অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে
অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামছে। ক্ষীণ একটা আলোর রেখা এসে পড়ল। পায়ের আওয়াজ শুনে মনে হচ্ছে, একজন নয়, অনেকে আসূছে। রিঙ্কু একেবারে কোণের দিকে সরে গিয়ে দাঁড়াল।
ঘরটা যে মাটির নীচে তা রিঙ্কু আগেই বুঝতে পেরেছিল। মোটা পাথরের দেওয়াল, কোনওদিক দিয়েই আলো আসে না। দেওয়ালগুলো স্যাতসেঁতে, তার ওপর জমে আছে পুরু শ্যাওলা।
রাজধানী বিজয়নগরে এরকম গুপ্তকক্ষ থাকা অস্বাভাবিক কিছু না। এটা কী ছিল বন্দিশালা? সিঁড়িটাও রিঙ্কু আগেই খুঁজে পেয়েছিল, ওপর পর্যন্ত উঠে দেখে ৪২০
এসেছে, একটা শক্ত দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। খুব লম্বা সিঁড়ি, প্রায় তিনতলা পর্যন্ত উঁচু মনে হয়।
একটা বিচ্ছিরি শরবত খেয়ে এই কাণ্ড হয়ে গেল!
রিঙ্কু খেতে চায়নি, তাকে জোর করে খানিকটা খাওয়ানো হয়েছে। চোখের সামনে সে দেখল, জোজো আর সন্তু অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল মাটিতে। রঞ্জন চিৎকার করে বলেছিল, এদের কী হল? বিষ খাইয়েছে? আমায় জব্দ করতে পারবে না, আমি সব হজম করে ফেলব! হাতের গেলাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রঞ্জন ছুটে গিয়ে তুলে নিয়েছিল একটা তলোয়ার। সন্তু আর জোজোর মাথার কাছে দাঁড়িয়ে সে বলেছিল, খবদার, এদের গায়ে হাত ছোঁয়াতে পারবে না!
বিরজু সিং বিকটভাবে হেসে উঠেছিল হা-হা করে!
রঞ্জন তলোয়ারটা হাতে ধরে রাখতে পারল না। প্রথমে সে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল, তারপর তার কপালটা ঠুকে গেল মেঝেতে। রঞ্জনও জ্ঞান হারিয়েছে।
রিঙ্কু বুঝতে পেরেছিল, রঞ্জনদের সাহায্য করার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। তারও ঘুম-ঘুম পাচ্ছে, আঙুলের ডগাগুলো অবশ হয়ে আসছে। শরবতের মধ্যে ওরা কী মিশিয়েছে, বিষ না কড়া ধরনের ঘুমের ওষুধ?
রিঙ্কু তখনও চোখ চেয়ে আছে দেখে বিরজু সিং বলেছিল, চিল্লামিল্লি কোরো না। কোনও লাভ হবে না!
রিঙ্কু জিজ্ঞেস করেছিল, তোমরা আমাদের মেরে ফেলবে? কেন? আমরা তোমাদের কী ক্ষতি করেছি?
এর উত্তরে বিরজু সিং আবার হেসেছিল।
দুটি মেয়ে এরপর এসে রিঙ্কুকে টানতে টানতে নিয়ে গেল, তখনও রিঙ্কুর জ্ঞান আছে, কিন্তু বাধা দেবার শক্তি নেই। তারা এক জায়গায় তাকে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়েছে, তাও রিঙ্কু টের পেয়েছে। তারপর একটা ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গায় তাকে রেখে ওরা চলে গেল, একটু পরে রিঙ্কু ঘুমিয়ে পড়ল।
কতক্ষণ সে ঘুমিয়েছে তা জানে না। এখন দিন না রাত তাও বোঝার উপায় নেই।
আবার ওরা আসছে।
রিঙ্কু প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইল। সিঁড়ির মুখটা থেকে অনেকটা দূরে। প্রথমে দুটো টর্চ হাতে নিয়ে নামল দুজন, পেছনে আরও কেউ আসছে। ওদের টর্চের আলো ঘুরে-ঘুরে এসে রিঙ্কুর মুখের ওপর পড়ল। রিঙ্কু ওদের দেখতে পাচ্ছে না।
এরপরে হাতে মোমবাতি নিয়ে নেমে এল আর-একটি মেয়ে, তার অন্য হাতে একটা খাবারের থালা। এবারে দেখা গেল, টর্চ হাতে দুজনের মধ্যে একজন মেয়ে, একজন পুরুষ।
টর্চ হাতে মেয়েটি রিঙ্কুর দিকে এগিয়ে এসে তাকে ভাল করে দেখল। খুব যেন অবাক হয়ে গেছে। রিঙ্কুর চোখের ওপর টর্চ ফেলে সে বলল, ভেরি স্ট্রেঞ্জ! এত সিমিলিয়ারিটি! তোমার কোনও যমজ বোন আছে?
