ছিল না। ওঁরা সেই জায়গায় পৌঁছে দেখতে পেলেন, বুনো ঝোঁপের মধ্যে ঢুকে বিশল্যকরণীর পাতা ছিঁড়ে আর বেরোতে পারছেন না বুনো ডালের কাঁটায় আটকে গিয়ে। অমল সোম বললেন, অভিমন্যুর মতো অবস্থা! যাও সাহায্য করো।

বেশ সময় লাগল কাঁটা ছাড়িয়ে স্টেফিকে বের করে আনতে। ওঁর শরীরে বেশ কয়েকটি জায়গা ছড়ে গিয়েছে। কনুই-এর পাশ দিয়ে রক্ত গড়াচ্ছে। কিন্তু ওসব নিয়ে ব্যস্ত না হয়ে অমল সোমকে পাতাগুলো দেখালেন স্টেফি উত্তেজিত হয়ে, দেখুন, এই পাতাগুলো আগেরগুলোর চেয়ে একটু বেশি গাঢ়।

অমল সোম মাথা নাড়লেন, ঠিক। আমার মনে হয় এদিকেই সেই পাতাগুলোকে পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু আপাতত এটুকুই, চলো, ফিরে যাই।।

স্টেফি আপত্তি করলেন, কেন? এখন তো সবে সাড়ে এগারোটা?

আমরা আবার বিকেলের আগে আসব। এখনই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজন পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে এখানে আসবে। ওরা ওদের কাজ করুক, আমাদের দেখলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে বিব্রত করবে।

অমল সোমের সিদ্ধান্ত পছন্দ না হলেও স্টেফি তাঁকে অনুসরণ করলেন। ওঁদের পিছনে হাঁটতে হাঁটতে অর্জুনের মনে হল, এই পাতাগুলো এখানে অবহেলায় পড়ে আছে অথচ এখানকার কেউ মাথা ঘামায়নি। কেন?

.

বারমুডা, গেঞ্জি, মাথায় টুপি পরে মেজর অনেকক্ষণ জলের ধারে দাঁড়িয়ে ভানুপ্রসাদের মাছধরা দেখছিলেন। শেষপর্যন্ত উত্তেজনা বাড়তে তিনিও জলে নেমে পড়লেন। বেশ স্রোত এবং ঠান্ডা জল। ভানুপ্রসাদ পাথর সরিয়ে জলের ধারাকে মূল স্রোত থেকে আলাদা করে দিতে চাইছিল, কিন্তু সক্ষম হচ্ছিল না। মেজর তার সঙ্গে হাত লাগালেন। একেবারে বালক হয়ে গেলেন তিনি। পাথরগুলোর খাঁজে বালি গুঁজে দেওয়ার পর জলস্রোত আলাদা হল। সেই স্রোত যেখান দিয়ে নেমে আবার মূল স্রোতে মিশে যাচ্ছে, সেখানে দু’পাশে দুটো কাঠি পুঁতে তাতে কাপড় টাঙিয়ে দিল ভানুপ্রসাদ। সঙ্গে সঙ্গে কাপড় ফুলেফেঁপে কাঠি উপড়ে দিল। তখন মেজর এগিয়ে গিয়ে কাপড়ের একপ্রান্ত ধরলেন চেপে, অন্য প্রান্ত ভানুপ্রসাদের হাতে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একঝাঁক মাছ যেন আত্মহত্যা করতেই কাপড়ের মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ল। ওঁরা দুজনে একসঙ্গে কাপড়ের দুই প্রান্ত তুলে শুকনো নুড়িপাথরের উপর নিয়ে এসে দেখলেন, কড়ে আঙুল থেকে তর্জনীর সাইজের মাছ ভয়ে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। ভানুপ্রসাদ গুনে দেখল, ন’টা মাছ পাওয়া গিয়েছে। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে গোটা পঞ্চাশেক মাছকে কবজা করে ভালুপ্রসাদ বলল, এতেই হয়ে যাবে সাব। খুব মিঠা মাছ।

কাপড়ে জড়িয়ে সে পারের দিকে হাঁটতে লাগল। এভাবে মাছ ধরার আনন্দ কখনও পাননি মেজর। এত তাড়াতাড়ি মাছ ধরার আনন্দ ফুরিয়ে যাওয়াটা পছন্দ হল না তাঁর। ইতিমধ্যে বারমুডা ভিজে গিয়েছে, গেঞ্জির খানিকটা। আরও কিছুক্ষণ জলে থাকতে ইচ্ছে হওয়ায় না ফিরে গিয়ে স্রোত ধরে হাঁটতে লাগলেন। জল ক্রমশ হাঁটু ছাড়িয়ে কোমরের কাছাকাছি চলে এল। মেজর বুঝলেন, এখন এর বেশি জল নদীতে নেই। হাঁটতে হাঁটতে উলটো দিকে চলে গিয়েছিলেন মেজর। নুড়িপাথরের উপর খালি পায়ে হাঁটার যে মজা তা এই প্রথম পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। হঠাৎ চোখে পড়ল, একটা খরগোশের বাচ্চা মুখ নামিয়ে জল খাচ্ছে পারের প্রান্তে এসে। তিনি এগিয়ে যেতেই বাচ্চাটা ছুট লাগাল। বেচারা ভয়ে এমন কানা হয়ে গিয়েছিল যে, একটা বড় পাথরে ধাক্কা খেয়ে গড়িয়ে পড়ল কিছুটা। চারটে পা উপরে তুলে চিত হয়ে রইল একটু। তারপর আবার উলটে সোজা হয়ে টলতে টলতে ঢুকে গেল জঙ্গলের মধ্যে। যেন একটা মজার খেলা পেয়েছেন এভাবে বাচ্চাটাকে অনুসরণ করলেন মেজর।

বাচ্চাটাকে আর দেখতে পেলেন না মেজর। কিন্তু যা দেখলেন তাতে তাঁর চক্ষুস্থির। ইটের উনুন, দুটো হাঁড়ি, গোটানো বিছানা। বোঝাই যাচ্ছে এই জায়গা কোনও মানুষের সংসার। অথচ মানুষটা ধারেকাছে নেই। উপরে বড় বড় পাতার গাছ যেন ছাউনি করে দাঁড়িয়ে আছে। যে এখানে থাকে সে নিশ্চয়ই তার থাকাটা গোপন রাখতে চায়। কিন্তু কেন? এই জঙ্গলের মধ্যে যে-কোনও মুহূর্তে বিপদ ঘটতে পারে। বৃষ্টি নামলে পাতাগুলো যতই বড় হোক, কতক্ষণ তাকে শুকনো রাখতে পারবে! মেজরের মনে হল, লোকটা নির্ঘাত ক্রিমিনাল। পুলিশকে এড়িয়ে এই জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। হয়তো পুলিশের খাতায় ওর নাম একজন ভয়ংকর অপরাধী হিসেবে রয়েছে।

নদী পেরিয়ে এপারে চলে আসতেই লছমনের মুখোমুখি হলেন মেজর। লছমন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ওদিকে কোথায় গিয়েছিলেন?

খরগোশ ধরতে পারলাম না, পালিয়ে গেল।

যেন স্বস্তির শ্বাস ফেলল লছমন। বলল, ওদিকে যাবেন না সাহেব!

কেন?

পরশু একটা চিতা হরিণ মেরেছে ওখানে। ব্যাটা ওদিকটায় ঘোরাঘুরি করছে।

রাগ হয়ে গেল মেজরের। এই লোকটিকে প্রথম থেকেই তিনি অপছন্দ করছেন। একদম মিথ্যে বলছে লোকটি। চিতা ঘুরলে ওখানে একটা লোক সংসার সাজিয়ে আছে কী করে? তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, লছমন, চিতা আমাকে কিছু বলবে না। ওরা মানুষ চেনে।

.

এ কী! একেবারে স্নান করে এলেন নাকি? দোতলার বারান্দা থেকে অর্জুন চেঁচাল।

সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে মেজর বললেন, মাছ ধরলাম ভানুপ্রসাদের সঙ্গে। দেখেছ?