চোখ বুজে ফেলে রিঙ্কু বলল, না!
পুরুষটি জিজ্ঞেস করল, কাম চলে গা?
মেয়েটি বলল, বহুত আচ্ছা চলে গা! না বলে দিলে কেউ বুঝতেই পারবে যে, এ অন্য মেয়ে।
পুরুষটি বলল, এ কি সব ঠিকঠাক পারবে?
মেয়েটি বলল, না পারার কী আছে? কাঁদতে তো পারবে। সব মেয়েই কাঁদতে জানে। বাকিটা আমি শিখিয়ে দেব।
পুরুষটি বলল, তব তত ঠিক হ্যায়। জানকী, ইনকো খানা খিলাও! কাপড়া বদল কর দেও। যাস্তি টাইম নেহি হ্যায়।
মেয়েটি রিঙ্কুর কাঁধ চাপড়ে বলল, ডয়ো মত। সব ঠিক হয়ে যাবে!
টর্চ-হাতে মেয়েটি ও পুরুষটি ওপরে উঠে গেল, রইল শুধু মোম-হাতে মেয়েটি। সে প্রায় রিঙ্কুরই সমবয়েসী। হাতের থালাটা মাটিতে নামিয়ে রেখে সে নরম গলায় ডাকল, আও বহিন, খানা খা লেও!
রিঙ্কু সাড়া দিল না। সে মোটেই ওই খাবার মুখে তুলবে না। একবার ওদের শরবত খেয়েই যা অবস্থা হয়েছে, তারপর আর কেউ ওদের খাবার খেতে যাবে!
মেয়েটি কাছে এসে রিঙ্কুর হাত ধরে বলল, খাবার খেয়ে নাও, তোমার খিদে পায়নি?
রিঙ্কু হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, না, আমি খাব না!
মেয়েটি হেসে বলল, না খেয়ে কতক্ষণ থাকবে? দুর্বল হয়ে যাবে যে। সারা রাত জেগে কাজ করতে হবে, তা কি পারবে?
মেয়েটির গলায় খানিকটা সহানুভূতির সুর পেয়ে রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল, কাজ মানে? আমায় কী কাজ করতে হবে?
মেয়েটি হাসতে হাসতে দুলে দুলে বলল, তুমি ফিমে চান্স পেয়ে গেছ। ফিল্মে পার্ট করবে। এক ঘন্টা পরেই শুটিং!
রিঙ্কু চোখ-মুখ ঘুরিয়ে বলল, ফিল্মে পার্ট করব? বললেই হল? মোটেই আমি পার্ট করব না। সেইজন্য ওরা এখানে আমাকে আটকে রেখেছে?
মেয়েটি আবার রিঙ্কুর হাত ধরে বলল, এসো বহিন, খেতে বসে যাও। খেতে-খেতে কথা হবে। আমার নাম জানকী। তুমি আমাকে জানকী বলে ডেকো।
রিঙ্কু বলল, বলছি তো, ওই খাবার আমি খাব না। যদি ওতে বিষ মেশানো থাকে?
জানকী অবাক হয়ে বলল, বিষ! কেন, খাবারে বিষ থাকবে কেন? ঠিক আছে, এর থেকে একটা আমি মুখে দিচ্ছি, তা হলে তোমার বিশ্বাস হবে তো!