হ্যাঁ।

সাইজে ছোট কিন্তু খুব মিষ্টি মাছ।

অমল সোম বসে ছিলেন চেয়ারে। বললেন, মেজর ধরেছেন, নাম দাও মাইনর।

মাইনর? নট ব্যাড। সাইজের সঙ্গে নামটা মিলছে। মেজর বারান্দায় উঠে এসে চেয়ার টেনে সে চিৎকার করলেন, ভানুপ্রসাদ। কফি বানাও। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, একটা সন্দেহজনক ব্যাপার দেখে এলাম।

ওঁর মুখের অভিব্যক্তি দেখে হেসে ফেলল অর্জুন, কীরকম?

ওই নদীর ওপারে কেউ লুকিয়ে থাকে। হয়তো আমাকে যেতে দেখে জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল লোকটা। রান্না করে খায়। হাঁড়ি, উনুন দেখে এলাম। সঙ্গে বিছানাও। মেজর বললেন, এখানে ভিখিরিদের আসার কোনও চান্স নেই। মনে হচ্ছে পুলিশের ভয়ে কোনও ক্রিমিনাল ওখানে আশ্রয় নিয়েছে। আর এই ব্যাটা চৌকিদার জানে লোকটাকে।

কেন একথা মনে হচ্ছে আপনার?

ব্যাটা আমাকে বলল ওপারে না যেতে। ওখানে নাকি চিতাবাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে। চিতা ঘুরছে কিন্তু মানুষটাকে কিছু বলছে না? ভাবতে পারো? মি. সোম, আপনি পুলিশের বড়কর্তাদের খবরটা জানিয়ে দিন। মেজর বললেন।

কিন্তু আপনি তো লোকটাকে দ্যাখেননি?

না দেখিনি। তবে একজন যে ওখানে থাকে তাতে কোনও ভুল নেই। যেসব জিনিস ওখানে পড়ে আছে সেগুলোই প্রমাণ করছে।

কিন্তু পুলিশ এসে কাউকে না পেলে আমার উপর বিরক্ত হবে। অমল সোম নির্বিকার মুখে কথাগুলো বললেন।

ঠিক কোন জায়গায় জিনিসগুলোকে দেখতে পেয়েছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

ঠিক ওপারে।

এদিক থেকে দেখলে কি বুনো ঝোঁপের আড়াল পড়বে?

একদম ঠিক। মাথা নাড়লেন মেজর।

অর্জুন চিন্তা করল খানিক। তারপর অমল সোমকে বলল, জায়গাটা একটু দেখে আসি। আমি জলে পাথর ছুঁড়েছিলাম। সেটা জঙ্গলে ঢুকে বোধহয় কাউকে আঘাত করেছিল। একটা যন্ত্রণার শব্দ শুনেছিলাম।

মেজর জিজ্ঞেস করলেন, স্টেফি কোথায়?

ঘরে। ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে।

পাতা খুঁজে পেয়েছে?

কাছাকাছি পাওয়া গিয়েছে। খোঁজাখুঁজি করলে পেয়ে যাব।

নেমে এল অর্জুন। সে ইচ্ছে করেই নদীর দিকে না গিয়ে সামনের গেট খুলে জঙ্গলের এপাশে চলে এল। আড়চোখে তাকিয়ে বুঝতে পারল, লছমন বাংলোর পাশে দাঁড়িয়ে তাকে লক্ষ করছে। মেজর ঠিকই বলেছেন, এই লোকটি সন্দেহজনক। সে বাংলোয় আসা-যাওয়ার পথ ছেড়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ল।

ডুয়ার্সের জঙ্গলের ভিতর একটা চমৎকার গা ছমছমে ব্যাপার আছে। ঝিঁঝির শব্দ, পাখির ডাক, বাঁদরগুলোর উল্লাস মিলেমিশে ছায়া জড়ানো বনের ভিতরটাকে যেন নাটকের মঞ্চ করে তোলে। মনে হয়, যে-কোনও মুহূর্তে নাটক শুরু হবে। একটা মোটা এবং শক্ত ডাল মাটিতে পড়ে আছে দেখে তুলে নিল অর্জুন। তারপর সেটা দিয়ে বুনো ঝোঁপের প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে সরিয়ে এগোতে লাগল। হঠাৎ একটা মিষ্টি গন্ধ নাকে আসতেই সে অবাক হয়ে বকুল গাছটাকে দেখতে পেল। এই জঙ্গলের বড়সড় গাছগুলোর মধ্যে একটা মাঝারি বকুলগাছ একা দাঁড়িয়ে অজস্র ফুল ঝরিয়ে দিয়েছে নীচের মাটিতে। তারই সুগন্ধে চারপাশ ম-ম করছে।

মিনিটদশেক পরে অর্জুনের খেয়াল হল, সে একটাও বিশল্যকরণী গাছ দেখতে পায়নি। এরকম হওয়ার কথা নয়। ডুয়ার্সের জঙ্গলে অযত্নেও বেশ পুরুষ্ট হয়ে ওরা ছড়িয়ে থাকে। তা ছাড়া অমলদার ভুল হওয়ার কথা নয়। হঠাৎ গাড়ির আওয়াজ কানে এল। একাধিক গাড়ি ওপাশের জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে আসছে। নিশ্চয়ই অমল সোমের ফোন পেয়ে ডি এফ ও লোকজন পাঠিয়েছেন। সে দিক পালটে নদীর দিকে হাঁটতে শুরু করতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল। একটা বিরাট পাইথন মাটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছে। মাঝারি আকারের হরিণকে অর্ধেক গিলে ফেললেও মুখটাকে গিলতে পারছে না বড় শিং দুটোর জন্যে। হরিণের মাথা শিং সমেত বাইরে রয়ে গিয়েছে। শিং দুটো এত বড় যে, পাইথনের পক্ষে তা গিলে ফেলা সম্ভব নয়। যতটা সম্ভব মুখের হা বাড়িয়েও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন ধীরে ধীরে লেজটাকে মুখের কাছে নিয়ে এসে তা দিয়ে শিং দুটোর একটাকে জড়িয়ে ধরে চাপ দিতে লাগল সাপটা। মিনিট খানেকের মধ্যে একটা শিং মট করে ভেঙে যেতেই মুখের অর্ধেকটা গিলে ফেলল পাইথন। হরিণের শরীর ওর মুখের ভিতরে আটকে থাকায় সাপটার আক্রমণ করার ক্ষমতা এখন নেই। অবশ্য একই উপায়ে দ্বিতীয় শিং ভেঙে ফেলে আস্ত হরিণটাকে পেটে চালান করে কয়েকদিন নিশ্চিন্তে ঘুমোবে পাইথনটা। অর্জুন একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। এই সময় শুকনো পাতায় শব্দ তুলে দুটো শিয়ালের চেয়ে বড় প্রাণীর উদয় হল। এরা নির্ঘাত নেকড়ে। কয়েক সেকেন্ড সাপটাকে দেখে নিয়ে দুজনে দু’পাশে গিয়ে শরীরের মাঝখানে কামড়ে মাংস ঘেঁড়ার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল শক্তিতে শরীর মোচড়াল পাইথন। দ্রুত লেজ ঝাঁপটে এমন আঘাত করল যে, একটা নেকড়ে দশ হাত দূরে ছিটকে পড়ে আর উঠল না। দ্বিতীয় নেকড়ে প্রাণ বাঁচাতে পড়ি কি মরি করে ছুটল যেদিকে পারে।

অর্জুন আর দাঁড়াল না। লাঠিটাকে নিয়ে ও নদীর অনেকটা উপরে চলে এল। এখানে জল বেশি নয় কিন্তু স্রোত প্রচুর। লাঠি থাকায় নদী পার হওয়া সহজ হল।