প্লেটটাতে একগোছা লুচি আর আলুর দম রয়েছে। মেয়েটি একখানা লুচি নিয়ে, একটু আলুর দম মুখে পুরল। রিঙ্কু আগে দেখে নিল, সে সবটা খায় কি না! খাবার দেখে তার খিদে পেয়ে গেছে ঠিকই। কতক্ষণ সে খায়নি কে জানে।
এবার সে খেতে শুরু করে দিল।
জানকী বলল, তোমাকে দেখতে ঠিক সুজাতাকুমারীর মতন। সেইরকম মুখ, সেইরকম হাইট, সেইরকম ফিগার। সুজাতাকুমারীর এই ফিল্মে বড় পার্ট আছে, হিরোইনের পরেই সে। কিন্তু তার অসুখ হয়ে গেছে। শুটিং তো বন্ধ রাখা যায় না। তোমাকে দিয়ে কাজ চলে যাবে!
রিঙ্কু বলল, আমি রাজি আছি কি নেই তা না জিজ্ঞেস করেই আমাকে দিয়ে পার্ট করাবে? বললেই হল! আমার সঙ্গে অন্য যারা ছিল, তারা কোথায়?
জানকী বলল, তোমার সঙ্গে আর কে ছিল?
রিঙ্কু বলল, আমার সঙ্গে আরও তিনজন ছিল। তাদের ওরা অজ্ঞান করে রেখেছে। তা ছাড়া কাকাবাবু ছিলেন, তিনি ক্রাচ নিয়ে হাঁটেন।
জানকী রীতিমত অবাক হয়ে বলল, তাদের তো আমি দেখিনি, বহিন। আমি অন্যদের কথা কিছু জানি না।
রিঙ্কু ধমক দিয়ে বলল, জানো না মানে? তুমিও তো এদেরই দলের!
ধমক খেয়ে কাচুমাচুভাবে জানকী বলল, বিশ্বাস করো বহিন, আমি কিছুই জানি না। আমার কাজ ফিমেল আর্টিস্টদের মেক-আপ করা। আমি তোমাকে সাজিয়ে দিতে এসেছি। আমাকে কস্তুরীজি বললেন, এই মেয়েটার দিমাগের ঠিক নেই। একটু পাগল আছে। তুই ওকে সাজিয়ে দিবি ভাল করে, তারপর ওর কাছে বসে থাকবি!
রিঙ্কু জিজ্ঞেস করল, কস্তুরী কে?
জানকী বলল, কস্তুরীজিকে চেনো না? তিনিই তো এই ফিল্মের হিরোইন। ওই যে একটু আগে টর্চ হাতে এসেছিলেন।
রিঙ্কু ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ও হিরোইন না ভিলেন? ডাকাত দলের সদারনির মতন চেহারা। ও আমাকে পাগল বলে, এত সাহস!
জানকী বলল, না, না তুমি পাগল কেন হবে! ও ঠাট্টা করে বলেছে। তুমি ওর জন্য ফিল্মে চান্স পেয়ে গেলে। যদি ভাল পার্ট করো, তা হলে তোমার কত নাম হবে। অনেক টাকা হবে। তাড়াতাড়ি খাবার খেয়ে নাও, তারপর তোমাকে সাজিয়ে দিতে হবে। এই দ্যাখো, কস্তুরীজি তোমার জন্য কত ভাল শাড়ি রেখে গেছেন।
এক পাশে একটা পুঁটলি পড়ে আছে, রিঙ্কু আগে দ্যাখেনি।
জানকী সেটা খুলল। তার মধ্যে রয়েছে নানারকম জরি বসানো একটা ঝকঝকে শাড়ি, ওড়না, একজোড়া ভেলভেটের চটি এইসব। আর-একটা ছোট বাক্সে ক্রিম, পাউডার, লিপস্টিক, কাজল ও কয়েকটা তুলি।
জানকী বলল, হিস্টোরিক্যাল বই তো, সেইজন্য তোমাকে বেশি সাজগোেজ করতে হবে।
খাওয়া শেষ করে রিঙ্কু বলল, জল? জল নেই?