নদীকে খানিকটা তফাতে রেখে গাছের আড়ালে আড়ালে নীচের দিকে নামতে লাগল অর্জুন। এপার থেকে বাংলোর ছাদ দেখা যাচ্ছে। রোদ পড়ায় চকচক করছে। মেজর যে জায়গাটার কথা বলেছিলেন, তার কাছাকাছি এসে নিঃশব্দে ডালপালা সরিয়ে সে এগোল। মিনিট তিনেক পরে সে শক্ত হল। মানুষের গলা। বেশ চাপা। সে নিচু হয়ে আর-একটু এগোতেই স্থির হয়ে গেল। বুনো ঝোপে নিশ্চিন্তে ছিল ওটা, মানুষ দেখে সোজা হয়ে ফণা তুলেছে। দূরত্ব এত কম যে, ছোবল মারলেই তার মুখে আঘাত লাগবে। আর মুখে বিষ ঢুকলে মৃত্যু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। অর্জুন নড়ল না। পাথরের মূর্তির মতো সাপের চোখের দিকে তাকিয়ে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। সাপটা দুলছে। ফণাটা এপাশ-ওপাশ করছে। কী সাপ জানার দরকার নেই। কিন্তু ওটা যে বিষধর তাতে কোনও সন্দেহ নেই। লাঠিটা পায়ের পাশে মুঠোয় ধরা। ওটা তুলতে গেলেই ছোবল নেমে আসবে। সাপটা এই মুহূর্তে মনঃস্থির করতে পারছে না।

হঠাৎ ওপাশের মানুষটির গলা চড়ল, তুই এখান থেকে চলে যা। পাহাড় পেরিয়ে ভুটানে ঢুকে যা। আমি বলছি, তুই এখানে থাকিস না!

গলার স্বর সাপটাও শুনতে পেয়েছিল, তাই মুখ ঘুরিয়ে যেদিক থেকে কথাগুলো এসেছিল সেদিকে তাকাল। তারপর ধীরে ধীরে ফণা নামিয়ে বা দিকের জঙ্গলে ঢুকে গেল নিঃশব্দে। কয়েক সেকেন্ড লাগল অর্জুনের ধাতস্থ। হতে। এমন অভিজ্ঞতা তার জীবনে এর আগে হয়নি।

মিনিটদুয়েক পরে কথাবার্তা বন্ধ হয়ে গেল। অর্জুন বুঝতে পারল কেউ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। সে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখতে পেল, লছমন নদী পার হচ্ছে। অর্থাৎ লোকটা কাউকে এখান থেকে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে বাংলোয়। অর্জুন লাঠিটা শক্ত করে ধরে এগোল। শেষ পর্যন্ত জঙ্গলের ডালপালার ফাঁক দিয়ে সে দেখতে পেল, একচিলতে পরিষ্কার জায়গায় পাথরের ভিতর শুকনো ডাল গুঁজে উনুন ধরাবার চেষ্টা করছে একটা লোক। পরনে ময়লা পাজামা আর গেঞ্জি। লোকটা আকাশের দিকে তাকালে বোঝা গেল ওর মুখ দাড়িতে ঢাকা।

ডালপালা সরিয়ে লোকটার পিছনে পৌঁছে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কে?

সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে খানিকটা দূরে গিয়ে একটা ধারালো কাটারি হাতে তুলে নিয়ে নোকটা আক্রমণের ভঙ্গিতে উবু হয়ে বসল।

ওসব করে কোনও লাভ নেই। আমি তোমার শত্রু নই। কে তুমি?

আপনি কে? এখানে কী করে এলেন?

ঘুরতে ঘুরতে চলে এলাম। ওই বাংলোয় বেড়াতে এসেছি।

লোকটা তাকে খুঁটিয়ে দেখল। তারপর বলল, লছমন আপনাদের কথা বলছিল। আমি কে জেনে আপনার কোনও লাভ নেই।

আমার লাভ না থাকলেও তোমার লাভ হতে পারে। অর্জুন হাসল।

মানে?

কাল রাত্রে কয়েকজন লছমনকে শাসিয়ে গিয়েছে। আমার মনে হচ্ছে, ওরা তোমার খোঁজে এসেছিল। একটু চাপ বাড়লেই লছমন তোমাকে ধরিয়ে দেবে।

লোকটা অদ্ভুত চোখে তাকাল। তারপর জিজ্ঞেস করল, সত্যি কথা বলুন তো, আপনি কে?

একটু আগে তো বললাম, এখানে বেড়াতে এসেছি। অর্জুন হাসল, কিন্তু তুমি এভাবে জঙ্গলে লুকিয়ে আছ কেন? থাকার পক্ষে জায়গাটা নিরাপদ নয়। বাঘ, হাতির কথা ছেড়ে দিলাম, চারপাশে মারাত্মক বিষধর সাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটাকে তো ওখানে দেখলাম।

লোকটা মাথা নাড়ল, কিন্তু কোথায় যাব? লছমন বলছে ওই পাহাড়ের ওপারে ভুটানে চলে যেতে। কিন্তু ভুটান তো আরও খারাপ জায়গা। ওখানকার পুলিশ অচেনা লোককে জঙ্গলে দেখলেই মেরে ফেলে। তা ছাড়া খাবারও পাব না। এরকম জঙ্গলে খাওয়া যায় এমন ফল দেখিনি।

খুব খারাপ সমস্যায় পড়েছ হে! তুমি কি পুলিশের ভয়ে এখানে লুকিয়ে আছ?

শুধু পুলিশ? ওরাও আমার মৃত্যু চায়।

কারা?

লোকটা আবার তাকাল, এসব জেনে আপনার কী লাভ? আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।

ঠিক আছে। তুমি যখন নিজের মৃত্যু চাইছ তখন তাই হোক।

মৃত্যু? আমি সেটা কখন চাইলাম?

তা হলে আমি যা বলব তা তুমি শুনবে?

অত্যন্ত অনিচ্ছার সঙ্গে খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে লোকটা বলল, শুনি।

তুমি ওইসব রান্না শেষ করে খেয়েদেয়ে এই জায়গাটা ছেড়ে দেবে। ইচ্ছে করলে নদী বরাবর গিয়ে অনেকটা উঁচুতে ডেরা বাঁধতে পারো। যদি কেউ বা কারা তোমার খোঁজে এখানে আসে, তা হলে তারা না পেয়ে হতাশ হবে। যাওয়ার আগে তুমি থাকার জন্য এখানে যেসব চিহ্ন রয়েছে তা ভাল করে মুছে দিয়ে যাবে। অর্জুন বলল।

এই জঙ্গলের কোথাও গিয়ে স্বস্তি পাব না। কাল রাত্রে যারা লছমনের কাছে এসেছিল তারাও তো জঙ্গলের ওপাশে নজর রাখছে। তারাও তো ওইদিকে আশ্রয় নিয়েছে। এদিকটায় সাপের উপদ্রব বেশি বলে ওরা ভয়ে আসে না। লোকটি বলল।

বুঝলাম। ওরা কাল বাইরে থেকে জঙ্গলে ঢুকে এতটা পথ ভেঙে বাংলোয় আসেনি, ওপাশের জঙ্গল থেকে নদী পেরিয়ে গিয়েছিল! অর্জুন চট করে ভেবে নিল। তারপর বলল, একটা পথ আছে। আমি লছমনকে কিছুক্ষণের জন্যে বাইরে পাঠাব। ওই বাংলোর দোতলার জানলায় দাঁড়িয়ে রুমাল নাড়লেই তুমি সোজা বাংলোয় চলে আসবে। লছমন কখনও দোতলায় ওঠে না। তুমি নিশ্চিন্তে দোতলার ঘরে লুকিয়ে থাকতে পারবে। কিন্তু তুমি কে, কেন এভাবে লুকিয়ে আছ, লছমনের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক, তা আগে পরিষ্কার করে বলতে হবে।

আপনি তো দু’দিনের জন্যে বেড়াতে এসেছেন? যখন চলে যাবেন তখন তো আমি ধরা পড়ে যাব। লছমন তখন আমাকে ছাড়বে?।

আমরা তো কালই এখান থেকে চলে যাচ্ছি না। তেমন হলে তুমি আমাদের সঙ্গে এই জঙ্গল থেকে বেরিয়ে যাবে। কেউ তোমার ক্ষতি করতে পারবে না। বিকেল চারটের সময় বাংলোর দিকে লক্ষ রেখো।