জানকী বলল, ওঃ হো, পানি আনা হয়নি। আচ্ছা, একটু বাদেই নিয়ে আসছি। তার আগে দ্যাখো তো, এই কাঞ্জিভরম শাড়িটা তোমার পছন্দ। হয়েছে?
রিঙ্কু নিজের শাড়ির আঁচলেই হাতটা মুছে নিল। তারপর ওড়নাটা তুলে নিয়ে ভাল করে দেখার ভান করে হঠাৎ সেটা জানকীর গলায় দিয়ে টেনেই একটা ফাঁস বেঁধে দিল।
ভয়ে জানকীর চোখ কপালে উঠে গেল, সে আঁ-আঁ করতে লাগল।
রিঙ্কু ফাঁসটা আর-একটু টেনে বলল, চ্যাঁচাবার চেষ্টা করলেই একদম দম বন্ধ করে মেরে ফেলব! তুমি এই ডাকাতদের দলে থাকো, আবার বলছ, তুমি কিছু জানো না? আমার সামনে ভালমানুষ সাজছ? জোর করে কাউকে বন্দী করে রেখে, তারপর তাকে দিয়ে সিনেমার পার্ট করানো যায়? চালাকি আমার সঙ্গে?
শাড়িখানার একদিক দিয়ে সে আগে জানকীর হাত দুখানা পেছনে নিয়ে গিয়ে বাঁধল শক্ত করে, তারপর অন্য দিক দিয়ে বাঁধল পা। এবার গলা থেকে ওড়নার ফাঁসটা খুলে নিয়ে সে জানকীর মুখ বেঁধে দিল। জানকীর আর কথা বলার কিংবা নড়াচড়ার ক্ষমতা রইল না।
জানকী মেয়েটা বোধহয় সত্যিই নিরীহ, সে এমনই ভয় পেয়ে গেছে যে, খুব একটা বাধা দেবার চেষ্টাও করেনি।
রিঙ্কু গিটগুলো পরীক্ষা করে দেখল, জানকী নিজে থেকে বাঁধন খুলতে পারবে না, চাচাতেও পারবে না।
এবারে রিঙ্কু একটু নরম হয়ে বলল, তুমি অবশ্য আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার কিছু করোনি। কিন্তু তুমিই ভেবে দ্যাখো, আমার সঙ্গে যে আরও চারজন ছিল, তারা কোথায় গেছে আমি জানি না। তিনজনকে আমি অজ্ঞান হয়ে যেতে দেখেছি, এরা বিষ খাইয়েছে। এই অবস্থায় আমি এদের সিনেমায় পার্ট করতে পারি? আগে তাদের খুঁজে দেখতে হবে।
জানকীর চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে এল!
রিঙ্কু বলল, কাঁদলে কী হবে, তবু তোমাকে আমি ছাড়ছি না। আমার অবস্থাটা একটু ভেবে দ্যাখো, আমাকে তো পালাতেই হবে। এইরকম অবস্থায় খানিকক্ষণ থাকলে তোমার কোনও ক্ষতি হবে না। কেউ-না-কেউ খানিক বাদে খুঁজতে এসে তোমাকে খুলে দেবে। কিংবা কাকাবাবুদের আমি যদি পেয়ে যাই, তা হলে আমিই এসে তোমাকে ছেড়ে দেব, কেমন?
আঁচল দিয়ে জানকীর চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে রিঙ্কু বলল, লক্ষ্মী মেয়ের মতন বসে থাকো, আমি চলি?
সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে উঠে এল রিঙ্কু। কিন্তু ওপরের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ!
সেই কস্তুরী জানকীকে শুদ্ধ এখানে বন্ধ করে রেখে গেছে? তা হলে উপায়!
রিঙ্কর একটা কথা মনে পড়ে গেল। জানকী জল আনবে বলেছিল। তা হলে কি বাইরে কোনও পাহারাদার আছে? রিঙ্কু দরজায় তিনটে টোকা দিল। হয়তো এদের কিছু সঙ্কেত আছে, সেটা কী কে জানে। সে আরও কয়েকবার টকটক করল দরজায়।
এবার দরজাটা খুলে গেল। একজন বন্দুকধারী লোক উঁকি মেরে বলল, কেয়া হুয়া?
রিঙ্কু মুখটা একপাশে ফিরিয়ে বলল, উ লেড়কি পানি মাস্তা। থোড়া পানি লে আইয়ে!
পাহারাদারটি অবহেলার সঙ্গে বলল, আমি কোথায় পানি পাব? আমি যাব না। আমাকে এখানে থাকতে বলেছে।
বাইরে প্রায় ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। বিষ্ণু চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে আবার বলল, তা হলে আপনি দরজা বন্ধ করে দিন। আমি জল নিয়ে আসছি। দেখবেন, যেন মেয়েটা বেরিয়ে না আসে। তা হলে কস্তুরীজি খুব রাগ করবেন!
আঁচলটা মাথায় দিয়েছে রিঙ্কু, তা দিয়ে মুখের একপাশটা ঢেকে সে বেরিয়ে পড়ল। পাহারাদারটি কোনও সন্দেহ করল না। তরতর করে হেঁটে রিঙ্কু মিলিয়ে গেল অন্ধকারে।
সেই অন্ধকারের মধ্যে হোঁচট খেতে-খেতে রিঙ্কু দৌড়ল। সে কোন্ দিকে যাচ্ছে জানে না। তার শুধু একটাই চিন্তা, যে-জায়গাটায় সে বন্দী ছিল, সেখান থেকে যতদূর সম্ভব দূরে চলে যেতে হবে। সে জল নিয়ে ফিরে না গেলেই খটকা লাগবে পাহারাদারটির মনে।
খানিকটা দূর যাবার পর রিঙ্কু দেখতে পেল মশালের আলো। সেই আলো ঘিরে ছায়ামূর্তির মতন জনাচারেক লোক বসে আছে। রিঙ্কু এবার খুব সাবধানে পা টিপেটিপে এগোতে লাগল। ওই লোকগুলো কারা আগে দেখতে হবে!
একটা তাঁবুর দড়িতে পা লেগে রিঙ্কু হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল আর-একটু হলে। তাঁবুটার মধ্যেও একটা লণ্ঠন জ্বলছে। রিঙ্কু তাঁবুটার পেছন দিকে চলে গিয়ে একটা ফাঁক দিয়ে চোখ লাগিয়ে দেখল। তাঁবুটা খালি। যতদূর মনে হচ্ছে, এই তাঁবুর মধ্যেই তাদের শরবত খাইয়ে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়েছিল। রঞ্জন-সন্তু-জোজোরা এখানে এখন নেই।
তাঁবুটা পার হয়ে আরও কিছুটা যাবার পর রিঙ্কু দেখল, মশালের আলো ঘিরে যারা বসে আছে, তারা পুলিশ। গোল হয়ে বসে তারা কিছু খাচ্ছে।
এবার রিঙ্কুর সব দুশ্চিন্তা চলে গেল। পুলিশদের যখন পাওয়া গেছে, তখন আর কোনও ভয় নেই। পুলিশের সাহায্য না পেলে সে একা-একা কী করে অন্য সবাইকে খুঁজে বার করবে?
রিঙ্কু একেবারে কাছে গিয়ে বলল, নমস্তে! আমি খুব বিপদে পড়েছি। আপনাদের সাহায্য চাই।
পুলিশরা খাওয়া থামিয়ে অবাক হয়ে তাকাল। রিঙ্কু বলল, এরা সব ডাকাত! এরা আমার সঙ্গের অন্য লোজনদের বন্দী করে রেখেছে!
একজন পুলিশ বলল,ডাকু? ইয়ে লোগ তো ফিল্ম ইউনিট হ্যায়?
আর-একজন পুলিশ বলল, এদের ফিল্মের গল্পটা বোধহয় ডাকাতদের নিয়ে। অনেক লড়াই আর গোলাগুলি!
অন্য একজন পুলিশ বলল, না, না, হিস্টোরিক্যাল। বিজয়নগরকা কাহানী!
রিঙ্কু ব্যাকুলভাবে বলল, আপনারা বুঝতে পারছেন না? এরা ফিল্মের লোকের ছদ্মবেশে ডাকাত। এরা আমাদের বিষ-মেশানো শরবত খেতে দিয়েছিল!
একজন পুলিশ তার থালার পাশ থেকে একটা গেলাস তুলে নিয়ে বলল, বিষ মেশানো শরবত? এই তো আমরা শরবত খাচ্ছি। বিষ-টিষ তো কিছু নেই।
সে ঢকঢক করে শেষ করে ফেলল গেলাসের বাকি শরবতটা!
পেছনে একটা ঘোড়ার খুরের খটাখট শব্দ শোনা গেল। একজন পুলিশ চেঁচিয়ে বলল, মোহন সিংজি! ও সিংজি, ইধার আইয়ে!
রিঙ্কু আরও এগিয়ে এসে বলল, আপনারা বুঝতে পারছেন না। আমাকে শিগগিরই থানায় নিয়ে চলুন।
একজন পুলিশ ধমক দিয়ে বলল, আপ চুপসে ইধার খাড়া রহিয়ে।
রিঙ্কু সামনে তাকিয়ে দেখল, বড় গেটটার বাইরে রয়েছে একটা গাড়ি। রঞ্জনের গাড়ি সে দেখেই চিনল। এই পথ দিয়েই ওরা ভেতরে এসেছিল। ঘোড়ার খুরের শব্দটা খুব কাছে এসে গেছে।
রিঙ্কু খুব জোরে সামনের দিকে দৌড়তেই দুজন পুলিশ লাফিয়ে উঠে তাকে ধরে ফেলল। রিঙ্কু তাদের একজনের হাত কামড়ে দেবার চেষ্টা করেও নিজেকে ছাড়াতে পারল না।
ঘোড়া হাঁকিয়ে যে এল, সে মোহন সিং নয়, সে ফিল্মের নায়িকা কস্তুরী।
তার এক হাতে একটা চাবুক।
একজন পুলিশ গদগদ হয়ে বলল, কস্তুরীদেবী! আইয়ে আইয়ে! দেখিয়ে ইয়ে লেড়কি কী সব উলটোপালটা বলছে!
কস্তুরী অবাক হবার ভান করে বলল, এ তো সেই পাগলিটা। আবার পালাবার চেষ্টা করছিল! কী মুশকিল হয়েছে জানেন, একে পাগলির পার্ট দেওয়া হয়েছিল, তাতে এ সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে গেছে।
সবকটি পুলিশ একসঙ্গে হেসে উঠল। কস্তুরী বলল, শিগগির এর হাত বাঁধুন, মুখ বাঁধুন। না হলে এ কামড়ে দিতে পারে।
একজন পুলিশ বলল, আমাকে তো কামড়ে দিয়েছে একবার। ওরে বাপরে, এমন পাগল!
কস্তুরী শপাং করে চাবুকটা রিঙ্কুর মুখের সামনে ঘুরিয়ে বলল, এই লেড়কি! আবার যদি গণ্ডগোল করবি তো চাবকে তোর পিঠের চামড়া তুলে দেব।
রিঙ্কু তবু তেজের সঙ্গে বলল, তোমরা আমার সঙ্গের লোকজনদের আটকে রেখেছ কেন? তারা কোথায়? তুমি ভেবেছ, তোমাদের ফিল্মে আমি পার্ট করব? মোটেই না! কিছুতেই না!
রিঙ্কু আর কিছু বলতে পারল না। একজন পুলিশ তার মুখ চেপে ধরে পাগড়ি দিয়ে বেঁধে দিল, আর-একজন পুলিশ শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল তার হাত।
কস্তুরী ঘোড়া থেকে নেমে সেই দড়ির অন্য দিকটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেল রিঙ্কুকে।