আমি কী যে করি! আপনাকে ভালমানুষ বলে মনে হচ্ছে। ঠিক আছে। আমার নাম বাদল রায়। লছমন আর আমার মধ্যে বিশ বছরের উপর জানাশোনা। জেলে আলাপ। দু’জনেই চুরির দায়ে জেল খেটেছিলাম। ওই। জেলেই কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ছিল। লছমন তাদের পছন্দ করত না, এড়িয়ে যেত। কিন্তু আমার খুব ভাল লাগত। ওদের কাছ থেকে অনেক নতুন কথা জানলাম। ওরা চায় দেশে কোনও গরিব বা বড়লোক থাকবে না। সবাই সমান হবে। কারও জমি আছে কারও জমি নেই, এটা চলবে না। এসব কথা বলেছে বলে সরকার ওদের ধরে জেলে ঢুকিয়েছে। জেল থেকে বেরিয়েই ওরা আবার আন্দোলন শুরু করবে। আমাকেও ওরা বলল, ওদের সঙ্গে হাত মেলাতে! জেল থেকে বেরিয়ে আমি ওদের সঙ্গে যোগাযোগ করতেই ওরা দলে টেনে নিল। জানতে পারলাম, বড়লোকদের সঙ্গে লড়াই করতে প্রচুর অস্ত্র দরকার। দাম দিলেই সেগুলো পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই টাকা তো কেউ এমনি এমনি দেবে না। আমরা ছোট ছোট জোতদার, ব্যবসায়ীকে ধরে জঙ্গলে নিয়ে গিয়ে তাদের আত্মীয়স্বজনদের উপর চাপ দিয়ে টাকা আদায় করতাম। দু-তিনটে খুনও করতে হয়েছিল। তবে আমি করিনি। আমাদের কেউ সাপের কামড়ে বা হাতির পায়ের চাপে মারা গেলে তাকে মাটিতে পুঁতে ফেলা হত, কিন্তু তার বাড়িতে কোনও খবর দেওয়া হত না। মনে হত, আমি মরে গেলে আমার আত্মীয়রা কোনও খবর পাবে না। আমি ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছে না বলতেই ওদের চোখে খারাপ হয়ে গেলাম। আমাকে আর অ্যাকশনে নিয়ে যেত না ওরা। ক্যাম্পে রান্নার কাজ দিয়ে বসিয়ে রাখত। ওরা আমাকে সন্দেহ করত। এক রাত্রে ওরা জয়ন্তীতে বেড়াতে আসা বিরাট এক ব্যবসায়ীকে তুলে নিয়ে এল জঙ্গলে। এককোটি টাকা দিলে তাকে ছেড়ে দেবে। আমাদের ক্যাম্প ছিল ওই ভুটান পাহাড়ে। লোকটির আত্মীয়রা টাকার। পরিমাণ নিয়ে যখন দরাদরি করছে, তখন ভুটানি পুলিশ আমাদের ক্যাম্পে হানা দিল। বন্দি লোকটিকে ফেলে ওরা যখন পালিয়ে গেল, তখন আমি ওকে সাহায্য করলাম। তখন লোকটি ওদের কাছে বোঝার মতো। তাই প্রমাণ মুছে। ফেলতে ওকে মেরে ফেলতে বলেছিল আমাকে। কিন্তু লোকটা তো নির্দোষ। কেন মারব? আমার কথা শুনে লোকটি ভুটানি পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে প্রাণে বেঁচে গেল। তাতে খেপে গেল ওরা আমার উপর। আমাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল। আমি কোনওমতে পালিয়ে এখানে চলে এলাম। একদিন লছমনের কাছে ছিলাম। সব শুনে লছমন আমাকে ওর কাছে রাখতে সাহস পেল না। রোজ চাল, ডাল, আলু দিয়ে যায়, তাই ফুটিয়ে খেয়ে বেঁচে আছি আমি। কিন্তু এভাবে আর থাকতে পারছি না। লোকটা দু’হাতে মুখ ঢাকল।

অর্জুন চুপচাপ শুনছিল। বলল, তুমি বিকেলে নজর রাখবে। আমি রুমাল নাড়লে চলে আসবে। তুমি কোনও মানুষ খুন করোনি তো?

না। একজন মানুষকে বাঁচিয়েছি বলে আমার এই অবস্থা।

ঠিক আছে। সাবধানে থেকো।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress